সমান্তরালের রহস্য – ৫

গাড়ির ভিতরে তিনকড়ি আর এক্কি বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাঁদের ওপর দিয়ে যেন সাতশো সাইক্লোন বয়ে গেছে। কেমন যেন একটা বিশাল ঘূর্ণিজালের মধ্যে দিয়ে তাঁদের গাড়িটা নিমেষের মধ্যে বেরিয়ে গেল। দুটো ফানেলের সরু দিক জুড়লে যেমন একটা দু’মুখো ফানেল হয়, তাঁরা যেন তেমনই একটা বিশাল দু’মুখো ফানেলের এক মুখ দিয়ে ঢুকে আর-এক মুখ দিয়ে নিমেষের মধ্যে বেরিয়ে গেলেন। তারপর আবার সেই থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে গাড়িটা থামল।

তিনকড়ি একটু ভয়ই পেয়ে গেছেন। তাঁরা গাড়ির বাইরে নেমে দাঁড়ালেন। এই অগস্ট মাসে এত ঠান্ডা পড়ল কী করে? তা ছাড়া পাড়াটাও কেমন যেন অন্ধকার। তাঁদের নিজেদের পাড়া বলেই তো মনে হচ্ছে, কিন্তু কেমন যেন পালটে গেছে! কতগুলো বাড়ি তো দেখতেই পাচ্ছেন না! পাড়ার লোকজনও বিশেষ কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এ কোথায় এলেন তাঁরা? তিনকড়ি আর এক্কি এগিয়ে যেতে থাকেন।

গাড়ির ডিকিটা খুলে গেল। অধীরের গ্যারেজে গোলমাল শুনে আর-একজন লুঙ্গি পরা লোক আর একটা ইয়ং ছেলেকে গ্যারেজে হঠাৎ করে ঢুকতে দেখে, লোকটা গাড়ির ডিকিতে লুকিয়ে পড়েছিলেন। ডিকির ভিতর থেকে এবার বেরিয়ে এসে একটা সিগার ধরালেন তিনি। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন গাড়ির সামনের দিকে। গাড়ির দরজাটা খুলে ভেতরে উঁকি মেরে কন্ট্রোল প্যানেলের স্ক্রিনে নজর রাখেন লোকটা। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে— ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪২। লোকটার চোখমুখ উত্তেজনায় ভরে উঠেছে।

এমন সময় হঠাৎ পিছনে একটা শব্দ শুনে লোকটা ঘুরে তাকালেন। বাড়ির দরজায় ফলক দেখা যায়— ৭ রামকৃষ্ণ লেন। আরে! এ তো অধীরেরই ঠিকানা। সেই বাড়ি থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে এক বছর তিরিশের যুবক বেরিয়ে এলেন। যুবকটার কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব, চুল-দাড়ি উসকোখুসকো। পরনে একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি আর পায়জামা, কাঁধে একটা ঝোলা। বাড়ি থেকে বেরিয়েই তিনি কপালে হাতজোড় করে বললেন, “জয়দেব জয়দেব শ্রীগুরু ভৃগু, নির্গুণ নিরাকার ত্রিকালদর্শী।”

লোকটা যুবকটির কাছে এগিয়ে গেলেন। কাছ থেকে তাঁকে দেখে অবাক হওয়ারই কথা। এঁকে যে কিছুটা অধীরের মতোই দেখতে। যুবক অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, “কাউকে খুঁজছেন নাকি?”

“আচ্ছা অধীর চৌধুরী…”

“আমার নাম সুধীরচন্দ্র চৌধুরী। অধীর চৌধুরী নামে এখানে তো কেউ থাকে না!” এই বলে যুবকটা এগিয়ে যান।

সুধীর চৌধুরী! তা হলে হিসেব ঠিকই দাঁড়িয়েছে। ঠিক সময়েই তিনি এসে পড়েছেন। অধীর তাঁর সেই রিসার্চ পেপার তাঁর এই ঠাকুরদা সুধীর চৌধুরীকেই তো উৎসর্গ করেছিলেন। একবার ২৫ ডিসেম্বর উপলক্ষে অধীর ইনস্টিটিউটের সবাইকে কেক খাইয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সেদিনই ছিল তাঁর ঠাকুরদার বিবাহবার্ষিকী। তাঁর জীবনের অনেক মজার গল্পও বলেছিলেন। তা হলে এই সেই পাগল জ্যোতিষী!

হঠাৎ লোকটা বলে ওঠেন, “সুধীরবাবু, আপনার ছেলের নাম অনিল চৌধুরী রাখবেন ঠিক করেছেন তো? কিন্তু আপনার তো বিয়েই হবে না। আর হ্যাঁ, আজ রাতে জাপানিরা কলকাতায় বোমা ফেলবে। তবে বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হবে না।”

সুধীর ঘুরে তাকালেন, কথাটা তাঁকে চমকে দিল। কিন্তু তাঁর নেমন্তন্ন বাড়িতে যাওয়ার তাড়া থাকায় তিনি আর দাঁড়ালেন না। তাঁর যে বিয়ে হবেই না সেটা সুধীরের থেকে ভাল আর কে-ই বা জানে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, জাপানিরা ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ শানাচ্ছে— এই খবর সুধীরের কানে এসেছে। মার্চ মাসে জাপানিরা বর্মার রেঙ্গুন দখল করে নেওয়াতে বর্মা থেকে চালের আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। চালের দাম ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে, লোকজন বলছে যে এটা দুর্ভিক্ষের লক্ষণ। যদিও সুধীর গণনা করে দেখেছেন যে, বাংলায় দুর্ভিক্ষ হবে না, তবুও এই সর্বনাশা যুদ্ধ কবে শেষ হবে কে জানে। তার ওপর সবাই বলাবলি করছে, যে-কোনও দিন জাপানিরা কলকাতায় বোমা ফেলতে পারে। ওদের টার্গেট নাকি হাওড়া ব্রিজ। সেই আতঙ্কে কলকাতা ছেড়ে সবাই পালাচ্ছে, ব্ল্যাক আউট চলছে। সুধীরের ওইসব নিয়ে চিন্তা নেই, তিনি নিজে গণনা করে দেখেছেন যে জাপানিরা কলকাতায় বোমা ফেলবে না, তাই এই উটকো তথ্য সুধীরকে বিব্রত করে না। তিনি নিশ্চিন্তে এগিয়ে চলেন তাঁর গন্তব্যস্থলের দিকে। আজ তাঁর বন্ধু সাতকড়ির ছেলের অন্নপ্রাশন।

১০ রামকৃষ্ণ লেনের বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধেছে। সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় একজন নামজাদা ঘটক। কিন্তু এমন একজন বাঘা লোকও নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত, একটা বছর ষাটের লোক এসে সেই বাড়ির দাবি ফলাচ্ছেন। লোকটার সঙ্গে একটা বছর পঁচিশের ছোকরা। ছোকরাটার সাজপোশাক খুবই সন্দেহজনক। ছেঁড়া জিন্‌স প্যান্ট দেখে মনে হয় ভিখারি, এদিকে চুলের বাহার দেখে মনে হয় ইংরেজ। তাই ছেলেটাকে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু ওই বুড়ো মতন লোকটার মেজাজ দেখে কেউ মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। লোকটার বক্তব্য, এই বাড়ি নাকি তাঁর। একটু আগে নাকি উনি খেতে খেতে এঁটো হাতে উঠে গেছিলেন, এর মধ্যে এই বাড়ির দখল নিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাড়িটা নাকি দোতলা ছিল, হঠাৎ করে একতলা হয়ে গেছে। সাতকড়ি যতই বলেন যে, এই বাড়িতে তাঁর দুই পুরুষে বাস, লোকটা তেড়েফুঁড়ে বলেন তাঁর নাকি চার পুরুষে বাস। এই নিয়ে লেগেছে জোর বচসা।

এক্কির মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। ওর অধীরকাকা কি তা হলে তাঁর স্বপ্নপূরণ করে ফেলেছেন? এক্কি আর উত্তেজনা চেপে রাখতে পারে না। সে সাতকড়িকে প্রশ্ন করে বসে, “আচ্ছা, বাইরে এত অন্ধকার কেন?”

সাতকড়ি প্রশ্ন শুনে হাসবেন কি কাঁদবেন বুঝতে না পেরে বলেন, “বোঝো! আপনারা কোথা থেকে এলেন বলুন তো! কলকাতায় ব্ল্যাক আউট চলছে সেটা জানেন না?”

“ব্ল্যাকআউট? আচ্ছা আজ এখানে কার অন্নপ্রাশন হচ্ছে?”

“কেন? আমার ছোটছেলে গোবরার। ভাল নাম পাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায়।”

নাম শুনে তিনকড়ি লাফিয়ে ওঠেন, “পাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায়! সে তো আমার বাবার নাম! হ্যাঁ, বাবার ডাকনামও তো গোবরা!”

সবাই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকান। এক্কি তার বাবার হাত টিপে ধরে তাঁকে সংযত করে সাতকড়িকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার নাম?”

“শ্রীযুক্ত সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়, পিতা ঈশ্বর নকড়ি চট্টোপাধ্যায়।”

তিনকড়ি আবার হা হা করে উঠতে গিয়ে সামলে নিয়ে এক্কিকে চুপিচুপি বলেন, “সাতকড়ি চট্টো… সে তো আমার ঠাকুরদার নাম!”

“আর তোমার ঠাকুরদার বাবার নাম নকড়ি চট্টোপাধ্যায়।”

“হ্যাঁ! বাঃ! তোর পূর্বপুরুষদের নাম বেশ মনে আছে দেখছি এককড়ি।”

এক্কি মনে মনে ভাবে, এ তো পাতি অ্যারিথমেটিক প্রোগ্রেশন।

এক্কি আবার সাতকড়িকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, আজ কত তারিখ?”

“১০ পৌষ ১৩৩৯, ইংরেজিতে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪২।”

তিনকড়ি আঁতকে ওঠে। এক্কি তিনকড়িকে একটা ধারের দিকে নিয়ে এসে চুপিচুপি তাঁকে বলে, “বাবা, তুমি কি এখনও কিছু বুঝতে পারছ না?”

“কী বুঝতে হবে তাই তো বুঝতে পারছি না!”

“ওই ভদ্রলোক তোমার ঠাকুরদা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়, ওই মহিলা যিনি ওই বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে, উনি হচ্ছেন তোমার ঠাকুরমা আর ওঁর কোলের ওই সাত মাসের বাচ্চাটা আর কেউ নন, তোমার বাবা বা আমার ঠাকুরদা পাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায়!”

তিনকড়ির চোখের দুই মণি তৃতীয় নয়নে ঠেকবার মতো অবস্থা, “কী বলছিস রে! এ তো ভুতুড়ে ব্যাপার! তাই তো! ঠাকুরদার মুখটা তো একেবারে ওই লোকটার মতোই দেখেছি ছবিতে। তবে কি আমাদের ভূতে পেল নাকি? নাকি আমরাই মরে ভূত হয়ে গেছি! এই অধীরের ভুতুড়ে গাড়িতে উঠে আমাদের কী সর্বনাশ হল রে এককড়ি!”

তিনকড়ি রামনাম জপতে জপতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান, পিছন পিছন এক্কিও ছোটে। রাস্তার এক কোণে এক্কি তার বাবাকে ধরে থামায়।

“বাবা, তুমি কি এখনও বুঝে উঠতে পারলে না? এই যে গাড়িটায় আমরা উঠেছিলাম সেটা কোনও গাড়ি নয়, সেটা আসলে একটা টাইম মেশিন!”

“কীসের মেশিন?”

“টাইম মেশিন! এটা এমনই এক যন্ত্র যা তোমায় অতীত বা ভবিষ্যতে নিয়ে যেতে পারে। আমি জানি, অধীরকাকা বহু বছর ধরে এই ব্যাপারে রিসার্চ করছে। আমরা এখন ১৯৪২ সালের চব্বিশে ডিসেম্বরে আছি।”

“মানে! অধীরের সঙ্গে থেকে থেকে তোরও কি মাথাটা বিগড়েছে?”

“নিজেই বোঝার চেষ্টা করো। অগস্ট মাসে হঠাৎ শহরে এত শীত পড়ল কেন? চারদিকে এত অন্ধকার কেন? জাপানিদের বোমার ভয়ে এখন কলকাতায় ব্ল্যাক আউট চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আর আজকের দিনেই তোমার বাবার অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান হচ্ছে।”

সুধীরকে জাপানিদের বোমা ফেলার খবরটা দিয়ে উপাধ্যায় টাইম মেশিনে ফিরে আসেন। উত্তেজনায় তিনি ছটফট করছেন। খুব সন্তর্পণে তাঁকে কাজটা সেরে ফেলে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই তিনি নিজেই নিজের জালে জড়িয়ে পড়বেন। নিজের কোটের পকেট থেকে অধীরের থিসিস পেপারগুলো বের করলেন উপাধ্যায়।

ঠিক এই সময় পুলিশের একটা গাড়ি এসে থামল এলাকায়। পুলিশের এক কর্তাব্যক্তি জ্যাকসন টহল দিতে এসেছিলেন এলাকায়, রাস্তায় ওই অদ্ভুত গাড়ি দেখে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবীরা যেমন খেপে উঠেছে, এ গাড়ি তাদের আমদানি কি না কে জানে! এমন গাড়ি তিনি বিলেতেই দেখেননি কোনওদিনও, এই পোড়া দেশে এটা কোথা থেকে এল? জাপানিদের কারসাজি নাকি? ব্যাপারটা তলিয়ে দেখার জন্য জ্যাকসনসাহেব নিজের গাড়ি থেকে নেমে চুপিচুপি এগিয়ে যান। তিনি দেখেন গাড়ির ভিতরে এক ভারিক্কি চালের ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে বসে একটা কাগজে কী যেন লিখছেন। লেখা শেষ করে কাগজটা মুড়ে একটা খামে ভরে লোকটা গাড়ি থেকে নেমে যান। জ্যাকসন লুকিয়ে দেখতে থাকেন। ৭ রামকৃষ্ণ লেনের বাড়ির সদর দরজায় লোকটা কাগজটা ফেলে রেখে চুপিচুপি ফিরে আসেন গাড়িতে। জ্যাকসন এগিয়ে যান সেই বাড়ির দিকে, তাঁকে দেখতে হবে সেই কাগজে কী লেখা আছে। এটা নির্ঘাত কোনও গোপন চিঠি বিপ্লবী দলের, কিংবা জাপানিদের কোনও এজেন্ট এই চিঠির মারফত খবর পাঠাতে চাইছে। এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিতে পারলেই জ্যাকসনসাহেবের নির্ঘাত একটা রেড ক্রশ বাঁধাধরা। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন তিনি।

অনেকদিন ধরে জ্যাকসন দেশে ফেরার ছুতো খুঁজছেন, কিন্তু ওপরমহল তাঁর আর্জি কিছুতেই মঞ্জুর করছেন না। এই এজেন্টকে ধরিয়ে দিতে পারলেই তাঁর কাজ হয়ে যাবে। এই পোড়া দেশে গরমে জ্যাকসন নাজেহাল হয়ে পড়েছেন। তার ওপর তাঁর একবার ম্যালেরিয়া হয়ে গেছে। এখান থেকে পালাতে পারলে তিনি বাঁচেন।

ইতিমধ্যে উপাধ্যায় গাড়িতে ফিরে কন্ট্রোল প্যানেলে তারিখ আর সময় সেট করেন, ১৩ অগস্ট ২০১৭ রাত ৯টা ৩০ মিনিট। গাড়ির মধ্যে মেন সুইচ বুঝে নিতে উপাধ্যায়ের অসুবিধা হল না। গাড়ির কলকবজা অধীর বেশ ‘ইউজ়ার ফ্রেন্ডলি’ ভাবেই বানিয়েছেন। মেন সুইচ টিপতেই আবার সেই আলোর ঝলকানি, প্রবল কম্পন এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘূর্ণিজালের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া।

একটা বিকট শব্দে জ্যাকসনসাহেবের ঘোর কাটে। তিনি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন সেই গাড়ি হঠাৎ উজ্জ্বল আলোয় বর্ণময় হয়ে উঠে সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল। নিজের দেশে থাকতে জ্যাকসন শুনেছিলেন যে ভারত ‘মিস্টিসিজ়ম’-এর দেশ। এখানকার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নাকি মন্তর-তন্তর জানে। এ কি তেমনই একটা ব্যাপার নাকি? সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকসনের পতন এবং মূর্ছা।

অধীরের গ্যারেজে টাইম মেশিন আবার ফিরে এল। এখন ১৩ অগস্ট ২০১৭, রাত সাড়ে ন’টা। উপাধ্যায় একটা বড় দম নিলেন। মেশিনের টাইম সেট করলেন ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪২, সকাল আটটা। বাইরে একটা ট্যাক্সি এসে থামে, তার থেকে অধীর, কল্যাণী আর রিয়া নামেন। অধীর ছুটে আসেন তাঁর গ্যারেজে। অধীরকে ঢুকতে দেখেই উপাধ্যায় গ্যারেজের দরজার পিছনে লুকিয়ে পড়েন। অধীরের পিছন পিছন রিয়া আর কল্যাণীও গ্যারেজে আসেন। তাঁরা বুঝতে পারেন যে, কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে, কিন্তু সেটা কী তা তাঁদের বোধগম্য হল না। সবাই গ্যারেজের ভেতরে ঢুকে পড়লে, সুযোগ বুঝে চুপিচুপি উপাধ্যায় গ্যারেজ থেকে পালালেন। অধীর তাঁর টাইম মেশিনকে নিজের জায়গায় দেখে আশ্বস্ত হন। তিনি এক্কিকে ফোন করলেন, কিন্তু নাম্বার নট রিচেবল। অধীর রিয়াকে বললেন একবার এক্কির বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতে।

রিয়া খোঁজ নিয়ে এসে জানায় যে, তিনকড়ি আর এক্কি খেতে খেতে ঝগড়া করে উঠে যান, তিনকড়ি খুবই উত্তেজিত ছিলেন। কিন্তু তার পর থেকে তাঁরা আর ফিরে আসেননি।

অধীর খুবই চিন্তায় পড়লেন। তিনকড়ি আর এক্কি যদি না ফেরেন তা হলে টাইম মেশিন ফিরে এল কী করে? অধীরের এই মেশিন সম্পর্কে তার স্ত্রী বা মেয়ের কোনও ধারণাই নেই। এই অবস্থায় তাঁদের সব কথা খুলে বলা উচিত হবে কি না তাও অধীর বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি লক্ষ করলেন, মেশিনে টাইম সেট করা ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪২, সকাল আটটা। এটা কী করে হল? তিনি তো এর টাইম কিছু সেট করে রাখেননি। তা হলে কি…

রিয়া তার বাবার খুব একটা ঘনিষ্ঠ না হলেও অধীরের হাবভাবের সঙ্গে সে ভালই পরিচিত। সে বুঝতে পারে খুব বড়সড় কিছু গন্ডগোল হয়েছে। রিয়া অধীরের রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে খুব তীক্ষ্ণ নজরে তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এক্কি আর তিনকড়িকাকা কোথায়?”

অধীর বুঝতে পারেন যে, আর লুকিয়ে রেখে কোনও লাভ হবে না। এই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাঁর টাইম মেশিন ব্যবহৃত হয়েছে এবং তিনকড়ি-এক্কি তাতে উঠেছিলেন— তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। মেশিনের ডেট দেখে অধীর বুঝতে পেরেছেন তাঁরা কোন সময়ে গেছেন। রিয়া আবার জিজ্ঞেস করে, “কী হল? ওরা কোথায়?”

“১৯৪২,” অধীরের সংক্ষিপ্ত জবাব।

রিয়া প্রচণ্ড অবাক আর বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তার মানে?”

“মানে বোঝানোর সময় এখন আমার নেই। আমায় যেতে হবে।”

কল্যাণী এগিয়ে এসে অধীরের রাস্তা জুড়ে দাঁড়ান।

“কোথায় যাবে তুমি?”

অধীর একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বললেন, “২৫ ডিসেম্বর ১৯৪২, ওদের ফিরিয়ে আনতে।”

কল্যাণী আর রিয়া প্রবল অবিশ্বাসের নজরে একে অপরের দিকে তাকালেন। অধীর নিজের টাইম মেশিনে উঠে বসলেন। কল্যাণী নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কতদিন ধরে তিনি তাঁর স্বামীকে দেখে আসছেন গ্যারেজে এই অদ্ভুত গাড়িটা নিয়ে কীসব করতে। দু’-একবার অধীরকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন এই গাড়িটার ব্যাপারে, কিন্তু অধীরের থেকে কোনও সদুত্তর কখনও পাননি। আজ কল্যাণী বুঝতে পেরেছেন যে, কোন অসম্ভবের সাধনায় অধীর এতদিন মত্ত ছিলেন। শ্রদ্ধায় কল্যাণীর মাথা নত হয়ে আসে। কিন্তু এও কি সম্ভব?

রিয়া এগিয়ে এসে টাইম মেশিনে উঠে বসে অধীরের পাশে। অধীর একবার রিয়ার দিকে তাকান, রিয়া খুব দৃঢ় নজরে একবার অধীরের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে তাকায়। অধীর হাল ছেড়ে দিয়ে টাইম মেশিন চালু করতে যান। কল্যাণীর চোখে একরাশ অবিশ্বাস-মিশ্রিত দুশ্চিন্তা। তাঁর দিকে তাকিয়ে অধীর বলেন, “আমরা ফিরে আসব, কিছুক্ষণের মধ্যেই। চিন্তা কোরো না।”

বর্তমানে… এই রে, এখানে যখন সময় ব্যাপারটাই আপেক্ষিক হয়ে গেছে তাই আর বর্তমান বা অতীত বা ভবিষ্যৎ জাতীয় অনর্থক শব্দ ব্যবহার না করাই ভাল। স্থান-কাল-পাত্র হিসেবেই আমরা ব্যাপারটা বরং দেখি।

স্থান: সাতকড়ির বাড়ি।

কাল: ১৯৪২ সালের ২৪ ডিসেম্বর, রাত সাড়ে আটটা।

পাত্র: তিনকড়ি, এক্কি, সাতকড়ি, সাতকড়ির শ্যালক কালীকিঙ্কর, সাতকড়ির স্ত্রী উমা আর তাঁদের সাত মাসের পুত্রসন্তান পাঁচকড়ি।

তিনকড়ি যে নিজের বাবার অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন খেতে এসে পড়েছেন, এই কথা বিশ্বাস করতে তাঁকে একবার অজ্ঞান হয়ে পড়তেই হয়। অতি কষ্টে পূর্বপুরুষদের সাহায্যে এক্কি তিনকড়ির জ্ঞান ফিরিয়েছিল। বর্তমানে সাতকড়ির ঘরের পালঙ্কে তিনকড়ি শুয়ে, তাঁর মাথায় পাখার বাতাস করছে এক্কি। সাতকড়ি, সাতকড়ির শ্যালক কালীকিঙ্কর আর সাতকড়ির স্ত্রী উমা তাঁদের সাত মাসের পুত্রসন্তান পাঁচকড়িকে কোলে নিয়ে ঘরে উপস্থিত। সাতকড়ি তিনকড়ির থেকে সমস্ত কথা শুনে তিনকড়ির মুখের কাছে কয়েকবার নিজের নাক নিয়ে গিয়ে শুঁকে দেখেছেন তিনকড়ির মুখ থেকে কোনওরকম দ্রব্যাদির গন্ধ বেরোচ্ছে কি না। গন্ধ কিছুই পাওয়া যায়নি। এমন আজগুবি কথা যে-কোনও লোকের পক্ষেই বিশ্বাস করা কঠিন। সাতকড়ির শ্যালক কালীকিঙ্কর পাবনা জেলার বাসিন্দা, তাঁর ঘোরতর সন্দেহবাতিক। সাতকড়িকে কালীকিঙ্কর সাবধান করেছেন আগেই, “জামাইবাবু, দিনকাল তো ভাল নয়। যুদ্ধের লগে চারদিকে আকাল লাগব লাগব করতাসে, আমার মনে হয় এরা ওই হাঘরেদের মধ্যে কেউ হইব। নেমন্তন্ন বাড়ি দেইখা খাওনের লগে ঢুইকা পড়েসে। দেখসেন না, (তিনকড়ির লুঙ্গি আর আধখোলা জামা দেখিয়ে) লোকটার জামাকাপড়ের কী দশা, (এক্কির হালফ্যাশনের ছেঁড়া জিন্‌স দেখিয়ে) আর ওই ছোঁড়াটা তো ছেঁড়া প্যান্টুলুন পইরাসে।”

সাতকড়ি গম্ভীর হয়ে তিনকড়ি আর এক্কিকে বললেন, “দেখুন মশাইরা, আজকের এই শুভ দিনে যদি আপনারা আমার ছেলেকে আশীর্বাদ করে খাওয়াদাওয়া সেরে…”

“কী বলছ ঠাকুরদা! আমি আমার বাবাকে আশীর্বাদ করব!” লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা তিনকড়ির। কালীকিঙ্কর চটে ওঠেন, “মশকরা পেয়েসেন আমাগো লগে! আইজ পাঁচকড়ির অন্নপ্রাশন, আর আপনারা হইলেন গিয়া নাকি পাঁচকড়ির ছেলে আর নাতি! আমাগো বলদ ঠাউরেসেন!”

তিনকড়িও দমবার পাত্র নন। তিনি কালীকিঙ্করকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন, “কী মুশকিল মামাদাদু, আমার কথা বিশ্বাস করুন! যদিও খুবই আজগুবি ব্যাপার, তবুও আমার বাবার দিব্যি খেয়ে বলছি ব্যাপারটা সত্যি।”

হঠাৎ শিশু পাঁচকড়ি উমার কোলে কাঁদতে শুরু করেছে। উমা পরদার আড়াল থেকে চেঁচিয়ে ওঠেন, “ওই দেখো! ছেলের নামে দিব্যি গালতেই ছেলে আমার কাঁদতে শুরু করেছে! কী হবে গো!”

তিনকড়ি পরদার দিকে এগিয়ে যান। শিশু পাঁচকড়ির উদ্দেশে বলেন, “বাবা গো, তুমি কাঁদছ কেন বাবা? কেঁদো না বাবা গো! ঠাগমা গো, তুমি বাবার কান্না থামাও গো ঠাগমা!”

উমার বয়স এখন বাইশ। এই বয়সে একজন ষাটোর্ধ্ব লোকের মুখে ‘ঠাগমা’ ডাক শুনে ঘোমটা আরও টেনে নিয়ে ঝাঁজিয়ে উঠে তিনকড়িকে গালমন্দ করতে শুরু করলেন।

“মর মর হতভাগা মিনসে! ড্যাকরা আমায় ঠাগমা বলে ডাকে!”

তিনকড়ি লাফিয়ে ওঠেন আনন্দে, “এই তো! এই তো আমার ঠাগমা! আমার মা’র কাছে তোমার কত গল্প শুনেছি গো ঠাগমা! এমন কত বাছা বাছা গালাগাল তুমি মাকে দিয়েছ ঠাগমা গো!”

উমা আরও তেতেপুড়ে ওঠেন, “আঁটকুড়ির ব্যাটার মরণ হয় না কেন!” সাতকড়িকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “তোমরা সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই পাগলামি দেখবে? এই বুড়ো ভামকে বের করে দিতে পারছ না?”

সাতকড়ি আর কালীকিঙ্কর এগিয়ে এসে তিনকড়িকে টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনকড়ি চিৎকার করে যান, “বাবা গো, আমি তোমায় জীবনে অনেক দুঃখ দিয়েছি গো! তোমার কত শখ ছিল গো আমি যেন একটা ঘটকালি শেখানোর ইসকুল খুলতে পারি। হাজার হাজার ঘটক আমাদের ইসকুল থেকে পাশ করে দেশময় ছড়িয়ে পড়বে…”

সাতকড়ি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। সাতকড়ি একজন নামজাদা ঘটক। অনেক বোবা, কালা, কানা, খোঁড়া সাতকড়ির কেরামতিতে ছাদনাতলা পার হয়ে গেছে। অন্য সব শিক্ষণীয় বিষয়ের মতো ঘটকালিও তো একটা ঘোরতর শিক্ষণীয় বিষয়। তাই সাতকড়ির সুপ্ত বাসনা, সে একটা ঘটকালি শেখানোর ইসকুল খুলবে। হাজার হাজার ঘটক সেই ইসকুল থেকে পাশ করে সারা দেশময় ছড়িয়ে পড়বে। সাতকড়ির এই ইচ্ছের ব্যাপারে এখনও কেউ কিচ্ছু জানে না। কিন্তু সেই কথা এই উটকো লোকটা জানল কী করে? তিনি বলছেন, সাতকড়ির ছেলে পাঁচকড়ি নাকি সত্যিই এমন একটা ঘটকালি শেখানোর প্রাইমারি ইসকুল খুলতে চেয়েছিল। তা হলে কি লোকটা সত্যি কথা বলছেন? সাতকড়ি তিনকড়িকে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করেন।

“এই মশাই! আপনার বাবার ইচ্ছে ছিল ঘটকালির ইসকুল খোলার? এ তো আমার ইচ্ছে!”

তিনকড়ি আশার আলো দেখতে পান, “তা কি আর আমি জানি না ঠাকুরদা! তুমিই তো আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় সাতকড়ি ঘটক। মরবার আগে তুমি যে বাবাকে বলে গিয়েছিলে তোমার অধরা স্বপ্ন সফল করতে! কত বোবা, কালা, খোঁড়া, ট্যারা, বেঁটে, মোটা তোমার কেরামতিতে পার হয়ে গেল, তা কি আমার অজানা! ঘটকালির কত সূক্ষ্ম টেকনিক তুমি আবিষ্কার করেছ! তুমি আমাদের বংশের গর্ব!”

সাতকড়ি আহ্লাদে গদগদ হয়ে পড়লেন, “বটে বটে!”

কালীকিঙ্কর তাঁর জামাইবাবুকে হাড়ে হাড়ে চেনেন। তিনি সাতকড়িকে সাবধান করলেন, “খাড়ান খাড়ান জামাইবাবু, আপনারে লইয়া কেউ ভাল ভাল কথা কইলেই আপনি গইলা যান! সবদিক বিবেচনা কইরা দেখনের লাগব তো! ভাবেন তো, আপনার বয়স বত্রিশ আর আপনার নাতির বয়স ষাটের ওপর। এইডা কেমনে সম্ভব?”

এক্কি এবার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, “এখানেই তো বিজ্ঞানী অধীর চৌধুরীর কেরামতি। তা ছাড়া বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি আমাদের সময়ে এতটাই অ্যাডভান্সড হয়ে গেছে যে, এখন সবকিছুই সম্ভব।”

এক্কি নিজের মোবাইল বের করে তাঁদের দেখিয়ে বলে, “এটাকে বলে মোবাইল ফোন, মানে…”

“মানে তারকাটা টেলিফোন,” তিনকড়ি শূন্যস্থান পুরণ করে দেন।

এক্কির ইচ্ছে ছিল ফোনটা ডেমনস্ট্রেট করে দেখানো। সিগন্যাল না থাকার জন্য ফোন বা ইন্টারনেট— কোনওটারই কেরামতি সে দেখাতে পারল না। কিন্তু এক্কি তার মোবাইল ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে তাদের সবার একসঙ্গে একটা ভিডিয়ো তুলে সবাইকে দেখায়। সেই ভিডিয়ো দেখে তো পূর্বপুরুষদের তাক লেগে গেছে। কালীকিঙ্কর পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখে বলেন, “দেখসেন জামাইবাবু, বায়োস্কোপে আমারে অনেকখান প্রমথেশ বড়ুয়ার মতন লাগতাসে।”

সাতকড়ি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বলেন, “বাবা, এসব কী অদ্ভুত ব্যাপার। তা হলে কি সত্যি সত্যি…”

এমন সময় উমা পরদার আড়াল থেকে সাতকড়িকে ডেকে বলেন, “দ্যাখো, ওই লোকটার পায়ের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে আমাদের গোবরার পায়ের বুড়ো আঙুলের কত মিল। আর ওই ছোট ছেলেটার মুখটা তো পুরো আমাদের গোবরার মুখ কেটে বসানো। তা ছাড়া কয়েকদিন আগে পাঁচু ঠাকুরের থেকে স্বপ্নাদেশ পেয়েছি, আমাদের বংশ আরও বাড়বে। এরা আমাদের সন্তান না হয়ে যায় না!”

হাইকোর্ট রায় দিয়ে দিয়েছে। সাতকড়ি উৎফুল্ল হয়ে বলেন, “ঠিক বলেছ! এই না হলে আমার গিন্নি! কালী, আমরা ঠিক করে ফেলেছি এরা যা বলছে সব সত্যি! সানাই জোরে জোরে বাজাও, উলুধ্বনি দাও!”

এক্কি সঙ্গে সঙ্গে সাতকড়িকে সাবধান করে, “দাদু, এই কথা আর কাউকে বলবেন না! কেউ তো বিশ্বাস করবেই না, উলটে আরও ঝামেলা হতে পারে।”

সাতকড়ি বলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আজ আমি আমার ছেলের সঙ্গে নাতি আর পুতি পেলাম। ওরে সোনার চাঁদ মানিক আমার! আয় আয় বুকের মধ্যে আয়।”

এক্কি আর তিনকড়িকে জড়িয়ে ধরলেন সাতকড়ি।

যুদ্ধের বাজার আর ব্ল্যাকআউটের জন্য নেমন্তন্ন বাড়িতে জাঁকজমক কিছুই করা যায়নি। খুবই অল্প আয়োজনে একমাত্র ছেলের অন্নপ্রাশন সারতে হচ্ছিল বলে সাতকড়ির আক্ষেপ ছিল। তা এখন সুদে-আসলে পুষিয়ে গেছে। নেমন্তন্ন বাড়ির সবাই এই উটকো ঝামেলা নিয়ে একটু বিব্রত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু সাতকড়ি এসে জানান যে, আগত দুই ব্যক্তি তাঁর বিশেষ পরিচিত। তাই আবার উৎসবের আমেজ ফিরে আসে বাড়িতে।

সাতকড়ির দালানের এক কোনায় নিমন্ত্রিতদের মধ্যে সুধীর বসে কয়েকজনের কুষ্ঠি বিচার করছেন। সুধীরের জ্যোতিষী হিসেবে বেশ নামডাক হয়েছে ইদানীং। শুধু তাঁর যজমানরা সুধীরের করা ভবিষ্যদ্বাণীটা উলটো করে নেয়, তা হলেই সেটা হুবহু মিলে যায়। এই নিয়ে লোকে হাসাহাসি করে, তবে সুধীর সেসব পাত্তা দেন না।

সবাই খেতে বসেছে, এমন সময় হঠাৎ করে সাইরেন বেজে উঠে অ্যালার্ট জারি হয়। খবর শোনা যায় যে, জাপানিরা কলকাতা আক্রমণ করেছে। ভয়ের চোটে সবাই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। সুধীর কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর মনে পড়ে, একটু আগে রাস্তায় দেখা হওয়া সেই অদ্ভুত লোকটার কথা, যিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আজই জাপানিরা বোমা ফেলবে কলকাতায়। তবে তিনি এটাও বলেছিলেন যে, বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হবে না। লোকটা কে ছিল?

এদিকে তিনকড়ি এক্কির সামনে হাহাকার করেন, “অধীরের জ্বালায় এই ১৯৪২ সালে আমরা না জন্মেই মরতে বসেছি। ২০১৭ সালে তোর মা একটা খবরও পাবে না!”

এক্কি বলে, “কিচ্ছু হবে না।”

তিনকড়ি ঝাঁজিয়ে উঠে বলেন, “তুই সব জানিস?”

“হ্যাঁ, আমি জানি ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪২-এ কলকাতার কোন কোন এলাকায় বোমা পড়েছিল। এই এলাকায় বম্বিং-এর কোনও এফেক্ট হবে না।”

সাতকড়ি আর কালীকিঙ্কর এক্কির কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েন।

কিছুক্ষণ পরেই বোঝা যায় যে, এক্কির কথাই সত্যি। রেডিয়োর খবরে জানা যায়, জাপানিরা কলকাতার চৌরঙ্গি, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, ম্যাঙ্গো লেন, ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট, ডালহৌসি স্কোয়ার আর সেন্ট জনস চার্চ চত্বরে বোমা ফেলেছে। ক্ষয়ক্ষতি খুবই সামান্য হয়েছে। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে ছ’জন ব্রিটিশ সৈন্য আর ম্যাঙ্গো লেনে ছ’জন ভারতীয় দারোয়ান নিহত হয়েছেন।

সাতকড়ির বিশ্বাস আরও পাকাপোক্ত হয়। এক্কি যা যা বলেছিল এই জাপানিদের বোমার ব্যাপারে, তা হুবহু মিলে গেছে। ভবিষ্যৎ মানব না হলে এসব কথা জানা সম্ভব নয়।

২৫ ডিসেম্বর ১৯৪২, সকাল সাড়ে আটটা। আজ ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গেল সুধীরের। যা হুজ্জুত গেল সারা রাত! নেমন্তন্ন বাড়ির খাওয়াদাওয়াটা একদম পণ্ড হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠেই সুধীরের প্রথম কাজ হচ্ছে তাঁর বিছানার ডানদিকে টাঙানো আদি জ্যোতিষগুরু শ্রীভৃগুর ছবির দিকে তাকিয়ে প্রণামমন্ত্র বলা। তার পরের কাজ হচ্ছে বালিশের তলা থেকে একটা ছবি বের করে তার দিকে উদাসভাবে চেয়ে থেকে ক্ষণিক কালাতিপাত। ছবিটা ভবানীপুরের দত্তবাড়ির ছোট মেয়ে সরলার, যাঁর জন্য সাতকড়ি ঘটক সুধীরের সম্বন্ধ নিয়ে গিয়েছিলেন। সুধীরকে দেখতে শুনতে ভাল, পৈতৃক বিষয়সম্পত্তিও যথেষ্ট আছে, তাই পাত্রীপক্ষের সুধীরকে বেশ ভালই মনে ধরেছিল। সরলা আর সুধীরের পরস্পরকে সবচেয়ে বেশি মনে ধরেছিল। কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ বাধ সাধল সুধীরের জ্যোতিষচর্চা। সরলার বাবা জ্যোতিষচর্চার ঘোর বিরোধী। ওঁর মতে এসব বুজরুকি ছাড়া আর কিছুই নয়। উনি শর্ত চাপালেন যে, সরলাকে বিয়ে করতে হলে সুধীরকে জ্যোতিষচর্চা ছাড়তে হবে। সুধীর সরলাকে হয়তো ভালবেসে ফেলেছেন, কিন্তু তা কখনওই তাঁর সারা জীবনের সাধনার বিনিময়ে হতে পারে না। অগত্যা দুটি তরুণ তাজা প্রাণের বিয়োগান্ত পরিণাম।

কিন্তু সুধীরের মাথায় গতকাল রাত থেকেই ঘুরছে সেই অদ্ভুত সাহেবি পোশাক পরা লোকটার কথা। যিনি আগাম জানিয়েছিলেন জাপানিদের হামলার কথা। সেই লোকটা তবে কে? সুধীর মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন যে, সরলার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হলে, তাঁদের পুত্রসন্তান জন্মালে তাঁর নাম রাখবেন অনিল আর কন্যাসন্তান হলে নাম রাখবেন নীলিমা। এই কথা তো তিনি আর কাউকে বলেননি। তা হলে লোকটা জানলেন কী করে? তিনি কি কোনও বড়সড় ত্রিকালদর্শী মহাপুরুষ? এই চিন্তা সুধীরকে গত রাত থেকেই গিলে খাচ্ছে।

সুধীর তাঁর বাড়ির বাইরে এলেন, যেমন রোজ আসেন সূর্যপ্রণাম করতে। দরজা খুলেই সুধীরের চোখে পড়ল একটা খাম। খামের ওপর সুধীরেরই নাম লেখা। খামটা খুলে সুধীর দেখলেন তাতে অনেক কাগজপত্র, আর তাঁকে উদ্দেশ করে লেখা একটা চিঠি— ‘গতকাল রাত্রে তোর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। আমি শ্রীগুরু ভৃগু, জ্যোতিষসাধনার আদি পুরুষ। আমি তোর সাধনায় তুষ্ট হইয়াছি। সেই হেতু আমার গ্রন্থ ভৃগুসংহিতা হইতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তোকে প্রদান করিলাম। এই ঘটনাগুলি এখন হইতে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ অবধি পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটিবে। এই সকল তথ্য ভবিষ্যদ্বাণী করিয়া তুই হইয়া উঠিবি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তখন তোর নাম হইবে স্বামী ত্রিকালানন্দ, কারণ তুই হইবি ত্রিকালজ্ঞানী। তোর মাহাত্ম্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। তুই এই গৃহে তোর আশ্রম নির্মাণ করাইবি। কিন্তু ইহার বিনিময়ে তোকে আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করিতে হইবে। তুই যদি ভবিষ্যতে কোনও নারীর সংসর্গ লাভ করিস, তাহা হইলে কিন্তু ঘোর অনর্থ। তুই নরকস্থ কীটে পরিণত হইবি, তোর ভবিষ্যদ্বাণী আর ফলিবে না। তদুপরি তোর ভবিষ্যৎ শিষ্যদের জন্য তুই এই নির্দেশ দিয়া যাইবি— ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের কলকাতা শাখায় পঙ্কজ উপাধ্যায় নামে এক মহামানব চাকরিতে যোগদান করিবেন। উক্ত উপাধ্যায় ভগবান শ্রী বিষ্ণুরই এক অংশ। তোর তৎকালীন শিষ্যদের গোপনে এই খামের অবশিষ্ট কাগজগুলো উক্ত উপাধ্যায়কে প্রদান করিতে হইবে। তবে খুব সাবধান। এই কাগজ যেন অতীব যত্ন করিয়া গোপন রাখা হয়। এই কাগজপত্র যদি অন্য কাহারও হস্তগত হয়, তাহা হইলে কিন্তু ঘোর অনর্থ। তোর পরকাল অত্যন্ত বেদনাদায়ক হইয়া উঠিবে এবং তোর ভবিষ্যদ্বাণী আর ফলিবে না, ভগবানের ইহাই বিধান।

পুনশ্চ: ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে অধীর চৌধুরী নামক এক দুরাচারী এই কাগজপত্র এবং তোর গৃহের উপর দাবি ফলাইতে আসিবে। ভগবানের নির্দেশে তাহাকে তৎক্ষণাৎ সংহার করিতে হইবে। তাহার কাছে এক অলৌকিক যান থাকিবে যা ভগবানের নির্দেশে উপাধ্যায়কে প্রদান করিতে হইবে।’

সুধীর সেই খামের বাকি কাগজপত্র উলটে দেখেন। তার পাতার পর পাতা শক্ত শক্ত ইংরেজিতে লেখা আর মাঝে মাঝেই কীসব দুরূহ অঙ্ক কষা, যার মাথামুন্ডু সুধীর কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। শুধু একটা কাগজ দেখে তাঁর আনন্দ বাঁধ ভাঙে। তাতে ১৯৪৩ থেকে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তারিখ সমেত নথিবদ্ধ করা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *