সময় সরণী

সময় সরণী

‘আচ্ছা, এটা কি সুধীরবাবুর বাড়ি?’

‘হ্যাঁ, আমিই সুধীর ভটচায। আপনি কে বলুন তো?’

‘আমাকে ঠিক চিনবেন না। বিশেষ প্রয়োজনে আসা। ভিতরে আসতে পারি কি?’

‘আসুন।’

‘এখানে বোধহয় দরজার বাইরে চটি ছেড়ে ঢোকার নিয়ম, তাই না?’

‘তা নিয়ম একটা আছে বটে, যদি আপনার অসুবিধে না-হয়, তাহলে—’

‘না, না, ঠিক আছে। চটি ছেড়েই আসছি।’

‘আসুন, বসুন।’

‘আপনাদের এ জায়গাটা বেশ গরম।’

‘তা তো বটেই। গ্রীষ্মকালে এ দেশে গরম পড়ে। আপনি কি এদেশে থাকেন না?’

‘না, না, আমিও এদেশেই থাকি। মাত্র কয়েক মাইল তফাতে। তবে আমাদের ওখানে বিশেষ গরম নেই।’

‘কয়েক মাইলের তফাতে তো আর দার্জিলিং পাহাড় নয় মশাই।’

‘না, না, অত দূরের কথা বলছি না। আমি শ্যামবাজারের দিকটায় থাকি।’

‘তা শ্যামবাজারে গরমের অভাব কি? কালও তো হাতিবাগানে গিয়ে গলদঘর্ম হয়েছি। আপনি বোধহয় এয়ার কণ্ডিশনে থাকেন।’

‘খানিকটা তাই।’

‘তাই বলুন।’

‘তবে সেটা ন্যাচারাল এয়ার কণ্ডিশনিং।’

‘সেটা আবার কীরকম?’

‘এমন সব গাছ আছে যা কুলিং সিস্টেমের কাজ করে।’

‘গাছ! শ্যামবাজারে আবার গাছ কোথায় পেলেন?’

‘সে কথা থাক। আগে জরুরি কথাটা সেরে নিই।’

‘হ্যাঁ বলুন।’

‘এখন ঘড়িতে বাজছে সকাল ন-টা। ঠিক তো।’

‘হ্যাঁ ¡। কাঁটায় কাঁটায়।’

‘ঠিক দশটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে এবাড়িতে একটা ঘটনা ঘটবে। আর সেইজন্যই আমার আসা।’

‘ঘটনা! কী ঘটনা বলুন তো! দিনে-দুপুরে ডাকাত পড়বে নাকি?’

‘না, না। অত বড়ো ঘটনা নয়। খুবই তুচ্ছ একটা ঘটনা, কিন্তু তার তাৎপর্য গভীর।’

‘আপনি কি জ্যোতিষী?’

‘আজ্ঞে না। তবে আমি লজিক্যাল।’

‘তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে? আপনি কি পাগল?’

দাঁড়ান, আমার কথাগুলো একটু হেঁয়ালির মতো হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। আসলে এখনকার বাংলা ভাষায় কথা বলতে তেমন অভ্যস্ত নই তো, তাই।

‘আপনি কি বাঙালি নন?’

‘বাঙালিই, তবে একটু অন্যরকম বাঙালি। আমাদের বাংলাটা একটু অন্যরকম।’

‘তা হতেই পারে। শুনেছি চট্টগ্রাম বা সিলেটের বাংলা বেশ অন্যরকম।’

‘প্রবলেমটা অনেকটা সেরকমই। যাই হোক, একটু বুঝিয়ে বলছি।’

‘বলুন।’

‘আপনার ছেলের নাম কিংশুক ভট্টাচার্য তো?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি তাকে চিনলেন কী করে?’

‘তিনি আমার দাদু।’

‘দাদু! বলেন কী মশাই! আপনার মাথায় তো বেশ গন্ডগোল! আমার ছেলের বয়স মাত্র আট মাস। আর কিংশুক নামটাই যে শেষ অবধি রাখা হবে তারও ঠিক নেই।’

‘প্লিজ। দয়া করে ওঁর নাম কিংশুকই রাখবেন। দু-হাজার বাষট্টি সালে কিংশুক ভট্টাচার্য নামেই উনি নোবেল প্রাইজ পাবেন। নাম পালটালে অনেক গন্ডগোল হয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা মশাই, আপনি এখন আসুন। আমার অনেক কাজ আছে।’

‘ভয় পাবেন না, আমি পাগল নই। আমি সত্যিই কিংশুক ভট্টাচার্যের নাতি। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেই বুঝতে পারবেন।’

‘আপনি কি টাইম মেশিনের গপ্পো ফাঁদবেন? ভবিষ্যৎ থেকে উড়ে এসেছেন! ওসব গুলগল্প আমাদের ঢের জানা আছে।’

‘আমরা ঘনাদার গল্প অনেক পড়েছি। স্টিফেন হকিং বলেই দিয়েছেন টাইম ট্রাভেল সম্ভব নয়। মিচকি মিচকি হাসছেন যে !’

‘স্টিফেন হকিং তো আর সব সত্যের সন্ধান জানতেন না, অধিকাংশ সত্যই হল আপেক্ষিক। এক-এক দেশে এক-এক সময়ে এক-এক পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে এক-একটা জিনিসকে সত্য বলে প্রতীয়মান হয় মাত্র। আমি সত্যিই সময়ের সরণি বেয়ে এসেছি। আমি সম্পর্কে আপনার ছেলে কিংশুকের নাতি, আপনার পুতি।’

‘হাঁ: হাঁ:, মশাই, বেড়ে গল্প ফেঁদেছেন। আসল কথাটা কী বলুন তো!’

‘সেই কথা বলতেই আসা। নইলে আমরা সহজে টাইম ট্রাভেল করি না, তাতে অনেক রকম বিপত্তি হয়। যা বলছি দয়া করে শুনুন। বেলা দশটা কুড়ি মিনিট নাগাদ আপনার বন্ধু বঙ্কুবিহারী আর অরূপ মাইতি আসবেন। দশটা পঁচিশ মিনিট নাগাদ আপনার স্ত্রী তাঁদের দুজনকে দুটি করে সিঙাড়া পরিবেশন করবেন। সিঙাড়াগুলো আপনি গতকালই একটি মাড়োয়ারি দোকান থেকে কিনে এনেছেন, কিন্তু অত্যধিক ঝাল বলে খেতে পারেননি, ফ্রিজে রেখে দেওয়া আছে। আপনার স্ত্রী সেগুলোই মাইক্রো ওয়েভে গরম করে দেবেন। দশটা বত্রিশ নাগাদ অরূপ ও বঙ্কুবিহারী ঝালে হাঁসফাঁস করতে করতে ঠাণ্ডা জল চাইবেন। আপনার স্ত্রী ফ্রিজের জল নিয়ে এ ঘরে আসবার উপক্রম করবেন। আর তখনই ঘটনাটা ঘটবে। আপনি ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন?’

‘একটু অবাক হচ্ছি। সিঙাড়ার ঘটনাটা সত্যি। বাকিগুলো সত্যি কিনা—’

‘সত্যি। একটু বাদেই বুঝবেন।’

‘আচ্ছা বেশ। কিন্তু ঘটনাটা কী?’

‘আপনার স্ত্রীর হাত থেকে একটা কাচের গেলাস পড়ে গিয়ে ভাঙবে এবং গেলাসের জল পড়ে পিছল মেঝেতে আপনার স্ত্রী আছাড় খেয়ে পড়ে ফিমার বোন ভাঙবে।’

‘সর্বনাশ!’

‘আরও সর্বনাশ হল ফিমার বোন ভেঙে আপনার স্ত্রী শেষ অবধি পঙ্গু হয়ে যাবেন এবং তার ফলে চিনাংশুক জন্মাতে পারবে না।’

‘চিনাংশুক! সে কে ?’

‘কিংশুকের ছোটো ভাই।’

‘বলেন কী?’

‘যা বলছি দয়া করে শুনুন। চিনাংশুক না-জন্মালে খুবই গন্ডগোল হয়ে যাবে।’

‘দাঁড়ান মশাই দাঁড়ান। আপনি নিজে তো পাগল বটেই, কিন্তু আপনার পাগলামির চোটে যে আমারও পাগল হওয়ার জোগাড়! কী সব আবোল-তাবোল বকছেন?’

‘রেগে যাবেন না, মাথা ঠাণ্ডা করুন। সমস্যাটা অনুধাবন করার চেষ্টা করুন।’

‘সমস্যাটা কী?’

‘সমস্যা হচ্ছে এক গেলাস জল। ওই এক গেলাস জলই ভাবী কালের ইতিহাস পালটে দিতে পারে। আর সেইজন্যই আমার আসা।’

‘আপনার গুলগল্পে আমি বিশ্বাস করি না। আপনি আসুন এখন।’

‘আপনার যাতে বিশ্বাস হয় সেইজন্য দু-হাজার বাষট্টি সালের একটি খবরের কাগজ আমি সঙ্গে করেই এনেছি। এটি অবশ্য আপনাদের সংবাদপত্রের মতো নিউজপ্রিন্টে ছাপা নয়, এটি ছাপা হয়েছে সিনথেটিক পেপারে। এই যে ফ্রন্ট পেজে বড়ো হেডিং-এ খবরটা দেখুন।’

‘ও বাবা! এ তো দেখছি কিংশুক ভট্টাচার্য পদার্থবিদ্যায় সত্যিই নোবেল প্রাইজ পেয়েছে! এটা জালি ব্যাপার নয় তো?’

‘ওই খবরের কাগজটা যে মেটেরিয়ালে ছাপা হয়েছে তা আপনি কখনও দেখেছেন?’

‘না মশাই! এ তো ভারি নরম অথচ মোলায়েম জিনিস। আর ছাপাও তো দারুণ সুন্দর। কিন্তু ভাষাটা একটু যেন কেমন কেমন। সব বাক্য ভালো বোঝা যাচ্ছে না।’

‘ভাষা এক নিরন্তর পরিবর্তনশীল জিনিস। আমাদের আমলে ভাষা অনেক সংকেতময় হয়েছে।’

‘তাই দেখছি।’

‘এখন কি একটু একটু বিশ্বাস হচ্ছে?’

‘আমি ধাঁধায় পড়ে গেছি। তা আপনি যদি টাইম ট্রাভেলার হয়েই থাকেন তাহলে আপনার গাড়ি কই?’

‘টাইম ট্রাভেল করতে গাড়ি লাগে নাকি?’

‘সিনেমায়-টিনেমায় তাই তো দেখি।’

‘ও তো আজগুবি ব্যাপার। তবে গাড়ি না-হলেও একটা শ্যাফট বা লম্বা নলের মতো জিনিস আছে। ওর টেকনোলজি আপনি ঠিক বুঝবেন না। তবে শ্যাফটটাও আপনার বাড়ির সামনের ওই খেলার মাঠটায় রয়েছে। ওটা দেখতে পাবেন না, কারণ ওটা ওখানে রয়েছে রাত তিনটের স্লটে। দিনেদুপুরে শ্যাফটটা দেখতে পেলে লোকের অনাবশ্যক কৌতূহল হবে।’

‘যাকগে, এখন খোলসা করে বলুন ব্যাপারটা কী।’

‘ব্যাপারটা সংক্ষেপে হল, সময়ের শরীরে মাঝে মাঝে এক-আধটা কুঞ্চন দেখা দেয়। ওই কুঞ্চনের ফলে অনেক সময়ে পরবর্তী ঘটনাবলিতে প্রভাব পড়ে। আমরা তেমন বিপজ্জনক কুঞ্চন দেখলে সেটাকে একটু মসৃণ করে দিই মাত্র। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিংশুক ভট্টাচার্য দু-হাজার বাষট্টি সালে যে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পাবেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার স্ত্রীর যদি আজ ফিমার বোন ভাঙে এবং চিনাংশুক না-জন্মায় তাহলে কিংশুক ভট্টাচার্য সেই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটা করতে পারবেন না।’

‘কেন মশাই?’

‘তার কারণ কিংশুক একমাত্র সন্তান হলে তাকে আপনারা অত্যধিক আদর দেবেন এবং অতিআদরে সে অলস অপদার্থ এবং বখাটে হয়ে যাবে। ফলে তার পক্ষে আর আবিষ্কারটা সম্ভব হবে না। চিনাংশুক জন্মালে কিন্তু আপনাদের মনোযোগ সে অনেকটাই কেড়ে নেবে এবং কিংশুক ভট্টাচার্যও অ্যাকটিভ থাকবেন।’

‘বটে! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু দশটা পনেরো বাজে। প্রস্তুত হোন।’

‘কী করতে হবে মশাই?’

‘আপনি কিছুই করবেন না। শুধু আপনার স্ত্রী যখন জলটা আনবেন তখন উঠে গিয়ে আপনি ওঁর হাত থেকে গেলাস দুটো নিয়ে নেবেন। টাইমিংটা কিন্তু খুব জরুরি। এক সেকেণ্ড আগে বা পরে হলেই ব্যাপারটা কেঁচে যাবে।’

‘বুঝেছি।’

‘খুব সাবধান। ওই ডোরবেল বাজছে, আপনার বন্ধুরা এসেছেন।’

‘দরজা কি খুলে দেব?’

‘দিন। আমার নাম অশঙ্ক ভট্টাচার্য। আমাকে আপনার দূরসম্পর্কের আত্মীয় বলে পরিচয় দিতে পারেন বন্ধুদের কাছে।’

‘তাই হবে। বলে গিয়ে সুধীরবাবু দরজা খুলে দেখলেন সত্যিই বঙ্কু আর অরূপ এসেছে।’

‘তার পরের ঘটনাগুলো ঠিক যেমনটি অশঙ্ক বলেছিল তেমনই ঘটতে লাগল। ঝাল সিঙাড়া খেয়ে দুজনেই বলে উঠল, বউদি, ঠাণ্ডা জল দিন।’

অশঙ্ক চোখের ইশারা করে সুধীরবাবুকে বলল, ‘এইবার! খুব সাবধান কিন্তু —’

সুধীরবাবু তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন এবং তাঁর স্ত্রী যখন ফ্রিজের বোতল বের করে গেলাসে জল ঢালছেন তখনই গিয়ে বললেন, ‘দাও গেলাস দুটো, আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

‘তুমি! তুমি নেবে কেন?’

‘আহা, দাও না। তুমি পড়ে-টড়ে গেলে যে সর্বনাশ!’

‘পড়ব! আমি পড়ব কেন?’

‘পড়ারই কথা কিনা। আর তুমি পড়লে চিনাংশুক জন্মাতে পারবে না। তাহলে যে সর্বনাশ।’

‘বলি সকালেই কি গাঁজা টেনেছ নাকি? কী সব বাজে বকছ! সরো, জল আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

‘আহা-হা, করো কী, করো কী!’

বলে সুধীরবাবু তাঁর স্ত্রীর হাত থেকে গেলাস দুটো একরকম কেড়েই নিতে গেলেন। আর টানা-হ্যাঁচড়ায় একটা গেলাস হাত ফসকে পড়ে শতখান হয়ে ভাঙল। এবং স্ত্রী নয়, সুধীরবাবু নিজেই পিছলে দড়াম করে পড়ে গেলেন।

স্ত্রী আর্তনাদ করে উঠলেন। বন্ধুরা ছুটে এল। সঙ্গে অশঙ্কও। ধরাধরি করে তোলা হল তাঁকে। বাঁ-হাতটায় প্রচন্ড লেগেছে।

বঙ্কু ডাক্তার। হাতটা ভালো করে দেখে বলল, ‘কনুইয়ের কাছটা তো ফ্র্যাকচার হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। ভোগাবে।’

সুধীরবাবুর মুখে অবশ্য হাসি। অশঙ্কের দিকে চেয়ে চোখ টিপে বললেন, ‘কী হে বাপু, কেমন সামলে দিয়েছি?’

অশঙ্ক মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, সময়ের যে কুঞ্চনটা ছিল সেটা এখন সটান হয়ে গেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *