সবাই 007 নয়, কেউ 000
ইংরেজরা চলে যাওয়ার এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে বাবা যখন শিলিগুড়িতে বদলি হলেন, তখন আর পথেঘাটে বা অফিস-কাছারিতে লালমুখোদের দেখাই পাওয়া যায় না। বলতে কী, তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন সালে এ দেশে সাহেবদের ঘোর অনটন। এমনকী শিলিগুড়িতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানও ছিল না। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরই সাহেবরা উধাও হয়ে গেল। অথচ মাত্র সাত-আট বছর আগেও শহরে মফস্সলে সাহেবরা গিজগিজ করত। বাবার সহকর্মী সাহেবরা প্রায়ই এসে আমাদের রেল-বাংলোয় লাঞ্চ বা ডিনার করে যেত। সেই সব আচমকা-অতিথিদের জন্য আলাদা করে রান্না করার সময়ও মা পেত না। তারা দিব্যি সরষে-বাটা দিয়ে রান্না করা মাছ, ফুলকপির ডালনা বা ডাল আর ভাত নাকের জলে চোখের জলে হয়ে সাপটে খেত। তারা বেশির ভাগই রেলের কর্মচারী, বাবার সহকর্মী। কাটিহারে বা মাল জংশনে কিংবা দোমোহানিতে আমাদের চারপাশে সাহেবদেরও কোয়ার্টার বা বাংলো ছিল। ফলে সাহেব দেখে দেখে বড় হয়েছি।
মনে আছে কাটিহারে, যখন আমার ছয়-সাত বছর বয়স, ভীষণ দুষ্টু আর ডানপিটে বলে বদনাম ছিল, তখন সাহেবপাড়ার নির্জন রাস্তায় টো-টো করে ঘুরতাম, কার বাগান থেকে কোন ফলপাকুড় চুরি করা যায় তার ধান্দায়। আমাদের বাংলোর পিছন দিকে একটা ভারী সুন্দর বড় বাংলোয় বেশ কয়েকটা কাশীর পেয়ারার গাছ ছিল। খুব লোভ হত। কিন্তু সেটা লালমুখোদের বাড়ি, এবং রাগী কুকুরও ছিল সেই বাড়িতে। এক দিন আমি আর টুনটুনিয়া নামে একটি বিহারি ছেলে ওই বাংলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি, সেই বাড়ির ছোট ছোট গোটা কয়েক ছেলেমেয়ে নিচু পেয়ারাগাছে উঠে খুব হইচই করছে। আমি বরাবর মুখচোরা, টুনটুনিয়াকে বললাম, ওদের কাছে পেয়ারা চেয়ে নে না! টুনটুনিয়া এগিয়ে গিয়ে ওদের উদ্দেশে হিন্দিতে বলল, পেয়ারা দেবে? খোকাবাবু চাইছে। বাচ্চাগুলো প্রথমে অবাক হয়ে থমকে গেল, তার পর হঠাৎ আমাকে দেখে কলকল করে উঠল, রুণু! রুণু! কী করে ওরা আমার নাম জানত কে জানে। কিন্তু তার পরই পটাপট ডাঁসা এবং পাকা পেয়ারা পেড়ে আমাদের দিকে ছুড়ে দিতে লাগল। জামার কোঁচড় ভরে সেই পেয়ারা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। আর সেই পেয়ারার গায়ে কী যে সুন্দর পারফিউমের সুবাস লেগে ছিল!
শিলিগুড়িতে আচমকাই এক দিন এক টকটকে ফরসা রং আর নীল চোখের সাহেবকে আবিষ্কার করে আমি অবাক। সাহেব, কিন্তু ঠিক সাহেবের মতো সাহেব নয়। যে সব ডাকাবুকো হার্মাদ সাহেব দুনিয়া দাপিয়ে আধিপত্য করে বেড়ায়, এ যেন তাদের কেউ নয়। শুধু চেহারাটা সাহেবের মতো। গায়ে চেকারের ইউনিফর্ম, কিন্তু শরীরে ফিট করেনি। পাতলুন ঝুলে অন্তত তিন-চার ইঞ্চি ছোট, বোতাম খোলা কোটটাও বেঢপ।
যত দূর মনে আছে, তার নাম ছিল বোধহয় নেলসন। শিলিগুড়ির টাউন স্টেশনটির এক সময় খুব রমরমা ছিল। তখন সাহেব আমলে সাহেবরা দার্জিলিং মেল-এ এসে সকালে টয় ট্রেনে চেপে দার্জিলিং যেত।
এখনও টাউন স্টেশনের কাঠামোতে পুরনো ঐতিহ্যের চিহ্ন আছে। বিশাল সরাবজি-র রেস্টুরেন্ট ছিল স্টেশনে, ইংলিশ ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা হত। হ্যাম অ্যান্ড এগ, টোস্ট বাটার, কেক, ক্রিম, চিকেন কাটলেট, খাঁটি দার্জিলিং চা। সকালে গমগম করত জায়গাটা।
নেলসন সেই আমলেরই লোক। কিন্তু সম্ভবত ইংরেজদের চোখে সে ছিল কুলাঙ্গার। কারণ এত নিরীহ সাহেব আমি আর কখনও দেখিনি। গেটে দাঁড়িয়ে টিকিট চেক করত। কেউ টিকিট দিত না। বাড়ানো হাতটা ঠেলে যে যার বেরিয়ে চলে যেত। নেলসন কখনও বিনা টিকিটের যাত্রীকে ধরত না।
স্টেশন মাস্টারের ছেলে বিজয় ছিল আমার বন্ধু। সে নস্যি নিত। নেলসন তাকে দেখলেই ‘বিজে’ বলে হাঁক দিত। তার পর নস্যি চাইত। কুলিদের কাছ থেকে অম্লানবদনে খৈনি চেয়ে নিত সে। কারও কাছ থেকে বিড়ি বা সিগারেট।
নেলসন বিয়ে করেছিল দিশি কোনও মহিলাকে। শুনতাম তার বউ বেশ দজ্জাল, নেলসনকে খুবই শাসনে রাখে। বাজারে গিয়ে নেলসনকে শাকপাতা, চুনো মাছ বা কচুঘেঁচুও কিনতে দেখেছি। সব দিক দিয়েই সে হয়ে গিয়েছিল ভেতো এবং ঝাঁজহীন ভারতীয় এবং অনেকটাই বাঙালি। তবে কক্ষনও তাকে হিন্দি বা বাংলা বলতে শুনিনি। ওই একটা ব্যাপারে সে বরাবর সাহেব থেকে গিয়েছিল। উচ্চারণও ছিল ব্রিটিশ। সেখানে কোনও খাদ আমার কানে ধরা পড়েনি।
বিজয়কে এক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম, নেলসনের বয়স কত? বিজয় ঠোঁট উলটে বলল, কে জানে? সত্তর-টত্তর হবে বোধহয়। তবে চাকরি করছে কী ভাবে? রিটায়ার করেনি? তাও জানি না। বোধহয় বয়স কমিয়ে চাকরিতে ঢুকেছিল।
বাস্তবিক নেলসনকে যখন আমি প্রথম দেখি তখনই সে বেশ বুড়ো। তখন রেলের নিয়মে আটান্নতে অবসর নেওয়ার কথা। অথচ তখনও সে দিব্যি চাকরি করছে। রেলের ছোট্ট খুপরি কোয়ার্টারে থাকত সে। সেখানে কমোড ছিল না। তবে নেলসন নাকি দিশি জলভাতও চামচ-কাঁটা দিয়ে খেত। হাতে নয়। ও ব্যাপারে সে ছিল খাঁটি সাহেব। আর একটা ব্যাপারও ছিল। হ্যাট ছাড়া তাকে কখনও দেখিনি।
নেলসনের সঙ্গে আমি একটু ভাব করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তেমন সুবিধে হয়নি। কথা সে বিশেষ বলতে চাইত না। কোনও এক দুর্বোধ্য কারণে ভিতরে একটা কপাট সে বরাবর বন্ধ রাখত। শুনেছি বউয়ের সঙ্গে ঝগড়াও করত না সে।
পরে সাহেবদের দেশে গিয়ে অনেক বার দেখেছি সাহেবদের মধ্যে সবাই কিন্তু দিগ্বিজয়ী হার্মাদ নয়। নেলসনের মতো বিস্তর নির্বিরোধী, নিরীহ, ভিতু সাহেব যে সব দেশে বসবাস করছে, তারা কেউ জিরো জিরো সেভেন নয়। আমাদের মতোই জিরো জিরো জিরো।