প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ৪২

অধ্যায় বিয়াল্লিশ – বর্তমান সময়

থানা রোড, ময়মনসিংহ

বাশারসহ সবাই থানার পেছনে পার্ক করা নীল মাইক্রোর ভেতরে বসে আছে চুপচাপ।

কিছুক্ষণ পরেই ঘটনা ঘটতে শুরু করল। থানার পেছনের ছোটো গেট দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা জিপ। সেটার ভেতরে বসে থাকা ওসি মল্লিককে চিনতে পেরে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল বাশার। মনে হচ্ছে ওর পরিকল্পনা কাজে লাগতে যাচ্ছে।

পরিকল্পনাটা ছিল খুব সহজ। মল্লিককে যদি সত্যিই কেউ নিয়োগ দিয়ে থাকে তবে সে কালী মূর্তিটা হাত করতে চাইবেই। বাশার এসপিকে জিম্মি করার নাটক করাতে সবাই যখন ব্যস্ত থাকবে এই সুযোগে ওসি মূর্তিটা তার নিয়োগ কর্তার কাছে চালান করতে চাইবে। এই ভরসাতেই বাশার পুরো পরিকল্পনাটা সাজিয়েছিল। বাইরে ওরা নজর রাখছিল আর অন্যদিকে থানার ভেতরে তৌফিক নজর রাখছিল ওসির ওপরে। সে বেরুতেই তৌফিক জানিয়ে দেয় মল্লিক মূর্তিটা নিয়ে জিপে উঠেছে। সেই জিপটার দিকেই তাকিয়ে আছে সবাই। জিপটা থানার গেট দিয়ে বেরিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিলো।

‘এখন কী করতে চাও, বাশার?’ এসপি আমজাদ জানতে চাইলেন।

‘স্যার, আমরা জিপটার পিছু নিয়ে দেখবো সে কোথায় যায়…আর,’ বাশার প্রশ্নটা শেষ করার আগেই এসপি জানতে চাইলেন, ‘তুমি যেটা প্রমাণ করতে চাইছিলে সেটা প্রমাণ করার মতো উপাদান তো পেয়েই গেছ। মল্লিক মূর্তিটা নিয়ে বাইরে এসেছে। ওর গাড়ি থামিয়ে ওকে অ্যারেস্ট করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়?’

‘স্যার, এই ঝুঁকিটা নিতেই হবে, কারণ এই ওসি ব্যাটার পেছনে অনেক বড়ো কারো হাত আছে। সেটা কে বের করতে হবে, সেই সঙ্গে পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে একটা ঐতিহাসিক রহস্য লুকিয়ে আছে সেটারও সমাধান হওয়া দরকার, বাশার একমনে সামনের জিপটাকে অনুসরণ করে চলেছে। ওটা থানা থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে কাচারি মোড়ের দিকে চলেছে এখন। যদি আমরা এখন ওসি মল্লিককে গ্রেপ্তার করি তাহলে সে কার সঙ্গে কাজ করছে সেটা বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। কাজেই ঝুঁকি নিয়ে হলেও এখন ওসিকে অনুসরণ করতে হবে। একমাত্র এভাবেই বের করা সম্ভব ওসি আসলে কার নির্দেশে কাজ করছে,’ কাচারি মোড় থেকে আবারো বাঁয়ে মোড় নিয়ে গাড়ি এখন ছুটে চলেছে কাঁচিঝুলি মোড়ের দিকে। রাতের বেলা ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গতি বেড়ে গেছে জিপের। বাশারও মাইক্রোর গতি বাড়িয়ে দিল।

‘কী জানি, আমার কাছে মনে হচ্ছে ঝুঁকিটা অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। ওসি এখন ওই জিপের ভেতরে আছে। তৌফিকের দেওয়া তথ্য ঠিক থাকলে তোমাদের উদ্ধার করা মূর্তিটাও ওর সঙ্গেই আছে। বাই এনি চান্স ওসিকে আমরা হারিয়ে ফেললে তো সব গেল,’ এসপিকে ঠিক সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে না।

‘স্যার, সেটা হবার প্রায় কোনো সম্ভাবনাই নেই,’ বলে ও আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ সামনে দেখতে পেল জিপের গতি কমে আসছে বেশ অনেকটাই দূরত্ব বজায় রেখে বাশারও মাইক্রোর গতি একেবারে কমিয়ে আনলো। জিপের গতি কমতে কমতে একেবারে থেমে গেল ওটা কাঁচিঝুলি মোড়ে।

‘করছে কী, হঠাৎ এভাবে থেমে গেল কেন?’ প্রশ্নটা করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব পেয়ে গেল ওরা। পেছন থেকে একটা সাদা মাইক্রো এগিয়ে গিয়ে থামলো ওটার পাশে।

‘সর্বনাশ! মূর্তিটা চালান করে দেবে না তো?’ পেছন থেকে জয়া বলে উঠল, তার গলায় ভীষণ আতঙ্ক। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না বরং পাশে একটু থেমেই সাদা মাইক্রোটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। ওটার পিছু পিছু চলতে শুরু করল ওসি মল্লিকের জিপ। দুটো গাড়িই আরেকটু এগিয়ে যেতে বাশার মাইক্রো ছেড়ে দিল। সামনের গাড়িগুলো কাঁচিঝুলি মোড় ছাড়িয়ে টাঙ্গাইল বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাসস্ট্যান্ড এলাকাতে এইরাতের বেলাও বেশ ভিড়। সামনের গাড়িদুটো ছাড়িয়ে যেতেই একটু জ্যামে পড়ে গেল ওদের গাড়ি। বেশ খানিকটা এগিয়ে স্টেডিয়ামের সামনে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে ফেলল বাশার।

‘কী ব্যাপার, কোনদিকে গেল? দেখতে পাচ্ছি না তো। সবাই আশপাশে দেখ তো,’ বাশার জানালা দিয়ে মাথা বের করে আশপাশে দেখার চেষ্টা করছে। ‘গেল কোথায়?’

‘বাশার সামনের দিকে এগিয়ে যাও, থেমে গেলে ওরা আরো এগিয়ে যাবে, হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে,’ এসপি আমজাদ বলে উঠলেন

‘হারিয়ে যাবে না, তবে…’ ও মাইক্রোটাকে স্টেডিয়ামের গেট থেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।

‘ওই যে পাশের গলিতে,’ পেছন থেকে জয়া চেঁচিয়ে উঠল। বাশার স্টেডিয়ামের গেট ছাড়িয়ে সামনের দিকে চলে গেছিল জয়ার কথা শুনে আবারো পিছিয়ে আনতে লাগল। স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে একটা সরু গলিতে পুলিশি জিপের ব্যকলাইট দেখা যাচ্ছে। বাশার গলির মুখের কাছে জিপ থামালো।

‘কী ব্যাপার, পিছু নিচ্ছ না?’ এসপি আমজাদ প্রশ্ন করলেন।

‘স্যার, এই সরু গলি দিয়ে পিছু নেওয়া যাবে না, ধরা পড়ে যাবো। তারচেয়ে অন্য উপায় আছে,’ বলে ও পকেট থেকে তৌফিকের দেওয়া অন্য জিনিসটা বের করল। মোবাইলের মতো দেখতে জিনিসটার গা থেকে হেডফোনটা খুলে গলায় ঝুলিয়ে অন করল ওরা। আগের দিনে হ্যান্ড ভিডিয়ো গেমগুলো দেখতে যেরকম ছিল জিনিসটা দেখতে অনেকটা সেরকম।

ওকে জিনিসটা বের করতে দেখেই এসপি আমজাদ বলে উঠলেন, ‘এই কারণেই তুমি এত নিশ্চিন্তে ছিলে যে জিপটা হারাবে না?’

‘জি, স্যর। ওসির গাড়ির সঙ্গে ট্র্যাকার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে যেখানে যাবে আমরা টের পাবো। ট্র্যাকার অন করতেই ছোটো একটা জ্বলজ্বলে বিন্দুকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল। ‘এবার এগোতে হবে। সবাই সাবধান, অন্ধকার গলিতে ঢুকতে যাচ্ছি কাজেই সামনে কোথায় কী আছে জানিনা। শক্ত হয়ে বসো,’ বলে বাশার গলির ভেতরের অন্ধকারে মাইক্রো চালাতে লাগল। ওর এক চোখ পথের দিকে অন্য চোখটা ট্রাকারের ছোট্ট জ্বলজ্বলে বিন্দুটার দিকে। জ্বলজ্বলে বিন্দুটা ওদের থেকে খুব বেশি সামনে না। বাশার মাইক্রোর গতি কমিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলল।

ট্র্যাকার থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকাল। এই এলাকাটা কিছুটা গ্রামের মতো। পরপর অনেকগুলো কাঠ কাটার স’মিল আছে। দু-তিনটে স’মিল পার হয়ে গেল ওদের মাইক্রো। ‘ব্যাপার কী? দুটো গাড়ির একটাও তো দেখতে পাচ্ছি না,’ আনমনেই বলে উঠল বাশার। ও মাইক্রো থামিয়েট্র্যাকারটা আবারো অন করার জন্যে হাতে নিতেই এসপি আমজাদ হাত তুলে সামনে দেখালেন। বেশ বড়ো একটা স’মিলের প্রাঙ্গণে ঘোলাটে হলদে আলোয় পুলিশের জিপটা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তবে সাদা মাইক্রোটাকে দেখা গেল না আশপাশে। বাশার একেবারে আস্তে-আস্তে চলতে থাকা মাইক্রোটাকে স’মিলের কাঠের দেওয়ালের পাশে থামিয়ে ফেলল।

‘এবার কি করবে?’ এসপি আমজাদ আশপাশে দেখার চেষ্টা করছেন। আধো অন্ধকারে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না কিছু।

বুঝতে পারছি না। গাড়ি এরকম নির্জন জায়গায় চলে আসবে ভাবতেও পারিনি এখানে তো কিছু করা…’ ও যা বলতে যাচ্ছিল সেটা শেষ করার আগেই তৌফিকের দেওয়া সস্তা মোবাইলটা বাজতে লাগল।

‘শিট,’ চমকে উঠে তাড়াতাড়ি মোবাইলটা বের করে কানে লাগাল বাশার। আবদুল্লাহ কল করেছে। ওখানকার অবস্থা শুনে নিয়ে ওরা কোথায় আছে সেটা জানাল। আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই অন্ধকারের ভেতরে ধপ করে জ্বলে ওঠা গাড়ির হেডলাইটের আলোয় চোখ অন্ধ হয়ে গেল সবার।

‘শিট,’ হাতের মোবাইলটা ফেলে মাইক্রোটাকে স্টার্ট দিতে যাবে বাশার তার আগেই পেছন থেকে সাদা মাইক্রোটা এসে সর্বশক্তিতে বাড়ি মারল ওদের নীল মাইক্রোর পেছনে। পেছন থেকে জোরে বাড়ি খেয়ে ওদের গাড়ি সামনের দিকে ছুটে গিয়ে একটা কাঠের খুঁটির সঙ্গে সরাসরি ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। হুইলের পেছনে বসে থাকা বাশারের দুই চোখের মাঝখানের অংশ হুইলের মাঝ বরাবর জোরে বাড়ি খেয়ে হুইলের ওপরেই ঢলে পড়ল ও।

***

জায়গাটা কি আবছা আলো, নাকি আবছা অন্ধকার? ঠিক বুঝতে পারছে না বাশার। চোখ খোলার আগেই জিভের ডগায় নোনতা একটা স্বাদ অনুভব করল ও, সেই সঙ্গে নাকের ভেতরে চুলকানি। পর পর দুবার হাঁচি দিয়ে চোখ খুলল ও। তবে খোলার পরে মনে হলো চোখ বন্ধ ছিল সেটাই ভালো ছিল।

‘আরে, নায়ক নাকি? গিয়ান ফিরলো তাইলে!’ তীব্র শ্লেষে ভরা কণ্ঠস্বরটা অপরিচিত নয় ওর। কয়েকবার চোখ পিট পিট করতেই পরিষ্কার দেখতে পেল মানুষটাকে। ছয় সাত মাসের গর্ভবতী মহিলাদের মতো পেটধারী ছোটোখাটো মানুষটার পরনে সাদা রঙের পাজামা আর হাফ হাতা শার্ট। ঠোঁট দুটো লাল হয়ে আছে পানের রসে।

‘সাঈদ আলী!’ অস্ফুটে বাশারের মুখ দিয়ে নামটা বেরিয়ে এলো।

‘সাঈদ কন্ট্রাকটারও কইতে পারো, আগে সাঈদ আলী নামে লুকে বেশি চিনলেও অহন সাঈদ কন্ট্রাকটার নামেই ডাহে বেহেই। তয় ভাতিজা, তুমি আমারে বহুত যন্ত্রণা দিছো,’ বলে সে পিচিত শব্দ তুলে পানের পিক ফেলে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ওদের সামনে বসে পড়ল।

বাশার তাকিয়ে দেখল চারপাশে, ও নিজে বসে আছে একটা বার্নিশ ছাড়া কাঠের চেয়ারে, ওর পাশেই বসে আছেন এসপি আমজাদ, তার অন্যপাশে জয়া আর রিফাত।

ওদের পাশেই দুপাশে দুজন বন্দুকধারী দাঁড়িয়ে আছে, ওদের সামনেই একইরকম চেয়ারে বসেছে সাঈদ আলী। ওদের পায়ের নিচে ভেজা কাঠের মেঝে, চারপাশে কাঠের সোঁদা গন্ধ। ও অনুমান করল এটা সেই স’মিলেরই কোনো কামরা হবে। আশপাশে কোনো দিক দিয়ে খাল বা নালা বয়ে চলেছে। কারণ পানির কুল- কুল শব্দ ভেসে আসছে। ওদের থেকে বেশ খানিকটা দূরত্বে একটা টেবিলের ওপরে ওদের সবার মোবাইল, মানিব্যাগ আর অস্ত্রগুলো দেখতে পেল বাশার। টেবিলটার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে খোঁচা-খোঁচা দাঁড়ি সেই লোকটা-যে ভুয়া রিফাত সেজেছিল। বাশারের ঘাড় ঘোরানো দেখে সে মুচকি একটা হাসি দিল। বাশার ওর দিকে শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

তবে ও যা খুঁজছে সেটা পেল না। মূর্তিটা নেই আশপাশে কোথাও। বুঝল ওটা খুঁজে লাভ নেই। নেই ওটা এখানে। ও নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনলো সাঈদ আলীর দিকে। সাঈদ আলী আর এসপির মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছে। ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে জয়া।

‘আপনি জানেন, আমি একজন সাংবাদিক? আমি আপনার কন্ট্রাক্টারির বারোটা বাজিয়ে দিতে পারি।’ জয়া পারলে চোখের দৃষ্টি দিয়ে সাঈদ আলীকে পুড়িয়ে দেয়। তবে জয়ার দৃষ্টি কিংবা গলার আওয়াজ কোনোটাই সাঈদ আলীর ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। সে জয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর পানের পিক ফেলার মতো করেই পিচিক করে হেসে উঠল। ‘সাম্বাদিক! না? এই মাইয়া তুমি কি আমারে ওই বলদ ইন্সপেক্টর পাইছ? সাম্বাদিক মারাইতে আইছে হেয়,’ বলে সে হাত তুলে এসপি আমজাদের দিকে দেখাল। ‘আস্তা একটা এসপি বইসা আছে হেরে বাদ দিয়া তুমার মতোন পাতি সাম্বাদিক লইয়া আমারে চিন্তা করতে কও? হাসাইলা মাইয়া।’

‘সাঈদ, তোমার সমস্যা কী? তুমি জানো না তোমারে যে শেল্টার দেয় রফিক ভুঁইয়া তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন?’ এসপি আমজাদ বলে উঠলেন পাশ থেকে। ‘তোমার বারোটা আমি কীভাবে বাজাবো তোমার কোনো ধারণা আছে।

সাঈদ কমিশনার জয়ার দিক থেকে শরীরটা ঘুরিয়ে এসপির দিকে তাকাল। ‘আপনেরে যখন প্রথম মাইক্রোর ভেতরে থাইক্কা বাইর হইতে দেখলাম, আমি আসলেই চিন্তায় পইরা গেছিলাম। কারণ আমার হিসাব আছিল একটা ডিমোশন পাওয়া ইন্সপেক্টর আর দুইডা মাইয়া সামলান তেমন কঠিন কিছু না; কিন্তু পুরা একটা এসপি তাই বইল্লা। তারপরে মনে পড়ল আরে এসপিরে আমার সামলাইতে হবে ক্যান। দুষতো সব যাইবো এই বলদ ইন্সপেক্টরের ঘাড়ে। কারণ এসপিরে তো হেয়ই সবার সামনে থাইক্কা জিম্মি কইরা বাইর কইরা আনছে,’ বলে সে হেসে উঠল ভুঁড়ি দুলিয়ে। ‘কাজেই আপনেরে আমি যাই করি না ক্যান দুষ অইবো ইন্সপেক্টরের।’

‘তারমানে শুরু থেকে এসব কিছুর পেছনে আপনিই ছিলেন?’ বাশার প্রশ্ন করল।

‘একরকম কইতে পারো, তুমি আমার এত সাধের জায়গাটার কাম বন্ধ করনের পর কুটি টেকার প্রজেক্ট তো বন্ধ হইয়া গেল। আমি যখন কপাল চাপড়াইতাছি আর রাগে ফুলতাছি এমুন সময় চাল্লি নামের এক বিদেশি আইসা আমার সঙ্গে যুগাযুগ করে। হেয় আমারে একটা ঘটনা কয়, লগে জানায় এই হানে নাকি বিরাট লাভের ব্যাপার আছে। আমিও আগ্রহ পাই। নুরুরে আমিই নিয়োগ দিছি,’ বলে সে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালাকে দেখাল। ‘এরপরে পুরা ঘটনার সময়ে নুরু আর চাল্লি মিইল্লাই যা ঘটানির ঘটাইছে।’

‘তারমানে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব এই নুরু আর চাল্লির কাণ্ড?’ বাশার জানতে চাইল। ‘এই চাল্লিটা কে?’

‘দেখবা, এট্টু পরেই দেখবা। তুমার শার্টের মধ্যে এই হাবিজাবি লাগানি এইসব ওরই বুদ্ধি। তাও মূর্তিটা শেষ পর্যন্ত পাইছে। ভাতিজা তুমি, এসপি, এই সাম্বাদিক তুমগো কেউরেই আমার দরকার নাই দরকার শুধু তুমারে,’ বলে সে রিফাতের দিকে আঙুল তুললো। ‘ক্যান দরকার এট্টু পরেই বুঝবা। তয় ভাতিজা তুমারে একটা কথা কউনের আছে। তুমি এসপিরে জিম্মি করুনের সময় ভাবছিলা খুব একটা বিরাট বুদ্ধি পাকাইয়া উঠছো। আসলে তুমি একটা গাধা,’ বলে সে নুরুর দিকে একটা হাত বাড়াল। খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা নুরু পাশের টেবিলের ওপর থেকে ট্র্যাকিং ডিভাইসটা তুলে তার হাতে দিল।

‘এইটা লাগাইছিলা না?’ বলে সে ছোটো ছোটো দুটো চ্যাপ্টা ব্যাটারির মতো দেখতে জিনিস বের করে দেখাল। বাশার বুঝতে পারল ওরা ডিভাইসগুলো আগেই খুঁজে পেয়েছিল।

‘তুমি ওসির গাড়িত এইগুলা লাগায়া, এসপিরে জিম্মি কইরা ভাবছিলা আমগো লাইগা ফাঁদ পাতছ, বিয়ষটা আসলে উলটা। তুমারো এইগুলা ভজায়া আমিই আসলে এইখানে আনতে চাইতেছিলাম। কারণ তুমাগোরে আমার দরকার ছিল।’

‘মানে কী? কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?’ বাশার প্রশ্ন করল। ওর চোখ সরু হয়ে গেছে।

তবে সাঈদ কন্ট্রাকটারকে উত্তর দিতে হলো না তার আগেই রুমের কাঠের দরজা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল দুজন মানুষ। একজন ওসি মল্লিক, তার পাশের মানুষটাও চেনা। বাশারের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলে উঠল, ‘হ্যালো, বস,’ বলে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সিল্কি চুলে হাত বুলালো সে।

‘তৌফিক, তুমি?’ বাশারকে কেউ যদি বলত ও নিজে বেইমান তাও ও এতটা অবাক হতো না। ‘তুমি শেষ পর্যন্ত!’ ও কথা খুঁজে পাচ্ছে না।

‘কি করব বস? এরা এত টাকা দিল,’ বলে সে আরেকবার চুলে হাত বুলালো। আর তুমি তো জানো আমি টাকার পাগল।’

বাশার আফসোসের সঙ্গে মাথা নেড়ে এসপির দিকে তাকাল। তবে এসপি ওর দিকে তাকিয়ে নেই। বাশার তাকানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি চেয়ারে বসা অবস্থাতেই ওসি মল্লিকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

***

‘এই হানেই তো হওয়ার কথা,’ আবদুল্লাহ স’মিলগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রমিজ দারোগার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। ‘বাশার স্যারে তো মোবাইলে এই হানকার কথাই কইলো।’

‘আর হাঁটতে পারতাম না,’ রমিজ দারোগা একটা কাঠের খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগল। আবদুল্লাহ সবসময় রমিজ দারোগাকে ইউনিফর্মে দেখে অভ্যস্ত, তাই গ্যাবাডিনের প্যান্ট আর টিশার্ট পরা মোটা মানুষটাকে দেখতে ওর কাছে কার্টুনের মতো লাগছে। ওরা বাশারের নির্দেশ মতো জিপটাকে ডাম্প করে বাশারকে কল দিয়ে ওরা কোথায় আছে জানতে পারে। ওখান থেকে একটা টমটম নিয়ে স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে খানিকটা ঢুকে ওটা ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। ‘কল দে, বাশাররে কল দে। আর হাঁটতে পারতাম না। উফ্।’

‘মোবাইল তো বন্দ দেহায়,’ মোবাইলে কল দিতে দিতে আবদুল্লাহ আবারো হাঁটতে শুরু করল। ‘ওই খাড়া,’ বলে রমিজ দারোগা এগোল তার দিকে। ‘কী যে করে,’ বলে সে থেমে গেল।

‘এইরহম থামলে তো হারা রাইতেও…’ রমিজ দারোগা থেমে যাওয়াতে আবদুল্লাহ রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই দেখল রমিজ দারোগা কাঠের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেখছে। ‘কী দেখো?’

চুপ চুপ, ভেতরে দেখো, আবদুল্লাহ উঁকি দিয়ে দেখল কাঠের বেড়ার ফাঁক দিয়ে নীল রঙের একটা মাইক্রো দেখা যাচ্ছে। সেটার পাশেই কাটা শটগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক।

‘ব্যাপার কী, এইহানে এই মাইক্রো। ভেতরে আবার বন্দুক লইয়া একজন খাড়ায় আছে,’ ফিস ফিস করে বলল রমিজ দারোগা। জবাবে আবদুল্লাহ বলল, ‘বাশার স্যারেরা মনে হয় কুনো ঝামেলায় পড়ছে। তুমার পিস্তলটা বাইর করো।’

রমিজা দারোগা পিস্তল হাতে নিলো। ‘কিন্তু এইডা দিয়া গুলি করন যাইবো না। শব্দ অইলে সব শেষ। খাড়া বুদ্ধি আছে। তুই এই দেওয়াল টপ কাইতে পারবি?’

জবাবে আবদুল্লাহ জানাল-পারবে।

***

‘হেই হেই হেই, আস্তে,’ বলে নুরু নামের লোকটা তার কাটা শটগানের নলটা চেপে ধরল এসপি আমজাদের মাথায়। ‘তুমি এসপি হও আর যেই হও এইটা দিয়া গুলি করলে শরীর থাকবো শরীরের জায়গায় আর মাথা আশপাশের সবার শরীরে ছিটকা পড়বো।’

প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যেতেই এসপিকে ছেড়ে দিল মল্লিককে। এসপিকে ঠেলা দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হলো চেয়ারে। বাশার জানতে চাইল সে ঠিক আছে কিনা? এসপি কোনো জবাব দিল না।

‘আরেকবার যেই উলটাপালটা কিছু করুক সুজা মাথা উড়ায়া দিবি, নুরুর দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিল সাঈদ আলী। ‘এসপি, বেশি গরম দেহাইয়ো না ঠান্ডা কইরা দিবো।’

‘আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না,’ বাশার বলে উঠল। ও একটু সময় ক্ষেপণ করতে চাচ্ছে। ‘আমাদেরকে আপনার দরকার তাহলে তো রিফাতের বাসা থেকেই সরাসরি ধরে আনতে পারতেন। মল্লিক, থানা এতসব নাটকের কী দরকার ছিল?’

‘আর কইয়ো না। এইটা এই নুরু আর চাল্লির বলদামির কারণে অইছে। তুমগোরো লাগবো এইডা চাল্লি কইছে অনেক পরে। হেয়…।’

‘হেই, কী হচ্ছে এখানে?’ কাঠের বেড়া দেওয়া দরজার কাছ থেকে ইংরেজি আর ভাঙা বাংলা মেশানো গলায় বলে উঠল কেউ একজন। সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল সেদিকে। দরজায় দাড়ানো আর্মি ট্রাউজার আর কালো টি-শার্ট পরা মাথা ন্যাড়া সাদা চামড়ার মানুয়টাকে দেখে জয়া আর রিফাত দুজনেই হাঁ হয়ে গেল।

‘ডেভিড?’ অস্ফুট স্বরে বলে উঠল রিফাত। বলেই সে জয়ার দিকে তাকাল, তাকেও বিহ্বল দেখাচ্ছে। বাশারও এই লোকটাকেই সে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে গাড়িতে দেখেছিল।

‘অহ, নো নো ডিয়ার। আমি ডেভিড না, আমি চার্লি,’ বলে সে কারো উদ্দেশ্যে ইশারা করতেই একজন লোক এসে ওদের সামনে ছোট্ট একটা টেবিল রেখে গেল। ‘মূর্তিটা নিয়ে এসো,’ লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে সে সবার দিকে ফিরে বলতে লাগল। ‘আমি আর ডেভিড আসলে পিঠাপিঠি ভাই। ডেভিড আমার থেকে মাত্র এক বছরের বড়ো ছিল। আমরা দেখতে অনেকটাই একরকম। চেহারা হয়তো হুবুহু মিলে না, তবে প্রায় কাছাকাছি। আর শারীরিক গঠন, উচ্চতা প্রায় একই হওয়াতে লোকে প্রায়ই আমাদেরকে একই মানুষ হিসেবে ভুল করত। আমি অ্যান্টিকের ব্যবসা করতাম আর ডেভিড ইউনিভার্সিটিতে পড়াত। ডেভিড নিজে এসব বিষয়ে এক্সপার্ট ছিল,’ বলে সে কাঁধ ঝাঁকালো একবার। ‘আমার ছিল ব্যাবসায়িক অভিজ্ঞতা আর ওর ছিল ডিগ্রি। তাই আমরা দুজনে মিলে একটা চক্র চালাতাম,’ ওই লোকটা এসে টেবিলের ওপরে সেই কালো প্যাকেটটা রেখে গেল।

‘আমাদের কাজ ভালোই চলছিল যতদিন না ডেভিড এই ফাকিং মূর্তিটার পেছনে এসে লাগল। বাট দিস ইজ ইন্টারেস্টিং। ইউ মাস্ট সি দিস,’ বলে প্যাকেট খুলে দুই ফিটের কিছু বেশি লম্বা মূর্তিটা আলগা করে ফেলল। কালো পাথর যেন চমকাতে লাগল সবার চোখের সামনে।

‘হোয়াট আ বিউটি, ঠিক? কিন্তু শুধু বিউটি নয় এর ভেতরে মারাত্মক রহস্য আছে,’ বলে সে মূর্তিটার গায়ে হাত বুলাতে লাগল। ‘সবাই জানে ভারত উপমহাদেশের ঠগী কাল্টের অন্যতম প্রতীক ছিল কালী মূর্তি—যেটা টুইন কালী নামে পরিচিত। এই দুটো মূর্তি নাকি একসঙ্গে থাকলে অদ্ভুত শক্তি তৈরি হয়। অন্তত ঠগীরা তাই বিশ্বাস করত। তাই ইংরেজ অফিসারেরা এদেরকে আবিষ্কার করার পর একটা থেকে আরেকটাকে সরিয়ে ফেলে। তখন থেকেই এই একটা মূর্তিই ছিল ইংল্যান্ডের এক মিউজিয়ামে, কিন্তু অপর মূর্তিটাকে আর কেউই দেখতে পায়নি। কিন্তু এখানে ইংরেজ অফিসারেরা একটা ট্রিক করে। এই মূর্তিটাকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিলেও এই মূর্তিটাতেই ওরা ক্লু দিয়ে রাখে কীভাবে অন্য মূর্তিটা খুঁজে পাওয়া যাবে,’ বলে সে মূর্তিটাকে টেবিলের ওপরে শুয়িয়ে দিয়ে পেছনের একটা বিশেষ অংশে চাপ দিল।

সঙ্গে সঙ্গে মূর্তির নিচে একটা ছোট্ট প্যানেল খুলে গেল। ওটার ভেতর থেকে চার্লি ছোট্ট একটা কাগজের মতো মোড়ানো জিনিস বের করে আনলো। জিনিসটাকে চোখের সামনে তুলে ধরে সে বিজয়ীর মতো ঘোষণা করে উঠল, ‘এটা মূর্তির বেদিতে বসানো একটা আলগা প্যানেল। এটা মূল মূর্তির অংশ না। আমার ধারণা মূল মূর্তির সঙ্গে এই প্যানেলটা ইংরেজ অফিসারেরা যোগ করেছিল অন্য মূর্তির নির্দেশনাটা রাখার জন্যে। এটা সেই নির্দেশনা, যেটা অনুসরণ করলে দ্বিতীয় মূর্তিটাকে খুঁজে বের করা যাবে। এটার জন্যেই ডেভিড ইংল্যান্ড থেকে মূর্তিটাকে এই দেশে আনানোর ব্যবস্থা করেছিল, এটার পেছনেই লেগেছিল বিজয় আচার্য থেকে শুরু ইতিহাসের বহু লোকজন, কিন্তু কেউই বের করতে পারেনি। ইতিহাসের সেই রহস্য এখন আমার হাতে তবে এটার সমাধান বের করতে হলে আমার আর্কিওলজিস্ট রিফাতের হেল্প লাগবে,’ বলে সে রিফাতের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে নুরু তার কাটা শটগানটা রিফাতের দিকে তাক করল।

***

শটগানের কাটা নল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীকে খুব গাড়লের মতো কুপোকাত করল ওরা। অবশ্য রমিজ দারোগার আইডিয়া গাড়লের মতো হবে সেটাই স্বাভাবিক। সে আবদুল্লাহকে নির্দেশনা দিয়ে গেটের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল কাঠের নড়বড়ে দেওয়ালের ওপরে চড়ে বসেছে আবদুল্লাহ। সঙ্গে সঙ্গে সে অনুচ্চ শিস দিল। প্রহরী তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো দুই পা। কিছু জিজ্ঞেস করার জন্যে মুখ খুলবে তার আগেই আবদুল্লাহ নড়বড়ে দেওয়ালের ওপর থেকে তার ওপরে লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিল কিন্তু সেটা হলো না। দেওয়াল তার ভার নিতে না পেরে কাঠের বেড়াসহ লোকটার ওপরে পড়ে গেল। একটা আস্ত মানুষসহ কাঠের বেড়া এসে আঘাত করাতে তার অস্ত্র ছিটকে গেল। সেই সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মানুষটা।

‘তুই ঠিক আছোস?’

কিছু না বলে হাঁটু ডলতে ডলতে উঠে বসল আবদুল্লাহ। লোকটাকে মাইক্রোর নিচে ঢুকিয়ে তার অস্ত্রটা হাতে নিয়ে রওনা দিল ভেতরের দিকে। ভেতরে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বিশাল স’মিল। আট ফিট দশ ফিট উঁচু সারি সারি কাঠের গুঁড়ি পাহাড়ের মতো উঁচু করে রাখা। ওগুলোর ফাঁক ফোকর দিয়ে একটা ভবন পার হয়ে এলো ওরা। দূরে ঘোলাটে আলো দেখে সেদিকে এগোল। দূর থেকে জায়গাটা দেখে অফিস ঘরের মতো মনে হচ্ছে। ঘরটার নিচ দিয়ে নালার মতো বয়ে চলেছে পানি।

অনেকগুলো কাঠের গুঁড়ি দিয়ে উঁচু করে পাটাতনের ওপরে বানানো হয়েছে ঘরটা। সামনে পেছনে পাশে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে রাখা হয়েছে ওঠা-নামার জন্যে। ঘরটার ভেতর থেকে উত্তপ্ত কথোপকথন ভেসে আসছে। আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা নিঃশব্দে একটা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে কাঠের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল ভেতরের দিকে।

এসপি আমজাদকে দেখল ওসি মল্লিকের ওপরে চড়ে বসেছেন। তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছে খোঁচা-খোঁচা দাড়িওলা এক লোক। তাকে টেনে সরিয়ে দেওয়া হলো ওসির ওপর থেকে। ঠেলে বসিয়ে দেওয়া হলো চেয়ারে।

‘সর্বনাশ,’ আবদুল্লাহ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তাকে চুপ করিয়ে দিল রমিজ দারোগা। তাকে টেনে নামিয়ে নিয়ে এলো নিচে। ‘হেরা তো দেহি মহা বিপদে আছে।’

‘হেইডা তো বুঝবার পারছি কিন্তু করন কী? থানাত খবর দিবাম?’ রমিজ দারোগা বলে উঠল।

‘ধুর মিয়া, থানায় যে খবর দিবেন কে শত্রু আমরা জানি?’

‘হেইডাও তো ঠিক, তাইলে করন কী?’ বলে সে পেছনে তাকাল আবদুল্লাহও একই দিকে তাকিয়ে আছে। একই ভাবনা খেলে চলেছে দুজনার মাথায়।

***

‘এটা বুঝতে হলে ইউ মাস্ট বি লোকাল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,’ বলে সে রিফাতের দিকে তাকাল। ‘ইফ ইউ ইনসিস্ট।’

‘ও কেন আপনাকে সাহায্য করবে?’ পাশ থেকে জয়া ছ্যাঁত করে বলে উঠল। ‘আপনারা এমনিতেও আমাদেরকে মেরে ফেলবেন ওমনিতেও।’

‘ধইন্যবাদ, এইডা অবশ্য আমার মাথায় ছিল না,’ সাঈদ আলী বলে উঠল । ‘সাহাইয্য করব কারণ সেইটা করলে পরে মরবো। আর না করলে অহনই মরবো,’ বলে সে নুরুর দিকে তাকাল। নুরু কিছু না বলে স্রেফ কাটা শটগান হাতে দুপা এগিয়ে এলো ওর দিকে। রিফাত উঠে দাঁড়াল।

‘আমি দেখবো। কারণ আমার নিজেরও কৌতূহল আছে এই ব্যাপারে,’ বলে সে হলদে হয়ে আসা কাগজের রোলটা তুলে নিয়ে বিছিয়ে দিল টেবিলের ওপরে। মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। ছোটো একটা ম্যাপের মতো আঁকা। ছোটো তবে বেশ বিস্তারিত, এমনকি দিক আর কোণগুলোও দেখানো আছে পরিষ্কার। তবে মূল জিনিস দুটো সমান্তরাল রেখা একটা ওপরে আরেকটা মাঝখানে দুটো ছোটো বিন্দুর মাঝখানে একটা আকৃতি। আবার সেই আকৃতিকে কেন্দ্র ধরে বেশ দূরত্বে দুটো আকৃতি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই দুটো আকৃতির একটাকে পরিষ্কার চিনতে পারল ও। কারণ এই জায়গাটা নিয়েই সে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। একটাকে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে অন্যটাও পরিষ্কার ধরতে পারল। কারণ দুটো জায়গাই পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর এই দুটো আকৃতিকে দুটো প্রান্ত ধরলে মাঝখানের সমান্তরাল রেখাটাকে বোঝা খুব একটা কঠিন ব্যাপার হবে না যদি কেউ স্থানীয় উপকথাটা জানে।

‘শিট…এত এত,’ বলে ও টেবিলের ওপরে রাখা চার্লির ম্যাপের এক জায়গায় আঙুল রাখল। চার্লিও ওর দিকে ঝুঁকে এসেছে। রিফাত বর্ণনা করার সঙ্গে সঙ্গে সে- ও চিনতে পারল জায়গাটা। চিনতে পেরেই অস্ফুটে কথা বলে উঠল। ‘মাই হলি গড…দিস ইজ ক্রেজি। হোয়াট হিস্ট্রি সেজ ইজ ট্রু…’

চার্লি কথা শেষ করার আগেই পাশ থেকে সাঈদ কমিশনার ধমকে উঠল ‘এই, তুমরা দুইজনে কী গুজুর গুজুর শুরু করলা, কতা পরিষ্কার কইরা কও।’

চার্লি কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলল কিন্তু রিফাত চিৎকার করে থামতে বলল, ‘চার্লি, চুপ।’

‘কিন্তু কেন…’ কে জানি বলে উঠল। ‘চুপ চুপ…’ আবারো রিফাত বলে উঠল। এবার সবাই শুনতে পাচ্ছে। ভূমিকম্পের মতো একটা শব্দ হচ্ছে। শব্দটা ক্রমেই বাড়ছে।

‘সর্বনাশ! এত ভূমিকম্প হচ্ছে মনে…’ বাশার কথা শেষ করার আগেই ওদের পায়ের নিচের কাঠের ফ্লোর নড়ে উঠল। কেউ ওদের কাঠের কামরাটাকে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করেছে। হঠাৎই একদিকে কাত হতে শুরু করল কামরাটা।

***

আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা দুজনেই যেদিকে তাকিয়েছে সেদিকে জিনিসই আছে দেখার মতো। সারি সারি শ্যাওলা পড়া কাঠের গুঁড়ি। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে রমিজ দারোগা এগিয়ে যেতে শুরু করল। আবদুল্লাহ আসলে বুঝতে পারছে না মানুষটা কী করতে যাচ্ছে। রমিজ দারোগা যখন গুঁড়িগুলো আটকে রাখা কাঠের তক্তাগুলি ধরে টানাটানি শুরু করল ভয়ে আঁতকে উঠল আবদুল্লাহ। এই লোক নিজে তো মরবেই পারলে ওকেও মারবে! ‘এই মিয়া আপনে কী করেন! মারবাইন তো।’ বলে সে টেনে থামালো রমিজ দারোগাকে।

‘ক্যান, সমস্য কী? ওইহানে যে পরিমাণ লোক আছে তাগো লগে লাইগা আমরা কিছু করতে পারুম না। তার চেয়ে এডি খুইলা দিল একটা গণ্ডগোল লাগবো তাইলে যদি কিছু করুন যায়,’ রমিজ দারোগার কথা শুনে আবদুল্লাহও একটু দ্বিধান্বিত হয়ে গেল। ভুল বলেনি তো লোকটা। ‘ঠিক আছে, কিন্তুক এমনে এইগুলা সরাইতেও পারবেন না। আর পারলেও এইগুলা তো আইসা পড়বো আপনের আর আমার উপরে। তারচেয়ে অন্যকিছু করতে অইবো,’ বলে সে আশপাশে দেখতে লাগল। ওপরে কাঠের রুমের ভেতরে চিৎকার চেঁচামেচি আরো বেড়েছে।

‘জলদি কিছু করতে অইবো,’ বলে আবদুল্লাহ আশপাশে খুঁজছে রমিজ দারোগা ওর হাত থেকে কাটা শটগানটা ছিনিয়ে নিলো। ‘এইটা দিয়াই কাম অইবো,’ বলে সে জিনিসটা তাক করল কাঠের গুঁড়িগুলোর দিকে। আবদুল্লাহ তার হাত ধরে ফেলল। ‘এই মিয়া। আপনে পাগল নাকি? এমনে গুলি কইরেন না,’ বলে ও নিচের দিকে এদিক সেদিক দেখে একটা পুরনো ছালা তুলে তার দিকে বাড়িয়ে বলল। ‘ওইটার মাথায় এইটা প্যাঁচায়া লন। শব্দ কম অইবো। আর আমাগোর আরো সইরা গুলি করা উচিত।’

রমিজ দারোগা তার কথামতোই আরো বেশ খানিকটা সরে এলো। পাহাড় সমান উঁচু কাঠের গুঁড়ি। সেগুলোকে আটকে রাখা হয়েছে বেশ কিছু মোটা মোটা কাঠের তক্তা দিয়ে। এরকমই একটা তক্তার দিকে তাক করে গুলি করে দিল রমিজ দারোগা। আবদুল্লাহ ভেবেছিল এই লোকের একটা গুলিও জায়গামতো লাগবে না। কিন্তু প্রথম গুলিটাই জায়গামতো লেগে যাওয়াতে খুবই অবাক হয়ে ও দেখল একটা তক্তা মাঝ বরাবর ভেঙে গেছে।

‘সাবাশ, আবার,’ না বললেও চলত। রমিজ দারোগা আবারো গুলি করল। আবার তৃতীয় গুলিতে দ্বিতীয় তক্তাটা ভেঙে পড়ল। আরো আগ্রহী হয়ে সে আবারো কাটা শটগান তুলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই অবাক হয়ে দেখল : স্তূপাকৃতির কাঠের গুঁড়িগুলো নড়তে শুরু করেছে, আর বাজ পড়ার মতো শব্দ করছে।

ঠেকনা দিয়ে রাখা তক্তাগুলো ভেঙে পড়াতে গুঁড়িগুলো যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। আপনা-আপনি নড়তে শুরু করেছে। দেখতে দেখতেই বাকিদুটো তক্তা আপনা-আপনি ভেঙে পড়ল। বিকট শব্দ আর পায়ের নিচের মাটি মৃদু কাঁপতে শুরু করতেই আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা পিছিয়ে পড়তে শুরু করল। চারটে তক্তাই ভেঙে গুঁড়িগুলো স্রোতের মতো গিয়ে আছড়ে পড়ল ছোট্ট অফিস ঘরের মতো দেখতে পলকা বাড়িটার খুঁটিগুলোর ওপরে। ককশিটের কোনো আকৃতির ওপরে লোহার রড দিয়ে বাড়ি মারলে ককশিটের অবস্থা যেরকম হবে, পলকা বাড়িটার খুঁটিগুলো ঠিক সেভাবেই ভেঙে পুরো বাড়িটাই একদিকে কাত হয়ে পড়ল।

***

পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে শুরু করতেই বাশার প্রথমে ভেবেছিল ভূমিকম্প শুরু হয়েছে কিন্তু একটু পরেই বুঝে গেল আসলে অন্যকিছু হচ্ছে। রুমটা প্রথম দফা কেঁপে উঠতেই রুমের প্রায় সবাই পড়ে গেল।

ভূমিকম্পের কথা মাথায় আসতে বাশার প্রথমেই স্বাভাবিক রিফ্লেক্সের বশে যে চেয়ারটাতে বসে ছিল সেটাই ধরে ফেলেছিল, কিন্তু কাজ হয়নি। চেয়ারসহই উলটে পড়েছে ও, চেয়ারটা পড়েছে ওর গায়ের ওপরে। এটা-ওটা ছিটকে চলেছে পুরো রুম জুড়ে। এমনকি রুমটার কাঠের কাঠামোও ভেঙে ছিটকে পড়েছে।

পুরো রুম জুড়ে নরক গুলজার। বাশার চেয়ার নিয়ে উলটে গিয়ে পড়ল নুরুর এক পাহারাদারের ওপরে, পড়তে পড়তে লোকটা ওকে ধরে ফেলল। হাতের শটগান ঠেকালো ওর থুতনির নিচে। আরেকবার পুরো রুমটা কাত হয়ে গেলো অন্যদিকে। যেদিক থেকে কাত হয়েছে সেদিকের সব জিনিসপত্র ছিটকে চলে এলো ওদের দিকে। কাটাশটগানের নলসহ হাতটা ধরে ফেলেছিল ও, কিন্তু যেই বুঝল লোকটার সঙ্গে শক্তিতে পেরে উঠছে না আনমনেই চোখ বন্ধ হয়ে গেছিল ওর। কিন্তু আচমকাই লোকটার শরীর কাদার মতো নরম হয়ে গেল। ও চোখ খুলে দেখল একটা চোখা কাঠের টুকরো লোকটার গলার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। লোকটার হাতের শটগানটা নিয়ে ঘুরে ওঠার চেষ্টা করল ও কিন্তু শরীরটাকে পুরোপুরি ঘোরানোর আগেই কে যেন ওর ওপরে ছিটকে এসে পড়ল। দুজনেই গাড়িয়ে সরে গেল।

মানুষটা রিফাত। ওকে এক হাতে ধরে অন্যহাতের শটগানটা কোমরে গুঁজে সোজা হবার চেষ্টা করল ও। পুরো রুমটা এমনভাবে একদিকে কাত হয়ে হেলে পড়েছে, দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় আবারো হেলে পড়বে। বাশার রিফাতকে এক কোনায় সরিয়ে দিয়ে প্রথমেই দেখে নিলো রুমের ভেতরে কোথায় আছে। জয়াকে দেখল একপাশে বসে আছে, তার ঠিক পাশেই এসপি আমজাদ পড়ে আছেন চোখ বন্ধ করে। খোঁচাখোঁচা দাড়ির এক পাহারাদার শেষ। অন্য আরেকটাকে ও দেখতে পেল মাটিতে পড়ে থাকা কালী মূর্তিটার দিকে হাত বাড়িয়েছে।

দয়া-মায়ার সময় নেই। লোকটার দিকে শটগান তুললো বাশার। তবে গুলি করার আগেই কে যেন পা ধরে টান মারলো ওর। মাটিতে পড়তে পড়তে মূর্তির দিকে হাত বাড়ানো লোকটার বেল্ট ধরে ফেলল ও লোকটাকে সহই মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল কে টান দিয়েছে ওর পা ধরে। সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি-সাঈদ আলী যার নাম বলেছিল নুরু। এক লাথি দিয়ে পা ছাড়িয়ে নিলো বাশার।

দুজনেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আগুন ঝাড়তে লাগল। লোকটার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। বাশার লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করল এই ব্যাটা পরোপুরি একটা সাইকো। এর সঙ্গে মারামারি করতে যাবার কোনোই কারণ নেই। শটগান তুলে সোজা গুলি করল। কিন্তু লোকটার ভাগ্য ভালো নাকি বাশারের ভাগ্য খারাপ কে জানে। পায়ের নিচের মাটি আবারো নড়তে শুরু করেছে। গুলি করার আগেই বাশারের শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল। আর ওর শটগানের নল উঠে গেল ওপরের দিকে। কালী মূর্তিটা গড়িয়ে চলে গেল রিফাত যেদিকে আছে সেদিকে। রিফাত মূর্তিটা ধরে ফেলল কিন্তু বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারল না। চার্লি নামের সেই টেকো এতক্ষণ পড়ে ছিল মাটিতে। সে উঠে দাঁড়িয়েই দেখতে পেল মূর্তিটা রিফাতের ওপরে। সোজা হামলে পড়ল তার ওপরে। এক টানে মূর্তিটা ছিনিয়ে নিলো সে। এমন সময় ওলটানো রুমের দরজার কাছ থেকে জোরে চেঁচিয়ে উঠল কেউ।

‘খবরদার, সবাই, দুইহাত তুলে উঠে দাঁড়াও,’ বাশার আবারো মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেছিল ও উলটো হয়েই দেখতে পেল দরজার কাছে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে রমিজ দারোগা আর আবদুল্লাহ। কিন্তু ওদের দুজনার কেউই খেয়াল করেনি উলটো হয়ে ঝুলে থাকা দরজার ঠিক পেছনেই কেউ একজন নড়ে উঠল।

‘আবদুল্লাহ, সাবধান!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল বাশার কিন্তু তার আগেই যা ঘটার ঘটে গেছে। রুমটা ওলটানোর সময়ে গড়িয়ে দরজার আড়ালে চলে গেছিল সাঈদ আলী। পুরো রুমে যখন তাণ্ডব চলছে সে তখন তক্কে তক্কে ছিল কখন পরিস্থিতি বুঝে পালাবে। কিন্তু পালাতে পারেনি। অবশেষে যখন বেরুতে যাবে ঠিক তখুনি কাত হয়ে থাকা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা। ওরা ভেতরে ঢুকে যেই সারেন্ডার করতে বলে সঙ্গে সঙ্গে দরজার আড়াল থেকে প্রথমে দরজাটা ওদের দিকে ঠেলে দেয় সে। দরজার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে ওরা যেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে,সঙ্গে সঙ্গে দরজার পেছন থেকেই গুলি করে সে। দরজার সঙ্গে প্রায় গা ঘেঁষে ছিল আবদুল্লাহ কিন্তু তাকে গুলির হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে ঠেলে দিতে গিয়ে রমিজ দারোগা চলে আসে পাল্লার সামনে। সেকেন্ডের ভেতরে আবদুল্লাহ ছিটকে পড়ে একপাশে, রমিজ দারোগা গুলি খেয়ে পড়ে যায়। বাশার উঠে বসেও দিকে এগোতে যাবে তার আগেই ওর দিকে কাটা শটগান তাক করে সাঈদ কমিশনার। একগাল হেসে গুলি করতে যাবে তার আগে নিজেই গুলি খেয়ে পড়ে যায় সে। বাশার তাকিয়ে দেখে এসপি আমজাদ একটা পিস্তল হাতে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তার পাশেই দাড়িয়ে আছে জয়া।

বিপদ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। রুমের পেছন দিকে অস্ত্রহাতে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল নুরুর সেই পাহারাদার বলার আগেই দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেছে কিন্তু রুমের ভেতরে নুরু কিংবা চার্লি দুজনের একজনকেও দেখতে পেল না ও। ‘ওরা পালিয়েছে, সঙ্গে মূর্তিটাও নিয়ে গেছে,’ রিফাত আনমনেই বলে উঠল 1

‘কী! ওরা পালাল কীভাবে?’ রীতিমতো আর্তনাদ করে উঠল জয়া।

‘সমস্যা নেই, ওরা বেশিদূর পালাতে পারেনি,’ বলে ও চলে এলো দরজার কাছে রমিজ দারোগার ওপরে ঝুঁকে আছে আবদুল্লাহ। তার দুই চোখে পানি। ‘স্যার,’ ওকে দেখে বলে উঠল সে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। খবর দিতে হবে থানাতেও। ওদেরকে ফোর্স পাঠাতে বলতে হবে।’

‘সমস্যা নেই, যা করার আমিই করছি। তোমাকে ভাবতে হবে না মাই বয়, বলে ওর কাঁধে একটা হাত রেখে মাটি থেকে তুলে নেওয়া একটা মোবাইলে লেগে থাকা ধুলো মাটি পরিষ্কার করতে লাগলেন এসপি আমজাদ। ‘তোমরা কেউ ওসি মল্লিককে কিংবা তৌফিককে দেখেছো?’

বাশার আশপাশে তাকিয়ে কাঠের তক্তার ভাঙাচোড়া স্তূপের নিচ থেকে বেরিয়ে থাকা মল্লিকের রক্তাক্ত দেহটার দিকে ইশারা করে দেখাল। ‘ওই যে মল্লিক, বেঁচে আছে কিনা কে জানে তবে তৌফিক…’

‘প্রথমবার, ঘরটা নড়ে ওঠার সময়েই সে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে, মনে হয় পালিয়েছে…’

‘না, পলাইতে পারে নাই, এইহান থাইক্কা বাইর হইতেই ওরে আমরা ধরছি। বাইরেই একটা খুঁটির সঙ্গে বাইন্দা রাহা অইছে। হেরে বানতে গিয়াই দেরি অইছে আমগোর এইহানে ঢুকতে…’ রমিজ দারোগার মাথা কোলের ওপরে নিয়েই ভেজা গলায় হঠাৎ বলে উঠল আবদুল্লাহ।

‘সাবাশ, এখন শুধু নুরু আর চার্লি,’ বলে বাশার মাটি থেকে ওর পিস্তলটা তুলে নিলো। মনে হয় টেবিলের ওপর থেকে ওটা গড়িয়ে পড়েছে। ‘স্যার, আমি ওদের পিছু নিচ্ছি। দেখি ধরতে পারি কি না।’ বলে ও চলে এলো রিফাত আর জয়ার কাছে। ‘আমি বেরুচ্ছি, ওরা মনে হয় বেশিদূর পালাতে পারেনি। যদি সম্ভব হয় আমি ধরার চেষ্টা করব ওদেরকে।

‘দাঁড়াও এক মিনিট,’ বেশ ঠান্ডা গলায় বলে উঠল রিফাত। ‘ওরা কোথায় যাবে আমি জানি। আর যদি তাতেও কাজ না হয় তবে সে ব্যবস্থাও আছে,’ বলে ও হাতে ধরা ভিডিয়ো গেমের মতো ট্র্যাকারটা দেখাল। ‘মূর্তিটা যখন আমার হাতে এসেছিল আমি ওটার নিচের ফাঁকা প্যানেলে একটা ট্র্যাকার ঢুকিয়ে দিয়েছি,’ বলে জয়া আর বাশারের দিকে তাকিয়ে ও মুচকি হেসে উঠল। ‘তবে এটারও আসলে দরকার নেই। ওরা কোথায় যাবে সেটা আমি পরিষ্কার জানি। কারণ ম্যাপটা আমি দেখেছি।’ কাত হয়ে থাকা রুমের কাঠের বেড়া ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়ির দিকে দৌড়াচ্ছে ওরা।

‘কোথায় যাবে ওরা?’

বাশারের দিকে না তাকিয়েই রিফাত জবাব দিল। ‘আমরা সেখানেই যাবো যেখান থেকে এই সমস্ত গল্পের শুরু,’ বলে ও একটানে সেই নীল মাইক্রোর দরজা খুলে ফেলল। ‘মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ি। গল্পের শুরু যেখানে হয়েছিল আমার ধারণা সমাধানও ওখানেই হবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *