সমস্যার শেষ নেই

সমস্যার শেষ নেই

মানুষের জীবনে সমস্যার শেষ নেই। কিছু আমরা সমাধান করতে পারি। আর কিছু আমাদের সঙ্গের সাথী হয়ে একেবারে চিতায় গিয়ে শেষ সমাধান খুঁজে পায়। সমস্যার সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে আমরা সংসার করি। কিন্তু অপরেশ বাবুর ব্যাপারটাই আলাদা। সমস্যার শরশয্যায় পিতামহ ভীষ্মের মতো অপরেশ বাবু শায়িত। তাঁর কোনও সমস্যারই ভৌতিক সমাধান সম্ভব নয়। অপরেশবাবু সমস্যার সজারু। অপরেশবাবুর উদয় হলে হয় স্নান না হয় দাড়ি কামানো, যে কোনও একটা বাদ দিতেই হয়। দাড়িতে সবে সাবান মেখেছি, মহাচিন্তিত মুখে অপরেশবাবু হাজির। হাতে এক টুকরো কাগজ। এক আধদিন একটু বিরক্ত হয়েছি বলেই আগেই ভূমিকাটা সেরে নিলেন, ‘ঠিক একমিনিট সময় নেবো। দাড়ি চাঁচা-ছোলার মধ্যেই হয়ে যাবে। এই চিরকুটটা।’ টুকরো কাগজটা হাত বাড়িয়ে নিলুম। কাগজে বিশাল একটা সংখ্যা :

১০৪০৭৯৩২১৯৪৬৬৪৩৯৯০৮১৯২৫২৪০৩২৭৩৬৪০৮৫৫

৩৮৬১৫৬২২৪৭৪৭৬৭০৪৮০৫৩১৯১১২৩৫০৪০৩৬০৮০৫

৯৬৭৩৩৬০২৯৮০১।

মাথাটা ঘুরে গেল। একেই লো প্রেসার। ধকল সহ্য হয় না। অপরেশবাবুর ধোঁয়া-ধোঁয়া মুখের দিকে তাকালুম। ‘এটা কি মশাই মানুষ মারার কল!’

অপরেশবাবু যথারীতি গম্ভীর ‘এক মাস আমার ঘুম নেই। যতক্ষণ না সমাধান পাচ্ছি ঘুম আর আসবে না।’

আমি তখন একটু সামলেছি। সাহস করে বললুম, ‘সমস্যাটা কি না বুঝলেও সমাধানটা বলে দিতে পারি। সমাধান হল এই,—কাগজটা টুকরো-টুকরো করে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলুম। অপরেশবাবুর মুখ দেখে মনে হল, আমি যেন এইমাত্র একটা মার্ডার করেছি, ‘ছিঁড়ে ফেললেন। জানেন এই সংখ্যাটা আপনার জন্যে লিখে আনতে আমার পাককা এক ঘণ্টা সময় লেগেছে। কেবল গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে! চোখে জল এসে যাচ্ছে। আপনি ছিঁড়ে ফেললেন।’

ভদ্রলোক এমন কাঁদো-কাঁদো মুখে কথাটা বললেন, বড় মায়া হল। বললুম, বসুন, চা খান। ওসব একগাদা নয়-ছয় নিয়ে মাথা খারাপ করে কি হবে?

অপরেশবাবু মোটা শরীর নিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে বললেন, ‘একশো তেরো বছর ধরে পৃথিবীর গণিতজ্ঞরা ওই সংখ্যাটা নিয়ে বিব্রত।

বিব্রত হবার কারণ?

সংখ্যাটাকে ভাগ করা যায় কিনা? এই হল তাদের সমস্যা।

সব ছেড়ে আপনি সেধে ওই উটকো সমস্যার সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাইছেন কেন?

এমন কিছু রূঢ় কথা বলিনি। অপরেশবাবু চা না খেয়েই অত্যন্ত আহত মানুষের মতো একটি কথাও না বলে ধীরে-ধীরে বেরিয়ে গেলেন।

একদিন সকালে মাছের বাজারে এই অদ্ভুত চরিত্রটিকে আমি আবিষ্কার করেছিলুম। ভীষণ ঝগড়া চলেছে। মাছওয়ালাও চেঁচাচ্ছে আর এক খদ্দের অনর্গল হিন্দি বলে চলেছেন। চারপাশে গোল হয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে পড়েছে। দূর থেকে আমার কানে আসছে চালাকি পা-গিয়া। কেতনা রোজ অ্যায়সা জোচ্চুরি চলে গা। নয়া সিস্টেম চালু করনে পড়ে গা।

মাছওয়ালার খালি একই কথা, যান না মশাই, আপনার মতো খদ্দের আমি অনেক দেখেছি।

ভীড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখি স্থূলকার, ধুতি পাঞ্জাবি পরা সৌম্য চেহারার এক ভদ্রলোক। এক হাতে মাছের ব্যাগ অন্য হাতে একটা দশ টাকার নোট। উত্তেজনায় মুখ টকটকে লাল। ঝগড়াটা দেখলুম সকলেই উপভোগ করছেন। কেউই থামাবার চেষ্টা করছেন না।

জিগ্যেস করলুম, আপনি বাঙালি?

ভদ্রলোক বলনে, জরুর বাঙালি।

তবে হিন্দিতে কথা বলছেন কেন?

মাছওয়ালা বললে, এর নাম হিন্দি।

ভিড়ের মন্তব্য, এর নাম ব্রজবুলি। ব্রজের রাখালরা এই ভাষায় কথা বলত, বুঝলে মধু। মাছওয়ালার নাম মধু।

ঝগড়ার কারণটা কি? কারণ ভারি অদ্ভুত। অপরেশবাবু বেশ একটা পাকা রুই মাছ থেকে তিনশো গ্রামের মতো একটা টুকরা ওজন করিয়েছেন। তারপর মধুকে বলেছেন আঁশ ছাড়াও। মধু ছাড়িয়েছে। তারপর বলেছেন আবার ওজন কর। দ্বিতীয় ওজনে পঞ্চাশ গ্রাম কম হয়েছে। অপরেশবাবু আড়াইশো গ্রামের দাম দেবেন। তাঁর যুক্তি, তিনি পনেরো টাকা দরে মাছ নেবেন, আঁশ নিতে যাবেন কি কারণে! আঁশ আর মাছ এক! মধু জীবনে এমন যুক্তি শোনেনি। তার বক্তব্য, আঁশ ছাড়া মাছ হয় না। অপরেশবাবু যখন মাছ ওজন করিয়ে আঁশ ছাড়াতে বাধ্য করেছেন তখন তিনশোর দাম দিয়ে মাছ নিতেই হবে। না নিলে অপরেশবাবুকে বাজার থেকে বেরোতে দেবে না। হই-হই ব্যাপার। দু-পক্ষই অনমনীয়।

ভদ্রলোককে দেখে আমার মায়া হয়েছিল। মাছওয়ালার হাত থেকে, অপমান থেকে রেহাই দেবার ভার আমিই নিলুম। তিনশোর দাম দিয়ে মাছ আমিই ব্যাগে পুরলুম। অপরেশবাবু গজগজ করতে-করতে চলে গেলেন। চোখে সেই দৃষ্টি, আমি যেন কত বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছি।

ওই ঘটনার দিনই সন্ধ্যের দিকে কিভাবে ঠিকানা যোগাড় করে অপরেশবাবু এসে হাজির। ভীষণ বিক্ষুব্ধ, আমি নাকি মহা অন্যায় করে ফেলেছি। একটা দীর্ঘদিনের অপরাধকে প্রশ্রয় দিয়েছি। যাই হোক, প্রায়শ্চিত্তের একটা রাস্তাই খোলা আছে, ওজনে কম দেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি যে ভলেন্টিয়ার ফোর্স গড়ে তুলতে চলেছেন, তার পিছনে আমাকে মদত দিতে হবে। অন্যায় যে করে, অন্যায় যে সহে, সবকো এক সাথ চুলা মে চড়ায় গা।

উত্তেজিত হলেই মশাই আমি হিন্দি বলি। চেয়ারে বসে পা ঠুকতে-ঠুকতে অপরেশবাবু গাইলেন, কদম কদম বাড়ায়ে যা। কদম, কদম?

অপরেশবাবুর বাড়ি আমার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। ছোট্ট ফ্ল্যাট। স্বামী-স্ত্রীর ছিমছাম সংসার। একটি মাত্র ছেলে ছিল। একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের লেবার অফিসার হিসাবে কাজ করতেন। দুর্ঘটনায় ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই স্ত্রী ধর্মের দিকে গেছেন, অপরেশবাবু অধ্যয়নের দিকে। নানা বই পড়েন। আর রাজ্যের সমস্যা মাথায় নিয়ে সারা রাত নির্জন রাস্তার দিকের জানলায় বসে একের পর এক সিগারেট পুড়িয়ে যান।

সেই সকালে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলার পর অনেকদিন অপরেশবাবুকে দেখিনি। হঠাৎ একদিন দেখা। আমাকে দেখেও না দেখার মতো ভাব করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম, কি ব্যাপার? রাগ হয়েছে?

ফিস-ফিস করে বললেন, ভীষণ চিন্তায় পড়েছি।

আবার কি হল? সেই সংখ্যাটা?

না—না, ওটার সলিউশান করে ফেলেছি।

অবাক হতে হল। কে এমন ধনুর্ধর, এই মহাগাণিতিক সমাধানটি করে ফেলেছে।

বললাম, আপনি?

আমার অজ্ঞতায় তাঁর চোখ বড়-বড় হয়ে উঠল, মানুষের একশো তেরো বছরের চেষ্টায় যা হয়নি, এক কথায় কমপিউটারে সেই সমাধান বেরিয়ে এসেছে। সংখ্যাটি প্রাইম, ভাগ করা যায় না।

তাহলে আর সমস্যাটা কি?

পাশ দিয়ে একটা গাড়ি যাচ্ছিল। বড়রা যেভাবে শিশুকে টেনে নেয়, সেইভাবে আমাকে নর্দমার ধারে নিরাপদ স্থানে টেনে নিয়ে বললেন? এবারে অন্য, আচ্ছা বলতে পারেন, সাদা ধবধবে, কালো কুচকুচে, লাল টকটকে, হলদে কি?

এবার আমার অবাক হবার পালা, হলদে কী মানে?

অপরেশবাবু ব্যাখ্যা করলেন আমরা সাধারণত কি বলি—সাদা ধবধবে, কালো কুচকুচে, লাল টুকটুকে। তাইতো? হলদে কি? বলুন, হলদে কি?

বলতে-বলতে অপরেশবাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাঁর সেদিনের চোখের দৃষ্টির মধ্যে কেমন যেন একটা উন্মাদ-উন্মাদ ভাব ছিল। যত দিন গেল, অপরেশবাবুর শুধু এক প্রশ্ন। হলদে কি? যেই আসে, যার সঙ্গেই দেখা হয় আর কোনও কথা নেই—হলদে কি? মাঝে-মাঝে মাঝরাতে মৃতপুত্রের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন—

বলতে পারিস, সাদা ধবধবে, লাল টুকটুকে, কালো কুচকুচে, হলদে কী। মধ্যরাতে প্রৌঢ়ের সেই চিৎকার প্রতিবেশিদের কানে আসে—হলদে কী? বলতে পারিস না হলদে কী, হলদে কী। অপদার্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *