প্রথম অংশ : ছন্দপতন
দ্বিতীয় অংশ : মৃত্যুহরণ

সপ্তরিপু – অধ্যায় ৪

অধ্যায় চার – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ

মধুপুর বনাঞ্চল, মুক্তাগাছা জমিদারের কাচারি বাড়ি

মনের গহিনের কষ্ট আর অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলোই নাকি বারবার ফিরে ফিরে আসে মানুষের স্বপ্নে। যদি তাই হয় তবে ক্যাপ্টেন জেমস ম্যাকফির জন্য সেই চিরাচরিত দুঃস্বপ্নের হাত থেকে কোনো নিস্তার নেই।

মুক্তাগাছার জমিদারের কাচারিবাড়ির লম্বা ঝুল বারান্দায় বসে নিজের দিনলিপিতে চোখ বুলাতে বুলাতে কথাগুলো ভাবতে লাগল ম্যাকফি। সামনের ঘন সবুজ বনভূমির দিকে তাকিয়ে তার মনে হতে লাগল, নীল সমুদ্র থেকে যাত্রা শুরু করে সবুজ বনভূমিতে চলে এসেছে ওরা। পথে-প্রান্তর, মানুষ-প্রকৃতি কতকী বদলে গেল, শুধু পিছু ছাড়ল না সেই চিরচরিত দুঃস্বপ্ন।

সেই একই হাত, একই আর্তনাদ, প্রত্যেকবার সেই একই স্মৃতির ফুলঝুড়ি। দীর্ঘ একটা নিশ্বাসের সঙ্গে ও আবারো অনুভব করল : স্বপ্নে দেখা আর্তনাদ করতে থাকা মানুষটা আর কেউ নয়…তার মা, আর অত্যাচারী মানুষটা তার বাবা; যাকে সে নিজ হাতে খুন করেছিল।

‘ক্যাপ্টেন, স্যারজি, হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠ শুনে লেখার কাগজগুলো ভাঁজ করে ফিরে তাকাল ম্যাকফি। তার একনিষ্ঠ অনুচর ও দলের প্রধান সেনা-অফিসার মহাবীর সিং দাঁড়িয়ে আছে। নিজের দলের যেদুজন মানুষকে ম্যাকফি এখানে নিয়ে আসার অনুমতি পেয়েছিল তাদের ভেতরে মহাবীর সিং একজন। মহাবীর সিং ক্যাপ্টেন ম্যাকফির বিশেষ বাহিনীতে সবচেয়ে প্রভাবশালী কমান্ডার।

যেকোনো ইংরেজ বাহিনীর জন্যে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আর্মিতে প্রচুর স্থানীয় ভারতীয়রা কাজ করলেও তাদের বেশিরভাগই খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি পায় না। এমনকি কর্মদক্ষতা দেখানোর পরেও না! আর সেখানে ব্রিটিশ আর্মির একটা বিশেষ দলে একজন ভারতীয়ের যেখানে স্থান পাবারই কথা নয় সেখানে, ম্যাকফির দলে ক্যাপ্টেনের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একজন পাঠানের অবস্থান খুবই আশ্চর্য ব্যাপার!

মহাবীর সিংয়ের সঙ্গে ম্যাকফির পরিচয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের ময়দানে। এর আগে মহাবীর সিং দক্ষিণ ভারতের নিজাম বাহাদুরের বাহিনীতে কাজ করত। কিন্তু সেখানে নিজামের প্রধান সেনাপতির সঙ্গে বনিবনা না হওয়াতে মোঘলদের বাহিনীতে এসে যোগ দেয় সে। ভগ্নপ্রায় মোঘল সেনাবাহিনীতে মহাবীর সিংয়ের মতো একজন দুর্ধর্ষ সৈন্যের ভালো লাগার কথা নয়, লাগেওনি। সে ওখান থেকে পালিয়ে এসে যোগ দেয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে।

ইংরেজরা যখন ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধের ঘোষণা দিল তখন তাদের প্রচুর সৈন্যের দরকার। শুধুমাত্র ইংরেজ সৈন্য দিয়ে তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করা সম্ভব ছিল না। তাই প্রচুর ভারতীয় সৈন্য নিজেদের দলে নিয়োগ দিতে শুরু করে। মহাবীর সিং মোঘল সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে যোগ দেয় ইংরেজ বাহিনীতে। সেখানেই তার স্থান হয় ক্যাপ্টেন ম্যাকফির দলে। মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানেই মহাবীর সিংয়ের বীরত্ব চোখে পড়ে ম্যাকফির। সেই থেকে মহাবীর সিংয়ের প্রতি ম্যাকফির একটা টান তৈরি হয়।

যুদ্ধের পর কর্নেলের মাধ্যমে ম্যাকফিকে যখন প্রস্তাব দেওয়া হয় বিশেষ একটা দল গঠনের জন্যে, তখন সবার আগে ম্যাকফির মনে আসে তার অধীনে কর্মরত অফিসার লিউক জোনাথন, আর ভারতীয়দের ভেতরে মহাবীর সিংয়ের কথা। যদিও এরকম একটা দলে ভারতীয় একজনকে রাখার ব্যাপারে ওপর মহল থেকে যথেষ্ট আপত্তি তোলা হয়েছিল…কিন্তু ম্যাকফি মহাবীর সিংয়ের ব্যাপারে নিজের জেদ ধরে রাখে। ফলে মহাবীর সিংয়ের জায়গা হয় তার দলে। নিজের দলের কেউই ম্যাকফির নেতৃত্বের ব্যাপারে কিছু বলেনি, কিন্তু তার ডান হাত হিসেবে মহাবীর সিংয়ের আদেশ মানার ব্যাপারে প্রথম দিকে একটু আপত্তি তাদের ছিল। যদিও দল গঠনের এক বছরের ভেতরে মহাবীর সিংয়ের সাহস আর কর্মদক্ষতার গুণে সবাই তাকে একবাক্যে দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে মেনে নেয়।

মহাবীর সিংয়ের পূর্বপুরুষেরা ছিল রাজপুত কুস্তিগীর। পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রেই বিশাল দেহ তার। অস্বাভাবিক শারীরিক শক্তি সে পেয়েছে পরিবার থেকে, সেই সঙ্গে বিভিন্ন ফৌজে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করেছে বন্দুক, তলোয়ার আর অন্যান্য ছোটো আগ্নেয়াস্ত্রে। পুরোদস্তুর সৈনিকের ইউনিফর্মে থাকলেও নিজের পূর্বপুরুষদের আদলে সবসময় মাথায় লাল-রঙের একটা পাগড়ি পরে থাকে সে। আর কোমরে রাখে ছোট্ট একটা কুঠার।

মাথার বিরাট লাল পাগড়ি নেড়ে সে ম্যাকফিকে অভিবাদন জানাল, ‘ক্যাপ্টেন স্যারজি, রাজা মশাই আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে পোষণ করেছেন।’

মহাবীর সিংয়ের দিকে না তাকিয়েই নিজের লেখার কাগজগুলো রোল করতে লাগল ম্যাকফি। ‘জোনাথন কোথায়?’

‘জোনাথন স্যার জরুরি কাজগুলো সেরে খোঁজ-খবর করতে আগেই বাইরে গেছেন। রাজা মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলার আগে কিছু ব্যাপারে খবর নেওয়া খুব জরুরি। উনি সেসব ব্যাপারেই খোঁজ করতে গেছেন।’

‘হুম, বুঝতে পেরেছি। মহাবীর সিং, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে,’ ম্যাকফি ডায়েরি রেখে তার দিকে তাকাল। ছয় ফিট তিন ইঞ্চি উচ্চতার চওড়া সিনা টান করে দাঁড়িয়ে থাকা মহাবীর সিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘দলটা ভেঙে যাওয়াতে আমি সত্যি দুঃখিত।’

টান-টান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মহাবীর সিং যেন একটু কেঁপে উঠল। দ্বিধার সঙ্গে সে জবাব দিল, ‘স্যারজি, আপনি যা করেছেন সেটা ঠিকই হয়েছে। এতে করে যদি আমাদের মৃত্যুদণ্ডও হতো সেটাও মেনে নিতে রাজি ছিলাম আমরা। এটাতো অনেক ছোটো ব্যাপার। আর খোদা চাইলে আবারো সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি দুঃখ নিবেন না।

ম্যাকফি নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটা হাত রাখল মহাবীর সিংয়ের কাঁধে। ‘আমাদের দলটা যদিও আমার নেতৃত্বে ছিল কিন্তু এর ওপর সবার অধিকার সমান। তোমরা সবাই সমান শ্রম-মেধা ব্যয় করেছ এর পেছনে। তবে আমি তো আগেই বলেছিলাম অনেক ঝড়-ঝাপটা আসবে আমাদের ওপরে। আমরা এখানে যে কাজে এসেছি সেটা ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারলে আশা করি আবারো আমরা এক হতে পারব। ‘

‘জি, স্যারজি,’ বলে সে সামনে এগোনোর পথ দেখাল।

ম্যাকফি হাঁটতে লাগল তার পাশাপাশি। ‘তুমি কি কোনো খোঁজ-খবর?’

‘এখনো তেমন কিছু করতে পারিনি। তবে যা বুঝতে পেরেছি এখানে অনেক ঝামেলা হয়েছে। খবর নিয়ে আমি এটুকু জানতে পেরেছি শুধু ইংরেজ সৈন্যরাই হারিয়ে যায়নি, তাদের সঙ্গে সঙ্গে কিছু স্থানীয় লোকজনও হারিয়েছে। এরা এখানে কী করছিল, কী হয়েছে-এই ব্যাপারে কেউই কথা বলতে রাজি না।’

ওরা হাঁটতে হাঁটতে ঘোড়ায় টানা গাড়ির কাছ পর্যন্ত চলে এসেছে। ম্যাকফিকে গাড়িতে ওঠার জন্যে পাদানিতে পা ফেলেও থেমে দাঁড়াল। ‘মানে কী? ওরা জানে কিন্তু কথা বলতে রাজি নয়, নাকি কেউ আসলে কিছু জানেই না?’

‘স্যারজি, এতটা আমরা এখনো বের করতে পারিনি। দেখা যাক রাজাসাহেব কী বলেন। আর জোনাথন স্যার তো গেছেই খোঁজ-খবর বের করার জন্যে।’

‘এখান থেকে রাজার বাড়িতে যেতে কতক্ষণ লাগবে?’

‘আধাঘণ্টার মতো।’

‘আচ্ছা, এক কাজ করো,’ বলে ও একটু ভাবল। ‘জোনাথন তো গেছে জায়গাটা জরিপ করতে। রাজার সঙ্গে দেখা করার আগে আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওকে আমরা চাইলে পথে কোথাও ধরতে পারার সম্ভাবনা আছে?’

‘আছে,’ মহাবীর সিং জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে সূর্যটা দেখার চেষ্টা করল। ‘বেলা তো বেশি হয়নি এখনো…’ সে কথা শেষ করার আগেই নিজের বুক পকেট থেকে বের করে চেইনের ঘড়িটা তার দিকে ছুড়ে দিল ম্যাকফি। ‘সিং, এইটা ব্যবহার করতে শেখো এখন ‘

ঘড়িটা হাতে নিয়ে এক পলক চোখ বুলিয়ে ম্যাকফিকে ফেরত দিয়ে মহাবীর সিং বলল, ‘স্যারজি, এইসব শৌখিন জিনিস আমার সয় না। তারচেয়ে আমার প্রকৃতি মাতাই ভালো। আমার মনে হয় আমরা যদি এখুনি রওনা দিয়ে বেগুনবাড়ির দিকে যাই তবে পথে জোনাথন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। কারণ জোনাথন স্যার যেখানে যাবার কথা সেখান থেকে রাজার বাড়িতে যেতে হলে তাকে ওই পথই ধরতে হবে।

‘বেগুনবাড়ি তো আমাদের যাবার পথেই পড়বে নাকি?’

‘তা পড়বে, কিন্তু আমাদেরকে একটু বামে যেতে হবে।’

‘ঠিক আছে ওইদিকেই যাও, আমি রাজার সঙ্গে দেখা করার আগে জোনাথনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

***

ব্রিটিশ আর্মির স্পেশাল টিমের অফিসার লিউক জোনাথন অবশ্য এই মুহূর্তে এক পিচ্চি ছেলের সঙ্গে দুষ্টামিতে ব্যস্ত।

খুব ভোরে উঠে সে প্রথমে বেরিয়েছিল আশপাশটা দেখতে। কাচারি বাড়ির আশপাশের জঙ্গলে মহাবীর সিংয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ চক্কর মারার পর জোনাথন সিদ্ধান্ত নেয় ইংরেজ অফিসারেরা যেখান থেকে গায়েব হয়েছে সে-জায়গাটা দেখতে যাবে সে। মহাবীর সিং ফেরত চলে যায় কাচারি বাড়িতে আর জোনাথন এক সহিসকে নিয়ে রওনা দেয় ওদিকে।

ঘণ্টাখানেকের মতো লাগে ওদের নদীর পাড়ে নির্দিষ্ট জায়গাটাতে পৌঁছাতে। সহিসকে নিয়েই আশপাশটা স্রেফ একবার চক্কর দিয়ে দেখে নেয় ও। চক্কর মারতে গিয়ে এটা বুঝতে পারে এখানে খুব গভীরভাবে নিরীক্ষা না করলে তেমন কিছু বোঝা যাবে না। কারণ জায়গাটাতে বলতে গেলে তেমন কিছুই নেই। কাজ শেষে সে আশপাশে আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। নদীর ঘাট আর বাজারে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে কিছু ব্যাপার বোঝার চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে একটা দোকানে এসে পানি খেতে চাইলে এক পিচ্চি ছেলে পানি এনে দেয় ওকে। ও খানিকটা পানি খেয়ে কিছুটা পানি নিয়ে ছুঁড়ে মারে ওর দিকে।

অন্য যেকোনো বাচ্চা হলে চমকে উঠতো কিংবা হেসে উঠতো। এই পিচ্চি স্রেফ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে। একজন সাদা চামড়ার মানুষ এমনটা করতে পারে, এটা সে মেনেই নিতে পারছে না। ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে ঘোড়ায় এসে উঠল জোনাথন। সহিসকে নিয়ে রওনা দিল উলটো দিকে।

ব্রহ্মপুত্র নদীর পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ সে উদাসীন হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল এরকমই এক জলধারার পাড়ে জন্মেছিল সে। এখান থেকে বহুদূরে, অন্য এক পৃথিবীতে, ফেলে আসা ভিন্ন এক জীবন।

আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন পোর্ট এলাকার এক লর্ডের বাড়ির আর্মারারের ঘরে জন্ম জোনাথনের। লর্ডের বাড়ির অস্ত্রাগারের রক্ষক সেই ক্যাথলিক আর্মারারের ছয় নম্বর সন্তান ছিল লিউক জোনাথন। তার বাপ খুব বেশি ধর্মকর্ম মানতো না, তবে তার মা ছিল মারাত্মক ধর্মভীরু। একারণেই ছেলের নাম রেখেছিলেন বাইবেলের চার রচয়িতার একজন লিউক-এর নামানুসারে। নামের মধ্যে যতই ধর্মীয় ছোঁয়া থাক না কেন ছোটোবেলা থেকেই জোনাথন ছিল একটা বাঁদরবিশেষ। বাপ অস্ত্রাগারের রক্ষক হবার কারণে ছোটোবেলা থেকেই অস্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বড়ো হয়ে ওঠে সে। আর বন্দর এলাকাতে বাড়ি হবার কারণে সমুদ্রের প্রতি তার তৈরি হয় দুর্বার নেশা। তাই মাত্র ষোলো বছর বয়সেই অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতগামী এক জহাজে চড়ে বসে সে।

ভারতবর্ষে নেমে তারই স্বজাতি এক বাটপারের পাল্লায় পড়ে সব হারিয়ে যখন না খেতে পেয়ে মরতে বসেছে তখন ঘটনাচক্রে ম্যাকফিই তাকে একদিন উদ্ধার করে বিপদের হাত থেকে।

সেই থেকে সে ভিড়ে যায় ক্যাপ্টেন ম্যাকফির বিশেষ দলে। পূর্বের জীবনে অস্ত্রচালনা আর শিকারের অভিজ্ঞতার কারণে দূর পাল্লার অস্ত্র চালনা আর শত্রু দলের ট্র্যাকিংয়ে অসাধারণ দক্ষতা দেখায় সে। দিন-দিন চর্চা করে এই দক্ষতাকে সে মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে সময়ে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষ হবার পর ম্যাকফির নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকে। এরপর ম্যাকফি যখন বিশেষ দল গঠন করে সঙ্গে সঙ্গে সেটাতে ভিড়ে যায় জোনাথন। এরপর থেকে আছে ম্যাকফির সঙ্গেই। কিছুদিন আগে গ্রামের সেই ঘটনার পর ভেবেছিল ওদের পথ বুঝি আবারো ছিন্ন হলো কিন্তু ভাগ্য এখনো তাদেরকে ধরে রেখেছে একসঙ্গেই।

ঘোড়ায় চড়ে চলতে চলতে জোনাথনের মনে হতে লাগল এই জঙ্গুলে এলাকায় যে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে যাচ্ছে ওরা সেটার সমাধান খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ সহিসকে নিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সে যা জানতে পেরেছে সেটা বেশ জটিল। ভাবতে ভাবতেই ওর ঘোড়া বেগুনবাড়ি বাজারে প্রবেশ করল। দূর থেকে দেখতে পেল লাল রঙের পোশাক পরা দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরকে দেখে হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।

***

ম্যাকফি নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোচোয়ানকে বলে ওরা গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা দিয়ে আধা ঘণ্টার ভেতরেই বেগুনবাড়ি বাজারে পৌছে গেল। বাজার বলতে কিছু দোকানপাট, কয়েকটা গুদাম ঘর, একটা সরাইখানা আর দুটো কাঠ মাড়াইয়ের কল। মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির গোড়াপত্তনের পর স্থানীয় শ্রমিকদের প্রয়োজনেই প্রথম গড়ে উঠেছিল এই বাজার এলাকা। এখনো যে খুব জমজমাট তা বলা যাবে না কিন্তু প্রায় জনমানবহীন এই জঙ্গুলে এলাকার এই অংশে এরকম বাজার মানেই অনেক কিছু। মূলত ব্ৰহ্মপুত্র নদী পথে যাতায়াতকারী ব্যবসায়ীদের জন্যে ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই এলাকা। এছাড়াও স্থানীয় কাঠ-ব্যবসায়ীদের অনেকের কাজের যোগানদাতাও এই বেগুনবাড়ি এলাকা। গাড়ি ঘোরানোর আধা ঘণ্টার ভেতরে ওদের ঘোড়ার গাড়ি প্রবেশ করল বেগুনবাড়ি বাজারে। গাড়িটাকে একপাশে করে ওরা নেমে এলো।

স্থানীয় লোকজনের দৃষ্টি দেখেই বোঝা যায় খুব বেশি সাদা চামড়ার লোকজন এদিকে আসে না। কোম্পানির সৈন্যরা সম্ভবত আরো কম আসে। কারণ প্রায় সবার দৃষ্টিতেই কৌতূহলের সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের অজানা ভীতির ছায়াও দেখতে পাচ্ছে ম্যাকফি। ব্রিটিশরা কীভাবে এত কম লোকবল নিয়েও পুরো উপমহাদেশটা শাসন করতে পারছে আরো খানিকটা পরিষ্কার হলো ম্যাকফির কাছে।

সমীহ ও ভীতি।

ব্রিটিশদের অনেকগুলো অস্ত্রের মধ্যে এই দুটো অন্যতম।

ম্যাকফি গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে রইল, আর মহাবীর সিং চলে গেল খবর নিতে। কিছুক্ষণের ভেতরেই সে ফিরে এসে জানাল সকালবেলা একজন সাহেব নাকি এদিক দিয়ে গেছে কিন্তু এখনো ফিরে আসেনি।

‘তারমানে জোনাথন যেকোনো সময় ফিরে আসবে। ও যেদিকে গেছে সেদিক থেকে ফেরার রাস্তা তো এই একটাই নাকি?’

‘জি, স্যারজি,’ মাথা দুলিয়ে বলল মহাবীর সিং। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই দূর থেকে ওরা দেখতে পেল লাল পোশাকের ঝলক। এই পোশাক ব্রিটিশ সৈন্যরা ছাড়া আর কেউ পরে না। তাই এটা জোনাথন না হয়েই যায়না। আরো কাছে আসার পর পরিষ্কার বোঝা গেল। কারণ ঘোড়ার পিঠের ওপরে মানুষটার চেয়ে বেশি নজরে পড়ছে তার পেছন থেকে বেরিয়ে থাকা বিরাট একটা বন্দুক। ঘোড়াটার পিঠে বসে থাকা অবস্থাতেই দূর থেকেই ওদেরকে দেখে হাত নাড়ল সে। কাছে এসে সহিসকে ঘোড়া বুঝিয়ে দিয়ে ওটাকে পাঠিয়ে দিল কাচারি বাড়ির দিকে।

‘আরে বস, তুমি এদিকে!’ মুখে হাসি নিয়ে ম্যাকফির সঙ্গে এসে হাত মেলালো সার্জেন্ট লিউক জোনাথন। সাদা চামড়ার মানুষ হিসেবে তার উচ্চতা অনেক কম। কোনোমতে ম্যাকফির কাঁধ পর্যন্ত পৌঁছেছে। বিশালদেহী কুস্তিগীর মহাবীর সিংয়ের সামনে তাকে দেখাচ্ছে অনেকটা ছোটো বাচ্চার মতো। তার কাঁধ থেকে ঝুলতে থাকা বন্দুকটা মনে হয় প্রায় তার সমানই লম্বা হবে। ‘আরে, মহাবীর যে। আমি তো আরো ভাবছিলাম তোমরা এতক্ষণে রাজার বাড়ি পৌঁছে গেছ।’

‘জন, কী দেখলে ওখানে? কিছু পেয়েছো?’ প্রশ্ন করল ম্যাকফি।

‘কথা আছে বস, চলো সরাইখানায় গিয়ে বসি,’ ম্যাকফি আর মহাবীর সিংয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল সে।

‘নাহ, সময় নেই। গাড়িতে বসে কথা বলবো।’

গাড়িতে উঠে বসল ওরা সবাই। ম্যাকফির মুখোমুখি বসেছে জোনাথন আর মহাবীর সিং। বসেই পাইপ বের করে ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ম্যাকফি।

সেটা দেখে গভীর নীল চোখ নেড়ে কৌতুকের ভঙ্গিতে একটা টিটকিরি সুলভ হাসি দিল ছোটোখাটো সার্জেন্ট জোনাথন। নিজের টুপি খুলে একমাথা রূপালি চুল নেড়ে হাসতে লাগল। বস, তুমি তামাক টানছো! আমাকে যদি কেউ বলত মহাবীর সিংয়ের মাথায় দুটো শিং গজিয়েছে তাহলেও আমি এতটা মজা পেতাম না।’

সঙ্গে সঙ্গে ম্যাকফি আর মহাবীর সিং দুজনেই রাগত ভঙ্গিতে ফিরে তাকাল তার দিকে। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের পিস্তল বের করে ওটার যত্ন নেওয়া শুরু করল সে।

‘জোনাথন, ফাজলামো বাদ দিয়ে বলো ব্যাপারটা কী? যা দেখে এসেছো, বিস্তারিত বলো,’ ম্যাকফির ডাক শুনে পিস্তল পরিষ্কার করা বাদ দিয়ে সে মুখ তুলে তাকাল। ‘রাজার বাড়িতে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে?’

‘আধা ঘণ্টার মতো,’ জবাব দিল মহাবীর সিং।

জোনাথন বন্দুকটাকে শেষবারের মতো চেক করে পাশে রেখে ওদের দিকে ফিরে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘খুব বেশি কিছু বলার নেই। যেতে যেতেই বলছি সব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *