সম্পত্তি

সম্পত্তি 

স্বরূপ মণ্ডল বলিল, আদালত-আদালত একালের একটা বাই হয়েছে দাদাঠাকুর এগুনে, মানে আমাদের সময়ে এসব ছেল না। তার আগেও ছেল না। দুজ্জোধন যখন বললেন —’ছুঁচের ডগায় যতটুকু মাটি ওঠে ততটুকু পর্যন্ত দোব না,’ কই, এঁরা পাঁচ ভাইয়ে তো কৌঁসুলি ডেকে আদালতে গিয়ে উঠলেন না!—মোট কথা মকদ্দমা করলেই যে সম্পত্তি-জ্ঞানটা খুব টল্টনে হল—এ কথা মানব না, দাদাঠাকুর। ওটা হল ট্যাকার গরমাই। শুনছেন তো— ঢোলের আওয়াজটা।—ট্যাকা আছে, কলকেতা থেকে কৌসুলি আনিয়ে মকদ্দমা জিতে দত্তরা লবীনের বাগানের ওপর দাঁড়িয়ে নিলেমের ট্যাডরা পিটোচ্ছে। ট্যাকার গরমাই, একে সম্পত্তিজ্ঞান বলব না। 

স্বরূপ আবার খানিকক্ষণ একমনে বাঁশের বাতাটা চাঁচিল, তাহার পর হাত থামাইয়া বলিল, কেমন করে বলব কন না, আমরা যে অন্যরকম দেখেছি কিনা! বেশি দূরের কথা নয়, এই তিনটে গেরাম পেরিয়েই বাতাসপুরে। বেশি দিনের কথাও নয় এমন, কতই বা আমার বয়েস হবে ত্যাখন? ধরুন দশ— জোর, বারো। যদি মনে করেন, স্বরূপ মিছে বলছে তো পাশের গেরামে গিয়ে খোঁজ নিলেই হবে, বাঞ্ছারামের নাতি-নাতকুড়েরা এখনও বাতাসপুরের ছ-আনিদের দেওয়া নাখরাজ রাজার হালে ভোগ করে যাচ্ছে। 

—বাতাসপুরের ছ-আনি তরফের কত্তা ত্যাখন উমেশ পাল। সবে কিছুদিন আগে সম্পত্তি ভাগ হয়েছে—দশ-আনি আর ছ-আনি এই দু-তরফের মধ্যে খুব রেষারেষি। ভৈরব পাল যদি উত্তর দিকে যায় তো উমেশ পাল যাবে দক্ষিণ দিকে। উমেশ পাল মায়ের সেরাদ্দে সাতখানা গেরাম বলে খব ধূমধাম করলে; ভৈরব পালের সেরাদ্দ করবার জন্যে না ছেল মা, না ছেল মাসি, না ছেল খুড়ি; মেয়ের এক দূর-সম্পক্যের জ্যেঠশাশুড়ি কোথায় পড়ে ভুগছিল, তাকে দেশে নিয়ে এসে ঘটা করে গঙ্গাযাত্রা করালে—তারপর সেরাদ্দ যা করলে তাতে উমেশ পালের মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিলে একেবারে।…উমেশ পালের হাতে তখনও এক খুড়ি রয়েছে—বিধবা। কে জানে ভাসুরপো যেমন খেপে আছে রেষারেষির মাথায় কখন কী ঘটিয়ে বসবে—এই ভয়ে তিনি রাতারাতি একদিন সরে পড়লেন। ভাবটা—আমার ঘটা করে সেরাদ্দর কাজ নেই বাপু, কোনওরকমে দুটো দিন বাঁচি আগে। দশ বছর পরে সেতুবন্ধ তীর্থ থেকে তাঁর মৃত্যুর খবর যেদিনকে পাওয়া গেল, উমেশ পাল তিলকাঞ্চন করে গোনাগুনতি বারোটি বামুন খাইয়ে দায় খালাস হল। দোষ দেবেন কী করে দাদাঠাকুর? খুড়ির ব্যাভারটা তো ভালো হল না। 

—এইরকম কাণ্ড,—পুজো বলো, পাবন বলো, অতিথি বলো, কুটুম বলো—সব নিয়েই রেষারেষি,—এমন রেষারেষি যে, সমস্ত গেরামটা অষ্টপহর সরগরম হয়ে আছে। সমস্ত তল্লাটটায় পালেদের ঝগড়া নিয়ে একটা ডাক পড়ে গেল। এই সময় বাঞ্চারাম হঠাৎ কেমন করে একদিন ধরা পড়ে গেল। 

—বাঞ্ছারাম যেমন সিঁদও কাটত তেমনি আবার সুবিধে পেলে দিনমানেই গেরস্তর থালাটা, বাটিটা, কাপড়টা, গামছাটা, বেমালুম পাচার করে দিত। খুব হাতসাফাই ছেল, কিন্তু বিধেতাপুরুষ যখন মুখ তুলে চান, তখন হাত-সাফাইয়ে আর কী করবে বলুন দাদাঠাকুর? ধরা পড়ে গেল। 

আমি কতকটা বিস্মিতভাবেই প্রশ্ন করিলাম, অথচ বলছ—বিধাতাপুরুষ মুখ তুলে চাইলেন? 

স্বরূপ হাত থামাইয়া একটু মৃদুহাস্যের সহিত আমার পানে চাহিল, বলিল, ধৈর্য ধরে সবটা শুনতে হবে দাদাঠাকুর। যদি দেখেন স্বরূপ মণ্ডল ভুল বলেছে, যেমন অভিরুচি সাজা দেবেন। ত্যাতক্ষণ একটু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।…হ্যাঁ, কী যে বলছিলুম—বাঞ্ছারাম আর সেবারটায় পারলে না চোখে ধুলো দিতে, ধরা পড়ে গেল।—বাতাসপুরের দশ-আনি তরফের বাড়ি দুটো পাশাপাশি; মাঝখানে কুল্যে একটা পুষ্করিণী। ভাগাভাগিতে দশ-আনি তরফের ভৈরব পাল পেল বসত-বাড়িটা, তারপরেই পুষ্করিণীটা, তারপরে কাছারি-বাড়ি। উমেশ পালের ভাগে পড়ল কাছারি—বাড়িটা। সেইটেকেই লম্বা দেয়াল দিয়ে ঘেরে-ঘুরে, দোতলার ওপর আর একতলা উঠিয়ে উমেশ পাল যে বাড়ি হাঁকড়ালে, তার সামনে দশ-আনিদের বাস্তু কানা হয়ে গেল। ছোট তো হতে পারে না জ্ঞাতির কাছে?—তখন ভৈরব পালও আবার দোতলার ওপর আর একতলা চাপাতে শুরু করে দিলে। মানে, খুন চেপে গেল আর কী দু-তরফের মাথায়। এ যদি বলে—আমার বাড়ি দোতলা, তো ও বলে—আমি তেতলা তুললুম। ওর যদি তেতলা শেষ হল তো ও বলে—আমি চারতলা তুলব। এর চারতলা তো ওর পাঁচতলা, ওর পাঁচতলা তো এর ছয়, এ যদি বলে—আমার ছয়, তো— 

স্বরূপ কাটারিসুদ্ধ হাতটা এক-এক তলার অনুপাতে ধাপে ধাপে তুলিতেছিল। সাতের কাছে যখন আসিল, আমি তাহার হাতের পানে বিমূঢ়ভাবে চাহিতে হাতটা নামাইয়া বলিল, না, সাততলা পর্যন্ত উঠতে পেলে আর কই? ভৈরব পালের তেতলা শেষ হয়ে চিলেকোঠা উঠছে, এমন সময় কোথা দিয়ে কী হল, — সমস্ত চিলেকোঠাটা, তেতলার খানিকটা, দোতলার খানিকটা, মায় পুরোনো একতলারও কোণের দিকটা নিয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল। ভৈরব পাল একটা ছুতো-নতে করে উমেশ পালের সঙ্গে ঠিক একটা দাঙ্গা বাধিয়ে দিত, কিন্তু 

আমি আবার বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিলাম, এতে উমেশ পালের দোষটা হল কোথায়, বুঝছি না তো স্বরূপ? 

স্বরূপ মৃদু হাসিয়া বলিল, দোষ, মকদ্দমা, সালিসি—এসব হল আপনাদের একালের কথা দাদাঠাকুর, সেকালে এসব তো ছেল না।—তুমি কোট্ করে একতলার ওপর দোতলা চাপাতে গেলে বলেই তো আমার এই ক্ষতি আর অপমান হল—সেকালের লোকেরা কথাটা এইরকম সোজাসুজি ভাবেই ধরত কিনা।…নির্ঘাৎ একটা হাঙ্গামা বেঁধে যেত এক-আধ দিনের মধ্যে। কিন্তু উমেশ পালের গুরুঠাকুর ব্যাপারটা সামলে দিলে। তিনি পুকুরে চান-আন্নিকটুকু সেরে গামছাটি মাথায় পাট করে দশ-আনিদের শুনিয়ে শুনিয়ে মন্তর আওড়াতে আওড়াতে ওই পথ দিয়ে বাড়ি সেঁদুচ্ছেল, আদ্দেকগুলি ইঁট নেমে মন্তরসুদ্দু তেনাকে চাপা দিয়ে দিলে। তবু মন্দের ভালো—বলে ভৈরব পাল গায়ের জ্বালা গায়েই মেরে নিলে। বাড়ি পড়া নিয়ে আর কোনও গোলমাল করলে না। উমেশ পালের তেমন গুরুভক্তি-টুরুভক্তি ছেল না দাদাঠাকুর—সবার তো সমান হয় না! তবুও বাতাসপুরের লোকেরা কী হয় কী না-হয় করছে, এমন সময়, আপনাকে যা বলছিলুম, বাঞ্ছারাম ধরা প’ড়ে গেল। 

—বাঞ্ছারামকে এ তল্লাটে সবাই চেনে, সাবধান থাকে; কিন্তু বাতাসপুর তো দূরে, যেখানে তাকে বড় একটা কেউ চিনত না। না চেনার দরুন উমেশ পালের বাড়িতে দিন-মজুরিতে সে একটা কাজ পেয়ে গেছল।—দুপুর গড়িয়ে গেছে, শীতকালের বেলা, মজুরি সেরে বাঞ্ছারাম গায়ে সুতির র‍্যাপারটুকু জড়িয়ে দাঁতন করতে করতে ঠুকঠুক করে চলেছে। এইবার চানটা সেরে খুদ মুড়ি যা জোটে একমুঠো গালে দিয়ে আবার খাটুনিতে নামবে, এমন সময় হেঁড়ে গলায় এক ডাক—কে জাতা হ্যায়? 

—রাস্তাটা ভৈরব পালের দেউড়ির সামনে দিয়ে। বাঞ্ছারাম ফিরে দেখে সিং—দরজায় এক তেপাইয়ের ওপর এক বেটা নতুন পশ্চিমে দারোয়ান। সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পেরে বাঞ্ছারামের বুক একেবারে শুকিয়ে গেল। কী তেওয়ারি না কি নামটা, আমার ঠিক স্মরণ হচ্ছে না, এগুনে পুলিশে কাজ করত, বাঞ্ছাকে এর আগে জেলে দেখেছে। বেশ ভালো করে চেনে।—মুখ ফিরুতেই জিজ্ঞেস করলে, বাঞ্ছারাম আছে না? এখানে কোথা থেকে? 

—যেমন বলা উচিত—খুব এক লম্বা সেলাম ঠুকে বাঞ্ছারাম বললে, হ্যাঁ, আমিই দারোগা সায়েব। গতর খাটিয়ে এক মুঠো উপার্জন করে যা জোটে তাতেই কোনওরকমে দিন গুজরান করছি। অনেকদিন পরে দর্শন পেয়ে বড় আনন্দ হল।… 

—মানে, মন ভিজোবার যতরকম কথা হতে পারে বাঞ্ছারাম আওড়ে দিলে, কিন্তু কথায় বলে, চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি, আর কথাতেই যদি মন ভিজবে তো পশ্চিমে বলেছে কেন? তেওয়ারি সব শুনে চোখ পাকিয়ে বললে, তোমারা র‍্যাপারকে ভেতরমে ফোলা কেন? 

—বাঞ্ছারাম একটু হাসবার চেষ্টা করে বললে, দুটো মুড়ি কিনেছিলুম দারোগা সাহেব, চান করে উঠে মুখে দোব।—আচ্ছা, এখন তা হলে আসি, বড্ড তাড়াহুড়ো রয়েছে, জমিদারের মজুর খাটছি, কিনা। সন্দের সময় এসে ভাং ঘুটে দিতে হবে দারোগা সাহেবকে, অনেকদিন সেবা করতে পাইনি… 

—তেওয়ারি তেপাই ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, গোঁফে একটা চাড়া দিয়ে গলা চড়িয়ে বললে, তোম এদিকে আবেগা কী হামকো উঠনে পড়েগা? 

—তেওয়ারির শরীর আগে থেকে ভারী হয়ে গেছে, বাঞ্ছারাম ছুট দিলে যে দৌড়ে ধরতে পারত এমন নয়, তবে কথা হচ্ছে, যখন যেটা ঘটবার সেটা ঘটবেই কিনা দাদাঠাকুর, বাঞ্ছারাম কেঁচোটির মতো সুড়সুড় করে কাছে এসে দাঁড়াল। দাঁড়াতে দেরি, তেওয়ারি র‍্যাপার ধরে দিলে এক রাম-ঝটকা। র‍্যাপারটা তো হাতেই থাকুক, একদিকে বাঞ্ছারাম ওই হুখানে ছিটকে পড়ল, আর একদিকে এই এত বড় এক রুপোর পানের ডিবে। তেওয়ারি বললে—উঠায় করকে লে আও। 

—বাঞ্ছারাম আস্তে আস্তে ডিবেটা কুড়িয়ে এনে দিতে হাত ধরে আর একটা ঝটকা দিয়ে দে মার। পুলিশের কাজ ছাড়া পর্যন্ত আসামি পায়নি, হাতটা নিশপিশ করছিল, মার যা দিলে তার আর হিসেব রইল না দাদাঠাকুর। দশ-আনি দেউড়ির আমলা গোমস্তা যে যেখানে ছিল ছুটে এল, কেউ থামাবার চেষ্টা করলে, কেউ ওরই ওপর আরও দু-ঘা বসিয়ে হাতের সুখ করে নিলে। কেরমে শোরগোলটা যখন বেড়ে গেল, তখন ছ-আনিদের তরফ থেকেও কয়েকজন এসে জুটল। 

—ছ-আনি তরফের দারোয়ানের নাম পাঁড়ে। অমন লাশও কেউ এ তল্লাটে কখনও দেখেনি, অমন রুক্ষু মেজাজও না। রুটির ময়দা ঠাসছিল, চোর ধরা পড়েছে শুনে তালটা থালায় ঢাকা দিয়ে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে এসে উপস্থিত হল। ভিড় ঠেলে সামনে এসে জিজ্ঞেস করলে, ক্যা হুয়া হ্যায়? 

—তেওয়ারি দেশওয়ালির কাছে বাহাদুরি দেখিয়ে বললে, শালা, রুপোর ডিনি চুরি করে পালাচ্ছেল পাঁড়েজি, ধরেছি। 

—পাঁড়েজি একে লোকটাই গোঁয়ার, তার—যেমন হয়ে থাকে দাদাঠাকুর, নিজে কখনও পুলিসে কাজ করত না বলে তেওয়ারির ওপর ভেতরে ভেতরে খুশি ছিল না। তার ওপর আবার যখন বাঞ্ছারামের দিকে চেয়ে বুঝলে যে, তেওয়ারি তার জন্যে কিছু বাকি রাখেনি, তখন ভয়ংকর খাপ্পা হয়ে উঠল। তা ছাড়া মনিবের মেজাজও বুঝত; জিজ্ঞেস করলে—ডিবে কোথায়? 

—তেওয়ারি ডিবেটা হাতে তুলে দিল। ডিবেটা হাতে নিয়ে পাঁড়েজি বললে, এ তো দেখছি আমাদের বাড়ির ডিবে। চোরকে ছেড়ে দাও। তেওয়ারি লতুন এসেছে, দুপক্ষের সব ব্যাপারটা শোনেনি তখনও তায় পুলিশের লোক সোজা পদ্ধতিটাই জানে, একটু হতভম্ব হয়ে থেকে বললে, বাঃ, চোরকে ছেড়ে দেব কেন?—ধরা পড়েছে, তাকে পুলিশে দিতে হবে। 

–পাঁড়েজি একটা সুবিধেই খুঁজছেল,— পুলিশের নাম হতেই তো ওদের নিজেদের ভাষায় চোখা চোখা একরাশ গাল ঝাড়লে, নিজে পুলিশ ছেল না বলে বরাবর একটা আক্রোশ ছেল কিনা। তারপর এগিয়ে বললে, মাল আমার, চোরও আমার, হাম য্যাসা খুশি করেঙ্গা, চোর দে দেও। 

—তেওয়ারিরও রোখ চেপে গেল, বাঞ্ছারামকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বললে, কোভি নেই ছোড়েঙ্গা, চোর সরকার বাহাদুরকে হ্যায়। 

—বলতে দেরি, চিতুনো বুকে এক রাম রদ্দা কষিয়ে তেওয়ারিকে হটিয়ে পাঁড়েজি ধরলে বাঞ্ছারামের টুটি টিপে; তারপর সে যা আরম্ভ হল দাদাঠাকুর, সে এক রামায়ণ—মহাভারতেই গপ্‌প শোনা যায়; প্রথমে তো নিজেদের মধ্যেই দিব্যি খানিকক্ষণ চড় ঘুষি অদল-বদল করলে দুজনে, তারপর চোর নিয়ে টানাটানি—একজন ধরলে দুটো নড়া বাগিয়ে, একজন ধরলে দুটো পা, তারপর টানাটানি, হেঁচড়া-হেঁচড়ি—এ একবার পাঁড়েজি সুদ্দু হিড়হিড় করে দেউড়ির দিকে টেনে নিয়ে যায় তো ও একবার তেওয়ারি সুদ্দু সিং-দরজার পাঁচ হাত বাইরে হিচড়ে নিয়ে আসে—’হামকো চোর’ তো ‘হামকো সরকারি চোর’। আমরা সবাই হাঁ করে তামাশা দেখছি। আমি ত্যাখন খুড়োর কাছে বেশির ভাগ থাকতাম কিনা—একবার মনে হচ্ছে, বুঝি নড়া দুটো ছিঁড়ে গেল, আবার মনে হচ্ছে পা দুটো বুঝি বাঞ্ছারামের কোমর থেকে খসে বেরিয়ে গেল। জন্মে আর একবার মাত্র সে-রকম কাণ্ড দেখেছি দাদাঠুকর, কলকেতার গড়ের মাঠে দু-দল গোরা খেলছেল—তা সেটা ছেল একটা কাছি -নিয়ে। গোটা একটা নিরীহ মানুষ নিয়ে—আর সে মানুষও আমাদের জানাশোনা বাঞ্ছারাম—এ ধরনের কাণ্ড আর দেখিনি কখনও। তামাশা দেখতে বোধ হয় দু-তরফে এমন শতাধিক লোক জমা হয়ে গেছে, খিস্তি খৌড় যা চলছে তার আর নেকা-জোকা নেই।…মাঝখানে ওই রকম সমুদ্রমন্থনের পালা চলেছে।… 

বলিলাম, মারা গেল না লোকটা স্বরূপ? গল্প শুনেই তো আমার আদ্দেক হয়ে এসেছে! 

স্বরূপ হাসিয়া উত্তর করিল, কথায় বলে–চোরের পরান ভোমরার মধ্যে থাকে দাদাঠাকুর, তা ছাড়া ওকে মরতে হবে যে অন্যভাবে, ত্যাতক্ষণ পর্যন্ত ওকে ধকলটা সামলাতেই হবে কিনা—তা না হলে নিয়তি আর বলেছে কেন! তারপর যা বলছিলুম, —বাঞ্ছারামের এর পরে যখন জ্ঞান হল, তখন দেখে সে ছ-আনিদের কাছারির সামনে ঘাসের ওপর পড়ে রয়েছে, চারদিকে একপাল লোক। পাশেই পাঁড়েজি, দশ—আনিদের দেউড়ির দিকে চেয়ে এক-একটা হুংকার ছাড়ছে আর তাল ঠুকছে—আর দ্যাখো, কীসকা চোর হ্যায়, শ্যালা তেওয়ারি! হামকো সামনে পুলিশগিরি ফলানে আয়া হ্যায়! 

—উমেশ পাল আহারাদি করে এই সময়টা ভেতরে থাকে। রাজামানুষ, একটু রঙেই থাকে, বুঝতেই পারেন, দাদাঠাকুর। পেরাই তো এই রকম ব্যাপার হচ্ছে দু—বাড়ি নিয়ে, গা করে না। তেমন তেমন কিছু হল, খবর গেল ভেতরে। দরকার মনে হয় বেরিয়ে এল, নয়তো হুকুম পাঠিয়ে দিলে। এই রকম করে চলে। এবার তো কাণ্ডটা একটু ঘোরালই হয়েছে, দাওয়ানজি খানসামাকে দিয়ে এত্তালা দিয়ে দিলে। খানসামা ছেল আমারই খুড়ো ভবানী মণ্ডল, দাদাঠাকুর। এত্তালা হল—এই রকম রুপোর ডিবে নিয়ে চোর পালাচ্ছেল, ও-দেউড়ির দারোয়ান আটকে রেখে মারপিট করছেল, পাঁড়েজি তাকে বামালসুদ্দু ছাড়িয়ে নিয়ে এসে আটকে রেখেছে, হুজুরে কী হুকুম হয়? 

—উমেশ পাল চোখ বুজে আলবোলায় তামাক খাচ্ছেল, বললে—শির লে আও। 

—কাঁচা মাথা একটা কেটে ফেলা সে সময় খুব বেশি কথা ছেল না, দাদাঠাকুর। খুড়ো বাইরে এসে হুকুম শুনিয়ে দিলে। শুনতে দেরি, মার খেয়ে বাঞ্ছারামের যে একটা ঝিম ধরেছেল, কোথায় গেল উড়ে, ডাক ছেড়ে কান্না জুড়ে দিলে। চোরের কান্না, তায় আবার মশানে যেতে বসেছে, কান্নার চোটে সারা দেউড়ি তোলপাড় করে তুললে বাঞ্চারাম—এমন কাণ্ড করে তুললে যে, কত্তার যে একটু রঙের আমেজ ধরে এসেছেল, সেটা গেল চটে। দাওয়ানজির ভেতরে ডাক পড়ল। 

—সামনে গিয়ে দাঁড়াতে কত্তা উমেশ পাল জিজ্ঞেস করলে, কাঁদে কে? 

—কত্তা রঙের মুখে থাকলে দাওয়ানজিও তটস্থ হয়ে থাকত, মানে মেজাজের ঠিক থাকত না কিনা; ভয়ে ভয়ে বললে—ওই ব্যাটা চোর। সামান্য একটু মাথাটা কেটে নেওয়ার হুকুম হয়েছে হুজুরের থেকে, পাড়া তোলপাড় করছে,—কেউ যেন কখনও দেয়নি মাথা এর আগে। তা এক্ষুনি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। যাই, পাঠিয়ে দিই। 

—দাওয়ানজি ফিরতেই কত্তা হাতটা একটু তুলে দাঁড়াতে হুকুম করলে, বললে—তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, কাজ-কৰ্ম্ম ছেড়ে বাড়ি গিয়ে বসো এবার। আমি কাঁচা মাথা চেয়েছি সে বেটা খোট্টা দারোয়ানের।…কী অধিকারে সে আমার চোরের গায়ে হাত দেয়? পাঁড়ে কী করছেল? জানে না সে আমার হুকুম? আজ আমার চোর আটকাবে, কাল আমার ভারী আটকাবে, পরশু আমার জুড়ি আটকাবে, পরদিন আমার জমিদারিতে হাত দেবে—আমার খাস সম্পত্তির ওপর যদি এই ভাবে দখল বসায় সবাই,, তো পাঁড়ে ব্যাটা কী করতে আছে শুনি? তোমরাই বা কী করতে আছ?…যাও, আর্ভি নেকালো সব। 

—চটে গেলে উমেশ পালের আবার বেশি করে মালের দিকে ঝোঁক পড়ত, খুড়োকে বোতল আনতে হুকুম করে দিলে। 

—দাওয়ানজি হাতজোড় করে বললে, হুজুর, পাঁড়েজি তো সে বেটার ধাষ্টামো আর বে-আইনির জন্যে কিছু বাকি রাখেনি,—অচৈতন্য হয়ে ও-তরফের সিং-দরজার সামনে পড়ে আছে, হুকুম হয় তো ধড় থেকে না হয় মাথাটা আলাদা করে আনিয়ে হুজুরে নজর দিই। 

—কর্তা কিছু উত্তর না দিয়ে একটু গোঁজ হয়ে রইল, তারপর বললে, চোর বেটা কোথায়? 

—দাওয়ানজি বললে, বাইরেই পড়ে আছে আধমরা হয়ে, হুজুর…। বেটা চিৎকার করছিল, ঠান্ডা করবার হুকুম দিয়ে এসেছি। 

—দশ-আনির বড় কত্তা কোথায়—অন্দরে? 

—হই-চই শুনে তিনি বেইরে এসেছিলেন, এখন তেওয়ারির এজাহার নিচ্ছেন বোধ হয়। বারান্দার সামনে বেস্তর লোক জড়ো হয়েছে। 

—কত্তা আবার খানিকটা গোঁজ হয়ে রইল। দাওয়ানজি একবার জিজ্ঞেস করলে, তা হলে চোর বেটার সম্বন্ধে যা সাজার হুকুম হয় হুজুরের— 

—কত্তা বললে, সাজা উমেশ পাল নিজের হাতে দেবে। হাতিশালা থেকে নতুন হাতিটা বের করতে বলো, হাওদাসুদ্দ। আমি স্বয়ং আসছি। 

স্বরূপ বাতা আর কাটারিটা রাখিয়া দিয়া দুইটা হাঁটু দুই হাতে জড়াইয়া আমার দিকে মুখ করিয়া বসিল। বলিল, হাতির তলায় চাপা দিয়ে চোর মারা হবে, স্বয়ং কত্তা থাকবেন হাতির উপর—সঙ্গে সঙ্গে কথাটা চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেল দাদাঠাকুর 

—কম করে বোধহয় দশখানা গেরামের লোক ভেঙে পড়ল। ছেলেমানুষ বলে খুড়ো আমায় দেখতে মানা করে দেছল, আমি চুপি চুপি গিয়া একটা ছাতিমগাছে উঠে বসে রইলেম। দশ-আনি তরফেরও যত লোক বাইরে এসে জমা হল, দেউড়ির ছাতে মেয়েরা গিয়ে জমা হল। ওদিকে দশ-আনির বড় কত্তা ভৈরব পাল গোপনে গোপনে সদর থানায় লোক ছুটিয়া ওপর-ঘরের একখানি ঘরে জানালার ধারে বসে ওপিক্ষে করতে লাগল। সেও তো বসে থাকবার পাত্তোর নয়—অত বড় অপমানটা হল! 

—বৈকাল হলে উমেশ পাল বাইরে এল। দাওয়ানজিকে জিজ্ঞেস করলে, ঢোল—সানাইয়ের জন্যে বলা হয়েছিল? হয়নি বলা—দাওয়ানজি চুপ করে রইল। কত্তা গলা চড়িয়ে বললে, বলেছি নিজে সাজা দোব, আমায় কি মেয়েমানুষের মতো লুকিয়ে চুরিয়ে সাজা দিতে হবে? নেকালো সব। তক্ষুনি ঢুলিসানাইদের ডাকতে পাইক ছুটল। কত্তা হুকুম দিল—চোরকে হাজির করা হোক 

—বাঞ্ছারামকে দু-তিনজন মিলে এক রকম টাঙিয়েই নিয়ে এল। হাতির পিঠে রুপোর হাওদাই থাকুক আর সোনার হাওদাই থাকুক, তবে তো মিত্যুই দাদাঠাকুর— একেবারে নেতিয়ে পড়েছে, মুখ দিয়ে আর রা সরছে না। 

—কত্তা হুকুম দিলেন, চারজন বরকন্দাজ সাজগোজ পরে হাজির হবে। তোষাখানা থেকে একখানা জরির পোশাক, আর কত্তার খাস আলমারি থেকে এক বোতল বিলাতি মালেরও হুকুম হল। সাজার আয়োজনটা দেখে দেউড়ির চারিদিকে ভিড় চাপ বেঁধে উঠল।—এইবার তামুকটা একবার দিন দাদাঠাকুর, একটু পেসাদ পাই।

স্বরূপ বেশ পুরাদমে কয়েকটা টান দিল। কলিকাটা একবার দেখিয়া লইয়া বলিল, আছে এখনও খানিকটে। 

তাহার পর কলিকাটা আবার হুঁকার মাথায় চাপাইয়া দিয়া বলিল, সে অনেক কথা দাদাঠাকুর, কত আর কইব! তাই বলছিলুম সম্পত্তি-জ্ঞান একটা জিনিসই আলাদা, কথায় কথায় মামলা মকদ্দমা করলেই যে সেটা খুব টল্টনে বলতে হবে তা নয়।—হ্যাঁ, সেদিনকার কথা যা বলছিলুম—সদর থেকে খুনের খবর পেয়ে য্যাখন দারোগা এসে হাজির হল, ত্যাখন জলুসটা ঠিক দশ-আনি তরফের সিং-দরজার সামনে! ঝালর—হাওদা দেওয়া—হাতির ওপরে, হাওদার ঠিক মাঝখানটিতে জরির কাপড়-চোপড় পরে বাঞ্ছারাম, বাবুর বোতলের মাল খেয়ে জয়জয়কার করতে করতে রুপোর ডিবেটা যতদূর হাত যায়, মাথার ওপরে তুলে ধরেছে—চারপাশে চারটে সাজগোজ—পরা বরকন্দাজ আসাসোঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে। নিচে দুখানা গেরামের যত ঢুলি আর সানায়ি পেল্লায় জোরে নহবত বাজিয়ে চলেছে। 

—দশ-আনিদের দেউড়ি ঘুরে, সারা বাতাসপুরটায় বার দুই চক্কোর দিয়ে জলুসটা পোড়ো শিবমন্দিরের সামনে দাঁড়াল। সেখানে থেকে বাঞ্ছারাম সুদ্দু হাতিটা মাঠে নামিয়ে দশ-আনিদের জমির পাশেই ছ-আনিদের যে একটা চাকলা আছে, তার প্রায় বিঘে পাঁচ-ছয় ঘেরে মাহুত আর একটা চক্কোর দিলে, হাতির পেছনে পেছনে একটা লোক চুনের দাগ দিতে দিতে চলল। বাঞ্ছারামের নাতি-নাতকুড়েরা আজ সেটা ভোগদখল করছে। দশ-আনিদের জমির ঠিক লাগোয়াই, দাদাঠাকুর, যেন ওরা কখনও ভুলতে না পারে আর কী। 

—তেওয়ারির কাঁচা মাথাটা নিয়ে আসতে পারেনি বলে কত্তা পাঁড়েজির ওপর একটু চটে গেছল; তবুও পঞ্চাশটা টাকা বকশিশ করলে। নইলে যে বড় অধম্ম হয় দাদাঠাকুর—সে-বেচারি চেষ্টার তো কিছু কসুর করেনি… 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *