সমুদ্রের ফেনা

সমুদ্রের ফেনা

আমিনার অবয়ব এ্যাখোন বিশ্বাসহীন আঁধারে গলে গলে একেবারে আঁধার হয়ে গেল, সীমাহীন ভয়াবহ আঁধার!

কবরের খোলের মতো হাল্কা, বিপদগ্রস্ত আমিনা। তার ঘনবয়ব গোপনে, তার পরিপূর্ণ মুখে ঝুর ঝুর কোরে অভিশাপ ঝরছে আর সাথে সাথে ঘূর্ণির মতো পাক খাচ্ছে তার ললিত বয়স, ব্যঞ্জনাময় স্বপ্ন। অনায়ত্ত আমিনা তার আঁধারের গলায় মুখ লুকিয়ে কাঁদলো–বালিশের আগুনে একটা একটা করে চুল, চুলের সুগন্ধ পুড়ে যেতেই তার শুয়ে থাকা প্রোফাইল, গ্রীবার মৃণাল, ঠোঁট গলে যেতে জানালা গলিয়ে অকস্মাৎ মেঝেতে ছটফট কোরলো বুনো হাঁসের দুটি রজত পাখা।

তরল শাদায়, পাল ঘেঁড়া, ভাঙ্গা, নাবিকহীন নিজজ্জিত নৌকার মতো অথৈ বিনাশে যেন ডুবে যাচ্ছে সে, এমন মনে হলো আমিনার। ও পাশে, জ্যোৎস্নার ঠাণ্ডায় দেহ ভিজিয়ে তার ভাই তার ছোটবোন; তারা জানছেনা আমিনা এখোন দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে তাদের আমিনা আঁধার হয়ে যাচ্ছে, একটা ভবিষ্যৎ, বালিশের অবিশ্বাস্য আগুনের মতো হলুদ দাঁতে তার আপাদমস্তক চিবিয়ে অন্তসারহীন করে রেখে যাচ্ছে। তার ভাইয়া ওপাশে তখোন শাহনেওয়ারেজ পরোক্ষ গলায় হাত ডুবিয়ে দিচ্ছে, ঠাণ্ডা আঙ্গুলে তার হাতদুটো একত্র কোরে শাহনেওয়াজের সিমসাম পাপড়ি খুলছে। কাল ভাইয়া অধিক রাতে এক নিষিদ্ধ মেয়েমানুষের দুষিত শক্তিতে ইন্দ্রিয় রেখে আজ আবার শাহনেওয়াজকে নিয়ে তৎপর। আমিনা দেখেছে, তার ভাইয়া তার কাছে কিছুই লুকোয়না। আমিনার কাছে ওর ভাইয়া সব বলে। নিষিদ্ধ শক্তির গন্ধ, প্রেমানুগ শাহনেওয়াজ, কবিতা চাকরি ভাল্লাগেনা’র সব কথা বলে আমিনার কাছে। কিন্তু আমিনা কিছু বোলতে পারে না বলেই ওর এ্যামোনি ডুবে যাওয়া। পুড়ে যাওয়া। খুলে খুলে নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া। কিন্তু না, বোলবে, একদিন সব ও ভাইয়ার কাছে। তার আর একটা জন্মের দরকার। না বোললে, নিঃশেষ করে না দিতে পারলে, পুনর্জন্ম হবে না ওর।

ভোরে ঘুম কামড়ে থাকায় সারা দেহ থেকে শাড়ীটা গুছিয়ে নিতেই ব্লাউজের তলাটা তার সুড় সুড় কোরে উঠলো। একটা অবতমান রোষ তাকে কামড়াচ্ছে বলে, তার মনে হলো, সে যদি বর্ষার দোলা ঢেউয়ের ওপর একজনের হাতে বাওয়া নৌকায় শুয়ে শুয়ে সারাটা রাত কাটাতে পারতো। ভোরবেলায় ঘুম জড়িয়ে থাকলে তার মনে হয়–এ বাড়ী থেকে পালিয়ে একটা পাহাড়ের ওপর, যেখানে শাল পাতার গান, নুড়ির চুমো খাওয়া সন্নিধান আর বুনো ঝরণার অনচ্ছ নাচ–আর পারিপার্শ্বিক একটা বাংলো শান্তিময়, দুটো পাশাপাশি পাখীর মতো জানালা-কাটা ছায়া যার ওপর এসে বসে; ঠিক অমোন একটা বাংলোয় সারা বিকেল ধরে, সারা দুপুর ধরে সে যদি ঘুমোতে পারতো!… কিন্তু সে পারেনা বলেই তার যন্ত্রণা, সে ভাইয়ের মতো সবকিছু খুলে বলতে পারেনা বলেই তার ডুবে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া।

ঘুমের মধ্যে তাই তার শয্যা, তার সিথি, তার বুক, তার যৌবন-কোমল জায়গা, তার নিজেরও-ইচ্ছে-করেনা দেখতে’র’ টলটলে লজ্জা কেমন ঘাস, প্রাজপতি, নদীর ঢেউ আর নদীতে বাঁধা ছোট ছোট নৌকা হয়ে যায়। আর এই বিভিন্ন সম্পদ নিয়ে সে অবিকল একটা সরোবর–যার ওপর দিয়ে তার আনন্দের বাতাস, তার নিরানন্দের ঘূর্ণি চাঁদের দেহকে টুকরো টুকরো করে গলিয়ে দেয়।

.

একদিন জ্যোৎস্নারাতে তাই-ই হয়েছিল, কিন্তু সেদিন বুঝতে পারেনি আমিনা। ভাই বাড়ীতে ছিলনা সেদিন ছোট বোন পড়ার টেবিলে মাথাটা সোপর্দ কোরে দিয়ে ঘুমে মগ্ন যখোন, তখোন সে বাইরের রান্নাঘরের ওদিকে, যেখানে একটা নীলমণি লতা আর কামিনীর ঝোঁপ পরস্পর নেশা, তার পাশে একটা বড় ধরনের দেবদারু গাছ-সেখানে পঁড়িয়ে অবিকল সে যখোন অতীতে নিমজ্জিত, তখোন কেন যেন মনে হলো তার–তার সামনে, তার পশ্চাতে একটা রূপালী সরোবর ঢল ঢল জল নিয়ে থৈ থৈ কোরছে। আর নীলমণি লতা, কামিনী ঝোঁপ আর দেবদারু গাছের পাতা শ্বেত হংসের মতো পাখা ঝাঁপটাচ্ছে স্বপ্ন ভিতরের দোকান ঘরের সুগন্ধ মাখবে বলে। আমিনার দেহ থেকে ক্যামোন একটা হাল্কা ব্যর্থতা ঐ রূপালী সরোবরে চারিয়ে যাওয়ায় তার মনে হলো, এ্যাখোন, ঘরে ফিরে যাওয়া দরকার। ঘরে ফিরে এসেই দ্যাখে, ভাই; ভাইয়ের বন্ধু। তাদের চোখের আঁধার কামোন চিতা বাঘের মতো জ্বলছে।

সেদিন ভাই আর তার বন্ধু খুব বেশী মদ খেয়েছিল–খুব বেশী। ভাইয়ের ঘর বন্ধ কোরে, দু’বন্ধু পরস্পর গ্লাসের পর গ্লাস টেনে টেনে নিজেরা যখোন অভ্যন্তরগামী, হৃদয়গ্রস্থ, তখোন তারা শাহেদের শিল্প, ভাইয়ের কবিতা নিয়ে সমালোচনা করছিল পরস্পর।

: শাহেদের খুব প্যাশোনেট হাত ছিল। ওয়াটার কালালের যে আঁচড়-আমার মনে হয় ও কনস্টেবলের আঙ্গিক নিয়ে আঁকে। কিন্তু ও আর ছবি আঁকবেনা, ও ছেড়ে দেবে। ওর কবিতা ও পুড়িয়ে দিয়েছে। কবিতা-ছবি-শিল্প, এতে নাকি কিচ্ছু হবে না। ও ফিরে যাবে বলেছে। গাঁয়ে ফিরে মাকে নিয়ে থাকবে। পুকুরের মাছ, জমির ধান চাষ কোরে তার নাকি বেশ কেটে যাবে। ও সব সময় বলে আজকাল, আমি শান্তি চাই, বুঝলে, আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। না অর্থ, না যশ; ও গুলো জবাই করা পশুর রক্ত! ও রক্তে আমার পিপাসা মিটবেনা।

: ও একটা মেয়েকে ভালোবাসতো।

: কিন্তু ওকে কোনোদিন ন্যুড কোরে একটি ছবি আঁকতে পারেনি বলে ওর দুঃখ।

মারিয়া ন্যুড হোতে জানতো। মারিয়ার বাবা তাকে দিয়ে টাকা কামাতো। মেয়েটা শাহেদকে অনেক দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শাহেদ মারিয়াকে ভালোবাসতে পারেনি। শাহেদ মারিয়াকে ছুঁয়েও দ্যাখেনি। শাহেদ ওর একটা ছবি এঁকেছিল। ন্যুড। ক্যামোন শ্যাওলা দিয়ে ঢাকা একটা ন্যুড। আর পাশে দুটো খরগোশ। মারিয়ার ন্যুড ব্রেস্ট, ন্যুড থাই আঁকতে গিয়ে শাহেদ একটু উষ্ণ হয়নি, বুঝলে! কিন্তু মারিয়া, ওকে খুব ভালোবাসতো। ওর জন্যে করাচী থেকে এক সেট সুন্দর পোশাকও নিয়ে এসেছিল মারিয়া। বোলতে শুনেছি তাকে, শাহেদ খুব বড়দরের শিল্পী বুঝলেন। ওর জন্যে আমার খুব কষ্ট হয়। ও মদ খেয়ে ওর প্রতিভা নষ্ট কোরে দিচ্ছে। ও প্রেরণাহীন হয়ে যাচ্ছে।

: মারিয়া জানতো ও একটা মেয়েকে ভালোবাসে।

: আমি বলিনি মারিয়াকে, ও একটা ভার্সিটি-মেয়েকে ভালোবাস।

: একটা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েকে ভালোবাসে শাহেদ। আমি ওকে বলেছি; শাহেদ চলে যাবে। শাহেদ বাড়ীতে গিয়ে ওর মাকে নিয়ে থাকবে। একটা পায়ে মাড়ানো ঘাস যেন, এ্যামোন মাথা নুয়ে এসেছিল মারিয়ার। মেয়েটা! একটা প্রতিভার বিকাশের জন্যে যে আপাদমস্তক, আহৃদয়বুদ্ধি ছিন্ন কোরে খুলে দেখাতে পারে তাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হলো। মারিয়ার জন্যে আমার মায়া হয়। ও এ্যাখোন কোথায় আছে জানিস?

: লাহোরে?

: হ্যাঁ। ওর বাবা একটা ব্রুট। ওর বাবা ওকে দিয়ে টাকা কামায়। ওর বাবা একটা প।

: শাহেদের কাছে যাওয়া দরকার। শাহেদ একটা ‘লোরকা’। শাহেদ একটা বিষণ্ণ আত্মা। ও আর কবিতা লিখবেনা।

: ও আর ছবি আঁকবেনা।

: ওর একটা ছবির জন্য আমি সারারাত ঘুমুইনি জানিস। সেই যেখানে সমুদ্রে জাহাজগুলো ছেড়ে যাচ্ছে আর একজন বৃদ্ধ লোক, হাতে যার দুটো শ্বেতকপোত, কুঁকে পড়েছে, যেন মনে হচ্ছে জাহাজের ঠিক সময়ে বৃদ্ধটা আসতে পারেনি বলে ওর এ্যামোন কুঁকে পড়া, সারা পোমাকে নে একটা সিনসিয়ারিটি অব এ্যাঙ্গুইস। বৃদ্ধের চারপাশে আকাশের ওপর মেঘ-সামনে সমুদ্রের ভীষণ ঢেউ আর জাহাজটা তার ওপর দিয়ে দুলে দুলে চলে যাচ্ছে। বন্দরে কোনো লোক নেই, সেই বৃদ্ধ শুধু একা, শুধু একা।

শাহনেওয়াজের গান দিয়ে লেখা ভাইয়ের কবিতাটি আমিনাকে কতো দিন শুনিয়েছে। তার ভাইয়া নাকি আর কবিতা লিখবেনা। ভাইয়া আর কোনোদিন ওর বন্ধুকে নিয়ে। আসবে না। ভাইয়া আর কোনোদিন কোনো কথা তাকে খুলে বলবে না। মারিয়া একটা সুইট মেয়ে। শজীর গন্ধ-ভরা মেয়ে মারিয়া। কি প্যাশোনেট ছিল মেয়েটা–শিল্পের ওপর, হৃদয়ের ওপর। কিন্তু মারিয়া এ্যাখোন খুব কষ্ট কোরছে লাহোরে। ওর বাবা একটা সুইট। মারিয়া তুমি ভালো থাকো! তোমার কল্যাণ হোক। মারিয়া কি কোনোদিন সন্ধ্যায় একা একা শাহেদের জন্যে কাঁদবে? বাবাকে মারিয়া কোনোদিন কিছু বলেনি। তার বাবা। ধীরে ধীরে বয়েসের ভারে নুয়ে পড়া তার বাবা। মরে যাবে একদিন। বাবার জন্যে মারিয়ার খুব কষ্ট। শাহেদের জন্যে কষ্ট।–মারিয়ার মতো মেয়ে জীবনভর কষ্ট বয়ে বেড়ায়। ওর মতো প্যাশোনেট মেয়ে যা খোঁজে তা পায় না। এইসব ভাবতেই আমিনার মনে হলো, তার আবার পুনর্জন্ম হোচ্ছে। তার আঁধার ফিরে যাচ্ছে। তার সরোবর তাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে না। তার যন্ত্রণা তাকে খুলে খুলে অনায় কাটায় গাঁথছে না আর।

স্মরণশক্তি আর পশ্চাদজীবনের তন্ময়তা যখোন প্রখর হোয়ে ওঠে, আমিনার তখোন ভীষণ ইচ্ছে হয়, মারিয়ার মতো যদি সে কাউকে ভালোবাসতে পারতো-ভালোবেসে ভীষণ যন্ত্রণা পেতো, আর জীবনকে উপলব্ধি কোরতে পারতো।

ভাইয়া সে রাতে বেলেছিল, আমাদের এখানে ওসবের কদর নেই। শুধু কবিতায় জীবন চলে না শুধ শিল্প নিয়ে জীবনের অর্থ হোচ্ছে তলাফুটো-নৌকো। সুতরাং অন্য কাজ করা চাই অর্থরোচক, স্বার্থসিদ্ধ কাজ।

সুজিতকে বোলেছিল ভাইয়া, এ্যাখোন তোর কাজে নামা উচিত। ঠকানোর কৌশল আয়ত্ত করা উচিত। দেখিস না সব অপচুনিস্টরা ক্যামোন আঙ্গুল নাচিয়ে একের পর এক উঠে যাচ্ছে। দেখিস না সব হার্টলেস ব্রুটদের এ্যখোন কত কদর।

আমি কালো ঘোড়ার পেছনে ছোটাটাকে আরো হার্টলেস মনে করি। আমি ছেড়ে দিয়েছি।

: কি?

: কবিতা লেখা।

: কেন?

: আমার আরো অনেক কিছু করার আছে। আমি আরো অনেক কিছু কোরতে পারি। গায়ে ফিরে চমৎকার একটা মাস্টারী তো জুটবে। ওখানে গিয়ে ছেলেদের ভেতর কবিতা চারিয়ে দেবো। বলবো, ভালোবাসতে না শিখলে ভালোবাসা পাওয়া যায় না। শেখাবো, ফুলের চাষ না কোরলে ফলও বেশী কোরে ফলে না।

: একে একে তোরা সবাই চলে যাবি। শাহেদ, তুই। বেশ। বেশ। যা। চলে যা। তারপর ভাইয়া ক্যামোন ঠাণ্ডা বাতাসের মতো কমনীয় নিঃশ্বাস টেনে কিছুক্ষণ নৈশব্দের পর আবার বোলেছিল, আমাদের দেশে শেষকালে তাই-ই হয়। হোতে হয়। আমরা বড় কিছু আশা কোরতে পারি না। আমরা প্রথমে সমুদ্রের মতো বিশাল, তারপর নদী, তারপর খাল, তারপর পুকুর, তারপর শেষাবধি কুয়োয় জীবনকে বিছিয়ে দিই শামুকের মতো। আমাদের তাই কিছু হয় না। কিছু কোরতে পারিনা আমরা।

শাহেদের গ্রামে ফিরে যাওয়া হলো না আর। অরণ্যময় একটা তাড়না তাকে যেতে দিল না। শাহেদ আজকাল ছবি আঁকে না। কবিতা লেখে না। শাহেদ একেবারে ইনএ্যাকটিভ, ইনআর্ট হয়ে গেছে প্রেরণার ব্যাপারে। হাসানের সাথে একদিন লঞ্চ-ঘাটে দেখা। খুব মনে হোয়েছিল। সদরঘাটের দোকানগুলো ছোট বউদের মতো নমনীয়।

নিষ্প্রভ আলোছায়ায় নদীর ওপর আইডব্লটির জাহাজ, মালভর্তি বড় বড় নৌকো, পাল খাটানো নাও দেখেছিল শাহেদ টারমিনালের সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে। ওর বাড়ী থেকে সাড়ে এগারোটার লঞ্চে আত্মীয় আসবে। ওর বাড়ী থেকে ওর আত্মীয় মায়ের মুখের কথা নিয়ে আসবে। লঞ্চ এলেও আত্মীয়ের দেখা না পাওয়ায় শাহেদের হাতের মুঠোয় তখন টারমিনাল আইডটির জাহাজ, পাল খাটানো নাও অনায়ত্ত মেঘ হোয়ে গেল–শাহেদ দেখছিল, টারমিনালের পাশ-ফেরা জলে তারাগুলো পাতি হাঁসের মতো ক্যামোন ডুবে ডুবে সাঁতার কাটছে আর মেঘগুলো জল ছিটানো বালকের মতো ব্যাকস্ট্রোকের ভঙ্গিতে ভেসে যাচ্ছে জলের ওপর দিয়ে।

সে রাতে ওরা সুজিতের বাড়ীতে গিয়েছিল। যেতে যেতে মায়ের কথা মনে পড়ায় শাহেদের গলা থেকে সূর্যাস্তের মতো অভিভূতি পাকস্থলীতে ডুবে যেতেই মনে পড়ে গ্যালো, শিমু ফুফু একটা লোকের জন্য কোরআন শরীফ পড়ে কাদতো। সেই লোকটা শিমু ফুফুকে বিয়ে কোরে আর একটা বিয়ে কোরেছিল। লোকটা শিমু ফুফুকে আর কোনোদিন নিতে আসেনি।

সেভেন ক্লাসে পড়ে তারপর ফুফু বাড়ী বসে শুধু চিলে-বাচ্চা-নেওয়া ডোমস্টিক মুরগীর মতো অস্থিরভাবে এ-ঘর ও-ঘর কোরতো। আর মাঝে মধ্যে মায়ের রান্না-বান্নায় একটু আধটু সাহায্য।

গোয়ালঘরের পাশে আমতলায় শুয়ে তখোন সে খুব ছোট, দেখতো, হাই স্কুলের ছেলেরা পুকুরে আশ্যাওড়া মাড়াতে মাড়াতে চলে যেতেই উত্তরোত্তর ত্রস্ত হয়ে ফুফু বোলতো, ‘যা না, পুকুরের হাঁসগুলো তাড়িয়ে দিয়ে আয়। দুপুর হলে ওদের জন্যে আর গোসল হোয়ে ওটে না জলগুলো একেবারে ঘোলা করে দিয়ে যায়।’

.

দরিদ্রাভ তরলতায় গাছপালাগুলো সোনালী আঁশ ঝাঁকে ঝাঁকে ছড়িয়ে দিয়েছে তখোন তাদের পুকুরে। কিন্তু ও আর হাঁসগুলো তাড়াতে পারতো না। মনে হতো, ওরা ফুফুর মতো কষ্ট পাচ্ছে। তাড়িয়ে দিলে ওরা অন্য কোথাও যেতে পারবে না। দেখতো শাহেদ চোখ মেলে, মাঠের ওধারে কোনোকিছু দেখা যাচ্ছে না। সড়ক বেয়ে দু’একটা গরুর মন্থর গতি ছাড়া। চাদ্দিকটায় সপ্রতিভ রোদ। আর ওর রূপালী পোষাকে মাথা গলিয়ে দিয়ে কালো গোড়ার মতো মেঘগুলো খুর দিয়ে য্যনো আকাশকে ভেঙে ফেলেছে, বুঝি এই-ই ভেঙে পড়বে, এ্যামোন ভাবতে ভাবতে ও তারপর চলে যেতো ডাঙ্গার দিকে। ধানের ওপর লম্বা হাত পা মেলে দিয়ে যেখানে হাল্কা গাঢ়ো বাতাস ঘুমিয়ে পড়েছে। আর এই সুযোগ বেল গাছতলায় কয়েকটা ছেলে গরুর ভাঙ্গা চোয়াল, ঝিনুক, কড়ি, তেঁতুলের বিচি দিয়ে হাট বসিয়েছে। এসব মনে পড়তেই হাসানকে বললো শাহেদ, আমি যদি সাত বছর বয়সে মরে যেতে পারতাম।

: সাত বছরতো অনেক সময়।

পরস্পর কথা বোলতে বোলতে পশারিনী অতীত সরিয়ে সরিয়ে তারা যখোন সুজিতের ঘরে পৌঁছলো, দ্যাখে ঘরে তালা ঝুলছে। সুজিত চলে গেছে। সুজিত খুব ভালো কবিত লিখতে পারতো। ওর একটা গল্পের সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে গ্যালো হাসানের। যেখানে সেই সমুদ্র ঝড় আর একটা যুবতী। দেখছে ঝড় এগিয়ে আসছে; কিন্তু তার কোনো খেয়াল নেই, অবিকল ঊর্বশীর মতো দেহ নিয়ে নির্বিকার সে, কিন্তু ঢেউয়ের ছোবল আসতে আসতে তার কাছে এসেই কি অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে গ্যালো। ঢেউ থেকে যাওয়ার বর্ণনাটা তার মনে পড়লেই চোখের সামনে, কানের ভেতর অবিকল য্যানো ত্যামোন কিছু অনুভব করে হাসান।

সুজিতকে না পেয়ে অগত্য ওরা গুলিস্তানের মোড় দিয়ে রেলওয়ে হাসপাতাল বায়ে ফেলে এলে শাহেদ তার ডেরায় ফিরে গ্যালো। হাসান গায়ের কবরগাহ দিয়ে হাঁটছে, এমোন অভিভূত পদে হাঁটতে হাঁটতে যখোন বাড়ী ফিরলো, দেখলো, আমিনা–যার দেহ থেকে পা পর্যন্ত আল্পা, জানালার ‘খোলা’ দিয়ে দেখা যাচ্ছে তাকে। একটা আমিষ বিচ্ছুরণ বেরুচ্ছে তার গা থেকে। ঘরে বাতি জ্বালানো বলে বুকের দুভাগের মধ্যখানটায় পাহাড়ের পাদদেশের আঙ্গুর বাগানের মতো একটা কালো তিল দেখা যাচ্ছে।

.

আমিনা অনেক বড় হয়ে গ্যাছে। আমিনার বুকের মধ্যে অপর্যাপ্ত শ্যাওলা ও মাছ। জানালাটা ভেজিয়ে দিয়ে ‘ও বড় নিঃসঙ্গ’ ধরনের স্বগোতোক্তি করে ঘরে ঢুকতেই দ্যাখে, সামনের চৌকাঠে একটা বিড়াল ঘুমানো, খাটো খাটো ছায়া ঝুলছে খিমকীর পাশের জায়গাটায়। আর একটা অবিভক্ত মেঘ খুলে ফেলে চাঁদ আপেল-চুরি-করা বালকের মতো দৌড় চ্ছে ভীষণ।

.

হাসানের ঘুম হবে না আজ। হাসান অনেকদিন ঘুমায় না। কবিতা লেখে না। চাকরি ‘ভাল্লাগে না’ বলে সংবাদ পত্রে কাজ নিয়েছে। চাকরিতে তার মতো লোক শান্তি পায় না। বাংলাদেশের চাকরি মানে ইচ্ছের বিরুদ্ধে দৌড়ানো। শাহনেওয়াজের গানের ওপর লেখা সেই কবিতাটা, যা ভেবেছিল শাহনেওয়াজকে পাঠাবে, কিন্তু না, তার কোনোকিছু হবে না। সে ভুলে গ্যাছে শাহনেওয়াজের গান, নিজের লেখা কবিতা। হাসপাতালের মোড়ে এসে যেদিন সে কাফন দিয়ে ঢাকা একজন যুবতাঁকে দেখতে পেয়েছিল, সেদিনই বিস্মৃতি এসে তাকে এই কবিতা, গান, ভালোবাসা থেকে অপহরণ কোরে নিয়ে গ্যাছে। সে বুঝেছে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ঠিকই করেছে সুজিত, মানুষের জন্য করার হলে, এই ‘এখানে-থাকা-ভালো-নয়’ গোছের শহরে ক্যানো? গায়ে ফিরে যেতে পারে না সে? সুজিত নাকি জীবনের শাদা অংশের ভূ-ভাগকে সবুজ ঘাস দিয়ে ঢাকার কৌশল শেখাচ্ছে ছেলেদের! সেই আমাদের কবি, গল্পকার সুজিত; এ্যাখোন মাস্টার!

কাল চিঠি এসেছে মারিয়ার। তার বাবা মারা গ্যাছে। বাবার ক্যানসার হয়েছিল। ব্রেন। ক্যানসার।

এক বান্ধবীর আশ্রয়ে আছে আপাতত। তারপর চলে যাবে করাচী। ওখানে এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চাকরি হয়ে গ্যাছে ওর।

লিখেছে, ‘জানেন, বাবা মারা যাবার পর আমি একেবারে নিঃসঙ্গ হোয়ে গেছি। শাহেদের কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হয় আমার বান্ধবী না থাকলে পাগোল হোয়ে যেতাম। বাবা শেষদিন পর্যন্তও আমাকে তো নিষিদ্ধ চোয়ালে চুবিয়ে দিয়েছেন। আমার দুঃখ হয়নি তবুও বাবা বুড়ো মানুষ! বাবাকে আমি ভালোবাসতুম। বাবা চলে গ্যাছেন বলে এ্যাকোন বাবাকে আর নিষ্ঠুর মনে কোরতে পারছি না। শাহেদ য্যানো ছবি আঁকে।’

.

চিঠিঠা পড়ে আমিনার মনে হয়েছিল, মারিয়া একটা অসম্ভব ব্রনের মেয়ে। অসাধারণ মেয়ে। ওর মতো সবাই হয় না।

শাহনেওয়াজের গান বাজছে ওদিকে রেডিওতে। ভাইয়াকে বললো আমিনা, শাহনেওয়াজের গান, ভাইয়া!’ হাসানকে তখোন কে য্যানো একটা নদীর তীরে নিয়ে গ্যালো। যেখানে সদ্যবিবাহিতা বউরা কাপড় ভাসিয়ে হাঁসের মতো হাতকে মেলে দিতেই অদ্ভূত গুঞ্জন উঠছে জলের, জল থেকে তাদের ভিজে বসনের।

হাসান চুপ থাকায় আবার বললো আমিনা, ‘শাহনেওয়াজের গান, শুনলে?’

: হ্যাঁ।

: খুব ভালো গান, না?

: খুব সুন্দর গান, না?

: নদীর মতো।

: শেষ রাত্রের ঢেউয়ের মতো।

: হ্যাঁ, ঠিক ঢেউয়ের মতো।

: তুমি ওকে বোলতে পারো না কিছু। আমি হোলে বোলতাম।

এইসব বোলেই আমিনা মসাধারে রাখা মৎসের মতো পিচ্ছিলভাবে ছড়িয়ে গ্যালো লজ্জান্তবর্তী শ্যাওলায়। হাসানের চোখ এড়ালো না কিছু! বোললো সে, অনেক কিছু বলা হয় না; য্যামোন তুই। তুই য্যামোন কিছুই বোলতে পারিস না, ঠিক ত্যামোন। মানুষ অনেক কিছু খুলে দিলেও, বোলতে পারে না। তারপর মনে মনে বোললো হাসান, ‘আমার ঘুমের দরকার। আমি ভালোবাসতে চাই না। কিছু হবে না আমাকে দিয়ে। কন্ট্রাক্টরি কোরছি শুধু তাদের জন্য। তুই কতো বড় হয়েছিস। মিনু এ্যাখখানো কত ছোট। সব আমাকে ভাবতে হয়।’

মারিয়ার জীবনই ভালো। মারিয়া জীবনকে ক্যামোন নিঃশব্দে ক্ষয় কোরে দিচ্ছে। ও করাচীতে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চাকরি নেবে। ওর জীবনে অনেক কষ্ট। সবাই কষ্ট পাচ্ছে। জীবনে কেউ সুখ পায় না। সেদিন একটা লোক দালানের উঁচু থেকে পড়ে মরে গ্যাছে। ওর মৃত্যু, ওর স্ত্রী, ছেলেমেয়ের মৃত্যু! কী হবে জীবনে? কী হ? কী হোলো ওর? মারিয়া একা। মারিয়ার কেউ নেই ওদেরও কেউ নেই। আমার টাকাগুলো সেদিন ওদের দিয়ে দিয়েছি। আমি মেয়েমানুষ, মদ, রেস্তোরাঁ সব ছেড়ে দিয়েছি। আমি কবিতা লিখতে পারি না আর।

‘তুই, মিনু–তোদের নিয়ে আমার দায়িত্ব অনেক। আমার ভালোবাসায় তাদের ক্ষতি হবে। তোর-মিনুর জন্যে আমার অনেক কিছু করা দরকার।

ভাইয়ের নীরবতায় আমিনার মনে হোলো, যেন, তার গা থেকে পরাগ ঝরার মতো সব অতীত খসে যাচ্ছে। জানে আমিনা, তার ভাই, তাদের নিয়ে খুব কষ্ট কোরছে। জানে সে, ভাই না থাকলে তারা অন্য কোথাও ঠাই পেতো না। বাড়ীতে তাদের কেউ নেই। একমাত্র বাবার হাতের চিহ্ন সেই চৌকো দেয়াল করা ঘর আর বর্গা। দেওয়া কবিঘে জমি ছাড়া। তার ছোট বেলায় সে যখোন ছোট, অনেক স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু স্বপ্ন কখোনো সত্যি হয় না। হোতে পারে না। মারিয়ার মতো মেয়ে শিল্পীদের মডেল হবার স্বপ্ন দেখতো। আনন্দের চাইতে ভারী সুন্দর-নড হোয়ে শাহেদের তুলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়ে এখোন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্সের সেলসম্যান!

রাত্রে আঁধারকে জখম করা জ্যোৎস্নার সাদা বল্লম যখোন চাঁদের হাতে তীর্যক ভাবে ধরা, তখোন হাসান ঘরে এলো। ভাবলো, সে আজ রাতে একটা কবিতা লিখবে, যেখানে উপমা হবে একটা অরণ্য আর যার ভেতর দিয়ে একদল শিকারী, শিকারের সন্ধানে ঢুকতেই যারা বাঘের থাবায় প্রাণ হারালো। ঠিক এ্যামোন ধরনের বক্তব্য থাকবে তার কবিতায়।

ঘরে ঢুকেই দ্যাখে সে, টেবিলে ঝি-এর রাখা টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত। শীতের আঙ্গুলের দাগ তাতে। মিনু যেহেতু হাসানের কাছে শোয়, দেখলো সে, মিনুর গতর থেকে লেপটা বাতাসে উল্টে গিয়ে তার মুখে কেউ ঠাণ্ডা চাবুক মারছে। আস্তে লেপটা ছুঁড়ে দিল সে মিনুর ওপর। ভাবলো, একজন গানের মাস্টার রেখে দেবে মিনুর জন্যে।

আমিনার ঘরে ঢুকে অবশেষে তার কবিতা ভুলে গিয়ে সে দেখলো; লম্বা তনুর অবশিষ্ট বাহুতে একটা শ্বেত হংস পাখা ঝাঁপটাচ্ছে। আর মাথা থেকে ঢেউ খেলানো বুকের হৃদয়-রোচক হরণ কোরে আমিনার উরু অবদি একটা তরল লণ্ঠন ওপাশের আমগাছ থেকে নেমে, ক্যামোন নমনীয় একটা অনাদৃত ভঙ্গীতে ‘ওর একজন সঙ্গী দরকার’ লিখে টেবিলের খোলা ড্রয়ারে নিঃসঙ্গ শ্বেত পেন্সিলটা রেখে তারপর আমিনার চুল বিছানো চেয়ারে বসে পড়ছে। যেন কিছুটা নির্বিকার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *