সমান্তরালের রহস্য – ১৫

১৫

অধীর দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে এসেছেন সায়েন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অফিসে তাঁর হিতৈষী ব্যানার্জিদার কাছে। ব্যানার্জিদা তো খুব ভাল করেই জানেন যে, এই কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বিষয়ক আবিষ্কারটি অধীরের, উপাধ্যায়ের নয়। এটা তো অধীর একটা সায়েন্স জার্নালেও পাবলিশ করেছিলেন। কিন্তু ব্যানার্জিদাও তাঁকে চিনতে পারলেন না। এই প্রথম নাকি তিনি অধীরকে দেখছেন। সায়েন্স জার্নালে সত্যিই থিসিসটা প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু সেটা উপাধ্যায়ের নামে। শুধু এটা নয়, অধীরের আরও যত সব গুরুত্বপূর্ণ থিসিস আছে, সেগুলো সবই নাকি উপাধ্যায়ের।

ব্যানার্জির এই উটকো লোকটাকে দেখে সন্দেহ হয়। লোকটা কে? উপাধ্যায়ের আবিষ্কারের সমস্ত খুঁটিনাটি লোকটা প্রায় মুখস্থ বলে দিলেন, যেন আবিষ্কারটা ওঁর নিজেরই! ব্যানার্জি খবরটা উপাধ্যায়কে জানানো উচিত মনে করেন।

উপাধ্যায় সমস্ত ব্যাপারটা মন দিয়ে শুনে একটা সিগার ধরিয়ে ব্যানার্জিকে বলেন, “এসব পাগল-ছাগলরা ইনস্টিটিউটে ঢোকে কী করে?”

ব্যানার্জি বলেন, “আমারও প্রথমে লোকটাকে পাগল মনে হচ্ছিল স্যার। কিন্তু বিশ্বাস করবেন না, আপনার রিসার্চের প্রতিটা হাইপোথিসিস, প্রতিটা অ্যাজ়াম্পশনস, প্রতিটা ডিরাইভেশনস অবিকল বলে দিচ্ছেন। এটাও বলছেন, এই থিসিস নাকি উনি সায়েন্স জার্নালে পাবলিশ করেছেন আগে।”

উপাধ্যায় হাসে। ব্যানার্জি বলে চলেন, “লোকটা বলছেন উনি নাকি এই ইনস্টিটিউটে কাজ করেছেন দীর্ঘ দশ বছর ধরে। আমি তো স্যার মনে করতে পারছি না, আপনি চেনেন? নাম বলছেন অধীর চৌধুরী।”

উপাধ্যায় চমকে উঠেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, “লোকটা কোথায়?”

“ওই তো বাইরে বসে আছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।”

উপাধ্যায় উঠে দরজার বাইরে দেখেন অধীর অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। উপাধ্যায় বলেন, “পাগল-ছাগল সবার সঙ্গেই কি আমায় দেখা করতে হবে নাকি? তাড়িয়ে দিন।”

ব্যানার্জি মাথা চুলকোতে চুলকোতে বেরিয়ে যান কেবিন থেকে। সঙ্গে সঙ্গেই উপাধ্যায় তাঁর কেবিনের দরজা লক করে নিজের প্রাইভেট লকার থেকে কিছু কাগজপত্র বের করেন। সেগুলো সবই বহু পুরনো কিছু থিসিসের পেপার। তাতে নাম লেখা— অধীর চৌধুরী।

উপাধ্যায় স্বামী ত্রিকালানন্দের আশ্রমে এসে, গোপনে আশ্রমের অধিকর্তা স্বামী অদ্ভুতানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে অধীরের ব্যাপারে জানান। অদ্ভুতানন্দ সব শুনে বলেন, “আপনি যা বলছেন, এ তো অসম্ভব! গুরুদেবের নির্দেশে আপনাকে যেসব কাগজপত্র আমরা দিয়েছি সেইসব তো গুরুদেব ১৯৪২ সালে পেয়েছিলেন।”

উপাধ্যায় বলেন, “কিন্তু এই লোকটা ওই কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির থিসিসের সমস্ত ডিটেল জানে। আমার খুব ভয় করছে।”

“শুনুন, আপনি পুলিশে কমপ্লেন করুন। এই লোকটা জেনুইন বা জালি যাই হোক, এর উপস্থিতি আমাদের পক্ষে বিপজ্জনক। একে সরিয়ে ফেলতে হবে।”

“চিরতরেই সরিয়ে ফেলব?”

“মশা মারতে কামান দাগার কোনও প্রয়োজন আছে? প্রভাব খাটিয়ে পুলিশকে কাজে লাগালেই কাজ হয়ে যাবে। এইসব ছোটখাটো ব্যাপারে মাথা ঘামালে আমাদের এখন চলবে? সামনে কত বড় কাজ! গুরুদেবের আশ্রম নির্মাণ করা হবে দেশ জুড়ে!”

“দেখুন, এই আশ্রমনির্মাণের নামে লোকজনের টাকা ইনভেস্ট করার ব্যাপার নিয়ে ওপরমহল কিন্তু একটু নড়েচড়ে বসেছে। গুরুদেবের নামে এরকমভাবে লোকজনের সঙ্গে চিট করাটা কি ঠিক হচ্ছে? তা ছাড়া একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হয়ে আপনাদের সঙ্গে আমার যোগসাজশ, যদি জানাজানি হয়ে যায় তা হলে আমার ইমেজের কী হবে?”

“ইমেজ? কে বানাল আপনার এই ইমেজ?” অদ্ভুতানন্দ তাঁর কাচের গেলাসে স্কচ ঢালেন, “ছিলেন তো একজন সাধারণ বিজ্ঞানী, বাপের পয়সায় ইনস্টিটিউট খুলেছেন। গুরুদেবের নির্দেশানুযায়ী সেই ১৯৪২ সালের অখ্যাত বিজ্ঞানীর রিসার্চ পেপার সময়ে সময়ে আমরাই আপনাকে সাপ্লাই দিয়েছি। সেগুলো বেশ নিজের নামে চালিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হয়েছেন। কী দেখেছিলেন গুরুদেব আপনার মধ্যে কে জানে! এর প্রতিদানে আমাদের সঙ্গে যদি এটুকু সহযোগিতা না করেন তা হলে তো দাদা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে! নিজের প্রভাব খাটিয়ে ওপরমহলকে শান্ত করুন।”

অদ্ভুতানন্দের এমন অনেক অপমান উপাধ্যায়কে হজম করতে হয় দিনের পর দিন।

অনেকক্ষণ হল উপাধ্যায় চলে গেছেন। অদ্ভুতানন্দ স্বামী ত্রিকালানন্দের লেখা সেই চিঠি পড়েছেন। তিনি জানেন যে, স্বামী ত্রিকালানন্দ ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন যে ২০১৭ সালে অধীর চৌধুরীর দেখা পাওয়া যেতে পারে। তাঁর সঙ্গে থাকবে এক অলৌকিক গাড়ি। সেই গাড়ি উপাধ্যায়কে প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছেন ত্রিকালানন্দ। কিন্তু সেই কথা উপাধ্যায় জানেন না। অদ্ভুতানন্দের মতলব অন্যরকম। সেই গাড়ি যদি সত্যিই অলৌকিক হয়, তা হলে তা বাধ্য শিষ্যের মতো উপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেওয়ার মতো মহাত্মা অদ্ভুতানন্দ নন। অধীর এসে পড়েছেন, গাড়িটা তা হলে কোথায়?

১৬

কত সাধ ছিল সাতকড়ির! নাতবউয়ের হাতে কচুর শাক খাবেন, কিন্তু শেষমেশ কপালে জুটল কচুপোড়া! এই কথাটাই কালীকিঙ্কর বেশ রসিয়ে রসিয়ে সাতকড়িকে শোনাচ্ছিলেন। এদিকে উমাও আহত বাঘিনির মতো বারে বারে ফুঁসে উঠছেন। এই অপমানের প্রতিশোধ উনি নিয়েই ছাড়বেন। উমা ঠিক করে ফেলেন যে, নিজের সময়ে ফিরে গিয়ে তিনি তাঁর ছেলে পাঁচকড়ির বিয়েই দেবেন না। বেগতিক দেখে সাতকড়ির ভবিষ্যৎ দেখার ইচ্ছে মাথায় ওঠে। তিনি ঠিক করেন, ফিরে যাবেন। কিন্তু তিনকড়ি তাঁদের না খাইয়ে-দাইয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না।

তিনকড়ি তাঁর পূর্বপুরুষদের খাওয়াতে শহরের একটা নামকরা রেস্তরাঁয় নিয়ে এসেছেন। সেখানে স্টার্টারে আনলিমিটেড কাবাব পাওয়া যায়। তিনকড়ি চার প্লেট অর্ডার দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সাতকড়ি বাধা দেন। যত খুশি যখন খাওয়া যাবে তা হলে আর চার প্লেট অর্ডার দিয়ে পয়সা নষ্ট করার কী মানে? কাবাব যখন আনলিমিটেড, তখন এক প্লেটই অর্ডার দেওয়া যাক, আর সেটাই সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়া যাক। কিন্তু জানা গেল, খাবার ভাগ করে খাওয়া যাবে না। চার জনের জন্য চার প্লেটই অর্ডার দিতে হবে। এক-একজন যত খুশি খেতে পারেন। এ আবার কী নিয়ম? সাতকড়ি তাঁর বাপ-ঠাকুরদার কাছে শিখেছেন সবার সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেতে হয়, কিন্তু এই স্বাধীন দেশে উলটো নিয়ম দেখা যাচ্ছে! নিজে যত খুশি খাও, কিন্তু কাউকে ভাগ দিয়ো না!

খাবারের বিল দেখে তো সাতকড়ির ভিরমি খাওয়ার দশা। সাড়ে তিন হাজার টাকা! এই টাকায় যে সাতকড়ি দু’ বিঘে জমি কিনে নিতে পারেন! তিনকড়িকে একটা ছোট্ট চারকোনা পাত, একটা টাইপ করার মত যন্ত্রে ঘষতে দেখে সাতকড়ির কৌতূহল হল ব্যাপারটা কী জানতে। জানা গেল, এর নাম ক্রেডিট কার্ড, এই কার্ড দিয়ে ধারে খাওয়া যায়। পয়সা পরে দিলেই চলে। সাতকড়ি তাঁর বাপ-ঠাকুরদার কাছে শিখেছেন, কখনও কারও কাছে ধার করতে নেই, অথচ এই স্বাধীন দেশের নাগরিকরা ধার করে খায়! এই কার্ড ব্যবহার করে ধার করাটাকে নাকি এই স্বাধীন দেশে স্টেটাস সিম্বল হিসেবে দেখা হয়! এই স্বাধীন দেশটা কেমন যেন স্বাদহীন বোধ হতে লাগল সাতকড়ির। ক্রেডিট কার্ডের বিলে তিনকড়িকে সই করতে দেখে কালীকিঙ্কর সাতকড়িকে বুঝিয়ে বলেন, “বোঝল্যান না জামাইবাবু? ধারে খাইলাম তো, তাই কত টাকা বাকি রইল সেইসব হিসাব তিনকড়ি লিখ্যা রাখতাসে। তোমার এইখানে খাতা চলে বুঝি তিনকড়ি?”

রামকৃষ্ণ লেনের মুখে দু’জন পুলিশ কনস্টেবল একজন শরবতওয়ালার থেকে শরবত খেয়ে পয়সা না দিয়ে কেটে পড়ার ধান্দা করছিল, এমন সময় হঠাৎ তাদের নজরে পড়ে একটা অদ্ভুত গাড়ি। সেই গাড়ির ডিকি খুলে গেল আর তার মধ্যে থেকে উঁকি মারছেন এক সাহেব। তাঁর পরনে আবার পুরনো আমলের পুলিশের পোশাক। সাহেবটা ডিকি থেকে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে চারপাশ দেখছেন। আগামীকাল পনেরোই অগস্ট, সেই উপলক্ষে হরেন তার চায়ের দোকানে একটা জাতীয় পতাকা লাগাচ্ছিল। সেই দেখে সাহেবটা এগিয়ে গিয়ে হরেনকে মারধর করে সেই পতাকা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। সঙ্গে সঙ্গে কনস্টেবল দু’জন এসে ওই সাহেবকে চেপে ধরে এবং জাতীয় পতাকা অবমাননার কেস দিয়ে তাঁকে থানায় নিয়ে চলে যায়। এ ব্যাটা নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসবাদী, রাষ্ট্রের শত্রু। সাহেব বলেন যে, তিনি পুলিশ সুপার, তিনি ভাইসরয়য়ের সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু কে কার কথা শোনে! সঙ্গে সঙ্গে সেই গাড়িও বাজেয়াপ্ত করা হয়। গাড়িটায় কোনও নম্বর প্লেট নেই, ভিতরের কলকবজাও কেমন অদ্ভুত। নিশ্চয়ই এই গাড়ির সাহায্যে কোনও নাশকতামূলক কাজের পরিকল্পনা করছিলেন ওই সাহেব।

থানার ওসি বনমালী সেন খুবই রাশভারী ব্যক্তি। পুলিশমহলে এমন সৎ কর্মচারী বিরল। তিনি নিজে একজন মারাত্মক কাব্যরসিক। সারা দিন ধরে কাজের ফাঁকে তিনি বিভিন্ন বাংলা কবিতার বই পড়েন। বনমালীর বিশ্বাস, যবে এই দেশের প্রতিটা লোক কবি হয়ে উঠবে, তবেই এই দেশ থেকে যাবতীয় ক্রাইম উধাও হবে। তাঁর থানার লকআপ ভরতি থাকে বিভিন্ন কবিতার বইয়ে। সব ক্রিমিনালদের সেইসব কবিতা পড়তে হয় এবং থানা থেকে ছাড়া পেতে গেলে নিজের মাথা খাটিয়ে একটা কবিতা লিখতে হয়। ক্রিমিনালদের কাছে এটা থার্ড ডিগ্রির থেকেও ভয়াবহ টর্চার। এমনই এক হতভাগ্য শিশি-বোতলওয়ালা মদন পড়েছে এখন বনমালী সেনের হাতে। মদনের অপরাধ বাংলা খেয়ে বউ-ঠ্যাঙানোর চেষ্টা। অবশ্য ঠ্যাঙাতে সে পারেনি, উলটে বউই তাকে ঠেঙিয়ে টানতে টানতে থানায় জমা করে দিয়ে গেছে। শাস্তি হিসেবে মদনকে এখন একটা কবিতা লিখতেই হবে, তবেই সে ছাড়া পাবে। সাধ্যমতো সে একটা লিখেও এনেছে— ‘আমার বউ পাঁচি/ বিদঘুটে তার হাঁচি/ মারছে মশা-মাছি/ মরলে এবার বাঁচি।’

কবিতাটা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বনমালী সেন মদনকে ‘বনলতা সেন’ পড়তে দিয়েছেন। মদন এখন সেই নিয়ে লকআপে হিমশিম খাচ্ছে।

ইতিমধ্যে থানায় তিনকড়িরা হাজির হয়েছেন গাড়ি ছাড়ানোর আর্জি জানাতে। কিন্তু বনমালীর সাফ কথা— এ গাড়ি আদালত থেকে তিনকড়িদের ছাড়াতে হবে। গাড়ির কোনও কাগজপত্র নেই, নম্বর প্লেট নেই, গাড়িটা দেখতেও সন্দেহজনক, তার ওপর গাড়ি থেকে একটা বিদেশি সন্ত্রাসবাদী বেরিয়েছে। ইনস্পেক্টর জ্যাকসনকে হাজির করা হয়। সাতকড়ি আর কালীকিঙ্কর জ্যাকসনকে দেখে আঁতকে ওঠেন। ব্যাটার জান কী কড়া! মক্কেল এখনও বেঁচে আছেন? এখন তো ওঁর বয়স একশো পেরিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু চেহারাটা যে একটুও পালটায়নি! ব্যাটা জাদুমন্ত্র জানে নাকি! জ্যাকসন আস্ফালন করেই চলেছেন, “ইউ ব্লাডি সোয়াইন! আই ওয়ন্ট টু মিট দ্য ভাইসরয়! আই নো ইউ অল আর টেররিস্ট! ইউ হ্যাভ ক্যাপচারড মাই পুলিশ স্টেশন!”

বিচক্ষণ সাতকড়ির বুঝতে একটুও বাকি থাকে না যে, অধীরের গাড়িতে করে তাঁদের সঙ্গে ইনস্পেক্টর জ্যাকসনও নিজের অজান্তেই ২০১৭ সালের স্বাধীন ভারতে হাজির হয়েছেন। সাহেব এখনও ভাবছেন যে, তাঁদের রাজ চলছে এই দেশে।

তিনকড়ি বুঝতে পারছেন যে, জল মাথা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচতে গেলে এক্ষুনি তাঁকে কিছু একটা করতেই হবে। তিনকড়ি বাধ্য হন তাঁর পূর্বপুরুষ আর ইনস্পেক্টর জ্যাকসনের আসল পরিচয় জানাতে। বনমালী সব শুনে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তিনকড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন। বনমালীর চোখমুখ এমন ভয়ংকর আকার নেয় যে, তিনকড়িরা আর থানায় বসে থাকতে ভরসা পান না। তিনকড়ি তাও একবার শেষ চেষ্টা করেছিলেন সাত মাসের কচি পাঁচকড়িকে কোলে নিয়ে এসে বোঝাতে যে এই বাচ্চাটাই তিনকড়ির বাবা আর তাঁরই অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন খেতে তিনকড়িরা গিয়েছিলেন। এই কথা শুনে প্রথমেই বনমালী সেন তিনকড়িকে ঘাড় ধরে লকআপে পুরে দিলেন। তারপর তিনি এমন তেড়েফুঁড়ে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ আবৃত্তি করতে শুরু করলেন যে, সেই দাপটে পূর্বপুরুষের পল্টন তাঁদের কুলপ্রদীপকে ফেলে রেখেই এক লাফে থানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন।

১৭

“বিজ্ঞান যে আর কত বিস্ময় দেখাবে! বিস্ময়ের পর বিস্ময়!”

অধীর, এক্কি আর রিয়া রামকৃষ্ণ লেনের একটা রোয়াকে বসে আছেন। রাত এখন প্রায় আটটা। সারা দিনের ধকলে তাঁরা প্রচণ্ড ক্লান্ত। টাইম মেশিন যে পুলিশের দখলে সে খবর অধীর এক্কির থেকে পেয়েছেন।

অধীরের কথা শুনে এক্কি আর রিয়া একে অপরের দিকে তাকায়। অধীর তাঁর পায়চারি থামিয়ে রোয়াকের ওপর বসে পড়ে কিছুক্ষণ তাঁর জটপাকানো চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে তাঁর চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিলেন। তারপর তিনি শুরু করলেন, “ব্যাপারটা প্রথম থেকে তোদের বুঝিয়ে বলি। এই যে ত্রিকালানন্দ, ইনি হচ্ছেন আমার ঠাকুরদা সুধীরচন্দ্র চৌধুরী।”

অধীর ‘ত্রিকালানন্দ কথামৃত’ বইটা বের করে দেখান। আজ সকালে পৌরসভার অফিসের এক কর্মচারীর থেকে এটা তিনি পেয়েছিলেন।

“এখানে লেখা আছে স্বামী ত্রিকালানন্দের সাংসারিক নাম ছিল শ্রীসুধীরচন্দ্র চৌধুরী। জন্ম বাংলার ১৩১৮ সালে অর্থাৎ ইংরেজির ১৯১১ সাল। এই দেখো, ওঁর প্রথম জীবনের ছবি।”

অধীর বই থেকে সুধীরের ছবি দেখান। ছবি দেখে চমকে ওঠে এক্কি। “এনাকে তো আমি দেখেছি ১৯৪২-এ। আমার ঠাকুরদার অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলেন, একজন পাগলাটে জ্যোতিষী।”

“ঠিক। প্রথমজীবনে আমার ঠাকুরদার জ্যোতিষচর্চার খুব শখ ছিল। আমার সেই ঠাকুরদাই হয়ে উঠেছেন স্বামী ত্রিকালানন্দ।”

“কিন্তু এই স্বামীজি তো শুনেছি বিয়েই করেননি, আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন।”

“সেই কারণেই তো পৌরসভার খাতায় আমার বাবার, আমার আর রিয়ার জন্মের কোনও রেকর্ড নেই, অর্থাৎ আমরা এই জগতে জন্মাইনি।”

“সে আবার কী! তোমরা সবাই তো পরিষ্কার জন্মেছ।”

“জন্মেছি, এদিকে আবার জন্মাইনি, সেটা হয় কী করে? ধর, কেউ যদি অতীতে ফিরে গিয়ে আমার ঠাকুরদাকে কোনও লোভে ফেলে, যার বশবর্তী হয়ে আমার ঠাকুরদা সারাজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তা হলে কি আমার বাবার জন্ম হবে?”

“না।”

“আর আমার বাবা না জন্মালে আমি বা আমার মেয়ে রিয়ার জন্মেরও কোনও প্রশ্নই আসে না।”

অধীর ত্রিকালানন্দ কথামৃতের একটা পেজ খুলে সেখান থেকে পড়তে শুরু করেন, ‘১৩৪৯ সালের ৮ই পৌষ কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া তিথির রাতে যখন আকাশে পুনর্বসু নক্ষত্রের উদয় ঘটেছে, সেই লগ্নে আদি জ্যোতিষগুরু শ্রীভৃগু ছদ্মবেশে স্বামী ত্রিকালানন্দকে দর্শন দেন। শ্রীভৃগু চার চাকাওয়ালা এক অদ্ভুত রথে চেপে এসেছিলেন। স্বামীজির জ্যোতিষসাধনায় তুষ্ট হয়ে উনি স্বামীজিকে ওঁর রচিত ভৃগুসংহিতা থেকে পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন এবং স্বামীজির জ্ঞানচক্ষু উন্মোচন করে গেছেন। এর প্রতিদানে শ্রীভৃগু স্বামীজিকে আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের আদেশ দেন, যা স্বামীজি নিজের জীবনে বেদবাক্যের মতন পালন করেছেন। সেই কৃচ্ছ্রসাধনের ফলস্বরূপ আজ স্বামীজির প্রতিটা ভবিষ্যৎবাণী ফলে গেছে।’ একটানা এতখানি পড়ে অধীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “আর তারই ফলস্বরূপ আমাদের এই জগৎ থেকে অবলুপ্তি।”

রিয়া প্রশ্ন করে বসে, “এই ভৃগু আবার কে?”

অধীর বলেন, “আর্য ঋষি ভৃগু। ভারতবর্ষের আদি জ্যোতিষগুরু। ওঁর লেখা ভৃগুসংহিতার আসল পুঁথি শোনা যায় উত্তর প্রদেশের একটি পরিবারের কাছে সংরক্ষিত। সেই ভৃগুসংহিতায় আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যারা যারা জন্মেছে এবং ভবিষ্যতে জন্মাবে, তাদের সবার বিষয়ে নাকি সব তথ্য দেওয়া আছে।”

“অ্যাবসার্ড। তুমি এসব বিশ্বাস করো অধীরকাকা?”

“দেখ এক্কি, আমরা বিজ্ঞানী। আমরা প্রমাণ ছাড়া কোনও কিছুই বিশ্বাস করি না। এ কথা যেমন সত্যি, তেমনই আবার এই কথাটাও সত্যি যে, আমরা বিজ্ঞানীরা এখনও এই জগতের সকল রহস্যের নাগাল পাইনি। তাই ‘বিশ্বাস করি’ যদি নাও বলতে পারি, ‘বিশ্বাস করি না’— এ কথাটাও বোধহয় জোর দিয়ে বলতে পারি না। আমাদের মুনিঋষিরা সবাই ছিলেন এক একজন খুব উচ্চ জ্ঞানবান পুরুষ। বহু যুগ আগে আমাদের ঋষিদের লেখা বিভিন্ন টেক্সটের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের এমন অনেক সিদ্ধান্তই মিলে যাচ্ছে।”

“তা হলে তুমি বলতে চাও সত্যি সত্যি এই মহর্ষি ভৃগু সেদিন…”

“না, সেকথা একদমই আমি বিশ্বাস করি না। তোকে একটা হিন্ট দিই। ১৩৪৯ সালের ৮ পৌষ হচ্ছে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪২।”

এক্কি একবার রিয়ার দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে ওঠে, “২৪ ডিসেম্বর ১৯৪২! আরে ওইদিনই তো আমি আর বাবা আমার ঠাকুরদার অন্নপ্রাশনে হাজির হলাম। ওইদিন তো সুধীরদাদুও ওখানে ইনভাইটেড ছিলেন। সেইদিনই উনি জ্যোতিষগুরু শ্রীভৃগুর দর্শন পেলেন? আবার তারপর থেকেই ওঁর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল?”

“এখানে একটা রথের কথা বলা হয়েছে। সেটা কি আমার টাইম মেশিন? তুই আর তিনকড়ি ছাড়া মহর্ষি ভৃগুও কি আমার টাইম মেশিনে সেদিন চেপেছিলেন? কে সেই ভৃগু? কেন তিনি আমার ঠাকুরদাকে দেখা দিলেন, আর তিনি কী এমন সিদ্ধপুরুষ, যাঁর সংস্পর্শে এসে ঠাকুরদা ত্রিকালদর্শী হয়ে উঠলেন?”

এক্কি মাথা চুলকে বলে, “তোমার আর রিয়ার নন এগজ়িস্টেন্স না-হয় বোঝা গেল। কিন্তু তোমার সব রিসার্চ ওয়র্ক ওই উপাধ্যায়ের কী করে হয়?”

অধীর পকেট থেকে সিগার কেস বের করে দেখান, “এটা উপাধ্যায়র সিগার কেস, যা আমি টাইম মেশিনে পাই। আমি নিশ্চিত, ১৩ অগস্ট ২০১৭-র রাতে তোর আর তিনকড়ির সঙ্গে উপাধ্যায়ও এই টাইম মেশিনে করে ১৯৪২-এ গিয়েছিলেন। আর উনিই হচ্ছেন এই কথামৃতের মহর্ষি ভৃগু। তোদের সঙ্গে তোদের পূর্বপুরুষের দেখা হওয়ার আগেই উপাধ্যায় তাঁর কাজ সেরে ২০১৭-য় ফিরে এসেছিলেন। যে-রাতে তোরা গেলি, সেই রাতেই আমি আমার ল্যাবে টাইম মেশিনটা দেখি, যাতে করে আমি আর রিয়া তোদের নিতে আসি। তার মানে উপাধ্যায় একা ওটা ফেরত এনেছিলেন। কিন্তু তোদের নিয়ে আমি আর ১৯৪২ থেকে নিজেদের ২০১৭-য় ফিরতে পারলাম না। আমরা ফিরলাম এক অন্য ২০১৭-য়, এক অলীক জগতে।”

এক্কি আর রিয়া প্রচণ্ড অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়।

“অন্য ২০১৭ মানে?”

অধীরের চোখ জ্বলে ওঠে। তিনি বলেন, “বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে প্যারালাল ইউনিভার্স। বিজ্ঞানের স্ট্রিং থিয়োরি বলে, আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ড বিভিন্ন হেরফের অবস্থায় বিরাজ করে।”

“তার মানে?” এক্কি আর রিয়া কিছুই বুঝতে পারল না।

“আমি বলতে চাইছি যে, ঠিক আমাদের এই জগতের মতন আরও অনেক জগৎ আছে। মানে আমি, তুই, রিয়া— সবাই সেই জগতে আছি অন্য কোনওভাবে, অথবা হয়তো নেই। অবশ্য, আমরা না বলে আমাদের আর-একটা ভার্শন বলা যায় যা সেখানে আছে, কিন্তু হয়তো একটু অন্যভাবে। একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলি। ধর, এই মুহূর্তে তোর আর রিয়ার মধ্যে একটা ঝগড়া হল, মারামারি হল। এখান থেকে তিনটে পসিবিলিটি তৈরি হয়। এক, রিয়া তোকে মেরে ফেলল। দুই, তুই রিয়াকে মেরে ফেললি আর তিন, দু’জনেই তোরা বেঁচে রইলি। তা হলে দেখ, এই তাৎক্ষণিক ঘটনার জন্য তিনটে সমান্তরাল জগৎ তৈরি হল। একটাতে রিয়া আছে, এক্কি নেই। আর একটাতে এক্কি আছে, রিয়া নেই। আবার আর-একটাতে এক্কি আর রিয়া দু’জনেই আছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক-একটা তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর ঘটনার বিভিন্ন সম্ভাবনা থেকে এই এক-একটা জগতের সূত্রপাত। একেই বলে প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল জগৎ। হতেই পারে যে, তেমন কোনও জগতে তিনকড়ি হয়তো দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসে আছে। আবার অন্য কোনও জগতে এক্কি হয়তো একজন মিউজ়িক কম্পোজ়ার হয়ে বসে আছে। আবার আর এক জগতে রিয়া বা আমার হয়তো কোনও অস্তিত্বই নেই। হয়তো আমার বাবা বা আমার ঠাকুরদা আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। আমার ঠাকুরদা শুনেছি একটা সময় জ্যোতিষচর্চায় এমন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন যে, উনি সংসার করবেন না বলে ঠিক করেছিলেন, তারপর অবশ্য প্রেমে পড়ে উনি মত পালটান। আমার ঠাকুরমা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে বিয়ে করেছিলেন আমার ঠাকুরদাকে। যদি বিয়েটা না হত, তা হলে তো আর আমি এগজ়িস্ট করতাম না আজ।!”

অধীর দেওয়ালে একটা নকশা আঁকে, “ভাল করে বোঝার চেষ্টা কর। এক্কি, তিনকড়ি, উপাধ্যায় প্রথমে ২০১৭ থেকে ১৯৪২ সালে গেলেন। উপাধ্যায় সেখানে কিছু কারচুপি করে একা ফিরে এলেন ২০১৭-য়। সেই ২০১৭ থেকে আমি আর রিয়া তোদের ফিরিয়ে আনতে গেলাম। কিন্তু আমাদের ফিরে আসার আগেই উপাধ্যায়ের কারসাজিতে অতীতের ঘটনাক্রম পালটে গেল।”

“মানে তুমি বলতে চাইছ, সুধীরদাদু উপাধ্যায়ের চিঠি পেলেন, আর উনি ভাবলেন মহর্ষি ভৃগুর লেখা চিঠি?” এক্কির কাছে ব্যাপারটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে।

“ঠিক তাই!” অধীরের কণ্ঠে উত্তেজনা স্পষ্ট, “আর সেই চিঠি উনি পেয়েছেন আমার আর রিয়ার ১৯৪২ সালে পৌঁছনো এবং আমাদের সবার চলে আসার মধ্যে কোনও এক সময়ে। মানে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪২ সকাল আটটা থেকে ন’টার মধ্যে। আর এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উনি জ্যোতিষচর্চায় মজে গিয়ে ভগবান ভৃগুর বা বকলমে উপাধ্যায়ের নির্দেশে বিয়ে করলেন না। সেই চিঠি পাওয়ার সময় যেহেতু আমরা সবাই সেখানে ছিলাম তাই সেই অতীতের ঘটনাক্রমের বিকৃতির ফলস্বরূপ আমরা সবাই এক অলীক ২০১৭-য় চলে এসেছি, যা আসলে একটি প্যারালাল ইউনিভার্স। মানে সেই কোটি কোটি সম্ভাবনাময় জগতের মধ্যে একটিতে আমরা এখন আছি। এই জগতে আমার ঠাকুরদা বিয়ে করেননি, তাই আমার বাবা, আমার আর রিয়ার জন্ম হয়নি। কিন্তু সময়ের নিজস্ব নিয়মে এই জগতে তোর বাবা তিনকড়ির জন্ম হয়েছে আর সেই সূত্রে তোরও জন্ম হয়েছে। তাই এই জগতে আরও একজন তিনকড়ি আর এক্কি আছে, যারা এই জগতের আসল তিনকড়ি আর এক্কি। তুই বা তোর বাবাও আমার আর রিয়ার মতন এখানে ফালতু, নন এগজ়িস্টেন্ট।”

রিয়া এক্কির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে। এক্কি হেসে ফেলে।

আশা করি পাঠকদের কাছে এবার তিনকড়ি (২) আর এক্কি (২)-র রহস্যটা পরিষ্কার হল।

অধীর বলে চলেন, “এই জগতে কল্যাণীর জন্ম হয়েছে, সে স্বাভাবিকভাবেই এই জগতে আমার স্ত্রী নয়। দেখলাম সে ওই আশ্রমের এক শিষ্যা।”

রিয়া বলে, “মা’র সঙ্গে আমাদেরও দেখা হয়েছে, আমাদের চিনতে পারেনি।”

“আচ্ছা, ঠিক যেমন আমার বা আমার বাবার বা কল্যাণী কাকিমার জন্ম হয়েছে এই জগতে, নিশ্চয়ই তেমনই উপাধ্যায়েরও জন্ম হয়েছে এই জগতে?”

“Exactly!” অধীর বলেন, “এই জগতের উপাধ্যায় সেই ১৯৪২ সালের কারচুপির ব্যাপারে কিছুই জানে না। আমাদের জগতের আসল উপাধ্যায় নিশ্চয়ই ১৯৪২ সালে সুধীরদাদুর কাছে ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন যাতে আমার থিসিস পেপারগুলো এই জগতের উপাধ্যায়কে দেওয়া হয়। মানে, উপাধ্যায় তাঁর নিজের জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করে নিলেন অতীতের কারচুপির মাধ্যমে। নির্ঘাত স্বামী ত্রিকালানন্দের নির্দেশে তিনি ওই আশ্রমের মোহন্তর থেকে আমার থিসিস পেপারগুলো একের পর এক পেয়ে গেছেন, যেগুলো নিজের নামে চালিয়ে উনি হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী। উপাধ্যায় এমনভাবে প্ল্যানটা করেছিলেন যাতে উনি জানতেন যে, আমি ওঁর ট্র্যাপে পড়ব। উনি টাইম মেশিনের ডেট সেইভাবে সেট করে দিয়েছিলেন যাতে আমি পৌঁছবার পর ওঁর কারচুপির এফেক্ট শুরু হবে আর আমি তোদের নিয়ে আমাদের আসল ২০১৭-য় আর ফিরতে পারব না। সেখানে আমি হয়ে যাব নিখোঁজ, যা উপাধ্যায় বরাবর চেয়ে এসেছেন— আমাকে মিটিয়ে ফেলতে। আর অন্য ২০১৭-য় তিনি তাঁর আর-একটা সত্তার দ্বারা নিজের অপূর্ণ বাসনাগুলো চরিতার্থ করালেন। আমার পরাজয়কেই উপাধ্যায় নিজের জয় বলে মনে করলেন। আমাদের নিজেদের ২০১৭-য় ফিরে যাওয়াটাই হবে উপাধ্যায়ের পরাজয়।”

এক্কি আর রিয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। রিয়া বাবার দিকে তাকিয়ে বলেন, “আমাদের এই ভুলভুলাইয়া থেকে বেরোনোর উপায় কী?”

“আমাদের আবার ১৯৪২-এ ফিরে যেতে হবে আর গিয়ে ওই অতীতের ঘটনাক্রমের বিকৃতি আটকাতে হবে। তা হলেই আমরা আমাদের নিজেদের ২০১৭–য় ফিরতে পারব।”

এক্কি উত্তেজিত হয়ে উঠে পড়ে বলে, “আর তার জন্য আমাদের টাইম মেশিন ফিরে পেতে হবে।”

১৮

তিনকড়ি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আজ সকালে এক্কি (২) তাঁকে লকআপ থেকে ছাড়িয়ে এনে বাড়ির একটা ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছে। গত রাতে এক্কি (২)-র পাকাদেখা অনুষ্ঠানে ভোম্বল আর দেবুর সঙ্গে তিনকড়ি (২)-র ঝগড়া লেগে যায়। দেবু আর ভোম্বলের দোষ বলতে সকালে তিনকড়ির পাগলামোর কথাটা তোলা। ব্যস, মাথা গরম করে অনুষ্ঠান ফেলে তিনকড়ি (২) বাড়ি ছেড়ে চলে যান, সারা রাত বাড়ি ফেরেননি। এক্কি (২) সকালে খবর পান যে, সারা রাত তিনকড়ি (২) লকআপে বন্ধ ছিলেন। সারা রাত তিনকড়ি লক আপে তাঁর পূর্বপুরুষদের নাম ধরে এমন ডাকাডাকি করেছেন যে, পুলিশদের ঘুমের দফারফা হয়ে গেছে। তাই সক্কাল-সক্কাল খবর পাঠানো হয়েছে থানা থেকে। বুঝতেই পারছেন যে তিনকড়ি (২)-র বদলে তিনকড়িকে নিয়ে এসেছে এক্কি (২)। বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই তিনকড়ি ‘ও বাবা, ও ঠাকুমা, ও ঠাকুরদা’ বলে চিলচিৎকার করেই যাচ্ছেন। তিনি বলছেন, পিটিশান লিখে পাড়ার প্রত্যেকটা লোককে দিয়ে সই করিয়ে তিনকড়ি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাবেন যাতে পুলিশ অধীরের গাড়িটা ছেড়ে দেয়। ওঁর এই অদ্ভুত আচরণ নিয়ে পাড়াসুদ্ধ সবাই বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তিনকড়ির সব পাড়ার বন্ধুরা মানসীর সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করে স্থির করেন যে, এই সমস্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে গেলে একমাত্র স্বামী ত্রিকালানন্দের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। ওই আশ্রম থেকে কোনও তাবিজ বা মাদুলি ধারণ করলে যদি তিনকড়ির পাগলামো বন্ধ হয়।

স্বামী অদ্ভুতানন্দ মানসীর থেকে সব কথা জানলেন। জানলেন যে তিনকড়ি বলে বেড়াচ্ছেন অধীর চৌধুরী নামে কোনও একজনের গাড়িতে চেপে তিনি নাকি ১৯৪২ সাল থেকে তাঁর পূর্বপুরুষদের এই ২০১৭ সালে বেড়াতে নিয়ে এসেছেন। আর সেই গাড়ি পুলিশে আটক করে নিয়েছে বলে তিনকড়ির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অদ্ভুতানন্দ নিশ্চিত হন— এই সেই অলৌকিক গাড়ি। গুরুদেবের কথা যে বেদবাক্য তা তো সবাই জানে।

নিজের প্রভাব খাটিয়ে অদ্ভুতানন্দ সেই গাড়ি থানা থেকে নিজের আশ্রমে আনিয়ে নিয়েছেন, এই খবর শুনে অধীর সাতকড়িদের বিশেষ কোনও আশার আলো দেখাতে পারেন না। শুধু বলেন একটু ধৈর্য ধরতে।

আর ধৈর্য! সাতকড়ি বুঝে গেছেন যে ১৯৪২ থেকে ২০১৭— এই পঁচাত্তর বছর মুছে গেছে তাঁদের জীবন থেকে। এই ২০১৭ থেকেই তাঁদের বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। কিন্তু নিজের পেশা ঘটকালি করে তো আর এখানে থাকা যাবে না। ঘটকদের নাকি আজকাল কোনও কদরই নেই। সবাই নাকি কীসব কমপিউটার নামে এক সবজান্তা মেশিনে নিজের নিজের জীবনসাথি খুঁজে পেয়ে যায়। হায় রে! পৃথিবীটা এতটা এগিয়ে গেল এই কয়েক বছরে?

কালীকিঙ্কর কিন্তু মরিয়া হয়ে একবার শেষ চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর জেলা পাবনায় ফিরে যাওয়ার গাড়ি কোথা থেকে পাওয়া যাবে সেই কথা একজন ট্র্যাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। একবার অন্তত যদি নিজের জায়গায় ফিরতে পারেন, তারপর সেখান থেকে না-হয় নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁর বর্তমান বংশধর অবধি পৌঁছবেন। তারপর তাকে বলে-কয়ে কোনও বিজ্ঞানী ধরে আবার নিজের সময়ে অর্থাৎ ১৯৪২-এ ফেরা যাবে। অধীরের ওপর তাঁর আর কোনও ভরসা নেই। যাঁর কোনও অস্তিত্বই নেই এই জগতে, তাঁর ওপর ভরসা করে বসে থাকার মতো বোকা কালীকিঙ্কর নন। কিন্তু জানা গেল, পাবনা যেতে গেলে পাসপোর্ট লাগবে, ভিসা লাগবে। পাবনা এখন আর নাকি ভারতবর্ষের মধ্যেই পড়ে না। স্বাধীনতা পাওয়ার সময় দেশ ভাগ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন আর-একটা ভিন্ন দেশ। কালীকিঙ্করের বুকটা যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। দেশ ভাগ হয়ে গেছে? তিনি আর ভারতবাসীই নন তা হলে? এই দিন দেখার জন্যই কি হাজার হাজার বিপ্লবী দেশভক্ত স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন?

উপাধ্যায় অধীরকে নিয়ে খুব বেশি মাত্রায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অধীরের কোনও পরিচয়পত্র নেই, তাঁকে কেউ চেনে না, তাই অধীরকে বিদেশি গুপ্তচর সাব্যস্ত করতে উপাধ্যায়কে বেশি বেগ পেতে হল না।

১৯

অধীর এখন থানায় ইন্সপেক্টর বনমালী সেনের জিম্মায়। লকআপে অধীরের পাশে বসে শিশি-বোতলওয়ালা মদন ‘বনলতা সেন’ খুলে ঢুলতে ঢুলতে অধীরের গায়েই উলটে পড়ে। তার ঝিমুনি কেটে যায়। অধীরের মতো ভদ্র পোশাকের লোককে থানার লকআপে বসে থাকতে দেখে মদনের একটু খারাপই লাগে, কিন্তু তারপরেই মনে হয় ভদ্রলোকগুলোই সব এক-একটা চোর-ছ্যাঁচড় বেরোয়। মদন অধীরের সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে।

“নতুন মনে হচ্ছে এই লাইনে? কোনও নাভ নেই! যতই ভদ্দরনোক হন না কেন, আর যতই নোকজনের ছাতে চেনা-জানা থাকুক, এই বনমানী ছেন বড্ড কড়া নোক গো। আমার নিজের কি কম বড় বড় নোক চেনা-জানা আচে? দেখচেন না ছাহেব হয়েও ওই ব্যাটার ছাড়ান নেই?”

অধীর দেখলেন পুলিশের পোশাকে একজন সাহেব-কয়েদি ‘সহজ পাঠ’ খুলে বসে বসে ঢুলছেন। বাইরে পাড়ার মাইক থেকে ‘বন্দে মাতরম্’ গান ভেসে আসছে। সেই শুনে নিজের মনে মাঝে মাঝে গজগজ করছেন সেই সাহেব। অধীর জিজ্ঞেস করেন, “বড় বড় লোকজনদের সঙ্গে আপনার চেনা-জানা?”

“তা নয় তো কী? আমি ছিছি-বোতল-কাগজওয়ানা, জানেন? ছয়ং ওই ছামি তিকালানন্দের আচ্ছমের যত ছিছি, বোতন, কাগজ— ছব আমাকে বিক্কি করে। ওই আচ্ছমের যতগুনো মহন্ত আছে, ছব আমার এক গেনাসের ইয়ার। একছাথে রাতে বছে ভোলার ছুড়িখানায় আমরা বাঙনা খাই। ছুধু তাই? আমাদের এনাকার যত খেনোয়াড়, গায়ক, মন্তী, কেট্ট, বিট্টু, এমনকী ওই যে বিজ্ঞানী, যাকে নিয়ে আজকাল খবরের কাগজে, টিভিতে খুব মাতামাতি হচ্চে গো, ওই পঙ্কজ উপাধ্যায়, তারও বাড়ির পুরনো ছিছি-বোতন-কাগজ এই ছম্মাকেই বিক্কি করে। এত্তো ছব বড় বড় নোকজনদের ছাথে জানাছোনা থেকেও কী হচ্ছে? কী করেচি আমি? নেছা করে বউকে এট্টু ঠেঙাতে চেয়েছি! এইটুকু ছাধীনতা যদি আমার না থাকে তালে কীছের ছালা কাল ছাধীনতা দিবছ!”

অধীর এবার বিরক্ত হচ্ছিলেন, এমন সময় লকআপের দরজা খুলে ইন্সপেক্টর বনমালী অধীরকে বাইরে ডাকেন। অধীরের সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছেন।

থানার একটা ঘরে অধীর, ইন্সপেক্টর, এক্কি আর রিয়া বসে। টেবিলের অপর প্রান্তে কল্যাণী বসে আছেন। নিজের আইডি কার্ড বের করে কল্যাণী দেখিয়ে বলেন, “কল্যাণী দত্ত, সিবিআই। আসলে আমি একটা সিক্রেট মিশনে আছি। আমরা এই ত্রিকালানন্দের আশ্রমের লোকজন আর বিজ্ঞানী উপাধ্যায়কে অনেকদিন ধরে সাসপেক্ট করছি। ওরা এই আশ্রম থেকে একটা বাজে র‌্যাকেট চালাচ্ছে বলে আমাদের বিশ্বাস, সাধারণ মানুষের টাকা মেরে দেওয়ার খুব বড় ব্যাবসা এটা। কিন্তু আমাদের কাছে কোনও কংক্রিট প্রুফ না থাকায় ওদের ধরতে পারছি না। অধীরবাবু, আপনি মনে হয় এই ব্যাপারে আমাদের কিছু ইনফরমেশন দিতে পারবেন, তাই আপনার সাহায্য চাই।”

এক্কি আর রিয়াকে দেখিয়ে কল্যাণী বলেন, “আপনাদের সম্পর্কে এদের দু’জনের থেকে অনেক অদ্ভুত কথা শুনলাম। দেখুন অধীরবাবু, ব্যাপারটা সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় আজগুবি। কিন্তু এও মনে হয়, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নানা রহস্যের কতটুকুরই বা আমরা খবর রাখি! আপনি বিজ্ঞানী, তাই আপনার কথা বিশ্বাস যদি নাও করতে পারি, অবিশ্বাসই বা করি কেমন করে?”

বনমালী সেন এতক্ষণ হাঁ করে সব শুনছিলেন। তিনি বলেন, “কিন্তু ম্যাডাম, এর পরের স্টেপগুলো আমাদের খুব ক্যালকুলেট করে নিতে হবে। পুলিশকে তো নিজেদের পকেটে পুরে রেখেছে এরা। এদের ট্র্যাপ করা যায় কীভাবে?”

অধীর বলেন, “লকআপে এক মাতাল শিশি-বোতলওয়ালা আছে। ও ওদের দু’জনের থেকেই কাগজ কেনে।”

“তাতে কী হবে?” বনমালী সেন প্রশ্ন করেন।

“আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। আপনাদের শুধু ওই শিশি-বোতলওয়ালাকে দিয়ে আমি যেমন যেমন বলব তেমন তেমন করাতে হবে। আর আমার এই গাড়িটা ওই আশ্রমে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে।”

“ওই আশ্রমের মোহন্ত অদ্ভুতানন্দ তো উঠেপড়ে লেগেছে গাড়িটা এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে। আমিই ছাড়ছিলাম না। ওপরমহলকে দিয়ে ইতিমধ্যে এই নিয়ে দু’-দুটো ফোন করিয়ে ছেড়েছে ওই অদ্ভুতানন্দ।”

“তা হলে তো ভালই হল। এবার আমি যা বলছি শুনুন।”

অধীরের প্ল্যান শুনে কল্যাণী সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। অধীর সবার সামনে ওই ঘরে বসেই কাগজে একটা বড়সড় লেখা লেখেন। কাগজটাকে ঘষাঘষি করে পুরনো ধাঁচের করা হয়।

মদনকে সেই ঘরে ডেকে এনে, তাকে সব বুঝিয়ে তার হাতে অধীরের সেই কাগজপত্র ধরিয়ে বনমালী সেন বলেন, “এই কাজটা যদি ঠিকঠাক করে করতে পারিস তা হলে তুই খালাস।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *