অধ্যায় চল্লিশ – বর্তমান সময়
কোতয়ালি মডেল থানা, ময়মনসিংহ
পুরো ব্যাপারটা যেন ফাঁসের মতো আটকে আছে ওসি মল্লিকের গলায়। এসপি আমজাদের রুমের ঠিক বাইরেই অস্থির হয়ে পায়চারি করছে সে। ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত। একদিকে তার বহুদিনের অনেকগুলো স্বপ্ন একসঙ্গে পূরণ হতে চলেছে, অন্যদিকে আবার সেটার আশপাশে ভিড় করছে অনেকগুলো শঙ্কা।
মনের ভেতরে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। তবে এতদিন পুলিশের চাকরি করে একটা ব্যাপার সে বুঝে গেছে—জীবনে উন্নতি করতে হলে ঝুঁকি না নিয়ে কোনো উপায় নেই। ভয়ের কোনোই কারণ নেই আসলে। তার পেছনে অনেক বড়ো বড়ো মানুষ রয়েছে। অস্থির হয়ে হাতঘড়ি দেখল সে একবার, ক্রিমিনালটার সঙ্গে এতকী কথা বলছেন এসপি? যত বেশি কথা, ততোবেশি বিপদ। সে আরেকবার বেঞ্চে বসে থাকা মেয়ে দুটোকে দেখল, মনে মনে ভাবল স্রষ্টার কী বিচিত্র খেয়াল। সব তারই সৃষ্টি কিন্তু একটার সঙ্গে অন্যটার কী বিরাট পার্থক্য!
ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েদুটোর দিকে তাকিয়েছিল বলে সে প্রথমে দেখতে পায়নি। কিন্তু এসপির রুমের দরজার দিক থেকে শব্দ শুনে ফিরে তাকাতেই মুখ হাঁ হয়ে গেল তার। যা দেখল সেটা দেখে আসলে তার খুশি হওয়া উচিত না ভয় পাওয়া উচিত সে বুঝে উঠতে পারল না। তবে স্বাভাবিক রিফ্লেক্সের বসে একটা হাত চলে গেল কোমরের কাছে পিস্তলটার দিকে কিন্তু সেটা বের করতে পারল না সে।
ওসি মল্লিক পিস্তল বের করার আগেই এসপির মাথায় পিস্তল ধরে থাকা বাশার চেঁচিয়ে উঠল। ‘খবরদার! সবাই অস্ত্র নামিয়ে রাখো।’ চিৎকার না করলেও চলত। এরকম ভয়ংকর দৃশ্য এর আগে এই থানায় কেন, সিনেমাতে ছাড়া বাস্তবে মনে হয় কেউই দেখেনি। থানার ভেতরে এরকম কিছু ঘটতে পারে সেটাও কেউ ভাবেনি। এসপির মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে বাশারকে তার রুম, থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে প্রথমে সবাই হতভম্ভ হয়ে গেল তারপর যে যার যার মতো রিঅ্যাক্ট করে উঠল। কিন্তু আবারো বাশার চেঁচিয়ে সাবধান করল সবাইকে। তার সাবধান করার প্রয়োজন ছিলো না কারণ ওসি মল্লিক তার চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে সবাইকে মানা করছে অস্ত্র ধরার জন্যে।
বাশার এসপিকে নিয়ে থানার মাঝখানের করিডরে চলে এলো। ওখানেই বেঞ্চে বসে ছিল জয়া আর রিফাত। ওদের দুজনকেসহ বাশার সোজা বেরিয়ে এলো থানার বাইরে। সেখানে একটা জিপ গেটের কাছে স্টার্ট দিয়ে রাখাই ছিল। সে এসপিকে নিয়ে সোজা সেটাতে উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে রিফাত আর জয়া।
ওরা উঠে বসতেই জিপ ছেড়ে দিল আবদুল্লাহ। তার সঙ্গে আগে থেকেই বসে ছিল রমিজ দারোগা ওরা উঠে বসতেই সে এসপিকে সালাম দিল। ‘ও তুমিও আছো এদের সঙ্গে,’ দাঁত কট-মট করে বলে উঠলেন এসপি আমজাদ। তিনি একহাতে ঘাড় ডলছেন।
‘বাশার, তুমি কি যে করো! আরেকটু হলে তো আমার ঘাড়টা ভেঙেই দিতে, ‘ তিনি ডলতে ডলতেই বলে উঠলেন। ‘খোদা জানে, তুমি কী করছ! সবদিক নিয়ে ডুববে কিনা কে জানে,’ বলে তিনি আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়লেন।
‘স্যার, তৌফিক স্যারে এইডা দিছে আপনেরে,’ বলে রমিজ দারোগা একটা কমদামি সাধারণ মোবাইল সেট বের করে বাশারের দিকে এগিয়ে দিল। ‘এইডাও বলে মোবাইলের মতো দেখতে একটু অন্যরকম আরেকটা জিনিস বাশারের দিকে এগিয়ে দিল। জিনিসটার গায়ে একটা হেডফোন প্যাচানো। এক সেকেন্ড জিনিসটা দেখে নিয়ে পকেটে রেখে দিল ও আর মোবাইল সেটটা হাতে নিয়ে কল দিল ওর বন্ধু জামিলকে।
জামিলের সঙ্গে কথা শেষ করে এসপির দিকে ফিরে বলল। ‘সরি স্যার, ওই সময়তো হুঁশ ছিল না,’ বলেই সে আবদুল্লাহর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘এই এই, থামো থামো!’ ওদের জিপ বিপিন পার্কের সামনে চলে এসেছে। এখানেই কোথাও জামিলের থাকার কথা। আবদুল্লাহ জিপ থামাতেই সেটা থেকে লাফিয়ে নেমে এলো বাশার।
রাস্তার অন্যপাশে দেখতে পেল একটা নীল রঙের মাইক্রোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে জামিল। মনে মনে খুশি হয়ে উঠল ও। দৌড়ে রাস্তা পার হলো। ‘ধন্যবাদ বন্ধু,’ বলে জামিলকে জড়িয়ে ধরল।
‘আরে কী যে কস। কিন্তু ব্যাপারটা কী? তুই কি কোনো ঝামেলায় পড়ছোস?’ জামিলের গলা একটু উদ্বিগ্ন।
‘শোন, আমি তোরে সব বলবো। কিন্তু পরে। এখন তুই যত কম জানবি ততোই ভালো। কিন্তু পরে যাই শুনিস, মনে রাখিস আমি খারাপ কিছু করি নাই। তুই এখান থেকে সরে পড়। আর এই গাড়িতে যে নম্বর প্লেট লাগানো আছে সেটা…।’
‘কোনো সমস্যা নেই। আমি গাড়ির ব্যবসাই করি, তো এইসব ব্যাপার উলটাপালটা করা কোনো বিষয়ই না। বেস্ট অভ লাক বন্ধু, পরে কথা হবে,’ বলে জামিল রাস্তার অন্যদিকে গিয়ে একটা টমটমে উঠে পড়ল।
বাশার মনে মনে ভাবল-হ্যাঁ লাকই ওর এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। ও মাইক্রোতে উঠে ওটাকে স্টার্ট দিয়ে ওদের জিপের পাশে নিয়ে এলো।
‘ওঠো ওঠো, সবাই এটাতে উঠে পড়ো,’ এসপি, রিফাত, জয়া আর রমিজ দারোগাকে ওঠার নির্দেশ দিয়েই ও আবদুল্লাহর কাছে এসে নির্দেশনা দিতে শুরু করল।
‘আবদুল্লাহ, তুমি এই জিপটা নিয়ে চলে যাবে শহরের বাইরে। পুলিশ এখন এটাকেই খুঁজবে, কাজেই সাবধান। শহরের বাইরে গিয়ে রাস্তার পাশে এটাকে আড়ালে কোথাও রেখে তুমি ওখান থেকে সরে পড়বে। তারপরে কল দিবে আমাকে। বুঝেছ?’
আবদুল্লাহ মাথা নাড়তেই ও সরে আসবে পাশ থেকে রমিজ দারোগা বলে উঠল। ‘স্যার, ও পুলাপান মানুষ। ঠিকমতো নাও বুঝতে পারে। আমি ওর লগে যাই?’ রমিজ দারোগা বাশারের দিকে তাকিয়ে আছে। বাশার তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘রমিজ সাহেব, আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। কারণ যে কাজে আমরা যাচ্ছি এতে অনেক ঝুঁকি, আর আপনি এখন অফ ডিউটিতে আছেন। মনে রাইখেন অফ ডিউটিতে কিছু হইলে কিন্তু আপনি বা আপনার পরিবার কিছুই পাবেন না,’ বাশারের কথা শেষ হবার অগেই রমিজ দারোগা বিশ্রীভাবে হেসে উঠল।
‘স্যার, কী যে কন। আমার আবার পরিবার। বউ ছাইড়া গেছে গা কবে, দুই পেলার কেউই লগে থাহে না। একমাত্র মাইয়াডা জামাই লইয়া থাহে বিদেশ। পাঁচ বছরেও একবার দেশে আহে নাই। আমি সারাজীবন কামচুরের মতোন কাম করছি। পলায়া পলায়া কুনোরকমে নিজের জান বাঁচায়া চাকরি করছি। জীবনে প্রথমবারের মতো ঝুঁকি নিতে শিখছি আপনের লগে থাইক্কা। জীবনে প্রথমবারের মতোন নিজেরে হিরু মনে অইতাছে। স্যার, এইডা আমার কাছ থাইক্কা কাইড়া নিয়েন না,’ বাশার তার দিকে তাকিয়ে রইল। বেশি ভাবার সময় নেই। তার দিকে তাকিয়ে জিপে ওঠার ইশারা করে ও দৌড়ে পার হয়ে এলো রাস্তাটা।
নীল মাইক্রোতে উঠে ওটাকে স্টার্ট দিয়ে চলে এলো থানার কাছে। থানার পেছন দিকের রাস্তায় এসে অন্ধকারে পার্ক করে বাতি নিভিয়ে দিল। এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে, এবার অপেক্ষার পালা।
‘বাশার, তুমি কি নিশ্চিত?’ এসপি আমজাদ অন্ধকারে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে জানতে চাইলেন। এসপিসাহেবের সিগারেটের ধোঁয়া নাকে এসে লাগতেই নিজেরও ধূমপানের তৃষ্ণা পেয়ে বসল বাশারের। কিন্তু উপায় নেই। এমনকি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও সিনিয়রের সামনে ধূমপান করা যাবে না।
বাশারের মোবাইল বাজতে শুরু করেছে। ও কল রিসিভ করে তৌফিকের সঙ্গে কথা বলল। কথা শেষ করে সবার উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে ইশারা করল। ‘সবাই সাবধানে বসো, যদি কপাল ভালো হয় তবে এবার খেলা শুরু হতে যাচ্ছে।’