সবুজ চশমা
বরদা বলিল, “আমিও একদিন তোমাদের মতো নাস্তিক ছিলুম।”
আমরা সকলে উৎসুকভাবে নিরুত্তর রহিলাম, কারণ, এরূপ ভূমিকার উদ্দেশ্য আমাদের অজ্ঞাত ছিল না; কেবল অমূল্য মুখ বিকৃত করিয়া হাসিল।
বরদা টেবিলের উপর হইতে পা নামাইয়া বলিল, “কিন্তু একবার এমন একটা ব্যাপার ঘটল যে, তারপর প্রেতযোনিতে অবিশ্বাস করা একেবারে অসম্ভব। অনেক দিন আগেকার কথা—প্রায় দশ বছর হল। সে রকম ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা জীবনে কখনও হয়নি। রেলে কাটা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলুম।”
অমূল্য সক্ষোভে কপালে করাঘাত করিয়া বলিল, “আমাদের ভাগ্যই মন্দ—কাকে দোষ দেব?”
পাছে আবার ঝগড়া বাধিয়া যায়, তাই পৃথ্বী তাড়াতাড়ি বলিল, “কাউকে দোষ দিতে হবে না। বরদা, তুমি আরম্ভ করে দাও।”
বরদা শত্ৰুমিত্র সকলকে সমান অগ্রাহ্য করিয়া অবিচলিতভাবে একটা চুরুট ধরাইল, তারপর আরম্ভ করিল—“কিউল জংসনের মতো এমন লক্ষ্মীছাড়া স্টেশন বোধ হয় পৃথিবীতে আর নেই। লুপ লাইন থেকে যে দিকেই যেতে চাও কিউলে অন্তত তিনটি ঘণ্টা বিশ্রাম করতে হবে।
সেবার বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে মামার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছিলুম—এলাহাবাদে। সন্ধ্যের সময় মুঙ্গের থেকে বেরিয়ে রাত্রি আটটা নাগাদ কিউল পৌঁছুনো গেল। সেখানে পশ্চিমের ট্রেন আসবে রাত্রি এগারোটায়—সুতরাং অফুরন্ত অবকাশ। আমার সঙ্গে কেবল একটা স্যুট্কেস ছিল; সেটা কুলির জিম্মা করে দিয়ে লম্বা কাঁকর-ঢাকা প্ল্যাটফর্মের ওপর পায়চারি করতে লাগলুম। ক্রমে ট্রেন বেরিয়ে গিয়ে স্টেশনটা একেবারে খালি হয়ে গেল। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে আর গাড়ি নেই।
কিন্তু একলা শূন্য প্ল্যাটফর্মে কাঁহাতক পায়চারি করা যায়? ঘণ্টাখানেক ঘুরে বেড়াবার পর দেখলুম, কেউ কোথাও নেই, স্টেশন স্টাফও বোধ করি এই অবসরে একটু নিদ্রা দিয়ে নিচ্ছে; গ্যাসের বড় বড় ল্যাম্পগুলো জনহীন প্ল্যাটফর্মে অনর্থক আলো বিকীর্ণ করছে। আমিও এদিক-ওদিক চেয়ে ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে ঢুকে পড়লুম, ভাবলুম, নিরিবিলি একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। —অ্যাঁ? হ্যাঁ, টিকিট ইন্টার ক্লাসেরই ছিল।
ওয়েটিং রুমের মাঝখানে একটি বড় গোছের গোল টেবিল, তার ওপর কেরোসিনের ল্যাম্প ঘোলাটেভাবে জ্বলছে। টেবিলের চারপাশে দশ-বারোখানা চেয়ার, আরাম-কেদারাও আছে। একটি চেয়ারে বসে একজন ভদ্রলোক ঝিমুচ্ছিলেন, একটা চামড়ার হ্যান্ডব্যাগ তাঁর সামনে টেবিলের ওপর রাখা ছিল। আমি ঢুকতেই তিনি চমকে উঠে তাড়াতাড়ি ব্যাগটা নিজের কাছে টেনে নিলেন।
আর কেউ যে ওয়েটিং রুমে আছে, তা প্রত্যাশা করিনি। যাহোক, অনধিকার প্রবেশের সঙ্কোচ দমন করে একটা চেয়ার টেনে বসলুম; ভদ্রলোক মিটমিট করে আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। বয়স্থ লোক, মুখে দাড়ি আছে,—ওস্তাগরের তৈরি ঝল্ঝলে কোট-প্যান্টলুন পরা, কিন্তু তবু বাঙালী বলে সন্দেহ হল। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘মশায়ের কোন্ দিকে যাওয়া হচ্ছে?’
ভদ্রলোক ব্যাগটি তুলে নিজের কোলের ওপর রাখলেন; এমন সন্দিগ্ধ-চোখে আমার দিকে চাইতে লাগলেন, যেন তাঁর ঐ ব্যাগটি চুরি করবার জন্যই আমি ঢুকেছি। তারপর সতর্কভাবে বললেন, ‘আমি বিলেত যাচ্ছি।’
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বললুম, ‘অ্যাঁ?’
তিনি আবার বললেন, ‘বিলেত যাচ্ছি। আপনি?’
লজ্জিতভাবে বললুম, ‘আমি এই—কাছেই, এলাহাবাদ যাচ্ছি।’
‘এলাহাবাদ? এলাহাবাদে কি করেন?’
‘কিছু করি না—মামার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। আপনি কি কখনও সেখানে ছিলেন?’
তাঁর সতর্ক সাবধান ভাব অনেকটা কেটে গেল, তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সেখানে আমি লিটন কলেজে ফিজিক্সের প্রফেসর ছিলুম—আমার নাম বিরাজমোহন সেন।’
বিরাজমোহন সেন! নামটা খুব পরিচিত, আমার মামাদের মুখে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি; মামারা তাঁর কাছে পড়েছিলেন। বিরাজবাবু একজন নামজাদা প্রফেসর ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে অধ্যাপনার কাজ থেকে অবসর নিতে হয়। আমি সচকিত হয়ে উঠলুম, তারপর খুব ভাল করে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করলুম; কিন্তু তাঁর চেহারায় মাথা খারাপের কোনও লক্ষণই দেখতে পেলুম না। প্রকাণ্ড কপালখানা বুদ্ধি এবং পাণ্ডিত্যেরই পরিচয় দিচ্ছে,—উঁচু বাঁকা নাক, চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু নেই—যা পাগলামি বলে মনে করা যেতে পারে। আমি বললুম, ‘আমি আপনার নাম শুনেছি—আমার মামারা আপনার ছাত্র!’
‘তাই না কি? কি নাম তাদের বল তো।’
আমি নাম বলতেই তিনি লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘শৈল, নীরজ! বিলক্ষণ! তাদের খুব চিনি। তুমি তাদের ভাগ্নে? বেশ বেশ! বড় খুশি হলুম।’ বলে তিনি ব্যাগটা আবার টেবিলের উপর রাখলেন।
আমার বড় হাসি পেল, জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আপনার ঐ ব্যাগটিতে কোনও মূল্যবান জিনিস আছে—না?’
‘মূল্যবান! তিনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, তা বলতে পার। এমন মূল্যবান জিনিস পৃথিবীতে আর নেই।’
আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কি জিনিস?’
তিনি আস্তে আস্তে বললেন, ‘একটা চশমা। বিলেতে নিয়ে যাচ্ছি স্যর অলিভার লজকে দেখাব বলে।’
আরও আশ্চর্য হয়ে গেলুম, বললুম, ‘চশমা! স্যর অলিভার লজকে দেখাবেন? কিসের চশমা?’
তিনি উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেলেন, মাথা নীচু করে বসে রইলেন, তারপর হঠাৎ মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি ভূত বিশ্বাস কর?’
‘হ্যাঁ—প্রেতযোনি।’
মনে হল মাথা খারাপের কথাটা হয়তো নেহাত মিথ্যে নয়; নইলে আপাতদৃষ্টিতে এমন একজন বিজ্ঞ লোক আবোল-তাবোল কথা কয় কেন? বললাম, ‘যা চোখে দেখা যায় না, তা বিশ্বাস করি না।’
তিনি একটু হাসলেন, ‘যা চোখে দেখা যায় না, তাই যদি অবিশ্বাস কর, তা হলে তো পৃথিবীর অধিকাংশ জিনিসই অবিশ্বাস করতে হয়। এক বিন্দু জলে লক্ষ কোটি বীজাণু আছে, সে কি চোখে দেখা যায়? মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয়। এক্সরে দিয়ে জ্যান্ত মানুষের শরীরের গোটা কঙ্কালটা দেখা যায়—শাদা চোখে কি দেখতে পাও?’
আমি বললুম, ‘তা পাই না বটে, কিন্তু ভূত যে মাইক্রোস্কোপ কিংবা এক্সরে দিয়েও দেখা যায় না।’
তিনি আবার হাসলেন, গূঢ় রহস্যময় হাসি। তারপর বললেন, ‘তা বটে, কিন্তু শাদা চোখেও যে অনেকে দেখেছে!’
আমি বললুম, ‘তারা হয় ভ্রান্ত, নয় ঠগ।’
তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, পৃথিবীতে সকলকে ভ্রান্ত কিম্বা ঠগের পর্যায়ে ফেলা যায় না—খাঁটি লোকও আছে। শিশির ঘোষ জোচ্চোর ছিলেন না, নির্বোধও ছিলেন না। কিন্তু তোমার এখন বয়স কম, নাস্তিকতাই তোমার বয়সের ধর্ম। আমিও তোমার মতোই অবিশ্বাসী ছিলুম—বেশি দিন নয়, দু’বছর আগে পর্যন্ত আমি প্রেতযোনি সম্বন্ধে ঘোর নাস্তিক ছিলুম। তারপর হঠাৎ একদিন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। যে অপূর্ব জিনিস না জেনে আবিষ্কার করে ফেললুম, তাতে জীবনের ধারাটাই বদলে গেল।’
‘কি আবিষ্কার করলেন?’
তিনি কিছুক্ষণ স্থির থেকে বললেন, ‘একটা চশমা,—বাইনকুলারের লেন্সও বলতে পার।’
আমি উত্তেজিত হয়ে বললুম, ‘সেই চশমাই কি আপনার ব্যাগে রয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঐ চশমাই স্যর অলিভার লজকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি ব্যাপার, আমাকে সব বলুন, আমার ভারি কৌতূহল হচ্ছে।’
তিনি বললেন, ‘লোকের কাছে বলে যে রকম হাস্যাস্পদ আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, তাতে কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না। যাহোক, তুমি যখন আগ্রহ প্রকাশ করছ, তখন শোনো—
‘আমি বিজ্ঞানের অধ্যাপক; বিজ্ঞানের রাজ্যে বাতিক খেয়াল কল্পনার স্থান নেই—সেখানে নীরস নিষ্ঠুর সত্যের কারবার। সুতরাং ভূতপ্রেত সম্বন্ধে আমার মনে যে একটা মজ্জাগত বিরুদ্ধতা থাকবে, তা সহজেই অনুমান করতে পারবে। ভেবে দেখ, নিঃসংশয়ে ভূতপ্রেত বিশ্বাস করা যেতে পারে, এমন জোরালো প্রমাণ আজ পর্যন্ত কিছু পাওয়া গেছে কি? সবই ধোঁয়া-ধোঁয়া—অনিশ্চিত—বৈজ্ঞানিক কেউ কেউ স্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু বিজ্ঞান স্বীকার করেনি। বিজ্ঞান চায় নিরেট স্থূল সত্য, আবছায়া অস্পষ্ট কিছু সে চায় না।
‘তাই শিক্ষার গুণে আমিও চিরদিন ভূতপ্রেতকে ঠাট্টাই করে এসেছি—কোনান্ ডয়েল, স্যর অলিভার লজ—এদের ভ্রান্ত খেয়ালী মনে করেছি, কখনও ভাবিনি যে, আমিই একদিন অন্যকে বিশ্বাস করাবার জন্য ছুটোছুটি করে বেড়াব আর তারা আমাকে পাগল মনে করে আমার কথা হেসে উড়িয়ে দেবে। এইটেই বোধ হয় আমার জীবনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস।
‘বছর দুই আগে কলেজের ল্যাবরেটরিতে আমি দূরবীনের লেন্স নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলুম। একটা বড় সবুজ রংয়ের ক্রিস্টাল এক দিন কুড়িয়ে পেয়েছিলুম—সেইটে—কিন্তু তুমি বোধ হয় আর্টস স্টুডেন্ট, সব কথা বুঝবে না। মোটামুটি বলে রাখি, একটা অদ্ভুত ফিকে সবুজ রংয়ের ক্রিস্টাল হাতে এসে পড়েছিল; তাই থেকে নিজের হাতে কতকগুলো লেন্স তৈরি করেছিলুম। যন্ত্রের সাহায্য না নিয়ে হাতে করে ঘষে ঘষে লেন্স তৈরি করা সহজ নয়, বিস্তর সময় লাগে, তা ছাড়া সব-সময় নির্ভুল হয় না—বাঁকাচোরা থেকে যায়। কিন্তু আমার খেয়াল হয়েছিল, তাই নিজের হাতেই তৈরি করছিলুম।
‘একদিন দুপুরবেলা,—তখনও লেন্স সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি,—কেমন হচ্ছে দেখবার জন্যে আমি সেগুলোকে ফ্রেমের ওপর বসিয়ে চোখে পরলুম। চশমার দোকানে চোখ পরীক্ষা করবার সময় যেরকম ফ্রেম চোখে পরিয়ে দিয়ে তাতে বিভিন্ন শক্তির কাচ বসিয়ে বসিয়ে পরখ করে, দেখেছ বোধ হয়?’
আমি ঘাড় নাড়লুম। বিরাজবাবু বলতে লাগলেন—‘দুপুরবেলা ল্যাবরেটরিতে কেউ ছিল না, আমি দোর বন্ধ করে একা কাজ করছিলুম। কিন্তু চশমা চোখে দিয়ে মুখ তুলেই দেখলুম একজন লোক ঠিক আমার সামনের চেয়ারে বসে একদৃষ্টে আমার পানে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটা সায়েব, টক্টকে গোলাপী রং, মুখে ছুঁচোলো দাড়ি। তার অদ্ভুত বেশভূষা,—মধ্যযুগে য়ুরোপীয়রা যে রকম মখমলের জরিদার পোষাক পরত, সেই রকম। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাড়াতাড়ি চশমা খুলে ফেললুম;—দেখলুম, কেউ কোথাও নেই, চেয়ার খালি।
‘খানিকক্ষণ কিছুই বুঝতে পারলুম না; তারপর আবার চশমা পরে দেখলুম,—লোকটা বন্ধ দরজার ভিতর দিয়ে চলে গেল।
বিরাজবাবু চুপ করলেন। আমি রুদ্ধ শ্বাসে প্রশ্ন করলুম, ‘তারপর?’
বিরাজবাবু বললেন, ‘এমনই অভাবনীয় এই ঘটনা যে, ব্যাপারটা ভাল করে হজম করতেই কয়েক দিন কেটে গেল। শেষে বুঝলুম ভুল নয়, সত্যিই অজ্ঞাতসারে একটা অপূর্ব জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছি—যার সাহায্যে সূক্ষ্ম দেহও প্রত্যক্ষ করা যায়!
‘এ জিনিস নিয়ে কি করব, প্রথমটা ভেবেই পেলুম না। শেষে ঠিক করলুম আমাদের প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে বলব। তাঁর কাছে গেলুম, একটু উত্তেজিতভাবেই আমার আবিষ্কারের কথা বললুম। তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘সেন, আপনার শরীরটা খারাপ হয়েছে, আপনি কিছুদিন ছুটি নিয়ে বিশ্রাম করুন।’
‘নিরাশ হয়ে তাঁর কাছ থেকে ফিরে এলুম। তারপর প্রফেসরদের মধ্যে আমার অন্তরঙ্গ যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বললুম। তাঁরাও আমাকে ছুটি নিয়ে বিশ্রাম করবার উপদেশ দিলেন। আশ্চর্য আমাদের দেশের লোকের মনোভাব! কেউ একবার জিনিসটা দেখতে চাইলেন না,—একবার বললেন না, দেখি আপনার কথা সত্যি কি মিথ্যে।
‘মরীয়া হয়ে আমি য়ুনিভার্সিটির ভাইস্-চ্যান্সেলারকে এক দরখাস্ত করলুম। তাঁকে সব কথা জানিয়ে লিখলুম যে, তিনি যদি ইচ্ছে করেন, আমি সর্বসমক্ষে ডিমন্স্ট্রেট্ করে দেখাতে রাজী আছি।
‘হপ্তাখানেক পরে আমার চিঠির জবাব এল। ইতিমধ্যে বোধ হয় আমার পাগলামির কানাঘুষো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল; ভাইস্-চ্যান্সেলার সাহেব বিনীতভাবে আমাকে জানিয়েছেন যে, আমি যদি কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করবার দরখাস্ত করি, তা হলে তৎক্ষণাৎ আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হবে। —রাগের মাথায় কাজ ছেড়ে দিলুম।
‘তারপর সারা ভারতবর্ষে যত বিজ্ঞ সুধী আছেন, সকলের দোরে দোরে চশমা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি,—এমন সব লোকের কাছে গিয়েছি—যাঁদের পৃথিবী-জোড়া নাম; কিন্তু সকলের কাছেই এক উত্তর পেয়েছি। কেউ হেসেছেন, কেউ তাড়িয়ে দিয়েছেন, কেউ বলেছেন সময় নেই; কিন্তু আমার কথাটা সত্যি কি মিথ্যে, তা যাচাই করে দেখবার কৌতুহল কারুর হল না।
‘যখন দেখলুম, এ দেশে এই মহামূল্য আবিষ্কারের মর্ম কেউ বুঝবে না, তখন স্থির করলুম-বিলেত যাব। সেখানে অন্তত একজন লোক আছেন—যিনি প্রকৃত তত্ত্বান্বেষী—যিনি আমার কথা না শুনে আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না।
‘ইতিমধ্যে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে আরম্ভ করেছিল। বললে বিশ্বাস করবে না, চশমার ওপর নানারকম অলৌকিক উৎপাত হতে শুরু করেছিল। প্রেতলোকের যবনিকা মানুষের চোখ থেকে সরে যায়, এটা বোধ হয় তাদের অভিপ্রেত নয়, তাই রোজ চশমাটার ওপর নতুন নতুন দুর্ঘটনা ঘটতে লাগল। কখনও অকারণে হাত থেকে পড়ে যায়, কখনও ট্রেনে ব্যাগসুদ্ধ হারিয়ে যায়, কখনও চোরে চুরি করতে আসে—এই ধরনের ব্যাপার। যখনই চশমা চোখে দিই, দেখি, ওরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, চশমাটা ভেঙে ফেলবার ইঙ্গিত করছে। একবার একটা অদৃশ্য হাত আমার চুল ধরে এমন নাড়া দিলে যে, চশমাটা চোখ থেকে ছিটকে মেঝেয় পড়ল। ভাগ্যে কার্পেট ছিল, নইলে সেই দিনই ওটা যেত। যাহোক, অনেক কষ্টে অনেক যত্নে এখন পর্যন্ত তাকে অটুট রেখেছি—জানি না, শেষ পর্যন্ত স্যর অলিভার লজের কাছে নিয়ে যেতে পারব কি না। এ হচ্ছে যাকে বলে একটা freak, এর অবিকল নকল কখনও তৈরি হবে না।
ভদ্রলোকের অত্যাশ্চর্য কথাগুলো আমার বদ্ধমূল অবিশ্বাসের গোড়ায় যেন প্রবল নাড়া দিয়ে গেল। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আচ্ছা, এই চশমা যে-কেউ চোখে দিলেই ভূত দেখতে পাবে?’
‘হ্যাঁ—নিশ্চয় পাবে;—যদিও সে পরীক্ষা করবার সুযোগ আজ পর্যন্ত পাইনি। আমি নিজে যতবার পরেছি, ততবারই দেখেছি।’
আমি আর কৌতুহল দমন করতে না পেরে বললুম, ‘তা হলে আমাকে একবার দেখাতে পারেন?’
‘নিশ্চয় পারি।’—তিনি সানন্দে ব্যাগটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘দেখাবার জন্যে আমি ছটফট করে বেড়াচ্ছি, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, কেউ দেখছে না।’
ব্যাগ খুলে তিনি সযত্নে একটি তুলোয় মোড়া চামড়ার কেস্ বার করলেন, তারপর অতি সন্তর্পণে কেসটি খুললেন। কেসের মধ্যে একটি মজবুত গোছের চশমা—ঠিক চশমা নয়, আজকাল একরকম বাইনকুলার চশমা বেরিয়েছে, অনেকটা সেইরকম দেখতে। সামনে কতকগুলো সবুজ কাচ লাগানো—তার আশেপাশে পেতলের স্ক্রু। টর্টইজ-শেলের মোটা-মোটা আর্ম। বিরাজবাবু উঠে এসে সাবধানে আমার নাকের ওপর চশমাটি বসিয়ে দিলেন।
প্রথমে কিছুই দেখতে পেলুম না—কেবল সবুজ ধোঁয়া। বিরাজবাবু স্ক্রু ঘোরাতে ঘোরাতে কম্পিতস্বরে বললেন, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছ? এবার? এবার? এবার?’
ক্রমশ চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হতে লাগল—মনে হল যেন ধোঁয়া আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপর বায়স্কোপের ছবির মতো স্পষ্ট জিনিস দেখতে পেলুম।
ঘরে কেরোসিনের যে ল্যাম্পটা জ্বলছিল, তাতে সামান্য আলো হচ্ছিল, কিন্তু চশমার ভেতর দিয়ে দেখলুম,—আলো ঢের বেশি; উজ্জ্বল অথচ মোলায়েম। সে রকম অলৌকিক আলো কখনও দেখিনি—কোথা থেকে আসছে বোঝা যায় না অথচ সর্বত্র সমান ভাবে পড়েছে,—কোথাও ছায়া নেই। আশ্চর্য আলো-এইটেই বোধ হয় প্রেতলোকের দীপ্তি!
কিন্তু আলোর কথা থাক! সেই আলোতে যা দেখলুম, তা ভয়াবহ কিছু না হলেও হৃৎপিণ্ডটা একবার ডিগবাজি খেয়ে কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দেখলুম, টেবিল ঘিরে প্রত্যেক চেয়ারে একটি করে লোক বসে আছেন—তাঁদের পেছনে মাথার পর মাথা, ঘরের মধ্যে তিল ফেলবার জায়গা নেই! আর, সবাই তীব্র নির্নিমেষ চোখে আমার পানে তাকিয়ে রয়েছেন।
বিরাজবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দেখতে পাচ্ছ?’
গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুল না, তাই উত্তর দেওয়া হল না। ডান দিকে মাথা ফিরিয়ে দেখি, আমার গা ঘেঁষে একটি প্রেত দাঁড়িয়ে মুখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছেন। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি—ঠিক তাই। আমার মাথার চুলগুলো শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠল, হৃৎপিণ্ডটা আবার সচল হয়ে গলার কাছে ধড়াস্ ধড়াস্ করতে লাগল।
এঁদের যে কত রকম চেহারা, তা বর্ণনা করা যায় না। সাহেব আছেন, চীনাম্যান আছেন, ভারতীয় লোক আছেন, আবার নিকষকান্তি নিগ্রোও রয়েছেন—কোনও ভেদজ্ঞান নাই। একজন শীর্ণকায় উপবীতধারী ব্রাহ্মণ এবং একটি পালক-দেওয়া টুপি পরা যোলো শতাব্দীর সায়েব পাশাপাশি বসে রয়েছেন দেখলুম। সকলেরই দৃষ্টি আমার ওপর—ভাবে মনে হল, কেউ আমার প্রতি সন্তুষ্ট নন। যেন দাবি জন্মাবার আগেই আমি তাঁদের রাজ্যে ঢুকেছি বলে তাঁরা আমার ওপর ভয়ঙ্কর চটেছেন।
ক্রমে তাঁদের মধ্যে একটা আলোচনা শুরু হল দেখলুম; কানে কিছুই শুনতে পেলুম না, কিন্তু মুখ আর হাত নাড়া দেখে আন্দাজ হল যে, খুব উত্তেজিতভাবে তর্ক চলছে—এবং আমি যে এই তর্কের লক্ষ্যবস্তু তাতেও সন্দেহ রইল না। শেষে সেই পৈতে-পরা শীর্ণ ব্যক্তিটি আমার দিকে ফিরে আঙুল দেখিয়ে খুব তীব্রভাবে কি বলতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু কোনও ফল হল না, তিনি কি বললেন আমি এক বর্ণও শুনতে পেলুম না।
অনেকক্ষণ বক্তৃতা দেবার পর তিনি টেবিলের ওপর একটা নিঃশব্দ চপেটাঘাত করে চুপ করলেন। তখন আবার তাঁদের মধ্যে তুমুল তর্ক আরম্ভ হল।
এই সমস্ত ব্যাপার দেখতে দেখতে আমার মনের অবস্থাটা কি রকম হয়েছিল সে সম্বন্ধে বিশদভাবে কিছু বলিনি; বলবার দরকারও নেই। তোমরা সহজেই আন্দাজ করে নিতে পারবে। চশমার ভিতর দিয়েই যে এই ভূতের রাজ্য দেখতে পাচ্ছি, চশমা খুলে ফেললে আর দেখতে পাব না, এ কথা সাফ ভুলে গিয়েছিলুম। মনে হচ্ছিল শাদা চোখেই এঁদের দেখছি। যেন নির্জন মনুষ্যহীন একটা জায়গায় একপাল ভূতের মধ্যে এসে পড়েছি, তারা আমাকে ঘিরে বসে আমার ভাগ্য বিচার করছে।
তাদের তর্কের উত্তেজনা ক্রমেই বেড়ে উঠতে লাগল। আমার মনে হল আমাকে নিয়ে এরা ভীষণ কাণ্ড একটা কিছু বাধাবে। আমার বুদ্ধি বিবেচনা যা সামান্য অবশিষ্ট ছিল তাদের কাণ্ড দেখে তাও লুপ্ত হয়ে গেল। চশমাটা খুলে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যেত, কিন্তু তা না করে আমি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালুম।
অমনি তারাও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল, তারপরে কি একটা ভয়ঙ্কর সংকল্প করে জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে আস্তে আস্তে আমার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। আমি আর চুপ করে থাকতে পারলুম না, বিকট চিৎকার করে চেয়ার উল্টে ফেলে দরজার দিকে দৌড় মারলুম।
প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দৌড়ুতে দৌড়ুতেই ঘাড় ফিরিয়ে দেখলুম, তারা তেমনই ভিড় করে আমার পিছনে তেড়ে আসছে। এই সময় একটা বিরাট রৈ-রৈ শব্দ কানে গেল—‘খবরদার!’ ‘হুঁসিয়ার!’ ‘ট্রেন আতা হ্যায়!’ সঙ্গে সঙ্গে চলন্ত ট্রেনের ফোঁস ফোঁস হড়-হড় শব্দ! ঠিক প্ল্যাটফর্মের কিনারায় পৌঁছে আমি হ্যাঁচকা মেরে নিজেকে সামলে নিলুম-গরম এঞ্জিনটা সোঁ সোঁ শব্দ করে আমার প্রায় নাকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
হ্যাঁচকা দিয়ে নিজেকে সামলালুম বটে, কিন্তু ভারী চশমাটা নাকের উপর থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল ঠিক লাইনের ওপরে, আর গাড়ির চাকাগুলো গড়গড় করে সেটাকে গুঁড়ো করে দিয়ে চলে যেতে লাগল।
আমার হাতে পায়ে আর জোর ছিল না, অবশভাবে আমি প্ল্যাটফর্মের কাঁকরের ওপরেই শুয়ে পড়লুম। চেতনা লুপ্ত হয়ে আসছিল, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছিল—তারই মধ্যে ক্ষীণভাবে শুনতে লাগলুম, মন্দীভূত ট্রেনের চাকার আর লোহালক্কড়ের শব্দ—মনে হল, যেন এতক্ষণে সে প্রেতগুলা সবাক হয়ে আমাকে ঘিরে বিচিত্রস্বরে মহা আনন্দের হাসি হাসছে।
মিনিট কয়েক পরে সংজ্ঞা হয়ে দেখলুম, আমার চারিদিকে অসংখ্য লোকের ভিড় জমে গেছে, আর বিরাজবাবু পাগলের মতো আমার দুটো নড়া ধরে ঝাঁকানি দিচ্ছেন—আর বলছেন, ‘কি করলে—আমার চশমা কই? আমার চশমা কই? আমার চশমা—’
মূর্ছা যাওয়াই সদ্যুক্তি বিবেচনা করে আমি আবার মূৰ্ছিত হয়ে শুয়ে পড়লুম।
২৬ শ্রাবণ ১৩৪০