১.
কোনও বায়োডাটা ফর্ম পূরণ করতে গেলে নাম বয়স ও জন্মতারিখের পর পিতা/স্বামীর ঘরে আমার দৃষ্টি থমকে দাঁড়ায়। বিবাহিত পুরুষেরা পিতা এবং স্বামীর মধ্যে পিতাকে বেছে নেন, কারণ তাদের ‘পিতা আছে, স্বামী নেই; বিবাহিত নারীদের কিন্তু খানিকটা মুশকিল হয়, কারণ তাদের পিতাও আছে এবং স্বামীও আছে। তাদের বেছে নিতে হয় যে কোনও একজনের ‘অভিভাবকত্ব’। সাধারণত স্বামীর অভিভাবকত্ব বরণ করতে হয় তাদের।
স্বামী ও স্ত্রীকে যদি একে অপরের পরিপূরক বলে ধরে নিই— স্ত্রী যদি স্বামীর নাম উল্লেখ করেন তার জীবনবৃত্তান্তে, তবে স্বামীরও নিশ্চয়ই স্ত্রীর নামই উল্লেখ করা উচিত। আর তা না হলে নারী ও পুরুষ উভয়কেই তাদের পিতা-মাতার পরিচয়ই উল্লেখ করতে হবে। আমার মনে হয় পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে সে বিবাহিত কী অবিবাহিত— অভিভাবক হিসেবে পিতা ও মাতাকে স্বীকার করাই উচিত।
ধরা যাক, দেশের কোনও এক নাগরিক তার পিতা-মাতাসহ ময়মনসিংহে বসবাস করে, তার পিতার জন্ম এবং আদি বাড়ি রাজশাহী জেলায়, তার মায়ের জন্ম এবং আদি বাড়ি চট্টগ্রাম জেলায়। এই নাগরিককে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার বাড়ি কোথায়, তবে সে কিন্তু ময়মনসিংহ নয়, চট্টগ্রাম নয়, বলবে রাজশাহী। ধরা যাক রাজশাহী পিতার বাড়ি বটে, তবে রাজশাহীতে সে কখনও যায়নি, তার পিতা চট্টগ্রামের মেয়েকে বিবাহ করে কর্মসূত্রে ময়মনসিংহে চলে আসেন এবং দীর্ঘকাল সেখানে বসবাস করেন, তবু তার নিজের ‘গ্রামের বাড়ি বা দেশের বাড়ি’ রাজশাহীকেই মানতে হবে। এ এক অদ্ভুত ব্যবস্থা বটে। পিতার জন্মস্থানকে নিজের উৎসস্থল বলে চিহ্নিত করা। এটির কারণ ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা’— পিতাই যেখানে পরিবারের প্রভু। সংসারে পিতার যদি কোনও অর্থনৈতিক অবদান না থাকে— পিতা যদি অথর্ব, অক্ষম, অসৎ ও অত্যাচারী হয় তবুও সন্তানকে পরিচিত হতে হয় পিতার পরিচয়ে। মাতা যদিও একটি ভ্রূণকে ন’মাস সাত দিন জরায়ুতে লালন পালন করেন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তা প্রসব করেন, তবু তার পরিচয় সমাজে মুখ্য নয়। আমি বলছি না মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এই সমাজকে ফিরে যেতে হবে। বলছি না রোকেয়ার নারীস্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। আমার একটিই প্রস্তাব, যে গ্রাম বা শহরে তুমি বাস করো, তোমার বাড়ি কোথায় প্রশ্ন করা হলে সেই গ্রাম ও শহরের নাম উল্লেখ করো। সেই সঙ্গে পিতার বাড়ি এবং মাতার বাড়িরও আলাদা উল্লেখ প্রয়োজন। অন্তত এই নিয়মটি শীঘ্র চালু করলে পিতৃতন্ত্রের নাগপাশ থেকে খানিকটা মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। মুক্তি পাওয়া মানে কিন্তু এই নয় যে, নারীর সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়া, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটে যাওয়া, নারীর রাজনীতি করবার, শিক্ষিত হবার, স্বনির্ভর হবার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যাওয়া, অন্ধকার ঘুচে যাওয়া। খুলে যাওয়া তার সামাজিক সকল শৃঙ্খল।
এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসুখ। এই অসুখ দূর করা সহজ কথা নয়। তবু সুস্থতার সামান্য যেটুকু চর্চা চলছে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে, আমি তারই বিস্তার চাই। মানুষ সজাগ হোক, মূলোত্পাটন করুক দুরারোগ্য ব্যাধি বৃক্ষের।
২.
‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’— এ কথা অনেকেই বলে। আমি তা বিশ্বাস করতে চাই না। কোনও মেয়ে যখন অন্য মেয়ের শাশুড়িতে পরিণত হয়, আমরা সাধারণত লক্ষ্য করি শাশুড়ি-মেয়ে বউ-মেয়ের ওপর ভীষণ মারমুখো, বাপ তুলে গালাগাল করছে, দিনভর খাটাচ্ছে, সময়ে অসময়ে গায়েও হাত তুলছে, কোথাও কোথাও তো এমনও হচ্ছে যে ননদ-শাশুড়ি মিলে বউকে একেবারে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে নয়তো দায়ে কুপিয়ে মারে। এক্ষেত্রে, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে অর্থাৎ তার ছেলের প্রতিনিধি হিসেবে সেই মেয়ে উপনীত হয় এবং অবিকল পুরুষেরই মতো অত্যাচার করে আরেক মেয়েকে। ঠিক একইভাবে সেই মেয়ে যখন অন্য এক ছেলের শাশুড়ি তখন ছেলে-জামাই-এর সঙ্গে তার আচরণ বড় চমত্কার, তখন সে নম্র, ভদ্র, পাতে তুলে দিচ্ছে মাছের মুড়ো, আস্ত মুরগি, চিতল মাছের কোপ্তা। কারণ সে তখন মেয়ের পক্ষ, মেয়ে মানেই সহায়হীন, অসহায়, দুর্বল।
এ ছাড়া আরও একটি কারণে মেয়েরা মেয়েদের শত্রু বলে মনে হয়, সে হলো ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। এটি একটি রোগ। এই রোগে অধিকাংশ মেয়েই ভোগে। ভোগে না বলে ভোগানো হয় বলা উচিত। মেয়েদের ‘ইনফিরিওর’ করে রাখা সমাজের যেন নৈতিক দায়িত্ব। মেয়েরা ‘ইনফিরিওর’ না হলে, অধিকাংশ মানুষই ভাবে যে সংসার টেকে না। তাই বিয়ে করতে হলে দৈর্ঘ্যে কম, প্রস্থে কম, বিদ্যায় কম, বুদ্ধিতে কম, এমন মেয়েকে ঘরে নিয়ে এসে ঘর ব্যালেন্স করা হয়। এতে করে সংসারের মূল উপার্জনের দায়িত্বের মতো, যে কোনও সিদ্ধান্ত এবং গুরুদায়িত্ব একা ছেলেকেই বহন করতে হয়। এ অবশ্য সুপিরিওর হবারও একটি চমত্কার কৌশল। এই কৌশল অবলম্বন করে সব ছেলেই অনায়াসে সুপিরিওর বনে কিন্তু মেয়েরা ইনফিরিওরটি কমপ্লেক্স রোগে মুহুর্মুহু আক্রান্ত হয়।
এই কমপ্লেক্স থেকে জন্ম নেয় ঈর্ষা। পরনির্ভর ‘গৃহবধূ’ ঈর্ষা করে চাকরিজীবী স্বনির্ভর মেয়েকে, স্বামী দ্বারা নির্যাতিত মেয়ে ঈর্ষা করে স্বামীকে তালাক দেওয়া ব্যক্তিত্বশালী মেয়েকে, নিচু ক্লাস অবধি পড়া মেয়ে ঈর্ষা করে বিদুষী মেয়েকে; অক্ষমতার এই ক্রোধ কি ভয়ঙ্কর হিংসের রূপ নেয় তা ওই হিংসের অনলে একবার না পড়লে বোঝা যাবে না। মেয়েদের জাত কিন্তু পুরুষের চেয়ে আলাদা নয়। মনুষ্য চরিত্র সব এক। হিংসে পুরুষের কম নয়। আসলে সত্যি বলতে কী, হিংসের কারণে এ পর্যন্ত খুন জখম মেয়েদের চেয়ে পুরুষরাই বেশি করেছে। নারীর চেয়ে পুরুষের ঈর্ষাটা বরাবরই বেশি। ঈর্ষায় পুরুষ কি না করেছে, দেশে দেশে যুদ্ধ বাধিয়েছে, ঘরে ঘরে ভায়োলেন্স করিয়েছে।
শিক্ষিত মেয়েরা হাতে ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষার বড়াই করে। কিন্তু শিক্ষা তো কোনও একাডেমিক পড়াশোনায় অর্জিত হয় না। মেয়েরা, কিছু মেয়েরা, পরীক্ষায় পাস করছে বটে, শিক্ষিত হচ্ছে না। শিক্ষিত হওয়া অন্য জিনিস। শিক্ষিত হলে মানুষ ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগে না, সেই কমপ্লেক্স থেকে হিংসের আগুনে সেও পোড়ে না, অন্যদেরও পোড়ায় না। আর পুরুষদের বেলায়ও একই কথা খাটে। সত্যিকার শিক্ষিত পুরুষরা হীনমন্যতায় ভোগে না।
লোকে এও বলে, মেয়েরা মেয়েদের যত হিংসে করে, ছেলেরা তত করে না। মেয়েদের মধ্যে এই নীচতা, হীনতা, কূটকচাল, হিংসে, লোভ ইত্যাদি বেশি। মেয়েরাই মেয়েদের সম্ভ্রম নষ্ট করে, মেয়েরাই মেয়েদের অগ্রসর ইচ্ছের গলা টিপে ধরে, মেয়েরাই মেয়েদের ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি। এই ক্ষতি কিন্তু একটি অশিক্ষিত, নির্বোধ মেয়ে যতটা করে, তার চেয়ে সহস গুণ বেশি করে একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত (!) বুদ্ধিমান মেয়েরা; এই শিক্ষিতরা যদি একবার কমপ্লেক্সে ভোগে, সে বড় মারাত্মক ভোগা, তাদের দূষিত দীর্ঘশ্বাসে চারপাশ সংক্রামিত হয়; তাদের ধ্বংসযজ্ঞে মেয়েরাই সুযোগ্য বলি হিসেবে ধৃত হয়।
আমার বড় করুণা হয়। আহা নারী! আহা হতভাগ্য নারী! লেখাপড়া করে ‘বুদ্ধি’ হবে বলে বলে তাকে লেখাপড়াই শেখানো হয় না, আর লেখাপড়া করে যাদের ‘বুদ্ধি’ হয়েছে, তারা এমন হতভাগ্য যে নিজেদের বুদ্ধির অপব্যবহার তারা এভাবেই করে যে দুর্বলের ওপর তারা খগড়হস্ত হয়, তারা অসহায়কে দাঁত খিঁচোয়, তারা দুর্গতদের ভাত কেড়ে নেয় এবং নিগৃহীতদের গালাগাল করে। যে ‘বুদ্ধি’ দ্বারা মানুষের ক্ষতি হয়, নারীর যে বুদ্ধি আরেক নারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে— আমি তাকে বুদ্ধি বলি না। বলি ছোবল, বিষধর সাপের ছোবল।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৫ মে, ২০১৬