অধ্যায় সাইত্রিশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ
তালুকদার পরিবারের বৈঠকখানা
‘ভবিষ্যত পরিকল্পনার চাইতে বর্তমান পরিস্থিতি সামলানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ, হঠাৎ ধমকে উঠল হেনরি। ‘আপনারা কি বুঝতে পারছেন না পরিস্থিতি কতটা গুরুতর? এই ঠগীরা ভারত ছেড়ে এভাবে দলে দলে এখানে চলে এসেছে কেন সেটা অনুধাবন করতে পারছেন না? কারণ এই এলাকায় ওরা নিজেদের একটা বিরাট আস্তানা তৈরি করতে চায়। আর সেটা খুবই সম্ভব, কারণ ওদের কাছে ভারতবর্ষে ঠগীদের জন্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতীক জোড়া কালীর মূর্তি আছে, ওদের দলের নেতা ফিরিঙ্গিয়া অত্যন্ত শক্ত মানুষ,’ বলে সে আবারো একটু থামলো। ‘তারচেয়ে বড়ো কথা ওরা এখানকার স্থানীয় শক্তির সহায়তা পাচ্ছে।’
হেনরি থেমে যেতেই বৈঠকখানায় নীরবতা নেমে এলো। ওরা এই মুহূর্তে জরুরি আলোচনায় বসেছে তালুকদার পরিবারের বৈঠকখানায়। হেনরি যখন ঘোষণা দিল সে একটা ফাঁদ পাততে চায় কিন্তু এর জন্যে তার বেশ কিছু মানুষের সহায়তা লাগবে তখন জরুরি পরিস্থিতির জানান দিয়ে সমন পাঠানো হয় সবার কাছে।
সবাইকে একসঙ্গে করার ব্যাপারটা সহজ ছিল না। কারণ যুগ-যুগ ধরে চলে আসা শত্রুতাকে ভুলে এক ছাদের নিচে আসাটা সহজ ব্যাপার নয়। তাই হেনরি সূর্যকান্তকে বিশেষ একটা চিঠি লিখে পাঠায়। সেটা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আসতে রাজি হয়ে যায় সূর্যকান্ত। এরপরে ডোংরু মহারাজকে আনতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। এই মুহূর্তে বৈঠকখানায় উপস্থিত আছে ক্যাপ্টেন ম্যাকফি আর তার দলের লোকজন, হেনরি স্লিম্যান, সূর্যকান্ত আচার্য, ডোংরু মহারাজ আর পর্দার আড়াল থেকে আলোচনায় অংশ নিবে জোহরা তালুকদার।
‘পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না যদি না আপনারা সত্য লুকাতেন। বিশেষ করে আপনি,’ বলে ক্যাপ্টেন ম্যাকফি একটা আঙুল তুলে দেখাল সূর্যকান্তের দিকে। ‘আমরা যখন এই এলাকায় এলাম তখন যদি আপনি আমাকে সব খুলে বলতেন তবে সময়ও বাঁচত আর আমাদেরকে এতটা ঝুঁকির মুখে পড়তে হতো না। আপনি আমাদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন কিন্তু সত্য বলেননি,’ বলে ম্যাকফি তামাকের পাইপে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল।
‘আমি আমি…’ জেরার মুখে পড়ে সূর্যকান্ত তোতলাতে লাগল। আমি তো তখন এতকিছু জানতাম না আর বুঝতেও পারিনি।’
‘আপনি ঠিকই বুঝেছিলেন,’ বলে ম্যাকফি পাইপটা নামিয়ে রাখল। আপনি যেটুকু জানতেন সেটুকু তো বলতে পারতেন। সেটাও যদি আমরা জানতাম তবে অনেক আগেই ব্যাপারটার ফয়সালা হয়ে যেত। এখন সত্যটা বলুন। সবাই সত্যটা জানতে চায়, সবার জানার অধিকার আছে।’
সূর্যকান্ত একবার ম্যাকফির দিকে দেখল তারপর তার দৃষ্টি ঘুরে গেল ডোংরু মহারাজের দিকে। ডোংরু মহারাজের মুখে কোনো ভাব নেই। সেপ্রশান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। কারো কাছ থেকে কোনো সাপোর্ট না পেয়ে সূর্যকান্ত বুঝতে পারল কথা বলা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই। ‘আমি আমি…’
‘বুঝতে পেরেছি আপনি বলতে পারবেন না। আমিই বলছি। ভুল হলে ঠিক করে দেবেন। সূর্যকান্তের বাবার মৃত্যুর পর তাদের পারিবারিক জমিদারির প্রকৃত উত্তরাধিকার ছিল সূর্যকান্তের বড়ো ভাই রমাকান্ত আচার্য। বাবার মৃত্যুর পর সে পারিবারিক সবকিছু বুঝে নিচ্ছিল এমন সময় ভারত মুলুক থেকে এলাকায় এসে হাজির হয় সূর্যকান্ত। তার বড়ো ভাই তখনো জমিদারির শপথ নেয়নি। কিন্তু তার আগেই সে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বেশকিছু বড়ো বড়ো কাজে হাত দেয়। এরই মধ্যে একটা ছিল নতুন জমিদার বাড়ির কাজ শুরু করা। মূলত সূর্যকান্ত যেটাকে শশীলজ নাম দিতে যাচ্ছে এটার কাজও সে শুরু করেনি, করেছিল তার বড়ো ভাই। তো যাই হোক, সে ভারত থেকে এসে এই বিরাট জমিদারি এসব দেখে তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। সেস্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মানুষের সহায়তায়,’ বলে সে এক ঝলক ডোংরু মহারাজের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তার বড়ো ভাইকে খুবই বাজেভাবে জমিদারি থেকে উৎখাত করে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে…’ এইপর্যন্ত বলতেই সূর্যকান্ত চেঁচিয়ে উঠল 1
‘আমি মোটেও রমাদাকে মেরে ফেলতে চাইনি। আমি শুধু চেষ্টা করেছি আমার প্রাপ্যটা বুঝে নিতে। আমার মা ছিল বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। রমাদার মা সবসময় সবচেয়ে বেশি সুবিধে পেয়েছে, আমরা সবসময় বঞ্চিত হয়েছি। কাজেই আমি আমার অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেছি স্রেফ। কিন্তু দাদা আমাকে ভুল বুঝেছে। আমি জমিদারি দখলের পর সে পালিয়ে চলে যায় ভারত।’
‘হ্যাঁ, এখান থেকেই ঠগীদের গল্প শুরু। পরাজিত বিধ্বস্ত চিরকুমার রমাকান্ত ছিল একটু সাধক ধরনের মানুষ। কালী পুজো করত সে। সে যখন ভারতে পালিয়ে যায় সেখানে গিয়ে এক ঠগীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সেই লোকের মাধ্যমে সে ইলোরায় ঠগীদের বাৎসরিক উৎসবে যোগদান করে। সেই উৎসবে এসেছিল ভারতের আরেক দুর্ধর্ষ ঠগী দলের নেতা ফিরিঙ্গিয়া, দক্ষিণ ভারত থেকে এক ইংরেজ অফিসারের সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়ে সে তখন এলাকা ছাড়া। তার ওপরে তার কাছে আছে ঠগীদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতীকগুলোর একটি, জোড়া কালী। একদিকে রমাকান্তের দরকার শক্তিশালী একটা পক্ষ, অন্যদিকে ফিরিঙ্গিয়ার দলের দরকার শক্ত একটা ঘাঁটি। তাই দুজনে মিলে তারা একটা চুক্তিতে আসে। ফিরিঙ্গিয়ার দল রমাকান্তকে সহায়তা করবে তার জমিদারি ফিরে পেতে, অন্যদিকে জমিদারি ফিরে পেলে রমাকান্ত ফিরিঙ্গিয়াদেরকে এই এলাকায় একটা চিরস্থায়ী শক্ত ঘাঁটি তৈরি করতে দিবে। কারণ ওদের সঙ্গে মিশতে মিশতে রমাকান্তও ততোদিনে ঠগী জীবনের স্বাদ পেয়ে গেছে। এরপর তারা সবাই মিলে চলে আসে এই এলাকায়। ওরা এলাকায় এলে সেই খবর পেয়ে সূর্যকান্ত বুঝতে পারে একদিকে তালুকদার পরিবার অন্যদিকে নিজের ভাই, এদের সঙ্গে একা লড়ে সে কুলিয়ে উঠতে পারবে না তখন সে চেষ্টা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে আঁতাত করতে।
‘কিন্তু ওরা আসার পর ওরাই গায়েব হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে গায়েব হয়ে যায় স্থানীয় আরো কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষ। ফিরিঙ্গিয়া আর তার দলের মুখোমুখি আমি হয়েছি। আমি জানি কতটা দুর্ধর্ষ আর ভয়ংকর ওরা। ফিরিঙ্গিয়া এই এলাকাকে তার ঘাঁটি হিসেবে তৈরি করে পুরো ভারতবর্ষের একক ঠগীনেতা হতে চায়। আর সেটা সে পারবে। কারণ ঠগীরা প্রতীকে বিশ্বাস করে, ইশারায় বিশ্বাস করে। তার কাছে ওদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতীক জোড়া কালী আছে। তার ওপরে সে সাহসী, সে শক্তিশালী ও চতুর। উদাহরণ দিচ্ছি, এটা আপনাদের এলাকা। এখানে সে বাইরে থেকে এসে একের-পর-এক কাজ করে যাচ্ছে অথচ আপনারা কেউ বেরই করতে পারছেন না সে আছেটা কোথায়। পেরেছেন?’ হেনরির প্রশ্নের জবাবে সবাই চুপ করে রইল। আসলে কেউই পারেনি।
‘কাজেই তাকে আর তার দলকে ধরতে হলে গর্ত থেকে বের করে আনতে হবে। আর যদি এখুনি আমরা সেটা করতে না পারি তবে রমাকান্তের সহায়তা ধীরে ধীরে ফিরিঙ্গিয়ারা এই এলাকাতে স্থায়ী হয়ে বসবে। আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে আপনাদের মধুপুর এলাকা ব্যবসায়ী ও নদীবন্দর এলাকা। এখান দিয়ে মেঘালয়, আসামের ব্যবসায়ীরা নিয়মিত যাতায়াত করে, লোকে তীর্থে যায়। কাজেই এই এলাকায় ওদের শিকারের অভাব হবে না। আপনারা যদি নিজেদের এলাকা, নিজেদের ব্যবসা রক্ষা করতে চান তবে এখুনি জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে এই এলাকা ঠগীদের দখলে যাবে। আর সবার আগে ধ্বংস হবেন আপনারা,’ বলে হেনরি একে একে সূর্যকান্ত, ডোংরু মহারাজকে দেখাল।
‘আপনি কী করতে চান?’ গম্ভীর মুখে অনেকক্ষণ পরে জানতে চাইল ডোংরু মহারাজ। ‘আমি সর্বাত্মক সহায়তা করব।’
ম্যাকফি তাকিয়ে আছে ব্রাহ্মণের দিকে। এই লোকটাকে ওর বুদ্ধিমান মনে হয়। এর আগেও একবার সে ঘোড়ার ব্যাপারটা জানিয়ে ওদেরকে সহায়তা করেছে। যদিও ম্যাকফি এখনো জানে না কীভাবে সেটা করেছে সে, তবে ওর বিশ্বাস এই লোক চাইলে এখনো পারবে। হেনরির দিকে তাকিয়ে ও ইশারা করল। হেনরি বলতে শুরু করল।
‘আমি একটা ফাঁদ পাততে চাই, তবে এর জন্যে আপনাদের সবার সহায়তা লাগবে। ক্যাপ্টেন ম্যাকফি, সূর্যকান্ত,’ বলে ও একটু বিরতি দিয়ে ডোংরু মহারাজের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বিশেষ করে ডোংরু মহারাজ, আপনার সহায়তা লাগবে আমার। কারণ স্থানীয় লোকজনের ভেতরে আপনার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। এর আগে একবার আপনি ক্যাপ্টেন ম্যাকফিকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। আমার বিশ্বাস চাইলে আপনি এবারও পারবেন।’
হেনরি থামতেই পর্দার আড়াল থেকে মুখ ঢাকা জোহরা এগিয়ে এলো ওদের দিকে। আমিও থাকতে চাই,’ বলে ও ক্যাপ্টেন ম্যাকফি আর হেনরির দিকে দেখল। ‘মানা করে লাভ হবে না। কারণ আমার অধীনে এই এলাকার সবচেয়ে শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী আছে। আমি নিজে ওদেরকে নেতৃত্ব দিতে চাই।’
সবাই চুপ হয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর হেনরি বলে উঠল, ‘ঠিক আছে, তাহলে আমরা কাজ শুরু করে দেই। আগেই বলেছি আমি একটা ফাঁদ পাততে চাই। আমি যতটুক জানি এই সময়ে প্রতিবছর তীর্থযাত্রা শুরু হয়। ঠিক?’ বলে সে ডোংরু মহারাজের দিকে তাকাল।
‘হ্যাঁ, আর সপ্তাখানেক পরেই আমাদের যাত্রা করার কথা,’ ডোংরু জবাব দিল।
‘সেটাকে এগিয়ে আনুন, আর এবার আপনার যাত্রার সঙ্গী হবে খোদ সূর্যকান্ত, ‘ হেনরির কথা শেষ হতেই সূর্যকান্ত লাফিয়ে উঠল।
‘কী বলছেন এসব, আমি পারব না। আমি…’
‘আপনার অনুমতি কে চেয়েছে। আমরা যা বলি সেটা আপনাকে মানতেই হবে,’ হেনরি এই পর্যন্ত বলতেই ডোংরু মহারাজ মৃদু হেসে উঠল, সঙ্গে আরো দুয়েকজন। হেনরি অনুমান করল সূর্যকান্তের কাপুরুষতা তাহলে সর্বজন বিদিত। ‘ফাঁদ পাতার জন্যে আমার একটা পরিকল্পনা আছে তবে তার আগে হাট থেকে আমরা যে ঘোড়াচোর বাজিকর ধরেছিলাম ওদেরকে নিয়ে এস। আমার পরিকল্পনা কাজে লাগাতে হলে ওদেরকে দরকার আমার।
***
‘দরকার নেই,’ ফিরিঙ্গিয়া তার সামনে ধরে থাকা পানের বাটাটা একহাতে সরিয়ে দিল। ভোজের পর আলোচনায় বসা মানেই হলো, তামাক আর পান চলবেই, কিন্তু ফিরিঙ্গিয়ার এখন পান নিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বরং সে তামাকের নলে টান দিল। গুড়গুড় করে বড়ো একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। ধোঁয়া টানার চাইতে বরং এই গুড়গুড় শব্দটা তার কাছে বেশি ভালো লাগে। চোখ বন্ধ করে তামাক টানলেও প্রতিটি মানুষের প্রত্যেকটা কথা তার কানে যাচ্ছে। নিজে বলার আগে সবারটা শুনতেই বেশি পছন্দ করে সে। তারপর যখন নিজে বলে তখন সবাইকে সেটা শুনতে বাধ্য করে।
‘গতবারের ঘটনায় আমরা যখন ঝিরণী দিতাছি তহন ওই লোকগুলা আতকা বাইরে থাইক্কা আইসা পড়ল। আমরা সাবধান আছিলাম, আমাগো পাহারা আছিল তারপরেও লোকগুলান কই থাইক্কা আসল কিছুই তো বুজলাম না। আর হেরা কেডা হেইডাও তো বাইর করুন যায় নাই,’ আমার মনে অয় এইডা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে অইবো,’ বয়স্ক এক ঠগী বলে উঠল। ফিরিঙ্গিয়ার বাপের পরে এই লোকেরই ঠগীনেতা হবার কথা ছিল কিন্তু ফিরিঙ্গিয়া পটভূমিতে আসার পর চিত্রটা বদলে গেছে।
‘হেরা যারাই হোক, তাগোরে নিকেশ করা অইছে, অইছে না?’ তার চোখের দিকে তাকিয়ে ফিরিঙ্গিয়া বলে উঠল। ‘আমি নিজ হাতে ঝিরণী দিছি। কাজেই মরা মানুষ কোনো বিপদ না। আমাগো ভাবতে অইবো…’
‘পরথমে ইংরেজরা, তারপর এই ঘটনা, পরিস্থিতি বেশি সুবিধার লাগের না। তুমার নেতৃত্বে বারবার আমরা নিয়মের বাইরে যাইতাছি। ওইদিন রাইতে ইংরেজ অপিসারগো আর তালুকদাররে মারুনের কুনো দরকার আছিল!’ আরেক বয়স্ক ঠগী রাগের সঙ্গে বলে উঠল।
‘দেবীর নির্দেশ। তুমরা কি আমারে দেবীর নির্দেশ অমাইন্য করতে কও? আমরা তো গেছিলাম নজর রাখতে। দেবী শুভ নিদর্শন দেওয়াতেই না ঝিরণী দিতে অইলো,’ কথাগুলো বলে ফিরিঙ্গিয়ার ভালো লাগল না। কেমন জানি জবাবদিহি মনে হচ্ছে তার কাছে।
‘দেবীর নির্দেশ! বারে বারে তুমি উলটা পালটা করবা আর দেবীর কথা কইবা! আগেও তুমি ইংরেজগো লগে বাজছো। তুমার বাজাবাজির কারণেই নিজের মুলুক ছাইড়া এইহানে আইতে অইছে আমগো,’ প্রথম বুড়ো ঠগী বলে উঠল।
‘তো কী অইছে?’ রক্ত চক্ষু করে ফিরিঙ্গিয়া তাকাল তার দিকে। এতক্ষণে ধৈর্য আর মেজাজ দুটোই হারিয়ে ফেলেছে সে। সারাজীবন তো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছো। আমার বাপে না থাকলে এহনো কুনো রাস্তার পাশে লাশ অইয়া পইড়া থাকতা। আর আমার কথা কও। মুলুক ছাড়ছি তো কী অইছে? যেকুনো সময়ের চেয়ে ভালা আছি আমরা। জোড়া দেবী আমগোর লগে আছে। আগে গোপনে দেবীর পূজা দিতে অইতো, ভোজ করতে অইতো, এখন নিজেগর বিরাট মন্দির আছে আমাগোর। ভাবতে পারো এক বছর আগে যহন আমি দলের দায়িত্ব নিলাম ভাবতে পারতা এক বছর পরে নিজেগো মন্দিরে দেবীর পূজা দিতে পারবা? আর হ, বিপদ আইছে; কিন্তু দেবীর আশীর্বাদে বিপদ কাটায়া আরো শক্তিশালী অয়া উঠছি আমরা। কাজেই কীসের এত সমস্যা তোমাগো? আর যদি কইতে চাও আরো বিপদ আইবো, কিন্তু আমি এই এলাকারে আরেকটা ইলোরা বানায়াই ছারমু। ইলোরার পরে এই এলাকা অইবো ভারতের ঠগীগো লাইগা দ্বিতীয় তীর্থস্থান। কী বলো রমাকান্ত, অইবো না?’ শেষ প্রশ্নটা করল সে ঝিমোতে থাকা প্রাক্তন জমিদার রমাকান্তের দিকে তাকিয়ে।
সূর্যকান্তের সৎভাই রমাকান্ত আচার্য। সেই ঠগীদেরকে এই এলাকায় নিয়ে এসেছে। ‘অবশ্যই হবে,’ বলে সে লাল টকটকে চোখ জোড়া খুলল। ‘জোড়া দেবীর আশীর্বাদ থাকলে হতেই হবে।’
‘হ, জোড়া দেবীর আশীর্বাদ আমাগো লগে আছে। এরচেয়ে বড়ো আর কিছু কি অইতে পারে। কাজেই প্যানপ্যানানি বাদ দিয়া আমি কি কই শুনো। হেইমতো কাম করলে আমরাই হবো এই এলাকার অলিখিত জমিদার, যা এই ভারতবর্ষে এখন পর্যন্ত কেউই করতে পারে নাই। তয় এর লাইগা আরো ঝুঁকি নিতে অইবো, বিশেষ করে সূর্যকান্তরে শেষ করতে হবে,’ হঠাৎ সে থেমে গেল। দূর থেকে একজন অনুচর কিছু একটা বলার জন্যে ইশারা করছে। ইশারায় তাকে কাছে ডাকল ফিরিঙ্গিয়া। তার কানে কানে কিছু একটা বলল অনুচর। চুপচাপ শুনে গেল সে। অনুচরের কথা শেষ হতেই তাকে যাবার ইশারা করে নিজের লোকদের দিকে ফিরে তাকাল।
‘একটা খবর আইসা পৌঁছাইছে,’ সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ‘আমাগো ঘুড়াচোর বাজিকর খবরি নাকি খবর পাইছে মেঘালয় থাইক্কা নাকি একদল ব্যবসায়ী মধপুর আইসা পৌঁছাইছে। হেরা নাকি উত্তরের দিকে রওনা দিবো। তাগো লগে ডোংরুর দলও একসঙ্গে তীর্থে রওনা দিবো। তবে এইডাও বড়ো খবর না। হেগো লগে এইবার যাইবো খোদ জমিদার সূর্যকান্ত,’ ফিরিঙ্গিয়ার শেষ কথাটা শুনে সভায় ফিসফাস শুরু হয়ে গেল।
‘আমাগো মূল দুই শত্রু, যাগো কব্জায় আনতে পারলে এই এলাকা আমাগো কব্জায় আইবো, রমাকান্তরে আবার জমিদার বানাইতে পারব আমরা। হেই দুই শত্রুরে একসঙ্গে এরহম অরক্ষিত অবস্থায় আর পাওয়া যাবে না। কাজেই এইটা আমাগো জন্যে বিরাট সুযোগ। কারণ সবকিছু ঠিক আছে। দেবী প্রসন্ন আছেন, যোগ শুভ আছে। সব লক্ষণ পরিষ্কার। কাজেই এইবারই আমাগো মাঠে নামা উচিত। সবাই কী বলেন?’
সবাই একযোগে সম্মতি জানাল। ফিরিঙ্গিয়া তার বাপের দিকে তাকাল। বাপ সামান্য মাথা নেড়ে তাকে কাছে ডাকল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল কিছু একটা। বাপের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবল সে। তারপর সবার দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘তাইলে আমরা পথে নামার প্রস্তুতি নেই। তবে এইখানে একটা কথা আছে। আব্বার কথা যদি ঠিক হয় তাইলে এইডা একটা ফাঁদ,’ বলে সে থেমে গেল। ধীরে ধীরে গোঁফে তাদিতে দিতে তার মুখে ফুটে উঠল এক টুকরো নিষ্ঠুর হাসি। ‘তয় অগোকী করতে অইবো, হেইডা আমি খুব ভালাই জানি। বাইরে খবর পাঠাও, আমার লোক লাগবো। সব আলগা ঝামেলা শেষ করতে হইবে এইবার।’