চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

সবই তো ছোট দিন

সবই তো ছোট দিন

সায়েবরা চলে গিয়ে বড়দিন কেমন যেন মিইয়ে গেছে। শহরও ভেঙেচুরে গেছে। বৃটিশ রাজমুকুটের মণি শহর কলকাতা সমস্ত সৌন্দর্য হারিয়ে হতশ্রী। তেমন শীতও আর পড়ে না। এলোমেলো বিশৃঙ্খল জীবনে আর আগের সুখ নেই। কি হিন্দু, কি খ্রিস্টান সকলেরই এক অবস্থা। সকলেই আমরা ত্রুশবিদ্ধ যিশু। মাথায় অস্বস্তি আর অনিশ্চয়তার কাঁটার মুকুট পরে দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছি।

অতীতের কথা মনে পড়ে। বড়দিন শুধু খ্রিস্টানের ছিল না, ছোঁয়া এসে লাগত আমাদের জীবনে। উৎসবের সাজে সেজে উঠত কলকাতা। হিন্দুর উৎসব, পালা পার্বণ বড় শব্দময়। হই-হই রই-রই না হলে ঠিক জমে না। বাবার মাথায় জল ঢালা থেকে রথের দড়ি ধরে টানা সবেতেই একটা যুদ্ধংদেহি ভাব। দু-একজন পদদলিত হলেও দু:খের কিছু নেই। বরং আনন্দের কথা ভাগ্যের কথা। মৃত সোজা স্বর্গের পাশপোর্ট পেলেন। হিন্দুর বিয়ে একটা গ্যালো-গ্যালো ব্যাপার। ইদানীং সানাইয়ের বদলে যুক্ত হয়েছে হিন্দি ছায়াছবির গান। বড় ঘরে ইলেকট্রিকের জগঝম্প মিউজিক। রাস্তার কোণে ডাঁই করা কলাপাতা, খাদ্যের ভুক্তাবশেষ, চিংড়ি মাছের খোলা। সাতদিন গ্যাস মাস্ক পরে হাঁটাচলা করলেই ভালো হয়। ঘরে রজনীগন্ধা, বাসরে আবর্জনার পচা গন্ধ। প্রাণ হায় রে পাঁচু বললে শুনছে কে? আমাদের সংজ্ঞাটাই অন্যরকম। আমাদের জীবনে বিশেষ পার্থক্য নেই। আমরাও ভগবান, গুরুও ভগবান। যিশুর ধর্মে মানুষ ভগবানের পুত্র। তিনি যেসব আচরণ বিধি রেখে গেছেন, তার ভিত্তিভূমি হল শৃঙ্খলা, অসীম ডিসিপ্লিন। সব ব্যাপারেই একটা পরিচ্ছন্নতা। বিশ্বজুড়ে যার নাম খ্রিস্টান ডিসিপ্লিন। চার্চের ঘণ্টার মধ্যে একটা গম্ভীর হিন্দু-হিন্দু ভাব আছে। বৈদান্তিক হিন্দু। চার্চের আকাশ ছোঁয়া ধারালো গঠন যেন মূলাধার চক্র থেকে সোজা সহস্রধারে উঠে গেছে। পরিবেশে হিন্দু পুরোহিতের সযত্নে লালিত নোংরামি নেই। ফুল, বেলপাতা, গঙ্গাজল চটকানো প্যাঁকপেঁকে কোনও ব্যাপার নেই। চার্চের চারপাশ যেন হিন্দুর তপোবন। রামকৃষ্ণ মিশন এবং অন্যান্য কয়েকটি মিশন এই মিশনারি আদর্শ মেনে চলেন বলেই পরিবেশের প্রভাবে অধার্মিকও ছুটে যান। খ্রিস্টধর্মই শেখাতে চায়, ক্লিনলিনেস ইজ নেকস্ট টু গডলিনেশ। কলকাতার মহাপ্রভুদের কে শেখাবে! হিন্দুমতে শহরের শ্রাদ্ধ তিলকাঞ্চন সমাপ্ত। গয়ার প্রেতশিলায় পিণ্ডোৎসর্গই যা বাকি।

খ্রিস্টান জনসংখ্যা কমে এসেছে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা চলে গেছেন হয় অস্ট্রেলিয়ায়, না হয় কানাডায়। বহুদিন বড় বড় চার্চের গাত্রমার্জনা হয়নি। আগে বছরে বছরে হত। সংলগ্ন উদ্যানে আগের মতো শীতের মরশুমি ফুলে হেসে ওঠে না। কবরখানার মর্মর ফলক হয় অপহৃত, নয় শ্যাওলাবৃত। প্রাচীনেরও আলাদা একধরনের সৌন্দর্য থাকে। এখানে প্রাচীন বড় হতশ্রী। হয় অর্থাভাবে, না হয় উদাসীনতায়।

বৃটিশ শাসনের মধ্যদিনে বড়দিন ছিল বড়িয়া দিন। জাঁকালো শীত, কমলালেবু, সুট-বুট, চারদিনের ছুটি, গোলাপি নেশা, ইডেনের গোরাবাদ্যি, চিড়িয়াখানার চিড়িয়া, সব মিলিয়ে পয়সাওলা বাবুদের ফূর্তির সময়। দিনের বড়-ছোট বোঝা না গেলেও দিলের দরাজ ভাব ধরা পড়ত। ধর্ম বিদেশের, আমোদ স্বদেশের। ধর্মে আমরা হিন্দু হলেও আমোদে পুরো খ্রিস্টান। বৃটিশ সূর্য অস্ত যেত না একটি কারণে, ইংরেজি ভাষা আর শিক্ষার প্রসারে। সিংহ যেখানে গর্জন করছে না, সেখানেও শেকসপিয়র, শেলি, বায়রন, টেনিসন বসে আছেন। বন্দুক যা পারে না, ভাষা তা সহজে পারে। ধুতি, পাঞ্জাবি, খুলিয়ে, প্যান্ট, টাই পরায়। মেঝে থেকে খাওয়ার টেবিলে তোলে। কাঁটা চামচে ধরতে শেখায়। মেয়েদের ঘোমটা খসায়। নরখাদককে কেকখাদক করে। হিন্দু সভ্যতা আমরা গ্রহণ করিনি। বেদান্ত বড় কঠিন বলে ইঁদুরকে দান করেছি। তপোবন তুড়ে দিয়েছি। তপোবনের ওপর দিয়ে রেললাইন গেছে। তৈরি হয়েছে পিকনিক স্পট। কলের চিমনি কালো ধোঁয়া-ফুঁসছে। ইংরেজি ভাষার গুণে আমরা ইংরেজি সভ্যতার সঙ্গে সহজে একাত্ম হতে পেরেছি। ইংরেজই আমাদের লেডিজ-ফার্স্ট শিখিয়েছে। শিখিয়েছে লাভ দাই নেবার। ইংরেজের কাজ থেকে জাতীয়তাবোধ শিখেছি। স্ত্রীকে পেটাবার আগে মন এসে হাত সরিয়ে দেয়। মেয়েদের লিবারেশানের কথা মনে পড়ে। নুইসেনস আর ভালগার শব্দ দুটি অসভ্যতার টুঁটি চেপে ধরে।

কোথায় গেল কলকাতার সেই সব বিভাগীয় বিপনী। বিশাল-বিশাল শো উইন্ডো। সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় প্রমাণ ম্যাপের ম্যানিকুইন। বড়দিনের মেজাজ আনে সাজানো দোকান, পরিষ্কার ফুটপাত, সজ্জিত দোকান, খ্রিস্টমাস ট্রি থেকে জরির তারা আর অভ্রচিকচিকে ঘণ্টা ঝুলছে। একপাশে হাসি হাসি মুখ সান্টাক্লস। এখন পড়ে আছে সবেধন নীলমনি নিউমার্কেট। সেখানেই দিশি সায়েবদের গুঁতোগুঁতি। চারপাশে জবজবে নরক। ইউরিন্যাল, শূকর, মাংসের দুর্গন্ধী দোকান। কোদলানো ফুটপাথ। সায়েবপাড়া পার্কস্ট্রিট আর তার আশেপাশে কোণঠাসা। সায়েবি দোকান এখন দিশি হাতে। সুইস আর ইতালিয়ান বেকাররা বিদায় নিয়েছেন। কেকের নামে যা বিক্রি হয় তা প্রায় ময়দার বাহারি তালের মতো।

দিশি সায়েবরা ধর্মটর্ম তেমন মানেন না। প্রথাতেও নেই, মনেও নেই। তাঁরা শুধু মদ্যপানের একটা উপলক্ষ খোঁজেন। বড়দিন আর নিউইয়ার্স সেইরকম দুটি দিন। আমরা কতটা সায়েব হয়েছি। তার প্রকাশ মদের গেলাসে। যিশু বলেছিলেন, ‘কোনও ভয় নেই, আমার বনফুল’। আমরা তাঁর মানবতার অনুসরণ না করে গেলাসে জীবাত্মার মুক্তি খুঁজি। তিনি বলেছিলেন, ‘এখন থেকে মাছের বদলে তোমাদের কাজ হবে মানুষ ধরা। তোমরা জালে মাছ ধরো মেরে খাওয়ার জন্যে। এখন থেকে তোমাদের জীবন মানুষকে অমৃতের ঠিকানা দেবে, তাদের অষ্টপাশ মোচন করে অমৃত অভয় পদের দিশারি করবে।’ হায় যিশু! কোথায় সেই মানব? সকলেই তো নিজের কোলে ঝোল টানায় ব্যস্ত। প্রতিটি মানুষ আজ লোভের শিকার। একদল লোভের জাল ফেলে মানুষ টানছে। অমৃতের বদলে গরল গেলাচ্ছে। একের পেছনে আরেককে লেলিয়ে দিচ্ছে। সাদা টাকাকে কালা টাকা বানিয়ে নেচে-কুঁদে একশো করছে। ওদিকে হাজার-হাজার অর্ধনগ্ন যিশু আস্তাবলে পড়ে আছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে দেশপ্রেমের কথা, আত্মত্যাগের কথা, দারিদ্র্য মোচনের কথা। পৃথিবী এখন উন্মাদের পৃথিবী।

সব ধর্মই মানুষকে মানুষের উপযোগী করতে চায়। হলে কি হবে, ধর্মে আর ক্ষমতায় আকাশ জমিন ফারাক। মানুষের বাইরেটা চাপকানের মতো, ভেতরটা কেমন আমরা নিজেরাই জানি না। মানুষের ভালো করতে চেয়ে এক যিশু কেন, শতশত যিশু ত্রুশবিদ্ধ হচ্ছেন। মানুষের হাতেই মৃত্যু। স্মৃতিতে মঠ বানিয়ে বারে-বারে প্রমাণ করা কুকুরের বাঁকা ন্যাজ সহজে সমান হওয়ার নয়। মানুষ স্নেহ চায়, মায়া চায়, মমতা চায়, উপকার চায়, সাহায্য চায়, সমাজ চায়, সুরক্ষা চায়, অথচ যার কাছ থেকে এসব পাওয়া যায় তাকে ধরে শূলে চাপায়। যে অন্যের জন্যে কাষ্ঠাহরণে যায় তাকে বাঘের মুখে ফেলে রেখে চলে আসা। ‘সকল দু:খের চেয়ে বড় দু:খ মানুষের এই যে, তার বড় তার ছোটোর দ্বারা নিত্য পীড়া পাচ্ছে। এই তার পাপ। সে আপনার মধ্যে আপনার সেই বড়োকে প্রকাশ করতে পাচ্ছে না, সেই বাধাই তার কলুষ।’ (রবীন্দ্রনাথ)

এই কলুষ দূর করার ক্ষমতা মানুষের নেই। মানুষের স্তর থেকে অতি মানবের স্তরে কেউ-কেউ হয়তো আরোহণ করবেন। রামপ্রসাদ যেমন বলেছেন, ‘লক্ষে একটি দুটি কাটলে ঘুড়ি হেসে দাও মা হাত চাপড়ি।’ রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে যে উদাহরণ দিয়েছেন—’বৃহৎ বনস্পতি যেমন ক্ষুদ্র বনজঙ্গলের পরিবেষ্টন হইতে ক্রমেই শূন্য আকাশে মস্তক তুলিয়া উঠে—-বিদ্যাসাগর সেইরূপ বয়োবৃদ্ধি সহকারে বঙ্গসমাজের সমস্ত অস্বাস্থ্যকর ক্ষুদ্রতাজাল হইতে ক্রমশই শব্দহীন সুদূর নির্জনে উত্থান করিয়াছিলেন, মহামানবের সঙ্গীহীন নির্জন বিচরণভূমি কোনদিনই জনাকীর্ণ হবে না। আমরা তাদের দেবতাদের আসনে বসাতে জানি, তাঁদের জীবন যাপনের আনন্দময় ক্লেশস্বীকারে রাজি নই। জন্মদিনে আলো, মৃত্যুদিনে মালা এই আমাদের ঋণ স্বীকার! যিশু, চৈতন্য, কৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর সকলেই এরা একলা পথিক। আমাকে অনুসরণ করো। কেউ কি অনুসরণ করেছে? প্রাণহীন প্রথায় সব ভেসে গেছে। বড় সুন্দর বলেছেন রবীন্দ্রনাথ :

‘আমাদের জীবনে তাঁর জন্মদিন দৈবাৎ আসে, কিন্তু ত্রুশে বিদ্ধ তাঁর মৃত্যু সে তো আসে দিনের পর দিন। বড়দিন মানে যিশুর জন্মদিন নয়। যেদিন সত্যের নামে ত্যাগ করেছি, যেদিন অকৃত্রিম প্রেমে মানুষকে ভাই বলতে পেরেছি, সেইদিনই পিতার পুত্র আমাদের জীবনে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেইদিনই বড়োদিন—।’

‘জানি আজ বিশেষ দিনে দেশে-দেশে গির্জায় গির্জায় তাঁর স্তবধ্বনি উঠেছে, যিনি পরমপিতার বার্তা এনেছেন মানব-সন্তানের কাছে—আর সেই গির্জার বাইরে রক্তাক্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী ভ্রাতৃহত্যায়।’

এই হল আর এক সত্য। দেব আর দানবের সহাবস্থান। আমাকে অনুসরণ করো—আহ্বান আমরা শুনেছি। বৃথা In vain have I smitten your children they received no corection : your own sword hath devoured your praphets, like a destroying lion.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *