সমান্তরালের রহস্য – ২০

২০

আজ ১৫ অগস্ট ২০১৭। ছুটির দিন। উপাধ্যায় তাই একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে, সবে সকালের চা-টা নিয়ে নিজের বাড়ির দোতলার ব্যালকনির রকিং চেয়ারে বসেছেন। উপাধ্যায়কে নিয়ে একটা বাংলা ছবি হতে চলেছে। সুপারস্টার কুমারজিৎ, উপাধ্যায়ের ভূমিকায় অভিনয় করবেন। আজ সেই ছবি নিয়ে খবরের কাগজে একটা লেখা বেরিয়েছে। সকালের চায়ের সঙ্গে বেশ জমিয়ে সেই লেখাটা পড়বেন এবং নিজের মহিমায় নিজেই কিছুক্ষণ বিভোর হয়ে থাকবেন— এটাই ছিল উপাধ্যায়ের পরিকল্পনা। কিন্তু বাধ সাধলেন স্ত্রী। স্ত্রী মদনকে নিয়ে উপাধ্যায়ের সামনে হাজির। উপাধ্যায়কে একটা কাগজ ধরিয়ে মদন বলে, “ছ্যার, এইরকম অনেক কাগজ ওই তিকালানন্দের আচ্ছম থেকে আমায় বিক্কি করে। আমি কোনওদিনও খেয়ান করে দেখি না। কিন্তু আজ আমার ছেনেটা এই কাগজ পড়ে বনন যে এই কাগজে নাকি আপনার নাম নেকা। দেখুন তো ছ্যার, এটা কি আপনার কোনও দরকারি কাগজ?”

উপাধ্যায় দেখল, সেটা অধীর চৌধুরীর সই করা নিজের একটা অপ্রকাশিত থিসিস পেপার যার ওপরে লেখা— ‘ফর পঙ্কজ উপাধ্যায়।’

“তুই এই কাগজ কোথা থেকে পেলি?”

“ছ্যার, ওই আচ্ছমে একটা নতুন গাড়ি এয়েছে, ছেই গাড়িতে এইরকম অনেক কাগজ আছে। মহন্ত অদ্ভুতানন্দ ছেই ছব কাগজ আমায় বেচে দিচ্ছে। কেন ছ্যার? এতে আপনার দক্কাই কিছু আছে?”

উপাধ্যায়ের মাথায় কে যেন পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাল। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলেন ওই অদ্ভুতানন্দ!

উপাধ্যায় তক্ষুনি নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন আশ্রমের উদ্দেশে।

এই একই সময়ে ত্রিকালানন্দ সেবাশ্রম থেকে তিনজন সেবক তিনকড়িকে ধরে নিয়ে যেতে হাজির হয়েছে তিনকড়ির বাড়িতে। তিনকড়ির বন্ধ ঘরের সামনে তারা দাঁড়িয়ে। তাদের পিছনে মানসী, দেবু, ভোম্বল আর এক্কি (২)। ঘরের ভিতর থেকে কোনও আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। মানসী আশ্রম সেবকদের বলেন, “মাথার দোষটা প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে, তাই আমরা এই ঘরে বন্ধ করে রেখেছি। আপনারা সাবধানে নিয়ে যাবেন।”

সেবকরা সন্তর্পণে দরজার হুড়কো খোলে, তারপর দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে ঘরের ভেতর উঁকি মারে। ষাঁড়ের মতন ধেয়ে আসেন তিনকড়ি ঘরের ভিতর থেকে। সবাইকে গুঁতিয়ে ধরাশায়ী করে তিনকড়ি ছুটে বেরিয়ে যান। সেবকরা উঠে পড়ে তিনকড়িকে ধাওয়া করে, পিছন পিছন স্ত্রী-পুত্র-মিত্ররা।

ঠিক এই সময়েই সারা রাত এদিক-সেদিক ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে তিনকড়ি (২) তাঁর দোকানের সামনে হাজির হন। দোকানের ঠিক উলটো দিকেই পূর্বপুরুষরা পূর্বনারী সমেত একটা রোয়াকে বসেছিলেন। উদ্বাস্তুর মতো এই রোয়াকে বসেই তাঁদের গত রাত কেটেছে। তিনকড়ি (২)-কে দেখে আশ্বস্ত হয়ে এগিয়ে আসেন তাঁরা। সাতকড়ি বলেন, “যাক, থানা থেকে ছাড়া পেয়েছ তা হলে তিনকড়ি। সারা রাত যে আমাদের কী ভয়ে ভয়ে কেটেছে! গাড়িটা ছাড়াতে পারলে?”

“হ হ, তাড়াতাড়ি ওই গাড়ি কইরা আমাগো ছাইড়া দিয়া আইস। আমার আর ভাল লাগসে না, দ্যাশই যখন ভাগ হইয়া গেসে…”

তিনকড়ি (২)-র মেজাজ এমনিতেই খিঁচড়ে আছে। তিনি বলেন, “কী আজেবাজে বকছেন? কী নেবেন তাড়াতাড়ি বলুন, কাল সারা রাত আমার ঘুম হয়নি, আমি তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে দেব।”

সাতকড়ি একটু বিরক্ত হয়েই বলেন, “আরে তিনকড়ি, আমাদের ফেরার ব্যবস্থার কী হবে?”

“কোথায় ফিরবেন তার আমি কী জানি? কে বলুন তো আপনারা?”

কালীকিঙ্কর খেপে ওঠেন, “কী কইস? আমাগো ফুসলাইয়া এখানে লইয়া আইনা এখন আমাগো ভুইলা যাইস?”

“উফ এ তো মহা ঝামেলা! বাড়ি ছেড়ে দোকানে এসেও শান্তি নেই। এই মশাইরা, যান তো এখান থেকে, ফালতু মাথা খাবেন না!”

এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা উমার সহ্য হয় না। সাতকড়ির কোলে পাঁচকড়িকে দিয়ে ছুটে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ডাবওয়ালার থেকে একটা কাটারি নিয়ে এসে উমা তিনকড়ি (২)-কে তাড়া করেন, “তবে রে হারামজাদা! হালায় কাইটা ফেলুম!”

উমা, কালীকিঙ্কর আর সাতকড়ি (পাঁচকড়িকে কোলে নিয়ে) তিনকড়ি(২)-কে তাড়া করেন। তিনকড়ি (২) পাগলের মতন ছুটছেন।

এদিকে আশ্রমের সেবকরা, মানসী, দেবু, ভোম্বল, এক্কি (২) মিলে তিনকড়িকে তাড়া করেছেন।

তাড়া খেতে খেতে তিনকড়ি আর তিনকড়ি (২) সামনাসামনি পড়ে যান। নিজেদের জ়েরক্স কপি দেখে দু’জনেই আঁতকে ওঠেন। তিনকড়ি ছিটকে পড়েন একটা ডাস্টবিনের আড়ালে। আশ্রমের লোকজন, মানসী, দেবু, ভোম্বল, এক্কি (২) এবার তিনকড়ি (২)-কে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যান। তিনকড়ি আড়াল থেকে লুকিয়ে হাঁ করে এই দৃশ্য দেখেন। তাঁর ঘাড়ের ওপর একটা হাত পড়তে চমকে পিছনে তাকিয়ে তিনকড়ি দেখতে পান এক্কিকে। এক্কির পাশে রিয়া। তিনকড়ি একবার অবিশ্বাসের নজরে তিনকড়ি (২) আর এক্কি (২)-র দিকে তাকান। পাঁচকড়িকে কোলে নিয়ে সাতকড়ি, কালীকিঙ্কর আর উমাও সেখানে এসে অবাক হয়ে এই ভ্রান্তিবিলাসের সাক্ষী হন। এক্কি তাঁদের সবাইকে একপাশে ডাকে, “এদিকে এসো, সব বুঝিয়ে বলছি।”

২১

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাস্তায়, ক্লাবে, পাড়ার মোড়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হচ্ছে। মাইকে দেশাত্মবোধক গান বাজছে। গতকাল রাতে জ্যাকসনকে নিয়ে তিনকড়ি যা বলেছিলেন সেই কথা মনে পড়ে যাওয়াতে জ্যাকসনকেও বনমালী সেন ছেড়ে দিয়েছেন। জ্যাকসন থানা থেকে বেরিয়ে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনে সজ্জিত শহর দেখতে দেখতে চলেছেন। দেশটার কী হল? জ্যাকসনের কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না যে এত কিছু দেখে ইংরেজ সরকার হাত গুটিয়ে বসে আছেন কেন?

বাজারে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে যাত্রা হচ্ছে— ‘বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী’। পাড়ার সব লোকজন ভিড় করে যাত্রা দেখতে বসেছে। যাত্রা বেশ জমে উঠেছে, কিন্তু এর মধ্যে এক ঝামেলা বেঁধেছে। ইংরেজ পুলিশ সুপারের চরিত্রে অভিনয় করবে যে-অভিনেতা সে পালিয়েছে। তার বেশ কয়েকটা শোয়ের পেমেন্ট বাকি পড়েছিল। ম্যানেজার মশাইয়ের সঙ্গে সেই নিয়ে বাগবিতণ্ডা করে মোক্ষম মুহূর্তে দলকে ঝুলিয়ে চম্পট দিয়েছে সেই অভিনেতা। এদিকে পুলিশ সুপারের দৃশ্য প্রায় এসে গেছে, কে হবে পুলিশ সুপার? নিতাই আর খোকনের ওপর পুলিশ সুপার খোঁজার দায়িত্ব পড়েছে। ভগবান আছে বলতে হয়, না হলে ঠিক এই মোক্ষম মুহূর্তেই তাদের সামনে কেন হাজির হবেন ইন্সপেক্টর জ্যাকসন? মেক-আপ যাকে বলে পারফেক্ট। ‘ব্লাডি সোয়াইন’, ‘হাম টুমখো বেট মারেঙ্গা’ ইত্যাদি ডায়লগও মুখস্থ। তাই জ্যাকসনকেই ধরে-বেঁধে তারা নিয়ে গেল পুলিশ সুপারের অভিনয় করাতে।

স্টেজে একদল স্বাধীনতা সংগ্রামী ‘বন্দে মাতরম্’ গান গাইবে আর পুলিশ সুপার সেই দলকে লাঠি মেরে ছত্রভঙ্গ করবে— এই হল সেই দৃশ্য। জ্যাকসন স্টেজে উঠে নিজে থেকেই ঠিক তাই করছিলেন, কিন্তু লাঠি চালনাটা ফলস না হয়ে বেশ সজোরেই বিপ্লবী-দলরূপী অভিনেতাদের গায়ে পড়তে লাগল। অভিনয়ের খাতিরে তারা মুখ বুজে ছিল। কিন্তু জ্যাকসন হঠাৎ তাদের বুট দিয়ে সত্যি সত্যি লাথি মারতে শুরু করলেন। বাজারের ভিতরে রবির মুরগির দোকানের মাঝখান দিয়ে একটা তেরঙ্গা পতাকা উঠে গেছে। সেই দেখে স্টেজ থেকে ঝাঁপিয়ে নেমে পড়ে জ্যাকসন সেই পতাকা নামিয়ে ফেলার চেষ্টা শুরু করলেন। কিন্তু এসব ঘটনা তো যাত্রার সিনে ছিল না! ব্যস! অভিনেতারা আর দর্শক মিলে তখন জ্যাকসনকে তাড়া করল। জ্যাকসন পড়ি কি মরি করে ছুটছেন, পিছনে কাতারে কাতারে লোকজন, কারও হাতে আঁশবঁটি, কারও হাতে কাটারি, কারও হাতে ছুরি, কারও হাতে বাঁশ। ছুটতে ছুটতে জ্যাকসন আশ্রমের মধ্যে ঢুকে পড়েন।

ইতিমধ্যে উপাধ্যায় হাজির হয়েছেন আশ্রমে। অদ্ভুতানন্দের সঙ্গে তাঁর জোর বচসা বেঁধেছে।

“আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? এক শিশি-বোতলওয়ালার কথা শুনে আপনি আমায় সন্দেহ করছেন? আপনাকে এতগুলো থিসিস পেপার দিনের পর দিন কে সাপ্লাই দিল?”

“ক’টা পেপার সাপ্লাই করেছেন আর ক’টা বিক্রি করেছেন? আমি জানতে চাই, যে-গাড়ি আপনারা পেয়েছেন, তাতে কী কী কাগজপত্র আছে? ওই গাড়ি আমার চাই!”

“মামার বাড়ির আবদার নাকি! আপনাকে যা যা দেওয়ার, সব দিয়েছি গুরুদেবের নির্দেশে। মাছি-মারা কেরানি থেকে দেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছেন, আবার কী চান?”

“এই গাড়ি আমি চাই! এ গাড়ি আমি না পেলে প্রেস ডেকে আপনাদের চিটফান্ডের কথা জানিয়ে দেব। জানাব কীভাবে আপনারা লোক ঠকাচ্ছেন গুরুদেবের নামে।”

“বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না! আপনি নিজে ধোওয়া তুলসীপাতা নন। যদি আমি প্রেসের সামনে অধীর চৌধুরীর পেপারগুলো তুলে ধরি? কী হবে আপনার অবস্থা ভেবে দেখেছেন?”

“আর আমিও যদি প্রেসকে জানাই যে কী করে আপনি এই ত্রিকালানন্দ মিউচুয়াল ফান্ড চালাচ্ছেন? একজনের থেকে টাকা নিয়ে আর একজনকে ফেরত দিচ্ছেন! কোথায় হচ্ছে আপনার আশ্রম? গুরুদেবের নাম ভাঙিয়ে এতগুলো গরিব মানুষকে সর্বস্বান্ত বানানোর চক্রান্ত করার ধান্দা ফেঁদেছেন!”

“বেশ করেছি! আপনি নিজে এই টাকা থেকে ফায়দা নেন না? আপনার দু’মাসে একটা করে ফরেন ট্যুর, কলকাতায় পাঁচটা বাড়ি, পেন্টহাউস, তিনটে বেনামি টিভি চ্যানেল, পরিবারের সব্বার জন্য একটা করে লাগজ়ারি কার— কোন টাকায় হল এসব? এখন গরিব মানুষের জন্য আপনার শোক উথলে উঠছে?”

কথাবার্তা যখন চলছিল তখন তাঁরা খেয়াল করেননি যে, বাজারের লোকজন জ্যাকসনকে তাড়া করে আশ্রমের ভিতর ঢুকে পড়েছে এবং উপরোক্ত সকল কথাই তারা শুনে ফেলেছে। ওই ভিড়ের প্রায় সব্বাই ত্রিকালানন্দ মিউচুয়াল ফান্ডে তাদের সঞ্চিত টাকা জমা রেখেছিল বেশি টাকা রিটার্ন পাবে বলে। সেই ভিড়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন অধীর এবং কল্যাণী। অধীর উপাধ্যায়কে বলেন, “আমার ঠাকুরদা সবকিছুই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন, শুধু আপনার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণীটাই করে যেতে ভুলে গেছেন। সেটা কী তা এবার নিজের চোখেই দেখুন মিস্টার উপাধ্যায়।”

ভিড়ের মধ্যে থেকে লোকজন চেঁচিয়ে ওঠে।

“গুরুদেবের নামে আমাদের থেকে টাকা মেরে ফুর্তি করা তোমার ঘোচাচ্ছি।”

“আমাদের রক্ত জল করা পয়সা নিয়ে ছেলেখেলা! আজ কেটেই ফেলব এদের!”

জনতার ভিড় এবার জ্যাকসনকে ছেড়ে অদ্ভুতানন্দ আর উপাধ্যায়কে ঘিরে ফেলল।

২২

তিনকড়ি তাঁর পূর্বপুরুষ-সমেত হাজির হয়েছেন সেই আশ্রমে। এক্কি আর রিয়াও হাজির। সবাই মিলে তাঁরা আবার যাবেন ১৯৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর সকালে, যখন সুধীর, উপাধ্যায়ের দেওয়া চিঠি পেয়েছিলেন। সেই ঘটনা আটকাতে পারলেই আবার সময়ের গতিপথ যথার্থ হবে এবং তা হলেই অধীররা আবার নিজেদের সঠিক সময়ে ফিরে যেতে পারবেন। এর মধ্যে তিনকড়ি অধীরকে জিজ্ঞেস করেন, “আচ্ছা অধীর, আমরা এবার কোন সময়ে যাব?”

“১৯৪২।”

“বাহ! খুব ভাল। তা সেই ১৯৪২-এ কি আমি জন্মেছি? আর জন্মালে ক’বার জন্মেছি?”

অধীর ধমক দেন তিনকড়িকে, “গাধার মতো কথা বলছিস কেন? ১৯৪২-এ তোর জন্মানোর কথা?”

“দেখ ভাই, কোনটা যে কথা আর কোনটা যে কথা নয় সেটা বোঝার ক্ষমতা আমি হারিয়েছি। তোর এই গাড়ি আমার আধ্যাত্মিক চেতনা জাগিয়ে দিয়েছে। আমি বুঝে গেছি, আত্মা অমর! আমি যুগে যুগে বহু বহু সংখ্যায় জন্মেছি। বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরোঽপরানি ইত্যাদি ইত্যাদি…”

সাতকড়ি বলেন, “জানো তো অধীর, আমাদের পাড়ায় একটা পরিবার ভাড়া থাকত। সেই বাড়ির ছোট মেয়ে সরলাকে সুধীর পড়াতে যেত, আর সেই সূত্রেই দু’জন দু’জনের প্রেমে পড়ে। ব্যাপারটা নিয়ে পাড়াময় বেশ ঢিঢি পড়ে যায়। সেই লজ্জা ঢাকতে ওই পরিবার পাড়া ছেড়ে চলে গেল ভবানীপুরে। তারপর থেকে সুধীরটা কেমন পাগল পাগল হয়ে গেল। আমি ওর সম্বন্ধ নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু শুনলাম সুধীরের জ্যোতিষচর্চাতেই সরলার বাবার যাবতীয় আপত্তি। ওঁর মতে ওসব বুজরুকি। কিছুতেই তিনি বিয়েতে রাজি হলেন না। তারপরেই তো এই চিঠি পেয়ে এত বড় জ্যোতিষী হয়ে উঠল সুধীর। এখন মনে পড়ছে, আমরা যেদিন এখানে আসছিলাম, সেদিন সকালে সুধীর আমার কাছে ওই চিঠি নিয়ে এসে খুব হম্বিতম্বি করে গিয়েছিল।”

অধীর বলেন, “আমার ঠাকুরদার বিয়ে ওই মহিলার সঙ্গেই হবে, কারণ আমার ঠাকুরমার নাম সরলাবালা দেবী। আমাদের ফিরে গিয়ে শুধু ওই চিঠি পাওয়া আটকাতে হবে। আর তারপরেই জ্যোতিষচর্চার ভূত ওঁর মাথা থেকে নামবে এবং যথারীতি সরলাবালা দেবীর সঙ্গেই বিয়ে হবে।”

সাতকড়ি বলেন, “কিন্তু সেটা তো তখনই সম্ভব যখন সরলা আর সুধীরের আবার দেখা হবে। তা কী করে সম্ভব?”

রিয়ার হঠাৎ মনে পড়ে কল্যাণী ওকে বলছিলেন যে, রিয়াকে অধীরের ঠাকুরমার মতো দেখতে। সে বলে উঠল, “বাবা!”

মেয়ের মুখে বহুদিন পর ‘বাবা’ ডাকটা শুনে অধীর আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। রিয়া বলতে থাকে, “বাবা, মা তো বলে যে আমায় নাকি একদম তোমার ঠাকুরমার মতন দেখতে। তা হলে আমি ভাবছিলাম, আমি নিজে যদি সরলা দেবী সেজে সুধীরদাদুর সামনে দাঁড়াই? ১৯৪২ সালে সরলা দেবীর বয়স তো নিশ্চয়ই আমার মতন!”

সাতকড়ি খুব খুশি হয়ে বলেন, “বাহ্! এই না হলে স্বাধীন দেশের মেয়ে! এত বুদ্ধি ধরে!”

কিন্তু তিনকড়ির সংশয় আর কাটে না। তিনি বলেন, “সরলাদেবী নিশ্চয়ই একজন সহজ-সরল বাঙালি ঘরোয়া মহিলা, এই ট্যাঁস ফিরিঙ্গি সাজবে নাকি সরলাদেবী! তা হলেই হয়েছে!”

রিয়া তিনকড়ির ছোড়া এই চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করে বলে, “তিনকড়িকাকা, তুমি শুধু দেখে যাও,” তারপর উমাকে বলে, “ঠাকুমা, আপনার একটু হেল্‌প লাগবে। আমায় একটা মেকওভার করিয়ে দেবেন?”

উমা বুঝতে পারেন না এর মানে। রিয়া বলে, “মানে, আপনার মতন করে সাজিয়ে দেবেন?”

উমার ট্রাঙ্ক খোলা হল। সেখান থেকে শাড়ি আর গয়না বের করে উমা সাবেকি ঢঙে রিয়াকে সাজালেন। সেই সাজ দেখে কে বলবে যে এই মেয়েই বাংলা রকব্যান্ডে হেডব্যাং করে গান গায়, ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাঁজা খায়। রিয়া যে এত সুন্দরী তা খোদ এক্কিই এতদিন জানত না! অধীর আর তিনকড়ি অবাক হয়ে দেখছেন তাঁদের মেয়েটাকে।

সবাই এবার অধীরের গাড়িতে ওঠার জন্য প্রস্তুত। অধীর সাতকড়িকে বলেন, “১৯৪২ সালে ফিরে গিয়ে ওই চিঠি পাওয়াটা আটকালেই কিন্তু আপনারাও আমাদের কথা ভুলে যাবেন। তিনকড়ির সঙ্গে আর আপনার দেখা হবে কি না সেটা সময়কে নিজে থেকেই জানাতে দিন।”

তিনকড়ি আর এককড়িকে বুকে জড়িয়ে ধরেন সাতকড়ি। তারপর রিয়াকে কাছে ডেকে বলেন, “আর কই হে, আমার পুতি-বউ! একটু কাছে এসো দেখি। তাই বলি! কেন তোমাকে প্রথম থেকেই আমার খুব চেনাচেনা মনে হত! কী দিয়ে তোমায় আশীর্বাদ করি মা!”

রিয়া লজ্জায় মুখ নিচু করে। অধীর কিছু বুঝতে না পেরে বলেন, “এ কী বলছেন আপনি ঠিক বুঝতে পারছি না তো।”

সাতকড়ি একটা মৃদু ধমক লাগিয়ে অধীরকে বলেন, “তোমার আর এসব বুঝে কাজ নেই অধীর, যেমন বিজ্ঞান নিয়ে আছ, তেমনই থাকো। শোনো, অধীর আর তিনকড়ি, নিজেদের সময়ে ফিরে তোমাদের প্রথম কাজ হবে এই চারহাত এক করা।”

এক্কি আর রিয়ার হাত একসঙ্গে ধরে সাতকড়ি বলেন, “স্বয়ং সাতকড়ি ঘটক বলে যাচ্ছেন, এ একেবারে রাজযোটক।”

অধীর বলেন, “এমন ভাগ্য কি আমার হবে?”

তিনকড়ি বলেন, “বাবা, তুই আবার এমন থিয়েটারি অ্যাক্টো কবে শিখলি রে? ওসব হবে, তার আগে তুই আমায় বল তোর ঠাকুরদার ওই চিঠি পাওয়া আটকাতে পারলেই আমরা নিজেদের ২০১৭-য় ফিরতে পারব তো? নাকি আবার দেখব, যে ২০১৭-য় ফিরলাম সেখানে এবার আমিই জন্মাইনি? দেখ ভাই, অনেক কষ্টে আমার দু’-দু’বার হার্টফেল করেছে, এইবারও কিন্তু হার্টফেল হতে বাধ্য। আর আমি মরলে কিন্তু ছেলের কাল-অশৌচ, এক বছর ওদের বিয়ে আটকে যাবে!”

তিনকড়ির কথায় সবাই মিলে প্রাণ খুলে হাসতে হাসতে টাইম মেশিনে উঠতে যাচ্ছেন, এমন সময় কোথা থেকে জ্যাকসন সাহেব ছুটে আসেন। সবার সামনে হাঁটু গেড়ে প্লিড করার ভঙ্গিতে বসে তিনি বলেন, “ওয়েট ওয়েট! প্লিজ় টেক মি ব্যাক!”

সাতকড়ি গোঁফে তা দিয়ে বলেন, “কালী, গিন্নি, দেখো দেখো! একজন ইংরেজ কেমন আমাদের কাছে ভিক্ষা চাইছে। এ জিনিস আর ফিরে গিয়ে দেখতে পাবে না।”

কালীকিঙ্কর বলেন, “আচ্ছা অধীর, এরে ছাইড়া যাইলে হয় না?”

অধীর বলেন, “না, তা হলে আবার গন্ডগোল।”

“থাক, তা হলে কাম নাই! এই জ্যাকসন, উইঠা পড়!”

জ্যাকসন ছুটে গাড়ির ডিকির দিকে যান। সাতকড়ি বাধা দিয়ে বলেন, “আহা, গাড়ির ভিতর তো জায়গা আছে।”

কিন্তু জ্যাকসন ডিকিতে ঢুকতে ঢুকতে বলেন, “নো নো, আই ওয়ন্ট টু গো ব্যাক ইন দি এগ্‌জ়্যাক্টলি সিমিলার ম্যানার অ্যাজ় আই কেম হিয়ার। আই ওয়ন্ট টু এনসিয়র এভরিথিং ইজ় ফাইন।”

“ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়। প্রগতিশীল ইংরেজকেও কুসংস্কারী বানিয়ে ছেড়েছে আমাদের অধীর চৌধুরী,” সাতকড়ি অধীরের পিঠ চাপড়ে দেন।

সবাই হেসে ওঠেন। অধীর গাড়ি স্টার্ট করতে যান, তিনি দেখতে পান রাস্তার এক ধারে কল্যাণী একা দাঁড়িয়ে। অধীর গাড়ি থেকে নেমে কল্যাণীর কাছে যান। কল্যাণী অধীরকে বলেন, “দেখুন আপনি বলছেন যে, আপনি আমাদের এই জগতের মানুষ নন। কিন্তু সেটা বিশ্বাস করার মতো কোনও প্রুফ আমার কাছে নেই। তাও কেন আপনার কথা আমি বিশ্বাস করলাম বলতে পারেন?”

“কারণ তুমি আমার প্রতিটা অস্তিত্বের রক্ষাকর্ত্রী। এক জীবনে এক দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামীর সাধনাকে সফল করতে নিজের কেরিয়ার স্যাক্রিফাইস করো, আবার আর-এক জীবনে স্বামীর অস্তিত্ব ফিরিয়ে দিতে শয়তানদের দমন করো। সত্যিই, তোমাদের অপার মহিমা। আসি!”

অধীর তাঁর গাড়িতে ফিরে আসেন। সময়যান আলোর ঝলকানি এবং প্রবল কম্পনের সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়। কল্যাণী একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন সেই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে। তাঁর চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে কেন কে জানে! এই বিজ্ঞানী অধীরকে কি তিনি ভালবেসে ফেললেন?

২৩

২৫ ডিসেম্বর ১৯৪২, সকাল আটটা দশ মিনিট। অধীররা এখন সুধীরের বাড়ির দোরগোড়ায়। ওই তো পড়ে আছে একটা খাম। সুধীর এখনও বেরোননি বাড়ির বাইরে। তাঁর হাতে পড়ার আগেই সেই খামটা কুড়িয়ে এনে পুড়িয়ে ফেলা হল। অধীর ঘুরে তাকালেন তাঁর ঠাকুরদার বাড়ির দিকে। সেখানে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রিয়া। তাই বা কেমন করে হয়? রিয়া তো অধীরের পাশেই দাঁড়িয়ে! তা হলে সেই মহিলা কে? রিয়াকে হুবহু সেই মহিলার মতো দেখাচ্ছে। সাতকড়ি হঠাৎ বলে ওঠে, “আরে, এই তো সেই সরলা!”

রিয়ার সঙ্গে সরলার যে এতটা মিল, সত্যি না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু সরলা এখানে এখন কী করছেন?

বাড়ির সদর দরজা খুলে সুধীর বেরিয়ে এসেছেন। সরলাকে যে এইভাবে তাঁর বাড়ির সামনে দেখতে পাবেন তা তিনি কোনওদিন ভাবতেই পারেননি। সুধীর সরলাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে যান। অধীররা সবাই সুধীরের বাড়ির পিছনে একটা জানলার সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁরা দেখতে পান সুধীর ভগবান বিষ্ণুর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সরলার সিঁথিতে সিঁদুর পরাচ্ছেন।

সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। সাতকড়ি প্রথম প্রশ্ন করেন, “কী হল ব্যাপারটা?”

“সময় তার নিজের নিয়ম পালন করল,” অধীর উত্তর দিলেন, “আমার ঠাকুরদার বিয়ে হয়েছিল ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৪২ সালে। আমি শুনেছিলাম, আমার ঠাকুরমা সরলাবালা দেবী খুবই সাহসী মহিলা ছিলেন। আমার ঠাকুরদা জ্যোতিষচর্চা করতেন বলে ঠাকুরমার বাবা সেই সম্বন্ধ মেনে নেননি, তাই ঠাকুরমা নিজের বাড়ির অমতে পালিয়ে এসে আমার ঠাকুরদাকে বিয়ে করেছিলেন। শাস্ত্রের নিষেধ অমান্য করে পৌষ মাসে ওঁদের বিয়ে হয় বলে আত্মীয়স্বজনের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। এটা আমাদের বংশের প্রথম লভ ম্যারেজ। এঁদের দেখেই তো অনুপ্রেরণা পেয়ে আমি কল্যাণীকে তার বাড়ির অমতে বিয়ে করি। কল্যাণীর বাড়ি থেকেও আমার চাকরি না করে রিসার্চ নিয়ে পড়ে থাকা মেনে নেননি। ছোটবেলায় মনে আছে এই ২৫ ডিসেম্বরে ঠাকুরদার বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে আমাদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া হত। বছর দুয়েক আগে আমাদের ইনস্টিটিউটে একটা সরকারি কাজের জন্য আমাদের ২৫ ডিসেম্বরের ছুটির দিনেও কাজ করতে হয়েছিল। সেদিন আমি আমাদের ইনস্টিটিউটের সবাইকে কল্যাণীর হাতে বানানো কেক খাইয়েছিলাম আর সবাইকে আমার ঠাকুরদার বিয়ের কথা বলেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, এর থেকেই উপাধ্যায় তাঁর পুরো পরিকল্পনাটা করেছিলেন। এই খামটা পুড়িয়ে ফেলতেই আবার সময়ের নিয়ম মেনে ওঁদের বিয়ে হয়ে গেল। এবার আমাদের ফিরে যেতে আর কোনও বাধা রইল না।”

তিনকড়ি, এক্কি, অধীর আর রিয়া ফিরে যাচ্ছেন তাঁদের সময়ে। ফিরে গিয়েই ঠাকুরদার আদেশ মেনে, এক্কি আর রিয়ার বিয়ের বন্দোবস্ত করতে হবে তিনকড়ি আর অধীরকে।

নিমন্ত্রিতের একটা হেড কাউন্ট করতে করতে তিনকড়ি টাইম মেশিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সাবেকি বেশে রিয়াকে দেখে তিনকড়ি বুঝতে পেরেছেন পাত্রী হিসেবে রিয়ার মর্ম। ঠিক এমন একটা বউমাই তো চেয়েছিলেন তিনকড়ি। রিয়াও যেন হঠাৎ করে কেমন বদলে গেছে। ওর রুক্ষ স্বভাবের খোলসটা খসে গিয়ে ভেতরের কোমল স্বভাবটা প্রকাশ পেয়েছে। এক্কিকে জামাই হিসেবে পেয়ে আপ্লুত অধীর। এ যেন মহারাজ রৈবতেরই আখ্যান! এক অন্য যুগে এসে তাঁর রেবতীর জন্য বলরামকে পাওয়া। তিনকড়ি, এক্কি আর রিয়াকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করে বিদায় জানান সাতকড়ি আর উমা।

অধীরের গাড়ি ২০১৭-র উদ্দেশে পাড়ি দেয়। সাতকড়ি একা দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁর উত্তরসূরিদের বিদায় জানাতে। হঠাৎ রাস্তার অপর প্রান্ত থেকে কালীকিঙ্করকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখা যায়।

“জামাইবাবু, যুদ্ধের লগে কইলকাতা ছাইড়া হগগলে এখন পালাইতাসে। আমি কই কী, আপনি দিদি আর গোবরারে লইয়া চলেন গিয়া কিছুদিন পাবনায় কাটাইয়া আইবেন। কাইল রাইতে হালার পো জাপানিগুলা কী কাণ্ডটাই না বাঁধাল!”

“বলছ? ঠিক আছে, তাই চলো।”

“জানেন তো জামাইবাবু, কাল রাইতে একখান ভয়ংকর স্বপ্ন দেখসি। দেখসি যে আমাগো সব নাতিপুতিগুলা আমাগো লইয়া কোথায় যেন হাওয়া হইয়া গেসে! সে এক অলীক জগৎ, আর আপনার ওই লুচ্চা বন্ধু সুধীর ওই জগতে বিরাট জ্যোতিষী হইয়া গেসে।”

“আর সেখানে আমাদের এক বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপ হয়।”

“হ! বিজ্ঞানী আর তার মাইয়া! কিন্তু সেই বিজ্ঞানীর সেই জগতে কোনও অস্তিত্বই নাই!”

“সে কী কালী! তুমিও এই একই স্বপ্ন দেখেছ কাল রাতে?”

“তার মানে? আপনিও এই স্বপ্ন দেখসেন?”

“এর মানে কী?”

কালী আর সাতকড়ি একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন।

“আইস্যা, আমরা কী লইয়া কথা কইসিলাম?”

“কে জানে! ঠিক মনে পড়ছে না তো! তুমিই তো কীসব বলছিলে!”

“কী জানি, আমারও ঠিক মনে পড়তাসে না! ছাড়ান দেন, চলেন তাড়াতাড়ি! শিয়ালদহ ইস্টিশানে বেবাক ভিড়! হগগলে কইলকাতা ছাইড়া পালাইতেসে!”

সাতকড়ি আর কালীকিঙ্কর হন্তদন্ত হয়ে চলে যান। রাস্তায় পুলিশ সুপার জ্যাকসন টহল দিতে বেরিয়েছেন। সাতকড়ি আর কালীকিঙ্করের দিকে সন্দেহজনক নজরে তিনি তাকিয়ে থাকেন। কাল রাতে তিনিও একটা গড়বড়ে স্বপ্ন দেখেছেন বটে। কালীকিঙ্করের সঙ্গে জ্যাকসনের চোখাচোখি হতেই কালীকিঙ্কর একটা সেলাম ঠোকেন। জ্যাকসন সেই দেখে খুব খুশি হন।

২৪

২৫ ডিসেম্বর ২০২০। এক্কি আর রিয়া তাদের কন্যাসন্তানকে নিয়ে অধীরের বাড়িতে এসেছে। সেই মুহূর্তে টিভিতে একটা নিউজ় চলছে। অধীর আর কল্যাণী একসঙ্গে বসে সেই খবর দেখছিলেন। একজন সাংবাদিক রিপোর্ট করছেন, “বিজ্ঞানের জগতে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য প্রখ্যাত বিজ্ঞানী শ্রীঅধীর চৌধুরীকে এই বছর ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড-এ ভূষিত করা হবে। এই অ্যাওয়ার্ড ভারত সরকারের তরফে বিজ্ঞানীদের প্রতি সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানজ্ঞাপন। এই খবরে সায়েন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটে নেমে এসেছে খুশির আমেজ। এই ইনস্টিটিউটের সঙ্গে দীর্ঘ পনেরো বছর অধীর চৌধুরী জড়িত আছেন, মাঝে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে উনি কয়েক মাসের জন্য এই ইনস্টিটিউট ছেড়ে গিয়েছিলেন। আমরা কথা বলব ইনস্টিটিউটের হেড প্রফেসর পঙ্কজ উপাধ্যায়ের সঙ্গে।”

উপাধ্যায়কে দেখা যায় সাংবাদিককে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে, “খুব ভাল লাগছে। খুবই ভাল লাগছে। আপনারা সবাই জানেন অধীর চৌধুরী খুব বড় একজন বিজ্ঞানী, কিন্তু আমি জানি উনি আরও আরও বড় একজন মানুষ। শুধুমাত্র অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারীই নন, ওঁর মতো দায়িত্বসম্পন্ন মানুষ বিরল। কোনও যোগ্য মানুষকে কখনওই আটকে রাখা যায় না।”

২০১৭-য় নিজেদের সঠিক সময়ে ফিরে আসার পর উপাধ্যায় অধীরের সামনে তাঁর দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। অধীর তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তারপর সেই ঘটনার কথা আর নতুন কাউকে অধীর বা উপাধ্যায় কখনওই বলেননি। তবে সেই ঘটনার পর থেকে অধীরের প্রতি উপাধ্যায়ের ব্যবহার একেবারেই বদলে যায়। উপাধ্যায়ই অধীরকে আবার ইনস্টিটিউটে ফিরিয়ে নেন।

এক্কি টিভিটা বন্ধ করে। তার পাশে বসে আছেন অধীর আর কল্যাণী। অধীর নির্বিকার, কল্যাণী অধীরের হাতের ওপর হাত রাখে। রিয়া চা নিয়ে আসে সকলের জন্য। চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, “তোমরা বেরোচ্ছ কখন?”

“এই তো বেরোব,” অধীর বলেন।

“তা এবার কোন টাইম পিরিয়ড?” এক্কি জিজ্ঞেস করে।

“খ্রিস্টাব্দ মানে AD মোটামুটি সব কিছু কভার করে দিয়েছি— পানিপথের যুদ্ধ, হর্ষবর্ধনের রাজত্ব, আকবরের দরবারে তানসেনের গান, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন… এই সবকিছু তোদের মাকে দেখিয়ে দিয়েছি। তবে এবার কল্যাণী ধরেছে এক নতুন বায়না।”

কল্যাণী বলেন, “আরে তোর বাবাই আমাকে বলল, খ্রিস্টের জন্মের ১৪৫৮ বছর আগে নাকি কৃষ্ণ নামে এক রাজা জন্মেছিলেন দ্বারকায়। তা আমি বললাম, তোমার মেশিনের যদি এতই ক্ষমতা তা হলে নিয়ে চলো আমায় সেই কুরুক্ষেত্রের সময়ে! কৃষ্ণের ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করে আসা যাবে।”

“হ্যাঁ! দেখি তোর কত ক্ষমতা! চল, আমরা রেডি!”

তিনকড়ি উপস্থিত হয়েছেন। তাঁর পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি।

“তোরা এটাতেও যাবি?” অধীর প্রশ্ন করেন।

“যাব না? ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি, আমাদের এখন ঝাড়া হাত-পা। তা ছাড়া আমার এই কুরুক্ষেত্র নিয়ে একটা কনফিউশন আছে। ওই শ্রীকৃষ্ণ যখন অত বড় গীতা বইটা থেকে একের পর এক বাণী ঝেড়ে যাচ্ছিলেন অর্জুনকে, সেই অতক্ষণ সময় ধরে বাদবাকি সৈন্যরা কী করছিল? ঘুমিয়ে পড়েনি তারা?”

“আরে বাবা, তখন সময় থমকে গিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে এত টাইম ট্র্যাভেল করেও বুঝে উঠতে পারলি না যে, সময় আপেক্ষিক?”

“অত কিছু বুঝলে তো তোর বদলে আমিই সব পুরস্কারগুলো পেতাম। তা ছাড়া এবারে একটা ভিডিয়ো ক্যামেরা সঙ্গে নিয়েছি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কিছু লাইভ ফুটেজ যদি ভিডিয়ো রেকর্ড করে আনা যায়! চল চল চল, তাড়াতাড়ি বেরো। আমি গিয়ে তোর বেয়ানকে নিয়ে আসি। নড়তে চড়তেই এর এক যুগ পেরিয়ে গেল! ওদিকে শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য ফুঁকে দিলেন বলে, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে…”

তিনকড়ি বেরিয়ে যান মানসীকে তাড়া দিতে। বেশ লাগছে এক্কি আর রিয়ার তাদের দুই বাবা-মাকে দেখে। কী অদ্ভুত মজার জীবন তাঁদের। অধীর একটা পেপার নিয়ে এসে এক্কিকে দেন।

“থিসিসটা দেখে রেখেছি। কিছু সাজেশনস আছে, সব নোট করে দিয়েছি। ওই পয়েন্টগুলো নিয়ে ভাবিস।”

“আর আমার সাজেশনটা ভেবে দেখেছ? একটু বাদেই প্রেস আসবে তোমার খোঁজে,” এক্কি বলে।

“বাবা, এবার তুমি এর কথা বলেই দাও। লোকে জানবে না তোমার এত বড় একটা আবিষ্কারের কথা?” রিয়া আবদার করে।

“না রে, এই টাইম মেশিনের কথা পৃথিবীর লোকের জানার সময় এখনও আসেনি। আমরা শুধু প্রযুক্তির দিকেই অগ্রসর হয়ে চলেছি, কিন্তু আমাদের মানসিকতার প্রসার যতক্ষণ না ঘটবে মানবসমাজে এইসব আবিষ্কারের কোনও মূল্যই থাকবে না। তাই এর কথা আমি গোপনই রাখব, আর আমি চাইব তোরাও গোপন রাখবি। এর মাধ্যমে তোর মায়ের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোই আমার কাছে এই আবিষ্কারের সব থেকে বড় স্বীকৃতি।”

অধীর কল্যাণীকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “আমরা এখন খুব ভাল আছি রে।”

______

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *