সমন্বয়পন্থী ধর্মের বিলুপ্তি
রাজনৈতিক ভাঙা-গড়ায় পুরোনো দল ভাঙে, নতুন দল গড়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়ায় বড় দল ছোট হয়, আবার ছোট দল হয় বড়। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক দল বিলুপ্ত হয়। উদাহরণ-স্বরূপ বলা যায় একসময় ‘কংগ্রেস’ ও ‘ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি’ সিপিআই) ছিল উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় পার্টি। বর্তমানের ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ (বিজেপি) তখন ছিল অন্য নামে, কিন্তু খুবই ছোট। আজ কংগ্রেস ও ‘সিপিআই’ ভেঙে গঠিত হয়েছে অনেক ছোট ছোট আঞ্চলিক দল। পরিণামে কংগ্রেসের প্রভাব হয়েছে খর্ব ও ‘বিজেপি’র হয়েছে উত্থান। ফলে দুটোই এখন বড় দল। এই দ্বি-দলীয় স্রোতে ছোটরা মিলে-মিশে ক্ষমতার লড়াই করছে।
একইভাবে সাবেক পাকিস্তানে একমাত্র বড় দল ছিল ‘মুসলিম লীগ’। এরপর ‘মুসলিম লীগ’ ভেঙে গড়ে ওঠে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। আরও পরে গঠিত হয় আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে এটি ছিল একমাত্র বড় দল। মুসলিম লীগ হয় নির্বাসিত। পরে ক্ষমতার আশ্রয়ে গড়ে ওঠে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি)’। ছোট ছোট অনেক দল এতে আশ্রয় নেয়। আজ বাংলাদেশে এই দুই বড় দলকে কেন্দ্ৰ করে আবর্তিত হচ্ছে রাজনীতি। ছোট ছোট দল অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করছে। আবার কেউ কেউ ব্যক্তি হিসেবে এই দুই দলের একটিকে ধীরে ধীরে বেছে নিচ্ছে।
রাজনৈতিক ভাঙা-গড়ার উপরোক্ত প্রক্রিয়া উপমহাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিগত তিন-চার হাজার বছরের ধর্মীয় ইতিহাস তার সাক্ষী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একসময়ে এই উপমহাদেশে ছিল মহেঞ্জোদারো-দ্রাবিড় সভ্যতার দেবতা শিব। পরে এতে যোগ দেয় বহিরাগত আর্য দেবতামণ্ডলী। প্রভাবশালী ধর্ম হয় আর্যধর্ম (বৈদিক ধর্ম)। শিবের ধর্ম পেছনে পড়ে যায়। বৈদিকধর্মের প্রতিবাদে জৈন ও বৌদ্ধধর্মের উত্থান হয়। সকলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সমঝোতা হিসেবে গোড়া পত্তন হয় পৌরাণিক বা হিন্দুধর্মের। এতে স্থান পায় এই অঞ্চলের সকল মত ও পথ। বুদ্ধ পেছনে পড়ে যান। শিব আবার ফিরে আসেন। আর্যদের মূল দেবতারা হন বর্জিত। ‘অবতারবাদের’ মাধ্যমে সৃষ্ট হয় নতুন নতুন দেবতা।
বিভিন্ন মত ও পথের সমন্বয়ে নবগঠিত পৌরাণিক কালের হিন্দুধর্মটির ভিত্তি পাকাপোক্ত হতে না হতেই এক পর্যায়ে আসে বহিরাগত ইসলাম। পাল্টে যায় সমগ্র প্রেক্ষাপট। একদিকে বহিরাগত আর্যধর্ম ও ইসলাম ধর্ম, অন্যদিকে দেশজ শিব ও বুদ্ধের ধর্ম। এই দুই স্রোতের ঘাত ও প্রতিঘাতের প্রেক্ষাপটেই দীর্ঘদিনের ব্যবধানে আমরা পাই এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় দুটো ধৰ্ম : হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম। বৌদ্ধধর্ম টিকে থাকে প্রাণে। এই তিন ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু, ইসলাম ও বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি জন্ম নেয় নতুন শিখ ধর্ম। মোটা দাগে ফলাফল দাঁড়ায় : ক. প্রাক-আর্য শৈবধর্ম, খ. আর্যধর্ম (বৈদিকধর্ম), গ. জৈন ও বৌদ্ধ- ধর্ম এবং ঘ. নানা ধর্মমতের জায়গায় স্থাপিত হয় বর্তমান কালের তিনটি বড় ধর্ম যথা: হিন্দু, ইসলাম ও শিখ ধর্ম।
ছোট ছোট সমন্বয়পন্থী ধর্মমতগুলো এই তিনটির একটিতে বিলীন হয়। বিলীন এই ধর্মমতের প্রবর্তকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলেন সমাজের তথা কথিত নিচু শ্রেণির লোক। এঁদের মধ্যে আছেন : ব্রাহ্মণ রামানন্দ (১৩শ শতাব্দী), জোলা শ্রেণির কবীর (১৩৮৩-১৪২০), শূদ্র তুকারাম (১৬০৮-১৬৪৯), রামদাস ( ১৬০৮-১৬৮১), দাদু (ধূনকর), রুইদাস (চর্মকার), রজ্জব (মদ বিক্রেতা), শুক্লহংস (ধোপা) ও নামদেব (কাপড় রং করতেন)।
অবিভক্ত বাংলাও উপরোক্ত সামাজিক-ধর্মীয় প্রক্রিয়ার বাইরে ছিল না। বাঙালির ছিল নানা ধরনের টোটেম, তন্ত্র, যাদুবিদ্যা ও প্রকৃতিতে বিশ্বাস। ধীরে ধীরে একসময় এই অঞ্চল বৌদ্ধধর্মের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। পাল রাজাদের আমলে (৭৫০-১২০০) বৌদ্ধধর্মই ছিল বাংলার প্রধান ধর্ম। বৈদিক’ বা ‘ব্রাহ্মণ্য’ ধর্মে বিশ্বাসী লোক ছিল বিরল। এক পর্যায়ে বৌদ্ধধর্ম বড় দুটো মতে বিভক্ত হয়। এই দুটো মত হচ্ছে ‘মহাযান’ ও হীনযান’। এই বিভক্তির পথ ধরেই বাংলায় ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মের’ অনুপ্রবেশ ঘটে। পাল আমলের শেষের দিকে ‘ব্রাহ্মণ্য’ ধর্ম ধীরে ধীরে শিকড় গাড়তে শুরু করে। সেনরা (একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী) এসে এতে মদত দেয়। এইসময়েই বাংলায় ইসলামের আগমন (১২০৩-৪)। ঘটনা পরম্পরায় বাঙালি জনসাধারণ দুটো প্রধান ধর্মীয় শিবিরে বিভক্ত হতে থাকে। এই দুটো প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে একটি ইসলাম এবং অন্যটি ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্ম।
বলা বাহুল্য দুটোরই নিকট অতীত বৌদ্ধ অতীত। কিন্তু এই সহজ সত্যটি দুই সম্প্রদায়ের কেউ স্বীকার করতে চায় না। একটি মনে করে তাদের পূর্বপুরুষরা আরব- তুরস্ক-ইরানের লোক, অন্যটি মনে করে তারা বহিরাগত আর্যদের বংশধর। এই বিশ্বাস যে কত অনৈতিহাসিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বলা বাহুল্য দুই ধর্মে বিভক্ত হওয়ার পূর্বে এই অঞ্চলের মানুষ বহু দিন নানা ধৰ্মীয় মতের সাধনা-ভজনা করেছে। এমনকি এক পর্যায়ে এ অঞ্চলের জনসাধারণ যুক্ত বা মিলিত সাধনার চেষ্টাও করেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব হ্রাস ও বিভক্তির প্রেক্ষাপটে বাংলা অঞ্চলে কয়েক শতাব্দীব্যাপী বেশ কয়েকটি উদার ও সমন্বয়পন্থী ধর্মমত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ১. নাথধর্ম ও ২. বৈষ্ণবধর্ম।
লক্ষ করা যায় নাথধর্মটি পাল আমলের শেষার্ধে বৌদ্ধদের বিভক্তির সুযোগে প্রবল হয়। সেন আমলে ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রবল হলে তা পেছনে পড়ে যায়। ব্রাহ্মণ্যধর্ম বাংলার সমাজকে নানা শ্রেণিতে ভাগ করে জন্ম দেয় জাতি (কাস্ট) ভিত্তিক এক ধর্মের। ঘটনাক্রমে পরবর্তীকালে এর নাম হয় হিন্দুধর্ম। মুসলমান আগমনের পর সাধারণ লোকেরা ইসলামের দিকে আকর্ষিত হতে থাকলে জাতভিত্তিক ধর্মের বিরুদ্ধে পঞ্চদশ শতাব্দীতে গড়ে ওঠে বৈষ্ণব আন্দোলন। আরও পরে গড়ে ওঠে আউল-বাউল ধারা ও অতি আধুনিক কালের ‘ব্রাহ্ম’ ধর্ম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই মতগুলো দুটো বড় ধর্মের একটিকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। নিচে প্রবল নাথধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম ও অন্যান্য সমন্বয়পন্থী ধর্মের বিকাশ ও বিলুপ্তি কিভাবে সম্ভব হল তা সংক্ষিপ্তভাবে আলোচিত হল:
১. নাথধর্ম : নাথধর্মটির ব্যাপ্তিকাল মোটামুটিভাবে সপ্তম শতাব্দী থেকে একাদশ- দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। ড. মুহম্মদ শহীদুলাহর মতে (শহীদুলাহ রচনাবলী : সম্পাদনা আনিসুজ্জামান : বাংলা একাডেমী : ১৯৯৫) নাথপন্থার আদিগুরু বা প্রবর্তক মীননাথ। মীননাথ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম লেখক। তাঁর মতে মীননাথ সপ্তম শতাব্দী অথবা তার আগের লোক। মীননাথ ছিলেন বাঙালি। তিনি মীনপাদ, মৎস্যেন্দ্রনাথ, মচ্ছিন্ন্দ্রনাথ, মৎস্যেন্দ্র পাদ ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
নাথপন্থা বৌদ্ধ সহজযান থেকে উদ্ভূত অথবা তার দ্বারা প্রভাবান্বিত। নাথরা শিবানুসারী। আদিনাথ হচ্ছেন শিব। প্রথমে নাথদের প্রধান দেবতা ছিল নিরঞ্জন বা শূন্য। পরে নিরঞ্জন শিবের সাথে যুক্ত হয়। ড. শহীদুলাহর মতে নাথধর্ম একসময় সমগ্র ভারতবর্ষে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। মীননাথ বাঙালি হওয়ায় ড. শহীদুলাহ গর্ব করে বলছেন : “বাঙালির ইহা একটি গৌরবের বিষয় যে একজন বাঙালি গোটা ভারতবর্ষকে একটি ধর্মমত দিয়েছিলেন। “
নাথপন্থা ও চর্যাপদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মতে (বাংলার নাথ সাহিত্য : সুবর্ণরেখা : কলকাতা ১৪০১) চারজন প্রধান নাথ সিদ্ধার মধ্যে আছেন কাহ্নপা (কানু পা) এবং মীন নাথ। কাহ্নপার বহু গীতি চর্যাপদে পাওয়া যায়। তা ছাড়া চর্যাগীতির টীকায় মীন নাথের লেখা একটি চর্যাগীতির কিয়দংশ উদ্ধৃত হয়েছে। অধিকন্তু কোনো কোনো চর্যাগীতিতে নাথদের অন্যতম সিদ্ধা জালন্ধরি পা’র উল্লেখ পাওয়া যায়।
একই প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় (বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা : ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানী : তৃতীয় সংস্করণ : ১৯৬৭) বলছেন : নাথ সাহিত্য ভাবের দিক দিয়ে চর্যাপদের সহিত সম্পর্কিত। নাথ সাহিত্য ও চর্যাপদ এই উভয় ধারাতেই সিদ্ধদিগের কয়েকটি সাধারণ নাম পাওয়া যায়। এই ঘটনা দ্বারা দু’য়ের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তা প্ৰমাণিত হয়।
এদিকে ক্ষেত্র গুপ্ত (বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস : গ্রন্থ নিলয় : কলকাতা, ১৯৯৮) নাথধর্ম সম্বন্ধে বলছেন : এই সাধন পদ্ধতিটি সুপ্রাচীন অর্থাৎ তুর্ক বিজয়ের পূর্ব কালেই প্রতিষ্ঠিত। ভারতের ব্যাপক অংশে এটি ছিল শ্রদ্ধেয়। ড. দীনেশ সেনের বক্তব্য আরও পরিষ্কার। তাঁর মতে (বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য: প্রথম খণ্ড : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ) নাথধর্ম বৌদ্ধ ও শৈবধর্মের শ্রেষ্ঠ উপকরণে গঠিত। কলকাতার কালীঘাট মন্দির নাথসিদ্ধা গোরক্ষনাথ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলে তিনি মনে করেন। এ দিকে কলকাতার চৌরঙ্গি অঞ্চলের নামটিও যে নাথসিদ্ধা চৌরঙ্গি নাথের অনুকরণে তাও সকলের জানা। কলকাতা শহরের এই দুটো প্রধান উদাহরণ নাথদের এককালীন প্রসিদ্ধির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
হজারী প্রসাদ দ্বিবেদীর মত (আলোক পর্ব: সাহিত্য একাদেমি : ১৯৯৪) এখানে উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতে ৮ম ও ৯ম শতাব্দীর দিকে বৌদ্ধধর্ম তন্ত্র ও যোগের দিকে ধাবিত হয়। পরে শৈব যোগী অর্থাৎ ‘নাথ’রা যখন প্রবল হয় তখন বৌদ্ধতন্ত্র এর সাথে মিশে যায়। এদিকে গোপাল হালদার (বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা: প্রথম খণ্ডঃ অরুণা প্রকাশনী : ১৪০৪) মনে করেন নাথযোগী ও সিদ্ধাচার্য্যদের কথা বাংলা সাহিত্যের জন্মকথার সাথে জড়িত। তাঁর মতে অবহট্টের নতুন ঐতিহ্য তারাই সৃষ্টি করেন। এদের ভাবলোক ছিল আর্যদের ভাবলোক থেকে পৃথক। সরল জীবন ছিল তাদের লক্ষ্য। বাংলা সাহিত্যের জন্মের সাথে জড়িত এই সম্প্রদায়টি ছিল স্বাধীন চেতা। এই কথাই উল্লেখ করেছেন ড. খান। ড. আকবর আলী খান তাঁর গ্রন্থে (ডিসকভারি অব বাংলাদেশ : এপ্লোরেশানস ইনটু ডিনামিকস অব এ্যা হিডেন নেশান: ইউনিভার্সিটি প্রেস লি: ঢাকা : ১৯৯৬) বর্তমান বাংলাদেশ কেন মুসলমান সংখ্যা-গরিষ্ঠ তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি নাথধর্মের স্বাধীন চিন্তা এবং এই অঞ্চলের নাথদের প্রসিদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন।
ওপরের আলোচনা থেকে বলা যায় বৌদ্ধধর্মের পরে এক সময় নাথধর্ম বাংলার প্রধান ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়। কুমিল্লার ময়নামতী এই নাথধর্মের প্রভাবের একটি বড় সাক্ষ্য। ময়নামতী ছিলেন নাথপন্থী। এই ধর্মমতটি একসময় সাবেক পূর্ববাংলা ও উত্তরবাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ময়নামতীর গান গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও উত্তর ভারতে ব্যাপক প্রচার লাভ করে। জনপ্রিয়তার দিক থেকে ময়নামতীর গান আধুনিকালের রামায়ণের জনপ্রিয়তা থেকে কম ছিল না। শৈব এই ধর্মমতটি শিবকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠার ফলেই যে এই জনপ্রিয়তা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শিব আর্যদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে একটি লোকশক্তি। সমতল সমাজে বিশ্বাসী এই ধর্মমতে কায়ার মাধ্যমে সিদ্ধি লাভের কথা বলা হয়েছে। এখানে সাধারণ মানুষের স্থান ঊর্ধ্বে। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখকে আশ্রয় করেই ‘চর্যাপদ’ও রচিত হয়েছে। বস্তুত নাথধর্মের চূড়ান্ত বিকাশের সময়েই চর্যাপদ রচিত হয়। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম প্রক্রিয়ায় এই উদার ও সমন্বয়পন্থী ধর্মমতটি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়। কিন্তু বিলুপ্তি প্রক্রিয়ায় তার বিশ্বাস ও ধারণাগুলো নিঃশেষিত হয় নি। প্রকৃতপক্ষে আজকের হিন্দুধর্মে তার বিশ্বাসগুলো দৃঢ়মূল হয়ে আছে। প্রথমে বুদ্ধ ও পরে শিবকে কেন্দ্র করে যে নাথধর্মের সৃষ্টি তা বাঙালি হিন্দু সমাজে পরবর্তীকালে শিবের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেষ হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে (সাহিত্য : বিশ্বভারতী : ১৪০১) বলছেন : বেদে শিবের আধিপত্য ছিল না। বেদে আধিপত্য ছিল ইন্দ্র ও বরুণ ইত্যাদি দেবতার। এক পর্যায়ে এই দেবতাগণ ছায়ার মত অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। আরো পরবর্তী পর্যায়ে ‘ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর’ এই তিন মূর্তির কল্পনা করা হয়। উদ্দেশ্য আর্য ও ভূমিপুত্রদের মিলন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতে হিন্দু এখানেও স্থির থাকে নি। দেখা যায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরে ক্ষণে ক্ষণে দ্বন্দ্ব হচ্ছে। আবার মিলনও হচ্ছে। এই দৈব সংগ্রামের এক পর্যায়ে ব্রহ্মা সর্বপ্রথম হিন্দুর পূজা গৃহ থেকে দূরে আশ্রয় নেন। বহু রূপের মাধ্যমে বিষ্ণু নিজের দাবি রক্ষা করতে ব্যস্ত হন। তাঁর মতে এক সময়ে মহেশ্বর (শিব) অধিকাংশ ভারত অধিকার করে নেন।
শিবের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিকই, কিন্তু শিবরূপী শক্তি ও তাঁর সাথে সংশিষ্ট দেব-দেবীকে সমাজের ওপরের শ্রেণির হিন্দুরা (বিশেষ করে শাক্ত হিন্দুরা) গ্রহণ করে সামাজিক ও ধর্মীয় অসাম্যের সূত্রপাত করে। লক্ষণীয় জমিদারি প্রথার উদ্ভব, শাক্তদের উত্থান ও জন্মগত জাতিভেদ (কাস্ট) প্রথার সর্বগ্রাসী রূপ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই তিন শক্তির বদৌলতে হিন্দু সমাজ একটি সামাজিক কারাগারে পরিণত হয়। পরিণামে বিলুপ্তির মাধ্যমে নাথপন্থাটিও হিন্দুধর্মের অঙ্গীভূত হয়।
২. বৈষ্ণব ধর্ম : নাথধর্মের বিলুপ্তি প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে বাংলায় জন্ম লাভ করে বৈষ্ণব ধর্ম। শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) এই বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত, যদিও বৈষ্ণবধর্মের মূল কথা ভক্তি দক্ষিণ ভারতে বহু পূর্ব থেকেই জনপ্রিয় ছিল। সে যাই হোক শ্রীচৈতন্য ভক্তির দ্বারা হিন্দুদেরকে সামাজিক কারাগার থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। অভূতপূর্ব এই বৈষ্ণব আন্দোলনের ফলে সমাজের উঁচু-নিচু ভেদাভেদ আর থাকে না। উঁচু-নিচু ভেদাভেদ বিহীন সমাজের যে আকুতি নাথধর্মের মধ্যে প্রবল ছিল, বৈষ্ণবধর্ম সেই চেতনাকে অবলম্বন করে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। কিন্তু চৈতন্যদেবের ভক্তি অথবা সমান সমাজের আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত শাক্তদের প্রতিরোধের কারণে ব্যর্থ হয়। অবশ্য এই প্রক্রিয়ায় রাম ও কৃষ্ণ ‘অবতারবাদের’ মাধ্যমে লাভ করেন দেবত্ব। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যে বিষ্ণু নানা আকারে টিকে থাকার চেষ্টা করছিলেন, সেই বিষ্ণু ‘অবতার’ হিসেবে শেষ পর্যন্ত রাম ও কৃষ্ণে আশ্রয় নেন।
ড. দেবকুমার দাসও এই মত সমর্থন করেন (সংস্কৃত সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত : সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার : ১৪০৪)। তাঁর মতে রাম প্রথমে ছিলেন বীর, পরে তাঁকে অবতার বানানো হয়। আরও পরে তাকে বিষ্ণুর অবতার করা হয়। রামকে দেবতা বানানোর প্রক্রিয়ায় শাক্তরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শিব ও শক্তি ছিল একত্রে। ব্রাহ্মণ্য সমাজ শিব থেকে শক্তিকে আলাদা করে এই সময়ে গড়ে তুলে শাক্তধর্ম।
‘শাক্ত’ মত ‘শৈব’ মত থেকে ভিন্ন। শাক্তরা আবার প্রচণ্ড বৈষ্ণব’ বিরোধীও। শাক্তধর্ম ভেদকে প্রাধান্য দিয়েছে বলে রবীন্দ্রনাথও মনে করেন। এই শাক্ত মতকেই মদত দেয় বাংলার জমিদার ও সামন্ত প্রভু শ্রেণি। তাদের সমর্থন ও সহযোগিতায় শাক্ত মত সমাজের উচু শ্রেণি অর্থাৎ ‘ভদ্রলোকদের’ মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। দুর্গা পূজায় পশুবলীর প্রবর্তন তাদেরই কীর্তি।
শাক্তমতকে প্রতিষ্ঠিত করতে জমিদার ও ভদ্রলোকদের প্রচেষ্টায় শাসক শ্রেণি ও পুরোহিত শ্রেণি সহযোগিতা করে। রমাকান্ত চক্রবর্তী এটি লক্ষ করে তাঁর গ্রন্থে (বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম : আনন্দ পাবলিশার্স : ১৯৯৬) বলছেন : বাংলার সুলতান ও তাদের প্রতিনিধিগণ স্মার্ত হিন্দুধর্মের (আর্যধর্ম) বিরোধিতা করেন নি। স্মার্ত কর্মকাণ্ড ও সুলতানের স্বৈরাচারী শাসন একে অপরের পরিপূরক ছিল। তিনি আরও বলছেন যে, ভট্টাচার্য্যি ব্রাহ্মণরা বৈষ্ণব আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করে। বলা বাহুল্য এই ভট্টাচার্য্যিরাই স্মার্ত ধর্ম (বৈদিক ধর্ম) প্রচার করে। এদিকে গড়ে উঠতে থাকে অনেক শাক্ত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোও শাক্ত মত দৃঢ়মূল করতে এক জোরালো ধর্মীয় ভূমিকা পালন করে।
বর্তমান কালের ‘লোকনাথ’ আশ্রমের এককালীন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকাস্থ শক্তি ঔষধালয়ের মালিক দিগিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী। তিনি বৈষ্ণব মতকে ( সিদ্ধ জীবনী : শ্রীমদ ব্রহ্মানন্দ ভারতী : প্রকাশক : দিগিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী ৪র্থ পরিবর্ধিত সংস্করণ : কলকাতা : ১৯৮২) শাস্ত্র বিরুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে ব্রাহ্মণদেরকে অন্ধভক্তি অর্থাৎ বৈষ্ণব ধর্ম থেকে মুক্ত থাকতে আহ্বান জানান। হিন্দুর চার বর্ণ রক্ষার সংগ্রামে ব্রাহ্মণদের আত্মনিয়োগ করতেও তিনি পরামর্শ দেন। এই উদাহরণ দুটো থেকেই বোঝা যায় শাক্তরা কিভাবে বৈষ্ণব আন্দোলনের বিরোধিতা করে। বলা বাহুল্য এদের এই কর্মকাণ্ডের পরিণতিতেই হিন্দু সমাজ আজ রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত এক অচলায়তনে পরিণত হয়েছে।
৩. অন্যান্য উদার ও সমন্বয়পন্থী ধর্ম : নাথ ও বৈষ্ণবধর্মের পরবর্তী উদার ও সমন্বয়পন্থী ধর্ম, যথা: আউল চাঁদের (১৬৯৪-১৭৭০) ‘কর্তাভজা’, অষ্টাদশ শতাব্দীর ‘ব্রাহ্মধর্ম’, আউল-বাউল পন্থা, হরিচাঁদ ঠাকুরের ‘মতুয়াধর্ম’ এবং নানা নামীয় উদার ও সমন্বয়পন্থী সাধনার পরিণতিও একই হয়। প্রথমেই আসা যাক ‘কর্তাভজা’ প্রসঙ্গে। আমরা জানি অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু করে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ‘কর্তাভজা’ নামে একটি শক্তিশালী সমন্বয়পন্থী ধর্ম বাংলায় জনপ্রিয় ছিল। এটি মূলত ‘সহজিয়া’ সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত। সহজিয়া সম্প্রদায় একসময় আউল, বাউল, সাঁই, দরবেশ, নেড়া, সহজিয়া প্রভৃতি বহুভাগে বিভক্ত হয়। এ ছাড়াও সহজিয়াদের মধ্যে ছিল কর্তাভজা, স্পষ্টদায়ক, সখীভাবক, কিশোরী ভজনী, রামবলভি, জগম্মোহিনী, গৌড়বাদী, সাহেবধানী, পাগলানাথি, গোবরাই প্রভৃতি। এ সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত কয়েকটি জনপ্রিয় ছিল। এর মধ্যে ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে (বাংলাদেশের ইতিহাস : মধ্যযুগ) কর্তাভজা সম্প্রদায় উনিশ শতকের প্রথমেও জনপ্রিয় ছিল।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মতে শ্রীচৈতন্যই আউল চাঁদরূপে পুনরায় জন্মগ্রহণ করে। তিনি ‘গুরু সত্য’ এই মত প্রচার করেন। এটি সহজধর্ম বা সত্যধর্ম বলে পরিচিত। গুরুসেবাই ‘কর্তাভজা’। এই সম্প্রদায়ে জাতিভেদ ছিল না। হিন্দু-মুসলমান উভয়ই একসাথে অন্নভোজন করত। স্ত্রী পুরুষ একসাথে উপাসনা করত। ড. মজুমদার লিখছেন :
“কর্তাভজা সম্প্রদায় আউলচাঁদ নামক এক সাধু অষ্টাদশ খ্রীস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নদীয়া জিলার নানা স্থানে ইহা প্রচার করেন। ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হইলে নৈহাটির নিকট ঘোষপাড়া নিবাসী সদ্গোপ জাতীয় রামশরণ পাল ইহার কর্তা হন। তিনি জাতিভেদ মানিতেন না এবং হিন্দু মুসলমান উভয়ই তাঁহার শিষ্য ছিল। এই সম্প্রদায়ের লোক কর্তা বা গুরুকে সাক্ষাৎ ভগবান বা কৃষ্ণ বলিয়া মনে করিত এবং তাহাকেই ইষ্টদেবতা জ্ঞানে পূজা করিত। ক্রমে এই সম্প্রদায়ের খুব সমৃদ্ধি হয় ও ভক্তের সংখ্যা অসম্ভব বৃদ্ধি হয়। এই দলের মধ্যে নিম্নজাতীয়া স্ত্রীলোকের সংখ্যাই ছিল খুব বেশি এবং গোপীরা কৃষ্ণকে যেমন ভাবে কায়মনপ্রাণে ভজন করিত ইহারাও সেইরূপ করিত। ঘোষপাড়ার মেলায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হইত, ইহার মধ্যে স্ত্রীলোকের সংখ্যাই ছিল অত্যন্ত অধিক। ঊনবিংশ শতাব্দীতেও রামশরণ পালের পুত্র রামদুলাল পালের অধ্যক্ষতায় এই সম্প্রদায় খুব প্রভাবশালী ছিল কিন্তু ঐ যুগের নীতির আদর্শ অনুসারে ইহাদের নীতি ও আচরণ খুব নিন্দনীয় বলিয়া পরিগণিত হইল। ইহার ফলে এই সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি নষ্ট হয়।
এবারে আসা যাক ‘ব্রাহ্মধর্মে’। আমরা জানি ‘ব্রাহ্মধর্মের’ মাধ্যমে অষ্টাদশ শতাব্দীতে রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) হিন্দুধর্ম ও সংস্কারের ওপর কঠোর আঘাত হানেন। তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, পৌত্তলিকতা বর্জন ও একেশ্বরবাদ হিন্দু শাস্ত্রসম্মত। তিনি যুক্তিবাদ ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেন এবং শাস্ত্রবিধি ও সামাজিক অনুশাসন যুক্তি ও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিপরীত হলে সেগুলো অমান্য করার নির্দেশ দেন। তাঁর ধর্মটি শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র একটি ধর্মে পরিণত হয়। তাঁর মতে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই শ্রেষ্ঠ। সুতরাং দেবদেবীতে বিশ্বাস ও প্রতিমা পূজা করা হিন্দুধর্ম বিরোধী। তিনি বেদান্তের ভাষ্য রচনা করেন। তিনি ‘ব্রহ্মসভার’ আয়োজন করেন যাতে বেদপাঠ ও ব্যাখ্যা, শাস্ত্র আলোচনা ও ব্রহ্মসঙ্গীত হতো। তিনি অবশ্য বিশিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠায় রাজি ছিলেন না। তাঁর ব্রহ্মসভায় ও উপাসনায় হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদি সবাই যোগ দিতে পারত। স্থির ছিল সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরের উপাসনায় জাতিধর্ম নির্বিশেষে মন্দিরে ঢুকতে পারবেন। উপাসনায় কোনো সাম্প্রদায়িক নামে ভগবান উপাসনা হবে না, মূর্তি ব্যবহৃত হবে না, প্রাণি হিংসা হবে না, পাণভোজন হবে না, কোনো সম্প্রদায়ের উপাস্যকে বিদ্রূপ করা যাবে না। সদগুণের বিকাশে বক্তৃতা, প্রার্থনা ও সঙ্গীত হবে। প্রথমদিকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবি ঠাকুর, কেশব সেন ও পরে সত্যজিত রায়, নীরদ সি চৌধুরী, ড. নীহার রঞ্জন রায় থেকে শুরু করে বহুগণ্যমান্য ব্যক্তি ব্রাহ্মসমাজী হন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ‘ব্রাহ্মধর্ম’ দ্বিধাবিভক্ত হয়। বর্তমানে কয়েকজন ব্যক্তি অনুসারী ছাড়া এই ব্রাহ্মধর্মের কোনো সাধারণ অনুসারী নেই। যারা আছেন তারাও আজ নিজেদেরকে হিন্দু হিসেবে পরিচয় দেন।
সমন্বয়পন্থী সাধনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লালনের ধারা। লালন সমাজের ধর্মীয় বিভক্তির ঊর্ধ্বে ওঠে মানুষের জয়গান করেন। করারই কথা। কারণ দেখা যায় এই লালনের (১৭৭৪-১৮৯০) জন্ম কুষ্টিয়া জেলার এক হিন্দুর ঘরে। তাঁর বাবার নাম মাধব কর, মা পদ্মাবতী। ছোট বেলায় তিনি অনাথ হন। তীর্থপথে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় লালন পথিমধ্যে সহযাত্রীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হন। পরে নিজ বাড়িতেও তিনি পরিবার-পরিজন ও সমাজ কর্তৃক বর্জিত হন। কারণ এক মুসলমান জোলা (তাঁতী) মহিলা তাঁকে বসন্ত রোগক্রান্ত অবস্থায় পুত্রবৎ লালন-পালন করে বাঁচিয়ে তোলেন। বলা হয় এতে তাঁর জাত গেছে। এই ঘটনা দ্বারা বোঝা যায় জোলা মহিলার যে মানবিক গুণ ছিল ব্রাহ্মণ্য সমাজে তা ছিল অকল্পনীয়। নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনে সমাজ সর্বনিম্ন মানবিক মূল্যবোধটুকু পর্যন্ত হারায়। এটি নিশ্চিতভাবেই উদারপন্থী ধর্মমতগুলোর বিলুপ্তির কারণেই সম্ভব হয়েছিল। তবু লালন সেই উদার পথেরই পথিক হন। কী ছিল লালনের এই উদার ধর্মে? লালন জাত সম্পর্কে বলছেন : “সবলোকে কয় লালন কী জাত সংসারে? লালন ভাবে, জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে। দেহ আত্মা সম্বন্ধে লালন বলছেন: “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়! ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়। লালন কয়-খাঁচা খুলে সে পাখি কোনখানে পালায়” (লালন সাঁই : হায়াৎ মামুদ: বাংলাদেশ শিশু একাডেমী : ১৯৯১)। বলা বাহুল্য লালনের এই উদার আহ্বানও সমাজ গ্রহণ করে নি।
জাত-পাত বিরোধী উদার আর একটি প্রভাবশালী আন্দোলনের ফল হচ্ছে ‘মতুয়াধর্ম’। ‘বাংলাপেডিয়ার’ ‘ লোয়ার কাস্টস মুভমেন্ট’ শিরোনামীয় একটি নিবন্ধে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ বাংলার তথাকথিত নমঃশূদ্ররা আত্ম-সান রক্ষার জন্য ব্রিটিশ আমলে নানাভাবে সংগঠিত হয়। সহজ ও সরল ভক্তির কথা বলে তখন কেশব পাগল অথবা শাহলাল পীর হিন্দুর জাত-পাতকে চ্যালেঞ্জ করেন। ১৮৭২-৭৩ সালে ওই অঞ্চলের তথাকথিত নমঃশূদ্ররা দ্বারকানাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে একতাবদ্ধ হয়ে তথাকথিত উঁচু জাতির হিন্দুদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ‘বয়কট’ করে। এই আন্দোলনের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠে ‘মতুয়াধর্ম’। এর নেতা শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি হিন্দু সমাজের জাত-পাতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন এবং এই অমানবিক প্রথা বিলোপের সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি পুরুষ ও মহিলার সমানাধিকারে বিশ্বাস করতেন। তাঁর বাণী ‘হাতে কাম, মুখে নাম’। এই সমাজের আর এক গুরুর নাম হরিচাঁদ ঠাকুর। রত্নেশ্বর সরকার ও নেপাল কৃষ্ণ রায়ের ‘মতুয়া সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ সমীপেষু’ শিরোনামীয় এক পুস্তিকা (১৯৯০) থেকে দেখা যায় মতুয়া মতবাদীরা আস্তিক্য দর্শনে আস্থাশীল। তারা অবতারবাদ ও স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস করে। আত্মার অস্তিত্ব জন্মান্তরবাদ ও কর্মফল তত্ত্বেও বিশ্বাসী। ব্রহ্মচর্য ও অহিংসায় তাদের অবিচল বিশ্বাস। এ সমাজের বর্তমান নেতারা পূর্ববর্তীদের মতই সামাজিক কুসংস্কারমুক্ত হিন্দুসমাজ গঠনে ব্রতী ও আন্দোলনরত। এখানে উল্লেখ্য একই সময়ে তথাকথিত নিচু জাতির মধ্যে জনপ্রিয় আর একজন ধর্মীয় নেতা ছিলেন প্রভু জগদ্বন্ধু (১৮৭১-১৯২১)। তিনিও হিন্দুসমাজকে উদার করার ব্রতে আত্মনিয়োগ করেন।
বলা বাহুল্য এসব আন্দোলনের ফলাফল খুব সামান্য। অশোক মিত্র এটি লক্ষ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর প্রবন্ধে (ভারতের প্রশাসন : স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে : গ্রন্থ : স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : প্রবন্ধ সংগ্রহ : মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স) বলছেন : বর্ণা-শ্রমধর্মী উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সামাজিক, ধর্মীয়, আর্থিক ও উৎপাদিকা শক্তি দ্বারা সমন্বয় ধর্মের আন্দোলনকে একে একে নির্বাসিত করেন। এতে গুরু নানকের (১৪৬৯-১৫৩৮) শিখ ধর্ম ছাড়া, এমনকি চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব আন্দোলনও উৎপাটিত হয়। বলা বাহুল্য একইভাবে রাজা রামমোহন রায় ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরদের অতি আধুনিক ‘ব্রাহ্ম’ ধর্মেরও বিলুপ্তি ঘটে।
সমন্বয়পন্থী ও উদার মতগুলোর পরিণতি দেখে মনে হয় উদারতার শক্তির চেয়ে বৈষম্যের শক্তি অনেক বেশি প্রভাবশালী। তাই বৈষম্যের শক্তিকে পরাস্ত করতে হলে একমাত্র ধর্মীয় আন্দোলন যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি দরকার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। এক ব্যক্তির এক ভোট এ ক্ষেত্রে হতে পারে বড় অস্ত্র। এই অস্ত্রটি তখনকার আমলে ছিল না। এটির অনুপস্থিতির সুযোগে এদেশের রাজন্যবর্গ, সামন্তশ্রেণি, জমিদার ও বৈষম্যকামী উঁচু শ্রেণির হিন্দুরা সমন্বয়ের সকল পথ রুদ্ধ করে এসেছিলেন।
পরিশেষে প্রশ্ন: সমন্বয়পন্থী ধর্মের বিলুপ্তির পরিণাম কি? পরিণাম স্পষ্টতই দুটো যথা: ক. জাতি (কাস্ট) ভিত্তিক হিন্দু সমাজ গঠন ও খ. ইসলাম ধর্মের সামাজিক ভিত্তি প্রাপ্তি। এই পরিণাম রচনায় হিন্দুদের দৈব সংগ্রাম’ও একটি ভূমিকা পালন করে। এই দৈব সংগ্রামটি ছিল : ক. শিব-বুদ্ধ বনাম রাম-কৃষ্ণ, খ. শিব-বুদ্ধ বনাম লোকায়ত দেব- দেবী এবং গ. রাম-কৃষ্ণ বনাম লোকায়ত দেব-দেবীর সংগ্রাম। মনে হয় সমন্বয়পন্থী ধর্মের বিলুপ্তি, জাতিভিত্তিক হিন্দু সমাজ গঠন ও দেব-দেবীর উপরোক্ত সংগ্রাম, সংঘর্ষ ও মিলনের প্রেক্ষাপটেই মুসলমান শাসন আমলে বাংলা দুই বড় ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমানে বিভক্ত হয়।
কেউ কেউ বলেন, ‘অন্ত্যজ’ শ্রেণির হিন্দু থেকেই মুসলমানের সৃষ্টি। কিন্তু প্রশ্ন, এই অন্ত্যজ শ্রেণি কি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ছিল? দেখা যায় প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধদেরকেই ‘ব্রাহ্মণ্য’ সমাজ ‘অন্ত্যজ’ বা ‘ব্রাত্য’ ইত্যাদি নামে ডাকত। প্রকৃতপক্ষে চার বর্ণের হিন্দু সমাজে ঢুকতে অনিচ্ছুক ছিল বলেই এদেরকে অন্ত্যজ বা ব্রাত্য বলা হতো। কাজেই এদেরকে হিন্দু বলা ঠিক নয়। অধিকন্তু হিন্দু কর্তৃক মুসলমানদেরকে দেয় গালি ‘ন্যাড়া’ নামের ইতিহাস খুঁজলেও দেখা যায় ব্রাত্যরাই ন্যাড়া। আমরা জানি মাথা ‘ন্যাড়া’ বৌদ্ধদেরকেই হিন্দুরা ‘ন্যাড়া’ নামে আখ্যায়িত করত। পরবর্তীকালে তারা মুসলমান হলেও নামটি অপরিবর্তিত থেকে যায়। প্রশ্ন: কি কারণে অন্ত্যজ শ্রেণির লোকেরা ধর্ম পরিবর্তন করল? এর একটা ইঙ্গিত ‘শূন্য পুরাণে’ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে দেখা যায় তৎকালীন প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সমাজ ব্রহ্মাকে দেখছে ‘মহদ’ রূপে, বিষ্ণুকে পয়গম্বর, শিবকে আদম, গণেশকে গাজী, কার্তিককে কাজী, ঋষিকে ফকির এবং ইন্দ্রকে মৌলানা হিসেবে। এই বর্ণনাতে যে ধর্মীয় পরিবেশের ইঙ্গিত রয়েছে তাতে বোঝা যায় হিন্দুর ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব ইত্যাদি দেবতাদের প্রত্যেকের স্থলে বৌদ্ধদের একটি করে বিকল্প আছে। এই বিকল্পের পথই অন্ত্যজ-ব্রাত্য শ্রেণির লোকেরা বেছে নেয় বলে মনে হয়। ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ’ এই বিকল্পটি সে গ্রহণ করে নি। কারণ তার কাছে ধর্মীয় সামাজিক সমানাধিকারের প্রশ্নটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই সত্যটি উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
শুধু কি ‘ব্রাত্যরাই’ মুসলমান হয়েছে? নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এ কথাটি বলা হয় না। ইতিহাসে দেখা যায় ব্রাহ্মণাদি জাতি থেকে মুসলমান হয়েছে অগণিত লোক বিরাট হিন্দু সমাজে তথাকথিত বর্ণহিন্দুর সংখ্যা কম-বেশি দশ শতাংশ। বাকি নব্বই শতাংশই হচ্ছে তথাকথিত অবর্ণ হিন্দু। কাজেই ধর্মান্তরিত মুসলমানের সংখ্যায় ব্রাহ্মণাদি জাতির হিন্দুর সংখ্যা শতাংশের হিসেবে কম হওয়াই স্বাভাবিক। সংখ্যায় কম হলে কি হবে, উদাহরণে বড়।
যেমন মুসলমান তানসেন, কালা পাহাড় ও মুর্শিদকুলী খান থেকে শুরু করে অগণিত প্রভাবশালী ব্যক্তির পূর্বপুরুষ ছিলেন ব্রাহ্মণ। এদের মধ্যে কালা পাহাড়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি কিভাবে অগণিত ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করেন তার বর্ণনা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে জন্মলাভকারী এই কালা পাহাড়ের প্রকৃত নাম কালাচাঁদ রায়। ভাদুড়ী বংশের এই ব্রাহ্মণ সন্তানের পিতার নাম নয়নচাঁদ রায়। তার পিতৃকুল ছিল শাক্ত, আর মাতৃকুল বৈষ্ণব। ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি মুসলমান শাসক গৌড়েশ্বরের মেয়েকে বিয়ে করেন। তথাকথিত বর্ণহিন্দুদের বিখ্যাত ব্যক্তিরা শুধু ইসলামই গ্রহণ করে নি, তারা ইংরেজ আগমনের পরে অনেকে খ্রিস্টানও হয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও মাদার টেরিজার সংগঠন অর্থাৎ ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ’ এর বর্তমান (২০০১) প্রধান সিস্টার নির্মলা (চ্যাটার্জি) এর মধ্যে দুটো বড় উদাহরণ। মনে হয় তাদের দৃষ্টান্ত অন্যদের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।