সব গাছে পাখি ডাকে (১৯৭৭)
সের্গেই দ্রুগাল। অনুবাদ : সৌভিক চক্রবর্তী
নতুন গ্রহটার বুকে এসে নেমেছিল ওদের রকেট-শিপ। অধৈর্যভাবে পাইলটের হাতের কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিল লেইটার। রকেটের ধাতব দেহ এবং নিচের জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া জমি তখনও পুরোপুরি ঠান্ডা হয়নি।
“তারপর, কী বুঝছ?” জানতে চাইল লেইটার।
অনেকগুলো টেস্টের রিপোর্ট ছাপা কাগজের ফিতেটা মুড়িয়ে রেখে কাঁধ ঝাঁকাল পাইলট ওয়ের্গ।
“নতুন কিছু নয়। গ্রহটার পরিবেশ অনেকটা আমাদের পৃথিবীরই মতো।”
“তুমি আগেও এখানে এসেছ, তাই না?”
“হ্যাঁ, নতুন গ্রহের খোঁজে বেরোনো কয়েকজন অভিযাত্রীর সঙ্গে এসেছিলাম,” জবাব দিল ওয়ের্গ, “কিন্তু নামিনি।”
বোতাম টিপে পোর্টহোলের শাটারগুলো খুলে দিল ও, তারপর আবার বলতে লাগল, “অনেকটা পৃথিবীরই মতো, কিন্তু যেহেতু এখানকার উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগৎ সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না, তাই আপনাকে অনুরোধ করব…”
“বুঝেছি।” মুখ বেঁকিয়ে পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করল লেইটার। সূচের ঢাকনা খুলে প্লাঞ্জারে চাপ দিতেই কয়েক ফোঁটা তরল চলকে বাইরে পড়ল। বাকি ওষুধটুকু বাঁহাতের বুড়ো আঙুলে ইঞ্জেক্ট করে ও সিরিঞ্জটা ছুঁড়ে ফেলে দিল, তারপর উঠে দাঁড়াল।
“চলো, এবার বেরোনো যাক।”
রকেট-শিপের হ্যাঁচ খুলে মসৃণ ধাতুর তক্তা নামিয়ে দিল ওয়ের্গ। মালপত্র বোঝাই রোভার আনত-তল বেয়ে গ্রহের মাটি ছুঁল। তারপর নামল লেইটার, হাতের বন্দুক উঁচানো, চোখের দৃষ্টি সজাগ। গ্রহটাকে দেখে ওর পৃথিবীর কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওরা যেখানে নেমেছিল সেই অঞ্চলটা চারপাশে ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। অদূরে একটা ছোটো ঝিল, তার জলের ওপর সাদা ফুল ভাসছে। পাপড়ি মেলা ফুলগুলো যেন আগন্তুকদেরই লক্ষ করছিল। আর্দ্র বাতাসে অদ্ভুত একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল যা পোড়া ঘাসমাটির দুর্গন্ধ অনেকাংশে ঢেকে দিয়েছিল। ঝিলের ওপারে অস্পষ্টভাবে নজরে আসছিল কতগুলো ঢালু পাহাড়।
হঠাৎ ঝিলের জলের উপরিতলে ঘূর্ণি দেখা গেল। সেখান থেকে উঠে এল ছোটোমতো এক রাক্ষুসে প্রাণীঃ শরীরটা ড্রাগনের মতো, পিঠের দু-পাশে তিরের ফলার মতো ডানা। সেই ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে শূন্যে ভেসে উঠল প্রাণীটা, পাড়ের কাছে এসে কমলা রঙের চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। সেভাবে নিশানা না লাগিয়েই বন্দুকের ট্রিগার টিপে দিল লেইটার।
“এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করিনি দেখছি। দারুণ কিছু শিকার পাওয়া যাবে।”
“যা আপনার ভালো মনে হয়।” জবাব দিল ওয়ের্গ।
জলের ওপরের ফুলগুলো ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। রাক্ষুসে প্রাণীটা ঝিলের ধারে লুটিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। খাবি খাওয়ার ভঙ্গিমায় বার বার খোলা-বন্ধ হচ্ছিল ওটার দাঁতহীন মুখটা। সেদিকে ক্যামেরা তাক করে বেশ কয়েকবার শাটার টিপল লেইটার।
“ঠিক বলেছ। আমার যা মনে হয় আমি তাই করব।” বিড়বিড় করে বলে উঠল ও। “আমার টাকা, আমি যা চাইব সেটাই হবে।”
ছুরি দিয়ে প্রথমে প্রাণীটার মাথা কেটে ফেলল লেইটার, তারপর দক্ষ হাতে ওটার ছাল ছাড়াল। মাথা আর ছাল ব্যাগে ভরে সংরক্ষণকারী পাউডার ছড়িয়ে ছুঁড়ে দিল রোভারের পেছনের সিটে। ঠিক সেই সময় ঝিলের জলতল ভেদ করে মাথা তুলল একটা ফুলের কুঁড়ি। দেখতে না দেখতেই পাপড়ি মেলল সেটা। পরমুহূর্তে জেগে উঠল একটা ঢেউ, বাড়তে বাড়তে ছোটোখাটো টিলার আকার নিয়ে নিল। প্রচণ্ড গতিতে পাড়ের দিকে ধেয়ে এল ঢেউটা, যেখানে প্রাণীটার দেহাবশেষ পড়ে ছিল। সবটুকু গিলে নিয়ে ফের মিলিয়ে গেল ঝিলের বুকে।
ঝিল-পাড় ধরে কিছুক্ষণ সামনের দিকে হাঁটল ওরা, তারপর জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের দিকে এগোতে লাগল। নরম সবুজ ঘাসের ওপর পা ফেলে হাঁটছিল ওরা, রোভারটা ওদের পেছন পেছন আসছিল। যাত্রাপথে অনেকগুলো জন্তু ওদের দেখে ভয়ে এদিক ওদিক ছিটকে গেল, কিন্তু আকারে ছোটো হওয়ায় লেইটার ওদের দিকে ভ্রূক্ষেপই করল না। গ্রহের বিবর্ণ আকাশজুড়ে তখন শোনা যাচ্ছিল অদৃশ্য পাখিদের কিচিরমিচির। হঠাৎ গর্জে উঠল শিকারির বন্দুক। গর্তের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ডোরাকাটা একটা সাপ বের করে আনল লেইটার–সরু, লম্বা দেহকে ভাঁজ করে রেখে দিল গাড়িতে।
“সরীসৃপ আমার সেরকম পছন্দ নয়। কিন্তু… ওই তো একটা ভালো জানোয়ার পাওয়া গেছে…”
সামনের পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ছয় পাওয়ালা একটা জন্তু যেন ওদেরই দেখছিল। গাভর্তি ধবধবে সাদা লোম, লম্বা গলার ওপর ছোটোমতো মাথা। আকৃতির দিক দিয়ে অদ্ভুত হলেও জন্তুটার অবয়বে কীরকম যেন একটা সামঞ্জস্য ছিল। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে গেল ওয়ের্গ, যাতে জন্তুটা ভয় পেয়ে পালিয়ে না যায়। সামনের একটা পা নাকি হাত বাড়িয়ে মাটি থেকে একটা ফুল তুলে নিয়েছিল জন্তুটা, কাছে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। তখনই রাইফেল চালাল লেইটার। হাই ক্যালিবার গুলি ওটার মুখ ভেদ করে ঢোকামাত্র প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মরে গেল জন্তুটা।
“দেখলে কেমন নিশানা লাগালাম!” আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল লেইটার। “তোমাকে আমার হয়ে সাক্ষী দিতে হবে কিন্তু, না হলে কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না।”
একছুটে মরা জন্তুটার কাছে ছুটে গেল ও; উবু হয়ে বসে নরম লোমের ওপর হাত বোলাতে লাগল।
“এমন জন্তু আগে কোনোদিনও দেখিনি। মনে হয় না পৃথিবীর কোনো মানুষ দেখেছে বলে।”
জন্তুটার ছাল ছাড়াতে লেইটারের অনেকক্ষণ সময় লাগল। ওকে খুব সন্তর্পণে কাজ করতে হচ্ছিল, পাছে ছুরির আঘাতে চামড়ার কোনোরকম ক্ষতি হয়ে যায়। যখন ওর ছাল ছাড়ানো শেষ হল, ততক্ষণে গ্রহের আকাশের স্বচ্ছ নীল সূর্য গাছপালার আড়ালে অস্ত যেতে বসেছে।
“তুমি তো আমাকে একটু সাহায্য করতে পারো।” হালকা চালেই পাইলটের দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিল লেইটার।
ওয়ের্গ অবশ্য কোনো উত্তর দিল না, চুপচাপ বসে রইল গোলমতো একটা বোল্ডারের ওপর। লেইটার যখন রোভারে চেপে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল, তখনই একমাত্র উঠে দাঁড়াল ও। পাহাড়ের ওপর থেকে রুপোলী ফিতের মতো নদী-বেষ্টিত একটা উপত্যকা ওর নজরে এল, আর নজরে এল দিগন্ত ছুঁয়ে ফেলা কতগুলো পর্বতের চুড়ো। স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন হাওয়া বইছিল ওদের ঘিরে। পাহাড়ের অন্য পারে ঘন ঝোঁপঝাড়ের মাঝবরাবর ছোটো একটা পুকুর দেখা যাচ্ছিল।
পুকুরটার ধারেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল লেইটার। পুকুরটা শেষ হয়েছিল গাছপালাভর্তি জঙ্গলের সীমানায় এসে। সেই জঙ্গলেরই একটা গাছ থেকে ভেসে আসছিল পাখির ডাক। আশ্চর্য সুরে গাইছিল পাখিটা, কিছুক্ষণ পর পর পালটে যাচ্ছিল সুরের ধরন। হাওয়ার দমকে গাছের পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপছিল। গোধূলির আলো আঁধারিতে টেলিস্কোপে চোখ রেখে গাছের ডালপালাগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগল লেইটার। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা আওয়াজ হল, সুরেলা পাখিটার রক্তমাংস ছিটিয়ে গেল চারদিকে। নিস্তব্ধতা নেমে এল গাছটার ওপর।
“দুচ্ছাই!” গজগজ করতে করতে বন্দুক নামিয়ে রাখল লেইটার। “বেশি বড়ো ক্যালিবারের বুলেট ব্যবহার করে ফেলেছি।”
অন্ধকার আরও ঘনিয়ে এল। একটা গাছ কেটে তার কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালাল লেইটার। রাতের খাবার বের করল ওয়ের্গ। আগুনের পাশে বসে ডিনার সারল ওরা, তারপর রোভারের ফোর্স ফিল্ড চালু করে, জন্তুদের ছালচামড়া একপাশে সরিয়ে রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সিটের ওপর। জঙ্গল থেকে শব্দ ভেসে আসা বন্ধ হয়ে গেল, রাতের নীরবতার বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্য রয়ে গেল কেবল পুকুরের জলের ছলাৎ ছল আওয়াজ।
“তোমার এরকম চুপ মেরে থাকার কারণ কী, ওয়ের্গ? সারাদিনে তুমি মোট দশটা শব্দও উচ্চারণ করেছ কি না সন্দেহ। সব খেলার সেরা খেলা এই শিকার তোমার ভালো লাগে না?”
“না, আমার ভালো লাগে না।”
“কিন্তু তুমি তো আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নও। জানো, এরকম একটা ছ’ পাওয়ালা জন্তুর ছাল বেচে যা টাকা পাবে, তাতে একটা গোটা বছর তোমার হেসেখেলে চলে যাবে?”
“আমি একজন পাইলট।” সংক্ষিপ্ত জবাব দিল ওয়ের্গ।
ও যে এই প্রথমবার কোনো গ্রহে অভিযাত্রী নিয়ে এসেছিল এমনটা নয়। নতুন গ্রহে অভিযান, ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় অংশগ্রহণ– এসব নেহাত সস্তা ছিল না। কিন্তু লেইটারের মতো মানুষদের কাছে সেই টাকা কিছুই নয়। ওরা নিজেদের শখ মেটাতে কর্পোরেশনকে মোটা টাকা দিত, বিনিময়ে কর্পোরেশন ওদের বিভিন্ন গ্রহে অভিযানে যাওয়ার সুযোগ করে দিত। এজন্য ওয়ের্গের মতো পাইলটদের মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছিল, ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের ক্ষেত্রে বোনাসও দেওয়া হত। ওর কাজ ছিল একজন অভিযাত্রীকে একটা কোনো গ্রহে নিয়ে যাওয়া, আবার সেখান থেকে আবার তাকে জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। যে গ্রহে যাওয়া হচ্ছে সেটাকে আগেই ভালোভাবে জরিপ করে নেওয়া হত, ফলে বিপদের সম্ভাবনা থাকত না। এর আগে এই ধরনের অভিযানে ওর কোনো অসুবিধে হয়নি, কিন্তু এইবারের ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল লেইটার আসল বন্দুক নিয়ে এসেছিল।
জঙ্গলের আড়াল থেকে এক এক করে তিনটে চাঁদ আকাশে উঠল। গাছেদের ঘন। ছায়ায় ঢাকা পড়ল রোভার। কখন যে আবছা, অবয়বহীন একটা অস্তিত্ব বেরিয়ে এল ঝোঁপের ভেতর থেকে, কখন যে জমির ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে গেল, পাইলট এবং শিকারি বুঝতেও পারল না। আলতো করে বইতে লাগল ধুলোর ঝড়, কাঁচের চুড়ির মতো ঝনঝন শব্দে নড়ে উঠল সারি সারি ঘাস…।
সকালবেলা পাইলটকে ডেকে তুলল লেইটার।
“এগুলো আবার কোথা থেকে এল?” জিজ্ঞেস করল ও।
রোভারের সিটে উঠে বসল ওয়ের্গ। রাতে ওরা যেখানটায় আগুন জ্বালিয়েছিল তার চারপাশে ঘাসের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি মরে পড়ে ছিল। বড়ো, ছোটো, ডানা ছড়ানো, রঙবেরঙের পালকে ঢাকা পাখি। ওয়ের্গ হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, মরা পাখিগুলো ছড়িয়ে বরফের মতো জমাটবাঁধা ঘাসের ওপর। সকালের আলোতে ঘাসগুলো চকচক করছিল। অথচ ফোর্স ফিল্ডের ভেতরের ঘাসগুলো আগের মতোই সবুজ ছিল। ফিল্ডের সুইচ বন্ধ করে রোভার থেকে নেমে পড়ল লেইটার, মরা পাখিগুলোকে ব্যাগে ভরতে শুরু করল। ওর পায়ের চাপে ঘাসের ডগাগুলো ভেঙে এদিক ওদিক ছড়িয়ে যেতে লাগল।
“এ তো দেখছি পুরো কাঁচ।” বিড়বিড় করে উঠল লেইটার। “তুমি এর মানে কিছু বুঝতে পারছ পাইলট? এই পাখিগুলো কোথা থেকে এল? মরলই বা কেন? আচ্ছা, তখন থেকে ওখানে দাঁড়িয়ে তুমি দেখছটা কী? এখানে এসে হাত লাগাও, এগুলো রোভারে তুলতে হবে তো।”
লেইটারের কোনো কথারই উত্তর দিল না ওয়ের্গ, বরং একসময় ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমাদের এখনই ফিরে যাওয়া উচিত। ওই দেখুন!”
যে ঢালু পাহাড়টা আগেরদিন ওরা সহজেই পেরিয়ে এসেছিল, রাতের অন্ধকারে। সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল সেটার আকৃতি। ওপরের মাটির আস্তরণ সরে বেরিয়ে এসেছিল নীচের শক্ত পাথর। যেন পাহাড়টা হঠাৎ করেই পাথুরে দেওয়ালে পরিণত হয়েছিল, এমন খাড়াই একটা দেওয়াল যা ওদের রোভার কোনোভাবেই পেরোতে পারবে না।
আশেপাশে তাকাল লেইটার। সবক’টা গাছই সবুজে ঢাকা, শুধু পুকুরের ধার ঘেঁষা একটা মাত্র গাছ একেবারে ন্যাড়া, পাতাবিহীন ডালপালাগুলো আকাশের দিয়ে ছড়ানো। মুচকি হাসল লেইটার, ওর চোখের পাশ থেকে থুতনি অবধি চামড়া কুঁচকে গেল।
“এসব সামলে নেওয়া যাবে খন পাইলট। শিকারের খেলা তো সবে শুরু হয়েছে। আর আমরা কখন ফিরব না ফিরব সেটা আমিই ঠিক করব, চুক্তিপত্রে সেরকমই লেখা রয়েছে। তুমি পড়েছ নিশ্চয়ই?”
ওয়ের্গ কোনো জবাব দিল না, মরা পাখিগুলো রোভারে তুলতে লাগল। লেইটার ঘাসপাতা জোগাড় করে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ওর ব্লাস্টারের প্লাজমার তাপে জ্বলে ওঠার বদলে সেগুলো বার বার গলে যেতে লাগল। একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে পাশের পুকুর থেকে বাটি করে জল নিয়ে এল ও, তারপর ব্লাস্টারের তেজ কমিয়ে প্লাজমা-রশ্মি তাক করল সেই বাটির ওপর। সেকেন্ডের মধ্যে জল ফুটতে লাগল, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড একটা দুর্গন্ধে ভরে গেল চারদিক।
কোনোরকমে বমি চেপে রোভারের দিকে দৌড় লাগাল লেইটার। ওয়ের্গ আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল রোভার কাঁচের গুঁড়ো মেশানো ধুলোর মেঘ পেছনে ফেলে।
বেশ কিছুক্ষণ অটোম্যাটিক মোডে চলার পর রোভারের স্টিয়ারিং নিজের হাতে নিল লেইটার। উঁচুমতো একটা পাথুরে ঢিপি কাটিয়ে বেরোনোর পর থেকেই কাঁচের ঘাস আর ওর চোখে পড়ছিল না। জোরে একবার নিঃশ্বাস টানল ও, তারপরই হাসিতে ফেটে পড়ল।
“গ্রহটা আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে, তাই না?”
“অথবা হয়তো আমাদের সাবধান করছে…”
“ফালতু কথা! এই গ্রহের ভূপ্রকৃতি এবং বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে কতটা পরিচিত আমরা? এর ভূপৃষ্ঠে কখন কী ধরনের পরিবর্তন হয়, তা কি তুমি জানো? গতকালের পাহাড়ের কথাটাই ধরো। আজ আর নেই, খাড়াই পাথর হয়ে গেছে। হয়তো এখানকার এটাই নিয়ম, আমাদের পৃথিবীতে বৃষ্টি নামার মতো। আর মনে আছে, তুমি এই গ্রহের উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের কথা বলেছিলে? হয়তো পুকুরের জলের ওই বিশ্রী দুর্গন্ধের জন্য কোনো আণুবীক্ষণিক প্রাণী বা উদ্ভিদই দায়ী।”
“ঘাসের কাঁচে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনাটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?”
প্যাসেঞ্জার সিটে বসা পাইলটের দিকে এক ঝলক তাকাল লেইটার। একপাশে হেলান দিয়ে বসে ছিল ওয়ের্গ, একটা হাত জ্যাকেটের কলারের ভেতরে ঢোকানো।
“তোমার কী মনে হয়?” ওকে জিজ্ঞেস করল লেইটার।
“দয়া করে আর কোনো প্রাণী শিকার করবেন না।” অপলক চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল ওয়ের্গ।
“এই শিকার অভিযানের জন্য আমি যত টাকা ঢেলেছি, তুমি জীবনে তত কামাবে কি সন্দেহ।”
“আর এখন শিকার করে সেই টাকা উশুল করতে চান?”
“উশুল?” চোখ সরু করে পাইলটের দিকে তাকাল লেইটার। “আমি শিকার করে আনন্দ পাই। যদিও তোমার পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব নয়। যখনই কোনো জন্তু আমার চোখে পড়ে, আমি ট্রিগার টানি। একটা প্রাণীর অস্তিত্ব আমার তর্জনীর সামান্য চাপের ওপর নির্ভর করে আছে এটা ভাবতে আমার ভালো লাগে। তুমি হয়তো জানো, আজকের পৃথিবীতে শিকার করা নিষিদ্ধ। পরিবেশপ্রেমের নমুনা! পৃথিবীর আইনে আমি হস্তক্ষেপ করতে পারি না, কিন্তু এখানে…”
ওয়ের্গই প্রথম দেখল জন্তুটাকে। নিরেট আংটির মতো চেহারা নিয়ে শুকিয়ে যাওয়া নদীখাত বরাবর এগিয়ে চলেছে, মাটি ঘষটে চলার দাগ পেছনে ফেলে। দেহের বাইরেটা যেন একটা বলয়, আর ভেতরটা নীল কাঁচের লেন্সের মতো। জলভর্তি একটা ডোবার সামনে দাঁড়াল জন্তুটা। ওটার ছায়া জলের ওপর পড়ল, বলয়ের ভেতরকার লেন্সের আকার বদলাল। কয়েক সেকেন্ড, তারপরই ধোঁয়া আর বাষ্প ঢেকে গেল সবকিছু। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ডোবার ভেতর জলকাদা আর অবশিষ্ট নেই। শুকনো গর্তে নেমে পড়ল জন্তুটা, লেন্সকে কেন্দ্রে রেখে ঘুরতে শুরু করল বলয়। বাষ্পের সঙ্গে সঙ্গে ঝলসে যাওয়া শ্যাওলা এবং ছত্রাক শুষে নিতে লাগল ধীরগতিতে।
“এর আগে এরকম কোনো প্রাণীর কথা শুনিনি।” নীচু গলায় বলে উঠল লেইটার। জন্তুটা সূর্যের আলোকে উত্তাপে পরিণত করতে পারে।”
বলয়টা আরও জোরে ঘুরতে শুরু করল। ভেতরের লেন্সটাও যোগ দিল সেই ঘূর্ণনে। পরমুহূর্তেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল জন্তুটা, বলয়ের অভিমুখ ঘুরে গেল রোভারের দিকে। বন্দুক তুলে ধরল লেইটার। নড়ে উঠল জন্তুটা, ওটার ছায়া এসে পড়ল রোভারের গায়ে।
“দোহাই আপনার, গুলি চালাবেন না!” মিনতি করল ওয়ের্গ।
“তুমি এতে নাক গলিও না পাইলট। আমি শুধু এটা বুঝতে পারছি না যে নিশানা কোথায় লাগাব। বলয়টা ওটার ভেতরকার লেন্সকে সুরক্ষিত রাখছে। আমার বিশ্বাস, লেন্সটাই হল জন্তুটার প্রাণকেন্দ্র।”
রোভারটা সামান্য পিছিয়ে আনল লেইটার। সঙ্গে সঙ্গে জন্তুটাও এগিয়ে এল। আবারও ওটার ছায়া এসে ঢেকে দিল ওদের গাড়িকে।
“আজব তো!” ম্যাগাজিনের বুলেট বদলাতে বদলাতে গর্জে উঠল লেইটার। “এবার দেখছি কী করে…”
বলয়ের ওপরের অংশ উপড়ে গেল বুলেটের আঘাতে, ঘুরন্ত অবস্থাতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল জন্তুটা। বলয়ের ঘূর্ণন থেমে গেলে জন্তুটার গোটা শরীরটা ওদের সামনে। স্পষ্ট হল। মনে হচ্ছিল একটা আংটির মাথার কাছটা ভেঙে দিয়েছে কেউ। জোড়া লাগার অক্ষম চেষ্টায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল জন্তুটার ক্ষতস্থান, স্বচ্ছ তরলের স্রোত বইছিল। আচমকাই ওটার গোলাকার লেন্সের আয়তন ছোটো হয়ে এল এবং প্রচণ্ড উত্তাপের একটা ঢেউ আছড়ে পড়ল রোভারের ওপর।
জ্ঞান ফেরার পর সবার আগে নিজের গোঙানিই শুনতে পেল ওয়ের্গ। অনেক কষ্টে চোখ মেলে দেখল, ওর মাথার ওপর নীল আকাশ। ঘাড়ে যন্ত্রণা হচ্ছিল ওর, মুখের একপাশে ব্যথা করছিল, গায়ের চামড়া নানা জায়গায় পুড়ে গিয়েছিল। রোভারের প্যাসেঞ্জার সিটে গা এলিয়ে পড়ে ছিল ও। শ্বাস নিলেই অদ্ভুত একটা গন্ধ ওর নাকে যাচ্ছিল। সেটা চিনতে পারল ওয়ের্গ। মিউরাডল। অর্থাৎ রোভার তার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। বিপদ বুঝে আপনা-আপনিই অন হয়ে গিয়েছিল ফোর্স ফিল্ড, জীবনদায়ী এরোসল ছড়িয়ে যাচ্ছিল ওর ফুসফুসে। কিন্তু রোভারটা চলছিল না। তার মানে লেইটার রোভারের বাইরে কোথাও ছিল। যদি সেও ভেতরে থাকত, তাহলে এতক্ষণে ওদের দুজনকে নিয়ে রকেট-শিপের দিকে ছুটে চলত গাড়ি।
মাথা ঘোরানোর চেষ্টা করল ওয়ের্গ। পোড়া চামড়ায় টান পড়ার যন্ত্রণা ছড়িয়ে গেল সারা ঘাড়ে। কোনোমতে ফার্স্ট এইড বক্সের দিকে হাত বাড়াল ও। তারপর যা করার সব রোবট ডাক্তারই করল। প্রথমে পরীক্ষানিরীক্ষা, তারপর চিকিৎসা পদ্ধতি বেছে নেওয়া, সবশেষে আহত শরীরে পেইন কিলার এবং অন্যান্য বিভিন্ন ওষুধ ইঞ্জেক্ট করা।
মিনিট দু-এক চুপচাপ শুয়ে রইল ও, তারপর ফোর্স ফিল্ড অফ করে রোভার থেকে নেমে দাঁড়াল। কন্ট্রোল প্যানেলের বেশ কিছুটা জায়গায় ধাতু গলে দলা পাকিয়ে গিয়েছিল। কাছেই উপুড় হয়ে পড়ে ছিল লেইটার। গুলি খাওয়া জন্তুটার শরীরে তখনও প্রাণ অবশিষ্ট ছিল, বাষ্পের কুণ্ডলীর ভেতর সামান্য নড়াচড়া করছিল ওটার বলয়। আহত শিকারিকে চিত করে দিল ওয়ের্গ, গা থেকে জ্বলে যাওয়া স্পেস স্যুটের ছাই ঝেড়ে তুলে আনল রোভারে। আরও একবার ফার্স্ট এইড বক্সের ভেতর থেকে রোবট ডাক্তারকে বের করে বসিয়ে দিল লেইটারের বুকের ওপর।
ছোটোখাটো অক্টোপাসের মতো চেহারার রোবট ডাক্তার তার গুঁড়গুলো ছড়িয়ে দিল। বারকয়েক সবুজ ফেনার মতো জিনিস বেরিয়ে এল ওটার দেহ থেকে। হঠাৎ একটা শুড় এগিয়ে গিয়ে শিকারির নীচের চোয়াল নামিয়ে ধরল, আরেকটা গঁড় ঢুকে গেল ওর মুখের ভেতর। তার ঠিক পরপরই দুটো সূচ ঢুকে গেল লেইটারের দু-হাতের শিরায়। মুহূর্তের মধ্যেই লাল হয়ে উঠল রোবট ডাক্তারের গোটা দেহ। প্লাস্টিকের ডগুলো নির্দিষ্ট ছন্দে সংকুচিত প্রসারিত হতে লাগল, কয়েক মিনিট বাদে বাদে উগড়ে দিতে লাগল বর্জ্য পদার্থ।
রোবট ডাক্তারের গায়ে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিল ওয়ের্গ। রোবটটাও তার একটা গঁড় দিয়ে ওর হাত আলগা করে পেঁচিয়ে ধরল। সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় রোভারের সিটে শুয়ে ছিল লেইটার, পোড়া চামড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর শরীরে এঁটে বসা স্পেস স্যুটের পোড়া টুকরোগুলোকেও ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিল ডাক্তার। অন্যান্য পাইলটদের মতো ওয়ের্গও রোবটের এই আশ্চর্য দক্ষতার কথা শুনেছিল, কিন্তু এত কাছ থেকে তার সেবাশুশ্রষা দেখার অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। অবাক হয়ে ওয়ের্গ দেখল, লেইটারের পেটের ক্ষতস্থান শুকিয়ে যাচ্ছে, পোড়া চামড়ার জায়গায় নতুন গোলাপি চামড়া গজিয়ে উঠছে।
একসময় লেইটারের মুখের ভেতর থেকে গুড় বের করে নিল রোবট ডাক্তার, হাত থেকে খুলে নিল সূচ। জোরে একবার শ্বাস নিয়ে তারপর চোখ মেলে তাকাল শিকারি। ওর মুখের চামড়ায় এতটুকু পোড়া দাগও দেখা যাচ্ছিল না। সিট থেকে না উঠেই একবার হাত-পা নাড়িয়ে দেখে নিল ও, তারপর চোখ টিপে হাসল।
“তোমার গায়ের রঙটা আরও খোলতাই হয়েছে দেখছি, পাইলট।” বলল লেইটার। ওর চোখের দৃষ্টি ততক্ষণে পরিষ্কার। একটু আগে কী ঘটে গিয়েছে সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারছিল ও, কোনোরকম ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল না। “এই জঘন্য জিনিসটা আমার বুকের ওপর কী করছে? হড়হড়ে, দুর্গন্ধে ভরপুর… সরাও এটাকে…”
লেইটারের বুকের ওপর থেকে সাবধানে রোবট ডাক্তারকে তুলে নিল ওয়ের্গ, প্যানেলের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখল। ওটার ওষুধের গেজের কাঁটা শূন্যের ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। ড্রাইভারের সিটে ফিরে এল ওয়ের্গ, লাল বোতামে আঙুল ছোঁয়াল। সবচেয়ে কম দূরত্বের পথ ধরে সোজা রকেটের কাছে গিয়ে পৌঁছনোর নির্দেশ পেয়ে জেগে উঠল রোভারের ইঞ্জিন।
“রোভার থামাও পাইলট। শিকারটাকে গাড়িতে তুলতে হবে।”
একবারের জন্য পেছনও ফিরল না ওয়ের্গ। লেইটারের প্রতি ওর মনে ঘেন্না ছাড়া আর কিছুই জাগছিল না। আর এক মুহূর্তের জন্যও এই অভিযান সহ্য করতে পারছিল না ও।
“তুমি পস্তাবে। আমি কর্পোরেশনকে জানাব তোমার এই আচরণ সম্বন্ধে। তুমি বোধ হয় আমাদের চুক্তির শর্তগুলো ভুলে গেছ- যতক্ষণ আমরা এই গ্রহের মাটিতে রয়েছি ততক্ষণ আমিই তোমার মালিক। একই কথা বারবার বলতে আমার ভালো লাগে না।”
যতক্ষণ ওরা এই গ্রহের মাটিতে রয়েছে… যদি সত্যিই এমনটা হত, মনে মনে ভাবল ওয়ের্গ, যদি সত্যিই এরকম পাণ্ডববর্জিত গ্রহেই এধরনের লোকের দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু ওর দুর্ভাগ্য, লেইটারের মতো মানুষই দুনিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সর্বত্র প্রভুত্বের আসনের দাবিদার।
“বেশ, আমারই ভুল হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার বলে উঠল লেইটার, “আমার উচিত ছিল তোমার প্রাপ্য দ্বিগুণ করে দেওয়া। এক অর্থে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞও, যদিও আমি জানি তুমি নিজের স্বার্থেই আমাকে বাঁচিয়েছ। কিন্তু এখন তুমি যেটা করছ সেটা একেবারেই অযৌক্তিক। দেখলে তো, শেষ অবধি আমাদের কোনো ক্ষতিই হয়নি।”
“আপনার চিকিৎসা করতে গিয়ে রোবট ডাক্তার তার প্রায় সব ওষুধই ব্যবহার করে ফেলেছে। হামের টিকা দেওয়া ছাড়া ওটার আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। আপনি পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছেন? যদি কিছু ঘটে যায়, আমরা প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব না।”
“যতসব আজেবাজে কথা! কী এমন হতে পারে আমাদের সঙ্গে?”
“অনেক কিছুই হতে পারে।” বলে উঠল ওয়ের্গ। নিজের অজান্তেই ওর গলায় আকুতির সুর ফুটে উঠেছিল। লেইটারের দিকে ফিরল ও। শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত একবারও ও শিকারির চোখের দিকে তাকায়নি। শুরু থেকেই ওর লোকটাকে ভালো লাগেনি, সেই স্পেস স্টেশন থেকেই। নিজের এই স্বভাবের সঙ্গে ওয়ের্গ পরিচিত ছিল, যাকে ও পছন্দ করত না তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারত না। কিন্তু এবার সেই স্বভাবগত অনীহা দূরে সরিয়ে রাখল ও, তাই লেইটারও পাইলট ওয়ের্গের চোখদুটো ভালো করে দেখতে পেল। ভুরু এবং চোখের পাতা প্রায় নেই বললেই চলে, চোখদুটো নেশার ট্যাবলেটের প্রভাবে লালচে। রোদে পোড়া তামাটে চামড়ার মুখ, আর অনুভূতিশূন্য, ফ্যাকাসে দুটো চোখ। ওয়ের্গের ঠোঁটজোড়া পুরু, থুতনির ঠিক মাঝখানে বাচ্চাদের মতো হালকা টোল। আপনমনেই হেসে উঠল লেইটার। এরকম একজন সাদামাটা চেহারার মানুষের সঙ্গে শিকার নিয়ে কথা বলাটাই হাস্যকর। লোকে ঠিকই বলে, ওয়ের্গ সেই পাইলট যে সর্বদা বেঁচে ফেরে। কারণ ও কখনো ঝুঁকি নেয় না। কোনোরকম ঝুঁকির কাজ ওর পক্ষে আদতেই অসম্ভব।
“অনেক কিছুই হতে পারে, আবার বলল ওয়ের্গ, “এবং আমার মনে হয় আপনিও সেটা উপলব্ধি করতে পারছেন। এখানে সব গাছে পাখি ডাকে। পাখি মরলে গাছ শুকিয়ে যায়; গাছ কেটে ফেললে পাখিরা বাঁচে না। এই মিথোজীবিতা, এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আপনার চোখে ধরা পড়ছে না? আমার কাছে তো এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। গ্রহটা বুঝতে পারেনি আমরা খুনি, তাই আমাদের রকেট-শিপকে নামতে দিয়েছিল। সে ভেবেছিল হয়তো আমরা দুর্ঘটনাবশত এখানকার প্রাণীদের মেরে ফেলছি, তাই আমাদের সাবধান করার চেষ্টা করেছিল। ঘাসকে ওইভাবে কাঁচ করে দেওয়া নিঃসন্দেহে একপ্রকার সাবধানবাণী। আপনিও নিশ্চয়ই সেটা বুঝেছেন। আর এখন গ্রহটা আত্মরক্ষা করছে। দেখতেই তো পাচ্ছেন তার পরিণাম। এর পরেও যদি আমরা শিকার করি, এই গ্রহ আমাদের শেষ করে দেবে।”
“আকাশের বুক চিরে নেমে আসবে আগুন, পাপীদের মাথায় বজ্রপাত হবে! যতসব ঢপের কথা! আমাদের ফোর্স ফিল্ড ভেদ করার ক্ষমতা কার আছে, পাইলট? একমাত্র একইধরনের কিন্তু বিপরীত মেরুর একটা ফিল্ড আমাদের শক্তিক্ষেত্রকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে। তুমি কি চলতে চাও এই গ্রহ সেরকম একটা ফিল্ডও তৈরি করে নেবে?”
লেইটারকে বুঝিয়ে পথে আনার চেষ্টা ছেড়ে দিল ওয়ের্গ। এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে সোজা এগিয়ে চলেছিল রোভার, দু-পাশের গাছপালা, ঘন ঝোঁপঝাড় পেছনে ফেলে। দুপুরের উজ্জ্বল আলোয় রকেটের চুড়ো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। পথে যদি আর কোনো জন্তুর পাল্লায় না পড়ে ওরা, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল ওয়ের্গ, যদি কোনোরকম দুর্ঘটনা ছাড়াই রকেট অবধি পৌঁছে যায়, তাহলে আর কখনো শিকার অভিযানে আসবে ও। এই শেষ।
“পরিবেশ নিয়ে এইসব কুসংস্কারের কোনো মানে হয় না। ‘গ্রহ ভাবছে’, ‘গ্রহ সাবধান করতে চাইছে…’ এই গ্রহে মানুষের কোনো অস্তিত্বই নেই। তাহলে কাদের প্রাণ রক্ষার কথা বলছি আমরা? পৃথিবীতে সবাই প্রকৃতির প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বুলি কপচায়। শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে। আমি এত খরচা করে অভিযানে আসি। শিকার করতে, জীবজন্তুদের দুমড়ে মুচড়ে ওদের প্রাণ ছিনিয়ে নিতে। তাই তুমি এই বিষয়ে কী ভাববো না ভাবো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না ওয়ের্গ।” শব্দ করে হেসে উঠল লেইটার। “আচ্ছা, তুমি তোমার জ্যাকেটটা আমাকে দিচ্ছ না কেন? এই যে তুমি বেশ জামাকাপড় পরে আছ, আর আমি উলঙ্গ হয়ে ঘুরছি–এটা কি ঠিক? তবে তাই বলে
আমার কাছ থেকে আবার ধন্যবাদ আশা কোরো না। আচ্ছা, এবার রোভার দাঁড় করাও। আমি একটু চারদিকটা ঘুরে দেখি।”
বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করল ওয়ের্গ, লেইটারের অপমানজনক কথাবার্তা ধর্তব্যেও আনল না। কোনো একটা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোকে আলাদা করে নিতে পারত ও, আর যা কিছু অপ্রয়োজনীয় সেসবের প্রতি মনোযোগই দিত না। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তাই সম্মান অথবা অপমানের অস্তিত্বই ছিল না ওয়ের্গের কাছে। ওর সামনে বিপদের সবচেয়ে বড়ো উৎস ছিল লেইটার। কিন্তু শিকারিকে নিষ্ক্রিয় করা ওর পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ একজন পাইলট হিসেবে ওকে নির্দিষ্ট কিছু বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে থাকতে হত। ওয়ের্গের শরীরের আড়ষ্ট মাংসপেশী শিথিল হয়ে এল–আসন্ন বিপদের প্রতিক্রিয়ায়।
ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আংটির মতো দেখতে আরেকটা জন্তু। আগেরটার চেয়ে ছোটো, ব্যাস এক মিটারও হবে কি না সন্দেহ। সূর্যের উলটোদিকে থাকায় আত্মরক্ষার কোনো উপায়ই ছিল না জন্তুটার কাছে। লেন্সের কেন্দ্র লক্ষ্য করে গুলি চালাল লেইটার, রোভার থেকে না নেমেই। বিস্ফোরণে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল নীলচে লেন্স, ঘুরতে ঘুরতে একসময় নিথর হয়ে গেল বলয়। ঠিক তখনই লেইটারের কনুই ঠেলে সরিয়ে প্যানেলের ওপর ঝুঁকে পড়ল ওয়ের্গ, ‘রিভার্স’ বোতামে চাপ দিল।
ঝটকা খেয়ে থেমে গেল রোভার, তারপর পেছন দিকে কয়েক হাত গড়িয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্যানেল থেকে হাত সরানোরও সময় পেল না ওয়ের্গ, রোভারের ঠিক সামনের মাটি ফুলে ফেঁপে স্কুপের মতো ওপরের দিকে উঠতে লাগল। এইধরনের কোনো একটা পরিবর্তন যে হতে পারে সেটা অবচেতনে উপলব্ধি করতে পেরেছিল পাইলট, তাই অনির্বচনীয় এক যুক্তি মেনে রোভারটাকে পিছিয়ে এনেছিল ও, লেইটারকে খুদে বলয়াকৃতির জন্তুটার দিকে গুলি চালাতে দেখে।
ভয়ানক এক ধূসর দানব উঠে এল ভূগর্ভ থেকে। ওটার গা থেকে ঝরে পড়ছিল আলগা মাটি-কাঁকর। আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনি তুলল এক বীভৎস হুঙ্কার। পরক্ষণেই ওদের দিকে ঝাঁপাল দানবটা।
ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া লেইটার লক্ষ করল কীভাবে মাঝপথে আকার বদলে ফেলল দানবটা, কীভাবে ওটার সমস্ত মাংসপেশি এসে জড়ো হল দেহের সামনের অংশে, কীভাবে মুখের দু-পাশে বসানো কালো দাঁতগুলো আরও লম্বা, আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। চোখ ধাঁধানো উচ্চতা থেকে ওদের রোভারের ওপর নেমে এল মাটির দানব। শক্তিক্ষেত্রের বাধা পেয়ে শূন্যে ঝুলে রইল কয়েক সেকেন্ড, কয়লার মতো কালো একটা চোখ মুহূর্তের জন্য তাকাল রোভারের সওয়ারিদের দিকে, তারপর ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গিয়ে পড়ল কয়েক হাত দূরে।
“দেখলেন তো–এটাই এতক্ষণ ধরে বোঝাতে চাইছিলাম আপনাকে। গ্রহটা এবার প্রতিশোধ নিচ্ছে।”
দাঁত খিঁচিয়ে উঠল লেইটার। চোখ কুঁচকে দূরে ছিটকে পড়া দানবটার গতিবিধি নজরে রাখতে রাখতে রাইফেলের চার্জ রেগুলেটরের মাত্রা বাড়িয়ে দিল।
“তুমি আমার সিটে চলে এসো পাইলট।” বলল শিকারি। দ্বিতীয়বার রোভারের ওপর ঝাঁপাল দানবটা, কিন্তু এবার লেইটার কোনোরকম প্রতিক্রিয়াই দেখাল না। শক্তিক্ষেত্র আবারও সফলভাবে আক্রমণ প্রতিহত করল। “এর পরেরবার যখন ওটা ফিল্ডের সঙ্গে ধাক্কা খাবে, তুমি এক সেকেন্ডের জন্য ফিল্ডের সুইচ অফ করে দিও। আমি গুলি চালানোর সময় পেয়ে যাব।”
দানবটা আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল, লাফিয়ে এল রোভারের দিকে। ওটার বিশাল দেহের সঙ্গে শক্তিক্ষেত্রের সংঘাতের কাঁপুনি যেন নিজের শরীরে অনুভব করতে পারল ওয়ের্গ। ফিল্ডের সুইচ অফ করে দিল ও। দানবটা তখনও শূন্যে ঝুলে ছিল। দ্রুত কয়েকবার গুলি চালাল লেইটার, এত তাড়াতাড়ি ট্রিগার টানল যেন মনে হল একবারই গুলি চলেছে। বাজ পড়ার মতো কান ফাটানো বিস্ফোরণের আওয়াজ কানে এল, একেকটা বিস্ফোরণ এতটাই তীব্র যে গ্রানাইটের বোল্ডার উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আগুন এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে হারিয়ে গেল দানবটা, শুধু বিশাল একটা গর্ত আর তার চারদিকে ছড়ানো পাথরের টুকরো পড়ে রইল।
জমতে থাকা নীরবতা ভেঙে কথা বলে উঠল লেইটার। “তুমি গাড়ি মন্দ চালাও না। পাইলট।” সামান্য খসখসে শোনাল ওর কণ্ঠস্বর। “তোমার রিফ্লেক্স অসাধারণ। তবে দেখলে তো, এটাও প্রমাণ হয়ে গেল যে আমাদের ফোর্স ফিল্ড দুর্ভেদ্য? কী হল, তুমি কোনো কথা বলছ না কেন?”
“দেখুন,” ফোর্স ফিল্ড পরিমাপক প্যানেলের দিকে ইঙ্গিত করল ওয়ের্গ, “যে পরিমাণ শক্তি খরচ হয়েছে তা থেকে আন্দাজ করা যায় দানবটার ওজন দশ হাজার কেজিরও বেশি। কিন্তু আয়তনের দিক দিয়ে ওটা অতটাও বড়ো নয়। অতএব…”
“না!” চেঁচিয়ে উঠল লেইটার, “একই গ্রহে জৈব এবং অজৈব দু-ধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। বিশ্বসংসারের এটাই নিয়ম, তুমিও সেটা জানো।”
“আসল কথাটা হল,” নীচু গলায় বলে উঠল ওয়ের্গ, “আমরা একমাত্র জৈব প্রাণীদেরই শিকার করি।”
“তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ?”
“আমি বলতে চাইছি যে এই গ্রহ নিজস্ব কৌশলে আমাদের আক্রমণ করছে। অজৈব একটা প্রাণী–একটা মাটির দানব বানিয়েছে আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে।”
অবিশ্বাসের চোখে পাইলটের দিকে তাকিয়ে রইল লেইটার।
“তোমার এই কথাবার্তা আর নেওয়া যাচ্ছে না! তুমি অলৌকিকতার যুগে ফিরে গেছ বলে মনে হচ্ছে পাইলট। অথবা ভয়ে উন্মাদ হয়ে উঠেছ।”
“না, লেইটার। আমার যুক্তি-বুদ্ধি সব নিজের জায়গাতেই রয়েছে।”
প্রচণ্ড একটা গর্জন পাইলটের বাকি কথাগুলো মুছে দিল। বিস্ফোরণে বিন্দুমাত্র আঘাত না পাওয়া দানবটা দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে এসে গর্তের সীমানা পেরোচ্ছিল। ওটার পেটের নীচ থেকে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিল না, চওড়া, চ্যাপ্টামতো একটা লেজে ভর দিয়ে মাটি সরিয়ে এগিয়ে আসছিল। হঠাৎ লাফ দিল দানবটা, ফের রোভারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
প্রায় নিঃস্পৃহভাবে দানবটাকে, ওটার দেহের দু-পাশে আর পেটের ওপরের কুৎসিত ফোলা অংশগুলোকে লক্ষ করতে লাগল ওয়ের্গ। দানবটা যখন লাফিয়ে ওদের আক্রমণ করছিল তখন ফোলাগুলো আয়তনে বেড়ে উঠছিল, আর যখন ফোর্স ফিল্ডের ধাক্কায় ছিটকে পড়ছিল তখন সেগুলো শুকিয়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছিল। প্রতিবার শক্তিক্ষেত্রের ওপর লাফিয়ে এসে পড়ছিল প্রাণীটা, পরমুহূর্তেই মাটি কাঁপানো শব্দে দূরে ছিটকে যাচ্ছিল। ওয়ের্গ বুঝতে পারল, জন্তুটা বার বার এভাবে সরাসরি আক্রমণ হেনে রোভারের ফোর্স ফিল্ড নিঃশেষ করে দিতে চাইছে।
নিঃস্পন্দ চোখে শক্তিক্ষেত্রের এনার্জি ইন্ডিকেটরের দিকে তাকাল লেইটার। যন্ত্রের কাঁটা একটু একটু করে শূন্যের দিকে এগোচ্ছিল।
“আপনি ঠিকই ধরেছিলেন।” দানবটার আক্রমণের মধ্যেই বলে উঠল ওয়ের্গ। “গ্রহটার পক্ষে আমাদের ফোর্স ফিল্ডের বিপরীতমুখী ফিল্ড সৃষ্টি করা সম্ভব ছিল না। তাই সে অন্য উপায় বেছে নিয়েছে। দানবটা একটু একটু করে আমাদের শক্তিক্ষেত্ৰ নিঃশেষ করে দিচ্ছে। বিকল্প সমাধান খুঁজে নিয়েছে গ্রহটা।”
“তুমি কিছু করছ না কেন?” উঁচু গলায় চিৎকার করে উঠল লেইটার। “তুমি না সেই পাইলট যে সবসময় বেঁচে ফেরে?”
“বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমার একমাত্র সুযোগ আমি কাজে লাগাতে পারিনি। আমার উচিত ছিল আপনাকে বেঁধে ফেলে রাখা, যাতে আপনি আমাদের আর কোনো সমস্যায় না ফেলতে পারেন। কিন্তু…”
.
…পথ যেন আর শেষই হচ্ছিল না। উপত্যকার পাথুরে রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছিল ওয়ের্গ, হোঁচট খাচ্ছিল বারবার। যখন তখন ওর চোখের সামনে নেমে আসছিল লাল পর্দা। তখন দাঁড়িয়ে পড়ছিল ও, জিরিয়ে নিচ্ছিল কিছুক্ষণ। লেইটারকেও পাঁজাকোলা করে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছিল ওকে। ওয়ের্গের পা ফেলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অচেতন শিকারির মাথা এদিক ওদিক দুলছিল। শুরুতে ওয়ের্গ চেষ্টা করেছিল ওকে কাঁধে করে নিয়ে পথ চলার, কিন্তু মৃগীরোগীর মতো ছটফট করছিল লেইটার, বার বার বমিও করছিল। তাই শেষ অবধি পাঁজাকোলা।
ওয়ের্গের স্মৃতি ঠিকমতো কাজ করছিল না। ওর শুধু এটুকু মনে পড়ছিল ফোর্স ফিল্ড নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে জোরে একটা বিস্ফোরণ হয়েছিল। তখনই ওরা দু’জন রোভারের বাইরে ছিটকে পড়েছিল। জ্বলন্ত ঘাস, পোড়া মাটির ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়ার সময় নিজের শরীরটাকে যতদূর সম্ভব গুটিয়ে নিয়েছিল পাইলট। টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল যখন, দেখেছিল রোভারের ওপর উপুড় হয়ে আছে দানবটা। প্রচণ্ড তাপ ছড়াচ্ছিল ওটার বিশালাকায় মাটির শরীর। পিষে যাওয়া গাড়িতে আগুন ধরে গিয়েছিল, ভেতর থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। একপাশে একটা গর্তের ভেতর অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল লেইটার। কোনোরকমে তাপের হাত থেকে নিজেকে আড়াল করে ওর কাছে পৌঁছেছিল ওয়ের্গ, কলার ধরে টেনে সরিয়ে এনেছিল ধোঁয়া এবং আগুন থেকে।
চলতে চলতে পায়ের তলায় ভেজা ভেজা অনুভব হওয়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল ওয়ের্গ। সরু একটা নদীর ধারে এসে পৌঁছেছিল ও। অগভীর নদীটার বুকে ছোটো ছোটো নুড়িপাথর বিছানো। হাঁটু মুড়ে ঝুঁকে শিকারিকে শুইয়ে দিল ও, তারপর ওর পাশে বসে আঁজলা করে জল নিয়ে মুখে ছেটাল। ঠান্ডা জলের স্পর্শ পেয়ে নিজেকে কিছুটা সুস্থ মনে হল ওর। আচমকা গুঙিয়ে উঠল লেইটার। উঠে দাঁড়াল পাইলট, তখনই রকেট-শিপটা ওর নজরে এল। ওরা যেখানে ছিল, সেখান থেকে খুব বেশি হলে এক কিলোমিটার দূরে। শিকারির দিকে আরেকবার তাকাল ওয়ের্গ। শরীরের কোথাও হাড় ভেঙেছে বলে মনে হচ্ছিল না, সবই কাটাছেঁড়া নয়তো কালশিটের দাগ। তবে নাড়ি ক্ষীণ। নির্ঘাত বিস্ফোরণের সময় শক পেয়েই অজ্ঞান হয়েছিল ও।
শিকারিকে নদীর পার অবধি টেনে আনল ওয়ের্গ, আঁজলা করে জল তুলে ওর মুখে ঢেলে দিল। কাশির দমকে ছটফট করে উঠল লেইটার। পিঠজুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা টের পাচ্ছিল ওয়ের্গ।
একসময় লেইটারের কাশি থামল। কোনোরকমে উঠে বসল সে, জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। ওর গালের একটা ক্ষত থেকে অনর্গল রক্ত ঝরছিল।
“আপনি হাঁটতে পারবেন তো?” লেইটারকে জিজ্ঞেস করল পাইলট। “আমাদের রকেট-শিপ এখান থেকে বেশি দূরে নয়।” ওর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যা কেউ শুনলে হয়তো অনুকম্পা বলে ভুল করত। ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল লেইটার।
দুর্বলতা সরিয়ে রেখে পাইলটের পেছন পেছন চলতে শুরু করল শিকারি। তবে একটানা বেশিক্ষণ হাঁটতে পারছিল না ও, একটু পরপরই মাটিতে বসে বিশ্রাম নিতে হচ্ছিল ওকে। সেই সময়গুলোতে ওয়ের্গ নিপে ওর পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
“কিন্তু একটু আগেও তো তুমি আমাকে বয়ে নিয়ে চলেছিলে।” একসময় বলল লেইটার। ওর গা গোলাচ্ছিল, বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছিল। “তুমি তো আমাকে বইছিলে।”
“হ্যাঁ, আমি আপনাকে বইছিলাম। কারণ আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।”
“মনে হচ্ছে যে-কোনো মুহূর্তে আমি আবার অজ্ঞান হয়ে যাব।” হাঁপ ধরা গলায় উঠল। লেইটার। একটানা কথা বলতে পারছিল না ও, শব্দগুলো থেমে থেমে উচ্চারণ করছিল। “আমি ছাড়া কিন্তু তুমি রকেটের ভেতরে ঢুকতে পারবে না।”
ঘেন্নায় একদলা থুতু ফেলল ওয়ের্গ, একবারের জন্যও পেছন না তাকিয়ে সোজা হেঁটে চলল। ওর ভেঁড়াখোঁড়া স্পেস স্যুটের জায়গায় জায়গায় খয়েরি ছোপ লেগে ছিল, শুকনো রক্তের দাগ। লেইটার চুপচাপ পাইলটের চলে যাওয়া দেখল। ওর গায়ের ব্যথা কমে আসছিল, মাথার ভেতরটা একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছিল। ক্রোধ সবসময়ই ওকে উত্তেজনা যুগিয়ে এসেছে, ওর মন ভালো রেখেছে। এখন যদি ওর হাতে ব্লাস্টার থাকত, পাইলটের পিঠের দিকে তাক করে নির্ঘাত চালিয়ে দিত। তারপর রসিয়ে রসিয়ে লোকটার আর্ত চিৎকার উপভোগ করত। ওয়ের্গের প্রতিটা কথায় যে তাচ্ছিল্যের ইঙ্গিত ছিল তা লেইটারের বুকে নিষ্ফল ক্ষোভের আগুন জাগিয়ে তুলেছিল।
রকেট-শিপের কাছে পৌঁছে লেইটার দেখল, আনত ধাতব তক্তাটার ওপর চুপ করে বসে রয়েছে ওয়ের্গ। ওর দৃষ্টি ঝিলের দিকে। সেখানে স্বচ্ছ জলের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা লিলি ফুল। মন শান্ত করে দেওয়া এক দৃশ্য।
অনেকগুলো ছোটো ছোটো জলজ জন্তু জল ভেঙে মাথা তুলছিল, আবার ডুব দিচ্ছিল গভীরে। দেখা দিয়েই নিমেষে মিলিয়ে যাচ্ছিল অসংখ্য ঘূর্ণি। ঝিলটারও যেন নিজস্ব প্রাণ ছিল। ওয়ের্গ দেখল, ওদের রকেট ল্যান্ডিংয়ের সময়ে পুড়ে যাওয়া ঘাস বেশ কিছু জায়গায় নতুন করে গজাতে শুরু করে দিয়েছে। তারপরই শিকারের লোভে আসা শয়তানটাকে রকেটের দিকে এগিয়ে আসতে দেখল ও। এখুনি নিজের রক্তমাখা হাতদুটো দিয়ে রকেটের হ্যাঁচ খুলবে লোকটা। ওকেও তখন ভেতরে যেতে হবে, কারণ ও পাইলট। এই গ্রহ ছেড়ে উড়ে যাবে ওদের রকেট, যাওয়ার সময় আরও একবার পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে এখানকার ঘাস-মাটি-ফুল।
তক্তা বেয়ে উঠে এল লেইটার, পাইলটের দিকে একবার তাকালও না। হ্যাঁচের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল ও। রকেটের মসৃণ ধাতুর গায়ে ওর প্রতিফলন পড়ছিল। ফুলে যাওয়া রক্তে ভেজা মুখ, বুজে আসা চোখ নিজেকে যেন চিনতেই পারছিল না ও। পেছন ঘুরল শিকারি। দূরে আগুন মরে এলেও রোভারটা থেকে তখনও কালো ধোঁয়া উঠছিল। ওর শিকার করা পশুর চামড়াগুলো নিশ্চয়ই এতক্ষণে সব জ্বলে গিয়েছে, মনে
মনে ভাবল লেইটার। ওই আগুনে, যেখান থেকে নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ওয়ের্গ ওকে উদ্ধার করে এনেছে।
জোরে হেসে উঠল শিকারি। ওর দু-চোখ থেকে উন্মাদ আক্রোশ ঝরে পড়ছিল।
“আমি আবার এখানে ফিরব ওয়ের্গ। তবে এবার আর আমি একা আসব না। দলবল নিয়ে আসব, আর এই গ্রহকে শেষ করে দেব। নিঃস্ব, বাঁজা গ্রহটা সেদিন আমার পায়ের তলায় পড়ে থাকবে। সৃষ্টির প্রথমদিনের মতো। চিন্তা নেই, আমি তোমাকেও আনানোর ব্যবস্থা করব, সেই দিনটা দেখার জন্য।”
“পায়ের তলায় পড়ে থাকবে…” নির্জীব স্বরে লেইটারের বলা কথাগুলোই একবার আওড়াল পাইলট। পরক্ষণে উঠে দাঁড়াল ও, পিঠের যন্ত্রণার তোয়াক্কা না করে দু-হাতে জাপটে লেইটারকে তুলে ফেলল মাথার ওপর। ওর হাতের চাপে শিকারির পাজরের হাড় গুঁড়িয়ে গেল।
জানোয়ারটাকে তারপর দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল ওয়ের্গ।