প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ৪৩

অধ্যায় তেতাল্লিশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

বৃহত্তর মধুপুর এলাকা, ময়মনসিংহ

ম্যাকফি উঠে যাবার পর থেকেই জোহরার অস্থির লাগছিল। বারবার চোখে ফিল্ড গ্লাস লাগিয়ে মাঠের কেন্দ্রের দিকে দেখছিল সে। হঠাৎই এক লোক এসে জানাল ক্যাপ্টেন হেনরি তাকে পাঠিয়েছে। জোহরাকে তার সঙ্গে দেখা করতে এখুনি মাঠের অন্যদিকে যেতে বলেছে। ব্যাপারটা খুবই নাকি জরুরি। এমনিতেও জোহরার অস্থির লাগছিল। লোকটা এসে একথা বলাতে যেন স্বস্তিই পেল সে।

উঠে দাঁড়িয়ে লাল পাগড়িদের নির্দেশনা দেওয়া শুরু করতেই হঠাৎ ওর মনে একটা ব্যাপার খটকা লাগল, লোকটা বলেছে ক্যাপ্টেন হেনরি। কিন্তু যতদূর জানে ক্যাপ্টেন হলো ম্যাকফি, হেনরি যদিও আর্মিতে নেই তবুও পদ মর্যাদা বলে কর্নেল ছিল সে। খোদ হেনরি নির্দেশনা দিয়ে পাঠালে তো লোকটার এরকম ভুল হবার কথা নয়। লোকটাকে ডেকে জেরা শুরু করতেই সে উলটাপালটা বকতে শুরু করল। সন্দেহের পারদ মাত্রা ছাড়াল জোহরার।

সে লোকটাকে বেঁধে ফেলার নির্দেশ দিতেই যেন নরক নেমে এলো ওদের ওপরে। মুহূর্তের ভেতরেই একদল কালো পাগড়ি ঘিরে ধরল ওদেরকে। জোহরার বুঝতে সময় লাগল না এরা সব ঠগী। ওদেরকে ফাঁদে ফেলেছে।

লাল পাগড়িদের সঙ্গে ঠগীদের লড়াই শুরু হতেই লাল পাগড়িদের দলনেতা জোহরাকে নিয়ে জঙ্গলে সরে এলো। বিপদের সময়ের জন্যেই এখানে আগে থেকেই একটা ঘোড়া রেখে দেওয়া ছিল। জোহরা ঘোড়ায় উঠে পাগড়ি সর্দারকে নির্দেশনা দিল ক্যাপ্টেন ম্যাকফিকে সতর্ক করে দিতে। ঘোড়া চালিয়ে জঙ্গলের বাইরে আসতে আসতে মনে মনে হিসেব করে জোহরা বুঝতে পারল হেনরি আর ম্যাকফি যে পরিকল্পনা সাজিয়েছে সেটা ভেঙে পড়েছে। কারণ সম্ভবত শত্রুপক্ষের লোক এটা আগেই বুঝতে পেরেছে অথবা তারা খবর পেয়েছে। ঘোড়া থামিয়ে মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হয় ফিরে যায়, কিন্তু এটাও বুঝতে পারল ফিরে গেলে কোনোই লাভ হবে না বরং নিজের প্রাণটাও হারাতে হতে পারে। তারচেয়ে একটা ভাবনা উঁকি দিল তার মাথায়। জোরকদমে ঘোড়া ছোটালো সে নিজের বাড়ির দিকে। কিন্তু জঙ্গলের ভেতরে কীসের সঙ্গে যেন বাড়ি খেয়ে ঘোড়াসহ ছিটকে পড়ল মাটিতে।

***

ছরি হাতে ঠগীদের দলটা অনেকটা স্রোতের মতোই এসে পড়ল ওদের ওপরে। প্রথম যে ঠগীটা ম্যাকফির দিকে এগিয়ে এলো তাকে সোজা গুলি করল ম্যাকফি। লাল তিলকের ওপরে ততোধিক লাল রং ধারণ করে পড়ে গেল লোকটা। পিস্তলটা কোমরে গুঁজে এবার অন্যহাতে ছুরি বের করল সে। একহাতে ছুরি নিয়ে অন্য হাতে তলোয়ার বাগিয়ে আরেকজনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

তবে হেনরি এরকম কিছু করল না। প্রথমেই পিস্তলটা কোমরে রেখে দিয়েছে সে। এটার একমাত্র গুলিটা সে ফিরিঙ্গিয়ার জন্যে খরচ করবে। তলোয়ার হাতে সামনের দিকে ধাবিত হয়ে থেমে গেল। পাশ থেকে ছুটে আসা কুকরির কোপ এড়াতে শরীরটাকে বাকিয়ে তলোয়ার চালিয়ে দিখণ্ডিত করে দিল একজনকে। একটাকে সরাতেই তার সঙ্গে জায়গা করে নিচ্ছে আরেকটা।

ম্যাকফি একজনের সঙ্গে তুমুল লড়াই করছে লোকটা ওর গলার দিকে নিশানা করে কুকরি চালালো, তবে সেটার ফলা ম্যাকফির গলায় লাগার আগেই একটা চোখ নেই হয়ে গেল লোকটার। ম্যাকফি বুঝল জোনাথনের কাজ। চারপাশে লোহার সঙ্গে লোহার, হাড়ের সঙ্গে মাংসের আর লাঠির সঙ্গে হাড়ের সংঘর্ষের শব্দ।

তবে লড়াইটা ছিল অবশ্যম্ভাবী। কিছুক্ষণের ভেতরেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে গেল। প্রথম আক্রমণেই হেনরি আর ম্যাকফিদের দল সংখ্যায় তিনভাগের একভাগ হয়ে ক্যাম্পের ভেতরের দিকে চেপে এলো। মাঝখানে রাজা সূর্যকান্ত আর তারপাশে আহত ডোংরু মহারাজ, গুটিকয়েক লাল পাগড়ি আর ম্যাকফিরা। বৃত্তটা ছোটো হয়ে আসছে সহজেই। ওদেরকে উদ্দেশ্য করে এক ঠগী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই মহাবীর সিংয়ের বিরাট লাঠিটার এক বাড়িতে খুলি থেঁতলে গেল তার। বিরাট বপু নিয়ে ওদেরকে আগলে দাঁড়াল সে।

একের-পর-এক ঠগী ভাঙা হাত পা নিয়ে ছিটকে পড়ল এদিক সেদিক। হঠাৎ অনুচ্চ স্বরে একটা শিস বেজে উঠতেই একটা কুকরি ছুটে এলো অন্ধকারের ভেতর থেকে। সোজা এসে বিঁধলো মহাবীর সিংয়ের লাঠি ধরা হাতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা কুকরি ছুটে এসে নিখুঁত লক্ষ্যে বিঁধে গেল তার পেটে। দুই কুকরি গেঁথে যাবার পর মাটিতে পড়ে গেল সে। হাত থেকে ছুটে গেল লাঠিটা।

মহাবীর সিং পড়ে যেতেই হঠাৎ সব ঠগীরা থেমে গেল। পিছিয়ে গিয়ে গোল হয়ে ঘিরে ধরেছে ওদের। পেছন থেকে কে যেন সামনে ঠেলে দিল কাকে যেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন মানুষ ছুটে এসে পড়ে গেল ওদের পায়ের কাছে। ম্যাকফি অস্ত্র সামলে লোকটাকে দেখল।

শংকর। তাকে ইচ্ছেমতো প্রহার করা হয়েছে। নাক-মুখ ভেঙে দেওয়া হয়েছে মেরে।

‘ক্যাপ্টেন, তোমার প্রতিটা লোকের যদি এই পরিণতি না চাও তবে অস্ত্র নামিয়ে ফেল। কথা দিচ্ছি যন্ত্রণাহীন মৃত্যু হবে সবার,’ হিন্দি টানে বলে উঠল একজন। সঙ্গে সঙ্গে চিবিয়ে চিবিয়ে হেনরি উচ্চারণ করল, ‘বাস্টার্ড।

‘বুজেছি, ভালো কথার মানুষ তোমরা নও,’ বলে হেসে উঠল অন্ধকারের কন্ঠস্বর। ম্যাকফি একবার নিজের লোকদেরকে দেখল, আরেকবার হেনরিকে দেখল।

এই তাহলে শেষ পরিণতি। তলোয়ারটাকে শূন্যে দুবার ঘুরিয়ে স্থির করল। মহাবীর সিং শোয়া অবস্থাতেই হেসে উঠল হা হা করে। তার হাসি সংক্রামিত হলো অন্যদের মাঝেও। হঠাৎ থেমে গেল হাসি। কীসের যেন শব্দ শোনা যাচ্ছে।

ওদেরকে আক্রমণ করতে থাকা ঠগীরাও থেমে গেছে। পরিষ্কার ঘোড়ার খুরের শব্দ এগিয়ে আসছে এদিকে। দেখতে দেখতেই লাল পোশাকের একদল ঘোড়সওয়ার উদয় হলো শূন্য থেকে। তাদের অগ্রভাগে কালো পোশাক পরা মুখ ঢাকা এক নারী। দেখতে দেখতেই ঘোড়সওয়ারের দল ঝাঁপিয়ে পড়ল ঠগীদের ওপরে। লম্বা চকচকে বর্শা আর বন্দুকের মাথায় পরানো বেয়োনেট দিয়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলল তাদেরকে।

ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্বে ঠগীদের ওপরে জোহরাদের আক্রমণটা হলো খুবই স্বল্পস্থায়ী, কার্যকর ও বীভৎস। একেবারেই অপ্রস্তুত অবস্থায় ঠগীদের দলটাকে পেছন থেকে আক্রমণ করল ওরা। ঘোড়ার লাথি, লম্বা বর্শা আর বেয়োনেটের সামনে টিকতেই পারল না ঠগীদল। প্রথম ধাক্কাতেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল তাদের সুশৃঙ্খল দল। পেছন থেকে ইংরেজ বাহিনী আর সামনে থেকে ম্যাকফিদের আক্রমণে কিছু মারা পড়ল কিছু ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাল আর একটা অংশ আত্মসমর্পণ করল।

খণ্ডযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর পোশাক পরা ভারতীয় এক লোক এগিয়ে এলো ম্যাকফি আর হেনরির দিকে, ‘সার্জেন্ট অজয় পাল, স্যার। আপনাদের ভেতরে ক্যাপ্টেন ম্যাকফি কে?’

ম্যাকফি হাত বাড়িয়ে দিল। ‘আপনারা এখানে কীভাবে?’

‘আপনার টিমের কাছ থেকে কোনো খবর না পেয়ে স্যার গ্রেগর খুব অস্থির হয়ে পড়েন। গতকাল আমাদের স্থানীয় চৌকিতে খবর পাঠান আপনাদের খোঁজ নেওয়ার জন্যে। সেজন্যেই আমরা গতকাল বিকেলে রওনা দিয়ে স্থানীয় জমিদার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম পথে থেমে ক্যাম্প করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় এই লেডি ঘোড়াসহ একেবারে আমাদের ক্যাম্পের ওপরে এসে পড়েন। ওনার কাছ থেকে খবর পেয়েই আমরা সোজা এখানে চলে আসি। এরা কারা? হচ্ছেটা কী এখানে?’

‘আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ, সব বলবো তবে তার আগে আরেকটু কাজ বাকি আছে আমাদের,’ বলে ও হেনরির দিকে ফিরলো। সে হন্যে হয়ে ফিরিঙ্গিয়ার খোঁজ করছে। ‘পেয়েছো ব্যাটাকে?’

‘নাহ,’ আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল সে। ‘একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ব্যাটা। কোনদিকে গেছে কে জানে।’

‘আমি জানি, আমি পালাতে দেখেছি ওদের কয়েকজনকে,’ নতুন একটা কণ্ঠ বলে উঠল। কণ্ঠটা জোনাথনের। গাছ থেকে নেমে মাঠের কিনারা ধরে দৌড়ে এসে এখনো হাঁপাচ্ছে সে। ‘ওরা উত্তরের দিকের জঙ্গলে প্রবেশ করেছে।’

‘এখুনি চলো,’ বলে হেনরি, মেজর পালের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল ‘দুঃখিত, আপনাদের কয়েকটা ঘোড়া ধার নিচ্ছি আমরা। ফিরে না আসা পর্যন্ত এদেরকে সামলে রাখুন।’ ম্যাকফি একবার জোহরার দিকে ইশারা করে ওরা তিনজনে তিনটে ঘোড়ায় চড়ে বসল।

‘দাঁড়ান আপনারা, আমাকেও নিয়ে চলুন। কারণ ওদেরকে কোথায় পাবেন আমি জানি,’ রাজা সূর্যকান্ত এগিয়ে এলো। ‘আপনাদেরকে সেখানেই যেতে হবে যেখানে এই গল্পের শুরু হয়েছিল। আমাদের পুরনো জমিদার বাড়িতে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *