সপ্তর্ষি আর হারানো বিকেল – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
বহরমপুর পেরিয়ে কান্দীর পথে পড়তেই রাস্তার দুধারে বাড়িঘর আর গাছপালার চেহারা বদলে যেতে লাগল৷ মাটির রংও এখানে সামান্য লাল৷ সপ্তর্ষির বাবা বুঝিয়ে দিলেন—মাটির সঙ্গে লোহা মেশানো রয়েছে বলে ওইরকম রং৷ এখান থেকেই নাকি রাঢ়বঙ্গের শুরু৷ রাঢ়বঙ্গ বলতে ঠিক কি বোঝায় সপ্তর্ষি জানে না, তবে সময়মতো বাবাই নিশ্চয় বলে দেবেন৷ বাবা বেশ ভালো লোক, বাবার সঙ্গে বেড়াতে মজা লাগে৷
দুপাশে ধূ ধূ মাঠ, মাঝখান দিয়ে কালো পিচের রাস্তা চলেছে সোজা৷ মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে অজস্র তালগাছ৷ কোথাও আবার খোলা প্রান্তরের ভেতর তালগাছগুলো জড়াজড়ি করে একজায়গায় ভিড় করে রয়েছে৷ এখানকার তালগাছ দেখতে একটু যেন অন্যরকমের, গুঁড়িটা বেশ মোটা, আর মাটির একেবারে কাছ থেকেই প্রথমে কিছুটা বেঁকে তারপর সোজা উঠেছে৷ মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে দু-একটা বিরাট শিমুল গাছ, পাতা নেই, ডালগুলো লাল ফুলে ভর্তি৷
বাবা হঠাৎ বললেন—বিকাশ, গাড়িটা এখানে একটু থামাও তো৷ এই বাঁদিকে— পথের বাঁদিকে কয়েকটা বড় গাছের ছায়ায় কিছু লোক বিশাল দুটো উনুন জ্বালিয়ে কি যেন করছে৷ সেখানে গাড়ি থামতেই তারা অবাক হয়ে তাকাল৷ সপ্তর্ষিও অবাক৷ এতবড় উনুন আগে সে কখনো দেখেনি৷ উনুনের ওপর লোহার চাদর জুড়ে তৈরি বড় কড়াই চাপানো, সে কড়াইতে কি যেন জ্বাল দেওয়া হচ্ছে৷ অত উঁচুতে নাগাল পাবার অসুবিধা বলে জ্বালা দেবার দেবার কাজে ব্যস্ত লোক-দুজন দুটো প্যাকিং বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে কাঠের হাতা নাড়ছে৷ চারদিকের বাতাসে একটা খুব চেনা চেনা মিষ্টি গন্ধ৷
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন—ওরা কি করছে বলতে পারিস?
সপ্তর্ষি মাথা নাড়ল৷
বাবা বললেন—আমারই অন্যায়৷ কলকাতায় চাকরি নিয়ে তোকে একেবারে শহুরে ছেলে বানিয়ে ফেললাম৷ কিন্তু এই হচ্ছে আসল দেশ, বুঝলি? শহরে আর কটা মানুষ থাকে? ওরা গুড় জ্বাল দিচ্ছে, বুঝেছিস? আখের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছে৷ আয়, তোকে আখের রস খাওয়াই—
গুড়ওয়ালারা ভারি ভালো৷ নতুন মাটির ভাঁড়ে করে তিনজনকে পেটভরে রস খাওয়াল তারা৷ সপ্তর্ষির বাবা পয়সা দিতে গেলে কাঁচাপাকা চুলওয়ালা লোকটা মাথা চুলকে বলল—আজ্ঞে আপনারা অতিথি, দু-ভাঁড় রস খেয়েছেন, ওর দাম দিতে হবে না—
—না না, সে কি কথা! সে হয় না—
সে কিছুতেই পয়সা নিতে রাজি হল না, বলল—আমাদের এমনি কত রস তো মাটিতে পড়েও নষ্ট হয়৷ আজ খোকাবাবু খেয়েছে, তার দাম নেব? খোকাবাবুর নাম কি?
সপ্তর্ষির নামটা তারা ঠিক বুঝতে পারল না৷ তাদের ছেলেপুলেদের নাম গণেশ, রামু, কার্তিক এইসব হয়৷ তবু তারা হেসে বলল—বেশ নাম, ভালো নাম৷
সপ্তর্ষির বাবা তাদের নমস্কার করে গাড়িতে এসে উঠলেন৷
কান্দী শহরে না ঢুকে তারা বাসস্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে বাইপাস ধরে পাঁচথুপীর রাস্তায় এসে পড়ল৷ এবার রাস্তা আরো সরু আর খারাপ৷ কিন্তু পথে যে জায়গাগুলো পড়ছিল তার নাম খুব সুন্দর৷ পুরন্দরপুর, গোকর্ণ৷ আর দশ-বারো কিলোমিটার গেলেই পাঁচথুপী৷
পথে বেরুলে কত মজার ঘটনা দেখা যায়৷ যেমন গোকর্ণ ছাড়িয়ে কিছুদূর এসে হঠাৎ গাড়ি থামাতে হল৷ রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট ছাগলছানা তার মায়ের দুধ খাচ্ছে৷ সরু রাস্তা, পাশেই নাবাল-জমি, ধানক্ষেত৷ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না৷ দু-তিনবার হর্ন দেওয়া হল, কিন্তু তারা নির্বিকার৷ বিকাশ নেমে তাড়া দেবার উদ্যোগ করছিল, সপ্তর্ষির বাবা বারণ করলেন—থাক, ওদের বিরক্ত কোরো না৷ বেশ লাগছে দেখতে৷ পেটভরে খেয়ে নিক বাচ্চাটা৷
কিন্তু একটু বাদেই উল্টোদিক থেকে আসা বড় একটা লরির এয়ার হর্নের বিকট আওয়াজে ভয় পেয়ে তারা দুজন ধানক্ষেতে নেমে গেল৷
পাঁচথুপী ঠিক শহর নয়, আবার গ্রামও নয়৷ বসতির ভেতরে পথ ভাঙাচোরা, পথে ধুলো৷ বহুদিন আগে এখানে নাকি পাঁচটি বৌদ্ধস্তূপ ছিল৷ সেই কারণে নাম হয়েছে পাঁচথুপী৷ বোধহয় পঞ্চস্তূপী থেকে৷ এখন অবশ্য আর স্তূপ নেই, তবে পোড়ামাটির সুন্দর মন্দির আছে একটা৷
সেই পোড়ামাটির নবরত্ন মন্দিরের সামনেই রাস্তার ওপর কয়েকজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ গাড়ি দেখে তাঁরা এগিয়ে এলেন, সপ্তর্ষির বাবাও বললেন গাড়ি থামাতে৷
মাঝারি গড়নের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একজন প্রৌঢ় মানুষ গাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে বললেন—হ্যাঁ, এই তো রেবতীবাবু৷ যাক, আপনি এসে গিয়েছেন, আর চিন্তা নেই—
সপ্তর্ষির বাবা হেসে বললেন—কেন, আমি আসব না, এমন ভয় করেছিলেন নাকি?
—না দাদা, ঠিক তা নয়৷ আসলে আমরা পাড়াগাঁয়ের লোক তো, শহরের বড় বড় পণ্ডিতেরা আমাদের অনুষ্ঠানকে কতখানি গুরুত্ব দেবেন সেটা আমরা ঠিক করে উঠতে পারি না৷ তবে আপনার ব্যাপার আলাদা, আমি সবাইকে বলেছি—দেখো তোমরা, রেবতীবাবু ঠিক সময়মতো এসে যাবেন৷ চলুন দাদা, বিশ্রাম করে খেয়ে নেবেন৷ বিকেল চারটে থেকে সেমিনার৷ এটি ছেলে বুঝি? কি নাম খোকা? বাঃ বাঃ, বেশ—
একটা বিশাল বাড়িতে তাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে৷ গল্পের বইতে এমন বাড়ির কথা পড়লেও, বাস্তবে কখনো দেখেনি সপ্তর্ষি৷ সিংদরজা দিয়ে ঢুকেই প্রথমে একটা বড় বাঁধানো চত্বর, ফুটবল খেলা যায় এত বড়৷ চত্বর পেরিয়ে রাধামাধবের মন্দির৷ তার সামনে নাটমন্দির, ভোগের ঘর৷ এসব পার হয়ে বাইরের মহল৷ মাঝখানে উঠোন ঘিরে তিনদিকে দোতলা বাড়ির ঘরগুলো দাঁড়িয়ে৷ কার্নিশে অশ্বত্থের চারা গজিয়েছে, পলস্তারা খসে পড়েছে৷ একতলার টানা বারান্দার ওপরদিকে লোহার আঁকড়ি দিয়ে দুটো পুরনো পালকি ঝোলানো৷ এ দুটো মহল পার হয়ে তবে শুরু হয়েছে ভেতরের মহল৷ কতবার যে ডানদিকে বাঁদিকে ফিরলো সপ্তর্ষি, কত অলিগলি পার হয়ে চলল, কত সরু সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠল-নামলো তা মনে করে রাখা কঠিন৷ বাড়ির বর্তমান মালিক সুধীন্দ্রনারায়ণ পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছিলেন৷ এবার দোতলার একটা ঘরের সামনে থেমে তিনি বললেন—এইটেয় আপনারা থাকবেন৷ আপনার গাড়ির চালকের জন্য নীচে আলাদা ব্যবস্থা করে দিয়েছি৷ লাগোয়া বাথরুমে জল দেওয়া আছে, হাতমুখ ধুয়ে নিন৷ দুপুরের খাবার এখানেই দেবে৷ কোনো অসুবিধে হলে বলবেন৷
মেঝেতে সেকেলে পশমের আসন পেতে খাবার জায়গা হল৷ পরিবেশন করতে লাগলেন সুধীনবাবুর স্ত্রী আর মেয়ে৷ মেয়েটি ভারি মিষ্টি দেখতে, নাম শ্রেয়া৷ বয়েসে সে সপ্তর্ষির চেয়ে কিছু বড় হবে৷ সুধীনবাবু পাশে দাঁড়িয়ে তদারক করছিলেন৷ খেতে খেতে সপ্তর্ষির বাবা বললেন—কি বিরাট বাড়ি আপনাদের! অনেক পুরনো, না?
সুধীনবাবু হেসে বললেন—হ্যাঁ, প্রায় তিনশো বছর৷
—বলেন কি!
—তাই৷ তবে গত আশি-নব্বই বছরের মধ্যে আর মেরামত হয়নি৷ মেরামত করবার সঙ্গতিও নেই৷ সব আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে৷
—কখানা ঘর আছে এ বাড়িতে?
—একশো চল্লিশটা?
রেবতীবাবু খাওয়া থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন—কটা?
—একশো চল্লিশটা৷ তবে এখন মাত্র চুরানব্বইটা ব্যবহার করা হয়৷
—চুরানব্বইটা ঘর ব্যবহার করেন! লোক কজন আপনারা?
সুধীনবাবু বললেন—চারজন৷ হাসছেন? আসলে ঘরগুলো খুলে, ঝাঁট দিয়ে পরিচ্ছন্নও তো রাখতে হবে৷ ঘরের সব আলাদা আলাদা নাম আছে, জানেন?
—কি রকম?
যেমন, এই যে ঘরটায় আপনি রয়েছেন, এটার নাম নীল ঘর৷ পাশেরটা সবুজ ঘর৷ তারপর আছে হলুদ ঘর, ফলের ঘর, খাটের ঘর, ফুলের ঘর—সেকালের কর্তাদের নামে নামে ঘর৷ আজ আর হবে না, কাল সকালে আপনাদের রাধামাধবের বিগ্রহ দেখাব৷
—এখনো পুজো হয়?
—রোজ৷ ওই একটা পুরনো রেওয়াজ এখনো বন্ধ হয়নি৷ তিনথালা অন্নভোগ নিবেদন করা হয়৷ পূজারী আছেন, বংশানুক্রমিকভাবে তাঁরাই পুজো করে আসছেন৷
খাওয়াদাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরে সুধীনবাবু সপ্তর্ষির বাবাকে সভার জায়গায় ডেকে নিয়ে চলে গেলেন৷
সপ্তর্ষির ব্যাগে দু-তিনখানা বই ছিল৷ কোথাও বেড়াতে গেলে সে সঙ্গে পছন্দমতো কিছু বই নেয়৷ একখানা বই নিয়ে সে বিছানায় আধশোয়া হয়ে পড়বার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু বইয়ে কিছুতেই মন বসল না৷ পড়ন্ত বেলার রোদ্দুর খড়খড়িওয়ালা জানালা দিয়ে তার বিছানায় আর মেঝেতে এসে পড়েছে৷ রোদ্দুরের রংটা কেমন যেন মন খারাপ করে দেয়, কবেকার সব ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়ে৷ অনেক—অনেক আগেকার দিনের কথা৷ কিন্তু অতদিন আগের কথা কি করে মনে আসবে তার? তার তো মাত্র চোদ্দ বছর বয়েস৷ তবু এই বাড়িটায় ঢোকামাত্র তার যেন কেমন অদ্ভুত মনের ভাব হচ্ছে, সামান্য জ্বর এলে যেমন একটা আরামদায়ক আলস্য ঘিরে ধরে৷
নীল ঘর, খাটের ঘর, ফুলের ঘর! সুন্দর নামগুলো৷
নির্জন, পুরনো বাড়িতে ঝিমঝিম করে ফাল্গুনের অপরাহ্ণ৷ জানালার বাইরেই বাতাসে দুলছে বকুলগাছের ডাল৷ তার ছায়া পড়েছে মেঝেতে৷ এখনো আবহাওয়া ভালো, এরপর গরম বাড়তে শুরু করবে৷ সারাদিন হাঁসফাঁস গরমের পর বিকেলে ঝিলমিল দেওয়া বারান্দায় বসে আরাম করে বাদামের সরবৎ খাওয়া—আঃ!
হঠাৎ বিছানায় সোজা হয়ে বসল সপ্তর্ষি৷ আশ্চর্য তো! বাদামের সরবৎ কথাটা মাথায় এল কেন তার? বাদামের সরবৎ বলে সত্যি কিছু হয় নাকি? সে অন্তত কখনো খায়নি৷ তাহলে এমন একটা পানীয়ের নাম তার মনে এল কি করে? কোনো গল্পের বইতে পড়েছে কি? কে জানে!
দরজা দিয়ে ভেতরে মুখ বাড়িয়ে শ্রেয়া জিজ্ঞেস করল—কি করছ? বই পড়ছ?
—হ্যাঁ৷ ভেতরে এসো, ওইখানে দাঁড়িয়ে কেন?
ঘরে ঢুকে খাটের এককোণে বসল শ্রেয়া৷ বলল—কেমন লাগছে আমাদের বাড়ি?
—খুব ভালো লাগছে৷ এতবড় বাড়ি আমি আগে কখনো দেখিই নি৷ শহরে আমাদের বাড়িতে মাত্র তিনটে ঘর, তাও ছোট ছোট৷ এমন মাঠও নেই৷ তোমরা কত মজায় থাকো!
—ঠিক বলেছ, কলকাতায় যেতে আমার একটুও ভালো লাগে না৷
সপ্তর্ষি জিজ্ঞেস করল—তুমি কলকাতায় গিয়েছ?
—বছরে দুবার যাই৷ ভবানীপুরে আমার মামাবাড়ি৷
শ্রেয়া বেশ পড়াশুনো করে, এ ব্যাপারটা সপ্তর্ষির বেশ ভালো লাগল৷ তার হাতের বইটা দেখিয়ে শ্রেয়া জিজ্ঞেস করল—কি বই ওটা?
—অবনীন্দ্রনাথের রচনাসংগ্রহ, ‘নালক’ বলে লেখাটা পড়ছি৷ তুমি বই পড়তে ভালোবাস?
—হুঁ-উ৷ বাবা অর্ডার দিয়ে ডাকে বই আনিয়ে দেন৷ আমি অবনীন্দ্রনাথের ‘বুড়ো আংলা’ পড়েছি৷ তুমি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়েছ?
উৎসাহে সোজা হয়ে বসে সপ্তর্ষি বলল—পড়েছি৷ উঃ, দারুণ বই! জানো, বড় হয়ে আমিও ওইরকম আফ্রিকায় অ্যাডভেঞ্চার করতে যাব৷ বাওবাব গাছের তলায় তাঁবু খাটিয়ে থাকব আর পায়ে হেঁটে কালাহারি মরুভূমি পার হব৷ হীরের খনিও আবিষ্কার করব—
শ্রেয়া বলল—আমিও যাব৷ বড় হয়ে৷
সপ্তর্ষি একটু সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকাল৷ মেয়েরা কি এরকম অ্যাডভেঞ্চারে বের হয়? সচরাচর তো শোনা যায় না৷ তারপরেই তার মনে হল—হতেও পারে৷ মেয়েরা তো আজকাল অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্টে উঠছে৷ আফ্রিকায় যেতে বাধা কি?
শ্রেয়া বলল—চল, তোমাকে প্যাঁচা দেখিয়ে আনি৷ যাবে?
—প্যাঁচা? কোথায়?
—ভেতরমহলের দালানের কার্নিশে৷ এসো দেখাচ্ছি—
—আমাদের দেখলে উড়ে পালাবে না?
—নাঃ৷ ওরা দিনের বেলা দেখতে পায় না তো, সেজন্য চুপচাপ বসে থাকে৷ এসো—
আবার অনেক অলিগলি পেরিয়ে, অনেক সরু সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করে ওরা দোতলার তিনদিক ঘেরা একটা ছাদমতো জায়গায় এসে পৌঁছল৷ তিনদিকের দেয়াল ওপরে উঠে চওড়া কার্নিশে শেষ হয়েছে৷ তারই এক জায়গায় আঙুল তুলে নির্দেশ করে শ্রেয়া বলল—ওই দেখ!
দেখে সপ্তর্ষি অবাক৷ কার্নিশের ওপর একটু অন্ধকারমতো কোণ বেছে নিয়ে পাশাপাশি চার-পাঁচটি প্যাঁচা গম্ভীরমুখে বসে আছে৷ এত কাছ থেকে এর আগে আর কখনো প্যাঁচা দেখেনি সপ্তর্ষি৷ লোকে খারাপ চেহারার সঙ্গে তুলনা করতে ‘প্যাঁচার মতো’ বলে কেন তা সে বুঝতে পারল না৷ এরা তো বেশ সুন্দর দেখতে৷ সপ্তর্ষি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, তারাও অকুতোভয়ে সপ্তর্ষির দিকে তাকিয়ে আছে৷
শ্রেয়া বলল—এরা কিন্তু সব লক্ষ্মীপ্যাঁচা, জানো? বাড়িতে থাকলে মঙ্গল হয়—
এইসময়ে শ্রেয়ারই বয়েসী আর একটি মেয়ে ভেতরবাড়ির দরজা দিয়ে ছাদে এল, শ্রেয়াকে দেখে বলল—এই যে! তুই এখানে, এদিকে আমি সারাবাড়ি খুঁজছি! লাইব্রেরিতে যাবি না?
শ্রেয়া সপ্তর্ষির দিকে ফিরে বলল—ও আমার বন্ধু কুন্তলা৷ আমরা দুজন একটু লাইব্রেরিতে যাব মায়ের জন্য বই বদলে আনতে৷ কিছুক্ষণ একা থাকো, কেমন? অসুবিধে হবে না তো?
—না না, তুমি যাও৷ আমি বরং তোমাদের বাড়িটা একটু ঘুরে দেখি৷
—দেখো, হারিয়ে যেয়ো না—
শ্রেয়া আর তার বন্ধুর পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরে কোথায় একটা পায়রা ডেকে উঠল—বাক বাক বাকুম৷ বিকেলের রোদ্দুর মিলিয়ে আসছে একটু একটু করে৷ ছাদের ওধার দিয়ে যে সিঁড়িটা ঘুরে ঘুরে নীচে নেমে গেল, সেটা দিয়ে নামলে কোথায় পৌঁছানো যায়? দেখা যাক৷
কয়েক ধাপ নেমে প্রথম বাঁকের পরেই আবছা আলো-আঁধারি৷ হাতড়ে হাতড়ে সাবধানে নামতে গিয়ে সপ্তর্ষির মনে হল—নাঃ, এ সিঁড়িটা বরাবরই বিপজ্জনক রইল৷ সেবার তো সে পা-ফসকে পড়েই যাচ্ছিল, নেহাত বৃন্দাবন ধরে না ফেললে একেবারে মুখ থুবড়ে—
অন্ধকারেই সিঁড়ির মাঝামাঝি দেয়াল ধরে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সপ্তর্ষি৷
কবে সে এ বাড়িতে পা-ফসকে পড়ে যাচ্ছিল? বৃন্দাবনই বা কে?
ভয়ের একটা অনুভূতি গুলি পাকিয়ে বুক বেয়ে গলার কাছে উঠে আসছে৷ চুপ করে একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর বুক-ঢিপ-ঢিপটা কমলে অবশ্য তার মনে হল—এতে ভয় পাওয়ার কি আছে? ইস্কুলে মাস্টারমশাইরা বলেন—‘সপ্তর্ষি, তুমি বড় কল্পনাপ্রবণ!’—এত পুরনো বাড়ি দেখে মনে মনে সে নানারকম কল্পনা করতে শুরু করেছে, এছাড়া অন্য কারণ কিছু নেই৷
আবার সে নামতে আরম্ভ করল৷ একতলার লম্বা একটা বারান্দায় সিঁড়ি শেষ হল৷ মেঝেতে পুরু ধুলো আর চামচিকের নাদি পড়ে আছে৷ এই মহলে লোকজন কেউ বাস করে না৷ সারি সারি তালাবন্ধ ঘর, কবজায় মরচে ধরে রয়েছে৷ কারা বাস করত এইসব ঘরে?
একটু এগিয়ে সরু একটা গলি৷ কিছু না ভেবেই সপ্তর্ষি ডানদিকে বাঁক নিল৷ কেন তা সে জানে না৷ গলির পরে নাটমন্দির৷ ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে বিশাল কাঠের দরজায় শেষ হয়েছে৷ দরজায় সিঁদুর আর চন্দনের দাগ৷ ওঃ, এটাই তাহলে রাধামাধবের মন্দির! হ্যাঁ, এ জায়গাটা রোজ পরিষ্কার করা হয়৷ ধুলোময়লা নেই৷ নাটমন্দিরের ছাদ এক জায়গায় ভেঙে পড়েছে, সেখান দিয়ে আসা পড়ন্ত ম্লান আলোয় রহস্যময় দেখাচ্ছে চারদিক৷
—ছোটকর্তা যে!
চমকে ফিরে তাকাল সপ্তর্ষি৷
একজন খুব বুড়ো মানুষ এসে দাঁড়িয়েছেন নাটমন্দিরের ওপাশের বারান্দায়৷ খাটো ধুতি পরা, খালি গা, টকটকে রং৷ বুক পর্যন্ত সাদা দাড়ি আর লম্বা সাদা চুলে মানুষটাকে মানিয়েছে খুব ভালো৷
মানুষটি আবার বললেন—খবর কি ছোটকর্তা? দেখতে এলেন বুঝি সব কেমন আছে?
সপ্তর্ষির ভয় কেটে গিয়েছে, সে বলল—আপনি কে?
—আমি রামগতি৷ রামগতি ভট্টাচার্য৷ অনেকদিন তো হল, আপনি সব ভুলে গিয়েছেন—হেঃ, হেঃ হেঃ! আসুন, আসুন—
বুড়োমানুষেরা এমন সব কথা বলে যার কোনো মানে হয় না৷ কি ভুলে গিয়েছে সে? তাকে ছোটকর্তা বলেই বা কেন ডাকছেন এ ভদ্রলোক? তবে লোকটি বেশ ভালো, কেমন আপন মানুষের মতো৷
সে পায়ে পায়ে নাটমন্দির পার হয়ে রামগতির সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ রামগতি সস্নেহ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন—হুঁ, নব কলেবর! তা ভালো, ভালো—
রামগতির পায়ে সেকেলে বউলওয়ালা খড়ম, গলায় সাদা ধপধপে মোটা পৈতে৷ সপ্তর্ষি বুঝল ইনিই সেই পুরোহিতমশায়, যাঁর কথা শ্রেয়ার বাবা বলেছিলেন৷ সে জিজ্ঞাসা করল—আপনি বুঝি এইখানেই থাকেন?
একগাল হেসে রামগতি বললেন—আর কোথায় যাব ছোটকর্তা? সবাই চলে গেল, আমিই কেবল একা পড়ে রইলাম৷ আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না৷ বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছে কিনা বাড়িটার ওপরে৷
বিকেলের ছায়া আরো ঘন হয়ে এসেছে৷ খিলানের ওপর কয়েকটা পায়রা উড়ে এসে বসল৷
সপ্তর্ষি বলল—সন্ধ্যেবেলা রাধামাধবের পুজো হবে না?
—হবে৷ আরতি হবে, তারপর শীতলভোগ দিয়ে ঠাকুরের শয়ন দেওয়া হবে৷
—আপনি কোন ঘরে থাকেন?
রামগতি বললেন—ভোগের ঘরের পাশে আমার সেই পুরনো ঘরখানাতেই৷ আসুন না কেন—
খড়মের খটাখট শব্দ তুলে রামগতি এগিয়ে চললেন৷ মন্দির বাঁয়ে রেখে সরু গলিটা কিছুদূর এগিয়ে যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেইখানে একটা ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়ালেন৷ হাত দিয়ে ঠেলতেই দরজা খুলে গেল৷ ভেতরে অল্প আলোতে চোখে পড়ে দেয়ালের ধারে খাট, মেঝেতে কুশাসন পাতা, তার সামনে গঙ্গাজলের পাত্র, কোশাকুশি৷ সন্ধ্যেবেলা আহ্নিক করবেন রামগতি, তার জোগাড় করা রয়েছে৷ ঘরে ঢুকে একটা জলচৌকি সপ্তর্ষিকে এগিয়ে দিলেন তিনি, নিজে বসলেন কুশাসনে৷
ঘরের মধ্যেটায় যেন একশো কি দুশো বছর আগেকার বাতাস থমকে আছে৷ আবহাওয়ায় প্রায় মিলিয়ে আসা মৃদু ধূপের গন্ধ৷ দুশো বছরের ওপার থেকে কাদের যেন খুব চেনা গলার আওয়াজ আবছা কানে আসে৷ কারা যেন খুব ভালোবাসত, খুব আপন ছিল—এই বাড়িটায় থাকত তারা৷
বাইরের দালানে পায়রার ডানার ঝটাপট শব্দে বৈকালী নির্জনতা আরো গাঢ় হয়ে আসে৷ সপ্তর্ষি জিজ্ঞেস করল—বাড়ির এদিকটাতে তো কেউ থাকে না, আপনার ভয় করে না একা থাকতে?
রামগতি হেসে বললেন—নাঃ, ভয় করবে কেন? এ আমার চেনা জায়গা, ছোটবেলা থেকে এখানে বড় হয়েছি৷ তাছাড়া রাধামাধব যেখানে রয়েছেন সেখানে আর ভয় কি?
—আপনি কি করেন সারাদিন?
—পাহারা দিই৷ সারাদিন, সারারাত্তির৷
অবাক হয়ে সপ্তর্ষি বলল—সে কি! কি পাহারা দেন আপনি?
রামগতি গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলেন—সবকিছু৷ এই বাড়িঘর, মন্দির, ভাঙা পালকি, খসে পড়া কড়িবরগা, ফেলে আসা দিনগুলো—সেগুলোকেই বেশি করে পাহারা দিতে হয়, নইলে পালিয়ে যাবে কিনা!
পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এ কথাগুলো সপ্তর্ষির খুব ভালো লাগল৷
রামগতি আবার বললেন—আর সেই জিনিসটা তো রয়েইছে, সেটাও পাহারা দিতে হয়৷
এই কথাটা রামগতি বললেন প্রায় ফিসফিস করে, তাঁর গলার স্বরে রহস্যের ছোঁয়া৷
কিসের কথা বলছেন রামগতি? সপ্তর্ষি জিজ্ঞেস করল—কোন জিনিসটা?
—হেঃ হেঃ হেঃ, ছোটকর্তা সব ভুলে গিয়েছেন! আপনিই তো লুকিয়ে রাখবার জন্য আমাকে দিয়েছিলেন৷ মেজকর্তার তখন মতিগতি ভালো নয়, তাঁর হাতে পড়লে কি হয় ঠিক নেই—তাই আমাকে দিলেন৷
সপ্তর্ষি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে রামগতি বললেন—মনে পড়ছে না? আচ্ছা আসুন—
খড়মের শব্দ তুলে আবার অন্ধকার গলিপথ পার হতে লাগলেন রামগতি৷ নাটমন্দিরের পেছনে ভোগের ঘরের ঠিক পাশ দিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গিয়েছে যেন মাটির তলায়৷ বৃদ্ধ পুরোহিত সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে চললেন৷ একটু ইতস্তত করে সপ্তর্ষিও তাঁকে অনুসরণ করল৷ এখানে বোধহয় বাতাস চলাচল করে না, কেমন ভ্যাপসা গন্ধ পরিবেশে৷ সিঁড়ি নেমে শেষ হয়েছে একটা ছোট্ট চৌকো ঘরে৷ কিছু নেই সেই ঘরে, কেবল কোণের দিকে ইঁট দিয়ে গাঁথা বেশ বড় একটা চৌবাচ্চা৷ রামগতি চৌবাচ্চার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন—এই যে, এটার নীচেই আমি আর আপনি রাত্তিরবেলা লুকিয়ে ফেলেছিলাম মূর্তিটা৷ জগদ্ধাত্রী মূর্তি৷ ওপরে আবার ইঁট পেতে মশলা দিয়ে গেঁথে দিয়েছিলাম৷ ঠিক এই কোণটাতে—
কাঁপা গলায় সপ্তর্ষি জিজ্ঞেস করল—কিসের চৌবাচ্চা এটা?
—গঙ্গাজলের৷ নিত্যপূজার গঙ্গাজল বহরমপুর থেকে পেতলের বড় বড় পনেরো-কুড়িটা জালায় ভর্তি করে গরুর গাড়িতে বোঝাই দিয়ে নিয়ে আসা হত৷ বছরে একবার, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন, চৌবাচ্চার পুরনো জল বের করে, পরিষ্কার করে আবার নতুন জল ভর্তি করা হত৷ ওই অক্ষয় তৃতীয়ার রাতেই তো আমরা মূর্তিটা লুকোলাম—
সপ্তর্ষি বলল—গরুর গাড়িতে কেন, বাসে আনলে তো তাড়াতাড়ি হয়—
এবার রামগতি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন—বাস কি?
ব্যাপারটা সপ্তর্ষির কেমন যেন লাগল৷ যতই সেকেলে মানুষ হোন না কেন, বাস দেখেন নি তাও কি হতে পারে? পাঁচথুপী থেকেই তো রোজ কত বাস ছাড়ে৷
রামগতি বললেন—চলুন ছোটকর্তা, ওপরে যাই৷ জায়গাটা আপনাকে দেখিয়ে ভালোই করলাম, আপনি তো সব ভুলেই গিয়েছিলেন!
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে অন্ধকার গলির বাঁকে দাঁড়িয়ে রামগতি বললেন—আসি তাহলে?
সপ্তর্ষি বলল—আবার যদি কখনো আসি আপনার সঙ্গে দেখা করব৷
বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়িয়ে রামগতি বললেন—সে কথা বলা যায় না, সে বলা মুশকিল৷ আচ্ছা—
তাঁর খড়মের আওয়াজ মিলিয়ে গেল বাঁকের ওধারে৷
একা একা ফিরে চলল সপ্তর্ষি৷ তার চারদিকে নামছে মন খারাপ করে দেওয়া সন্ধ্যা৷
সে রাত্তিরে যতবার তার ঘুম ভাঙল সে শুনতে পেল লক্ষ্মীপ্যাঁচার ডাক৷
সকালে উঠে হাতমুখ ধুয়ে গরম গরম আটার লুচি আর আলুচ্চচড়ি দিয়ে দারুণ ব্রেকফাস্ট হল৷ সুধীনবাবু বললেন—তাড়াতাড়ি ঝোলভাত করে দিচ্ছি, আপনারা খেয়েদেয়ে রওনা হন—
সপ্তর্ষির বাবা বললেন—না ভাই, তার উপায় নেই৷ বিকেল পাঁচটার মধ্যে আমার বাড়ি পৌঁছতে হবে৷ সাড়ে দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ব এখান থেকে—
—বেশ, তাহলে চা খেয়ে নিন, তারপর আপনাদের রাধামাধবের বিগ্রহ দেখিয়ে আনি৷
আবার সেই নাটমন্দির, ভোগের ঘর, চকমিলানো দালান৷ রেবতীবাবু ভাবপ্রবণ কবিপ্রকৃতির মানুষ, প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ পরিবারের ভদ্রাসন দেখে তিনি ভারি খুশি৷ বললেন—সত্যি, এসব দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়৷ শিক্ষিত আর ধনী দেশ হলে জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে এ বাড়ি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করত৷ কই, মন্দির তো বন্ধ দেখছি৷
সুধীনবাবু বললেন—তাই তো! পুরোহিত আজ দেরি করছে কেন?
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই একজন ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসের ধুতি-পরা চাদর- গায়ে লোক নাটমন্দিরে প্রাঙ্গণে ঢুকে বলল—এই যে সুধীনদা, একটু দেরি হয়ে গেল আজ!
সুধীনবাবু তাকে বললেন—নাও, তাড়াতাড়ি মন্দির খোলো, এঁরা বিগ্রহ দেখবেন৷
তারপর সপ্তর্ষির বাবার দিকে ফিরে বললেন—এই হচ্ছে দুর্গাগতি, বর্তমান পূজারী৷
দুর্গাগতি মন্দিরের তালা খুলছে, সপ্তর্ষি আশ্চর্য হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল৷ এই লোকটা বর্তমান পূজারী! তাহলে গতকাল বিকেলে যাঁর সঙ্গে পরিচয় হল সেই রামগতি কে? রামগতি আর দুর্গাগতি—নাম দুটোও তো বাপ-ব্যাটা কিম্বা দুই ভাইয়ের বলে মনে হচ্ছে!
কথা বলতে বলতে রেবতীবাবু আর সুধীন্দ্রনারায়ণ একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন৷ সপ্তর্ষি দুর্গাগতিকে জিজ্ঞাসা করল—আপনার বাবা রামগতি ভট্টাচার্য এখন কি আর পুজো করেন না?
বিশাল তালায় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে দুর্গাগতি চমকে তার দিকে তাকিয়ে বলল— রামগতি আমার বাবা না তো, আমার ঠাকুর্দার বাবা৷ তিনি আর কি করে পুজো করবেন? তিনি তো মারাই গিয়েছেন আজ একশো বছরের ওপর৷ তুমি তাঁর নাম কি করে জানলে? ওঃ বুঝেছি—সুধীনদা গল্প করেছেন৷
সপ্তর্ষি আস্তে করে সেখান থেকে সরে এল৷
বলে কি লোকটা? একশো বছরের ওপরে মারা গিয়েছে মানে? কাল তাহলে সে কার সঙ্গে গল্প করল?
বাবা এখনো কথা বলছেন সুধীনবাবুর সঙ্গে৷ সপ্তর্ষি চট করে নাটমন্দিরের ওপাশ দিয়ে সরু গলিটায় গিয়ে পড়ল৷ এই সকালবেলাতেও গলিটা আবছা অন্ধকার৷ একটু এগিয়ে রামগতির ঘর৷ সে ঘরের দরজায় মরচে ধরা একখানা পুরনো তালা ঝুলছে৷ তালার গায়ে মাকড়সার জাল, ঝুল৷ দরজার সামনে বারান্দায় ধুলো-ময়লা পড়ে আছে কতদিনের৷ এ দরজা অন্তত বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যে কেউ খোলেনি!
কিন্তু এই ঘরটার মধ্যে বসে গতকাল বিকেলে সে রামগতির সঙ্গে কথা বলেছে!
সপ্তর্ষির আর একটুও ভয় করছে না৷ বরং খুব মহৎ কিছু, সুন্দর কিছুর মুখোমুখি হলে মনে যে শান্ত আনন্দের ভাব জাগে, তাই জাগছে৷
মন্দিরের সামনে ফিরে আসতে আসতে সপ্তর্ষি শুনতে পেল সুধীনকাকা এখনো তার বাবাকে পুরনো দিনের গল্প শোনাচ্ছেন৷ তিনি বলছেন—সেকালের মানুষগুলো সবদিক দিয়েই বড় হত, কি চেহারায়, কি মনে৷ আমার প্রপিতামহের আমলে আমাদের এক কর্মচারী ছিল, তার নাম বৃন্দাবন৷ শুনেছি সে নাকি একবার আমাদের বাড়ি ডাকাত পড়লে কেবল লাঠি ঘুরিয়ে পঞ্চাশজন ডাকাতকে গ্রামের বাইরে তাড়িয়ে দিয়ে এসেছিল৷ এজন্য কিছু পুরস্কার দিতে চাওয়া হয়েছিল, সে নেয়নি৷ বলেছিল—আজন্ম এ বাড়িতে আছি, মরবও এখানে৷ ও নিয়ে করব কি? রাখব কোথায়?
বৃন্দাবন! এই নামটাই সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় কাল তার মনে এসেছিল৷
চারদিকে তাকাল সপ্তর্ষি৷ এই বিরাট বাড়িটার সঙ্গে একদিন তার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ এর ঘরে ঘরে বাস করত তার প্রিয়জনেরা৷ ভাগ্য আজ তাকে এখানে এনে তার চোখের সামনের আবরণ সরিয়ে দিয়েছে৷ গল্পের বইতে এমন ঘটনা পড়েছে সপ্তর্ষি— বাস্তবেও হয় তাহলে!
সুধীনকাকাদের অবস্থা এখন পড়ে গিয়েছে৷ এ সময় যদি বেশ কিছু টাকা হাতে পান, তাহলে বাড়িটা মেরামত করতে পারেন, শ্রেয়ার খুব ভালো বিয়ে দিতে পারেন—আরো কত কি ভালো কাজে লাগাতে পারেন৷
চৌবাচ্চার নীচে গাঁথা রয়েছে মূর্তিটা৷ রামগতি বলেছিলেন—ধাতুর তৈরি! কি ধাতু? সোনা? রূপো? যাই হোক না কেন, তার দাম অনেক—অনেক হবে! জিনিসটা ন্যায্যত সুধীনকাকুর প্রাপ্য৷ আর কতদিন ওটা পড়ে থাকবে ওখানে?
মূর্তিটার সন্ধান সে বলে দিলে খুব হই-চই হবে, সবাই তাকে প্রশ্ন করবে, বিরক্ত করবে—কিন্তু সুধীনকাকার খুব উপকার হবে৷ অবশ্য সুধীনকাকাকে বলে দেওয়া যায়, তিনি যেন সপ্তর্ষির নাম কাউকে না বলেন৷
বিগ্রহ দেখবার জন্য তার বাবা তাকে ডাকছেন৷
সে এগিয়ে গেল৷ তারপর সুধীন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে বলল—কাকা, আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে৷