পুরীতে সমুদ্র দেখিয়া হে আদিজননী সিন্ধু , বসুন্ধরা সন্তান তোমার , একমাত্র কন্যা তব কোলে । তাই তন্দ্রা নাহি আর চক্ষে তব , তাই বক্ষ জুড়ি সদা শঙ্কা , সদা আশা , সদা আন্দোলন ; তাই উঠে বেদমন্ত্রসম ভাষা নিরন্তর প্রশান্ত অম্বরে , মহেন্দ্রমন্দির-পানে অন্তরের অনন্ত প্রার্থনা , নিয়ত মঙ্গলগানে ধ্বনিত করিয়া দিশি দিশি ; তাই ঘুমন্ত পৃথ্বীরে অসংখ্য চুম্বন কর আলিঙ্গনে সর্ব অঙ্গ ঘিরে তরঙ্গবন্ধনে বাঁধি , নীলাম্বর অঞ্চলে তোমার সযত্নে বেষ্টিয়া ধরি সন্তর্পণে দেহখানি তার সুকোমল সুকৌশলে । এ কী সুগম্ভীর স্নেহখেলা অম্বুনিধি , ছল করি দেখাইয়া মিথ্যা অবহেলা ধীরি ধীরি পা টিপিয়া পিছু হটি যাও দূরে , যেন ছেড়ে যেতে চাও ; আবার আনন্দপূর্ণ সুরে উল্লসি ফিরিয়া আসি কল্লোলে ঝাঁপায়ে পড় বুকে — রাশি রাশি শুভ্রহাস্যে , অশ্রুজলে , স্নেহগর্বসুখে র্আদ্র করি দিয়ে যাও ধরিত্রীর নির্মল ললাট আশীর্বাদে । নিত্যবিগলিত তব অন্তর বিরাট , আদি অন্ত স্নেহরাশি — আদি অন্ত তাহার কোথা রে! কোথা তার তল! কোথা কূল! বলো কে বুঝিতে পারে তাহার অগাধ শান্তি , তাহার অপার ব্যাকুলতা , তার সুগভীর মৌন , তার সমুচ্ছল কলকথা , তার হাস্য , তার অশ্রুরাশি! — কখনো-বা আপনারে রাখিতে পার না যেন , স্নেহপূর্ণস্ফীতস্তনভারে উন্মাদিনী ছুটে এসে ধরণীরে বক্ষে ধর চাপি নির্দয় আবেগে ; ধরা প্রচণ্ড পীড়নে উঠে কাঁপি , রুদ্ধশ্বাসে ঊর্ধ্বশ্বাসে চীৎকারি উঠিতে চাহে কাঁদি , উন্মত্ত স্নেহক্ষুধায় রাক্ষসীর মতো তারে বাঁধি প্রকাণ্ড প্রলয়ে । পরক্ষণে মহা অপরাধীপ্রায় পড়ে থাকে তটতলে স্তব্ধ হয়ে বিষণ্ন ব্যথায় নিষণ্ন নিশ্চল — ধীরে ধীরে প্রভাত উঠিয়া এসে শান্তদৃষ্টি চাহে তোমাপানে ; সন্ধ্যাসখী ভালোবেসে স্নেহকরস্পর্শ দিয়ে সান্ত্বনা করিয়ে চুপেচুপে চলে যায় তিমিরমন্দিরে ; রাত্রি শোনে বন্ধুরূপে গুমরি ক্রন্দন তব রুদ্ধ অনুতাপে ফুলে ফুলে । আমি পৃথিবীর শিশু বসে আছি তব উপকূলে , শুনিতেছি ধ্বনি তব । ভাবিতেছি , বুঝা যায় যেন কিছু কিছু মর্ম তার — বোবার ইঙ্গিতভাষা-হেন আত্মীয়ের কাছে । মনে হয় , অন্তরের মাঝখানে নাড়ীতে যে-রক্ত বহে , সেও যেন ওই ভাষা জানে , আর কিছু শেখে নাই । মনে হয় , যেন মনে পড়ে যখন বিলীনভাবে ছিনু ওই বিরাট জঠরে অজাত ভুবনভ্রূণ-মাঝে , লক্ষকোটি বর্ষ ধ ' রে ওই তব অবিশ্রাম কলতান অন্তরে অন্তরে মুদ্রিত হইয়া গেছে ; সেই জন্মপূর্বের স্মরণ , গর্ভস্থ পৃথিবী ' পরে সেই নিত্য জীবনস্পন্দন তব মাতৃহৃদয়ের — অতি ক্ষীণ আভাসের মতো জাগে যেন সমস্ত শিরায় , শুনি যবে নেত্র করি নত বসি জনশূন্য তীরে ওই পুরাতন কলধ্বনি । দিক্ হতে দিগন্তরে যুগ হতে যুগান্তর গণি তখন আছিলে তুমি একাকিনী অখণ্ড অকূল আত্মহারা , প্রথম গর্ভের মহা রহস্য বিপুল না বুঝিয়া । দিবারাত্রি গূঢ় এক স্নেহব্যাকুলতা , গর্ভিণীর পূর্বরাগ , অলক্ষিতে অপূর্ব মমতা , অজ্ঞাত আকাঙ্ক্ষারাশি , নিঃসন্তান শূন্য বক্ষোদেশে নিরন্তর উঠিত ব্যাকুলি । প্রতি প্রাতে উষা এসে অনুমান করি যেত মহাসন্তানের জন্মদিন , নক্ষত্র রহিত চাহি নিশি নিশি নিমেষবিহীন শিশুহীন শয়ন-শিয়রে । সেই আদিজননীর জনশূন্য জীবশূন্য স্নেহচঞ্চলতা সুগভীর , আসন্ন প্রতীক্ষাপূর্ণ সেই তব জাগ্রত বাসনা , অগাধ প্রাণের তলে সেই তব অজানা বেদনা অনাগত মহাভবিষ্যৎ লাগি হৃদয়ে আমার যুগান্তরস্মৃতিসম উদিত হতেছে বারম্বার । আমারো চিত্তের মাঝে তেমনি অজ্ঞাতব্যথাভরে , তেমনি অচেনা প্রত্যাশায় , অলক্ষ্য সুদূর-তরে উঠিছে মর্মর স্বর । মানবহৃদয়-সিন্ধুতলে যেন নব মহাদেশ সৃজন হতেছে পলে পলে , আপনি সে নাহি জানে । শুধু অর্ধ-অনুভব তারি ব্যাকুল করেছে তারে , মনে তার দিয়েছে সঞ্চারি আকারপ্রকারহীন তৃপ্তিহীন এক মহা আশা — প্রমাণের অগোচর , প্রত্যক্ষের বাহিরেতে বাসা । তর্ক তারে পরিহাসে , মর্ম তারে সত্য বলি জানে , সহস্র ব্যাঘাত-মাঝে তবুও সে সন্দেহ না মানে , জননী যেমন জানে জঠরের গোপন শিশুরে , প্রাণে যবে স্নেহ জাগে , স্তনে যবে দুগ্ধ উঠে পূরে । প্রাণভরা ভাষাহরা দিশাহারা সেই আশা নিয়ে চেয়ে আছি তোমা পানে ; তুমি সিন্ধু , প্রকাণ্ড হাসিয়ে টানিয়া নিতেছ যেন মহাবেগে কী নাড়ীর টানে আমার এ মর্মখানি তোমার তরঙ্গ-মাঝখানে কোলের শিশুর মতো । হে জলধি , বুঝিবে কি তুমি আমার মানবভাষা । জান কি তোমার ধরাভূমি পীড়ায় পীড়িত আজি ফিরিতেছে এ-পাশ ও-পাশ , চক্ষে বহে অশ্রুধারা , ঘন ঘন বহে উষ্ণ শ্বাস । নাহি জানে কী যে চায় , নাহি জানে কিসে ঘুচে তৃষা , আপনার মনোমাঝে আপনি সে হারায়েছে দিশা বিকারের মরীচিকা-জালে । অতল গম্ভীর তব পীড়িয়া নাড়িয়া যেন টুটিয়া ফেলিয়া একেবারে অসীম অতৃপ্তিমাঝে গ্রাসিতে নাশিতে চাহ তারে অন্তর হইতে কহ সান্ত্বনার বাক্য অভিনব আষাঢ়ের জলদমন্দ্রের মতো ; স্নিগ্ধ মাতৃপাণি চিন্তাতপ্ত ভালে তার তালে তালে বারম্বার হানি , সর্বাঙ্গে সহস্রবার দিয়া তারে স্নেহময় চুমা , বলো তার ‘ শান্তি , শান্তি ' , বলো তারে ‘ ঘুমা , ঘুমা , ঘুমা ' ।