সমান্তরালের রহস্য – ১

বিষ্ণুপুরাণে রৈবত নামে এক রাজার কথা বর্ণিত আছে, যাঁর রেবতী নামে এক কন্যাসন্তান ছিল। সেই রেবতী ছিলেন রূপে গুণে অতুলনীয়া। কন্যার উপযুক্ত পাত্র নির্বাচনের জন্য মহারাজ রৈবত রেবতীকে নিয়ে হাজির হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে। সেখানে তখন স্বর্গের অপ্সরাদের নাচগান চলছে। মহারাজ তাঁর কন্যাকে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। সেই নাচগান শেষ হলে মহারাজ ব্রহ্মার সামনে উপস্থিত হয়ে বলেন যে, তিনি তাঁর কন্যার জন্য মর্তলোকে কয়েকজন পাত্র বাছাই করেছেন, তাঁদের মধ্যে উপযুক্ত পাত্রটিকে যেন প্রজাপতি নির্বাচন করে দেন। ব্রহ্মা বললেন, তা আর সম্ভব নয়, কারণ মর্তলোকে মহারাজের নির্বাচিত পাত্ররা আর কেউই বেঁচে নেই। পুরাণ মতে, ব্রহ্মার এক দিন হচ্ছে পৃথিবীর হিসেবে ৮৬৪ কোটি বছর। মহারাজ তাঁর কন্যাকে নিয়ে এই ব্রহ্মলোকে আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন, ইতিমধ্যে পৃথিবীতে ১৮ কোটি বছর পার হয়ে গেছে। রাজা রৈবতকে বিচলিত দেখে ব্রহ্মা তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন, ভগবান শ্রীবিষ্ণু বর্তমানে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং নাম নিয়েছেন বলরাম। সেই বলরামই রেবতীর উপযুক্ত পাত্র।

আমাদের মুনিঋষিরা দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার জগতে কতটা এগিয়ে ছিলেন, এই গল্প তারই প্রমাণ। এ তো টাইম ট্রাভেল, যে সম্ভাবনার কথা স্বয়ং আইনস্টাইনও তাঁর আপেক্ষিকতার থিয়োরিতে বলে গেছেন। আইনস্টাইন বলেছেন, সময় হচ্ছে একটা প্রহেলিকা, সময় আপেক্ষিক। একটা প্রবহমান নদীর মতো তার প্রকৃতি। নদীর স্রোতের মতোই এর গতিবেগ কখনও বাড়ে, কখনও-বা কমে।

তা হলে কি অতীত বা ভবিষ্যতে পাড়ি দেওয়া সত্যিই সম্ভব? এই চিন্তা বহু বছর ধরে বিজ্ঞানী অধীর চৌধুরীকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে চলেছে। অধীর একটি সরকারি বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রে চাকরিরত একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। তাঁর বেশ কিছু সাড়া জাগানো গবেষণা বিজ্ঞানজগতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। অধীরের অস্বাভাবিক সব গবেষণা তাঁর সমসাময়িক অনেক বিজ্ঞানীর ঈর্ষার কারণ, বিশেষ করে সংস্থার এক কর্তাব্যক্তি বিজ্ঞানী প্রফেসর উপাধ্যায়ের। অধীর খামখেয়ালি প্রকৃতির। সংস্থার নিয়মকানুন মেনে চলার মতো সুবোধ বালক তিনি নন। তিনি মেতে থাকেন নিজস্ব খেয়ালে। কোনও প্রতিষ্ঠানের নির্দেশমতো ভোগবিলাসের নিত্য নতুন সামগ্রীর উৎপাদন করাটাই বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য বলে তিনি মেনে নিতে নারাজ। সৃষ্টির ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর রহস্যের সন্ধানে তাঁর জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন।

ব্যতিক্রমী মানুষরা যুগ যুগ ধরে অন্যায় অবিচারের শিকার, এর কোনও ব্যতিক্রম হয় না। অধীরের খামখেয়ালিপনার সুযোগ নিয়ে উপাধ্যায় উপরমহলের কান ভাঙাতে থাকেন। অধীরকে এই ব্যাপারে বহুবার সাবধান করেছিলেন অধীরের এক সিনিয়র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট ব্যানার্জি। যাঁদের চোখ বৃহত্তর লক্ষ্যে স্থির, এই সামান্য কাদা ছোড়াছুড়ি তাঁদের গায়ে লাগে না। কিন্তু একদিন অধীরেরও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে তিনি চাকরি ছেড়ে দিলেন।

অধীরের মতো বিজ্ঞানসাধক যে সাংসারিক ব্যাপারে উদাসীন হবেন, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে! অধীরের স্ত্রী কল্যাণীর কিন্তু তাই নিয়ে কোনও ক্ষোভ নেই। তিনি জানেন যে, গুণী মানুষরা এমনই খামখেয়ালি হন। এই নিয়ে ক্ষোভ জানালে আখেরে তাঁদের সাধনাকেই ছোট করা হয়, সেটা কল্যাণী কখনওই করবেন না। অধীরের এই খামখেয়ালিপনার মোহেই তো একদিন কল্যাণী নিজের বাড়ি ছেড়ে অধীরের সঙ্গে চলে এসেছিলেন। অধীরের এই উদাসীনতা নিয়ে তাঁদের একমাত্র মেয়ে রিয়ার সঙ্গে কল্যাণীর ভয়ানক মতভেদ। বাবার প্রতি রিয়ার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। রিয়া বুঝতে পারে, তার মা যে-স্বপ্ন নিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন তার বাবার সঙ্গে, দিনে দিনে সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হচ্ছে। কত অবহেলা দিনের পর দিন সয়ে এসেছেন তার মা, আর এমনি করেই মুখ বুজে চিরটাকাল সয়ে যাবেন। রিয়া কিন্তু সহ্য করে না। অধীরের মুখের ওপর এমন অনেক কথা সে বলে দেয়, যা অধীরের গায়ে লাগত যদি তিনি সাধারণ মানুষ হতেন। কল্যাণী সবসময় বাবা আর মেয়ের মধ্যে একটা মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়ে যান। কল্যাণী রিয়াকে বলেন, “দেখিস তোর বাবার একদিন কত নামডাক হবে, কত বড় মানুষ হবে!”

রিয়ার উত্তর, “নিজের লোকজনদের মনে দুঃখ দিয়ে কেউ কোনওদিন বড় হতে পারে না মা।”

অধীরের পৈতৃক বাড়ির লাগোয়া একটা ছোট্ট গ্যারেজ আছে। সেটাই এখন অধীরের ল্যাবরেটরি। সারা দিন অধীর সেই গ্যারেজে একটা গাড়ি নিয়ে গবেষণায় মেতে আছেন। নানা রকমের গাড়ির বিভিন্ন অংশ দিয়ে সেই গাড়িটা অধীর নিজের মতো করে গড়ে তুলেছেন। অধীরের সেই গবেষণাগারে আর কেউ আসেন না, শুধু মাঝে-মধ্যে বাইশ বছরের একটি ছেলে আসে— তার নাম…

ছেলেটার নাম জানানোর আগে একটু তার বংশপরিচয় দেওয়া দরকার। ছেলেটার বাবার নাম তিনকড়ি চট্টোপাধ্যায়। তিনকড়ি আর অধীর ছেলেবেলার বন্ধু। তাঁরা দক্ষিণ কলকাতার রামকৃষ্ণ লেনে তিনটে বাড়ির ব্যবধানে থাকেন। তাঁদের দু’জনেরই চার পুরুষে পৈতৃক বাড়ি। রামকৃষ্ণ লেনে তিনকড়ির একটা মুদির দোকান আছে। পাড়ার যাবতীয় লোকজন সেই দোকান থেকেই তাদের মাসকাবারি বাজার, টুকিটাকি জিনিসপত্র সব কেনে। অধীরও। তবে চাকরি ছাড়ার পর থেকে অধীরের কেনাকাটা ধারেই চলছে। যদিও এই কথা তিনকড়ি আর কাউকে বলেননি। তিনকড়ি তাঁর বন্ধুকে খুবই ভালবাসেন, সেই জোরে অধীরকে কথায় কথায় শাসনও করেন। অধীরের দুম করে চাকরি ছেড়ে দেওয়া তিনকড়ি একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। কল্যাণী বউঠানের কথা না-হয় ছেড়েই দিলেন, মেয়েটা কলেজে পড়ে, বিয়ের বয়স হয়ে গেছে— তার কথা অধীর একবার ভেবে দেখল না? কী বিশৃঙ্খল হয়ে উঠছে রিয়া দিনে দিনে! ছেলেদের সঙ্গে কী সব বাংলা ব্যান্ডে গান গায়, গান না বলে তাকে সমবেত শিয়াল-সংগীত বলতে তিনকড়ি বেশি পছন্দ করেন। মেয়েমানুষ হয়ে সিগারেট ফোঁকে! কানাঘুষো শোনা যায়, গাঁজাও নাকি খায়! আর কী তার মুখের ভাষা! অধীরটা এমনই অপোগণ্ড যে, মেয়েটার দিকে কোনও নজরই নেই! কতবার বুঝিয়েছেন তিনকড়ি অধীরকে— নিজের পাগলামো নিয়ে মেতে না থেকে সংসারের দিকে একটু নজর দিতে। এর উত্তরে অধীর কী সব আইনস্টাইন, নিউটনের দোহাই পাড়েন। এই নিউটন যে অধীরের জীবনে অনটন এনে ফেলেছেন, এটা কিছুতেই তিনকড়ি অধীরকে বুঝিয়ে উঠতে পারেন না। নিউটন লোকটাকে নিয়েই তিনকড়ির ঘোরতর সন্দেহ আছে। যে লোক গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখে, আগে সেটা না খেয়ে তাই নিয়ে আকাশপাতাল ভাবতে বসেন, তিনি পাগল ছাড়া আর কী! এইসব লোক যার আদর্শ সেও তো বদ্ধ পাগলই হবে!

তিনকড়ির দোকানের নাম ‘কড়ি অ্যান্ড সন্স দশকর্মা ভাণ্ডার’। তিনকড়ির প্রপিতামহের নাম নকড়ি চট্টোপাধ্যায়, পিতামহের নাম সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়, পিতার নাম পাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায়, নিজের নাম তিনকড়ি হালদার এবং সেই হিসেব মতোই পুত্রের নাম এককড়ি চট্টোপাধ্যায়। আজকের যুগের আধুনিক ছেলে, যার রকস্টারদের মতো লম্বা চুল, ইংরেজিতে চোস্ত, জিম মরিসন-পিঙ্ক ফ্লয়েড যার মুখে লেগেই আছে, কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, তার নাম কিনা এককড়ি চট্টোপাধ্যায়! এমন বদনাম তো ছেলেটার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই ছেলেটা নিজের নামটাকে একটুখানি ছেঁটে ফেলে যুগোপযোগী করে নিয়েছে— এক্কি। সেই নিয়ে তার বাবার ঘোরতর আপত্তি। বংশের পরম্পরা ভেঙে ছেলের এই অকালপক্বতা তিনকড়ি কোনওভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। যুগটাই যেন কেমন হয়ে গেছে। এই হঠাৎ আধুনিকতার হাওয়া যে কীভাবে এই যুবসমাজের গায়ে লাগল, তা তিনকড়ি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না।

সবচেয়ে ভয়ের কথাটা এবার শোনা যাক। সেদিন তিনকড়ির প্রতিবেশী ভোম্বল কড়ি অ্যান্ড সন্স দশকর্মা ভাণ্ডারে বসে ভয়ানক একটা খবর শোনালেন। অধীরের মেয়ে রিয়ার সঙ্গে নাকি এককড়িকে প্রায়ই এখানে-ওখানে সন্দেহজনকভাবে দেখা যাচ্ছে। এককড়ি আর রিয়া দু’জনেই একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। রিয়া হিস্ট্রি অনার্স আর এককড়ি কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। বয়সটা দু’জনেরই কাঁচা। ছেলে যা একগুঁয়ে, যদি জেদ ধরে বসে যে ওই লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটাকেই বিয়ে করবে, বিয়ে ছাড়ো, আরও কীসব ইয়ে আজকালকার ছেলেমেয়েরা করে বেড়ায়! তিনকড়ি তাই এককড়ির জন্য এক্ষুনি একটা মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছেন। ওই ভোম্বলেরই মেয়ে কাদম্বরী। কী লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটা! যতরকম সামাজিক প্রথা সব মেনে চলে। জয়মঙ্গলবার, ইতুপুজো, শিবরাত্রি, থোয়া-থুয়ি, নীলষষ্ঠী, চাপড়াষষ্ঠী— সব মানে। একবার তো ভুল করে একাদশীই করে ফেলেছিল। তিনকড়ি চুপিচুপি সব ঠিক করে ফেলেছেন। ছেলে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চাকরি পেয়ে গেছে, কোর্স শেষ হলেই এই কাদম্বরীর সঙ্গে এককড়ির গাঁটছড়া বেঁধে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবেন।

অধীর এক অসাধ্য সাধন করে বসেছেন। অধীর তাঁর থিসিস পেপার নিয়ে গেছেন তাঁর পুরনো সায়েন্স ইনস্টিটিউটে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যানার্জিদার কাছে। ব্যানার্জি থিসিস পেপার দেখে তো আনন্দে আত্মহারা! ওঁর বুক গর্বে ভরে উঠছে এটা ভেবে যে, ওঁর ভ্রাতৃসম অধীর, যাঁর সঙ্গে তিনি প্রায় বিশ বছর কাজ করেছেন, সেই মানুষটা এই অসাধ্যসাধন করেছেন— পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম। এমন এক প্রতিভা এই ইনস্টিটিউট ছেড়ে চলে গেল? বেচারা কী অভাবের মধ্যেই না আছে এখন! একবার যদি প্রফেসর উপাধ্যায়কে বলে অধীরকে ফেরত আনা যায়!

ব্যানার্জি উপাধ্যায়ের কেবিনে এসে তাঁকে অধীরের এই রিসার্চের ব্যাপারে সব বলেন। অধীর তাঁর এই থিসিস একটা সায়েন্স জার্নালে পাবলিশ করতে দিয়েছেন। ফলত, এই থিসিস চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় আর নেই। তাই ব্যানার্জি উপাধ্যায়কে ওই রিসার্চ পেপারের একটা কপি দেখান। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা, এই থিসিসের বাস্তবরূপ দিতে অধীর নাকি একটা মেশিনও তৈরি করেছেন।

উপাধ্যায় টেনশনে একটা সিগার ধরালেন। এই খবর জানাজানি হয়ে গেলে তো অধীরকে নিয়ে হইচই পড়ে যাবে সারা পৃথিবীজুড়ে! এরই মধ্যে ব্যানার্জি অধীরের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নানা রকমের অনুনয়-বিনয় করেই চলেছেন। উপাধ্যায়ের মাথায় ওসব কথা কিছুই ঢুকছে না। ওঁর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা— যে-কোনওভাবে অধীর চৌধুরীকে আটকাতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? ব্যানার্জির থেকে উপাধ্যায় রিসার্চ পেপারের কপিটা কয়েকদিনের জন্য চেয়ে নেন। ব্যানার্জিরও দিতে কোনও বাধা নেই। ব্যানার্জি পেপার দিয়ে বেরিয়ে যান কেবিন থেকে। উপাধ্যায় অস্থির পায়চারি শুরু করেন তাঁর কেবিনময়। কিছু না কিছু উপায় উপাধ্যায়কে বের করতেই হবে। তিনি নিজেও একজন বিজ্ঞানী, অধীরকে জব্দ করতে হবে অধীরেরই রিসার্চের সাহায্যে। উপাধ্যায়ের মাথায় পুরো পরিকল্পনাটা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তিনি তাঁদের সংস্থার ডেটাবেস থেকে অধীরের যাবতীয় থিসিসের কপি বের করতে শুরু করেন। হঠাৎ অধীরের একটা থিসিসে নজর আটকায় তাঁর। থিসিসটা প্রকাশ পায় পঁচিশে ডিসেম্বর উনিশশো বিরানব্বই সালে। এটা অধীরের প্রথম থিসিস, যার দ্বিতীয় পাতায় রয়েছে ইংরেজিতে একটা লেখা, যার মানে দাঁড়ায় এরকম— ‘আমার প্রথম শিক্ষক আমার ঠাকুরদা শ্রীসুধীরচন্দ্র চৌধুরী। তাঁর প্রভাব আমার জীবনে অনস্বীকার্য। ১৯৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঠাকুরদা এবং ঠাকুরমা সরলাবালা দেবী পরিবারের অমতে গিয়ে তাঁদের স্বাধীন সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিতে বিবাহ করেন। এটাই ছিল আমাদের পরিবারের প্রথম লভ ম্যারেজ। আজ তাঁদের বিবাহবার্ষিকীর সুবর্ণজয়ন্তীতে আমার এই থিসিস তাঁদের উৎসর্গ করলাম।— অধীর চৌধুরী।’

উপাধ্যায় এবার তাঁর প্ল্যান নিয়ে তৈরি। তবে ঝুঁকিটা মারাত্মক। একটু এদিক-ওদিক হলেই তাঁর নিজের অস্তিত্ব নিয়েই সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই কাজটা তাঁকে খুব সন্তর্পণে করতে হবে। উপাধ্যায় অধীরের থিসিস পেপারগুলোর প্রিন্ট আউট নেওয়া শুরু করেন।

১৩ অগস্ট ২০১৭-র রাত। গরমটা এখনও কাটছে না। একপশলা বৃষ্টি হয়ে যেন গুমোট ভাবটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইন্টার কলেজ ব্যান্ড কম্পিটিশনে রিয়াদের ব্যান্ড প্রথম হয়েছে। প্রাইজ় মানি দিয়ে রিয়া কল্যাণীর জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছে। খুব খুশি হয়ে কল্যাণী শাড়িটা নেড়েচেড়ে দেখে বলেন, “হ্যাঁরে, তোর বাবার জন্য কিছু আনলি না?”

রিয়া একটা প্যাকেট ছুড়ে ফেলে বিছানায়। কল্যাণী প্যাকেট খুলে দেখেন ভিতরে একটা শার্ট। কল্যাণী খুব খুশি হয়ে তাকান রিয়ার দিকে, রিয়া বিরক্ত হয়ে বিছানায় মুখ ভার করে শুয়ে পড়ে। কল্যাণী মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, “মানুষটাকে ভুল বুঝিস না রে। তুই নিজেই দেখ, পৃথিবীর যত বড় বড় মানুষ সবাই এইরকম আপনভোলা হয়। তুই মিলিয়ে নিস, তোর বাবা একদিন ভীষণ বড় একজন মানুষ হবেন।”

“আপনজনদের দুঃখ দিয়ে কেউ কোনওদিন বড় হতে পারে না মা। আমার কথা ছেড়ে দাও, তোমাকে পদে পদে কি কম ইগনোর করেন? উনি বোধহয় ভুলে গেছেন যে, তুমিও ডব্লিউবিসিএস পাশ করেছিলে। তোমার নিজের কেরিয়ার স্যাক্রিফাইসের জন্য উনি আজ নিশ্চিন্তে নিজের খামখেয়ালিপনা নিয়ে মেতে থাকতে পারেন।”

“তেজি মানুষদের দোষ হয় না কিছুতে। আগুনকে কোনও মালিন্য স্পর্শ করতে পারে?”

“আগুনের ধারেকাছে যারা থাকে, তারাই কিন্তু পুড়ে ছাই হয়।”

“উফ! বাপ রে বাপ! বোস তো একটু আমার কাছে!” কল্যাণী রিয়ার মাথাটা তাঁর কোলে টেনে নেন, “যেমন আমার দিদিশাশুড়ির মতো দেখতে হয়েছিস, ঠিক তেমনই তার মতো দাপট হয়েছে।”

“আচ্ছা, তোমার দিদিশাশুড়ি মানে তোমার স্বামীর দিদি। তাই না?”

“আমার স্বামী তোর কে হয়?”

“কেউ না! তুমি আমায় বোঝাবে? স্বামীর দিদিকেই তো দিদিশাশুড়ি বলে!”

“না রে বাবা! তোর বাবার ঠাকুরমা হচ্ছে আমার দিদিশাশুড়ি! কিছুই শিখলি না, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কী হবে রে তোর! জানিস, আমার দাদাশ্বশুর আর দিদিশাশুড়ি বাড়ির অমতে সেইসময় প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন।”

“লাভ ম্যারেজ?”

“হ্যাঁ, এই পরিবারের প্রথম। আমার দাদাশ্বশুরের প্রথমজীবনে খুব জ্যোতিষচর্চার নেশা ছিল, তাই দিদিশাশুড়ির বাড়ি থেকে মেনে নেননি। দিদিশাশুড়ি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে আমার দাদাশ্বশুরকে বিয়ে করেন, তাও আবার পৌষ মাসে। জানিস তো? পৌষ মাসে কোনও শুভকাজ করা শাস্ত্রের মানা, ভাব তো কী সাহস!”

“ওঃ! দারুণ!”

অধীর তাঁর কাজ সেরে এইমাত্র ঘরে ঢুকলেন। কল্যাণী এগিয়ে যান অধীরের কাছে।

“হ্যাঁগো, মাম্পির ব্যান্ড একটা কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছে, ও আমাদের জন্য কীসব কিনে এনেছে দেখো।”

কল্যাণী শার্টের প্যাকেটটা রিয়ার হাতে তুলে দিয়ে ইশারা করেন বাবাকে নিজের হাতে দিতে। অধীর কথাটা শুনে একটু খুশি হন যেন। তিনি বলেন, “ও, তাই নাকি? এদিকে আমারও যে একটা ভাল খবর আছে।”

কল্যাণী অবাক হয়ে তাকান অধীরের দিকে। বহু বছর হয়ে গেল অধীরের মুখ থেকে ভাল খবর শোনেননি তিনি।

“আমার তৈরি করা একটা যন্ত্রের পেটেন্ট নিল সরকার। সেই বাবদ কিছু টাকা পেলাম। ধারটারগুলো শোধ করব এবার, আর ভাবলাম তোমাদের নিয়ে একটা সিনেমা দেখতে যাব নাইট শো-তে। অনেকদিন একসঙ্গে বেরোইনি।”

এমন কথা কল্যাণী তাঁর বিয়ের প্রথম বছরে কয়েকবার শুনেছিলেন অধীরের মুখে। সে কবেকার কথা! অধীরের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সামগ্রীর জন্য যে-টাকা লাগে তা এতদিন গোপনে জুগিয়ে এসেছেন কল্যাণী। প্রথমে অমত থাকা সত্ত্বেও বিয়ের পর কল্যাণীর বাড়ির লোকজন অধীরকে মেনে নেন। একমাত্র সন্তানের জন্য কল্যাণীর বাবা তাঁর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি উইল করে দিয়ে গেছেন। অধীরের চাকরি যাওয়ার পর সেই টাকা থেকেই আপাতত সংসার আর অধীরের গবেষণা চলছে।

কল্যাণী তাঁর উচ্ছ্বাস সংবরণ করে রিয়ার দিকে তাকান। রিয়া মুখ ফিরিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চোখের কোণটা কেমন ভেজা-ভেজা মনে হল।

ঠিক এমন সময় রামকৃষ্ণ লেনের মুখে একটা দামি গাড়ি এসে থামল। তার থেকে একজন ভদ্রলোক নেমে এলেন। লোকটার পরনে কালো জ্যাকেট, হুড দিয়ে মাথা ঢাকা। লোকটা খুব সন্তর্পণে অধীরের বাড়ির গ্যারেজের সামনে দাঁড়ালেন। গ্যারেজটা অধীরের বাড়ির লাগোয়া। বাড়িটা পাড়ার একদম শেষ প্রান্তে। পাড়ার সবাই ওই গ্যারেজটাকে অধীরের খ্যাপামির আখড়া হিসেবেই জানে। ওখানে যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থাকতে পারে, এমন দুরাশা ওই পাড়ার সবচেয়ে বদ্ধ উন্মাদেরও নেই। কেউ ওই গ্যারেজের আশপাশেও ঘেঁষে না। গ্যারেজের দরজাটা সবসময় ওই কারণেই ভেজানোই থাকে। তালা-চাবির প্রয়োজন হয় না। লোকটা চারদিক দেখে খুব সন্তর্পণে গ্যারেজের টিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন।

ভেতরে ঢুকেই তিনি একটা অদ্ভুত গাড়ি দেখতে পেলেন। এটাই তা হলে সেই জিনিস! গাড়িটা তিনি পরীক্ষা করতে থাকেন। কী অদ্ভুত যন্ত্র বানিয়েছেন অধীর! গাড়ির সামনের সিটে একটা কন্ট্রোল প্যানেল, যেখানে তারিখ সেট করা যায়, লোকটা গাড়ির সামনের সিটের দরজা খুলে উঠে বসেন।

এদিকে তিনকড়ির বাড়িতে তিনকড়ি এক্কির সঙ্গে খেতে বসেছেন, এক্কির মা মানসী খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। এক্কি ভাতের মধ্যে মুগের ডালটা চার আঙুল দিয়ে এদিক-ওদিক করে কিছুক্ষণ। তারপর সে বাবাকে বলে, “বাবা, আমি এক্ষুনি চাকরি করব না।”

“ভাল কথা, তা কী করবে শুনি?”

“মাস্টার্স, তারপর পিএইচ-ডি।”

“ভাল। তারপর খাবে কী? হাওয়া আর জল? জলও তো ক’দিন পর পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হবে মনে হচ্ছে। সূর্যের আলো আর হাওয়ার ওপরেও কোনওদিন গভর্নমেন্ট না ট্যাক্স বসায়!”

“বাবা, আমি অধীরকাকার মতো সায়েন্টিস্ট হতে চাই। সবাই যদি এমএনসি-তে চাকরি করে, তা হলে আর আমাদের দেশে নতুন নতুন সায়েন্টিস্ট কীভাবে তৈরি হবে? অধীরকাকা বলে…”

“থাক! ওই অধীর যে কী বলে সেটা আমি খুব ভাল করেই জানি। শোনো এককড়ি, তুমি উচ্ছন্নে যাও, শুধু একটা কথা জেনে রাখো, তোমার বাড়তি পড়াশোনার জন্য আমি আর এক পয়সাও খরচ করব না।”

“অধীরকাকা জানত যে তুমি আমার এমটেক-এর অ্যাডমিশনের টাকা দেবে না। তাই অধীরকাকা আমাকে ওই টাকা দিয়েছে।”

তিনকড়ির ব্রহ্মতালুর ওপর দিয়ে যেন একটা পাঞ্জাবি লরি চলে গেল।

“এত বড় সাহস অধীরের! মাসের পর মাস ধার-বাকিতে নিজের সংসার চালাচ্ছে, নিজের মেয়ের সর্বনাশ করে এবার আমার ছেলেটার ভবিষ্যতের পিন্ডি চটকাচ্ছে! না, আমি আর সহ্য করব না।”

এঁটো হাতেই একটা লুঙ্গি পরা অবস্থায়, গায়ে একটা জামা চড়িয়ে, বুকের একটা বোতাম কোনওমতে লাগিয়ে তিনকড়ি বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। আজই একটা এসপার নয় ওসপার করেই ছাড়বেন। নিজের বাবাকে এক্কি খুব ভালভাবেই চেনে, রেগে গেলে এই মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। অগত্যা এক্কিও পিছন পিছন বেরিয়ে পড়ে, যদি বাবাকে ঠান্ডা করা যায়!

তিনকড়ি অধীরের বাড়ি পৌঁছে দরজায় তালা দেখেন। অগত্যা এক্কির মোবাইল থেকে অধীরকে ফোন করেন। অধীর কল্যাণী আর রিয়াকে নিয়ে ট্যাক্সি করে তখন সিনেমা হলের দিকে যাচ্ছেন, এমন সময় তাঁর ফোন বেজে ওঠে।

“দেখো ভাই, তুমি আমার ছোটবেলার বন্ধু বলেই তোমার যাবতীয় অন্যায় আবদার আমি এত দিন সহ্য করে এসেছি। আমার দোকানে তোমার দশ হাজার টাকার মতো বাকি, কিন্তু আমি কোনওদিনও এক পয়সাও তোমার থেকে ফেরত চাইনি। কিন্তু এখন তো দেখছি তুমি গৌরী সেন হয়ে গেছ! আমার ছেলের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছ! ভাল কথা, আমি আর তোমাদের মধ্যে থাকতে চাই না, শুধু আমার দোকানের বাকি টাকাটা তুমি এক্ষুনি ফেরত দিয়ে দাও!”

তিনকড়ি চটে গেলে প্রায়ই এমন কথা বলেন, অধীর গায়ে মাখতেন না। কিন্তু এবার যেন তিনকড়ির গলায় এক অন্যরকম সুর। অধীর কথাগুলো শুনে বেশ বিব্রত হয়ে পড়ে বলেন, “তিনকড়ি, আমায় একটু সময় দে, আমার একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট প্রায় সাকসেসফুল। আর ক’টা দিন যেতে দে, আমার আর কোনও অভাব থাকবে না।”

“তোমার এক্সপেরিমেন্ট জীবনে সফল হবে না। ওসব ব্লাফে আমি আর ভুলছি না। ঠিক আছে, টাকা যখন দেবে না তখন ওই গ্যারেজে যত খেলনা জমা করেছ সব বেচে আমি পয়সা তুলে নেব।”

তিনকড়ি তেড়েফুঁড়ে গ্যারেজে ঢোকেন। ঢুকেই সামনে একটা অদ্ভুত গাড়ি। তিনকড়ির চক্ষু ছানাবড়া। তিনকড়ি ফোনে অধীরকে বলেন, “বাঃ বাঃ! ভেরি গুড! আনন্দে তো তোকে আমার চুমু খেতে ইচ্ছে করছে রে অধীর! আমাকে ফেরত দেওয়ার মতো টাকা তোর নেই, এদিকে লাক্সারি করার জন্য একটা গাড়ি হাঁকিয়ে বসে আছিস!”

অধীর অশনি সংকেত টের পান। তিনি তিনকড়িকে যথাসম্ভব বোঝানোর চেষ্টা করেন।

“আরে শোন, এটা ঠিক সাধারণ গাড়ি নয়।”

“সে তো দেখতেই পাচ্ছি সাধারণ গাড়ি নয়, এ তো একেবারে ইম্পোর্টেড গাড়ি মনে হচ্ছে। বাঃ বাঃ! ঠিক আছে, পয়সা যখন দিবি না তখন এই গাড়ি নিয়েই আমি চলে যাব।”

এক্কি গাড়ি চালাতে জানে, তাই এক্কিকে মারধর করতে করতে তিনকড়ি ওই গাড়িতে তোলেন, সঙ্গে সঙ্গে নিজেও উঠে বসেন। এক্কি বাবাকে বাধা দেওয়ার প্রাথমিক কয়েকটা চেষ্টা করে বুঝতে পেরেছে যে, বাবা আজ স্বয়ং ভোলানাথ হয়ে গেছেন, দক্ষযজ্ঞ না বাঁধিয়ে আজ তিনি ক্ষান্ত হবেন না। এক্কি ভাবল, গাড়ি এখন যদি তারা নিয়েও যায় পরে বাবার রাগ পড়লে এক্কি আবার গাড়ি ফেরত দিয়ে যাবে অধীরকাকাকে। তাই সে আর কথা বাড়ায়নি।

গাড়িতে উঠে তো এক্কি আর তিনকড়ির তাক লেগে গেছে! এ কী অদ্ভুত গাড়ি! কী সব বিচিত্র কলকবজা! এ গাড়ি চালায় কেমন করে? অধীর ফোনে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তিনকড়িকে বিরত করতে। গাড়ির মূল কন্ট্রোল প্যানেলে একটা বড় সুইচ আছে, তিনকড়ি কী মনে করে সেটা টিপে দিলেন হঠাৎ। সমস্ত গাড়িটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। যেন প্রবল এক ভূমিকম্পের সূচনা হতে চলেছে। কত বিচিত্র আলোর রোশনাইয়ে সেই গাড়িটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপরেই যেন কোন মন্ত্রবলে গাড়িটা তিনকড়ি আর এক্কি সমেত অদৃশ্য হয়ে গেল।

ফোনটা কেটে গেছে। অধীর এক্কির মোবাইলে কল-ব্যাক করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু লাইন পাওয়া গেল না। বিস্ময় এবং আতঙ্ক অধীরকে সমপরিমাণে গ্রাস করেছে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো তাঁর আর হল না। তাঁদের ট্যাক্সি বাড়ির দিকে ঘোরাতে নির্দেশ দেন অধীর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *