অধ্যায় চুয়াল্লিশ – বর্তমান সময়
ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল হাইওয়ে
‘ব্যাপারটা আসলে কী, খুলে বলো তো?’ সামনের অন্ধকার রাস্তা থেকে নজর না সরিয়েই রিফাতের কাছে জানতে চাইল বাশার। ওদের গাড়ি প্রায় আশি কিলোমিটার বেগে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে। অন্ধকার রাস্তায় এই গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে যদি একটু এদিক থেকে সেদিক হয় তবেই হয়েছে। হাইওয়েতে চলতে থাকা শতশত ট্রাকের একটাতে লাগলেই ওদের মাইক্রোর স্থান হবে আশপাশের কোনো খাদে, আর ওদের স্থান হবে ইহলোক থেকে পরলোকে।
তুমি আরেকটু আস্তে চালাও তো, ইতিহাস উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেরাই ইতিহাস হয়ে যাবার কোনো মানে হয় না,’ পেছনের সিট থেকে জয়া বলে উঠল। বাশার স্রেফ মাথা নাড়ল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ওদের তো আর জানবার কথা নয় এই রাস্তার পাশেই কোনো এক এলাকায়ও জন্মেছে, বড়ো হয়েছে। যদিও অনেক পালটে গেছে তবুও এই রাস্তাটা একসময় নিজের হাতের উলটোপিঠের মতোই চিনত ও।
‘কী হলো, তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম,’ বাশার আবারো রিফাতের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
রিফাত কেমন জানি ঝিম মেরে আছে। আরো কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে একবার হাতের ট্র্যাকারটা দেখল। অন্য বিন্দুটা ওদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে। যদিও নড়তে থাকা বিন্দুটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওটা এখনো জায়গামতো পৌঁছাতে পারেনি। বিন্দুটাকে আরেকবার দেখে নিয়ে ট্র্যাকারটা পাশের সিটে রেখে দিল রিফাত। সে রাখতেই জয়া তুলে নিয়ে ওটাতে চোখ বুলাতে লাগল।
‘শোনো, ওই ম্যাপে আমি যা দেখেছি সেটা এই এলাকার এক বহু পুরনো মিথের সাক্ষাৎ প্রমাণ,’ রিফাত আনমনেই বলে উঠল এখনো সে তার ভাবনার জগৎ থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি।
‘আশ্চর্য কাণ্ড, কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে ওই কয়েকটা আঁকিবুকি দেখে এতকিছু বুছে ফেললে?’ জয়ার গলায় খানিকটা টিটকিরির সুর। নাকি সুরটা হিংসের?
‘বুঝতে পেরেছি তার কারণ বহু বছর ধরে এই এলাকার জিওগ্রাফি আর আর্কিওলজি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি আমি। আচ্ছা, তোমরা কি জানো ব্রহ্মপুত্রনদকে নদ কেন বলা হয়?’ বাশার আর জয়া দুজনেই মাথা নাড়ল। বাশারের চোখ এখনো সামনের দিকেই। ওদের গাড়ি কাঠগোলা বাজার পার হয়ে খাগডহর এলাকার বিডিআর ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে এখন।
‘আমি তো জানতাম এই নদ-নদীর ব্যাপারটা স্রেফ ভাষাগত ব্যাপার, অন্যকিছু নয়,’ জয়া বলে উঠল
‘আসলেই এটা স্রেফ ভাষাগত একটা ব্যাপার, তারপরও এতে অনেক সময় জিওগ্রাফিক্যাল একটা অ্যাঙ্গেল থাকে। যেমন ধরো কোনো একটা মূল জলধারা থেকে নতুন জলধারা উৎপন্ন হয় তখন মূল জলধারাকে নদ আবার উৎপন্ন জলধারাকে নদী বলে। আবার যেসব নদীর কোনো শাখা-প্রশাখা আছে তাদের বলে নদী, যেটার নেই সেটাকে বলে নদ। সবক্ষেত্রে অবশ্য এটাও ঠিক না। তবে আমরা যদি উপকথা অনুযায়ী বলতে চাই তবে ব্রহ্মপুত্র নিয়ে এরকম একটা উপকথা প্রচলিত আছে। এমনকি ময়মনসিংহ গীতিকাতেও নাকি এর উল্লেখ আছে,’ রিফাত আগ্রহ নিয়ে বলে চলেছে আর বাশারের বিরক্তি বাড়ছে।
‘রিফাত মূল কথাটা বলো।’
‘প্রচলিত ব্যাপারটা অনেকটা এরকম; ব্রহ্মপুত্র নাকি একটা নদ বা নদী নয়। এটা নাকি দুটো নদীর একটা সংমিশ্রণ। সংমিশ্রণটাও একটা ব্যতিক্রম। ব্রহ্মপুত্র নাকি একটা নদীর ওপরে আরেকটা নদী। তাই উপরের অংশটাকে বলা হয় নদ আর নিচের অংশটাকে…’
‘তুমি যা বলছ সেটাকে বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে বা প্রকৃতিগতভাবে বলতে গেলে, ব্রহ্মপুত্র নদের নিচেই আরেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড নদী রয়েছে?’ জয়া বলে উঠল।
‘ঠিক তাই, তবে ব্যাপারটা স্রেফ উপকথা হিসেবেই রয়ে গেছে; এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কারণ আগের সেই ব্রহ্মপুত্রের খুব সামান্যই অবশিষ্ট রয়েছে এখন। নদী ভাঙন, মরুকরণ আর বিশেষ করে আশির দশকে আসামের বড়ো ভূমিকম্পের সময়ে ব্রহ্মপুত্রের মূলধারা সরে গিয়ে ছোটো হতে হতে এখন নদীটা নিঃশেষ প্রায়। তবে ওই ম্যাপে যা আছে এই ব্যাপারটারই একটা ইঙ্গিত।’
‘মানে?’ বাশার সামনে থেকে জানতে চাইল।
‘মানে খুব জটিল। ওই ম্যাপের একটা প্রান্তে শশীলজের আকৃতি আঁকা ছিল, অন্যপ্রান্তে মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ির আকৃতি আঁকা। মাঝখানে দুটো সমান্তরাল রেখার মাঝামাঝি আরেকটা পাতলা রেখা আঁকা এবং সেখানে…’ বলে সে একটু নাটকীয়ভাবে থামলো। কৌতূহলের চোটে বাশার আরেকটু হলে একটা ট্রাকের সঙ্গে মাইক্রোর অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাতে যাচ্ছিল। ‘আরে ভাই, এভাবে থেমে থেমে না বলে সোজা বলো তো,’ বিরক্তির সঙ্গে গজ-গজ করল বাশার।
‘দাঁড়াও, আমি বলবো,’ বলে জয়া একটা হাত তুললো। ‘ছোটোবেলা থেকে আমরা একটা কথা শুনে আসতাম। মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ি থেকে নাকি শহরের জমিদার বাড়িতে যাবার একটা সুড়ঙ্গ আছে। শত্রু বা ডাকাতরা আক্রমণ করলে তারা নাকি এই সুড়ঙ্গ দিয়ে মুক্তাগাছা থেকে শহরে চলে যেত। এই সুড়ঙ্গটা আসলে সুড়ঙ্গ না, এটা আসলে পাতালের ব্রহ্মপুত্র নদী।’
‘ঠিক তাই,’ মাথা নেড়ে সায় জানাল রিফাত। ‘আর এই পাতালেরই কোথাও আছে এই উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরনো কালী মন্দিরগুলোর একটা। সেই ঐতিহাসিক মন্দির, যাকে ডাকা হয়ে থাকে জোড়া দেবীর মন্দির। আর সেই মন্দিরেই আছে জোড়া কালীর দ্বিতীয় মূর্তিটা,’ বলে সে দুজনার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আমরা এখন সেখানেই যাচ্ছি।’
সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ
‘কী বকছেন আপনি এসব, মন্দির, পাতালের নদী, এসবের সঙ্গে এই ঠগী ফিরিঙ্গিয়ার সম্পর্ক কি?’ চরম বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল ম্যাকফি। একবার হেনরির দিকে ফিরেও তাকাল। হেনরির চেহারা দেখে যদিও মনের ভাব বোঝা গেল না। তবে সে-ও ঘোড়ার রাশ টেনে থামিয়ে ফেলেছে। এই থামাটা দরকার ছিল। সেই মাঠ থেকে একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে মানুষ আর ঘোড়া উভয়েই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
‘সম্পর্ক আছে। ফিরিঙ্গিয়ারা ওখান থেকে পালিয়ে কোথায় গেছে সেটা বুঝতে হলে ব্যাপারটা আপনাদের জানা দরকার। আমাদের পরিবার বগুড়া থেকে এসে এখানে যখন গোড়াপত্তন করে তার আগে মঙ্গলা দেবীর পুজো হতো এই এলাকায়। আমরা আসার বহু আগেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়। ওদের অনুসারীরা এই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এখন আমাদের বাড়ি যেখানে সেখানে মূল ভিটার পেছনে মঙ্গলা দেবীর একটা মন্দির ছিল। আমাদের বাড়ি বানানোর পরেও জায়গাটা পরিত্যক্তই ছিল।আমার বাবা যখন আমার মাকে বিয়ে করে আনে, এরপর থেকে বড়ো বউ হবার পরও রমাকান্ত দাদার মায়ের কদর আমাদের বাড়িতে কমতে থাকে। বড়ো মা তখন সারাদিন বাড়ির পরিত্যক্ত অংশের ওই দেবীর মন্দিরে গিয়ে পড়ে থাকত। ওখানে পড়ে থাকতে থাকতেই সেখানকার পুরনো পুঁথি ঘাটতে গিয়ে সে আবিস্কার করে এই মন্দিরটা আসলে একটা কভার। এই মন্দিরের নিচ দিয়ে পাতালে নামা যায়, যেখানে ব্রহ্মপুত্রের পাতাল নদী রয়েছে। এই পাতাল নদীর কিনারায় হাজারো বছর আগে কারা যেন গড়ে তুলেছিল এক বিরাট মন্দির। রমাকান্ত দাদা জমিদারি পাবার পর এই মন্দির আর পাতালের নদীর সঙ্গে সংযোগ আছে এরকম একটাজায়গাতেই গড়ে তুলতে শুরু করে নতুন জমিদার বাড়ি।
‘যেখানে আপনার সঙ্গে প্রথমবার আমাদের দেখা হয়?’ ম্যাকফি ঘোড়া পরীক্ষা করে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ, সেটার কাজ আসলে শুরু করেছিল রমাকান্ত দাদা। ওই নতুন জমিদার বাড়ি আর পুরনো জমিদার বাড়ি দুটোর মাঝখানে আসলে পাতাল পথে যাতায়াত করা যায়। সঠিকভাবে বলতে গেলে সেই পাতাল নদী দিয়ে যাতায়াত করা যায়।’
‘আমাদের মনে হয় রওনা দেওয়া উচিত…’ জোনাথন বলে উঠল।
যাবো, তবে আগে বোঝা উচিত আমরা সঠিক জায়গায় যাচ্ছি কি না? এই মন্দিরেই ঠগীদের আস্তানা? সেটা কীভাবে সম্ভব?’ এবার হেনরি জানতে চাইল।
‘রমাকান্তকে জমিদারি থেকে উৎখাত করার পর সে ভারতে গিয়ে যখন ঠগীদের সঙ্গে মিশতে শুরু করে তখন সে কথায় কথায় তাদের সঙ্গে এই মন্দিরের ব্যাপারটা জানায়। তখন ফিরিঙ্গিয়া তার কাছে পুরো ব্যাপারটা জানতে চায়। সে সব শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এই মন্দিরটাকেই সে তার আস্তানা হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব করে। সে রমাকান্তকে প্রস্তাব দেয় আমাকে উৎখাত করে তাকে জমিদারি ফিরিয়ে দিবে। আর বিনিময়ে তাকে এই মন্দিরটাকেই জোড়া দেবীর মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে দেবে। এর পেছনে ফিরিঙ্গিয়ার কিছু যুক্তিও ছিল। পাতালের ওই মন্দির থেকে মাটির নিচ দিয়েই এই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় কারো চোখ না পড়েই সে আর দল যাতায়াত করতে পারবে। এই মন্দিরেই বসে সে ঠগীদের জন্যে ভারতবর্ষে সবচেয়ে সুরক্ষিত গোপন আর শক্তিশালী আস্তানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে।’
‘তারমানে এই পুরোটা সময় যখন আমরা এই ঠগীদেরকে খুঁজে বের করে নিধন করার পরিকল্পনা করছি ওরা ঠিক আমাদের নিচেই অবস্থান করেছে। হায় খোদা। কিন্তু এখন গেলে আমরা ওদেরকে পাবো কোথায়? এই পাতাল মন্দিরে ঢোকার বের হবার রাস্তার নিশ্চয়ই শেষ নেই?’
‘আমারও তাই মনে হয়। তবে মারা যাবার আগে রমাকান্ত আমাকে বলে গেছে মন্দিরটার অবস্থান ঠিক কোথায়। আর আমাদের বাড়ির পেছনের পরিত্যক্ত সেই মন্দিরের ঠিক কোনদিক দিয়ে ওখানে প্রবেশ করা যাবে। আমার মনে হয় আমরা যদি সময়মতো পৌছাতে পারি তবে অবশ্যই ফিরিঙ্গিয়া আর তার দলের অবশিষ্টদের মন্দিরেই ধরতে পারব কারণ যতই খারাপ অবস্থা হোক জোড়া দেবীর মূর্তি না নিয়ে ওরা এই এলাকা ছাড়বে বলে মনে হয় না।’
‘আমারও একই মত,’ জলদি চলো সবাই। সবাই জমিদার বাড়ির দিকে ঘোড়া ছোটালো।
সময় : বর্তমান
‘আর কতক্ষণ লাগবে?’ জয়া একটু অধৈর্য হয়েই জানতে চাইল।
সামনের অন্ধকার আর নির্জন রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই বাশার জবাব দিল। আর সর্বোচ্চ পনেরো মিনিট,’ বলে ও গিয়ার পরিবর্তন করে গতি আরো বাড়িয়ে দিল।
ওর হিসেব পরিষ্কার। ওদের মাইক্রো বেগুনবাড়ি বাজার পার হয়েছে আরো পাঁচ মিনিট আগে। কাজেই রাতের এই নির্জন সময়ে আর খুব বেশিক্ষণ লাগার কথা না।
‘ফিরে এসেছে, ফিরে এসেছে,’ খুশি হয়ে উঠল রিফাত। একটু আগে ওদের ট্র্যাকার থেকে বিন্দুর মতো জ্বলতে থাকা সিগন্যালটা গায়েব হয়ে যাওয়াতে রিফাত আর জয়া দুজনেই অস্থির হয়ে উঠেছিল। তবে বাশার জানত ব্যাপারটা ঘটেছে দূরত্বের কারণে। রেঞ্জের ভেতরে প্রবেশ করলে ঠিকই আবার সিগন্যাল ফিরে আসবে। হয়েছেও তাই।
‘বিন্দুটা কি এখনো সচল আছে নাকি…’ বাশারের প্রশ্ন শেষ হবার আগেই জয়া বলে উঠল। ‘নাহ, স্থির হয়ে আছে।’
‘তারমানে ওরা পৌঁছে গেছে জায়গামতো,’ রিফাত মন্তব্য করল। ‘আমরাও প্রায় চলে এসেছি।’
বাশারের মাইক্রো আরো দশ মিনিটের ভেতরেই মুক্তাগাছা সদরে প্রবেশ করল। ছোটোবেলায় জমিদার বাড়িতে বহুবার এসেছে। তাই রাস্তাটা ওর ভালোই চেনা আছে। মুক্তাগাছা পৌরসভা পার হয়ে খানিকটা এগিয়ে মূল রাস্তা থেকে ডানে মোড় নিয়ে কলেজ রোডে ঢুকে পড়ল ওদের মাইক্রো। বাশারের যতটুকু মনে পড়ে আরেকটু এগোলেই সামনে শহীদ স্মৃতি কলেজ পাবে। ওটা থেকে আরেকটু এগিয়ে ডানে মোড় নিলেই রাজবাড়ি রোডেই অবস্থিত পুরনো সেই জমিদার বাড়ি।
শহীদ স্মৃতি কলেজ পার হয়ে রাজবাড়ি রোডে প্রবেশ করল ওদের মাইক্রো। রাজবাড়ির নামেই এই রাস্তার নামকরণ হয়েছে। ‘বিন্দুটার কী অবস্থা?’ বাশার জানতে চাইল। কোমরে গুঁজে রাখা নিজের পিস্তল আর কাটা শটগানটা পরীক্ষা করে রেখেদিল। খুঁজে পেতে মাইক্রোর ড্যাশবোর্ডে একটা ছোটো কিন্তু ভালো মানের টর্চ দেখে তুলে নিলো ওটা।
ট্র্যাকারটা পরীক্ষা করতে করতে জবাব দিল রিফাত। কাজেই ওখান থেকে পাঁচ-ছয়শো গজের ভেতরেই আছে।’
‘তারমানে আমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছি। নামো সবাই,’ বলে সবাইকে নামার জন্যে ইশারা করে নিজেও নেমে এলো। ‘যদিও অনুমান করছি ওরা সংখ্যায় দুই জনের বেশি হবে না, তবুও ওরা কয়জন আছে সঠিকভাবে জানি না আমরা। নিশ্চয়ই ওদের সঙ্গে অস্ত্রসস্ত্র আছে। আর তাছাড়া ওরা মরিয়া। কাজেই সাবধান।’
‘আমাদের মনে হয় আরো লোক নিয়ে আসা উচিত ছিল,’ রিফাত বলল।
‘কীভাবে লোক নিয়ে আসবো? ওখানে তো আনার মতো কেউ ছিলই না। আবদুল্লাহ রমিজ দারোগাকে নিয়ে ব্যস্ত। আর ছিল এসপি স্যার, তাকে নিয়ে আসতে বলছ? ব্যাকআপের জন্যে অপেক্ষা করলেও দেরি হয়ে যেত।’
যা হয়েছে বাদ দিয়ে চলো কাজে নামি, জয়া শক্ত কণ্ঠে বলল। ওরা তিনজনে মিলে পুরনো দিনের পরিত্যক্ত রাজবাড়ির গেটের ভেতরে প্রবেশ করল। গেটের ঠিক ভেতরেই বড়ো বড়ো খিলানওয়ালা বাড়িটার সামনেই সেই সাদা গাড়িটা পার্ক করা। মনে মনে বাশার খুশি হয়ে উঠল, ঠিক জায়গাতেই এসেছে। পুরনো রাজবাড়ির মূল ভবন পার হয়ে ওরা পেছনে চলে এলো। অন্ধকারের ভেতরে খুব সাবধানে এগোচ্ছে। আলো জ্বালতে ভয় পাচ্ছে বাশার। তাই অন্ধকারের ভেতরেই যতটা সম্ভব দেখে-বুঝে এগোতে হচ্ছে। হঠাৎ অস্ফুটে শব্দ করে উঠল রিফাত।
‘কী ব্যাপার, কী হলো?’ বাশার যতটা সম্ভব গলা নিচু করে জানতে চাইল। তার প্রশ্নের জবাবে রিফাত কিছু না বলে বরং ট্র্যাকারটা এগিয়ে ধরল বাশারের দিকে। মৃদু আতঙ্কের সঙ্গে বাশার দেখল বিপ-বিপ করতে থাকা বিন্দুটা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। ‘সর্বনাশ,’ আনমনেই বলে উঠল ও। ‘ওরা টের পেয়ে গেছে আমরা এখানে!’
সময় : অতীত
রাজবাড়িতে পৌছাতে খুব বেশি সময় লাগল না ওদের। ওদের ঘোড়াগুলো দেখে দৌড়ে এলো এক সহিস। তাকে দেখে চিৎকার করে সূর্যকান্ত জানতে চাইল। ‘এই, এদিকে কেউ এসেছে?’
সহিস জানাল তারা বেরোবার পর থেকে কাউকেই এদিকে আসতে দেখেনি ওরা। ‘যারাই বাড়িতে আছে সবাইকে সাবধান করে দে। পাহারা বাড়াতে বল। আর ব্যারাকে খবর পাঠা, লোক লাগবে আমার,’ নির্দেশনা দিয়েই সে ওদেরকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। প্রত্যেকেই যার যার নিজের অস্ত্র পরীক্ষা করে ঠিকঠাক করে নিলো।
‘আমরা কি ব্যারাক থেকে সৈন্যদের দলটা পৌছানোর জন্যে অপেক্ষা করব?’ হেনরি আর ম্যাকফির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল সূর্যকান্ত।
‘প্রশ্নই আসে না। এক মুহূর্তও অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। আমরা যত দেরি করব ওদের পালানোর সম্ভাবনা ততোই বেড়ে যাবে। আর একবার ওরা পালিয়ে গেলে এই জীবনে খুঁজে বার করতে পারব না আমরা। কাজেই এখুনি চলুন। পারলে কিছু মশাল দিয়ে যেতে বলুন।’
কিছুক্ষণের ভেতরেই ওরা চারজন প্রত্যেকে হাতে একটা করে মশাল নিয়ে চলে এলো বিরাট বাড়িটার পেছনের প্রাঙ্গণে। বাড়ির পেছন দিকে একটা ছোটো জঙলার মতো। ছোটো হলেও বেশ গভীর জঙ্গলের মতোই জায়গাটা ওরা মশাল হাতে জঙ্গলে প্রবেশ করতেই সঙ্গমরত দুটো শেয়াল দৌড়ে পালাল ওদেরকে দেখে। এসব জঙ্গলে ছোটো মেছো বাঘ থাকাও বিচিত্র নয়। ওরা সাবধানে জঙ্গলমতো জায়গাটা পার হয়ে মন্দিরের প্রাঙ্গণে চলে এলো। আগের জঙ্গুলে জায়গাটার সঙ্গে এই অংশের কোনো মিলই নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে যত্ন নেওয়া হচ্ছে জায়গাটার, সে-ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই। ওরা সবাই মিলে মশাল হাতে ঢুকে পড়ল মন্দিরের ভেতরে। ছোটো মন্দিরের ভেতরেই বড়ো একটা বেদির উপরে মঙ্গলা দেবীর মূর্তি রাখা।
‘আশ্চর্য! আমি জানতাম এই মন্দির পরিত্যক্ত। অথচ আমার নাকের ডগাতেইকিনা…?’
‘কোথায়, কোন দিকে দিয়ে প্রবেশ পথ পাওয়া যাবে সেটা দেখান,’ সূর্যকান্তের কথাকে পাত্তা না দিয়ে, রীতিমতো ধমকে উঠে জানতে চাইল হেনরি।
‘এই যে, এখানে। যদি রমাকান্তের কথা ঠিক থাকে তবে এই দেবী মূর্তির নিচের বেদির ভেতর দিয়েই প্রবেশ করতে পারার কথা।’ তার কথা শেষ হতেই নিজেদের মশালগুলো জোনাথনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দেবী মূর্তিটা ধরে টান দিল দুজনে মিলে। নড়া তো দূরের কথা একটু হেললোও না ওটা। আবারো চেষ্টা করল ওরা।
‘না না, আমার মনে হয় এভাবে কাজ হবে না,’ বলে উঠল ম্যাকফি। চিকন ঘাম দেখা যাচ্ছে তার কপালে। ‘এটাকে বেদির ওপরে ঘোরোতে হবে,’ বলে সে আর হেনরি মিলে প্রথমে ডানে ঘোরালো। কাজ হলো না। এরপর বাঁয়ে ঘোরালো, জোরে মোচড় দিতেই বোতলের মুখে আটকে থাকা শক্ত ছিপির মতোই একটু একটু করে ঘুরতে শুরু করল ওটা। খুশির চোটে জোনাথনের গায়ে চাপড় মারলো সূর্যকান্ত। সঙ্গে সঙ্গে কড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল জোনাথন।
মুখ চুপসে গেল সূর্যকান্তের। দুজনে মিলে মূর্তিটাকে ঘুরিয়ে দিতেই বড়ো একটা ফোকরের মতো দেখা গেল। জোনাথনকে মশাল ধরতে বলে আগে নিজের শরীরটা গলিয়ে দিল ম্যাকফি। নিচে কী আছে জানে না। স্রষ্টার নাম নিয়ে শরীরটাকে ছেড়ে দিল।
খুব বেশি বড়ো না গর্তটা। কয়েক ফিট নিচে ধপ করে পড়ল সে। নিচে নেমে জোনাথনকে বলল নিচে মশাল ফেলতে। উপর থেকে মশালটা মাটিতে পড়ার আগেই ধরে ফেলল ও। আগেই শব্দটা পাচ্ছিল মশালের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল বিরাট আকারের একটা গুহায় নেমে এসেছে ওরা। তবে শব্দটা আসছে গুহার শেষ মাথা থেকে। ওদিকেই আলোটা ধরল। ‘চকচক করে কী?’ সূর্যকান্ত জানতে চাইল। ইতিমধ্যেই ওরা নেমে এসেছে গুহার ভেতরে।
ম্যাকফি তার দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘কী চকচক করে বুঝতে পারছেন না। পানি দেখেননি জীবনে?’
ওরা জলধারার দিকে এগিয়ে গেল। নদী না বলে এটাকে খাল বললেই ভালো হবে। চওড়া পঞ্চাশ-ষাট ফিটের বেশি হবে না। ওটার পাড়েই ছোটো একটা ঘাট, তাতে বাঁধা একটা ডিঙ্গি নৌকা।
‘এটা দিয়েই মনে হয় আপনার বড়ো মা অন্যপাড়ে যেত,’ হেনরি বলে উঠল। ‘চলুন আমরাও যাই,’ বলে সে উঠে এলো ডিঙ্গিটাতে। ছোটো হলেও কোনোমতে চেপে বসতে পারল চারজনেই।
‘চলুন, দেখা যাক পাতাল নদীর অন্যপাড়ে ভাগ্য কী অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে আমাদের জন্যে,’ বলে বৈঠা তুলে নিলো হেনরি
সময় : বর্তমান
তাজ্জব হয়ে ট্র্যাকারের বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে আছে বাশার। ওটাকে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে যে যেদিকে পেরেছে পুরনো রাজবাড়ির ভাঙাচোরা দেওয়ালের আশপাশে আড়াল নিয়ে বসে পড়েছে। ভেবেছিল লোকগুলো টের পেয়ে গেছে ওদের উপস্থিতি। কিন্তু ওদেরকে তাজ্জব করে দিয়ে বিন্দুটা ওদেরকে পার হয়ে চলে গেল ওদের ওপর দিয়ে।
‘আশ্চর্য কাণ্ড! ওরা তো আমাদের ওপর দিয়েই গেল। তবে তবে…’ রিফাতকে কথা শেষ করতে দিল না জয়া।
‘ওরা আমাদের ওপর দিয়ে যায়নি, গর্দভ। ওরা গেছে আমাদের নিচ দিয়ে।’
‘তারমানে ওরা পাতালে প্রবেশের রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। চলো জলদি চলো,’ বাশার অস্ত্র হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওরাও অনুসরণ করল তাকে। পুরনো দিনের জৌলুসময় রাজবাড়ির কঙ্কাল পার হয়ে ওরা চলে এলো বাড়ির পেছনের দিকে। মূল রাজবাড়ি পার হয়ে পেছনে একটা ছোটো নালার মতো দেখতে পেল ওরা। নালাটার অন্যপাশে আরো দুয়েকটা ভাঙাচোরা আকৃতি দেখা যাচ্ছে। ‘ওই দেখ। ভুতুড়ে আকৃতিগুলোর ভেতরে একটা থেকে মৃদু আলোর মতো দেখা যাচ্ছে যেন। শুকনো নালাটা পার হয়ে আরো কয়েকটা ভাঙা আকৃতি পার হয়ে একেবারে রাজবাড়ির প্রান্তে চলে এলো। পুরো রাজবাড়িটা যদি ভগ্নাবশেষ হয় তবে এই আকৃতিটাকে বলতে হবে কবরস্থান। এটাকে এখন শুধুমাত্র একটা আকৃতি ছাড়া আর কিছু বলার উপায় নেই। ওটার ভেতর থেকেই এলইডি লাইটের মৃদ আলো ভেসে আসছে।
‘চলো চলো,’ মন্দিরের আকৃতিটার ভেতরে এসে আশপাশে টর্চ মারলো বাশার। একেবারেই কিছু অবশিষ্ট নেই জায়গাটার।
বড়ো একটা পাথরের মূর্তির ভাঙাচোরা দুয়েকটা আকৃতি দেখা গেল। বিশাল আকারের বেদির ওপরে একটা বড়ো কালো পাথর চাপা দেওয়া ছিল মনে হয়। এখন সেই পাথরটা পড়ে আছে একপাশে। বেদির ভেতরে গোলাকৃতির গর্তের ভেতর থেকে ভেসে আসছে আলো। ‘এদিক দিয়েই নামতে হবে,’ বলে ও শরীরটাকে নামিয়ে নিচে দেখল গভীরতা খুব বেশি না। লাফিয়ে নিচে নেমে এলো। ওদেরকেও বলল নেমে আসতে। জয়াই নেমে এলো প্রথমে। তারপর রিফাত নামতে যাবে হঠাৎ জোরে গুরুম-গুরুম শব্দের সঙ্গে কেঁপে উঠল পায়ের নিচের মাটি। রিফাত গর্তের ভেতরে শরীরটা গলিয়ে নেমে আসছিল হাত ফসকে সোজা নেমে এলো বাশার আর জয়ার ওপরে। তিনজনে গড়াগড়ি খেতে লাগল মাটিতে। পায়ের নিচের কম্পন থেমে গেছে। বাশার উঠে বসে দেখল রিফাত গোঙাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখল পা মচকে গেছে তার। কোনোমতে তাকে ধরে ওঠালো। বাতাসে মৃদু একটা গন্ধ ভেসে আসছে।
‘ডিনামাইট,’ আনমনেই বলে উঠল জয়া। সামনে টর্চ মেরে দেখেছে বাশার। বেশ বড়ো একটা গুহার মতো জায়গাটা। সামনেই একটা গলি। ওটার প্রান্তে আসতে গিয়েই হঠাৎ মাটিতে দেখল একটা লাঠির মতো পড়ে আছে। জিনিসটা তুলে জয়া আর রিফাতকে দিল। ‘এটা ধরে হাঁটো, সুবিধে হবে,’ জিনিসটা নিয়ে ভর না দিয়ে দেখতে লাগল রিফাত। আপনমনেই বলে উঠল, ‘এটা একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া বৈঠা। তারমানে আশপাশেই কোথাও একটা নৌকো থাকার কথা, সঙ্গে পানিও।’ টর্চ মেরেই বহু পুরনো নষ্ট হয়ে যাওয়া ভাঙা নৌকোর অবশিষ্টাংশ দেখতে পেল ওরা।
‘তারমানে আমরা এখন যেখানে আছি সেটাই সেই পাতালের নদী। বহুআগেই এটা শুকিয়ে গেছে,’ বলে মাটিতে পা দিয়ে খোঁচা দিল জয়া। ‘রিফাত ভালো বলতে পারবে, তবে আমারও মনে হচ্ছে এখানে আগে পানি ছিল।’
‘চলো, আগে দেখতে হবে।’ ওরা খালের মতো শুকনো জায়গাটা হেঁটে পার হয়ে এলো। যতই এগোচ্ছে, ডিনামাইটের গন্ধ ততোই কড়া হয়ে নাকে বাজছে। সামনেই গুহার মতো একটা জায়গা দেখা গেল। ওটার ভেতর থেকে সাদা আলো ভেসে আসছে। গুহাটার মুখে ভাঙাচোড়া পাথর ছিঁড়ে-খুঁড়ে আছে। এখনো অনেক পাথর থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। এই জায়গাতেই যে ডিনামাইট ব্যবহার করা হয়েছে এব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই।
‘জয়া, এটা রাখো,’ বলে কোমর থেকে কাটা শটগানটা বের করে জয়ার হাতে ধরিয়ে দিল। নিজের হাতে বের করে এনেছে পিস্তলটা। রিফাত এখন নিজেই হাঁটতে পারছে।
ওরা তিনজনেই হেঁটে গুহার মুখে গর্তের মতো জায়গাটা পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।
ভেতর ঢুকে টর্চের আলোটা নিভিয়ে দিল বাশার। ভেতরে পরিষ্কার আলো দেখা যাচ্ছে। উৎসটা কোথায় সেটা খেয়াল করল না। কিন্তু সে-আলোয় যা দেখল সেটা অবিশ্বাস্য। গুহার ভেতরটা বেশ বড়ো আর ফাঁপা। একবাক্যে বলতে গেলে এটা গুহা না বরং এটাকে কোনো পাহাড়ের পাদদেশের মতো লাগছে। ভেতরে গোল দ্বীপের মতো জায়গা। দেখলেই বোঝা যায় একসময় এটার চারপাশে পানি ছিল কিন্তু এখন একেবারে খটখটে শুকনো। সেই দ্বীপের মতো জায়গাটাতেই বিরাট আকারের একটা খোলা মন্দির।
ইতিহাসের হারানো অধ্যায়, জোড়া দেবীর মন্দির!
পোড়া মাটির তৈরি মন্দিরটা একসময় যে অসাধারণ ছিল সে ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই কিন্তু কালের আবর্তে তার রূপ-যৌবন সবই গেছে। এখন শুধু কঙ্কালটা টিকে আছে। সেই মন্দিরের কঙ্কালের সামনে বিরাট একটা বেদি সেই বেদির ওপরে ঠিক শশীলজ থেকে ডাকাতি হয়ে যাওয়া কালী মূর্তিটার মতোই দেখতে আরেকটা কালী মূর্তি রাখা। বেদির ঠিক নিচেই ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করার ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে আছে একটা কঙ্কাল। কঙ্কালটা এমনভাবে বসানো যেন পুজো দিচ্ছে দেবীকে। তিনজেনই মুগ্ধ হয়েই দেখছিল হঠাৎ চট করে ঘুরে গেল বাশার।
কিন্তু ইতিমধ্যেই দেরি হয়ে গেছে। ঘুরে গেলেও পরোপুরি ঘোরার আগেই শক্ত কিছু একটার আঘাতে মাটিতে পড়ে গেল। চেতনা না হারালেও ব্যথার তীব্রতায় চোখে অন্ধকার দেখতে পেল ও। তবে এর ভেতরেও শ্লেষ মাখা হাসিতে পরিষ্কার শোনা গেল কথাগলো। ‘যাক, অবশেষে দুটোই পাওয়া গেছে। জোড়া দেবী আর বলদ ইন্সপেক্টর,’ বলে কেউ একজন লাথি মারলো বাশারের পেটে।
সময় : অতীত
ওদের নৌকোটা পাতাল নদীর অন্যপাশে আসতেই এক লাফে প্রথমেই নেমে এলো ম্যাকফি। ওর মনে হচ্ছিল যেকোনো সময়ে নৌকোটা উলটে যাবে। কারণ এটাতে বড়োজোর দুজন বা তিনজন উঠতে পারে। সেখানে ওরা চারজন। ম্যাকফি কোমর পানিতে নেমে নৌকাটাকে টেনে নিয়ে এলো কিনারায়। ঘাটের মতো দেখতে একট জায়গা এখানেও আছে। বাকিরা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে নৌকাটাকে বেঁধে রাখল। মশালের আলো থাকার পরও পরিষ্কার দেখা গেল পাথরের গুহার মতো দেখতে একটা জায়গার ভেতর থেকে আলো আসছে। ওরা সেদিকেই এগোল। পাথরের মেঝেতে গোল একটা ফোঁকরের মতো। সেটা দিয়ে তীব্র স্রোতের মতো পানি বয়ে যাচ্ছে। পাথুরে চত্বরের মতো একটাজায়গা দেখা যাচ্ছে দরজার অন্যপাশে।
পানি টপকে সেটার ভেতরে একে একে প্রবেশ করল সবাই। ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই মুখ থেকে কথা সরছে না আর কারো। ভেতরে একটা গোল চত্বরের মতো জায়গা সেটার চারপাশে পানি দিয়ে ঘেরা। পানিটা মোটেই শান্ত পানি নয়। কেমন জানি উত্তাল পানি প্রতি মুহূর্তে এসে বাড়ি মারছে পাথরে চত্বরে। সেই পানি ঘেরা জায়গাটার ভেতরে ছোটো দ্বীপের মতো দেখতে উঁচু একটা জায়গায় পোড়া মাটির মন্দির। পোড়া মাটির এরকম নিখুঁত কারুকাজ এর আগে এখানকার কারো চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। নিখুঁত আকৃতির লালচে মন্দিরটার প্রাঙ্গণ ততোধিক লাল হয়ে আছে বলির শুকনো রক্তে। চারপাশে রক্ত আর সিঁদুর দিয়ে ঘেরা জায়গাটার মাঝখানে বিরাট একটা বেদি। বেদির ওপরে পাশাপাশি রাখা অপূর্ব সুন্দর কালো পাথরের তৈরি দুটো কালী মূর্তি। মূর্তি দুটোর ঠিক সামনেই বেদির নিচে হাঁটু গেড়ে বসে আছে একজন মানুষ। এমনভাবে নিজেকে অর্পণের ভঙ্গিতে বসে আছে সে তার চকচকে কালো পিঠ আর পেশিবহুল কালো কাঁধ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নিজের বন্দুক লোড করে সেদিকে এগোল হেনরি। সে গলা উঁচু করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বেদির সামনে বসে থাকা লোকটা চট করে উঠে বসে ওদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে কথা বলে উঠল।
শশশ, চুপ! সবাই চুপ,’ মানুষটা ফিরিঙ্গিয়া। তার সমস্ত শরীর রক্তাক্ত। কালো ধুতি আরো কালো দেখাচ্ছে, মাথায় পাগড়ি নেই। অবিন্যস্ত চুল, লাল টকটকে চোখ আর মোটা গোঁফে তাকে দেখতে দেখাচ্ছে দানবের মতো।
‘দেখতে পাচ্ছিস না মা ভবানীর আরাধনা করছি? মা অসন্তুষ্ট আছেন আমার ওপরে। তাই তো…তাই তো তোদের সঙ্গে হেরে গেছি,’ বলে সে উন্মাদের মতো একবার ওদেরকে দেখল আরেকবার। মূর্তি দুটোর দিকে তাকাল।
সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। কালো শরীরের প্রতিটা পেশি চকচক করছে, পেশির ভেতরে ফুলে উঠছে শরীরের সব শিরা-উপশিরা। ‘অথচ সব ঠিক ছিল। সব লক্ষণ ঠিক ছিল। বলি হইছে, ভোজ হইছে। এমনকি বাইরে যাবার সময় সাদা পেঁচার ডাকও শুনছিলাম। সব ঠিক ছিল, তাও হাইরা গেলাম। তারমানে তারমানে…’ বলে সে এক লাফে বেদি থেকে নেমে এলো।
‘তারমানে দেবী বড়ো কিছু চায়,’ ফিরিঙ্গিয়া একেবারে হেনরির বন্দুকের নলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই। একেবারেই নির্বিকার ভঙ্গিতে সে হেনরির বন্দুকের নলকে অগ্রাহ্য করে তার চোখের দিকে তাকিয়ে উন্মাদের মতো বলে চলেছে। ‘তাই আমি সিদ্ধান্ত নিছিলাম আইজ মানুষ বলি দিবো মা ভবানীর জন্যে। দেবী মানুষ চায়,’ শেষ কথাটা সে এত জোরে চিৎকার করে বলল গুহার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
‘মানুষ চায় মানুষ চায় মানুষ চায়…’ ম্যাকফি আর জোনাথন প্রথমে হেনরির মতোই ফিরিঙ্গিয়ার দিকে বন্দুকের নল ঠিক করে রেখেছিল ধীরে ধীরে ওদের বন্দুকের নল ঘুরে যেতে লাগল চারপাশে। ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাঁশপাতার মতো কাঁপছে সূর্যকান্ত। কারণ ওদের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে ঠগীদের ছোটোখাটো একটা দল।
ওদের দৃষ্টি ঘুরে গেলেও ফিরিঙ্গিয়া আর হেনরি এখনো পরস্পরের দিকেই তাকিয়ে আছে। ওদেরকে ঘিরে ফেলতেই ফিরিঙ্গিয়া চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ভাবছিলাম দেবীরে মানুষ দিবো একটা। পাইয়া গেছি, চাইরটা,’ শেষ কথাটা সে হাতের চার আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল। কথা শেষ হতেই কোমরের পেছন থেকে বের করে আনলো একটা বিরাট আকারের কুকরি।
সময় : বর্তমান
‘দাঁড়াও, ইন্সপেক্টর,’ ভাসা ভাসা কণ্ঠটা বলে উঠল। প্রথমে মাথায় বাড়ি এরপরে আবার পেটে লাথি; বাশারের মনে হচ্ছে ব্যথার চোটে অজ্ঞান হয়ে যাবে বিশেষ করে কাঁধের ক্ষতটার মুখ খুলে গেছে টের পাচ্ছে ও। ভেজা ভেজা অনুভূতি হচ্ছে। তারমানে আবারো রক্ত বেরুতে শুরু করেছে ওখান থেকে। কোনোমতে উঠে বসার চেষ্টা করেও আবারো পড়ে গেল ও মাটিতে।
‘উঠে দাঁড়া, ইন্সপেক্টর, শুনেছি তুই নাকি হিজরার মতোন তোর বন্ধুরে গুলি কইরা মারছোস পিছন থাইক্কা,’ বাশার এবার কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারল। গলাটা নুরুর। ‘তোর সঙ্গে অবশ্য যায় ব্যাপারটা,’ বলে সে পা এগিয়ে আবারো লাথি মারতে যাবে শোয়া অবস্থাতেই বাশার চট করে তার পা-টা ধরে নুরুকে ঠেলে দিল পেছন দিকে। হঠাৎ এরকম প্রতিরোধ নুরু আশা করেনি। সে ব্যালেন্স রাখতে পারল না। ধাম করে পড়ে গেল মাটিতে। মাটিতে পড়তেই শোয়া থেকে লাফিয়ে বাশার উঠে এলো তার ওপরে। এক ঘুসি মেরে নাকটা সমান করে দিল। অবশ্য ঘুসি খেয়েও নুরু এক হাতে ওর চুল টেনে ধরে পাশে টেনে ফেলে দিল। এবার সে উঠে এলো বাশারের ওপরে। ঘুসি মারতে যাবে পাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই খবরদার নামো, এর ওপর থেকে নামো, গলাটা জয়ার, সে কাটা শটগানটা চেপে ধরেছে নুরুর মাথার পাশে।
নুরু সরে এলো ওর ওপর থেকে। ওর দিকে তাকিয়ে রক্ত মুখে হেসে উঠল নুরু। ‘এই বেটির তেজ তোর চেয়ে বেশি।’
‘এই চুপ,’ জয়া ধমকে উঠল। চুপ, সরে আয়, নাহলে…’ ওর গলা সম্পূর্ণ শেষ হবার আগেই পেছন থেকে একটা বন্দুক লোড করার শব্দ শোনা গেল।
‘সবাই চুপ,’ আধা বাংলা আধা ইংরেজি মেশানো গলাটা বলে উঠল। ‘এখানে আমরা মারামারি করতে আসিনি। এই, নুরু, তুমি সরো ওখান থেকে।
ওরা ফিরে তাকিয়ে দেখল ডেভিডের ভাই চার্লি তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। হাতে একটা মেশিন পিস্তল। পায়ের কাছেই সেই কালো ব্যাগটা। ‘আমরা আপনাদের শত্রু নই। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আমি এই মূর্তি দুটো চাই। আমি এগুলো নিয়ে যেতে পারলেই খুশি, আপনাদের কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার নেই।’
বাশার দ্রুত বিবেচনা করছে পরিস্থিতি। সে নিজে আহত, রিফাত আহত। এদের সঙ্গে লড়াইয়ে পারবে না ওরা। তারচেয়ে এরা যদি মূর্তি নিয়ে পালায়ও ট্র্যাক করতে তেমন অসুবিধে হবে না।
‘আমি রাজি,’ বাশার জবাব দেওয়ার আগেই জয়া বলে উঠল। তবে আমি মূর্তি দুটোকে পাশাপাশি রেখে দেখতে চাই মিথ যা বলে সেটা সত্যি কি না। আসলেই মূর্তি দুটোকে একসঙ্গে করলে কিছু ঘটে কি না। চার্লি একবার নুরুর দিকে দেখল। আরেকবার জয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘ঠিক আছে, আমার কোনো আপত্তি নেই, তবে এসব বুলশিটে আমি বিশ্বাস করি না,’ বলে সে ব্যাগটা তুলে ধরল জয়ার দিকে। জয়া সেটা নিয়ে মূর্তিটা বের করে এক মুহূর্ত দেখল। তারপর এগিয়ে যেতে লাগল বেদির দিকে।
বাশার তাকিয়ে আছে, রিফাতও লাঠিতে ভর দিয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাশার রিফাতের দিকে তাকিয়ে একটা বিশেষ ইশারা করল। সবার আড়ালে কিছু একটা ধরিয়ে দিল রিফাতের হাতে।
এসব কোনোদিকে খেয়াল নেই জয়ার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে এগিয়ে চলেছে বেদির দিকে। বেদির সামনের কঙ্কালটা এড়িয়ে মূর্তিটাকে ধীরে ধীরে বসিয়ে দিল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিকট শব্দে কেঁপে উঠল গুহার ভেতরটা।
সময় : অতীত
হেনরি কোনো দিকে না তাকালেও বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটছে। তাদেরকে যে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে এটা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। সে মুহূর্তমাত্র দ্বিধা না করে গুলি চালালো ফিরিঙ্গিয়ার দিকে। সেই সঙ্গে চিৎকার করে তার সঙ্গীদেরকে গুলি চালাতে বলল। হেনরির গুলিটা সরাসরি ফিরিঙ্গিয়ার গায়ে না লাগিলেও গুলি লেগে তার হাত থেকে বিরাট কুকরিটা ছিটকে পড়ে গেল। সে সোজা এগিয়ে এসে হেনরিকে ধরে ফেলল। শক্তিশালী হাতে হেনরির গলা চেপে ধরে শূন্যে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলল তাকে। হেনরি মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই উন্মাদের মতো সে ছুটে এলো হেনরির দিকে। খালি পায়ের শক্ত লাথি খেয়ে হেনরির মনে হলো বুকের বাতাস সব বেরিয়ে গেছে।
অন্যদিকে ওদেরকে ঘিরে ধরতেই গুলি চালালো ওরা। ওরা মানে দুজনে ম্যাকফি আর জোনাথন। দুজনার গুলি খেয়ে দুজন ঠগী পড়ে গেল। মুহূর্তের জন্যে থমকে গেলেও পিছিয়ে গেল না ওরা। দুজনার জায়গা দখল করল আরো চারজন। কিন্তু লড়াইটা বেশি স্থায়ী হলো না। চারজনের ভেতরে দুজনকে পিস্তলের গুলিতে ঘায়েল করে ফেলতেই অবশিষ্ট দুজন আর জীবনের ঝুঁকি নিলো না ঝেড়ে দৌড় দিল বাইরের দিকে। দুজনকে পালাতে দেখে গুহার ভেতরে অবস্থানরত বাকি দুজনও দৌড় দিল। ওদের পিছু না নিয়ে ম্যাকফি আর জোনাথন ফিরে তাকাল হেনরি আর ফিরিঙ্গিয়ার দিকে। দুজনের লড়াই ততোক্ষণে তুঙ্গে উঠেছে 1
হেনরিকে লাথি মেরেই ফিরিঙ্গিয়া ভেবেছিল সে কাবু করে ফেলেছে। তার পা ধরে টেনে নিয়ে চলে বেদির কাছে। বেদির কাছে পৌঁছে তাকে ছেড়ে দিয়ে আগের দিন ছাগল বলি দেওয়া হয়েছে যে খড়্গগটা দিয়ে সেটা উঠিয়ে নিলো হেনরিকে বলি দেওয়ার জন্যে। খড়্গগ হাতে সে ঘুরে দাড়াতেই শোয়া অবস্থা থেকে সটান উঠে বসে হেনরি ফিরিঙ্গিয়ার পেটে ঢুকিয়ে দেয় ফিরিঙ্গিয়ারই বিরাট কুকরিটা। তাকে মাটিতে ফেলে টেনে আনার সময়েই মাটি থেকে উঠিয়ে নিয়েছিল সে ওটা। পেটে ঢুকেই সঙ্গে সঙ্গে টেনে বের করে আনে এবার বসিয়ে দেয় গলায়। ফিরিঙ্গিয়া কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে বেদির সামনে। তার রক্তে লাল হয়ে যেতে থাকে তারই মা ভবানীর বেদির পায়ের কাছটা।
ফিরিঙ্গিয়ার মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে হেনরি বড়ো করে একবার দম নিয়ে ফিরে তাকায় ম্যাকফি, জোনাথন আর সূর্যকান্তের দিকে। যে দৌড় শুরু হয়েছিল সেই নর্মদা থেকে তার অবসান হয়েছে। ওরাও হেনরির দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে কিন্তু তাদের হাসি পূর্ণ হবার আগেই বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ।
সময় : বর্তমান
যে বিকট শব্দে গুহাটা কেঁপে উঠেছে সেটা দুই কালী মূর্তিকে একসঙ্গে করার কারণে কোনো অদ্ভুত শক্তির প্রভাবে ঘটেনি; বরং রিফাতের ছুঁড়ে দেওয়া একটা হাত বোমার কারণে ঘটেছে। হাতাহাতির সময়ে এই হাত বোমাটা নুরুর বুক পকেট থেকে বের করে নিয়েছিল ইন্সপেক্টর বাশার। জয়া যখন বেদির দিকে এগিয়ে যায় সে ওই বোমাটাই রিফাতের হাতে তুলে দেয়। তারপর জয়ামূর্তিটাকে বেদি বসানোর সময়ে সবাই যখন সেদিকে তাকিয়ে আছে এই সুযোগে রিফাতকে ইশারা দিতেই সেটা সে ছুড়ে দেয় নুরুর দিকে। বোমাটা সোজা গিয়ে নুরুর সামনে পড়ে, সে লাফিয়ে সরে যাবার আগেই বিস্ফোরণে উড়ে যায় তার একটা পা। ঠিক একই সময়ে বাশার বের করে আনে তার পিস্তলটা।
চার্লি বেদির দিকে তাকিয়ে জয়ার কর্মকাণ্ড দেখছিল। বিস্ফোরণ ঘটতেই সে- ও একপাশে ছিটকে পড়ে। তবে শোয়া অবস্থা থেকেই হাতের মেশিন পিস্তলটা তুলে গুলি করার আগেই বাশার নিজের পিস্তল তুলে পর পর দুইটা গুলি করে তাকে। তবে দুইটা গুলি খেয়েও স্বাভাবিক রিফ্লেক্সের বশে তার আঙুল চেপে বসে মেশিন পিস্তলের ট্রিগারে। এক ঝাঁক গুলি উড়ে আসে ওদের দিকে। বাশার ডাইভ দিয়ে সরে যায় কিন্তু রিফাত গুলি খেয়ে পড়ে যায় মাটিতে। মাটিতে একটা গড়ান দিয়ে মৃত চার্লির হাত থেকে মেশিন পিস্তলটা নিয়ে অন্যদিকে ছুড়ে দেয় বাশার। তারপর দৌড়ে আসে রিফাতের কাছে।
গুলি খেয়েমাটিতে পড়ে আছেরিফাত। বাশার পরীক্ষা করে বুঝতে পারল : দুটো গুলি লাগলেও একটা গুলিও মারাত্মক নয়। আঘাতের চেয়ে বেশি শকেই জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটা। রিফাতকে সাবধানে শুইয়ে দিচ্ছে এমন সময় পেছন থেকে কাটা শটগান লোড করার শব্দ পেয়ে মৃদু হেসে ওঠে বাশার।
‘এতে হাসির কী হলো?’ রাগি গলায় জানতে চাইল জয়া।
রিফাতকে শুইয়ে দিয়ে ওর দিকে হাসি মুখেই ফিরে তাকাল বাশার। বসে পড়ল রিফাতের পাশেই। শরীরের নানা জায়গায় ব্যথা। তবুও না হেসে পারছে না ও। জয়ার কাটা শটগান ধরা হাতটার দিকে তাকিয়ে আবারো হেসে উঠল ও। ‘গল্পের এই টুইস্টটা আমি জানতাম। তবে এই কারণে হাসছি না। কিন্তু এই টুইস্টটা যে আমি জানি এটা তুমি জানতে না। এই কারণেই হাসছি,’ বলে আবারো হেসে উঠল বাশার।
‘মানে কী? কী আবোল-তাবোল বকছো?’ যদিও বন্দুক জয়ার হাতে, পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে তবুও সে রেগে উঠছে।
‘আবোল-তাবোল না। এটাতো খুব স্বাভাবিক যে দলের ভেতরে একজন বেইমান থাকবে যে শেষ মুহূর্তে সব নিয়ে কেটে পড়তে চাইবে, এটা মোটামুটি সব গল্পের কমন প্যাটার্ন। তবে তোমার প্যার্টানটা আরেকটু ব্যতিক্রম তাই না, জয়া?’ বাশার একটু থেমে যোগ করল। ‘নাকি আমার বলা উচিত বিজয়, বিজয় আচার্য। মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের শেষ বংশধর বিজয় আচার্য। ওটাই তো তোমার নাম তাই না?’
সময় : অতীত
‘হচ্ছেটা কী?’ হেনরি জানতে চাইল।
যেদিক থেকে শব্দটা এসেছে জোনাথন আর ম্যাকফি মিলে সেদিকে দৌড়ে গেল। ফিরে এলো একটু পরেই। এসে জানাল পলায়নরত ঠগীরা যাবার সময়ে ওরা যেদিক দিয়ে প্রবেশ করেছে সে-পথটা বড়ো একটা পাথর ফেলে বন্ধ করে গেছে।
‘ব্যাপারটা ভালো না,’ বলে উঠল সূর্যকান্ত। ‘কারণ পানি বাড়ছে। তারমানে ভোরের জোয়ার আসছে। আমরা যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম সেটাই ছিল এদিক দিয়ে পানি বের হবার একমাত্র রাস্তা,’ বলে সে উলটো দিকে দেখাল আঙুল তুলে। ‘ওদিক থেকে আসা পানি এই ফোঁকর দিয়ে বের হয়ে অন্যপাশের নদীতে মিশত। ওরা যদি রাস্তাটা বন্ধ করে দিয়ে থাকে তবে পানি অনেক বেশি বেড়ে যাবে। সেটা হবার আগেই এখান থেকে বেরুতে হবে।’
‘কিন্তু বেরুবোটা কোনদিক দিয়ে?’ হেনরি জানতে চাইল।
‘রাস্তা আছে,’ বলে সূর্যকান্ত গুহার অন্যপ্রান্তটা দেখাল। ‘আমার ধারণা এখান থেকে বেরুনোর একাধিক পথ আছে। কারণ ঠগীরা ওসব পথ দিয়েই যাতায়াত করত।’
‘হেনরি, এগুলো কী করবেন?’ ম্যাকফি বেদির কাছে ফিরিঙ্গিয়ার লাশ, আর কালী মূর্তি দুটো দেখিয়ে জানতে চাইল।
হেনরি এক মুহূর্ত ভাবল। ফিরিঙ্গিয়ার মৃতদেহটা এমনভাবে বেদির কাছে মাথা দিয়ে নিচু হয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন দেবীর আরাধনা করছে। লোকটা শত্রু হলেও তার দেবী ভক্তি হেনরির মনে দাগ কেটেছে।
‘লাশটা এখানেই থাক। সে শত্রু ছিল, তবে তার দেবী ভক্তি অসাধারণ। দেবীর পায়ের কাছেই থাক সে বাকিটা জীবন। এই মূৰ্তি দুটো অশুভের প্রতীক। এই দুটো একসঙ্গে থাকা চলবে না। একটা আমরা নিয়ে যাবো প্রমাণস্বরূপ উপর ওয়ালাদের দেখানোর জন্যে যাতে তারা আমাদের কথা বিশ্বাস করে, আর অন্যটা এখানেই থাক। ফিরিঙ্গিয়া আর তার দেবী পড়ে থাক একে-অপরের কাছে।’
‘চলুন চলুন,’ জোনাথন আর ম্যাকফি মিলে মূর্তিটা নিয়ে গুহার অন্যপ্রান্তে রওনা দিল। কিছুদূর এগোতেই ওরা নদীর স্রোতধারার মতো আরেকটা খাল দেখতে পেল। ওটার প্রান্তেও একটা ছোটো নৌকো বাঁধা। সবাই মিলে উঠে বসে তীব্র স্রোতের ভেতরে নৌকো ভাসিয়ে দিল। প্রথমে কিছুক্ষণ বৈঠা দিয়ে নৌকা বাওয়ার চেষ্টা করে বাদ দিল ওরা। স্রোতের টানে নৌকা ভেসে চলল ইচ্ছেমতো। ধীরে ধীরে জোয়ার যত এগিয়ে আসছে স্রোতের বেগ ততো বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে পানির উচ্চতা। পানির উচ্চতা বাড়তে বাড়তে একটা সময় মনে হলো পানি ওপরের ছাদে উঠে যাবে আর ওরা নালায় আটকে পড়া ইঁদুরের মতো মরবে। মাথা নিচু করে স্রোতের টানে ভেসে চলল ওরা জীবন বাজি রেখে। চলতে চলতে পানির স্রোতের সঙ্গে ওদের নৌকা ছিটকে বেরিয়ে এলো একটা পুকুরে। এই পুকুরের আরেক প্রান্ত গিয়ে মিশেছে একটা ছোটো খালের সঙ্গে।
প্রথমে কিছুক্ষণ পাগলের মতো উল্লাস করল ওরা বেঁচে থাকার আনন্দে।
‘জায়গাটা চিনতে পেরেছেন?’ সূর্যকান্ত হেনরি আর ম্যাকফির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। ভোরের আলো সবেমাত্র ফুটে উঠতে শুরু করেছে। দুজনেই ফিরে দেখল জায়গাটা। এইখানেই নতুন রাজবাড়িটা গড়ে উঠছে। চারপাশে বিরাট কর্মযজ্ঞের আয়োজন। নির্মাণ শ্রমিকেরা এখনো বেশিরভাগ ঘুমে। কয়েকজন মাছ মারছে, গোসল করছে বিরাট পুকুরটাতে। অবাক হয়ে দেখছে তারা ওদেরকে।
‘আমি রমাকান্ত দাদার স্বপ্নটা পূরণ করব। এই বাড়িটা সম্পন্ন হবার পর বাড়িটার নাম রাখবো ‘শশীলজ’। আর যেদিক দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম ওখানে একটা বড়ো গোসলখানা করে পুরো পাতাল পথটাকে ডেকে দিবো। তবে রহস্য রেখে দিবো ওখানেও,’ বলে সে ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো।
তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল ওরা।
সময় : বর্তমান
বাশার ভেবেছিল জয়া ব্যাপারটা পুরোপুরি অস্বীকার করবে কিন্তু জয়ার অবাক হবার মাত্রাটা এতই বেশি সে উলটো জানতে চাইল, ‘তুমি কীভাবে বুঝলে?’
বাশার নিশ্বাস ছাড়ল। ‘কীভাবে বুঝেছি, আসলে কী বলবো? অনুমান করেছিলাম অনেক আগেই, কিন্তু পুরোপুরি ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করি অনেক পরে। শুরু থেকেই তোমার চরিত্রটাকে ঠিক গল্পের ভেতরে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না আমি। সাংবাদিকদের কৌতূহলের মাত্রাটা এমনিতেই বেশি হয়, তবে তোমারটা অনেক বেশি। একজন মানুষ যতই কৌতূহলী হোকনা কেন, স্রেফ অতীতের একটা ঘটনা জানার জন্যে এতটা ঝুঁকি নিবে-এটা ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। তার ওপরে তোমার ওপরে মূল সন্দেহটা গিয়ে পড়ে যখন তুমি রিফাতেরসঙ্গে ডেভিডের প্রেমের ব্যাপারটা জানালে।’
বাশার আহত হাতটা ধরে ঝাড়া দিল। ‘তুমি ওই ব্যাপারটা আগে থেকেই জানতে, একটা সুযোগ খুঁজছিলে তথ্যটা ফাঁস করার। তথ্যটা ওই সময়ে ফাঁস করো যাতে কোনোভাবেই তোমার দিকে আমার মনোযোগ না যায়। কিন্তু বাস্তবে ঘটে উলটো। ওতেই তোমার ওপরে আমার মনোযোগ স্থির হয়। তোমার মনে আছে, তুমি আমাকে বলেছিলে রিফাতের ব্যাপারে আরো খোঁজ-খবর করতে। আমি তার ব্যাপারে খোঁজ না করে তোমার ব্যাপারে করি। জানতে পারি তুমি যে পত্রিকাতে কাজ করার কথা বলেছ শশীলজে ডাকাতির সময়ে সে-সময়ে সেই পত্রিকা ছিলই না। ওটা চালু হয়েছে আরো দুবছর পর। এখান থেকে শুরু। এরপরে আগের কিছু ব্যাপার মেলানোর চেষ্টা করি আমি।’
‘নুরু যখন রিফাত সেজে আমাদের সামনে আসে তুমি সঙ্গে সঙ্গেই সেটা বুঝতে পেরেছিলে, কিন্তু বলোনি। এরপরে এই মূর্তি উদ্ধারের ব্যাপারে তোমার অতি আগ্রহ থেকে শুরু করে আরেকটা ব্যাপার। তৌফিককে যখন আমি তোমার ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলি, সে সবই জেনেছিল। তাই সাঈদ আলী যখন তোমার সঙ্গে কথা বলে তখন সে তোমাকে ভুয়া সাংবাদিক ডাকে, কারণ তৌফিকের মাধ্যমে সে জানত তুমি ভুয়া। সন্দেহের পারদ চড়তে শুরু করার পর আমি আরো ছোটোখাটো কিছু হিসেব করি। যেমন ধরো যখনই রিফাত বিজয় আচার্য নিয়ে বলতে শুরু করত, তুমি চুপ হয়ে যেতে। কারণ তুমি ভয় পেতে বেশি বলে ফেলো কিনা। এরকম আরো আছে। এসবকিছু মিলিয়ে বুঝতে পারি তুমি আসলে ভুয়া। ডাকাতির দিন রাতে ওই বাড়িতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তুমি মরোনি। কে মরেছিল? লাশটা কার ছিল দাপুনিয়ার ওই ছেলেটার তাই না? কী যেন নাম ছিল…মোক্তার। তবে আমার প্রশ্ন হলো ডেভিডকে তুমি মারলে কেন? তাও আবার গলায় ফাঁস দিয়ে। মেরে গাড়িসহ পানিতে ফেললে কীভাবে?’
‘আমি ডেভিডকে মারতে চাইনি। কারণ আমি জানতাম ডেভিড মূর্তিটা এমন কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে যেটা একমাত্র সেই জানে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো ডাকাতির পর পুলিশের জেরা শেষে ডেভিড আমাকে বলে বাড়িতে নামিয়ে দিবে। কিন্তু অর্ধেক রাস্তা যেতেই সে আমাকে পিস্তল বের করে শাসাতে থাকে। আমি বুঝতে পারি সে আমাকে পথেই খুন করে কোথাও ফেলে দিবে। আমি মরিয়া হয়ে হাতাহাতির এক পর্যায়ে গাড়ির সিটবেল্ট পেঁচিয়ে ধরে পেছন থেকে টান দিলে সিটবেল্ট তার গলায় চেপে বসে। সম্ভবত তখুনি তার গলার হাড় ভেঙে যায়। বেল্টটা গলায় চেপে বসতেই তার পিস্তল থেকে গুলি বেরিয়ে আমার গায়ে লাগে। একদিকে তখন গাড়িটা উলটাপালটা চলতে শরু করেছে, অন্যদিকে গুলির আঘাতে আমি ছিটকে পড়ি গাড়ি থেকে।
‘গুলির আঘাত খুব ভয়ংকর না হলেও অন্ধকার রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি আমি বেশ কিছুক্ষণ। যখন জ্ঞান ফিরে আসে আমি পাগলের মতো ডেভিড আর ওর গাড়ির খোঁজ করি। কিন্তু পাইনি। আমি ভেবেছিলাম সে পালিয়েছে। কিন্তু সে যে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে পানিতে পড়ে গেছে এটা কখনোই আমার মাথায় আসেনি। তখন আমার অবস্থা পাগলের মতো। সঙ্গে টাকা নেই, কিচ্ছু নেই। পোশাক ছিঁড়ে গেছে, আহত। সিদ্ধান্ত নেই আগে বাড়ি যাবো। সেখানে গিয়ে ঠিক হয়ে ঠান্ডা মাথায় সব ভাবতে হবে। কিন্তু বাড়িতে যে ইতিমধ্যেই পুলিশ পাহারা বসে গেছে সেটা ভাবতে পারিনি। ওখানে গিয়েই পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা বেঁধে যায়। বাড়িতে আগে থেকেই মোক্তার ছিল। সে আর আমি মিলে রান্নাঘরের পেছেনের দরজা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করার সময়ই পুলিশের গুলিতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মোক্তার ওখানেই মারা পড়ে। আমি মারাত্মক আহত অবস্থায় পালাই। তারপর ভীষণ পোড়া চেহারায় একাধিকবার সার্জারি আর এরপরে…’ বলতে বলতেই জয়া থেমে গেল। অনেক তো বললা। এবার আমার একটা প্রশ্ন আছে। এটা না হয় বুঝলাম, তুমি বুঝতে পেরেছো আমি ভুয়া কিন্তু তুমি এটা কীভাবে বুঝলে আমিই বিজয় আচার্য।’
‘মজার ব্যাপার কি জানো, এটা বোঝা খুব সহজ ছিল। তবে সবচেয়ে বেশি দায়ী তোমার হাতের ওই আংটি। মেটামরফোসিস রিং পরে থাকত বিজয় আচার্য। সে ছিল আনবর্ন বেবি। বড়ো হয়েছে হিজরাদের মাঝে। পরে দেখা যায় সে পুরুষ। আসলে সে মানে তুমি পুরোপুরি পুরুষ ছিলে না, তাই না। একারণেই তুমি হাতে ওই প্রজাপতি রিংটা পরে থাক। রূপান্তর, তাই না, ট্রান্সজেন্ডার। প্রজাপতি হলো প্রাকৃতিক রূপান্তরের সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ। সেটারই প্রতীক তুমি ধারণ করে রাখতে নিজের হাতে। পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হওয়া। নিজের পরিচয় পালটে ফেলার জন্যে এরচেয়ে বড়ো ছদ্মবেশ আর কি হতে পারে? তাই না বিজয় আচার্য, ওরফে জয়া সরকার?’
শেষ কথাটা বেশ শান্তভাবে বলল বাশার। ‘কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে। কেন? বুঝলাম একসময় তোমার কিছুই ছিল না। কিন্তু এরপরে তোতুমি সব পেয়েছিলে তবে কেন এই ঠগীত্ব? কেন এই রূপান্তর?’ বলে ও হাত তুলে জোড়া মূর্তি দেখাল। ‘এসবের জন্যে? রিয়েলি? তুমি এসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করো। কি হয়েছে? কীসের বিশেষ শক্তি জোড়া মূর্তির। বলো জয়া।’
‘তুমি বুঝবে না, বাশার। কারণ তুমি জানো না,’ জয়ার কণ্ঠস্বর ঝাপসাহয়ে গেছে। ‘বদলে যাওয়ার অনেক সংজ্ঞা আছে। তুমি যখন এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর হও, তখন কী ঘটে কেউই সেটা জানে না। তাই সব পেয়েও সবকিছু আমার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। বরং পুরনো সিন্দুকের সেই পোকায় খাওয়া ডায়েরিতে আমি নতুন এক জীবন খুঁজে পেয়েছিলাম। এত কাহিনি কিছুই ঘটত না, যদি আমি পুরো ডায়েরিটা পেতাম। পোকায় খাওয়া ডায়েরিটার ভেতরে শুধু প্রথম অংশটুকুই পড়তে পেরেছিলাম আমি। সেখানেই নতুন এক জীবনের সন্ধান পাই আমি, নতুন এক ডিভোশন, অতিমাত্রায় নিজেকে উৎসর্গ করা। এক মহান দেবীর জন্যে জীবন বিলিয়ে দেওয়া। অন্য এক রিপু, যাকে বলে সপ্তরিপু। এমন কি সার্জারির সময় ইচ্ছে করেই আমার গায়ের রঙও…’
‘অহ, কামঅন জয়া, তুমি এসবে বিশ্বাস করো? শত বছর আগে একদল মূর্খ ডাকাত কি মানত সেসবে তুমিও বিশ্বাস করো, এটা আমাকে অন্তত বিশ্বাস করতে বলো না। প্লিজ,’ বাশার মাথা নাড়ল।
‘তুমি সেটা মানতে পারবেও না। যাই হোক তবে এই জোড়া মূর্তির কত দাম হতে পারে, সেটা তো বিশ্বাস করো নাকি? এমনিতেই এর অবজেক্ট ভ্যালু মানে শুধু কষ্টি পাথরের দামই হবে কয়েক কোটি টাকা আর ঠগীদের মিথটা ঠিকমতো স্টাবলিশ করতে পারলে…’ জয়া কাঁধ ঝাঁকালো। ‘এছাড়াও এই মুর্তির আরো গভীর এক রহস্য আছে…’
‘নাউ ইউ আর টকিং বিজনেস,’ বাশার বলে উঠল। কিন্তু তুমি তো সেটা পারবে না। ‘কারণ। আমি তোমাকে সেটা করতে দিবো না।’
‘মানে? বন্দুক আমার হাতে, বাশার। আমি সত্যিই তোমাদের দুজনকে মারতে চাই না।’
‘তুমি পারবেও না। কারণ মনে আছে তোমার হাতে বন্দুকটা আমিই দিয়েছিলাম। ওটার টরশন পিন ভাঙা, একটাও গুলি বেরুবে না। চেষ্টা করে দেখতে পারো।’ বাশারের শেষ কথাটা শুনে জয়া পাগলের মতো ট্রিগার টানাটানি করতে লাগল। কিন্তু আসলেও গুলি বেরুল না। বাশার এবার আস্তে করে বের করে আনল নিজের পিস্তল।
‘তুমি পারবে না,’ বন্দুক কাজ করছে না দেখে ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাশারের মুখের ওপরে হেসে উঠল জয়া। ‘আমি দেখেছি তুমি রিফাতের বাসার বাগানে নুরুকে গুলি করতে পারোনি। আরো বহুবার আমি দেখেছি গুলি করতে গেলে তোমার হাত কাঁপে। কেন বাশার, নিজের বন্ধুকে গুলি করে মেরেছিলে বলে? এবার কোথায় গেল তোমার যুক্তিবাদি মন?’ বলে সে হেসে উঠল।
বাশার পিস্তলটাকে তুলে ধরেছে। আঙুলে চেপে বসেছে ট্রিগার। ‘তুমি পারবে না বাশার, তোমাকে দিয়ে…’ ভীষণ টিটকিরির সঙ্গে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল জয়া কিন্তু বিকট এক পশলা গুলির শব্দে থেমে গেল। একাধিক গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেছে তার শরীরের একাংশ। যেন ভীষণ অবাক হয়ে গেছে এরকম ভঙ্গিতে বেদির ওপরে পড়ে গেল সে। এখনো মরেনি।
নিজের পিস্তলের ঠান্ডা নলের দিকে একবার তাকিয়ে ঝট করে পেছন ফিরলো বাশার। চার্লির মেশিন পিস্তলের ধোঁয়া ওঠা নলটার দিকে একবার দেখে নিয়ে ও অবিশ্বাসের সঙ্গে তাকিয়ে রইল রিফাতের দিকে। শোয়া অবস্থাতেই সে চার্লির কুড়িয়ে পাওয়া পিস্তলটা দিয়ে গুলি করেছে জয়াকে।
বাশারের অবিশ্বাসের দৃষ্টি আর গুলিবিদ্ধ হয়ে বেদির ওপরে আর্তনাদ করতে থাকা জয়ার দিকে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘রূপান্তর বিজয়, আমিও রূপান্তরিত হয়েছি। তুমি আর ডেভিড আমার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছিলে। সেই থেকে আমিও রূপান্তরিত হয়েছি
ওদের চোখের সামনেই জয়ার দেহটা বেদি থেকে গড়িয়ে জোড়া দেবীর পায়ের কাছে পড়ে গেল।