সময় যখন হঠাৎ থেমে যায়

সময় যখন হঠাৎ থেমে যায়

একতলার বসবার ঘরে হঠাৎ বিরাট জোরে একটা বোমা ফাটার মতন শব্দ হল৷ কেঁপে উঠল সারা বাড়ি৷

এরকম আওয়াজ শুনলে ভয়ে বুক কেঁপে উঠবে না, এমন মানুষ হয় না৷

মা এখন ঠাকুরঘরে৷ পুজো করছিলেন না, ঠাকুরের বাসনপত্র ধুয়ে রাখছিলেন৷ সেই আওয়াজ শুনে তাঁর হাত থেকে বাসনগুলো পড়ে গেল৷ তিনি নিজেও ‘ওঃ মাগো’ বলে শুয়ে পড়লেন মাটিতে৷

বাবা লাইব্রেরি ঘরে বসে কিছু লেখালেখি করছিলেন, তিনিও বলে উঠলেন, অ্যাঁ, কী হল? সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে হল, বাড়িতে ডাকাত ঢুকেছে?

শুধু শান্তিপিসি রান্নাঘরে বসে তরকারি কুটছেন, তিনি কেঁপেও উঠলেন না, ভয়ও পেলেন না৷ কারণ, তিনি আজকাল কিছুই কানে শুনতে পান না৷

শান্তিপিসির মেয়ে টুকটুক সবে মাত্র চান করে বাথরুম থেকে বেরিয়েছে, সেই ভয়ংকর শব্দ শুনে সে টপ করে আবার বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি তুলে দিল৷

ওই একবারই, আর কোনো শব্দ নেই৷ অতবড় আওয়াজের পর নিস্তব্ধতাকে আরও নিস্তব্ধ মনে হয়৷

মা খানিকটা সামলে নেবার পরই ভাবলেন, বুলেট? বুলেট কোথায়?

বাবাও সেই একই কথা ভাবলেন৷ বুলেটের তো কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না৷ সে নীচের বসবার ঘরে একা একা খেলা করছিল না? সর্বনাশ, ডাকাত এলে তো প্রথমেই তাকে ধরবে!

টুকটুক আবার বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেই দৌড়ে চলে এল লাইব্রেরি ঘরের দিকে৷

বাবাকে সে জিজ্ঞেস করল, ফুলদা, কিসের শব্দ হল অত জোরে?

বাবা বললেন, কী জানি বুঝতে পারছি না৷

টুকটুক বলল, বসবার ঘর থেকেই তো শব্দটা হল৷ আমি নীচে গিয়ে দেখে আসছি৷

টুকটুকের বয়েস পনেরো বছর৷ সে খুব সাহসী মেয়ে৷

বাবা যে প্রথমেই ডাকাতের কথা ভেবেছেন, সে জন্য ভয়টা যাচ্ছে না৷ কিন্তু টুকটুক একা নীচে যাবে, তাও কি হয়?

তিনি বললেন, হ্যাঁ, চল, আমিও যাচ্ছি তোর সঙ্গে৷

এর মধ্যে মা-ও নেমে এসেছেন ওপরের ঠাকুরের ঘর থেকে৷

সিঁড়ির গোড়ায় এসে তিনি বললেন, এই টুকটুক, তোকে যেতে হবে না৷ আমরা আগে গিয়ে দেখি—

টুকটুক বলল, আমি না গেলে তোমাকে সামলাবে কে? তুমি যদি অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যাও!

তিনজনেই নেমে এল নীচে৷

রান্নাঘরে বসে শান্তিপিসি এখনো একমনে তরকারি কেটে যাচ্ছেন, অন্যদিকে তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই৷

এখন দুপুর দেড়টা, এই সময় কি ডাকাত আসে? তারা তো আসে মাঝরাত্তিরে৷ অবশ্য এখন নানারকম ঘটনা ঘটছে, এখন সবই সম্ভব৷

একতলায় একটা ছোট্ট উঠোনের একপাশে রান্নাঘর, তারপর খাবার ঘর, আর একটা ঘরেও নানান জিনিসপত্র জমা থাকে৷ উঠোনের অন্যদিকে বসবার ঘর, সেখানেই বাইরে বেরুবার দরজা৷

সেই ঘরে এখন আর কোনো সাড়াশব্দ নেই৷

তিনজনই খুব সাবধানে উঁকি মারল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে৷

কোনো লোক দেখা গেল না, তবে মেঝেতে অনেক কাচের টুকরো ছড়ানো৷

মা ডাকলেন, বুলেট, বুলেট, তুই কোথায়?

ভেতর থেকে একটা বাচ্চা ছেলের গলা শোনা গেল, মা, আমি…….আমি কিছু করিনি৷

বুলেটের বয়েস ঠিক দশ৷ তার ভালো নাম রণজয়, সে যখন আরও ছোট, তখন তাকে খোকন বলে ডাকা হত৷ তার মতন দুরন্ত ছেলে এ তল্লাটে কেউ কখনো দেখেনি৷ ইংরিজি কাগজে ডেনিস দা মিনেস বলে একটা খুব দুষ্টু ছেলেকে নিয়ে কার্টুন ছাপা হয়, রণজয় বোধহয় দুরন্তপনায় তাকেও ছাড়িয়ে যায়৷

একদিন ওর ছোটমামা বলেছিল, দিদি, তুমি ছেলের নাম রেখেছ রণজয়৷ ও যে কত যুদ্ধ জয় করবে তার ঠিক নেই৷ এ ছেলের মাথাটাই তো দেখছি বুলেটে ঠাসা৷

সেই থেকে খোকনের বদলে ওর ডাকনাম হয়ে গেল বুলেট৷

ওরা তিনজনই এবার ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে দেখল, একদিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বুলেট৷ তার মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে৷

সে বলল, আমি কিছু করিনি৷ ওটা আপনি আপনি পড়ে গেল!

ওই দিকেই একটা ছোট টেবিলের ওপর থাকে টিভি৷ সেটা এখন ফাঁকা৷ সেই টিভিটাই মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে৷

বাবার মাথায় যে ডাকাতের ভয় ঢুকেছিল, এখন সেটা চলে গিয়ে এসেছে রাগ৷

তিনি কড়া গলায় বললেন, এমনি এমনি পড়ে গিয়ে ভাঙল? অ্যাঁ?

বুলেট বলল, হ্যাঁ, আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ওতে হাতও দিইনি৷

বাবা এবার আরও জোরে বললেন, আর তো কেউ পাশ দিয়ে গেলে টিভি ভাঙে না৷ হতভাগা ছেলে, তুই আবার মিথ্যে কথা বলতেও শিখেছিস!

বাবা ছেলেমেয়েদের মারধোর করা একেবারেই পছন্দ করেন না৷ কিন্তু আজ আর রাগ সামলাতে পারলেন না৷ বুলেটকে একটা চড় মারবার জন্য তিনি হাত তুললেন৷

মা তখুনি ছুটে গিয়ে বুলেটকে জড়িয়ে ধরে বললেন, এই, এই, ওকে মারবে না৷ ওর যে কোনো ক্ষতি হয়নি, সেটাই যথেষ্ট৷ ভাগ্যিস ওর গায়ে লাগেনি৷

টুকটুক পা দিয়ে কাচ সরাতে সরাতে বলল, ইস, এ আর সারাবার কোনো উপায় নেই৷ এমন ভাবে ভেঙেছে…এক হিসেবে ভালোই হল৷ এবার একটা নতুন সেট কেনা হবে৷

মা বললেন, ঠিক বলেছিস৷ ওঁকে কতবার বলেছি, এই টিভিটা এবার বদলাও৷ কত রকম নতুন টিভি বেরিয়েছে, এমন কি দেওয়ালের গায়েও ঝুলিয়ে রাখা যায়৷ কিন্তু ও এমন কিপ্যুস, কিছুতেই…..

বাবা বললেন, এই টিভিটা তো বেশ ভালোই চলত৷ সব প্রোগ্রাম দেখা যেত৷ শুধু শুধু এক্ষুনি আর একটা কিনতে যাব কেন? শুধু শুধু বাজে খরচ! টাকা-পয়সা কি এমনি এমনি আসে?

টুকটুক বলল, ভাঙার সময় এই টিভিটায় এত বিকট জোর শব্দ হল কেন? শুধু কাচ-টাচ ভাঙলে তো এরকম বোমার মতন আওয়াজ হয় না৷ আমি তো ভেবেছি, ডাকাত পড়ল নাকি?

মা বললেন, আমিও তো তাই-ই ভেবেছি৷ এর মধ্যে বোধহয় গ্যাস-ট্যাস কিছু থাকে৷

বাবা বললেন, তোমরাই বুঝি বুলেটকে দিয়ে এটা ভাঙালে?

মা বললেন, মোটেই না৷

বুলেট এর আগে আরও অনেক জিনিস ভেঙেছে৷ কাচের গেলাস, ওষুধের শিশি, টেবিল ল্যাম্প…এই তো পরশুদিনই একটা দেয়াল ঘড়ি আছড়ে ভেঙেছে৷ তখন ওকে বকুনি দিতে গেলে ও হেসেছে হি হি করে৷ কিন্তু টিভির মতন এত দামি আর বড় জিনিস ভাঙেনি৷ তাই আজ সে নিজেই ভয় পেয়ে খানিকটা চুপসে গেছে৷

এবার সে আস্তে আস্তে বলল, টিভিটা নিজে নিজেই উল্টে গিয়ে পড়ল, তারপর ওই লোকটা…

সে বাইরের দরজার দিকে আঙুল তুলে দেখাল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ৷

তার অদ্ভুত পোশাক, জামা-প্যান্ট গায়ের সঙ্গে একেবারে সেঁটে আছে আর চকচক করছে রুপোর মতন, মাথার চুল হলদে রঙের, নাকটা বেশ লম্বা৷

তাকে দেখে মায়ের মুখ বিস্ময় আর খুশিতে ভরে গেল৷

টুকটুক হাততালি দিয়ে বলে উঠল, একি? এ তো স্বপ্নকুমার৷ কত প্রোগ্রামে ওঁকে দেখেছি৷ ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ সিরিয়ালে ইনিই তো হিরো৷

লোকটি দু’হাত জোড় করে, নম্র গলায় বলল, নমস্কার৷ হ্যাঁ, আমিই স্বপ্নকুমার৷ ওই ছেলেটির কোনো দোষ নেই৷ আমি টিভির মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম, বেরুতে পারছিলাম না কিছুতেই, তাই এই টিভিটা ভেঙে বেরিয়ে আসতে হল৷ আমি আপনাদের…

বাবা বললেন, এ আবার কে? আপনি কে মশাই! কোথা থেকে আসছেন?

লোকটি বলল, ওই যে বললাম, আমার নাম স্বপ্নকুমার৷ অবশ্য ওটা আমার আসল নাম নয়৷ আসল নাম হুতুম বকসি৷ আমি টিভিতে অনেক অনুষ্ঠান করি৷ আপনার স্ত্রী আর পিসতুতো বোন আমাকে ঠিক চিনতে পেরেছেন৷

বাবা বললেন, আমি অত টিভি দেখি না৷ শুধু খবর-টবর…

বুলেট এবার অনেকটা ভয় কাটিয়ে উঠে বলল, তুমি সত্যি সত্যি আকাশে উড়তে পারো?

লোকটি একগাল হেসে বলল, হ্যাঁ, তা তো পারিই৷ ওটা এমন কিছু শক্ত নয়৷ একা একা কথা বলার দৃশ্যগুলোই খুব কঠিন৷

টুকটুক বলল, আমাকে কিন্তু একটা অটোগ্রাফ দিতে হবে৷ আমি অটোগ্রাফ বুকটা ওপর থেকে নিয়ে আসছি৷

মা বললেন, তোর ক্যামেরাটাও নিয়ে আসিস৷ ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলব৷

বাবা এক ধমক দিয়ে বললেন, দাঁড়াও! এসব কী হচ্ছে? আমরা কি বোকা আর অশিক্ষিত নাকি! টেলিভিশন সেটের মধ্যে কি মানুষ থাকতে পারে? তোমরা অমনি তাই বিশ্বাস করে নিলে? টিভির প্রোগ্রাম তো শু্যটিং হয় স্টুডিয়োতে৷ তারপর সেই ছবি হাওয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷…তখন একসঙ্গে অনেক বাড়ির টিভিতে সেটা দেখা যায়!

লোকটি বলল, আপনি ঠিক বলেছেন স্যার৷ স্টুডিয়োতেই শু্যটিং হয়, মাঝে মাঝে বাইরেও হয়, তাকে বলে আউটডোর৷ সেই ছবি একসঙ্গে অনেক মানুষ দেখে৷ তবে কি জানেন স্যার, এক এক সময় আটকেও যায়৷ টিভিতে দেখেননি, হঠাৎ ছবিটা থেমে যায়, আর এগোয় না—

টুকটুক বলল, সে রকম তো হয়ই৷ তখন এত রাগ হয়!

লোকটি বলল, কাল সন্ধেবেলা, ঝড়ের পাখি নামে একটা ধারাবাহিকের শু্যটিং চলছিল, ভি আই পি রোডের এক জায়গায়৷ ঠিক পৌনে সাতটার সময় লোডশেডিং হয়ে গেল৷ চারপাশ একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ তার মধ্যে আমি কিসে যেন আটকে গেলাম৷ নড়াচড়াও করতে পারছি না৷ আমি চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলাম, এই ভুতো, ভুতো, আমাকে ছাড়াবার ব্যবস্থা কর৷ তখন এত সব গোলমাল চলছিল, ভুতো আমার ডাক শুনতেই পেল না৷

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ভুতোটা আবার কে?

লোকটি বলল, এই সিরিয়ালের পরিচালক৷ তাকে সবাই গোলাম মুস্তফা নামে চেনে৷

টুকটুক জিজ্ঞেস করল, তারপর? তারপর কী হল?

লোকটি বলল, অনেকক্ষণ বাদে, এক ঘণ্টা তো হবেই, আবার কারেন্ট এসে গেল, জ্বলে উঠল রাস্তার সব আলো৷ আমি দেখি কী, আমাদের ইউনিটের কেউ নেই, সবাই প্যাক আপ করে চলে গেছে৷ ওরা বোধহয় ভেবেছে, আমিও এর মধ্যে বাড়ি চলে গেছি৷ কিন্তু আমি তখনও বন্দি হয়ে রয়েছি৷ বেরুবার কোনো উপায়ই পাচ্ছি না৷ উঃ, সে কী কষ্ট! খিদেও পেয়েছে খুব, সারারাত জেগে বসে রইলাম৷ আজ সকালে মনে হল, যদি একটা টিভি সেট ভেঙে বেরুতে পারি…..

টুকটুক বলল, তার মানে কাল সারারাত আপনি আমাদের এই টিভির মধ্যেই ছিলেন? এ মা, কাল রাত্তিরে টিভি খোলাই হয়নি৷ খুললে বোধহয় আপনাকে দেখতে পেতাম!

মা বললেন, অনেক লোকের বাড়িতেই তো টিভি আছে৷ একসঙ্গে একই প্রোগ্রাম দেখে৷ আমাদের টিভি থেকে আপনি বেরিয়ে এলেন, তাহলে অন্য সব টিভির কী হবে?

লোকটি বলল, একটা টিভি ভেঙে পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে অন্য সব টিভি তা জেনে যায়৷ আর কিছু করতে হয় না৷ সেই জন্যই আমরা একটা কোনো পুরোনো সেট, একটু পচা মার্কা, সেটাই বেছে নিই৷ এটা যে শুধু আমার বেলাতেই প্রথম হল, তা কিন্তু নয়৷ এই তো ঠিক একমাস দশদিন আগে আমাদের নায়িকা হিঙ্গুলি, ও তাকে তো এই নামে চিনবেন না, তার অন্য নাম বিশালাক্ষী৷

টুকটুক বলল, হ্যাঁ চিনি, বিশালাক্ষীকে অনেকবার দেখেছি৷

লোকটি বলল, তারও এইরকম হয়েছিল, সে তখন টালিগঞ্জের এক মিষ্টির দোকানের টিভি সেট ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল৷

বাবা এবার বেশ রেগে গিয়ে বললেন, এই সব গাঁজাখুরি গল্প আমায় বিশ্বাস করতে হবে? তোমাদেরও কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? টিভি সেটের থেকে কোনো মানুষ বেরিয়ে আসতে পারে?

সেই লোকটি বলল, আমি তবে এবার যাই?

বাবা তার দিকে ফিরে চোখ গরম করে বললেন, যাবে মানে? তুমি চুপটি করে এখানে বসে থাকো৷ আমি পুলিশে খবর দিচ্ছি৷ টিভি সেট ভেঙে ফেলাও তো ক্রাইম৷ পুলিশ এসে ঠিক করবে, তোমাকে কী শাস্তি দেওয়া উচিত!

লোকটি হাতজোড় করে বলল, স্যার, আমি তো আপনাদের অন্য কোনো ক্ষতি করিনি৷ হ্যাঁ, শুধু টিভি সেটটা ভাঙতে হয়েছে, তা আমি স্বীকারও করেছি৷ তারজন্য ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি আছি৷ কত টাকা দিতে হবে বলুন৷

মা বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওমা, ছি ছি৷ তুমি ওঁর কাছে টাকা নেবে? উনি একজন বিখ্যাত মানুষ৷ এই তো আমাদের পচা, পুরোনো টিভি, তার আবার দাম কী?

লোকটি বলল, তাও যদি কিছু ক্ষতিপূরণ দিতে হয়…মানে, আমার ঠিক আড়াইটের সময় একটা শু্যটিং আছে, এক্ষুনি সেখানে যেতে হবে৷

মা বললেন, যাবেন তো নিশ্চয়ই! তবু একটু বসে যান৷ আপনিই তো বললেন, কাল সন্ধে থেকে আপনার কিছু খাওয়া হয়নি৷ আমাদের বাড়িতে অন্তত এককাপ চা আর বিস্কুট খেয়ে যান৷

টুকটুক বলল, আমি আমার ক্যামেরাটা নিয়ে আসছি৷

বাবা রাগ করে বসবার ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন ওপরে৷

পরদিন ঠিক দুপুর দেড়টায় আবার সেইরকম একটা বোমা ফাটার মতন বিকট শব্দ হল৷

বাবা তখন দোতলার লাইব্রেরি ঘরে কিছু লেখালেখি করছেন৷ মা ওপরের ঠাকুরঘরে, পুজোর বাসনপত্র ধুয়ে রাখছেন৷ পিসিমার মেয়ে টুকটুক সবে স্নান করে বেরিয়েছে৷

বাবা ভাবলেন, আজ তা হলে সত্যি সত্যি ডাকাত এল নাকি?

মায়ের হাত থেকে বাসনপত্র সব পড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দ হল৷

টুকটুক ভয় পেয়ে আবার বাথরুমে ঢুকে পড়ে ছিটকিনি তুলে দিল৷

তারপর আর কোনো শব্দ নেই৷

কয়েক মিনিট পরেই মা নেমে আসতে আসতে বলতে লাগলেন, বুলেট কোথায় গেল? অ্যাঁ?

বাবা ভাবলেন, সত্যি তো, অনেকক্ষণ বুলেটের সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি৷

টুকটুকও বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে বলল, আমি যাচ্ছি নীচে, দেখছি বুলেট কোথায়৷

মা বললেন, না, না, তোকে যেতে হবে না৷ আমি যাচ্ছি৷

টুকটুক এর মধ্যেই সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নেমে গেছে৷ বাবা আর মা দু’জনেও নামতে লাগলেন৷

নীচের রান্নাঘরে বসে একমনে তরকারি কুটে যাচ্ছেন পিসিমা৷ তিনি কিছুই জানেন না, কারণ তিনি এখন কানে শুনতে পান না কিছুই৷

ডাকাত পড়লে এতক্ষণ চুপচাপ থাকবে কেন? তারা তো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ সেরে নিতে চায়৷ ডাকাতদের এখন সাহস বেশ বেড়ে গেছে৷ এই দিনের বেলাতেও ডাকাতির কথা শোনা যায় মাঝে মাঝে৷

ওঁরা খুব সাবধানে পা টিপে টিপে এসে বসবার ঘরের দরজার বাইরে থেকে উঁকি মারলেন৷ কোনো লোকই দেখা গেল না৷

এবার ভেতরে ঢুকে এসে ওঁরা দেখলেন, সারা মেঝেতে অজস্র কাচের টুকরো ছড়ানো৷ ভাঙা টেলিভিশানের সেটটা কাত হয়ে পড়ে আছে এক জায়গায়৷

কালকের মতোই দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বুলেট৷ তবে আজ তার মুখে অপরাধী অপরাধী ভাবটা নেই৷ বরং দুষ্টু দুষ্টু ভাবটাই ফুটে আছে৷

টুকটুক বলল, এ মা, বুলেট তুই টিভিটা ভেঙে ফেলেছিস? তাই অতজোর শব্দ হল৷

বুলেট বলল, আমার কোনো দোষ নেই৷ আমি টিভিটা চালাতে গেলাম, এই সময় ওয়ার্লড কাপ খেলা দেখাবে, রিমোটটা খুঁজে না পেয়ে আমি হাত দিয়ে টিপলাম, অমনি ওটা ভেঙে পড়ে গেল৷

মা বললেন, তোর গায়ে-টায়ে লাগেনি তো?

বাবার মুখে রাগ ফুটে উঠল৷ তিনি বাইরে যাবার দরজার দিকে একবার তাকালেন৷ সেখানে কেউ নেই৷

তিনি বললেন, তুই সুইচটা টিপলি, ওমনি টিভিটা উল্টে পড়ে গেল? এরকম কখনো হয়?

বুলেট বলল, হ্যাঁ, অবশ্য তখন আমার খুব হাঁচি পেয়ে গেল, পরপর দু’বার হাঁচতেই টিভিটা….

বাবা বললেন, ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে? হাঁচিতে টিভি উল্টে যায়? খুব মিথ্যে কথাও বলতে শিখেছিস!

তিনি বুলেটকে একটা চড় মারার জন্য হাত তুললেন৷

মা তখুনি দৌড়ে গিয়ে বুলেটকে জড়িয়ে ধরে বললেন, এই, এই, ওকে মারবে না৷ ওর তো সত্যিই কোনো দোষ নেই৷ টিভিটা এত পুরোনো হয়ে গেছে, তাই নড়বড়ে হতেই তো পারে৷

বাবা বললেন, তোমার ছেলে রোজ একটা করে টিভি ভাঙবে, তবু তাকে শাসন করা চলবে না? তুমিই তো বেশি বেশি আদর দিয়ে ছেলেটার মাথা খাচ্ছ৷

মা বললেন, রোজ একটা করে টিভি ভাঙছে মানে? ও আর একটা টিভি কবে আবার ভাঙল?

বাবা বললেন, কেন, কাল ঠিক এই সময়ে? তুমিও তো আমার সঙ্গে এসে দেখলে!

মা বললেন, কাল এই সময়ে তো আমি বাড়ি ছিলামই না৷ দিদির বাড়ি খেতে গিয়েছিলাম, আরও অনেকে ছিল৷

বাবা বললেন, মোটেই তুমি কাল দিদির বাড়ি যাওনি৷ সেটা অন্য কোনোদিন৷ কাল তুমি এখানেই ছিলে, সব দেখেছ৷ আজকাল তুমি বড্ড ভুলে যাচ্ছ৷

মা বললেন, মোটেই আমি ভুলে যাইনি৷ তোমাদের খাবার-টাবার গুছিয়ে রেখে, আমি চলে গেলাম দিদির বাড়ি৷ সেটা কালই৷ তুমি ইচ্ছে করলে দিদিকে ফোনে জিজ্ঞেস করতে পারো৷

বাবা বললেন, টুকটুক, তুইও তো কাল সব দেখেছিস, তাই না?

টুকটুক বলল, ফুলদা, আমিও কিন্তু কাল দুপুরে বাড়িতে ছিলাম না৷ কাল আমাদের ইস্কুলে একটা নাটক ছিল…সেখানেই তো আমি…

বাবা বললেন, ইস্কুলে বুঝি আজকাল পড়াশুনোর বদলে দুপুরে নাটক হয়! খুব বানাতে শিখেছিস৷ কালই তো সেই ভাঙা টিভি থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল…

টুকটুক হেসে ফেলে বলল, টিভি ভেতরে একটা লোক? হি হি হি হি৷

মা বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? টিভির সেটের মধ্যে কোনো মানুষ থাকতে পারে? আজকাল তো বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও এটা জানে৷

বাবা বললেন, আমিই তো বলেছি, টিভির মধ্যে কোনো মানুষ থাকাটা অসম্ভব৷ তোমরা দুজনেই তো সেই লোকটাকে দেখে একেবারে বিগলিত হয়ে গেলে৷ স্বপ্নকুমার না কী যেন তার নাম৷ সে নাকি অনেক টিভি প্রোগ্রামের খুব ফেমাস হিরো৷

টুকটুক বলল, স্বপ্নকুমার? আমি তো ও নাম কখনো শুনিনি৷ টিভি প্রোগ্রামে ওইরকম নামের কোনো হিরোও নেই৷

বাবা বললেন, তার আসল নাম হুতুম বকসি না ভুতুম দাস, এইরকম একটা কিছু৷

এবার বুলেটও হেসে উঠল৷

মা বললেন, ধ্যাৎ, ওইরকম নাম কোনো মানুষের হয় নাকি? তুমি গল্প লিখতে গেলে ওইরকম নাম দিও না যেন৷

বাবা বললেন, এটা মোটেই গল্পের ব্যাপার নয়৷ আমরা সবাই তাকে স্বচক্ষে দেখেছি৷ টুকটুক, তুই সেই লোকটার অটোগ্রাফ চাসনি?

টুকটুক বলল, আমি যাকে চিনি না, কোনোদিন নামও শুনিনি, তার কাছে অটোগ্রাফ চাইব কেন বলো? তা ছাড়া সত্যিই কাল দুপুরে আমি এ সময়ে বাড়ি ছিলাম না৷

বাবা এবার মায়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে চা খাওয়াতে চাওনি?

মা বললেন, মোটেই না৷ আমি ছিলামই না৷ আর একটা কথা শোনো৷ তুমি বললে কাল একটা টিভি ভেঙেছে, আজ আবার একটা…আমাদের বাড়িতে কি দুটো টিভি আছে? এইটাই তো সেই পুরোনোটা৷ আর একটা টিভি কোথা থেকে আসবে?

বাবা হতাশ ভাবে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন ধপাস করে৷ তাঁর মাথায় সব গুলিয়ে যাচ্ছে৷ গতকাল তিনি এই সময়ে এইরকম দৃশ্য ঠিকই দেখেছেন৷ মা আর টুকটুক সঙ্গেই ছিল৷ অথচ ওরা দুজন বলছে, ওরা কাল এই সময় বাড়ি ছিল না৷ তা হলে? এটা মোটেই স্বপ্ন-টপ্ন কিছু নয়৷ তাঁর অত স্বপ্ন দেখার বাতিক নেই৷ কাল সেই লোকটা যখন চা খাওয়ার জন্য বসে রইল, তিনি রাগ করে বেরিয়ে গেলেন৷ তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে একটা হোঁচট খেলেন, তাতে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলে বেশ ব্যথা লেগেছিল৷ এখনো সেই আঙুলটায় ব্যথা আছে৷

তা হলে কি যে সময় অনবরত বয়ে চলেছে, সেই সময় হঠাৎ একটুখানি থেমে, আজ যা ঘটবে, সেটাই গতকাল দেখিয়ে দিল তাঁকে? কিন্তু কেন? কেন দেখাবে? সময়ের মতিগতি বোঝা খুব শক্ত৷

এই সময় বাইরের দরজায় বেল বেজে উঠল৷

বাবা তড়াক করে উঠে দরজাটা খুলে দিয়ে দেখলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক৷ তার মুখখানা ঠিক কালকের হিরোর মতন৷ তবে সে সাধারণ একটা পাজামা আর সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরা৷ ঘাড়ে একটা রুমাল৷

বাবা তাকে কী চাই প্রশ্নটা মুখে না বলেও চোখ দিয়ে বোঝালেন৷

লোকটি হাতজোড় করে বলল, নমস্কার স্যার, আমার নাম স্বপ্নকুমার নন্দী৷ আমার নাম শুনে চিনবেন না৷ আমি টিভির সিরিয়াল প্রযোজনা করি৷ আপনার লেখা ঝড়ের পাখি গল্পটা আমাদের অনেকেরই খুব পছন্দ হয়েছে৷ আপনি যদি সেটা নিয়ে সিরিয়াল বানাবার অনুমতি দেন, তাই নিয়ে কথা বলতে এসেছি৷ কিছু টাকা অ্যাডভান্সও করে যেতে চাই৷

বাবা বললেন, আসুন, ভেতরে এসে বসুন৷

মা আর টুকটুক তখন মেঝের কাচ সরিয়ে ফেলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷

লোকটি চেয়ারে বসে, ঘাড় থেকে রুমালটা হাতে নিয়ে হাওয়া খাওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, একটু অসময়ে এসে পড়েছি৷ আসলে বেরিয়েছি অনেক আগে, মাঝখানে একটা মিছিলে আটকে গিয়েছিলাম, কিছুতেই বেরুতে পারছিলাম না৷ আমার ভয় হচ্ছিল, আপনি যদি গল্পটা অন্য কারুকে বিক্রি করে দ্যান৷ উঃ, যা গরম! একটু জল খাওয়াবেন?

মা বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই৷ এই টুকটুক, জল নিয়ে আয়৷ আপনি কি একটু চা খাবেন?

সেই লোকটি বলল, চা? হ্যাঁ তাহলে তো খুবই ভালো হয়৷ আমি সারাদিনে দশ-বারো কাপ চা খাই!

বাবার মুখের থেকে সব রাগের চিহ্ন মুছে গেছে৷ তাঁর চোখে এখন খুশির ঝিলিক৷ নিজের লেখা গল্প নিয়ে সিনেমা কিংবা টিভি সিরিয়াল হলে কার না আনন্দ হয়৷

তিনি মাকে বললেন, হ্যাঁ, ওকে চা-টা খাওয়াও৷ আর শোনো, আজ বিকেলেই তুমি আর টুকটুক দুজনে গিয়ে একটা নতুন টিভি সেট কিনে নিয়ে এসো৷ তোমাদের পছন্দ মতন, দামের কথা চিন্তা করো না৷

তাই শুনে বুলেট হাততালি দিয়ে উঠল৷

বাবা বললেন, তুই হাততালি দিচ্ছিস কেন রে? তুই নতুন টিভিতে খবর্দার হাত দিবি না৷ ধারে-কাছেও তোকে ঘেঁষতে দেওয়া হবে না৷

বুলেট মায়ের দিকে তাকিয়ে তবু হাততালি দিতে লাগল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *