সমান্তরালের রহস্য – ১০

১০

কলকাতা শহরে জাপানিদের আক্রমণের ফলে এক ভয়ানক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সবাই শহর ছেড়ে পালাচ্ছে, সাতকড়িও পালাতে চান, কিন্তু পালিয়ে যাবেন কোথায়? দেশের বাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে বাপ নকড়ির আমল থেকে একটা আমবাগান নিয়ে তাঁদের মামলা চলছে, যার দরুন একে অপরের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এখন বিপদে পড়ে যে তাঁদের শরণাপন্ন হবেন, এতে সাতকড়ির আত্মসম্মানে ঘা লাগে। এমন সময় তিনকড়ি মুশকিল আসান হিসেবে সাতকড়ির কাছে প্রস্তাব পাড়েন, “তুমি তোমার নাতির বাড়ি চলো! ২০১৭ সালে! ঠিক যেমনভাবে আমরা অতীত দেখে গেলাম, ঠিক তেমনভাবে তোমরাও তো ভবিষ্যৎ দেখে আসতে পারো ঠাকুরদা! তোমাদের নাতবউয়ের হাতে মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক আর মুড়িঘন্ট খেয়ে আসতে পারো তো! অধীরের গাড়ি আছে কী করতে? কয়েকদিন আমাদের ওখানে থেকে বিপদ-আপদ কাটিয়ে তোমাদের সময়ে আবার ছেড়ে দিয়ে যাব! এখন তো আকছার আসা-যাওয়া চলবে!”

এই প্রস্তাব এক্কির বড্ড বাড়াবাড়ি মনে হয়, অধীরকাকাকে জিজ্ঞেস না করে এমন কাজ করাটা তাদের একেবারেই উচিত হবে না। এক্কি তিনকড়িকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তিনকড়িকে আটকায় কার সাধ্য! সাতকড়িদেরও এই প্রস্তাব খুবই লোভনীয় মনে হয়। সাতকড়ি, উমা, তাঁদের সাত মাসের ছোট ছেলে পাঁচকড়িকে নিয়ে ঠিক করেন ভবিষ্যৎ দেখতে যাবেন। কালীকিঙ্করের কিন্তু ঘোরতর সন্দেহ পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। আবার ব্যাপারটা যদি সত্যি হয় তা হলে এমন ব্যাপার দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হবেন তিনি। তাই সাতপাঁচ ভেবে সন্দেহ মোচনের জন্য কালীকিঙ্করও যেতে চাইলেন।

সবাই সেজেগুজে তৈরি। তাঁরা স্বাধীন ভারতে বেড়াতে যাচ্ছেন। যদিও এক্কির বক্তব্য, “সত্যিকারের স্বাধীন হতে আমাদের এখনও অনেক দেরি আছে। আগে ইংরেজরা আমাদের চালাত, এখন কিছু দেশি মাতব্বর আমাদের চালায়।”

এই কয়েক বছরে দেশটা, দেশের মানুষজন কতখানি পালটে গেছে কে জানে! মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ— এসব কত কিছুরই তো নাম তাঁরা সারা রাত ধরে শুনেছেন এক্কির কাছে। যন্ত্র সভ্যতার স্বর্ণযুগ নাকি ওই ২০১৭। মানুষ নাকি একে অপরের সঙ্গে মুখে কথা কম বলে। কী নাকি মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপে টাইপ করে করে কথা বলে। বাবা, টাইপ নামটা শুনলেই যে সাতকড়ির গায়ে জ্বর আসে। সাহেবি অফিসে তিনি কয়েকটা টাইপ রাইটার দেখেছেন। একটা বাক্য টাইপ করতে সাতকড়ির এক ভগ্নিপতির প্রায় দশ মিনিট সময় লাগে। ২০১৭-য় যদি সেই টাইপ করে ওঁদের কথাবার্তা চালাতে হয় তা হলেই তো তাঁদের হয়ে গেছে! সাতকড়ি মনে মনে বেশ টেনশনের মধ্যেই আছেন।

এমন সময় হঠাৎ সুধীর হাজির। তাঁর হাতে একটা খাম। সুধীর সেই খাম নেড়ে নেড়ে খুবই উত্তেজিতভাবে বললেন, “এই যে সাতকড়ি, যারা দু’পাতা ইংরিজি পড়ে আমাদের দেশের প্রাচীন বিদ্যাকে অগ্রাহ্য করে, তারা এবার বুঝবে মজা! তুমি জানিয়ে দিয়ো ওই ভবানীপুরের দত্তদের, মেয়ে সুন্দরী বলে বেশি দেমাক দেখানো! এবার আমিও দেখিয়ে দেব! এই দেখো, ভগবানের চিঠি আমার জন্য! আমি হব পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা!”

যেমন ঝড়ের গতিতে বাড়িতে এসেছিলেন ঠিক তেমনই ঝড়ের গতিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন সুধীর। সাতকড়ির দৃঢ় ধারণা হল যে, তাঁর প্রাণের বন্ধু চিরতরে পাগল হয়ে গেছেন। এই জ্যোতিষচর্চাই সুধীরের সর্বনাশ করবে। কিন্তু কালের টানে স্থান আর পাত্রকে অগ্রাহ্য করে সাতকড়ির মন এখন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় সওয়ার। তাঁর মাথায় এখন শুধুই ২০১৭। পঁচাত্তর বছর পর জীবন কী বিস্ময় সৃষ্টি করেছে তা নিজের চোখে দেখার সুযোগ কি আর কেউ পায়!

পুলিশের কর্তাব্যক্তি জ্যাকসনসাহেবের গতকাল রাত থেকে ঘুম ছুটে গেছে। একে তো জাপানিদের হাঙ্গামা, তার ওপর কাল রাতের সেই অদ্ভুত গাড়ি। আজ সকালে জ্যাকসন এলাকায় টহলে বেরিয়েছিলেন, এখন বাজে প্রায় সকাল সোওয়া আটটা। হঠাৎ… এ কী! সেই গাড়িটাই না? ঠিক তাই! জ্যাকসন একটা দেওয়ালের পিছনে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে সেই গাড়ির ওপর নজর রাখতে শুরু করেন। গাড়ির ভিতরে এবার অন্য একজন লোক আর তাঁর সঙ্গে একটি মেয়ে। দু’জনেই প্রচণ্ড বিস্মিত হয়ে চারপাশ দেখছে বলে মনে হচ্ছে। কী মতলব ওদের? এ নিশ্চয়ই কোনও বিপ্লবীদলের কাণ্ড, না হলে জাপানি এজেন্ট। গাড়িটা দেখে শেষের সন্দেহটাই বেশি প্রবল বলে মনে হয় জ্যাকসনের। তিনি লুকিয়ে নজর রাখতে থাকেন।

ইতিমধ্যে স্ত্রী উমা, তাঁদের সাত মাসের খোকা পাঁচকড়িকে নিয়ে তিনকড়ি আর এক্কির সঙ্গে সাতকড়ি বেরিয়ে পড়েছেন ভবিষ্যৎ দেখতে। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচন গেলার মতো মুখ নিয়ে চলেছেন কালীকিঙ্করও। তাঁদের সঙ্গে একটা বড় ট্রাঙ্ক, তাতে উমার শাড়ি আর গয়না। সাতকড়ি আপত্তি জানিয়েছিলেন কিন্তু উমা কোনও কথা শোনেননি। মেয়েমানুষ হয়ে উমা বেড়াতে যাবেন অথচ শাড়ি-গয়না নেবেন না? নাতবউয়ের কাছে তা হলে তাঁর মুখ থাকবে? তাঁর স্বামী কি এলিতেলি নাকি!

তাঁরা সবাই মিলে সেই অধীরের গাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে সেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন অধীর, সঙ্গে রিয়া। রিয়া ছুটে এক্কির কাছে এসে অবাক চোখে এক্কিকে দেখতে থাকে। এক্কি চোখের ইশারায় তাকে জানায় যে তারা ঠিক আছে। তিনকড়ি অধীরকে দেখতে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। তিনি নিজের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সাগ্রহে অধীরের পরিচয় করিয়ে দিয়ে অধীরকে জিজ্ঞেস করেন, “তুই হঠাৎ এখানে কী করে?”

অধীর তিনকড়ি আর এক্কিকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলেন, “তোর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে পুরো ব্যাপারটা সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম। বাড়িতে ফিরে এসে আমি অবাক হয়ে দেখি যে টাইম মেশিন গ্যারেজেই আছে। আমি গাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখতে পাই যে স্ক্রিনে তারিখ সেট করা ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪২। তার মানে নিশ্চয়ই তোরা এই সময়ে গিয়ে কোনও বিপদের মধ্যে পড়েছিস। কিন্তু এই ডেট তো আমি সেট করিনি। তা হলে কে করল? আর তোরা যদি নাই ফিরিস তা হলে টাইম মেশিন ফিরল কী করে? তোরা ছাড়া কি অন্য কেউ ছিল এতে?”

এক্কি খুব জোর দিয়ে বলে, “না তো অধীরকাকা। আমরা দু’জনেই তো ছিলাম।”

অধীরের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।

সবকিছু শুনে রিয়া হতবাক! বাবা যে এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে তা রিয়ার ধারণার বাইরে। বাবার ওপর তার যত ক্ষোভ আজ হঠাৎ কেমন যেন মিলিয়ে গেল। সে আজ জীবনে প্রথমবার বাবাকে নিয়ে গর্বিত।

এর মধ্যে তিনকড়ি একটা বায়না জুড়ে দিয়েছেন, “আচ্ছা অধীর, আমি ভাবছিলাম আমার বাবা, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা আর মামাদাদুকে একবার আমাদের যুগটা ঘুরিয়ে আনলে কেমন হয়? বেশ একটু হাওয়া বদল হত।”

অধীর চটে যায় এই কথা শুনে, “মানে! আমি কি ট্রাভেল এজেন্সি খুলেছি নাকি যে, লোকজনকে এক যুগ থেকে আর-এক যুগে হাওয়া বদল করতে নিয়ে যাব! এর কী ভয়ানক পরিণতি দাঁড়াতে পারে ভাবতে পারিস?”

“অমন করছিস কেন? আমি না-হয় আমার দোকানে তোর যত বাকি সব মাফ করে দিলাম! তা হলে তো একটা ব্যবস্থা করবি! তোর ওই আপেলখেকো বিজ্ঞানীর দিব্যি, কিছু একটা ব্যবস্থা কর না!”

অধীর তিনকড়িকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন, “দেখ তিনকড়ি, নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মানুষের বেশি জেনে ফেলা ভাল না। আমি ওই রিস্ক নিতে পারব না।”

তিনকড়ি নাছোড়বান্দা, “আরে বাবা আমি বলছি কিচ্ছু হবে না। এই তো আমরা কেমন অতীত ঘুরে দিব্যি ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাচ্ছি।”

“না তিনকড়ি, তা হয় না। আমি আর দেরি করতে পারব না। তুই আর এক্কি উঠে পড়, আমাদের ফিরতে হবে।”

তিনকড়ি এবার মোক্ষম চালটা চালেন, “ও, তার মানে তুই আমার পূর্বপুরুষদের নিয়ে যাবি না? ঠিক আছে, আমিও তা হলে ফেরত যাব না। যা তুই ফিরে যা!”

“কী বলছিস তুই তিনকড়ি? এই কথার মানে বুঝিস তুই? তিনকড়ি, এমন জেদ করিস না।”

“আমি যাব না! ব্যস!”

অধীর বুঝতে পারেন যে, তাঁর এই গোঁয়ারগোবিন্দ বন্ধুর সঙ্গে জেদে তিনি পারবেন না। অনেক ভেবে অধীর বলেন, “তা হলে কিন্তু বেশিক্ষণ ওঁদের ওখানে রাখা যাবে না। একবার ঘুরিয়েই ফেরত দিয়ে যেতে হবে।”

তিনকড়ি তাতেই খুশি। আনন্দে অধীরকে তিনি চুমু খেয়ে ফেলে লাফাতে লাফাতে পূর্বপুরুষদের কাছে গেলেন খবর দিতে। টাইম মেশিনে বসতে গিয়ে অধীরের চোখ আটকায় গাড়িতে পড়ে থাকা একটা সিগার কেস দেখে। এই সিগার কেস তাঁর খুব পরিচিত।

এক্কি আর রিয়া রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছে। এমন বিস্ময়কর ঘটনা যে তাদের জীবনে ঘটবে, তারা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তাদের উলটোদিকের দেওয়ালে ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ পোস্টার। তাদেরই পাড়া, কিন্তু বাড়িগুলো পুরনো। মানুষজন বিশেষ এখন দেখা যাচ্ছে না যদিও, কিন্তু এই সব বাড়িতে তাদেরই সব প্রতিবেশীদের পূর্বপুরুষরা থাকেন।

“অধীর কাকার ওপর রাগটা এবার একটু কমল? বুঝলি তো, উনি একজন জিনিয়াস?”

এক্কির কথায় ঘোর কাটে রিয়ার। সে বলে, “এক্কি আমিএখনও বিশ্বাস করতে পারছি না! ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪২? তার মানে গতকাল রাতে এখানে জাপানিরা বোমা ফেলেছে? সেকেন্ড ওয়র্ল্ড ওয়ার চলছে? তার সঙ্গে গাঁধীজির ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন!”

“হ্যাঁ। তোর কাছেই তো আমি শুনেছিলাম ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪২ কলকাতার কোথায় কোথায় জাপানিরা বোমা ফেলেছিল। তাই তো ওঁদের কাল রাতে বলেছি যে, এই এলাকায় কোনও এফেক্ট হবে না।”

রিয়ার খুব ইচ্ছে ছিল তাদের বাড়িটা একবার দেখার। কিন্তু অধীরের ডাক শোনা যায়— “উঠে আয় সবাই।”

সাতকড়ি, তিনকড়ি, এক্কি, রিয়া, কালীকিঙ্কর আর পাঁচকড়ি কোলে উমা টাইম মেশিনে উঠে বসেন।

এদিকে ব্যাপারস্যাপার সব লুকিয়ে দেখতে দেখতে জ্যাকসনসাহেবের তো আক্কেল গুড়ুম! এ কী হচ্ছে! এতগুলো লোক এই গাড়ি করে কোথায় যাচ্ছে? এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনও গভীর ষড়যন্ত্র আছে। অগত্যা জ্যাকসনসাহেব তাঁর সেপাইদের সেই গাড়ি ফলো করার নির্দেশ দিয়ে, নিজে সেই গাড়ির ডিকি খুলে চুপিচুপি তাতে সেঁধিয়ে গেলেন।

সেপাইরা গাড়ি নিয়ে তৈরি, কিন্তু তাদের চোখের সামনে থেকে জলজ্যান্ত একটা গাড়ি আলোর ঝলকানি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে অদৃশ্য হয়ে গেল! জ্যাকসনসাহেব কি তা হলে মহাপ্রস্থানের পথে বেরিয়ে পড়লেন? স্বদেশি-টদেশি হলে না-হয় কথা ছিল, কিন্তু সাক্ষাৎ ভূতের সঙ্গে সামান্য পুলিশ হয়ে তারা কী করে এঁটে উঠবে? রামনাম জপতে জপতে সেপাইরা যে যেদিকে পারল দৌড় লাগাল।

১১

গাড়ি থেকে গুটিগুটি পায়ে নেমে এলেন তিনকড়ি। গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিতেই তিনকড়ির পূর্বপুরুষরা বিস্ফারিত চোখে ভবিষ্যতে পদার্পণ করলেন। বাঃ! কী উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ! কী সুন্দর সুন্দর সব বাড়িঘর। সাতকড়ি তাঁর নিজের পাড়াটাকে চিনতেই পারছেন না। এত পরিবর্তন ঘটে গেছে এই কয়েক বছরে! হবেই তো, স্বাধীন ভারতবর্ষ বলে কথা! তিনকড়ি রাজকীয় ভঙ্গিতে পূর্বপুরুষদের নিয়ে এগিয়ে চললেন নিজের বাড়ির দিকে। অধীর তাঁকে আবার মনে করিয়ে দেন, “বেশিক্ষণ কিন্তু না।” তিনকড়ি কথাটা কানে নিলেন বলে অধীরের মনে হল না। যতক্ষণ না পূর্বপুরুষদের আবার তিনি নিজেদের সময়ে ফিরিয়ে দিতে পারছেন ততক্ষণ অধীর নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। যদি কোনও গন্ডগোল হয়, তার কী ভয়ানক পরিণতি হতে পারে অধীর সেটা ভেবে আঁতকে ওঠেন। অধীরের উৎকণ্ঠা হঠাৎ করে শত গুণ বাড়িয়ে দেয় একটা দৃশ্য।

অধীর তাঁর বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন যে, সেটা আর তাঁর নিজের বাড়ি নেই, সেটা হয়ে গেছে ‘স্বামী ত্রিকালানন্দ সেবাশ্রম’। সেই আশ্রমের বাইরে অগণিত মানুষের ভিড়। এ কীভাবে সম্ভব?

অধীর সেই বাড়িতে ঢুকতে যান, কিন্তু তাঁকে লাইনে দাঁড়াতে হবে। এটা নাকি আর তাঁর বাড়ি নয়, এটা প্রখ্যাত জ্যোতিষী এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা স্বামী ত্রিকালানন্দের পৈতৃক বাড়ি— যা এখন আশ্রম হয়ে উঠেছে। বাড়িতে ঢোকার মুখে অধীর একটা কাউন্টার দেখতে পান, যার সামনে একটা বোর্ডে স্বামী ত্রিকালানন্দের পরিচয় জানিয়ে একটা লেখা আছে। স্বামী ত্রিকালানন্দের মতন অমন অব্যর্থ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নাকি এই পৃথিবীর ইতিহাসে আর কেউ হননি। ওঁর সমস্ত ভবিষ্যৎবাণী বেদবাক্যের মতো নাকি ফলে গেছে। উনি সেই চল্লিশের দশকে বসে বলে দিয়েছেন যে, কবে ভারত স্বাধীন হবে, কবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবে, কবে গাঁধীজি মারা যাবেন, কবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, কবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়বে, কবে ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে পড়বে ইত্যাদি। স্বামী ত্রিকালানন্দের ভক্ত সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে। তিনি আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন, তাই মৃত্যুর পর ওঁর পৈতৃক বাড়ি আশ্রমে পরিণত হয়েছে। এই আশ্রমের বর্তমান প্রধান মহন্তের নাম স্বামী অদ্ভুতানন্দ।

অধীরের চারপাশটা কেমন যেন অন্ধকার মনে হতে থাকে। এ কোথায় এসে পড়লেন তিনি! কে এই ত্রিকালানন্দ? লাইনের এক ভক্তকে অধীর জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, এটা তো ৭ রামকৃষ্ণ লেন?”

“হ্যাঁ।”

“আজ তো ১৪ অগস্ট ২০১৭?”

“হ্যাঁ।”

“তা হলে আমার বাড়ি পালটে গেল কী করে?” কথাটা অধীর আনমনেই বলে ফেলেন। সেই শুনে সেই ভক্ত প্রথমে অবাক হয়ে যান, তারপরেই অধীরের প্রতি খুব সংবেদনশীল হয়ে বলেন, “বুঝতে পেরেছি। কত পাগল এই আশ্রমে স্বামী ত্রিকালানন্দের কৃপায় সুস্থ হয়ে ফিরে গেলেন। আপনার ওপরও বাবা কৃপা করবেন। লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ুন।”

অধীরের সত্যিই পাগল হওয়ার মতো অবস্থা। ওঁরা যখন নিশ্চিতভাবে ২০১৭ সালেই ফিরে এসেছেন, তা হলে ওঁর বাড়িটা কোথায় গেল? অধীর রুদ্ধশ্বাসে আশ্রমের বাইরে বেরিয়ে এসে বাঁদিকে ছুটে যায়, কিন্তু না, তার গ্যারেজটাও তো নেই!

এমন সময় ফর্ম হাতে এক গেরুয়া-পরিহিতা মহিলা অধীরের সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁকে দেখে চমকে ওঠেন অধীর, “এ কী কল্যাণী! এসব কী ব্যাপার?”

কল্যাণী অবাক হয়ে যান অধীরের কথা শুনে, “আপনি আমার নাম জানেন দেখছি।”

“নাম জানি মানে? কী বলছ? তুমি কি আমায় চিনতে পারছ না?”

“আজ্ঞে না তো। আমায় ক্ষমা করবেন, আপনাকে তো আমি ঠিক চিনি না।”

অধীরের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে শুরু করে এবার, “কী বলছ তুমি? তুমি আমার স্ত্রী কল্যাণী। আর তুমি বলছ আমায় চেনো না?”

কল্যাণী এবার অধীরের দিকে তাকিয়ে হেসে খুব সহজভাবে বলেন, “আমি স্বামী ত্রিকালানন্দের শিষ্যা, আজীবন ব্রহ্মচর্যের ব্রতে দীক্ষা নিয়েছি। আর আপনি বলছেন… যাই হোক, এই নিন ফর্ম। স্বামী ত্রিকালানন্দ মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্ট করুন, দু’মাসে আপনার টাকা ডবল হয়ে ফিরে আসবে।”

অধীরকে কল্যাণী একটা ফর্ম দিয়ে অন্য ভক্তদের দিকে এগিয়ে যান। অধীর অসাড় হয়ে পড়ছেন ক্রমশ। ফর্মটা হাতে নিয়ে তিনি কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এ কীভাবে সম্ভব?

১২

“ওমা, এর মধ্যে চলে এলে? বাজার কোথায়?”

পূর্বপুরুষদের নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই স্ত্রী মানসীর এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল তিনকড়িকে।

“বাজার? কী যা তা বলছ? কাল রাতে খেতে খেতে উঠে গেলাম আমি আর এককড়ি, এর মধ্যেই ভুলে মেরে দিয়েছ নাকি? যাই হোক, ওসব বাদ দাও। অধীর কী কাণ্ডটাই না বাঁধিয়েছে দেখো!”

“কে?”

“অধীর গো অধীর!”

“কে অধীর?”

“কে অধীর মানে! আরে, আমার ছোটবেলার বন্ধু, তোমার আদরের ঠাকুরপো অধীর!”

মানসী এবার বিরক্ত হয়ে ঝাঁজিয়ে ওঠেন, “আরে কে অধীর? নেশা করছ নাকি আজকাল? বলি আজ বিকেলে যে এককড়িকে আশীর্বাদ করতে আসবে ভোম্বল ঠাকুরপোরা, তা সেই অতিথি সৎকারের ব্যবস্থাটা কী হবে শুনি? ঘরে যে একটা কিছু বাজার নেই।”

এক্কি চমকে ওঠে এই কথা শুনে, “কী বলছ মা?”

ছেলেকে দেখে এবার মা’র চমকে ওঠার পালা, “ওমা এককড়ি, তুই এর মধ্যে কলেজ থেকে ফিরে এলি যে! এর মধ্যে আবার জামাকাপড় কোথায় বদলালি?”

তিনকড়ি এক্কিকে বলেন, “এককড়ি, তোর মা’র তার কেটে গেছে একেবারে। যাই হোক, কই গো ঠাকুরদা, তোমরা সবাই দাঁড়িয়ে কেন? আরাম করে বসো, এ তো তোমাদের নিজেদের বাড়ি।”

পূর্বপুরুষরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন এখান থেকেই ধুলো পায়ে বিদেয় হবেন কি না। তিনকড়ির আমন্ত্রণে তাঁরা আশ্বস্ত হয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এক পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই হইহই করে তেড়ে আসেন মানসী, “ওমা এনারা কারা? কোথা থেকে কাদের ধরে আনলে গো?”

তিনকড়ি যত মানসীকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন যে, উমা দেবীর কোলের ওই সাত মাসের কচি ছেলেটা তিনকড়ির বাবা, ততই মানসী কপালে দু’হাত ঠেকিয়ে স্বামী ত্রিকালানন্দকে স্মরণ করে বলতে থাকেন, “গুরুদেব, আমার স্বামীর মাথাখারাপের রোগ ভাল করে দাও।”

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, মানসী অধীরকে চিনতেই পারছেন না। তাঁর বক্তব্য, অধীর নামে নাকি কাউকে ও কোনওদিনও চিনতেন না। তিনকড়ি এই কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। এদিকে আবার কোন এক ত্রিকালানন্দের কথা মানসী বলছেন, যিনি নাকি তাঁদের গুরুদেব। ত্রিকালানন্দের কথা যে তিনকড়ি মনে করতে পারছেন না, সেই শুনে মানসী অবাক হয়ে যান। মানসী আর তিনকড়ি পরস্পরকে বদ্ধ পাগল বলে সাব্যস্ত করলেন। এক্কি মাকে একবার বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল। মানসী ছেলের কথা শুনেও হতবাক হয়ে যান। বলেন, “হ্যাঁরে এককড়ি, তোর বাপের না-হয় ভিমরতি ধরেছে, কিন্তু তোর মাথাটাও কি গেছে? কোথা থেকে কোন অধীরের সঙ্গে আলাপ করে তার গাড়ি করে এ কাদের নিয়ে এলি?”

“মা, তুমি অধীরকাকাকে চিনতে পারছ না?”

“থাম! এসব গাঁজাখুরি গল্প আমাকে শোনাতে আসবি না একদম। এইসব উটকো লোকদের কিছুতেই আমি বাড়িতে থাকতে দেব না।”

দাদাশ্বশুর এবং দিদিশাশুড়ির দিকে ধেয়ে যান মানসী।

“এই যে, আমার বর আর ছেলেকে বোকাসোকা পেয়ে বেশ মাথাগুলো খেয়েছেন দেখছি! লজ্জা করে না বুড়ো দামড়া হয়ে লোক ঠকাতে? মানে মানে বিদেয় হবেন নাকি পুলিশ ডাকব?”

পূর্বপুরুষরা আঁতকে ওঠেন। উমা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, কিন্তু শাশুড়ি হয়ে বাড়ির বউয়ের মুখঝামটা বেশিক্ষণ সহ্য করা বাঙালি রমণীর ধাতে সয় না। তেড়ে যান উমা মানসীর দিকে।

“এই যে ভালমানুষের মেয়ে! বড্ড গলা দেখছি!”

মানসীও কম যান না, “গলা আর কী দেখেছেন! এইবার বের করব! আমার বাড়িতে এসে আমাকে চোখ রাঙানো? চোখ গেলে দেব!”

গৃহযুদ্ধ বাঁধার সিঁদুরে মেঘ দেখেই ঘরপোড়া দুই গোরু তিনকড়ি আর সাতকড়ি নিজের নিজের শিবিরে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনও লাভ হল না। ১৯৪২ হোক বা ২০১৭, এই কলহের সমাধান আজ পর্যন্ত কেউ করে উঠতে পারেনি। কোমরে আঁচল বেঁধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন উমা আর মানসী। গৃহযুদ্ধে মানসীর নৈপুণ্য বেশি দেখা গেল, অগত্যা তিনকড়িকে রিট্রিট করতে হয়। সাতকড়ি একবার শেষ চেষ্টা করেন, “আহা, নাতবউ, তুমি বুঝতে পারছ না। সত্যিই আমরা…”

মানসী এক দাবড়ানি দেন, “থামুন! আপনারা যাবেন? নাকি আমি চেঁচিয়ে পাড়ার লোক জড়ো করব?”

কালীকঙ্করের হাহাকার শোনা যায়, “নাও, এইবার ঠ্যালা সামলান জামাইবাবু। খুব নাতবউয়ের হাতে কচুর শাক খাওনের শখ ছিল, না? এখন ঘাড়ধাক্কা খাস্‌সেন!”

তিনকড়ি এবার শেষ চালটা চেলে দেখার চেষ্টা করেন, “মানসী! তুমি কিন্তু সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ! এঁরা যদি এই বাড়িতে ঠাই না পান, তা হলে আমিও এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব!”

“তা যাও না দেখি বাড়ি ছেড়ে থাকার কত মুরোদ!”

“কী! এত বড় চ্যালেঞ্জ করলে তুমি আমায়! ঠাকুরদা, ঠাগমা, মামাদাদু, সবাই চলে এসো আমার সঙ্গে।”

সাতকড়ি ঘাবড়ে গিয়ে বলেন, “কী মুশকিল, যাব কোন চুলোয়?”

তিনকড়ি বলেন, “কেন? আমার দোকান আছে কী করতে?”

তিনকড়ি দেওয়ালে ঝোলা তাঁর দোকানের চাবি নিয়ে নেন। সেই দেখে মানসী বলেন, “ওমা সকালেই যে দোকানের চাবি নিয়ে বেরোলে, আবার ডুপ্লিকেট চাবিটাও নিচ্ছ কেন?”

“শাটআপ!” দোকানের চাবি হাতে পূর্বপুরুষদের নিয়ে মার্চ করতে করতে ওয়াক আউট করলেন তিনকড়ি।

১৩

পাঠকদের কাছে আগেভাগেই মার্জনা চেয়ে জানাই যে, গোলযোগ বাড়াতে এবার থেকে আর-এক পিস করে তিনকড়ি এবং এক্কি মঞ্চে অবতীর্ণ হতে চলেছেন, যাঁরা অরিজিনালের হুবহু কপি বলে আপনারা ধরে নিতে পারেন। কেন, কীভাবে, কোন লজিকে— এসব প্রশ্নের উত্তর যথাসময়েই পাওয়া যাবে। আপাতত এঁদের আমরা তিনকড়ি (২) এবং এক্কি (২) বলে চিহ্নিত করব।

এখন দুপুর বারোটা। তিনকড়ি (২) তাঁর ‘কড়ি অ্যান্ড সন্স দশকর্মা ভাণ্ডার’ বন্ধ করে বাড়ির দিকে যাবেন। দোকানের বাইরে একটা বেঞ্চে বসে তিনকড়িদের এক প্রতিবেশী দেবু সংবাদপত্রে মাথা ডুবিয়ে আছেন। তাঁকে তিনকড়ি (২) বলেন, “দেবু, আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকতে হবে বুঝলে। সব বাজার সেরে ফিরব। স্বামী ত্রিকালানন্দের কৃপায় এককড়ির আশীর্বাদটা আজ ঠিকঠাক উতরে যাক। দেখলে তো কত বড় মহাপুরুষ। ওঁর আশ্রম গড়ার ফান্ডে দশ হাজার টাকা ইনভেস্ট করতেই দু’মাসের মাথায় তা কুড়ি হাজার হয়ে ফিরে এল। এবার ভাবছি চল্লিশ লাগাব, দু’মাসে আশি। এই করে করে ছেলের বিয়ের খরচটা উঠে যাবে।”

দেবু বলেন, “দেখো, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।”

“সে তো লোভ না করলেও একদিন না একদিন মৃত্যু। মরতেই যখন হবে তখন লোভ করেই মরা যাক! আজ রাতে ওখানেই কিন্তু আমার খাওয়াদাওয়া, দেরি কোরো না। যাক, আজ দুপুরে আবার স্বামী অদ্ভুতানন্দের বেদান্ত বিশ্লেষণ আছে। যাই, তাড়াতাড়ি বাজার দিয়ে, স্নানটান সেরে যেতে হবে আবার।”

এমন সময় অধীর এসে বেঞ্চে দেবুর পাশে বসে পড়েন। তিনকড়ি (২) আর দেবু দু’জনেই অধীরকে অবাক হয়ে দেখেন। অধীর হতাশ হয়ে তিনকড়ি (২)-কে বলেন, “এ কী সমস্যায় পড়লাম রে তিনকড়ি। আমার বাড়ি আর আমার নেই, ওখানে একটা আশ্রম হয়ে গেছে।”

তিনকড়ি (২) বেশ ভদ্রভাবেই অধীরকে বললেন, “আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।”

অধীরের এবার পাগল হওয়ার মতো অবস্থা, “কী বলছিস তিনকড়ি! তুইও কল্যাণীর মতন আমায় চিনতে পারছিস না? কী রে দেবু?”

তিনকড়ি (২) দেবুকে বলেন, “দেবু, তুমি এনাকে চেনো নাকি?”

দেবু বলেন, “না তো, আর আপনি কোন আশ্রমের কথা বলছেন?”

“কেন? ওই ত্রিকালানন্দ সেবাশ্রম। ওটা তোমরা বলতে চাইছ যে, আমার বাড়ি নয়?”

তিনকড়ি (২) আর দেবু হাসিতে ফেটে পড়েন। অধীরের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে ক্রমশ। তিনি কী করবেন জানেন না। কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের অফিসে এসেছেন অধীর। রেজিস্টার দেখে এক কর্মচারী বলেন, “না দাদা। এই দেখুন ৭ রামকৃষ্ণ লেনের বর্তমান মালিক স্বামী ত্রিকালানন্দ ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। বর্তমানে সেই সোসাইটির অধিকর্তা স্বামী অদ্ভুতানন্দ।”

“আপনারা অধীর চৌধুরীর নাম পাচ্ছেন না? আচ্ছা, অনিলচন্দ্র চৌধুরীর নাম পাচ্ছেন কি না দেখবেন?”

কর্মচারী আবার রেজিস্টার দেখে বললেন, “না, এমন কাউকে তো পাচ্ছি না। তবে সুধীরচন্দ্র চৌধুরীকে এই জমির মালিক দেখতে পাচ্ছি ১৯৬০ সাল অবধি। তারপর এই জমির মালিক হন স্বামী ত্রিকালানন্দ ওয়েলফেয়ার সোসাইটি।”

অধীর একটু আশার আলো দেখতে পান।

“হ্যাঁ, সুধীরচন্দ্র চৌধুরী তো আমার ঠাকুরদা! তাঁর উত্তরাধিকারী আমার বাবা অনিলচন্দ্র চৌধুরী আর তারপর আমি অধীর চৌধুরী। আমাদের নাম আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?”

“না দাদা।”

“তার বদলে ত্রিকালানন্দ! আচ্ছা, কে এই ত্রিকালানন্দ?”

“সে কী! তাও জানেন না? সাক্ষাৎ মহাপুরুষ! অব্যর্থ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা।” কর্মচারীটি ভক্তিরসে গদগদ হয়ে বলেন, “ওঁর সব ভবিষ্যদ্বাণী একেবারে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। এই বইটা পড়বেন, ওঁকে সম্যকভাবে জানতে পারবেন।”

ড্রয়ার থেকে একটা বই বের করে অধীরকে দেন তিনি। বইটার নাম— ‘স্বামী ত্রিকালানন্দ কথামৃত’।

এরপর পুরসভার জন্মমৃত্যু ডিপার্টমেন্টে অধীর খোঁজ করতে আসেন। সেখানকার কর্মচারী রেজিস্টার দেখে জানান, “দেখুন সুধীরচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর আমরা রেকর্ড পাচ্ছি, কিন্তু ওঁর কোনও সন্তান অনিলচন্দ্র চৌধুরীর রেকর্ড তো পাচ্ছি না।”

অধীর বলেন, “তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, অনিলচন্দ্র চৌধুরীর সন্তান অধীর চৌধুরীর জন্মের কোনও রেকর্ড নেই?”

“আরে মশাই, অনিল চৌধুরীই জন্মায়নি, তা হলে তার সন্তান আবার কোথা থেকে জন্মাবে?”

অধীর রাস্তায় খবরের কাগজের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সব কাগজে হেডলাইন— প্রফেসর পঙ্কজ উপাধ্যায় কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বিষয়ক আবিষ্কারের জন্য সরকার থেকে পুরস্কার পেতে চলেছেন। এক্কি রিয়াকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সেখানে পৌঁছয়। খবরটা দেখে এক্কিও হতভম্ব।

“এসব কী হচ্ছে অধীরকাকা? তোমার রিসার্চ এই উপাধ্যায়ের কী করে হতে পারে? তা ছাড়া রিয়ার নাম ইউনিভার্সিটির রেজিস্টারে নেই। রিয়া কোনওদিনও নাকি ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ছিল না। রিয়া তার কলেজ ব্যান্ডের রিহার্সাল প্যাডে গিয়েছিল, কিন্তু তার ব্যান্ড মেম্বাররা কেউই তাকে চিনতে পারল না। তারা নাকি রিয়াকে এই প্রথমবার দেখছে। রিয়ার ক্লাসের বন্ধুরাও একই কথা বলছে।”

রিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাবার কাছে কৈফিয়ত চায়, “আমাদের বাড়ির কী হল? মা কোথায় গেল?”

অধীর নিরুত্তর। তিনি এক্কিকে বলেন, “শোন এক্কি, রিয়াকে একা কোথাও ছাড়বি না। আমি আসছি।”

অধীর চলে যান। একজন মহিলা দাঁড়িয়ে উলটোদিকে মুখ করে এতক্ষণ খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আসলে তিনি এতক্ষণ অধীরদের কথা শুনছিলেন। এক্কি তাঁকে দেখতে পেয়ে ডাকেন, “এ কী কাকিমা!”

রিয়া মাকে পেয়ে এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, “মা! তোমায় কখন থেকে খুঁজছি!”

রিয়া এগোতে গিয়ে কল্যাণীর পোশাক দেখে থমকে যায়। কল্যাণীর পরনে জিন্‌স আর কুর্তা। এমন পোশাকে রিয়া কখনও তার মাকে এর আগে দেখেনি। কল্যাণী রিয়াকে বলেন, “আমি আপনার মা?”

এক্কি অবাক কল্যাণীর আচরণে, “সেকী কাকিমা? তুমিও কি আমাদের চিনতে পারছ না?”

কল্যাণী ওদের পাশে এসে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলেন, “একটু কথা বলতে পারি আপনাদের সঙ্গে?”

১৪

তিনকড়ি তাঁর পূর্বপুরুষদের নিয়ে ‘কড়ি অ্যান্ড সন্স দশকর্মা ভাণ্ডার’-এ সবে এসেছেন। দোকানে গলায় মালা দেওয়া নিজের বুড়ো বয়সের ছবি দেখে সাতকড়ি ভুল করে সেই ছবিকে প্রণাম করে ফেলেন। এমন সময় এক বছর আঠেরোর মেয়ে টুসু বাজারের থলে নিয়ে দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তিনকড়িকে দেখে টুসু দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে, “এ কী তিনকড়িকাকা, আবার দোকান খুললেন যে?”

“আবার খুললাম মানে! এই তো সকাল থেকে সবে দোকান খুললাম।”

টুসু প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলে, “সে আবার কী! সকালবেলা আমি মাসকাবারি বাজার নিয়ে গেলাম, কত কথা হল, বললেন আজ আপনার ছেলেকে আশীর্বাদ করতে বাড়িতে লোকজন আসবে, তাই দোকান তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দেবেন।”

“আচ্ছা, এ কী হচ্ছে বলো তো! আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। সবে আমি আমার পূর্বপুরুষদের নিয়ে ফিরলাম…”

তিনকড়ি কোনওমতে নিজেকে সামলে নেন। টুসু ব্যাপারস্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে বলে, “যাই হোক। ফর্দে পঞ্চাশ গ্রাম গুঁড়ো জিরে লেখা ছিল, আপনি দিয়েছেন গোটা জিরে। একটু পালটে দেবেন?”

তিনকড়ি অবাক হয়ে বলেন, “কখন দিলাম?”

“কেন? আজ সকালে।”

“দেখো টুসু, আমি তোমায় সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি। আজ পর্যন্ত কোনওদিনও তো তোমায় আমি মিথ্যে কথা বলতে শুনিনি।”

টুসুর আত্মসম্মানে লাগে, “কী বলছেন তিনকড়িকাকা! আমি মিথ্যে বলছি?”

“আলবাত! পঞ্চাশ গ্রাম জিরের জন্য তোমায় এই মিথ্যের আশ্রয় নিতে হল? ছিঃ ছিঃ!”

“কী যা-তা কথা বলছেন তিনকড়িকাকা? আপনি বলে দিন আপনি জিনিস পালটাবেন না! থাক, দিতে হবে না আপনাকে।”

টুসু গজগজ করতে করতে দোকান ছেড়ে চলে যায়। তিনকড়ি তখনও তড়পাতে থাকেন।

“কী মিথ্যেবাদী মেয়েটা দেখলে ঠাকুরদা! এই হচ্ছে আমাদের যুগ, বড়দের মুখের ওপর মিথ্যে কথা বলে!”

সাতকড়ি টুসুকে এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “মেয়েটা কে রে তিনকড়ি? খুলনার উকিল জয়ন্ত সিংহ তাঁর মেজছেলের জন্য পাত্রী দেখতে বলেছেন।”

তিনকড়ি সাতকড়ির চিন্তার তরঙ্গ ধরার চেষ্টা করেন, “তা এই মেয়ের সঙ্গে তুমি ওই খুলনার উকিলের মেজছেলের বিয়ে দেবে কী করে?”

সাতকড়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “এইবার বুঝেছি কেন আমাদের ঘটকালির পরম্পরা উঠে গেছে। এই বুদ্ধি নিয়ে তুই ব্যাটা ব্যাবসা করিস কীভাবে কে জানে! আরে বাবা এমন সুলক্ষণা মেয়ে, তাই ভাবছিলাম এর বংশের সবাই বেশ সুন্দর দেখতে হবে।”

“হ্যাঁ, তা সুন্দর বই কী! ওই তো আমাদের হরের বাড়ি।”

“হর? এমন কেউ তো আমাদের পাড়ায় নেই!”

“আরে এরা নতুন এসেছে আমাদের পাড়ায়, ওদের আদি বাড়ি শ্যামনগর। ওখানকার বনেদি বংশ। ওদের বংশের সবাই বেশ সুন্দর দেখতে, কিন্তু এমন মিথ্যেবাদী!”

সাতকড়ি একটা খাতা বের করে লিখে নেন।

“শ্যামনগর, হর, বনেদি বংশ।”

তিনকড়ি ঠিক বুঝতে পারেন না তাঁর ঠাকুরদার মতিগতি।

“এসব দিয়ে কী হবে ঠাকুরদা?”

“আরে বাবা এও বুঝলি না? আমাদের নিজেদের সময়ে ফিরে গিয়ে আমি ওই খুলনার উকিলের ছেলের জন্য এই শ্যামনগরের হরদের বাড়ির সম্বন্ধ নিয়ে যাব। এই মেয়েটির পূর্বপুরুষদের মধ্যে নিশ্চয়ই কাউকে পাওয়া যাবে যে ১৯৪২ সালে কুমারী। তার সঙ্গেই সম্বন্ধ করব। বুঝলি?”

তিনকড়ি তাঁর ঠাকুরদার পায়ের ধুলো নিতে যান, এমন সময় রাস্তার অপর প্রান্তে হইহট্টগোল শোনা যায়। সাতকড়ি আর তিনকড়ি সেদিকে ছুটে যান। সেখানে গোলযোগ বেঁধেছে খুব জোর। দু’জন বছর কুড়ি বয়সের লম্বা চুল, কানে দুলওয়ালা ছেলেকে দেখে কালীকিঙ্কর তাদের দিকে তেড়ে যাচ্ছিলেন, জনতা আটকেছে। কালীকিঙ্কর চেঁচাচ্ছেন, “ইউ ইংরেজ! ইউ ইস্টুপিড! গেট আউট! ইন্ডিয়া ইজ় ফ্রিডম। স্বরাজ ইজ় বার্থ রাইট! ইউ এগেন কামিং?”

তিনকড়ি ব্যাপারস্যাপার বুঝতে না পেরে ছেলেগুলোকে জিজ্ঞেস করেন কী ব্যাপার। একটি ছেলে জবাব দেয়, “আমরা এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ উনি আমাদের দিকে তেড়ে এলেন। উনি আমাদের এই দেশ ছেড়েই চলে যেতে বলছেন। পাগল নাকি লোকটা?”

সাতকড়ি কালীকিঙ্করকে জিজ্ঞেস করেন, “কী হল কালী? বাচ্চা ছেলেগুলোর ওপর এত চটে গেলে কেন হঠাৎ?”

কালীকিঙ্কর বলেন, “চটুম না? এই যে তিনকড়ি কইলা দেশ স্বাধীন হইয়া গেসে? তাও ওই হালায় ইংরাজগুলা এখনও কেন দেশ ছাইড়া যায় নাই?”

তিনকড়ি অবাক হয়ে বলেন, “ওরা ইংরেজ কেন হবে?”

“ইংরাজ নয়? তা হইলে ইংরাজদের পতাকা লাগানো জামা পইরা ঘুরতাসে কেন? সাজপোশাকও তো ইংরেজদের মতো।”

তিনকড়ি ব্যাপারটা বুঝতে পারেন, “ওহো! মামাদাদু, এসব আধুনিক পোশাক। বিদেশি ব্র্যান্ডের পোশাক সব। এসবই এখন লোকজন পরে।”

কথাটা শুনে সাতকড়ি ক্ষুণ্ণ হন। তিনি বলেন, “সে কী রে তিনকড়ি! বিদেশি বস্ত্র বর্জন করতে বলে গাঁধীজি খদ্দর পরার ডাক দিলেন, আর সেই স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে তোরা সেই ইংরেজদের পতাকা লাগানো জামা পরিস?”

এমন সময় তিনকড়ির প্রতিবেশী ভোম্বল সেজেগুজে সপরিবারে হাতে ফুল মালা নিয়ে চলেছেন, তাঁর সঙ্গে আর-এক প্রতিবেশী দেবু। ভোম্বল তিনকড়িকে দেখে বলেন, “এ কী তিনকড়ি, এখনও রেডি হওনি? চলো!”

“কোথায় যাব?”

“আরে? কথা ছিল তো আজ স্বামী ত্রিকালানন্দের আশ্রমে যাব বেদান্ত বিশ্লেষণ শুনতে।”

“ত্রিকালানন্দ? কে সে?”

“ওমা! তোমার কী হয়েছে বলো তো? স্বামী ত্রিকালানন্দ! আমাদের গুরুদেব! তাঁকে তুমি চিনতে পারছ না?”

দেবু হেসে বলেন, “সকালের ওই পাগলটার মতন তোমার মাথাটাও বিগড়াল নাকি?”

“পাগল? কে পাগল?”

“কেন? ওই পাগলাটে লোকটা! খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে চশমা।”

“কে? অধীর?”

ভোম্বল আর দেবু একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলেন, “কে অধীর?”

তিনকড়ি গর্জে ওঠেন, “সে কী! আমাকে পাগল বলছ, তোমার নিজের মাথার ঠিক আছে? তুমি অধীরকে চিনতে পারছ না? আমাদের পাড়ার পাগলা বিজ্ঞানী!”

ভোম্বল হতভম্ব হয়ে দেবুকে বলেন, “আমাদের পাড়ার বিজ্ঞানী! কী বলছে হে দেবু?”

দেবুর অবস্থাও ভোম্বলের মতোই। তিনি বলেন, “আমাদের পাড়ায় কোনও বিজ্ঞানী আছে বলে তো আমি কোনওদিনও শুনিনি।”

কালীকিঙ্কর হাহাকার করে ওঠেন, “দেহেন জামাইবাবু দেহেন! হাজারবার কইলাম এইসব লুচ্চার পাল্লায় পড়া ঠিক হইতেসে না! আমার কথাই আপনি শুনলেন না!”

উমাও হা-হুতাশ করতে থাকেন, “এ কী সব্বোনাশ হল গো! তখনই বলেছিলাম, ওগো, পৌষ মাসে ছেলের শুভকাজ কোরো না, শাস্ত্রে মানা আছে। কী অমঙ্গল হয় এখন কে জানে! হে পাঁচু ঠাকুর রক্ষে করো!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *