সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ঐতিহাসিক পটভূমি
মধ্যযুগীয় জীবন ব্যবস্থা ছিলো ভূমিনির্ভর। সেকালে জমির মালিকানা স্বত্ব অথবা তার উপর কর্তৃত্বের ভিত্তিতেই মানুষের আর্থিক ও সামাজিক জীবনের সমৃদ্ধি মর্যাদা নির্ণীত হতো। ভূমিনির্ভর এই ব্যবস্থার নামই সামন্ততন্ত্র। সে ব্যবস্থায় আর্থিক সমৃদ্ধি, সামাজিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ক্ষেত্রে রাজাই ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। অন্য পক্ষে, সব দিক থেকেই সম্পূর্ণ অধমস্থানীয় ছিলেন ভূমিদাসেরা, যাঁরা নিজেদের পরিশ্রমের দ্বারা ধন উৎপাদন করলেও তাতে তাঁদের নিজেদের কোন অধিকার থাকতো না, যাঁরা ছিলেন পুরোপুরি নিঃস্ব, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সামাজিক মর্যাদাহীন। এই দুইয়ের মধ্যবর্তী ছিলো সমাজের অবশিষ্ট অংশ।
আর্থিক জীবনের যারা নিয়ন্ত্রেতা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ প্রধানতঃ তাদের হাতেই থাকে। সামাজিক সম্পর্কের এই অলঙ্ঘনীয় নিয়মেই মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিলো তাদেরই হাতে, যারা ছিলো জমির মালিক। সে ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি দেশ একটি জমিদারীর মতো শাসিত হতো। এই জমিদারীর শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত থাকতেন রাজা এবং তাঁর অধীনস্থ বহুসংখ্যক সামন্ত ভূম্যধিকারী সমগ্র দেশের উৎপাদন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে নিযুক্ত থাকতেন। এই শ্রেণীভুক্ত মানুষেরাই ভূমিনির্ভর সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সত্যি অর্থে ‘মানুষ’ বলে বিবেচিত হতেন। মানবিক অধিকার, সম্পত্তির মালিকানা, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি সব কিছুই ছিলো শুধুমাত্র তাঁদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তার মধ্যে এই শক্তিশালী শ্রেণীর এ জাতীয় চিন্তা এবং অধিকারবোধ পুরোপুরিভাবে প্রতিফলিত হতো।
রাজা ও ভূম্যধিকারীরা যেহেতু ভূমিহীন কৃষকদের জীবনকে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন, সেজন্যে নিজেদের কোন কাজ অথবা সিদ্ধান্তের জন্যে নিম্নশ্রেণীর লোকদের কাছে তাঁদের জবাবদিহির কোন প্রশ্ন উঠতো না। অর্থাৎ শাসনের জন্যে তাঁরা শাসিতের অনুমতির অপেক্ষা করতেন না। এজন্যে তখনকার রাষ্ট্রীয় কাঠামোও এমন ছিলো, যাতে করে সে রকম কোন রাজনৈতিক সম্মতি জ্ঞাপন অথবা গ্রহণের কোন উপায়ও তার মধ্যে ছিলো না। সে অবস্থায় রাজা কার্যতঃ তাঁর অনুগত সামন্ততান্ত্রিক ভূম্যধিকারীদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং তত্ত্বগতভাবে তাঁর সকল রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকর্মের জন্যে দায়ী থাকতেন খোদাতালার কাছে। অর্থাৎ তিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন জনসাধারণের নয়, খোদাতালার।
এই প্রতিনিধিত্বের দাবীতে রাজরাজেশ্বরেরা বাস্তবতঃ যেভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন তার চরিত্র ছিলো পুরোপুরি স্বেচ্ছাচারী। যে শোষণ ব্যবস্থার উপর তখনকার শাসনব্যবস্থা স্থাপিত ছিলো, তার অপসারণ সাধারণ ভূমিহীন কৃষক ও অল্পবিত্ত মানুষের না থাকার ফলে মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ সত্ত্বেও স্বেচ্ছাচারী সামন্ততান্ত্রিক শাসনের উচ্ছেদ তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
২
সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজা ও ভূস্বামীদের অত্যাচার-উৎপীড়নের ফলে অনেক সময় ভূমিহীন কৃষকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করতো, কখনো হয়তো অন্যান্য আরও নানাভাবে তারা ভূম্যধিকারীদের অধিকারকে খর্ব করতে চাইতো। এই সব প্রচেষ্টাই পরিশেষে নিষ্ফল হলেও তার দ্বারা উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা নানাভাবে বিপদগ্রস্ত হতো, তাদের শাসন-শোষণও নিশ্চিতভাবে সম্পন্ন হতো না। এজন্যে প্রয়োজন হতো নিম্নশ্রেণীর কৃষকদেরকে অনুগত রাখার বিবিধ ব্যবস্থা, যার মধ্যে ধর্ম ছিলো অন্যতম প্রধান।
ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে তাদেরকে আনুগত্য শিক্ষা দেওয়া হতো এবং খোদাতালার প্রতিনিধি হিসাবে রাজা হতেন সেই আনুগত্যের সর্বপ্রধান দাবীদার। তাদের মনে এই আনুগত্যবোধ সঞ্চারের ক্ষেত্রে চার্চ এবং ধর্মযাজকদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। বস্তুতঃ তারাই এক্ষেত্রে রাজা ও ভূস্বামীদের সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য সহযোগী।
রাজচক্রবর্তীদের স্বর্গীয় অধিকারের (divine right) তত্ত্ব ভূমিহীন কৃষক এবং সমাজের অন্যান্য নিম্নশ্রেণীর মানুষদেরকে শোষণ করার প্রয়োজন থেকেই উদ্ভূত এবং সামন্ততন্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে অপরিহার্য। এই তত্ত্বের উপর রাষ্ট্র সংক্রান্ত চিন্তাকে স্থাপন করলে রাজার প্রতি দেশের মানুষের আনুগত্যহীনতার কোন তত্ত্বগত ভিত্তি থাকে না এবং স্বেচ্ছাচারিতার পথও হয় পরিষ্কৃত। এজন্যে রাজার স্বর্গীয় অধিকারের তত্ত্ব সর্বাংশে স্বেচ্ছাচারিতারই রাষ্ট্রীয় দর্শন।
৩
এই রাষ্ট্রীয় দর্শনের পতন ঘটে সতেরো শতকে। সে সময় ইউরোপীয় দার্শনিকেরা নোতুন প্রয়োজনের তাগিদে রাষ্ট্রের প্রকৃত ভিত্তি সম্পর্কে নানা মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে তার জবাব সন্ধানে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু সতেরো শতকীয় দার্শনিকদের চিন্তা সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজে কি পরিবর্তন সূচিত হয়েছিলো, সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়োজন।
পূর্ববর্তী ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে সতেরো শতকে ইউরোপের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারিত হয়। ইউরোপীয় সওদাগরেরা সে সময়ে আমেরিকায় দাস ব্যবসায়ের দ্বারা প্রভূত অর্থ উপার্জন করে। এছাড়া ইংলণ্ডে তুলাজাত, লৌহজাত এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন শুরু হয় এবং ভাড়া খাটা মজুরদেরকে বিভিন্ন কারখানা বা ম্যানুফ্যাক্টরীতে কাজে লাগানোর ব্যবস্থাও প্রবর্তিত হয়। তার ফলে একদিকে একটি নোতুন বাণিজ্যিক বুর্জোয়া শ্রেণী এবং অন্যদিকে নিঃস্ব দিনমজুর শ্রেণীর উৎপত্তি ঘটে।
কৃষকদের উপর ষ্টুয়ার্ট রাজাদের নানা অত্যাচার এবং অন্যদিকে সমস্ত শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রয়ের একচেটিয়া অধিকার নিজেদের হাতে রাখার ফলে কৃষি ও শিল্প উভয়েরই উন্নতি সে সময়ে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হতো। শিল্পজাত দ্রব্যসমূহ বিক্রীর অনুমতি লাভের জন্যে রাজার কাছে আবেদন করতে হতো এবং উপযুক্ত সালামী দেওয়ার পর সে অনুমতি তারা লাভ করতো। সত্যিকার কারবারী লোকদেরকে এই অনুমতি না দিয়ে অনেক সময় রাজা নিজের বশংবদ সামন্ততান্ত্রিক আমলাদেরকে এই সব কারবারের অনুমতি দিতেন। তাছাড়া বহু জিনিষের উৎপাদন তাঁরা আইনতঃ নিষিদ্ধ করেছিলেন। এই নিষিদ্ধ দ্রব্য উৎপাদনের জন্যে আবার পৃথকভাবে অনুমতি প্রার্থনা করতে হতো এবং যে অনুমতি তাদেরকেই দেওয়া হতো, যারা সেই সমস্ত দ্রব্যের একচেটিয়া কারবারের অধিকার রাজার নিকট থেকে ক্রয় করতে পারতো।
এক কথায় বলা চলে যে স্টুয়ার্ট রাজাদের আমলে ইংল্যান্ডে কৃষি এবং শিল্প বাণিজ্য এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিলো, যাতে করে একটা বিপ্লব ব্যতীত তাদের উভয়েরই উন্নতির কোন পথ ছিলো না। বিপ্লবের প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছিলো এজন্যে যে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতে নবউত্থিত বুর্জোয়া শ্রেণীর কোন প্রতিনিধিত্ব ছিলো না। কাজেই তাদের দাবী- দাওয়ার প্রতি কর্ণপাত করার মতো কোন শক্তি সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্রের মধ্যে ছিলো অনুপস্থিত।
ইংল্যান্ডের বিপ্লবের মাধ্যমে ক্রমওয়েল প্রথমে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ করেন। ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের পর রাজতন্ত্র সেখানে নিরাপদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও তার সাথে পূর্ববর্তী রাজতন্ত্রের অনেক প্রভেদ ঘটে। নোতুন রাজতন্ত্রে রাজার ক্ষমতা বহুলাংশে খর্ব হয় এবং বণিক-ভূস্বামী শ্রেণীর লোকদের দ্বারা প্রভাবিত পার্লামেন্ট প্রভুত্ব লাভ করে। তার পর থেকে কর ধার্যের ক্ষমতা রাজার হাত থেকে পার্লামেন্টের কাছে হস্তান্তরিত হয়, রাজার কোন সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর দস্তখত ব্যতিরেকে কার্যকরী হবে না বলে স্থির হয়। তাছাড়া, তখন থেকে রাজা খোদাতালার পরিবর্তে পার্লামেন্টের কাছে নিজের কার্জকর্মের জন্যে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী থাকবেন এই সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। কাজেই, সতেরো শতকে ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলেও বস্তুতঃপক্ষে সেখানে স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটে। নোতুন আর্থিক জীবনের উন্নতির জন্যে স্বৈরতন্ত্রের অবসান অপরিহার্য ছিলো। এবং সেই অনুসারে স্বৈরতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় দর্শনেরও প্রয়োজন ছিলো পরিবর্তনের। এই প্রয়োজন থেকেই সতেরো শতকের নোতুন রাষ্ট্রদর্শনের উদ্ভব হয় এবং ইংল্যাণ্ডের টমাস হব্স্ই হন তার প্রথম প্রধান প্রবক্তা।
হব্স্ রাজতন্ত্রের সমর্থক হলেও তাকে তিনি সম্পূর্ণ অন্য ভিত্তির উপর স্থাপন করেন। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রয়োজনের তাগিদে কেন্দ্রীকৃত রাষ্ট্রব্যবস্থা তিনি অনুমোদন করেন কিন্তু সেই সাথে এ কথাও বলেন যে কোন সার্বভৌম রাজা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন ঐশ্বরিক প্রতিনিধিত্বের জোরে নয়; তাঁর ক্ষমতার আসল উৎস হচ্ছে জনসাধারণের অথবা নাগরিকদের সম্মতি। তাঁর দর্শনে এই সম্মতি দানের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ হলেও বিষয়টির অবতারণা ইউরোপীয় রাষ্ট্রীয় চিন্তার ইতিহাসে একটি বৈপ্লবিক ও যুগান্তকারী ঘটনা। এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে দুটি জিনিসের হাত থেকে রাষ্ট্রদার্শনিক চিন্তা মুক্তি লাভ করে।
এর প্রথমটি হচ্ছে ধর্ম। মধ্যযুগে সর্বপ্রকার চিন্তার মতো রাষ্ট্রীয় চিন্তাও ধর্মপ্রভাবে আচ্ছন্ন ছিলো। চার্চের প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনে প্রবল থাকায় রাজনৈতিক জীবনে তাকে অতিক্রম করা সম্ভব ছিলো না। কিন্তু সতেরো শতকের দিকে শিক্ষিত ইউরোপীয়ানদের জীবনে ধর্মীয় প্রভাব অনেকাংশে শিথিল হয়ে আসে। তাছাড়া ধর্ম সে সময় সরাসরিভাবে শিল্প বাণিজ্যের প্রসারে বাধা দান করতে থাকে। এর ফলেও ধর্মের বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়া বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে দেখা দেয়। রাষ্ট্রীয় চিন্তাকে ধর্মমুক্ত করা সেকালের আর্থিক অগ্রগতির পক্ষে তাই হয়ে দাঁড়ায় অপরিহার্য। হস্ত্রে চিন্তায় বৃহত্তর জীবনের এই তাগিদই বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছিলো।
দ্বিতীয়তঃ, রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জনসাধারণের সম্মতি, এই তত্ত্বের মধ্যে মানুষ স্বেচ্ছাচারিতার হাত থেকে নিষ্কৃতির সন্ধান পায়। কেন্দ্রীকৃত রাজতন্ত্র অনুমোদনের দ্বারা হস্ নিজে পরোক্ষভাবে স্বেচ্ছাচারিতা সমর্থন করলেও তত্ত্বগতভাবে স্বেচ্ছাচারিতার মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেন। সামাজিক চুক্তির মুখ্য কথা হলো শাসনের জন্যে শাসিতের সম্মতি। এই সম্মতির প্রশ্ন উত্থাপন করে হস্ আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তার দিক নির্দেশ করেন। তাঁর নির্দেশিত পথেই তাঁর দার্শনিক উত্তরসূরীরা নিজেদের চিন্তাকে চালনা করে প্রথমে রাজতন্ত্রকে সীমিত এবং পরে বাতিল করে দেন। এইভাবে রাজতন্ত্র, সামাজিক চুক্তিবাদের দ্বারা ধর্ম এবং স্বৈরতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে অনেকখানি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক চরিত্র পরিগ্রহণ করে। ইউরোপীয় সমাজ ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রকে উত্তীর্ণ হয়ে নোতুন এক পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার সন্ধিক্ষণে তত্ত্বের ক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সেই শূন্যতাই পূরণ হয় সামাজিক চুক্তিবাদের দ্বারা। এই দর্শনের তাত্ত্বিক দুর্বলতা যাই থাক, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব তাই অনস্বীকার্য
৪
বুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান এবং তার সাথে সামন্ততন্ত্রের সংঘাতের সময় থেকেই ইউরোপীয় ধর্মজীবনে এক দারুণ সংকট উপস্থিত হয়। চার্চ ও যাজক সম্প্রদায় স্বার্থগতভাবে সামন্ততন্ত্রের সাথে সংযুক্ত ছিলো। কাজেই বুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান ও প্রসারকে বাধা দানের ক্ষেত্রে ক্যাথলিক ধর্ম একটা বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে। এজন্য বুর্জোয়া শ্রেণী এবং তার মুখপাত্রেরাও তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। বস্তুতঃ, ক্যাথলিক চার্চ সামন্ততান্ত্রিক শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হওয়ার ফলেই তার সাথে বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত দার্শনিক ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সংঘর্ষ আঠারো শতকে এক চরম আকার ধারণ করে। ফরাসীদের এই নোতুন বুর্জোয়া শ্রেণীর সর্বপ্রধান দার্শনিক মুখপাত্র ভলতেয়ার ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে অবিরত সংগ্রাম করেন। কবিতা, নাটক, গল্প এবং দার্শনিক নিবন্ধের মাধ্যমে তিনি অবিশ্রান্তভাবে প্রবৃত্ত হন সামন্ততান্ত্রিক ও ধর্মীয় শোষণের স্বরূপ উদঘাটনে। তিনি সোজাসুজি ঘোষণা করেন যে, ধর্ম জালিয়াতি ব্যতীত কিছুই নয় এবং সেই জালিয়াতিতে তাঁদের কোন প্রয়োজন নেই। দিদেরো প্রমুখ বিশ্বকোষ রচয়িতারাও অনুরূপ মতই পোষণ করতেন।
কিন্তু ধর্মের প্রতি বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গীর অপর একটি দিকও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ধর্মে ব্যক্তিগতভাবে তাদের কোন প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু স্বল্পকাল পরেই তারা উপলব্ধি করলো যে ধর্মকে সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা তাদের স্বার্থের অনুকূল নয়। এ কথা ভলতেয়ারের মতো ধর্মদ্বেষী দার্শনিকও উপলব্ধি করেছিলেন। তাই খোদাতালা এবং ধর্মে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস না করলেও সাধারণ মানুষকে বুর্জোয়া স্বার্থের প্রতি অনুগত রাখার উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করার স্বপক্ষে তিনি ওকালতি করতে দ্বিধাবোধ করেন নি।
এতো গেলো ফরাসী বিপ্লবের পূর্বের কথা। কিন্তু বিপ্লবোত্তর যুগে বুর্জোয়া শ্রেণী চার্চের সহযোগিতার মূল্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করে আবদ্ধ হলো তার সাথে এক ‘পবিত্র’ আঁতাতে। সামন্ততান্ত্রিক শাসনের যুগে যে বুর্জোয়া শ্রেণী লিপ্ত ছিলো চার্চের সাথে শত্রুতায়, তারাই এবার নিজেদের শ্রেণীস্বার্থের তাড়নায় নিযুক্ত হলো বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে ক্যাথলিক এবং বিশেষ করে প্রচেষ্ট্যান্ট চার্চের নোতুন মৈত্রীবন্ধনে।
৫
ফ্রান্সিস বেকনই (১৫৬১-১৬২৬) ইংল্যান্ডে বস্তুবাদের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক দর্শনকে অধিবিদ্যার (metaphysics) প্রভাবমুক্ত করে তাকে মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে প্রাথমিক জ্ঞান আমরা লাভ করি, তার যুক্তিগ্রাহ্য বিচার ও বিশ্লেষণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হস্ বেকনের এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে অনুসরণ করে বস্তুবাদকে দৃঢ়তর ভিত্তির উপর স্থাপন করেন। কিন্তু মানুষের সমস্ত জ্ঞান তার অভিজ্ঞতার উপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল, একথা স্বীকার করলেও সে বিষয়ে সিদ্ধান্তসূচক কোন প্রমাণ হস্ দিতে সক্ষম হননি। সে প্রমাণ প্রথম পাওয়া গেলো জন লকের মধ্যে। তিনিই অভিজ্ঞতার বিস্তৃত বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই প্রমাণ উপস্থিত করেন। কাজেই ইংল্যাণ্ডে বস্তুবাদী চিন্তার সূত্রপাত, সংগঠন ও দৃঢ়ভিত্তি রচনার ক্ষেত্রে বেকন, হস্ এবং লকের গুরুত্ব অপরিসীম। ডেভিড হিউম বস্তুরূপ সম্পর্কে কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলেও পদ্ধতিগতভাবে তাঁর কৃতিত্বও অসাধারণ। আঠারো শতকের ফ্রান্সে যে বস্তুবাদী চিন্তার উত্থান হয়, সেটা ইংল্যান্ডের পূর্ববর্তী অনুরূপ চিন্তা ব্যতীত কিছুতেই সম্ভব হতো না। তৎকালীন ফরাসী বস্তুবাদী দার্শনিকেরা সরাসরিভাবেই বৃটিশ বস্তুবাদী দার্শনিকদের উত্তরসুরী। এই বস্তুবাদ শুধুমাত্র ধর্মীয় চিন্তার সমালোচনাকে বিশেষভাবে অবলম্বন না করে তাকে চিন্তার সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়। তার ফলে আঠারো শতকীয় ফ্রান্সে ধর্মের সাথে বস্তুবাদের বিরোধ ও শত্রুতা আরও ঘোরতর আকার ধারণ করে।
আঠারো শতকের সাধারণ ইংরেজ মধ্যবিত্ত তার সমশ্রেণীয় ফরাসীদের থেকে অনেক বেশী রক্ষণশীল ও ধর্মানুসারী ছিলো। তার কারণ, গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে ইংলন্ডে সামন্ততান্ত্রিক ভূম্যধিকারী এবং বুর্জোয়াদের মধ্যে একটা আপোষরফার ফলে সেখানে সামন্ততান্ত্রিক ও বুর্জোয়া শক্তির মধ্যে একটা লেনদেনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এর ফলে বুর্জোয়া শ্রেণী ক্রমাগত নোতুন শক্তি সঞ্চয় করে গেলেও তার দ্বারা সামন্ততন্ত্র এবং প্রটেস্ট্যান্ট চার্চের ধ্বংস সাধিত হলো না। উপরন্তু ধনতন্ত্রের প্রসার ও সমৃদ্ধির সাথে সাথে শিল্পশ্রমিক শ্রেণীর সংগঠিত শক্তিকে দমন ও খর্ব করার উপায় হিসাবে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তারা ধর্মের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকলো।
আঠারো শতকের ফ্রান্সে কিন্তু চিন্তার আবহাওয়া অন্যরকম ছিলো। ‘গৌরবময় বিপ্লবের’ মতো কোন আপোষরফা না হওয়ার ফলে সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামী ও ক্যাথলিক চার্চের সাথে বুর্জোয়াদের শত্রুতা সেখানে এক চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। বস্তুবাদী চিন্তাও সে সময় পরিগ্রহ করে একটা বৈপ্লবিক রূপ। সাধারণ কারিগরি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যবহার আপত্তিজনক ছিলো না, কিন্তু বৈজ্ঞানিক চিন্তা যখন সে পর্যায় উত্তীর্ণ হয়ে নানা মৌলিক তাত্ত্বিক প্রশ্ন উত্থাপন করে তার সমাধান দানে প্রবৃত্ত হলো, তখন ক্যাথলিক চার্চের সাথে শুরু হলো তার সরাসরি শত্রুতা। শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের উপযোগিতার জন্যে তাকে বর্জন করার ক্ষমতা বুর্জোয়াদের ছিলো না। কাজেই আঠারো শতকের ফ্রান্সে চার্চের সাথে বিজ্ঞান এবং তার পৃষ্ঠপোষক বুর্জোয়া শ্রেণীর এই শত্রুতা ছিলো অপরিহার্য।
এজন্যেই ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালের বুর্জোয়া বিপ্লবের কোন ধর্মীয় মুখোশ ছিলো না, সরাসরিভাবে সেটা রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবেই গঠিত ও পরিচালিত হয় এবং সামন্ততন্ত্রের সাথে কোন আপোষরফার চেষ্টা না করে পরিশেষে তার পরিপূর্ণ উচ্ছেদ সাধন করে।
ইংল্যান্ডে বিপ্লবপূর্ব ও বিপ্লবোত্তর অবস্থার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং সামন্ততন্ত্র ও বুর্জোয়াদের মধ্যে সমঝোতার ফলে আইনের কাঠামোতে কোন বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের বদলে সেখানেও একটা ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় এবং সামন্ততান্ত্রিক আইন কানুন বহুল পরিমাণে প্রচলিত থাকে। কিন্তু ফ্রান্সে বিপ্লবের পর পূর্ব আইন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে নেপোলিয়নের আমলে সেখানে নোতুন ধনতান্ত্রিক আর্থিক জীবনের উপযোগী এক আইন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এবং পরবর্তী সময়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও তা বিস্তৃত প্রভাব বিস্তার করে।
৬
ফরাসী বিপ্লবের পর শুধু ফ্রান্সেই সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটলো, তা নয়। ইউরোপের যে সমস্ত এলাকা ফরাসীদের আয়ত্তে এলো, সেগুলিতেও সামন্তবাদী প্রভাব-প্রতিপত্তি বহুলাংশে বিনষ্ট হলো। অন্যদিকে ধনতন্ত্র এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর বিস্তার এবং আধিপত্যও অনুরূপভাবে বৃদ্ধি লাভ করলো। এ পরিবর্তন আরও ত্বরান্বিত হলো ফ্রান্স এবং ইউরোপের অন্যান্য কতকগুলি দেশের প্রতি ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক নীতির ফলে। ফরাসী সামরিক শক্তিকে খর্ব করার জন্যে তারা ইউরোপে বহু শিল্পজাত দ্রব্যের রপ্তানি বন্ধ করে দিলো। তার ফলে প্রয়োজনের তাগিদে ফ্রান্সকে অতি দ্রুতগতিতে সেই সমস্ত নিষিদ্ধ শিল্পজাত দ্রব্য প্রস্তুত শুরু করতে হলো। কাজেই, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য ব্যবহারিক দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের অভ্যন্তরীণ শিল্পবাজার বহুলাংশে সম্প্রসারিত হতে থাকলো এবং রাস্তাঘাট ও যাতায়াতের প্রভূত উন্নতিও সাধিত হলো।
শিল্পের উন্নতির জন্যে ‘জাতীয় শিল্পোন্নতি সংস্থা’ নামে একটি সংস্থাও নেপোলিয়নের সময়ে স্থাপিত হয়েছিলো এবং নেপোলিয়ন ও তাঁর সামরিক এবং বেসামরিক কর্মচারীরা ছিলেন তার প্রধান প্রধান অংশীদার ও কর্মকর্তা। শিল্পের এই দ্রুত ও প্রভূত উন্নতির ফলেই নেপোলিয়নের পক্ষে ইংল্যান্ডে এবং ইউরোপের অন্যান্য রাজ্যের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা এবং বিস্তৃত এলাকা দখল সহজতর হয়েছিলো।
নেপোলিয়নের উত্থান প্রকৃতপক্ষে ছিলো ফ্রান্সে বৃহৎ বুর্জোয়ার উত্থান। এজন্যে তাঁর রাজত্বকালে শিল্প শ্রমিকদের স্বার্থের বিরুদ্ধে বহু আইন রচিত হয়, এমনকি ছোটখাটো ধর্মঘটের অধিকার থেকেও তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত করা হয়। অন্যদিকে, নেপোলিয়নের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভের পূর্বেই জ্যাকবিন ক্লাব বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে যে রাজনৈতিক নীতির সূচনা হয় নেপোলিয়নের সময়ে সেই নীতিকেই আরও সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করে শিল্প শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তিকে রুদ্ধ ও খর্ব করার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এই ব্যবস্থাগুলির মধ্যে ক্যাথলিক চার্চের সাথে বুর্জোয়া রাজতন্ত্রের নোতুন সম্পর্ক স্থাপনই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। যে বুর্জোয়া শ্ৰেণী সামন্ততান্ত্রিক ভূম্যধিকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময়ে ধর্মকে নানাভাবে আঘাত করেছিলো এবং তার শক্তিকে সর্বপ্রকারে খর্ব করতে ব্যাপৃত ছিলো, সেই বুর্জোয়া শ্রেণী এবং তাদের প্রতিনিধি নেপোলিয়ন ক্যাথলিক চার্চের প্রধান পোপের সাথে সমঝোতা করে নোতুন আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমর্থনে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করলেন। চার্চের যে সমস্ত জমিজমা এবং অন্যান্য সম্পত্তি তখন পর্যন্ত অবিক্রীত ছিলো সেগুলিকে ধর্মযাজকদের হাতে ফেরৎ দেওয়া হলো, এমনকি তাদের বেতন পর্যন্ত রাষ্ট্রের তহবিল থেকে প্রদান করার ব্যবস্থা হলো।
৭
ঊনিশ শতকের গোড়া থেকে ইংল্যান্ডে ভূম্যধিকারী অভিজাতদের সাথে বুর্জোয়াদের কার্যকরী সম্পর্ক অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হতে আরম্ভ করে। পূর্বে সামাজিক দিক থেকে নিজেদেরকে অভিজাতদের অপেক্ষা নিকৃষ্ট মনে করায় নানাভাবে তারা অভিজাতদেরকে মান্য করে চলতো এবং তাদের নেতৃত্বও স্বীকার করতো। অভিজাতদের সমাজে কোন প্রকারে ঠাঁই পাওয়াটাকে সে সময় তারা মহাভাগ্যের ব্যাপার বলেও বিবেচনা করতো। কিন্তু ধনতন্ত্রের ক্রমপ্রসারের ফলে উদ্ভূত নোতুন অবস্থায় সে সম্পর্ক বেশী দিন বজায় রাখা সম্ভব হলো না। এ কথার অর্থ আবার এই নয় যে, ফ্রান্সের মত ইংল্যান্ডেও অভিজাতদের সাথে বুর্জোয়াদের সম্পর্ক একেবারে বিচ্ছিন্ন হলো। এর অর্থ হলো, নিজেদের আর্থিক স্বার্থকে রক্ষা ও প্রসারের জন্যে যে আংশিক রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োজন, সে ক্ষমতা অভিজাতদের হাত থেকে আদায় করা ব্যতীত বুর্জোয়াদের কোন উপায় থাকলো না। কিন্তু ভূম্যধিকারী অভিজাতরা সে রাজনৈতিক ক্ষমতা সহজে বুর্জোয়াদের কাছে হস্তান্তরিত করারও পক্ষপাতী ছিলো না। কাজেই অভিজাত ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে পার্লামেন্টের সংস্কার প্রশ্ন নিয়ে এক রাজনৈতিক সংঘাত ক্রমশঃ ব্যাপক আকার ধারণ করলো। তারপর ১৮৩০ সালের ফারসী বিপ্লবের ধাক্কায় বাধ্য হয়ে ১৮৩২ সালে অভিজাতেরা পার্লামেন্টের সংস্কার সাধন করলে কিছুসংখ্যক বুর্জোয়ার পার্লামেন্টে প্রবেশের পথ পরিষ্কৃত হলো।
কিন্তু ১৮৩২ সালের এই সংস্কার আইনের দ্বারা বুর্জোয়ারা উপকৃত হলেও তাতে প্রকৃত সমস্যার সমাধান হলো না। কারণ, সংস্কার আন্দোলনকালে বুর্জোয়াদের সাথে শিল্পশ্রমিকরাও ব্যাপকভাবে শরীক হয়েছিলো। রাজনৈতিক অধিকারের দাবীতে তারাও অভিজাতদের কাছে দাবী করেছিলো পার্লামেন্টের সংস্কার। কিন্তু নোতুন সংস্কার আইন পাশ হওয়ার পর তাদের অবস্থার কোনরূপ পরিবর্তন হলো না। ১৮৩২ সালে বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক অধিকার লাভের পর আরও বিস্তৃত সংস্কারের জন্য কোন নোতুন আওয়াজ তুললো না এবং তখন থেকেই শিল্পশ্রমিকদের সাথে শুরু হলো তাদের সংগঠিত শত্রুতা। তাদের সাথে এই সংঘাতের সময় বুর্জোয়া এবং ভূম্যধিকারী সামন্ত পরস্পরের সাথে হাত মেলালো এবং শ্রমিকদেরকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে আবার শুরু হলো তাদের সহযোগিতা। এজন্যেই ইংলণ্ডে বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে কখনই আয়ত্ত করতে পারেনি। প্রথমদিকে ভূম্যধিকারীদের সাথে এবং পরবর্তীকালে শিল্পশ্রমিকের সাথে তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয়েছে। একথা শুধু ইংলণ্ডের ক্ষেত্রে নয়, সকল দেশের বুর্জোয়াদের ক্ষেত্রেই সত্য; কিন্তু ইংল্যান্ডে পরিবর্তন খুব আকস্মিকভাবে না আসার দরুন কোন সময়েই বুর্জোয়ারা সামন্ত ভূম্যধিকারীদের মত নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হয়নি।
১৮৩২ সালের সংস্কার আইনে ইংলণ্ডের শিল্পশ্রমিকেরা পার্লামেন্ট কোন আসন না পাওয়ার ফলে তারা বৃহৎ আকারে আন্দোলন শুরু করে। নিজেদের দাবী সম্বলিত একটি চার্টারকে কেন্দ্র করে আন্দোলনটি গঠিত হয়েছিল বলে তার নাম হয় চার্টিষ্ট আন্দোলন এবং যাঁরা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা চার্টিস্ট নামে পরিচিত হন। এই চার্টিস্টদেরকেই এঙ্গেলস আধুনিক যুগের প্রথম শিল্পশ্রমিকদের দল হিসাবে অভিহিত করেন। চার্টিষ্টদের এই সংস্কার আন্দোলন প্রবল শক্তি সংগ্রহ করে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কিন্তু তাদের দাবী শেষ পর্যন্ত স্বীকৃত না হওয়ার কারণ, একদিকে বুর্জোয়াদের ক্ষমতাবৃদ্ধি এবং অন্যদিকে শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে নানাপ্রকার তত্ত্বগত হতবুদ্ধিতা ও সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা। তবে শিল্পশ্রমিকদের এই সংস্কার আন্দোলনের পতন হলেও তার মাধ্যমে সাধারণভাবে তাদের রাজনৈতিক চেতনা অনেকখানি অগ্রসর হয়। অবশ্য, তখন পর্যন্ত শিল্পশ্রমিকদের কোন বৈজ্ঞানিক সংগঠন সম্ভব না হওয়ার ফলে তারা লিবারল পার্টির আওতায় একটি চরমপন্থী দল হিসাবে পার্লামেন্টারী সংস্কারের জন্যে চেষ্টা করতে থাকে।
বৃটিশ বুর্জোয়ারা অনেক পূর্বেই জনসাধারণ ও শিল্পশ্রমিকদেরকে ধর্মপ্রভাবে রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলো; কিন্তু চাৰ্টিষ্ট আন্দোলনের পতন, ১৮৪৮-৪৯ সালের ফরাসী বিপ্লব এবং প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী প্রভৃতি দেশের বিপ্লবের ফলে তারা এই প্রয়োজনীয়তাকে আরও বেশী করে উপলব্ধি করলো। এজন্যেই তারা চার্চ এবং অন্যান্য ধর্ম সংগঠনগুলিকে বহুভাবে অর্থ সাহায্য করে তাদের ধর্মের ব্যবসা নোতুনভাবে ফাঁদার ব্যবস্থা করেছিলো। শুধু তাই নয়, এর জন্যে তারা স্কুল বোর্ডে পাদ্রীদের সংখ্যাধিক্য সৃষ্টি করলো, এমনকি নিজেদের উপর কিছু কিছু বিশেষ কর ধার্য করে পুনর্জাগরণবাদী সংস্থা (revivalist society), ধর্মীয় মুক্তি ফৌজ (Salvation Army) ইত্যাদি সৃষ্টি ও পোষণ করারও ব্যবস্থা করলো। বুর্জোয়ারা ইউরোপে সর্বত্রই এই চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ইংলণ্ডে তাদের সাফল্য এসেছিলো সর্বাধিক।
৮
ইউরোপে আধুনিক দর্শন-বিজ্ঞানের উত্থানের সাথে সাথে যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তার যথেষ্ট গুরুত্ব বাড়ে। শুধু দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে নয়, সাধারণ মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রেও যুক্তির প্রভাব অনেকাংশে বৃদ্ধি লাভ করে। এর ফলে সমাজের বহু অসংগতি, অন্যায় এবং কুসংস্কারের চরিত্র তাদের সামনে উদ্ঘাটিত হয়। সমসাময়িক সমাজ এবং জীবন ব্যবস্থা তাঁদের কাছে মনে হয় সম্পূর্ণ যুক্তিহীন। আধ্যাত্মিক, আধিমানসিক, সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক জীবনের এই বিপর্যস্ত অবস্থা পরিবর্তনের জন্যে তাঁরা যুক্তিনির্ভর এক জীবন ব্যবস্থা গঠনের চিন্তায় ব্যাপৃত হন।
কিন্তু যুক্তিনির্ভরশীলতা সত্ত্বেও তাঁদের প্রচেষ্টাজনিত ব্যবস্থায় যুক্তির পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা হলো না। কারণ, সেখানে দেখা গেল যে অধিকার, আইনের সমতা, স্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা, সবকিছুই সমাজের অল্পসংখ্যক সুবিধাভোগী মানুষ, অর্থাৎ বুর্জোয়াদের জন্যে। এটা ঘটলো এই কারণে যে, বুর্জোয়ারা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে স্বীকার করলো একটি মৌলিক অধিকার হিসাবে। শুধু তাই নয়, নবোত্থিত বুর্জোয়ারা নিজেদের অবস্থার দ্রুত উন্নতির জন্যে ব্যবসা- বাণিজ্যকে পরিণত করলো শঠতায়। চতুর্দিকে অনাচার, বেশ্যাবৃত্তি, চুরি, দাগাবাজী, জুয়াচুরি অভাবিতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে সমগ্র জীবনে নিয়ে এলো বিস্তৃত নৈতিক নৈরাজ্য। এর ফলে দেখা গেলো যে আঠারো শতকের বস্তুবাদী দার্শনিকদের যুক্তির রাজত্ব’ ঊনিশ শতকে এসে পর্যবসিত হলো তারই একটি ব্যঙ্গচিত্রে। সমাজের একদিকে সঞ্চিত হতে থাকলো প্রভূত ধনসম্পদ এবং অন্যদিকে বিস্তৃত ও প্রকটতর হলো দারিদ্র্য এবং হতাশা। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে কয়েকজন দার্শনিক এই হতাশাকে সংগঠিত চিন্তার মাধ্যমে রূপদান করতে এগিয়ে এলেন। তাঁদের মধ্যে সাঁ সিমন, ফ্রাঁসওয়া ফুরিয়র এবং রবার্ট আওয়েনের নামই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
৯
হেনরী সাঁ সিমন (১৭৬০-১৮২৫) ফ্রান্সের একটি অভিজাত এবং ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে স্বাধীন চিন্তার উন্মেষ হয়। মাত্র তেরো বছর বয়সে নিজের কমুনিয়ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অস্বীকার করার ফলে তাঁর ধর্মানুগত পিতা তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়ে তাঁকে জেলবন্দী রাখার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সে ব্যবস্থাতে ভীত না হয়ে তিনি জেলারকে গায়ের জোরে পরাভূত করে সেখান থেকে পলায়ন করতে সমর্থ হন। ঊনিশ বছর বয়সে তিনি ফরাসী সৈন্যবাহিনীর অফিসার হিসাবে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন এবং তারপর ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে ১৭৮৩ সালে দেশে ফেরত আসেন। সৈন্যবাহিনীতে পদমর্যাদা এবং ঐশ্বর্যগত সম্ভাবনা সত্ত্বেও তিনি সে পদে ইস্তফা দিয়ে জনসাধারণের সমস্যা নিয়ে চিন্তা ও তাদের উন্নতি সাধন করার সিদ্ধান্ত নেন।
সাঁ সিমনকে এঙ্গেলস ফরাসী বিপ্লবের সন্তান বলে অভিহিত করেছেন। ফরাসী বিপ্লব প্রথমদিকে ছিলো যাজক ও সামন্ত অভিজাতদের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিক শ্রেণীর সম্মিলিত বিজয়। কিন্তু স্বল্পকাল মধ্যেই সে জয়ের চরিত্র পরিবর্তিত হলো। দেখা গেলো যে, সত্যিকার ক্ষমতা শ্রমিকদের কাছ থেকে হস্তান্তরিত হয়েছে সম্পত্তিশালী মধ্যবিত্ত অর্থাৎ বুর্জোয়াদের হাতে। অভিজাত শ্রেণী ও চার্চের যে সমস্ত জমিজমা বিপ্লবের পর বাজেয়াপ্ত হয়েছিলো, সেগুলো নানাভাবে করায়ত্ত করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে শঠতার আশ্রয় নিয়ে তারা দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করার ফলে নেপোলিয়নের পক্ষে সার্বভৌম ক্ষমতা দখল সহজ হলো। এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে নেপোলিয়ন বৃহৎ বুর্জোয়া স্বার্থকেই দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করতে নিযুক্ত হলেন।
সাঁ সিমন শ্রেণী-সংগ্রামে বিশ্বাস করতেন না। কাজেই তিনি ফ্রান্সের যাজক, অভিজাত এবং অন্যান্যদের মধ্যে সংঘর্ষকে মূলতঃ ‘শ্রমবিমুখ এবং ‘পরিশ্রমকারী’ মানুষের সংঘর্ষরূপে দেখলেন। শ্রমবিমুখ বলতে তিনি তাদেরই বোঝাতে চাইলেন, যারা কোন প্রকার পরিশ্রম না করে অন্যের শ্রমের ফল ভোগ করে। ধর্মাযাজক এবং অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলতেন, তারা যদি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলেও সমাজের কোন ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। অন্যদিকে পরিশ্রমকারী বলতে তিনি বোঝালেন, শিল্পশ্রমিক, ব্যবসাদার, শিল্পপতি, ব্যাংকার ইত্যাদিকে। শ্রেণী-সংগ্রামের ভিত্তিতে অগ্রসর না হওয়ার জন্যে তিনি সমগ্র ‘থার্ড এস্টেট’ অর্থাৎ বুর্জোয়া ও শ্রমিকদেরকে পরিশ্রমকারী বলে অভিহিত করেই অনেকখানি নিশ্চিত হলেন, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করলেন না। এবং এই কারণেই তাঁর পরবর্তী বিশ্লেষণ হয়ে দাঁড়ালো অনেকাংশে অবৈজ্ঞানিক।
‘শ্রমবিমুখ’ যাজক অভিজাতেরা যে নেতৃত্বের অধিকার এবং যোগ্যতা দুইই হারিয়েছিল, সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহ ছিলো না, কিন্তু নোতুন আর্থিক ব্যবস্থা ও সামাজিক পরিস্থিতিতে শিল্পপতি, ব্যাংকার ইত্যাদি বুর্জোয়া শ্ৰেণীভুক্ত মানুষদের ভূমিকা যথার্থবাবে অনুধাবন না করার ফলে তিনি মনে করতেন যে, তাদের হাতেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্পণ করা উচিত ‘সম্পত্তিহীন শ্রমিকরা এ দায়িত্বভার বহন করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না, কারণ, ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম থাকাকালীন যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো সেটাকে তিনি ভ্রান্তভাবে তাদেরই ক্ষমতা দখলের ফল বলে বিবেচনা করেছিলেন। কাজেই, সমাজকে নোতুনভাবে গঠন করার দায়িত্বভার দিতে হবে বিজ্ঞান ও শিল্পক্ষেত্রে যারা অগ্রণী, তাদেরই হাতে। এ বিষয়ে তাদেরই যোগ্যতা সর্বাধিক। এই বুর্জোয়ারা অন্যান্যদের তুলনায় আপেক্ষিকভাবে ক্ষমতাশালী ও আর্থিক দিক থেকে কিছুটা অতিরিক্ত সুবিধাভোগের দাবীদার হলেও আসলে তারা এক ধরনের সরকারী কর্মচারী অথবা সামাজিক জিম্মাদার। কাজেই জনসাধারণ এবং সাধারণ শ্রমিকদেরকে মুনাফার জন্যে শোষণ করার কোন অধিকার তাদের নেই। শুধু যোগ্যতার কথা বিবেচনা করেই দেশের শাসন ও আর্থিক জীবন নিয়ন্ত্রণের ভার তাদের উপর অর্পণ করা দরকার, অন্য কারণে নয়।
সাঁ সিমন শ্রেণী-সংগ্রামে বিশ্বাস না করলেও একথা স্বীকার করেন যে, অর্থনীতিই হচ্ছে রাজনীতির প্রকৃত ভিত্তি। শুধু তাই নয়, তিনি একথাও মনে করতেন যে, ভবিষ্যতে মানুষের উপর রাজনৈতিক শাসনের সম্পূর্ণ অবসান ঘটবে এবং উৎপাদনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনের দ্বারাই সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন হবে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটবে।
প্রচলিত খৃষ্টধর্মে সাঁ সিমন বিশ্বাস করতেন না। তবু এক ধরনের মানবতাবাদী ধর্ম তিনি প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেছিলেন, যার মধ্যে ‘মিষ্টিক’ প্রভাব বেশ প্রবল ছিল। এই ধর্ম সম্পর্কিত আলোচনাতেই তাঁর চিন্তার অবৈজ্ঞানিক চরিত্র সব থেকে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এই আলোচনাক্ষেত্রে তিনি যুক্তির উপর নির্ভরশীল না হলে কল্পনাকেই বিশেষভাবে আশ্রয় করেছিলেন।
নিজের দারুণ দারিদ্র্য সত্ত্বেও সাঁ সিমন দরিদ্র জনসাধারণকে তাদের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধারের নানা পরিকল্পনা নিয়ে দিবারাত্র পরিশ্রম করে যেতেন। লেখা ছাপার অর্থ না থাকার জন্যে সমস্ত কিছু স্বহস্তে কপি করে তিনি বহু লোকের কাছে পাঠাতেন। এ ব্যাপারে ইউরোপের বুর্জোয়া বণিক শ্রেণীর কাছ থেকে সাঁ সিমন উৎসাহ এবং সাহায্য আশা করেছিলেন, কিন্তু তারা তাঁকে সর্বতোভাবে নিরাশ করেছিলো। কোন সাহায্য করা তো দূরের কথা, তাঁর লেখা পড়ার মতো ধৈর্য এবং উৎসাহ পর্যন্ত তাদের ছিলো না।
১০
ফ্রাঁসোয়া ফুরিয়র (১৭৭২-১৮৩৭) জীবনের অধিকাংশ সময় সওদাগরী অফিসে কেরানী হিসাবে কাজ করেন। কাজেই পেশাগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে কিছুটা সংশ্লিষ্ট থাকার ফলে তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজের অবস্থাকে খুবই দক্ষতার সাথে তিনি বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ধনতন্ত্রের সম্প্রসারণের ফলে উদ্ভূত সাধারণ দারিদ্র্য এবং নৈতিক নৈরাজ্যের সাথে তিনি পূর্ববর্তী দার্শনিকদের স্বপ্নময় জগতের তুলনা করে দেখতে চেষ্টা করেন যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ ধরনের উচ্চ দার্শনিকতার সাথে বাস্তব অবস্থার কোন সামঞ্জস্য নেই। ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তী যুগে বুর্জোয়া ব্যবসাদারদের অসাধু ও শঠতামূলক আচরণকেই তিনি বিশেষভাবে আক্রমণ করেন। ধনতন্ত্রের পরিকল্পনাহীন উৎপন্নসামগ্রী বিতরণের ক্ষেত্রে যে অসাম্য এবং অন্যায় নিহিত আছে, তিনি ছিলেন তারও একজন কঠোর সমালোচক। শ্রেণী-সংগ্রামে ফুরিয়রও বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি একথা স্বীকার করতেন যে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী হতে বাধ্য।
বুর্জোয়া সমাজে স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কেরও তিনি কাঠোর সমালোচনা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম বলেন যে, কোন বিশেষ সমাজে সাধারণ মানুষ কতখানি মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত সেটা যাচাই করার জন্যে সেই সমাজে স্ত্রীজাতি কতখানি মর্যাদাসম্পন্ন সেটা দেখা দরকার।
পৃথিবীর ইতিহাসকে ফুরিয়র দাস যুগ, বর্বর যুগ, পিতৃপ্রধান যুগ ও সভ্য যুগ, এই চার পর্যায়ে বিভক্ত করেন। সভ্যযুগ আসলে হলো বুর্জোয়া যুগ। সভ্যতা, তাঁর মতে একটি বিষাক্ত বৃত্ত, যার মধ্যে নানা প্রকার স্ববিরোধিতার দেখা মেলে। ধনসম্পদের প্রাচুর্যের মধ্যে নিদারুণ দারিদ্র্য, এই স্ববিরোধিতারই অন্যতম উদাহরণ।
কিন্তু এই সমস্ত সমালোচনা সত্ত্বেও নোতুন আর্থিক ও সামাজিক অবস্থায় দারিদ্র্য সৃষ্টি হয় কীভাবে এবং কাদের সহযোগিতায় তার অবসান ঘটতে পারে, এ সম্পর্কে কোন সুষ্ঠু ধারণায় ফুরিয়র উপনীত হতে পারেননি। এজন্যে তিনি মনে করতেন যে সমাজে ধনী-দরিদ্র সকলে মিলেমিশে থাকতে পারবে। উৎপাদন ক্ষেত্রেও পরস্পরের সহযোগিতার মাধ্যমে দারিদ্র্য এবং নৈতিক নৈরাজ্যের অবসান ঘটানো সম্ভব। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তিনি নিজের একটি পরিকল্পনাও প্রস্তুত করেন এবং তাকে কার্যকরী করার জন্যে সাঁ সিমনের মতই ইউরোপের বহু ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তির কাছে আবেদন জানান। একথা বলাই বাহুল্য যে, তাঁর আবেদনে তাদের মধ্যে কেউই সাড়া দেয়নি।
তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা কতকগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ সংস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে এবং তাদের প্রত্যেকটিতে ষোল শত ব্যক্তি নিযুক্ত থাকবে। তারা এক্ষেত্রে এক একটি বিরাট হোষ্টেল জাতীয় বাড়িতে বসবাস করবে এবং মিলিতভাবে যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন করবে। এই সংস্থার মধ্যে সকলেই পরস্পরের সমান বলে বিবেচিত হবে, কাজেই তার মধ্যে কোন অহেতুক প্রতিযোগিতা অথবা নির্দয় শাসন- শোষণের অস্তিত্ব থাকবে না। এর ফলে সমাজে প্রভূত ধনসম্পদ উৎপন্ন হবে এবং প্রত্যেকটি মানুষ শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত হয়ে মানুষের যোগ্য নোতুন জীবনযাপন করতে সমর্থ হবে।
১১
রবার্ট আওয়েন (১৭৭১-১৮৫৮) মাত্র নয় বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য এক বস্ত্রব্যবসায়ীর কাছে শিক্ষানবিসী শুরু করেন। পরে ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে তিনি ম্যাঞ্চেষ্টারে গিয়ে তাঁতের কাপড় তৈরীর কাজে নিযুক্ত হন এবং শীঘ্রই ব্যবসাক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। এর কিছুকাল পরে তাঁর কোম্পানী নিউ লানাকে অবস্থিত স্কটল্যান্ডের সর্বাপেক্ষা বড় কাপড়ের কারখানাটি ক্রয় করে এবং তিনি ১৮০০ খৃষ্টাব্দে সেই কলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে অধিষ্ঠিত হন।
অন্যান্য কারখানার মতো নিউ লানাকেও শ্রমিকেরা অল্প বেতন পেতো, কারখানার জীবনকে ঘৃণা করতো এবং মদ্যপান করে নিজেদের অর্থ, স্বাস্থ্য এবং শান্তি নষ্ট করতো। ছেলেমেয়েদেরকেও কারখানায় কাজ করতে হতো এবং উপযুক্ত খাদ্য, শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদির অভাবে এবং কারখানার অতিরিক্ত পরিশ্রমে সকলেই ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়তো। নিউ লানার্কের পরিচালনাভার গ্রহণ করার পর থেকে আওয়েন সেখানকার শ্রমিক ও অন্যান্য উচ্চ কর্মচারীদের সমবায়ে গঠিত সমগ্র শিল্পসমাজটির সংস্কার ও উন্নয়নকার্যে ব্যাপৃত হন। আওয়েন মনে করতেন যে মানুষের ব্যক্তিচরিত্র তার নিজের সৃষ্টি নয়। উত্তরাধিকার ও পরিবেশ, এ দুইয়ের দ্বারাই তা সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রিত। কাজেই চরিত্রের ভালোমন্দের জন্যে কোন মানুষকেই ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা চলে না। চরিত্র গঠনের চেষ্টা করতে হলে প্রয়োজন মানুষের পরিবেশকে উপযুক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। সামাজিক জীবনযাপনকালে সে যে সমস্ত প্রভাবের আওতায় থাকে, সেগুলিকে বাদ দিয়ে চরিত্র গঠন অথবা সংস্কার, কোনটিই সম্ভব নয়। এবং পরিবেশের পরিবর্তনের জন্যে প্রয়োজন যথোপযুক্ত শিক্ষা। এই শিক্ষা শুরু হওয়া উচিত দু’বছর বয়স থেকে।
আওয়েন মনে করতেন, মানুষের সব শয়তানী এবং দুঃখদুর্দশার কারণ পূর্বপুরুষদের অজ্ঞতা। রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় বিরোধের অবসান ঘটবে তখনই, যখন মানুষ বুঝতে পারবে যে তাদের মতামতগুলো সবই পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের প্রভাবে গঠিত, তারা নিজেরা তার জন্যে দায়ী নয়। একমাত্র তখনই তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি বাদ দিয়ে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। মানুষ নিজে যে তার চরিত্র গঠন করতে পারে না, একথা চূড়ান্তভাবে স্বীকৃত হওয়া প্রয়োজন। এ স্বীকৃতি ছাড়া তার মুক্তি নেই।
আওয়েন বিপ্লবের পথে আর্থিক ও সামাজিক উন্নতির কথা চিন্তা করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিলো, শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে সামন্ততান্ত্রিক পথেই মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধন করা যেতে পারে। উপযুক্ত কারিগরি শিক্ষাপ্রাপ্ত হলে মানুষের পক্ষে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন বৃদ্ধি করাও সম্ভব। ফুরিয়রের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করলে ধন উৎপাদন প্রভূতভাবে বর্ধিত হতে পারে।
আওয়েন এমন এক ধরনের ‘সমবায় পল্লী’ গঠন করতে চেয়েছিলেন, যাতে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপন্ন করে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হবে। তাঁর এই ‘সমবায় পল্লী’র সাথে অনেকক্ষেত্রে ফুরিয়রের ‘ফ্যালান্সটারী’র কিছু সাদৃশ্য আছে।
প্রত্যেক সমবায় পল্লীতে আটশো থেকে বারোশো লোক থাকবে এবং তারা প্রত্যেক ছয় থেকে আঠারো একর জমি আবাদ করবে। কৃষিই তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন হবে, তবে কিছু কিছু শিল্পজাত দ্রব্যও তারা উৎপাদন করতে পারবে। পল্লীর লোকেরা সকলে একত্রে বসবাস করবে। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, সব কিছুরই ব্যবস্থা সেখানে থাকবে এবং তারা একই পরিবারভুক্ত বলে পরিগণিত হবে। এই পল্লীসমাজে বসবাসকালে মানুষের মনে একটা নোতুন মানবিক মনোবৃত্তি সৃষ্টি হবে।
শিল্পবিপ্লবের সময় যাঁরা কারখানার মালিক অথবা তার পরিচালক ছিলেন, তাঁরা সকলেই শ্রমিকদেরকে যথাসম্ভব শোষণ করে নিজেদের অবস্থার উন্নতি সাধনে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু আওয়েন নিউ লানার্কের পরিচালনভার গ্রহণ করার পর তাঁর শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার সংক্রান্ত ধারণাগুলোকে বাস্তব রূপ দানের প্রচেষ্টা শুরু করেন। তিনি সেখানে যে শিশু বিদ্যালয় স্থাপন করেন, সেটাই ছিলো পৃথিবীর সর্বপ্রথম শিশু বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে দুবছর বয়সে শিশুরা ভর্তি হত এবং সেখানে তাদের আদর-যত্ন এবং খেলাধুলার এত সুন্দর ব্যবস্থা থাকতো যে, তারা বাড়ি ফিরে যেতে তেমন উৎসাহ বোধ করত না। সেকালে সব কারখানাতেই শ্রমিকদেরকে তেরো-চোদ্দ ঘণ্টা খাটানোর নিয়ম ছিল, কিন্তু নিউ লানার্কে আওয়েন কর্মকালকে কমিয়ে সাড়ে দশ ঘণ্টায় নামিয়ে এনেছিলেন। শুধু তাই নয়, একবার তুলো সরবরাহের অসুবিধার জন্যে কারখানা চার মাসের জন্যে বন্ধ থাকাকালে তিনি শ্রমিকদের বেতন না কেটে অথবা তাদেরকে ছাঁটাই না করে তাদের প্রত্যেককে পুরো বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তাঁর তত্ত্বাবধানে কারখানার কাজকর্ম এতো শৃঙ্খলা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিচালিত হতো যে, শ্রমিকদেরকে এত সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও ব্যবসাতে তাদের মুনাফার ঘাটতি হতো না। এই সমস্ত কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করে আওয়েন নিউ লানার্কের প্রায় আড়াই হাজার শিল্পশ্রমিকেরা জীবন থেকে মাতলামি, ঝগড়া-বিবাদ, দান- খয়রাত জেল-হাজত, অশিক্ষা ইত্যাদি দূর করে তাদেরকে মানবিক জীবনযাপনের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করেন। তাঁর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো এই যে, মানুষ উপযুক্ত পরিবেশের আওতায় থাকলে তার পক্ষে মানুষের যোগ্য জীবনযাপন সম্ভব। নিউ লানার্কের সমাজকে নিজের ধারণামত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি এর সত্যতাকে অনেকখানি প্ৰমাণ করেন।
কিন্তু এই সাফল্য অর্জনের পর আওয়েনের অন্তরে অন্য একটি মৌলিক প্রশ্নের উদ্ভব হয়। তিনি উপলদ্ধি করেন যে, এক হিসাবে তাঁর পরীক্ষা সফল হলেও একথা অনস্বীকার্য যে, নিউ লানার্কে শ্রমিকেরা যে সুবিধাসমূহ ভোগ করছে তার কোন বাস্তব ভিত্তি নাই। সেখানকার আর্থিক ও সামাজিক জীবন সর্বাংশে তাঁরই ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। কাজেই আগামীকাল তিনি যদি নিজের মত পরিবর্তন করে তাদেরকে অন্যান্য শিল্পপতিদের চেয়ে অতিরিক্ত সুবিধা দান করতে অস্বীকার করেন, তাহলে তাদের জীবন-ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে যাবে এবং অন্যান্য কারখানার মতো সেখানেও আবার অশিক্ষা, কুসংস্কার, দারিদ্র্য এবং অপরাধের রাজত্ব কায়েম হবে। এ উপলব্ধির অর্থ হলো এই যে, ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর কোন ব্যবস্থা যতদিন নির্ভরশীল, ততদিন পর্যন্ত সে ব্যবস্থা অবাস্তব ও বিপজ্জনক হতে বাধ্য। কাজেই তাকে অন্য কোন ভিত্তির উপর স্থাপন করা দরকার।
আওয়েনের এ জাতীয় চিন্তার সূত্র কিন্তু এখানেই ছিন্ন হলো না। তিনি উৎপাদন বিতরণের ক্ষেত্রেও একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। নিউ লানার্কে নিযুক্ত আড়াই হাজার শ্রমিক যে পরিমাণ ধন উৎপাদন করতো, সে পরিমাণ ধন উৎপন্ন করতে পঞ্চাশ বছর পূর্বে ষাট হাজার শ্রমিককে নিযুক্ত করতে হতো। শিল্পবিপ্লবের ফলে নোতুন যন্ত্রপাতির সাহায্যে শ্রমিকদের উৎপাদন শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। কিন্তু একটি জিনিস বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এই উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও শ্রমিকদের অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। আওয়েন যে প্রশ্ন তুললেন, তার অর্থ এই যে, পূর্বে ষাট হাজার শ্রমিক যা উৎপন্ন করতো, তাতে মালিককে যথেষ্ট মুনাফা দান করেও ষাট হাজার মানুষের ভরণ-পোষণ চলতো। এখন আড়াই হাজার লোক সেই একই পরিমাণ ধন উৎপাদন করছে এবং আড়াই হাজারের ভরণ- পোষণের জন্যে তার থেকে ব্যয় করা হচ্ছে। নোতুন উৎপাদন ব্যবস্থায় যদি শ্রমিকদের আর্থিক জীবনের প্রভূত উন্নতি না হয়ে তারা দরিদ্র অবস্থাতেই জীবিকা নির্বাহ করে, তাহলে ষাট থেকে আড়াই বাদে সাড়ে সাতান্নো হাজার মানুষের ভরণ-পোষণের জন্যে পূর্বে যে সম্পদ ব্যয় হতো, সেগুলো গেল কোথায়? শ্রমিকদের কাছে যদি এই অতিরিক্ত উৎপাদনের ভাগ না আসে, তাহলে সেটা যায় কার ঘরে?
এ প্রশ্নের উত্তরও তাঁর কাছে অজ্ঞাত ছিলো না। সাড়ে সাতান্নো হাজার শ্রমিকের জন্যে পূর্বে যা ব্যয় করা হতো, শিল্পবিপ্লবের পরে সেটা অতিরিক্ত মুনাফা হিসাবে শিল্পমালিকদের আয়ের অঙ্ককেই স্ফীত করতো।
এঙ্গেলস উল্লেখ করেছেন যে, যতদিন আওয়েনের চিন্তা মোটামুটিভাবে সংস্কামূলক ছিলো ততদিন বুর্জোয়া সমাজে, এমনকি ইউরোপের সমস্ত অভিজাত সমাজে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানীয় এবং প্রশংসিত ব্যক্তি। কিন্তু যে মুহূর্ত থেকে তাঁর চিন্তা কিছুটা কম্যুনিজমের দিকে অগ্রসর হতে থাকলো, সে মুহূর্ত থেকে তাঁর কদর ইউরোপীয় বুর্জোয়া এবং অভিজাত সমাজে কমতে কমতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হলো। যে খবরের কাগজগুলি পূর্বে আওয়েনের প্রশংসায় মুখর থাকতো, তারা তাঁর খবর ছাপা বন্ধ করলো এবং উচ্চ সমাজ থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে বহিস্কৃত হলেন। আমেরিকার নিউ হারমানীতে তিনি যে সাম্যবাদী পরীক্ষা শুরু করেছিলেন সেটাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় তাঁর প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হলো। এর পর থেকে আওয়েন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শ্রমিকদের উন্নতির জন্যে অবিশ্রান্তভাবে পরিশ্রম করেছিলেন। ইউরোপের এবং বিশেষ করে ইংলন্ডের প্রত্যেকটি প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে তাঁর নাম বিশেষভাবে জড়িত ছিলো। ইংল্যান্ডের ট্রেড ইউনিয়নসমূহের প্রথম কংগ্রেসের তিনি সভাপতি ছিলেন। সমবায় আন্দোলনেরও তিনি ছিলেন নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা। ফুরিয়রের মতো তিনিও ধনতান্ত্রিক বাণিজ্যিক লোনদেনের একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন এবং এ জাতীয় বাণিজ্যের বিলোপ সাধনের জন্যেই তিনি মূলতঃ উৎপাদন ও বিতরণের ক্ষেত্রে সমবায় আন্দোলনের উদ্বোধন করেন।
১২
ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপের বিভিন্ন স্থান ছোট বড় অনেক শ্রমিক বিপ্লব ঘটেছিলো। ১৮৩১ সালে ফ্রান্সের লিয়ন্স শহরে বিদ্রোহী শ্রমিকেরা দশ দিন যাবৎ শিল্পনগটির কর্তৃত্বে ছিলো। কিন্তু কর্তৃত্ব নিয়ে কি করতে হবে, অর্থাৎ কর্তৃত্ব লাভের পরবর্তী পর্যায়ে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কি হতে পারে, এ সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণার অভাবে কোন সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ তাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। কাজেই শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজয় ঘটলো। ১৮৩০-৩২ সালে ইংল্যান্ডের সংস্কার আন্দোলনের পরিণতিও তাই হলো। ১৮৩২ সালের সংস্কার প্রকৃতপক্ষে ইংল্যান্ডে সমস্ত অভিজাতদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শ্রমিকের মিলিত আন্দোলনের অবসান ঘটালো। সংস্কারের দ্বারা শ্রমিকদের কোন লাভ না হলেও তাদের শিক্ষা সেই ব্যর্থতার দ্বারা অনেকখানি অগ্রসর হলো। বুর্জোয়াদের সাথে তাদের স্বার্থের যে কোন যোগ নেই, এ উপলব্ধি তাদের মধ্যে এলো। এজন্যেই ১৮৩২ সালের পর থেকে নতুন সংস্কারের জন্যে চার্টিস্ট আন্দোলন পূর্বের থেকে আরও বেশী বৈপ্লবিক পরিণতি ও সাংগঠনিক উৎকর্ষ লাভ করলো। কিন্তু তত্ত্বগত দুর্বলতা এবং নিম্নবুর্জোয়া প্রভাবের ফলে সে আন্দোলনও ১৮৪৮ সালে ব্যর্থ হলো। তারপর ইউরোপের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিল্পশ্রমিক বিদ্রোহ ঘটেছিলো, কিন্তু তার মধ্যে কোনটিরই সাফল্য আসে নি। এ সবগুলির ব্যর্থতার কারণ মোটামুটিভাবে একই।
একমাত্র আওয়েন ব্যতীত পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রেীদের কারও সাথে শ্রমিকদের তেমন কোন প্রত্যক্ষ যোগ ছিলো না। কিন্তু আওয়েনের প্রচেষ্টাও ছিল ব্যক্তিগত। তাঁর সাথে কোন বিপ্লব বা বিপ্লবী জনসাধারণের সম্পর্ক ছিল না। কাজেই সকলেই সর্বশ্রেণীর সহ-অবস্থান ও আপোষের মধ্যে দিয়ে একটি কিছু হবে, এই আশাই পোষণ করতেন।
লেনিন বলেছিলেন যে, বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া কোন সত্যিকার বিপ্লবী কর্মপন্থা থাকতে পারে না। এই বিপ্লবী তত্ত্বের অভাবেই সেকালে বিপ্লবী কর্মপন্থার অভাব ঘটেছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তনের নিয়ম আবিষ্কারের চেষ্টাও হয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে চেষ্টা ছিল অনেকাংশে অবাস্তব ও কাল্পনিক।
পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে বাস্তবতার অভাবের কারণ তৎকালীন ঐতিহাসিক অবস্থা। শিল্পবিপ্লবের পর ইউরোপে ধনতন্ত্রের ক্রমাগত বিকাশ হতে থাকলেও তার পূর্ণ চরিত্র তখনো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এ পর্যায়ে সমাজতন্ত্রীদের প্রতিভা, সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা থাকলেও বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের দিকনির্ণয় অথবা দার্শনিক ভিত্তি রচনা, কোনটাই তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। এ সব সত্ত্বেও শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ও বিতরণ-পদ্ধতির মধ্যে যে অযুক্তি এবং অবিচার নিহিত আছে, তাঁরা তার উপরই গুরুত্ব আরোপ করেন। এ অযুক্তি এবং অবিচার দূর করার অন্য পথ তাঁরা নির্দেশ করতে অক্ষম হলেও তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষের অন্তরে একটা চেতনা সঞ্চার করতে তাঁরা সক্ষম হন। অবৈজ্ঞানিক হলেও এখানেই তাঁদের চিন্তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত শ্রমিক আন্দোলনগুলি অনেকাংশে ব্যর্থ হলেও তার দ্বারা শ্রেণী-সংঘাতের বাস্তবতা সম্পর্কে একটা মূল্যবান শিক্ষা তারা লাভ করেছিলো। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থ যে পৃথক এবং এই পৃথক স্বার্থগুলি যে শ্রমিক ও বুর্জোয়াদের ক্ষেত্রে পরস্পর-বিরোধী, এ উপলব্ধি তাদের মধ্যে এসেছিলো। এর ফলে পূর্ববর্তীদের কল্পনা- প্রবণতা স্বভাবতঃই উত্তরসুরীদের মধ্যে অনেকখানি কমে এসে তাঁদের চিন্তাকে বাস্তবমুখী করেছিলো।
১৩
জার্মান দার্শনিক হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) দ্বন্দ্ববাদ (dialectics) তত্ত্বগত ক্ষেত্রে একটা বিপ্লবের সূচনা করে। দ্বন্দ্ববাদ ইউরোপীয় চিন্তার ইতিহাসে সম্পূর্ণ নোতুন নয়। গ্রীক দার্শনিকেরা প্রায় সকলেই পদ্ধতি হিসাবে দ্বন্দ্ববাদকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মধ্যযুগে এবং আধুনিক যুগের প্রারম্ভে দেকার্ত, স্পিনোজা প্রমুখ দু’চারজন ব্যতিরেকে অন্য সব দার্শনিকের চিন্তা ভিন্ন পথ অনুসরণ করে। হেগেল শুধু যে দ্বন্দ্ববাদের অবতারণা করেছিলেন তা নয়। তাঁর দর্শনে এর উপর গুরুত্ব পড়েছিলো অপরিসীম। আধুনিক যুগের অধিবিদ্যাগত চিন্তার মধ্যে বাস্তবমুখীনতার যথেষ্ট অভাব ছিলো। প্রকৃতির গতিশীলতা, ঘটনাসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি আবিষ্কার এবং তার সম্পর্ক আলোচনার বিশেষ কোন প্রচেষ্টা তার মধ্যে ছিলো না। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ডারউইন প্রাকৃতিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে যে বিপ্লব সাধন করেছিলেন, হেগেলের চিন্তা দার্শনিক ক্ষেত্রে অনেকাংশে সেই বিপ্লবের সূচনা করে। ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও এখানেই হেগেলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। তাঁর দর্শনে প্রাকৃতিক, আধিমানসিক, দার্শনিক সমস্ত কিছুকেই এমন একটা চলমান প্রবাহ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে, যার মধ্যে স্থিতিশীলতার কোন স্থান নেই।
হেগেল সমগ্র প্রাকৃতিক জগৎ এবং ইতিহাসকে মনে করতেন দ্বান্দ্বিক গতিসম্পন্ন ও বিবর্তনশীল। এই বিবর্তনশীল জগৎ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হলে দ্বন্দ্ববাদ ব্যতীত উপায় নেই। ভাববাদী সংস্কার বশে নিজের উত্থাপিত অনেক প্রশ্ন ও সমস্যার যথার্থ জবাব দান তাঁর পক্ষে সম্ভব না হলেও দ্বান্দ্বিক গতিসম্পন্ন জগৎ ও ইতিহাসকে জানার জন্যে দ্বন্দ্ববাদের প্রয়োজন এবং উপযোগিতা ব্যাখ্যার দ্বারা তিনি আধুনিক দর্শনের ক্ষেত্রে এক নোতুন চেতনার সঞ্চার করেন। এদিক দিয়ে তাঁর কৃতিত্ব এবং অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও হেগেলের ভাববাদিতার ফলে দ্বন্দ্ববাদকে তিনি তার যথার্থ পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ইতিহাস ও প্রকৃতিকে যথার্থভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হননি ভাববাদী দার্শনিক হিসাবে তিনি মনে করতেন ইতিহাসে গতিশীলতা ব্যাখ্যার জন্যে প্রয়োজন এক পরম সত্তার। সেই সত্তাকে বাদ দিয়ে ইতিহাসের কোন ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়। এ কথার দ্বারা তিনি অনিত্য ও পরিবর্তনশীল জগতের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে চেয়েছিলেন এমন এক সত্তার সাথে, যা গতিহীন এবং নিত্য। তাঁর দর্শনের এই স্ববিরোধিতার চরিত্র এবং দুর্বলতা ঊনিশ শতকীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের ধাক্কায় স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এর ফলে ইউরোপীয় দার্শনিক চিন্তাধারা আবার অনেকখানি বস্তুবাদের দিকে ফিরে আসে। তবে সে বস্তুবাদের সাথে আঠারো শতকের যান্ত্রিক বস্তুবাদের একটা মৌলিক প্রভেদ ছিল। পূর্ববর্তী বস্তুবাদে সমগ্র ইতিহাসকে হিংসাদ্বেষ পরিপূর্ণ একটা অযৌক্তিক ব্যাপার মনে করা হতো। কিন্তু ঊনিশ শতকীয় নোতুন বস্তুবাদে ইতিহাসকে একটা বিবর্তন হিসাবে দেখে সেই বিবর্তনের নিয়মকানুন আবিষ্কারের চেষ্টা দেখা গেলো। এই প্রচেষ্টাক্ষেত্রে ডারউইনের প্রভাবও অনস্বীকার্য। এই বিবর্তনবাদে বস্তুবাদ শুধু যে ইতিহাসের ব্যাখ্যাতেই নিযুক্ত হলো, তা নয়। প্রাকৃতিক ইতিহাস, প্রাণীজগতের ইতিহাস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও ঐ একই চিন্তাধারা প্রভাবশীল হলো এবং পরিশেষে বিজ্ঞানের সাথে বস্তুবাদী দর্শনের স্থাপিত হলো একটা নিকট সম্পর্ক।
ইউরোপীয় সমাজ, দর্শন ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নোতুন আন্দোলনসমূহের উদ্ভবের ফলে প্রয়োজন হলো সমগ্র মানব ইতিহাসকে নোতুনভাবে বোঝার এবং ব্যাখ্যা করার। শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর বুর্জোয়া-শ্রমিক সংঘর্ষের ফলে এ সংঘাতের শ্রেণীচরিত্র বিশেষভাবে উদ্ঘাটিত হলো। হেগেল ঐতিহাসিক গতিকে দ্বন্দ্ববাদের দ্বারা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাকে অনেক অধিবিদ্যাগত সংস্কার থেকে মুক্ত করলেও ভাববাদী প্রভাব তার মধ্যে পুরোপুরি বর্তমান ছিল। এবার মানবিক বিবর্তন ও ইতিহাসের ক্ষেত্র থেকেও অধিবিদ্যা নির্বাসিত হলো এবং ভাববাদী বিবর্তনবাদের স্থান দখল করলো ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ববাদ।
পূর্ববর্তী সমাজগ্রবাদীরা ধনতান্ত্রিক শোষণের কঠোর সমালোচনা করলেও শোষণের কারণ ব্যাখ্যা করতে তাঁরা সক্ষম হননি। এজন্যে শোষণ বন্ধ করার প্রকৃত পথনির্দেশের ক্ষমতাও তাঁদের আয়ত্তের বাইরে ছিলো। ধনতন্ত্রবাদী শোষণের অপরিহার্যতা সম্পর্কেও তাঁদের কোন ধারণা ছিলো না। ধনতান্ত্রিক শোষণকে তাই তাঁরা তার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে পারেননি। এ ছাড়া, ধনতান্ত্রিক শোষণের সত্যিকার চরিত্র সম্পর্কেও তাঁদের কোন ধারণা ছিলো না। একমাত্র ‘উদ্বৃত্ত মূল্যে’র আবিষ্কারের পরই এ সম্পর্কে একটা সুষ্ঠু ধারণা সম্ভবপর হয়। এর ফলে দেখা যায় যে, প্রকৃত শোষণের বস্তু হচ্ছে প্রত্যেক শ্রমিকের অতিরিক্ত শ্রমশক্তি। একটি শ্রমিক একদিনে যত ঘণ্টা কাজ করে, তার পূর্ণ প্রতিদান সে পায় না। অর্থাৎ সে যে পরিমাণ সম্পদ উৎপাদন করে এবং যে পরিমাণ পারিশ্রমিক তাকে দেওয়া হয়, তার মধ্যে অনেক ব্যবধান। এবং এই উদ্বৃত্ত শ্রমমূল্যই শোষণের সত্যিকার সামগ্রী। প্রচলিত হার অনুসারে অথবা তা থেকে কিছু উচ্চ হারে শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক দিলেও একথা সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মানুষ আসলে অন্য মানুষের শ্রমশক্তিকেই শোষণ করে। এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, বস্তুবাদ এবং এই উদ্বৃত্ত শ্রমমূল্যের তত্ত্ব কার্ল মার্ক্সের নিজের আবিষ্কার এবং এই দুই ঐতিহাসিক যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলেই সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ব্যক্তিগত ভাবপ্রবণতা এবং কল্পনার হাত থেকে মুক্ত হয়ে একটা সুদৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর স্থাপিত হয়।