সবুজ স্যান্ডেল
‘তোমার সঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়। আমায় তালাক দিয়ে দাও।’
‘লাহোলবিলা!! কী বল! মুখে কোনো লাগাম নেই তোমার?…তোমার সবচেয়ে বড় সমস্যাই এটা…বকবক শুরু করলে মাঝে মাঝে তোমার আর মাথার ঠিক থাকে না যে কী বলতে হয় আর কী বলতে নেই!…’
‘তোমার মাথা তো দারুণ ঠিক, তাই না?! চব্বিশ ঘণ্টা মদ খেয়ে পড়ে থাক!…’
‘আমি মদ খাই ঠিকই, কিন্তু খেয়ে পড়ে থাকি না। আর তোমার মতো না খেয়ে ভুলও বকি না।’
‘আমি ভুল বকছি?’
‘সেটা বলিনি…কিন্তু তুমি নিজেই বল না! তালাক নেবে, এ আবার কেমন কথা!’
‘আমি তালাক চাই, ব্যস…যে স্বামীর নিজের স্ত্রীয়ের বিন্দুমাত্র পরোয়া নেই, তার কাছ থেকে তালাক চাইব না তো কী চাইব?!’
‘তালাক ছাড়া আর যা ইচ্ছা চাও।’
‘সেই! যা চাই তাই তো যেন এসে যাবে!…তুমি দাওটা কী আমায়?’
‘উফ, আবার একটা নতুন অভিযোগ!…তোমার মতো সৌভাগ্য খুব কম মহিলারই আছে।’
‘চুলোয় যাক অমন সৌভাগ্য!’
‘চুলোয় পাঠিয়ে কাজ নেই…আচ্ছা শোনো। আমি জানি না তুমি এত রেগে কেন আছ, কিন্তু সত্যি বলছি, আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি।’
‘আল্লাহ আমায় এমন ভালোবাসা থেকে মুক্তি দিন!’
‘আচ্ছা, এসব কথা ছাড়। বাচ্চারা স্কুল চলে গেছে?’
‘তোমার তো ওদের জন্য বিশাল মাথাব্যথা!!…স্কুলেই যাক আর জাহান্নমেই যাক, তাতে তোমার কী?…আমি তো দোয়া করছি ওরা যেন মরেই যায়!’
‘তোমার জিভ একদিন দেখছি জ্বলন্ত চিমটে দিয়ে টেনে বের করে আনতে হবে!…লজ্জা করে না নিজের সন্তান সম্বন্ধে এই ধরনের কথা বলছ!’
‘শোনো! আমার সঙ্গে এরকমভাবে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি! মুখের কী ভাষা!…লজ্জা তো তোমার করা উচিত।…নিজের বিবির দায়িত্ব নেওয়ার বদলে তার সঙ্গে এরকম অসভ্যভাবে কথা বলছ!…এ সব তোমার ওই কুসঙ্গের ফল।’
‘আর তোমার মাথার কুচিন্তাগুলো? সেগুলোর কী কারণ শুনি?’
‘তুমি! আর কী কারণ হবে!’
‘সেই! আমিই সবকিছুর কারণ। যত দোষ সবই আমার। জানি না তোমার কী হয়েছে যে উল্টোপাল্টা বকেই যাচ্ছ!’
‘কী হয়েছে!! আমার জীবনে দুর্ঘটনা তো তুমি!…সারাক্ষণ আমার ঘাড়ের উপর বসে আমায় বিরক্ত করছ!…আমি তোমায় আবার বলছি, আমায় তালাক দাও।’
‘আরেকবার বিয়ে করবে? আমায় আর ভালো লাগছে না?’
‘ছি ছি! লজ্জা করছে না বলতে? আমায় ওই ধরনের মেয়ে পেয়েছ?’
‘তাহলে তালাক নিয়ে কী করবে?’
‘যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব। দরকার হলে লোকের বাড়িতে কাজ করে নিজের আর মেয়েদের পেট চালাব।’
‘তুমি কাজ করবে?! ঘুম থেকে ওঠোই তো দশটার সময়! তারপর জলখাবার খেয়ে আবার গড়াও…দুপুরে খেয়েও কমসে কম তিন ঘণ্টা ঘুমাও। নিজেকে মিথ্যে বলে কী লাভ!’
‘সেই তো! আমি তো সর্বক্ষণ ঘুমোই আর তুমি সর্বক্ষণ জেগে থাক, তাই না!…এই তো কাল তোমার দপ্তরের একজন এসেছিল। সে বলছিল, ”আমাদের অফিসার সাহেব যখনই দেখি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে নেন।” ‘
‘কোন শালা বলেছে এসব?!’
‘মুখের ভাষা ঠিক করো।’
‘আরে, রাগ হয়ে গেছিল। রাগলে মানুষের মুখের ভাষা ঠিক থাকে না।’
‘আমারও তো তোমার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে! কই, আমি তো অসভ্য কথাবার্তা বলছি না!…নিজের সম্মান রাখতে জানতে হয়।…সব তোমার কুসঙ্গের ফল! নইলে এই ধরনের শব্দ কেউ উচ্চারণ করে!’
‘আচ্ছা, অনেকক্ষণ ধরে তো বলছ! এবার একটু শুনি, আমার এই কুসঙ্গটা ঠিক কে?’
‘ওই লোকটা! ওই যে নিজেকে কাপড়ের বিশাল বড় ব্যবসায়ী বলে জাহির করে!…তার কাপড়জামা দেখেছ! জঘন্য, নোংরা।…সে নাকি বি.এ.! এদিকে তার আদবকায়দা দেখে গা জ্বালা করে।’
‘ও! ও বহিরাঙ্গের মোহমুক্ত একজন মানুষ।’
‘মানে! সেটা আবার কী বস্তু!’
‘ও তুমি বুঝবে না। বেকার একগাদা সময় নষ্ট হবে তোমায় বোঝাতে গেলে।’
‘জি! সেই! তোমার সময় তো ভীষণ দামি!…একটু কথা বললেই নষ্ট হয়ে যায়।’
‘ঠিক করে বলো তো, তুমি কী চাও?’
‘কিছু না!…যা বলার বলে দিয়েছি…ব্যস, আমায় তালাক দিয়ে দাও…এই নিত্যদিনের ঝগড়া আর ভালো লাগে না।’
‘তোমার তো ভালোবাসার কথাও ভালো লাগে না!…ভালোটা কী লাগে তোমার?! বল, এবার কী করব!’
‘বললাম তো! তালাক দিয়ে দাও!’
‘যাও, মৌলভি ডেকে আন। যদি সত্যিই তুমি তাই চাও, আমি বাধা দেব না।’
‘আমি কোত্থেকে ডাকব!’
‘দেখ! তুমি যখন তালাক চাও, তখন তোমাকেই ব্যবস্থা করতে হবে… আমি তালাক দিতে চাইলে এক মিনিটে দশজন মৌলভি এনে খাড়া করে দিতাম…যাই হোক, এতে আমার কাছ থেকে কোনো সাহায্য আশা কোরো না। তোমার ইচ্ছা, তুমি যেভাবে খুশি করো।’
‘তুমি এটুকুও করবে না আমার জন্য!!’
‘জি না।’
‘এতক্ষণ তো খুব বলছিলে, আমায় নাকি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাস!’
‘ঠিক কথা! বাসি বৈকি!…কিন্তু সেটা একসঙ্গে থাকার ব্যাপারে…আলাদা হওয়ার ব্যাপারে না!’
‘তো আমি কী করব?’
‘যা ইচ্ছা কর। আর আমার মাথা খারাপ কোরো না। কোনো মৌলভিকে ডেকে তালাকনামা লিখে দিতে বল। আমি সই করে দেব।’
‘মোহর?’
‘যেহেতু তুমি তালাক চাইছ, তাই মোহর দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’
‘বাঃ! এ তো দারুণ কথা!’
‘তোমার ভাই তো উকিল!…তাকে চিঠি লিখে জিগ্যেস করে নাও, যদি বিশ্বাস না হয়!…স্ত্রী তালাক চাইলে সে আর মোহর দাবি করতে পারে না।’
‘তাহলে তুমিই আমায় তালাক দাও।’
‘আমি কি পাগল!…আমি তো তোমায় ভালোবাসি। তালাক কেন দিতে যাব খামোখা?’
‘তোমার এইসব ঢং আমার ভালো লাগে না!…ভালোবাস না ছাই! ভালোবাসলে এরকম ব্যবহার করতে!’
‘কী দুর্ব্যবহার করেছি তোমার সঙ্গে?!’
‘যেন কিছুই জান না!…এই তো পরশুরই কথা! আমার শাড়ি দিয়ে তুমি নিজের জুতো পরিষ্কার করনি?’
‘আল্লাহর কসম, আমি করিনি।’
‘তো কি স্বর্গ থেকে পয়গম্বর নেমে এসে করে গেছিলেন!’
‘তোমার তিন মেয়ে নিজেদের জুতো ঝাড়ছিল তোমার শাড়ি দিয়ে… আমি ওদের বকেওছিলাম।’
‘মেয়েরা মোটেই এরকম অসভ্য নয়।’
‘খুবই অসভ্য তারা। তুমি কোনো সহবত শেখাওনি তাদের। বিশ্বাস না হয়, স্কুল থেকে ফিরলে জিগ্যেস করে দেখো!’
‘আমি ওদের কিচ্ছু জিগ্যেস করব না।’
‘তোমার যে আজ কী হয়েছে কে জানে! আসল কারণটা জানলে তবে না কিছু সমাধান করব!’
‘তুমি তোমার সমাধান ভাব গিয়ে, আমি আমারটা ভেবে ফেলেছি। তুমি আমায় তালাক দাও। যে স্বামী নিজের স্ত্রীর খেয়াল রাখে না, তার সঙ্গে থাকার কোনো মানে নেই।’
‘আমি তো সবসময় তোমার খেয়াল রাখি!’
‘তোমার মনে আছে, কাল ঈদ?’
‘হ্যাঁ। মনে থাকবে না কেন!…কালকেই তো মেয়েদের জন্য নতুন জুতো আনলাম। ওদের ফ্রক কেনার জন্য তোমায় আগের সপ্তাহেই ষাট টাকা দিয়েছি!’
‘আমার চোদ্দোপুরুষ ধন্য হয়ে গেছে!’
‘ধন্য হওয়ার কথা বলিনি, উফ! হয়েছেটা কী?’
‘হয়েছে এটাই যে ষাট টাকাটা কম!…তিন মেয়ের জন্য অর্গান্ডির কাপড় কিনতে পড়েছে চল্লিশ টাকা…তারপর প্রত্যেক ফ্রকের জন্য দর্জি নিয়েছে সাত টাকা করে…এবার বল, আমার আর বাচ্চাদের জন্য তুমি কী এমন বিশাল কাজ করেছ!’
‘তুমি নিজের থেকে এক টাকা দিয়েছ?’
‘না দিলে ফ্রকগুলো পেতাম কী করে?’
‘সেটা তুমি আমার থেকে এক্ষুনি নিয়ে নাও!…এতে এত রাগারাগির কী আছে!’
‘বলছি, কাল ঈদ!’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি জানি রে বাবা!…আমি দুটো মুরগি আনাচ্ছি…সিমুইও… তুমি কিছু ব্যবস্থা করলে?’
‘চুলোয় যাক ব্যবস্থা!’
‘সে কী! কেন?’
‘আমি ভেবেছিলাম কাল সবুজ শাড়ি পরব…সঙ্গে সবুজ স্যান্ডেল…সবুজ স্যান্ডেলের অর্ডারও দিয়ে এসেছিলাম!…তোমায় হাজারবার বললাম মুচির কাছে গিয়ে খোঁজ নাও যে ওটা হল কি না!…কিন্তু তোমার তো আমার কোনো কথাতেই কিছু যায় আসে না!…আমার কথা ভাবলে তবে না তুমি যেতে!’
‘লাহোলবিলা!…এই পুরো ঝগড়ার কারণ তাহলে ওই সবুজ স্যান্ডেল!!… জনাব, আপনার সে স্যান্ডেল আমি পরশুই নিয়ে এসেছি…আপনার আলমারিতে রাখা আছে…সারাক্ষণ তো ঘুমাও!…আলমারিটা খুলে পর্যন্ত দেখোনি!…’