সবচেয়ে বড় হিরে
লর্ড ডানসানী শুধু লেখক হিসেবে নয়, সৈনিক, ক্রিকেট-খেলোয়াড় আর শিকারি হিসেবেও ওদেশে সুপরিচিত। হালকা রসিকতা মিশিয়ে আষাঢ়ে গল্প পরিবেশনায় তার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। বিলিয়ার্ডস্ ক্লাবের সভ্য জরকেন্স হল তার অননুকরণীয় সৃষ্টি। তারই Travel Tales থেকে A Large Diamond অনুবাদ করা হল। আজ পর্যন্ত জরকেন্সের গল্পের সত্যতা নিয়ে কেউই চ্যালেঞ্জ করার স্পর্ধা দেখায়নি–তবুও শ্রোতাদের অস্বস্তি কমেনি এক বিন্দুও।
আগুনের সামনে বসেছিলাম আমরা কজন। লাঞ্চের পর ক্লাবের এই ঘরটাতেই নিয়মিত জমায়েত হই আমরা। সোফাতে কয়েকজন গা এলিয়েছিল, বাকি সবাই বসেছিল এদিকে-ওদিকে ছড়ানো চেয়ারগুলোতে। শীতের ম্যাজমেজে বিকেল, কুয়াশায় ধোঁয়াটে হয়ে এসেছে চারদিক। বিকেল তো নয়–রাত্রিই বলা উচিত। বেলা এগারোটায় যে দিনের শুরু হয়েছিল, তিনটে বাজার আগেই তা মুছে গিয়ে যেন রাতের ঘোমটা টানা শুরু হয়ে গেছে। এহেন অলস অপরাহ্নে না জানি কত মধুর চিন্তাই ভিড় করে আসে মনে, সে বিকেলে কিন্তু কুয়াশায় হাবুডুবু খেয়ে রীতিমতো মুষড়ে পড়েছিলাম আমরা। যতদূর মনে পড়ে এইভাবে শুরু হয়েছিল আমাদের কথাবার্তা।
আশ্চর্য! এ যে মস্ত বড় হে! মস্ত বড়? কোনটা?
এই হিরেটা।
ওঃ। আমি ভাবলাম তুমি বুঝি মাছটার কথা বলছ।
মাছ নয় এটা, হিরে।
কিন্তু শুধু ছবি দেখে ওভাবে তো কিছুই বলা সম্ভব নয় তোমার পক্ষে।
নিশ্চয়ই সম্ভব।
কী করে?
হিরের আসল মাপের ছবি এটা।
বুঝলে কেমন করে?
আরে গেল যা, তা তো লেখাই রয়েছে।
তোমার কি মনে হয় সম্পাদক মশাইও সঠিক মাপ জানেন?
নিশ্চয় জানেন।
কেমন করে?
কী মুশকিল! এরকম একটা দামি পাথরকে পৃথিবীতে চেনে না কে? শুধু কষ্ট করে একে ওকে জিগ্যেস করা, তার বেশি তো নয়।
কিন্তু শুধু একটা ছবি দেখে হিরের আকার বলা যে কী করে সম্ভব, তা তো ভেবে পাচ্ছি না।
পাচ্ছ না?
না।
না পেলেও খুবই বড় হিরেটা।
তবে বড়।
চমৎকার। আমিও তাই বলছিলাম।
বাগ্বিতণ্ডার এই একঘেয়েমি থেকে শুধু একটি জিনিসই আমাকে রেহাই দিলে। তা হল জরকেন্সের মাথা নাড়া। সেদিন ক্লাবেই ছিল জরকেন্স। গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ছিল সে। মস্তবড় হিরেটার প্রসঙ্গ শুরু হওয়ার সময়ে প্রথমে সে মাথা নাড়ে–তারপর আগাগোড়া কথা কাটাকাটির সময়ে আস্তে-আস্তে মাথা নেড়েই চলল সে। প্রথমে ওকে আমি বিশেষ লক্ষ করিনি; হয়তো করতামই না, যদি না মস্তবড় হিরে এই শব্দ দুটো প্রতিবার শোনার সঙ্গে-সঙ্গে প্রবলতর হয়ে উঠত তার মাথা নাড়ার বেগ। শুধু এইটুকু না থাকলে তার মতানৈক্যের একঘেয়েমি হয়ত আমার দৃষ্টিই আকর্ষণ করতে পারত না। নিশ্চয় কিছু বলবে জরকেন্স, এই আশায় কান খাড়া করে রইলাম কিন্তু টু শব্দটি এল না ওর দিক থেকে। অথচ বসে-বসে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে সে মাথা নাড়তে লাগল যে আমার মনে হল হিরে সম্বন্ধে এমন কিছু নিশ্চয় ও জানে যা আজ পর্যন্ত আমরা শুনিনি। কিন্তু এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পাত্র তো সে নয়। শেষপর্যন্ত কৌতূহল চাপতে না পেরে আমিই ওর নীরবতা ভঙ্গ করলাম। নিরেট-মাথা তর্কবাগীশ দুজন কাগজের নক্সা নিয়ে বাগবিতণ্ডা সবে শেষ করেছে। কাগজটার দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে সোজা শুধোলাম জরকেন্সকে, হিরেটা সত্য-সত্যিই মস্তবড় হে, তাই না?
না। শান্তভাবে বলল জরকেন্স।
কেন নয়? বললাম আমি। এর চাইতে বড় হিরে কি তুমি দেখেছ?
হ্যাঁ। বললে ও।
কোথায়?
যারা এরকম একটা পাথরকে মস্তবড় বলে মনে করে তারা আমার কাহিনি বিশ্বাসই করবে না। বললে জরকেন্স।
আমার যতদূর স্মরণ হয়, স্কেচটা কোহিনুরের।
বললাম, আমি কিন্তু করব।
আরও দু-একজন, খুব সম্ভব কুয়াশায় তিতিবিরক্ত হয়ে ঝুঁকে পড়ে বলল, আমরাও।
শুনে বেশ খুশি হয়ে উঠল জরকেন্স–উৎসাহ পেয়ে কোনওরকম গৌরচন্দ্রিকা না করে তৎক্ষণাৎ শুরু করে দিলে গল্পটা।
.
অনেক বছর আগে রাশিয়ার অনেক উত্তরে একটা উল্কা পড়েছিল এস্কিমোদের দেশে। বিরাট সে উল্কা। এক বছর কি তারও পরে খবরটা এসে পৌঁছল ইউরোপে–তাও গুজবের ছদ্মবেশে। গুজবটা শোনার সঙ্গে-সঙ্গে একটা জিনিস বুঝলাম যে উল্কাটা পাহাড়ের মতো বিরাট না হয়ে যায় না। গুজব থেকে আদত খবরটা নিংড়ে বার করা খুব কঠিন ব্যাপার নয়–ঠিক পথ ধরলেই হল। এস্কিমোদের নিছক একটা উপকথার ছদ্মবেশে প্রথম এল গুজবটা। ওরা বললে, লকলকে অগ্নি শিখাময় জ্বলন্ত রথে চড়ে আকাশ থেকে এক দেবতা নেমে এসেছে তাদের দেশেরথ হাঁকিয়ে গেছে দক্ষিণের দেশে। সারারাত আকাশ নাকি সিঁদুরের মত লাল হয়েছিল–আর চারদিকের চল্লিশ মাইল পর্যন্ত তুষার নাকি গলে জল হয়ে গেছিল।
বুঝতেই পারছ, এস্কিমোদের এসব গাল-গল্প বিশ্বাস করিনি আর আমি। কিন্তু জানোই তো সাদাসিধে মানুষগুলো সরল কারণেই গল্পের সৃষ্টি করে–ওদের এ কাহিনিরও উৎস একটা আছে নিশ্চয়। খবরটা সবারই চোখ এড়িয়ে গেল। আমার কিন্তু মনে হল, এ কাহিনির পেছনে একটা কারণই শুধু থাকতে পারে। নিশ্চয় এইরকম একটা কিছু ঘটেছে ওদের দেশে। উল্কাপাত হওয়াই সম্ভব। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে যত উল্কা পড়েছে, তাদের চেয়েও অনেক বড় সে উল্কা। শেষপর্যন্ত এই উল্কার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম আমি।
খুঁজে বার করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না আমায়। ভৌগোলিক তথ্যগুলো এস্কিমোরাই দিয়ে দিয়েছিল। বেগ পেতে হয়েছিল আসল কারণটুকু খুঁজে বার করতে। উপকূল থেকে পুরো দেড়দিন যেতে না যেতেই meteoric iron-এর একটা পাহাড় দেখলাম–যার সন্ধানে আসা তারই হদিশ পেলাম বলেই মনে হল। ম্যাপে এ পাহাড়ের কোনও উল্লেখই ছিল না–অবশ্য সে সময়ে ওদিককার ম্যাপে উল্লেখ থাকত না কোনও কিছুরই কাজেই প্রমাণ হল না কিছুই। পাহাড়টার উপাদান কিন্তু ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত, সেইরকম। যেখানে উল্কাটা পড়েছে, তার চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইলের মধ্যেই পড়েছিল পাহাড়টা–তবুও আমার খটকা গেল না। তাই চোখ-কান ঝুঁজে আবিষ্কারের উল্লাসে আত্মহারা হলাম না। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক অভিযানে বেরিয়েছিলাম আমি–আর জানোই তো বেখাপ্পা ব্যাপার তালে-গোলে ধামাচাপা দেওয়ার রেওয়াজ বিজ্ঞানে নেই। সেসব দিনে বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে খুব সচেতন থাকতাম আমি। অনেক বৈজ্ঞানিক অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। কয়েকটা হয়তো তোমাদের কাছে বলে থাকতে পারি।
জরকেন্স অবাক হোক, তা আমি চাইনি। কেননা এবার যদি তা হয়, তাহলে ওকে কায়দা করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।
শুধোলাম, কিন্তু পাহাড় দেখে তোমার খটকা লাগল কেন, তা তো কই বললে না?
আরে, অত বড় একটা বিশাল জিনিস–আকারে যা আল্পসের চেয়ে কম হবে না–অকল্পনীয় গতিতে মহাশূন্য পথে ধেয়ে এসে ধাবমান পৃথিবীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লে কী হবে বলো তো? বিপুল সংঘর্ষের ফলে জিনিসটা সিধে ঢুকে যাবে পৃথিবীর বুকে, সেঁধিয়ে যাবে ধরিত্রীর জঠরে চিরকালের জন্যে। কিন্তু তা তো হয়নি। চোখের সামনেই সেন্ট গোথার্ডের চূড়ার মতো নাক উঁচু করে পড়ে রয়েছে পাহাড়টা। বল্গা হরিণ-টানা শ্লেজ চালানোর জন্যে জন তিন-চার এস্কিমোকে সঙ্গে এনেছিলাম আমি। ওদেরকে বাধ্য হয়ে জিগ্যেস করলাম। জানোই তো, ইউরোপের এদিকে উল্কা সম্বন্ধে একমাত্র এস্কিমোদের গুজব ছাড়া আর কোনও খবরই আসেনি। আর এই গুজব ছাড়া কাজ শুরু করার মতো বিজ্ঞানসম্মত তথ্য কিছুই ছিল না আমার হাতে। ওদেরকে জিগ্যেস করতে ওরা কিন্তু সেই একই কাহিনি বারবার শোনাতে লাগল আমায়। পেল্লায় রথ চড়ে দেবতা আরও উত্তরে নেমেছে। পৃথিবীতে রথ চালিয়ে ছুটে এসেছে এই দিকেই। যেখানে সে নেমেছে, অগ্নিকাণ্ডটা ঘটেছে সেইখানেই–এদিকে নয়। আর তাই শুনেই বেশ কিছুক্ষণের জন্য মাথা গুলিয়ে গেল আমার। অগ্নিকাণ্ডের সহজ ব্যাখ্যা শুধু একটাই হওয়া সম্ভব। জ্বলন্ত জঙ্গলে লেলিহান আগুনই দেখেছে এরা দূর থেকে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কী, উত্তরে তো কোনও জঙ্গলই নেই। শুধু তুষার আর বরফ। বছরের মধ্যে শুধু মাসখানেকের জন্যে সে বরফ গলে যায় সামান্য যা উদ্ভিদ দেখা যায়, তা নিঃশেষ করে দেয় কটা বল্গা হরিণেই। এস্কিমো-ভাষার ডজন খানেক শব্দ আমার জানা ছিল কাজেই ওই সামান্য পুঁজি নিয়ে আর প্রচুর ইশারা-ইঙ্গিত মিশিয়ে অনেক প্রশ্ন করলাম ওদের। বিশাল একটা অগ্নিকাণ্ড যে বহু উত্তরে দেখা গেছে–সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই শেষ অবধি রইল না আমার।
আর তারপরেই বুঝলাম আসল কারণটা। নিশ্চয় ভোলা একটা কয়লার স্তর ছিল ওদিকে। জুলন্ত উল্কাপিণ্ডটা তার ওপর এসে পড়ায় দপ করে জ্বলে উঠেছে সমস্ত স্তরটা।
পাহাড়টার ধারেকাছে কিন্তু কোনও কয়লার চিহ্নই দেখতে পেলাম না। বুঝলাম, কয়লার স্তরের ওপর ঠিকরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছিটকে উঠে লাফাতে-লাফাতে উল্কাটা এগিয়ে এসেছে এই দিকেই। আমার এই সিদ্ধান্তই কিন্তু শেষপর্যন্ত সত্য হল। তোমরাও বুঝে দেখো, উল্কাটা তো আর টুপ করে খসে পড়েনি পৃথিবীর বুকে। তার ওপর শুধু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবই ছিল না–তাহলে তো সিধে পথেই আসত সে। কিন্তু তা তো নয়, উল্কার নিজস্ব কক্ষপথ আর নিজস্ব গতিবেগ একটা ছিল? এরই সঙ্গে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এক হওয়ায় ঢালু হয়ে গেল তার গতিপথ। সিধে না এসে তির্যক রেখায় আছড়ে পড়ে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর পর খুবই সহজ হয়ে গেল আমার কাজ। উল্কার গতিপথ অনুসরণ করে প্রথম যেখানে সে আছড়ে পড়েছে, সেখানে যাওয়া এরপর আর মোটেই কঠিন কাজ নয়। কঠিন শুধু থিওরি তৈরি করা হাতেনাতে কাজ তো যে কেউ করতে পারে। দেখলাম, বেশ কয়েক জায়গায় পাহাড়টা ধাক্কা মেরেছে ভূস্তরকে–এক মাইল অন্তর-অন্তর সেইসব সংঘর্ষস্থানগুলোয় সৃষ্টি হয়েছে জলশূন্য হ্রদের মতো অগভীর গর্তের। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর ব্যবধান বেড়ে যেতে লাগল–সেইসঙ্গে গম্ভীর হয়ে উঠতে লাগল গর্তগুলো, বেশিরভাগ গর্তেই হ্রদের মতো জল জমেছিল। তুষার খুব তাড়াতাড়ি গলে যাচ্ছিল বলে পাহাড়টার কাছে বক্সা হরিণগুলোকে রেখে আসতে হয়েছিল আমায়। বছরের যে মাসে বরফ গলে যায়, সেই মাসেই শুরু করেছিলাম আমার অভিযান–তাই জমি দেখতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না।
ভালো কথা, ফস করে প্রশ্ন করে একজন, রাশিয়ায় কি হিরে আছে?
রাশিয়ায় কি হিরে আছে? অনুকম্পা মিশিয়ে প্রতিধ্বনি করল জরকেন্স।
কিন্তু হিরের গল্পই তো বলছ, তাই নয় কি?
শুনতেই পাবে তা, শুনতেই পাবে, বলে জরকেন্স। তারপর শুধোয়, হিরে জিনিসটা আদতে কী তা নিশ্চয় জানো আশা করি?
ইয়ে, তা জানি বইকী। দু-একজন আমতা-আমতা করে ওঠে, স্পষ্ট বুঝলাম কেউই জানে না আসল উত্তরটা কী। একজন শুধু জানত। সেই বললে, দানা বেঁধে যাওয়া কার্বন।
আবার গল্প শুরু করল জরকেন্স।
তুষার সমস্তই গলে গেছিল। এইভাবে আগে থেকেই সময় হিসেব করে যাত্রা শুরু করেছিলাম। তিনটে গাধা নিয়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে সঙ্গে রইল শুধু তিনজন এস্কিমো। গাধা তিনটে কিনেছিলাম গ্রামের মতো একটা জায়গা থেকে; অবশ্য কটা কুঁড়েঘরকে তোমরা গ্রাম নিশ্চয় বলবে না। আজ যেখানে দেখবে সেগুলো–পরের বছর এসে তাদের আর কোনও পাত্তাই পাবে না সেখানে। কিটব্যাগগুলো গাধার পিঠে চাপিয়ে হেঁটে চললাম আমরা।
মস্ত একটা গহ্বরের কাছে এসে পৌঁছলাম সবাইজল জমে বরফ হয়ে গেছে সেখানে। বিশাল একটা হ্রদনলখাগড়ার চিহ্ন ছিল না আশেপাশে কোনও বুনোপাখিও সন্ধান পায়নি হ্রদের। নিঃসীম শূন্যতায় ধু-ধু করছিল চারদিক। কনকনে ঠান্ডা আর মরা দীপ্তির ঝিকিমিকিতে সে নির্জনতা যেন আরও অসহ্য হয়ে উঠেছিল। বরফ গলে প্যাঁচপেচে হয়ে এসেছিল চারদিক। এরপর পঁচিশ মাইলের মধ্যে আর কোনও গহুর নেই। এইটাই তাহলে পৃথিবীর সঙ্গে পাহাড়টার শেষ সংঘাত, অথবা প্রথমও হতে পারে, কেননা আমি তো হাঁটছিলাম বিপরীত দিকে। বিশাল হ্রদটার দশ মাইল উত্তরে তাঁবু ফেললাম আমরা। পরের দিন তাঁবুটাবু গুটিয়ে নিয়ে পাড়ি দিলাম আরও পনেরো মাইল। পথের শেষে এসে পৌঁছলাম উল্কা যেখানে সর্বপ্রথম পৃথিবীর বুকে ঠিকরে পড়ে ছিটকে উঠেছিল, সেইখানে। মাধ্যাকর্ষণের টানে নিজের গতিপথ ছেড়ে এইখানেই আছড়ে পড়ে উল্কাটা–তারপর ছিটকে উঠে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে গেছে যেদিক থেকে এসেছি, সেইদিকে।
প্রথম সংঘাত যে এইখানেই, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই আর রইল না আমার। প্রথমত কয়লা সম্বন্ধে আমার সিদ্ধান্ত যে অভ্রান্ত তার প্রমাণ পেলাম মাইলখানেক পরে শুধু অঙ্গার দেখে যন্দুর মনে হল খুব পুরু একটা কয়লার স্তরের একেবারে নীচ পর্যন্ত স্কুলে গেছে। তারপরই এসে পড়লাম বিশাল একটা মসৃণ সমতলভূমির ওপর বহু দূরে দিগরেখায় গিয়ে মিশেছিল চ্যাটালো জমিটা। আর কী দারুণ ঠান্ডা। সর্বত্র তুষার গলে গেছে কিন্তু এ জমি তখনও ঢাকা রয়েছে সাদা তুষারে। পরের দিন সকালে এই ধু-ধু ফাঁকা জমিটার ওধারে আরও কয়েক মাইল যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, তাই রাতের মতো সেইখানেই তাঁবু ফেলতে বললাম, কিন্তু রাজি হল না এস্কিমোরা। কারণ জিগ্যেস করলাম। ওরা বললে, খারাপ বরফ। তুষারের মধ্য দিয়ে খোঁচা দিয়ে দেখলাম, বাস্তবিক ইস্পাতের মতো কঠিন সে বরফ। ওরা কিন্তু বারবার বলতে লাগল, খারাপ বরফ। তাতে ক্ষতি কী? ওদের ভাষা যতটা পারলাম বললাম।
দারুণ ঠান্ডা। খুব খারাপ বরফ। বললে ওরা।
বরফ ঠান্ডা হলে বুঝি খুশি হও না তোমরা? জিগ্যেস করার চেষ্টা করি আমি। কিন্তু দেশি লোকদের সঙ্গে এ শ্লেষের কোনও মানেই হয় না বিশেষ করে ইঙ্গিত দিয়ে তো শ্লেষ ফোঁটানো যায় না।
ওরা শুধু বললে, না। খুব ঠান্ডা।
ধুত্তোর, বলে শেষ অবধি তবু সমেত একটা গাধা নিয়েই রওনা দিলাম তুষারের মধ্য দিয়ে। খুঁটি পুঁতে গাধাটাকে বাঁধবার কোনও ব্যবস্থা করতে পারলাম না কাজেই একটু জিরিয়ে নিয়ে সেই রাতেই সরে পড়ল সে; আমি কিন্তু কোনওরকমে তাঁবু খাঁটিয়ে হাড় কাঁপানো নিদারুণ ঠান্ডা সত্ত্বেও একটু ঘুমের চেষ্টা করলাম। সেই আশ্চর্য নিথর নৈঃশব্দ্যকে কোনও ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়; বরফ ভাঙার ক্ষীণ শব্দও নেই, নেই জলের কুলকুল ধ্বনি। বরফের মধ্যে দিয়ে গুঙিয়ে ওঠে কত হাজারও রকমের বিচিত্র শব্দ, কিন্তু শুধু গাধাটার শ্বাসপ্রশ্বাসের ফেস-ফোঁস শব্দ ছাড়া পেলাম না কোনও প্রাণের সাড়া, ফিসফিসানি অথবা মর্মরধ্বনি; সব কিছুকেই টুটি টিপে কেউ যেন বোবা করে দিয়েছে। শেষপর্যন্ত গাধাটাও চলে গেল, পাঁচ মাইল পর্যন্ত শুনলাম ওর যাওয়ার শব্দ–সে শব্দ ছাড়া চারপাশের দিগন্ত জোড়া ধু-ধু শূন্যতার মাঝে ছিল না আর কোনও শব্দ। তাই পাঁচ মাইল পেরিয়ে অপর পারে পৌঁছনো না পর্যন্ত স্পষ্ট শুনতে পেলাম তার পায়ের শব্দ। কনকনে ঠান্ডার মধ্যে সেই অস্বাভাবিক নিঝুম নিস্তব্ধতা অনেকক্ষণ পর্যন্ত জাগিয়ে রাখলে আমায়। ভোর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে স্কেট পরে নিলাম; কিন্তু তার আগেই বুঝেছিলাম, একটা কিছু গলতি আছে এখানে, এস্কিমোদের কথাই ঠিক। স্কেট পরে নিলাম, কেননা তুষার একেবারে গলে গেছিল–কোনও চিহ্নই আর দেখলাম না তার। হার্ড টেনিস কোটের ওপর তুষার গলে গেলে যেমন দেখায়, সেইরকমই দেখাচ্ছিল চারদিক। বল্গা হরিণের গাড়িতে ফেলে এসেছিলাম তুষার জুতো, তাই রাত্রে বুট পরে হাঁটতে হয়েছিল। কিন্তু এখন স্কেট পরে নিয়ে মনেমনেই হিসেব করে দেখলাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাব অপর পারে। কিন্তু আশ্চর্য একটা জিনিস লক্ষ করলাম। বরফের এরকম জৌলুস এর আগে কখনও দেখিনি। অচিরেই পায়ের তলার বরফের আর একটা বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করলাম। ইস্পাতের চেয়েও অনেক কঠিন সে বরফ। আমার স্কেটজোড়া তো কিছুতেই আঁকড়ে ধরতে পারল না তার মসৃণ গা–বারবার হড়কে গিয়ে আর আছাড় খেয়ে সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল আমার। উল্কার সঙ্গে সংঘর্ষে কী এমন পরিবর্তন আসতে পারে এখানকার বরফে–তাই ভাছিলাম। আর তখনই আচমকা বুঝলাম ব্যাপারটা। বরফের চেয়ে কঠিন যদি হয়–তবে এ বরফ নয়। চার হাত পায়ে ভর দিয়ে নীচু হয়ে বরফের দীপ্তির গভীরতায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝলাম আসল ব্যাপারটা। পকেট-ছুরিটা বার করে আঁচড় কাটবার চেষ্টা করলাম। কোনও দাগই পড়ল না। যেসব জিনিসের ওপর ইস্পাতেরও কোনও দাগ পড়ে না, তাদের সংখ্যা পৃথিবীতে খুব বেশি নয়–এ জিনিসটাও তাদেরই অন্যতম। সে সময়ে একটা আংটি পরতাম আমি; আংটিটার সোনার মাঝে গাঁথা ছিল একটা পাথর। পাথরটা আসলে একটা পাথুরে কৃস্টাল। না, না, এখন যেটা দেখছ আঙুলে, এটা নয়–সেটা আসল পাথর ছিল। লোকে ভাবত হিরে–যদিও সে উদ্দেশ্যে কিনিনি পাথরটা। কী কারণে কিনেছিলাম তাও মনে নেই–বোধহয় নিছক খেয়ালের বশে অথবা দেখতে ভালো লেগেছিল বলেই। সে যাই হোক, পাথর সমেত আংটিটা আঙুলেই ছিল তখন। খুলে নিয়ে ঠান্ডা ঝকঝকে জিনিসটার ওপর বেশ করে ঘষলাম সেটা–কোনও আঁচড়ই পড়ল না। দুটোই যদি পাথুরে কৃস্টাল হত, তাহলে আঁচড় নিশ্চয় পড়ত। কাজেই সম্ভাব্য জিনিসগুলোর সংখ্যা আরও কমে এল। ভিজে পাথরটার ওপর বসে খুলে ফেললাম স্কেট। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ানক দীপ্তি থেকে চোখ আড়াল করে ভাবতে লাগলাম। এ বিশাল সমতল জমিটা যে বরফ–সে কথা ভেবে আর লাভ নেই। অবিজ্ঞানীরাই এ ধরনের আজেবাজে চিন্তায় সময় নষ্ট করত। কিন্তু ইস্পাত ছুঁইয়ে তো প্রমাণ হয়ে গেছে বস্তুটা আদতে কী। কাজেই নতুন থিওরি চিন্তা করতে হল আমায়। খুব সহজেই শেষ হল আমার চিন্তা। ধরো, তুমি নিজেই একজন বিজ্ঞানবিৎ; তাহলে যে-কোনও একটা পাথর দেখলে প্রথমেই কী করো তুমি? কোন স্তরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেইটাই লক্ষ কর, কেমন? একথা ভাবামাত্রই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। আমি দাঁড়িয়েছিলাম কয়লার ওপর; কিনারার চারধারে পোড়া অঙ্গার আমি দেখে এসেছি। আর জানোই তো কয়লা কী।
কার্বন। শেষ যে কথা বলেছিল, সেই আবার উত্তর দিলে।
কিন্তু…, আর একজন শুরু করে। শান্তভাবে জরকেন্স তাকেই শুধোয়, আচ্ছা, কার্বন বা ওই জাতীয় কিছুকে দানা বাঁধাতে কী দরকার তা জানো নিশ্চয়?
চাপ, তাই না? বলে অপরজন।
কল্পনা করতে পারি না এমনই চাপ, আর আজ পর্যন্ত যত আগুন আমরা জ্বালাতে পেরেছি, তার চাইতে কল্পনাতীত বেশি উত্তাপ। বললে জরকেন্স। অবশ্য ক্ষমতাতীত নয়, কেননা, ল্যাবরেটরিতে একটা হীরা আমরা তৈরি করতে পেরেছি। কিন্তু তার আকার এতই ছোট্ট আর প্রয়োজনীয় চাপ এমনই ব্যয়বহুল যে আমার তো মনে হয় না সে চেষ্টা আর কেউ করেছে বলে। কিন্তু কল্পনা করো তো উত্তাপে সাদা একটা পাহাড় মিনিটে হাজার মাইল বেগে ধেয়ে চলেছে; সেই সঙ্গে যোগ দাও আমাদের পৃথিবীর গতিবেগ–তাও প্রায় মিনিটে হাজার মাইল, বরং মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জন্য আরও কিছু বেশি। তারপর সমস্ত জিনিসটাকে সিধে আছড়ে ফ্যালো কার্বনের একটা জমির ওপর। ফলাফল জানার জন্যে কষ্ট করে এতদূর না হলেও চলত আমার। কিন্তু এসেই যখন পড়েছি, তখন স্থির করলাম ওদিক পর্যন্ত গিয়ে সবটুকু দেখতে হবে আমায়। কিন্তু কী কষ্টে যে এই পথ চলেছিলাম, তা বোঝাতে পারব না। ভয়ংকর কঠিনতা, নিদারুণ ঠান্ডা আর মারাত্মক জৌলুস, শ্রান্ত পা, মাথা আর মন। আসলে আমি খুঁজছিলাম সামান্য একটু খাঁজ কি চিড়-যার ফাঁকে আমার ছুরির ফলাটা বা স্কেট ঢুকিয়ে বেশ বড় একটা চাই খসিয়ে আনতে পারি। কিন্তু জানি না বিশ্বাস করবে কিনা সমস্ত পথ হেঁটেও এতটুকু ফাটল দেখতে পেলাম না কোথাও।
সাঙ্ঘাতিক জ্বলজ্বলে ওই দীপ্তিতে মাথা ধরে গেছিল আমার–যতই এগোতে লাগলাম, ততই তা বাড়তে লাগল। ওদিককার অক্ষাংশে জুন মাসের শেষে এমন কোনও রাতের আবির্ভাবের সম্ভাবনা ছিল না যাতে আমি একটু আরাম পেতে পারি। শ্রান্ত পা দুটো টেনে-টেনে চলতে লাগলাম আমি হিরে দেখে এরকম ক্লান্ত আর কখনও হইনি আমি। লেডি ক্লাশনের ইভনিং পার্টিতে আমার না যাওয়ার এইটাই আসল কারণ–যাকে খুশি এখন তা বলতে পারো। যাক, চললাম তো চললামই। তারপর অনেকক্ষণ পরে, অন্য দেশে যখন সন্ধ্যা, এসে পৌঁছলাম অপর পারে। পোড়া অঙ্গার ছাড়া সেখানে আর কিছুই দেখার ছিল না। ছাই আর ধুলোর মধ্যে হাঁটা খুবই কষ্টকর সন্দেহ নেই, কিন্তু তবুও হিরেটা আবার এড়োএড়ি পেরোবার চেষ্টা না করে সমস্ত পথটা ছাই মাড়িয়েই এলাম। সলোম পশুচামড়ার পোশাক পরেছিলাম–তাই ঘুমোতে পেরেছিলাম পথেই। দিনভর বিশ্রাম নিয়ে রওনা দিলেও একদমে সমস্ত পথটা পেরোবার ক্ষমতা আমার ছিল না। হিরের পার বরাবর ছাই মাড়িয়ে দীর্ঘপথ পেরিয়ে ফিরে এলাম যাত্রা শুরুর জায়গাটিতে।
এস্কিমোগুলোকে দেখলাম বটে, কিন্তু কোনও প্রলোভনেই ওরা হিরেটার কাছে যেতে রাজি হল না। দেবতা বিদায় নেওয়ার পর শয়তান এসে আড্ডা গেড়েছে ওখানে–জাদুমন্ত্রে সমস্ত জায়গাটুকু ঠান্ডায় আর জ্বলজ্বলে দীপ্তিতে ভরিয়ে তুলেছে। ওদের ভাষা তো বেশি বুঝি না, তাই বুঝলাম না, শয়তান মহাপ্রভু দেবতার পিছুপিছু পৃথিবীতে এসেছিল, না দেবতার অন্তর্ধানের পর বেদখল করেছে জমিটুকু। সে যাই হোক, সব কিছুরই সহজ একটা ব্যাখ্যা থাকে; ওরা গেল ধর্মের ব্যাখ্যায় আর আমি এলাম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়।
উপকুলে এসে অনেক পরিশ্রম আর বেশকিছু প্রচারকার্য চালিয়ে হয়তো খানিকটা ডিনামাইট সংগ্রহ করে ফিরে এসে Rue de la Paix-এর ভাড়ার ভরাবার মতো বেশকিছু টুকরো হিরে নিয়ে যেতে পারতাম। প্যারীর নাম শুনেছ তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেইখানেই। কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল তার চাইতেও অনেক বড়। পৃথিবীর সবকটা বাড়ি আমি সুন্দর করে তুলতে চেয়েছিলাম। এমন একটা কোম্পানি গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, যারা মধ্যবিত্তের হাতের মুঠোয় এনে দিত আশ্চর্য সুন্দর হিরের বেলওয়ারী ঝাড়। জমকালো ফুলদানির পরিকল্পনাও ছিল। আরও রকমারি রোজকারের ব্যবহারের জিনিসপত্র তৈরির পরিকল্পনা এসেছিল আমার মাথায়।
কিন্তু শেষপর্যন্ত হল কী? ঠিক যেদিন আমি লন্ডনে পৌঁছলাম, সেদিনই রাস্তায় পোস্টার দেখলাম–বিরাট ভূমিকম্প… শুধু এইটুকু দেখেই ছুটলাম খবরের কাগজওয়ালাদের দোকানে। একটা কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ তাই বটে। রাশিয়াতেই হয়েছে ভূমিকম্পটা।
আমি জানতাম। পৃথিবী যে কী প্রচণ্ড ঘা খেয়েছে, তা আমি জানতাম। জানতাম, ওই ভীষণ সংঘর্ষে পৃথিবীর বুক থেকে বহু মাইল ভেতর পর্যন্ত টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে, ফেটে-ফুটে গেছে। সমস্ত স্তরগুলো। ধরো, তোমার কোনও বন্ধুর গোড়ালি বা হাঁটু জখম হয়েছে, তারপরেই হঠাৎ একদিন কাগজে তার নাম দেখলে। তৎক্ষণাৎ তুমি বুঝে নেবে আদতে হয়েছে কী। জখম হাঁটু আর গোড়ালি যে বন্ধুটির দেহভার বইতে পারেনি, পড়ে গিয়ে বেশ আহত হয়েছে সে, তা বুঝতে তোমার এক লহমাও লাগে না। প্রবীণা ধরিত্রীর বেলাও ঘটেছে তাই। কী প্রচণ্ড আঘাত যে সে বুক পেতে নিয়েছে, তা আমি জানতাম। তাই যে মুহূর্তে ভূমিকম্প শব্দটা দেখলাম, বুঝলাম সব কিছুই। ওরা সিসমোগ্রাফ দেখে উৎপত্তিস্থান বার করেছে–আমি কিন্তু কিছু না দেখেই ঠিক আসল কেন্দ্রটি বলে দিতে পারতাম।
তৎক্ষণাৎ ফিরে গেলাম আমি সবকিছুই নিজের চোখে দেখতে। স্বচক্ষে না দেখে তো আর কোম্পানি গঠন করা চলে না। পরের বোটেই গেলাম। যে ভয় করেছিলাম, অবস্থা দেখি তার চাইতেও অনেক খারাপ। সাঙ্ঘাতিক ভূমিকম্প। আশ্চর্য হলাম না মোটে–আঘাতটা তো আর সামান্য নয়। বরং ওই আঘাত সয়ে এতদিন ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটাই তো আশ্চর্য। অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে উঠেছে। সামান্য একটু ঢালু অবস্থায় দেখে গেছিলাম হিরেটাকে। ও অবস্থায় না থেকে যদি সমতল অবস্থায় থাকত, তাহলে কখনই এভাবে বেমালুম চোখের আড়াল হত না। কিন্তু এতটা আশা করাও যায় না। কল্পনাতীত একটা রেল দুর্ঘটনার পর সেতুর খিলানগুলো যেরকম টুকরো-টুকরো হয়ে যায়, সেইভাবেই গুঁড়িয়ে গেছিল ভূ-স্তরগুলো। কাজেই দীর্ঘদিন কোনওরকমে খাড়া থাকলেও এক সময়ে আর ভার সইতে না পেরে স্রেফ টুপ টুপ করে ভূগর্ভে ধ্বসে পড়েছে স্তরগুলো। যেভাবেই হোক না কেন অদৃশ্য হয়ে গেছে হিরেটা। এমনকী অঙ্গারগুলোরও কোনও হদিশ পেলাম না। হিরের ধার বরাবর সাগরের বেলাভূমির মতো পড়েছিল অঙ্গারের রাশ। সব চিহ্ন সমেত তলিয়ে গেছে হিরে আর সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে ধরিত্রীর মুখ। এই হয়তো ভালো। হিরে রইল না বটে কিন্তু তাতে মানবসমাজের মঙ্গল বই অমঙ্গল কিছু হল না। কিন্তু কস্মিনকালেও দার্শনিক নই আমি, তা তো জানো। হিরেটার আকারও তুচ্ছ নয়–যে ক্ষতি আমার হল, তাও বলবার নয়। তবুও মুখ বুজেই থাকি। কিন্তু বড় হিরেটিরে নিয়ে কেউ যদি বড়-বড় কথা বলে, তাহলেই মেজাজ যায় বিগড়ে। কী করব বলো, সামলাতে পারি না নিজেকে।
কিন্তু মাটি খুঁড়ে কি উদ্ধার করা যেত না! হঠাৎ রাগেদুঃখে যেন কী বলবে ভেবে পায় না জরকেন্স।
মাটি খুঁড়ে কি উদ্ধার করা যেত না! নিশ্চয় যেত। কিন্তু শুরুতেই লাগত হাজার দুয়েক লোক। ঠিকমত আটঘাট বেঁধে কাজ করতে গেলে হাজার পঞ্চাশের কমে অবশ্য সম্ভব নয়–মজুরিও তো খুব সস্তা ওখানে হপ্তায় দশ শিলিংই যথেষ্ট ওদের পক্ষে। তাহলে গিয়ে প্রতি হপ্তায় যাচ্ছে পঁচিশ হাজার পাউন্ড। দশ হপ্তায় যদিও কাজ শেষ হত না–তবুও ফলাফলের মুখ দেখতে পেতাম খানিকটা। তাহলে শুধু মজুরিই যেত আড়াই লক্ষ পাউন্ড। সেই অনুপাতে টাকা লাগত ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে–আর প্রায় তত টাকাই যেত গাড়ির আয়োজনে। তারপর ছিল বাড়ি ঘর-দোর তৈরির খরচ; স্রেফ আদিম প্রথার কুঁড়ে বানালেই কাজ চলে যেত আমাদের। মোটমাট দশ লক্ষ পেলেই কাজ শুরু করা যেত। লন্ডন শহরে দশ লক্ষ পাউন্ড কি সোজা কথা হল? সবরকম চেষ্টাই করেছি। আমি; বকবক করেছি একনাগাড়ে ঘন্টার-পর-ঘণ্টা, যত পেরেছি মদ গিলিয়েছি। কিন্তু কেউই রাজি হল না দশ লক্ষ ঢালতে। হায়রে, লাভের হিসেবটা একবার ভাব তো! তুচ্ছ ওই দশ লক্ষ পাউন্ডের লাভ দাঁড়াত, শতকরা কোটি-কোটি পাউন্ড। কিন্তু রাজি হল না কেউই। শেষপর্যন্ত ওরা যে আসলে কী, তা ওদের মুখের ওপর বলে দিয়ে ছেড়ে দিলাম সব প্রচেষ্টা।
ওয়েটার! হাঁক দিল জরকেন্স। খুব ছোট্ট একটা হুইস্কি এনে দাও–আর সামান্য একটু সোডা ছিটিয়ে দিও তাতে।
আমাদের ক্লাবে খুব ছোট্ট হুইস্কি পাওয়া যায় না। ছোট্ট হুইস্কি অবশ্য আছে কিন্তু সব ওয়েটারই জানে জরকেন্সের কাছে ছোট্ট হুইস্কি কখনও না চলে না। * মাসিক রোমাঞ্চ পত্রিকায় প্রকাশিত। (কার্তিক, ১৩৬৬)