অধ্যায় পয়ত্রিশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ
মধুপুর গড়, ময়মনসিংহ
তুপানির গুড়ের তিতকুটে মিষ্টি রসের নেশার সাগরে ভাসতে ভাসতে নিজের স্মৃতি রোমন্থন করছে ফিরিঙ্গিয়া। সেই সঙ্গে নিজের ঠগী হয়ে ওঠার গল্পও।
ফিরিঙ্গিয়া কখনো নিজের আসল মা-বাপকে দেখেনি। রতন সিং, যাকে সে বাপ বলে জানে, সে আসলে তার পালক বাপ। তার মুখেই শুনেছে নিজের আসল মা-বাপের করুণ কাহিনি।
ভারতবর্ষে ইংরেজরা আসন গেড়ে বসে গদি সবেমাত্র শক্ত করতে শুরু করেছে। ফরাসি, ওলন্দাজ, পর্তুগীজরা ততোদিনে বুঝতে পেরেছে ভারতবর্ষে তাদের আর কোনো আশা নেই। যে যেখানে যা পারছে লুটে নিয়ে কীভাবে ভারত ছাড়বে সেই ধান্দা।
ইংরেজরাও ততোদিনে বণিক থেকে শাসক, শাসক থেকে শোষক হবার পথে। তাদের শোষণের ঝান্ডা প্রথমেই তারা তাক করে নিজেদেরই স্বজাতির দিকে। ভারতবর্ষের যেখানেই ইংরেজ ছাড়া অন্য কোনো সাদা চামড়া চোখে পড়ছে তাকেই তাড়িয়ে মারছে আর না হয় বস্তাবন্দি করে তুলে দিচ্ছে জাহাজে। ইংরেজদের সঙ্গে এরকমই কোনো এক খণ্ডযুদ্ধে পরাজিত পর্তুগীজ ফিরিঙ্গির দল স্থানীয় ফৌজের তাড়া খেয়ে পালাচ্ছিল মাদ্রাজ বন্দরের দিকে। পালানোর পথে তারা এক গ্রামে থামে।
এই গ্রামেরই মোড়ল ছিল ফিরিঙ্গিয়ার আসল বাবা। অনাহুত অতিথিদের সে যথেষ্টই আপ্যায়ন করার চেষ্টা করে। কিন্তু অতিথিরা সবেমাত্র খেতে বসেছে এমন সময় ইংরেজ ব্রিগেড ফিরিঙ্গিদের খোঁজে গ্রাম আক্রমণ করে। প্রতিরোধ করে ফিরিঙ্গিরা।
দুই বিদেশি দলের যুদ্ধে তছনছ হয় গ্রাম। এই যুদ্ধের মাঝে পড়ে ভীষণ আহত ফিরিঙ্গিয়ার আসল বাবা; কোনো মতে নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে পালানোর সুযোগ করে দিতে পারলেও নিজে বাঁচতে পারেনি। তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কোনো মতে কিছুদূর গিয়ে জঙ্গলের ভেতরেই একাকী নির্জনে জন্ম দেয় এক শিশু সন্তানের।
পরদিন ভোরে ওই জঙ্গলের পায়ে চলা পথ দিয়ে যাচ্ছিল একদল লোক। তাদেরই একজন জঙ্গলের ভেতরে শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে থেমে যায়। কান্নার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে মৃত মায়ের পাশে তারা আবিস্কার করে সদ্য জন্ম নেওয়া এক শিশু। সেই শিশুই ছিল ফিরিঙ্গিয়া। আর লোকগুলো ছিল ঠগী।
সেই ঠগীদলের সর্দার রতন সিং জানত আগের দিন এখানে ইংরেজ আর ফিরিঙ্গিদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। কী ঘটেছে সেটা অনুমান করা খুব কষ্টকর না। শিশুটিকে ফেলে দিতে গিয়েও সর্দার কী মনে করে রেখে দেয় নিজের কাছে। চিরকুমার ঠগী সর্দার রতন সিংয়ের মনের গহিনে চাপাপড়া পিতৃসত্তা হয়তো সেদিন জেগে উঠেছিল। ফিরিঙ্গিদের আক্রমণের সময়ে জন্ম হয়েছিল বলে শিশুটির নাম রাখা হয় ফিরিঙ্গিয়া।
রতন সিংয়ের বাড়িতেই বড়ো হতে থাকে ফিরিঙ্গিয়া। রতন সিং ছিল গ্রামের সর্দার, সেই সঙ্গে সে ছিল ঠগীদের বেশ বড়ো একটা দলের সর্দার। এই ব্যাপারটা অবশ্য ফিরিঙ্গিয়া তার প্রথম বয়সে কোনোভাবেই জানত না, জানা সম্ভবও ছিল না। তবে রতন সিং তার পরিচয় নিয়ে কখনোই কিছু গোপন করেনি, তাকে কীভাবে পেয়েছে, নাম দিয়েছে এটা ফিরিঙ্গিয়া বেশ ভালোভাবেই জানত। বাপকে সে বেশ ভালোবাসত, শ্রদ্ধাও করত, তবে বাপের আচরণখুব রহস্যময় লাগত তার কাছে।
মাঝে মাঝেই তার বাপ দল-বল নিয়ে গায়েব হয়ে যেত। ফিরে আসত দুই, তিন, চার সপ্তা কখনো কখনো এক মাস এমনকি দুইমাস পরেও। সে জানত তার বাপ আর গ্রামের সমর্থ পুরুষেরা চুক্তিতে কাজ করতে যায়। কাজ সেরে টাকা নিয়ে ফিরে আসে। কৌতূহল হতো খুব, কিন্তু তারা কোথায় যায় জানার উপায় ছিল না।
পনেরো বছর বয়সের সময়ে তার গ্রামেরই সমবয়সি এক ছেলের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালায় সে। পালিয়ে দক্ষিণে চলে যায়। ওখানে তখন যুদ্ধের দামামা বাজছে। মারাঠা সেনাপতি পেশোয়া বাজিরাওয়ের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেয়। লম্বা সময় যুদ্ধের ময়দানে থেকে দুটো ব্যাপার আবিস্কার করে ফিরিঙ্গিয়া। সাদা চামড়ার লোকজনের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর নিজের ভেতরে অদ্ভুত এক নিষ্ঠুরতা। দুটো ব্যাপারই হয়তো তার মজ্জাগত ছিল কিন্তু ব্যাপারগুলো সে আবিস্কার করে যুদ্ধের ময়দানে। বছর দেড়েক পরে বাড়ি ফিরে আসে ফিরিঙ্গিয়া। সময়টা ছিল অনেক কম কিন্তু পরিবর্তনটা ছিল অনেক বেশি। বাড়ি ফিরে আসার পর সে আসলে বুঝতে পারছিল না কী করবে।
নিজেকে তার সবসময় মনে হতো খাপখোলা একটা তলোয়ার, যে তলোয়ার কাটার জন্যে কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। এমন সময় তার বাপ তাকে নিয়ে পথে নামে। সরাসরি না জানলেও ততোদিনে সে এটা খুব ভালোভাবে টের পেয়ে গেছে তার বাপ আর গ্রামের সমর্থ পুরুষেরা উলটোপালটা কিছু একটা করে।
পথে নেমে ফিরিঙ্গিয়া প্রথমেই অবাক হয়ে খেয়াল করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে এক জায়গায় থেমে সবাই পোশাক বদলে নেয়। তাকেও বদলাতে হয়। পারিবারিকভাবে তারা বেশ সম্পদশালী তাই পোশাক আশাকও খারাপ নয়। তবে পোশাক বদলে তারা অতি সাধারণ পোশাক পরে নেয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার পাগড়ি পরা বাধ্যতামূলক। তাকে সাবধান করে দেওয়া হয় যাতে কোনো অবস্থাতেই পথে চলতে গিয়ে পাগড়ি পড়ে না যায়। পাগড়ি পড়ে যাওয়া নাকি অশুভ। ফিরিঙ্গিয়া অবাক হয়ে জানতে চায় কীসের জন্যে অশুভ। পাশ থেকে তার বাপ জানায় পথ চলার জন্যে। বাপের ভারী গলার গম্ভীর জবাব শুনে চুপ মেরে যায় ফিরিঙ্গিয়া। তবে মনের ভেতরে ঠিকই খচখচ করতে থাকে।
এভাবেই ওরা দিন সাতেক চলার ওপরেই থাকে। নিজেদের কোনো পরিচর্যা নেই, খাওয়া শুধুরুটি আর শুকনো ফল। সঙ্গে ডাল, শুকনো মাংস আর পেঁয়াজ থাকার পরও কেউ ওগুলোতে হাত দেয় না। পথ চলতে গেলে নাকি আমিষ খাওয়া বারণ। ফিরিঙ্গিয়ার মনের কৌতূহল বাঁধ মানে না। সে লুকিয়ে-ঘুমের ভান ধরে বড়োদের আলোচনা শোনার চেষ্টা করে কিন্তু লাভ হয় না। কারণ তারা নিজেদের ভেতরে আলোচনা করে এক বিচিত্র ভাষায়। ফিরিঙ্গিয়া সেই ভাষা বুঝতে পারে না। সে অপেক্ষায় থাকে।
তবে অপেক্ষার অবসান হয় শীঘ্রই। দিন সাতেক যেতেই তাদের দলের হালচাল পালটে যায়। পথের মোড়ে মোড়ে দলনেতারা বারবার দাঁড়িয়ে কী যেন দেখে, কী যেন খোঁজে। ফিরিঙ্গিয়া জানতে চায় না। কারণ ইতিমধ্যে সে বুঝে গেছে জবাব পাবে না। বরং সে অপেক্ষায় থাকে। যাত্রার নবম দিনে হঠাৎ এক রাস্তার মোড়ে তাদেরকে থামতে বলে দলনেতা, মানে তার বাবা। উৎসুক হয়ে কী যেন দেখছে সবাই হঠাৎ ওদের সামনে দিয়ে একটা খরগোশ দৌড়ে রাস্তাটা পার হয়ে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দলের বড়োরা গুঙিয়ে ওঠে। জরুরি সভা বসে। সিদ্ধান্ত হয় পথ পরিবর্তন হবে। আরো দুদিন পথ চলার পর দুপুরে খেয়েদেয়ে তারা বিশ্রাম করছে। কেউ হুঁকো টানছে, কেউ ঘুমিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। হঠাৎ মাথার ওপরে গাছের ডাল থেকে একটা কাক ডেকে ওঠে।
কাকের ডাক আর এমন কী? কিন্তু ওদের দলের ভেতরে যেন ঝলকের মতো বয়ে যায়। বড়োদের দুয়েকজন শোয়া থেকে উঠে বসে, বন্ধ হয় যায় তামাক টানা। আবারো কাক ডেকে ওঠে মাথার ওপরে, একবার নয় পর পর দুবার। সঙ্গে সঙ্গে দলের লোকজন সহাস্যে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘জয় মা ভবানী’ ফিরিঙ্গিয়া অবাক হয়ে সব দেখছিল। সেই ভর দুপুরেই পথ চলা শুরু করে তারা।
মাইল দুয়েকের মতো এগোতেই আট-দশজনের একটা দল দেখতে পায় ওরা। দলটাকে দেখে ওরা চাপা আনন্দ প্রকাশ করে নিজেদের ভেতরে। ফিরিঙ্গিয়া শুনতে পায় কেউ একজন বলে ওঠে : মা ভবানীর ইশারা কখনো ভুল হতে পারে না। ভেতরে ভেতরে কৌতূহলে ফেটে পড়লেও চুপ থাকে সে। একটু পরেই অবসান হয় তার সব কৌতূহল। দলটার সঙ্গে গিয়ে তারাও বসে পড়ে। দলের ভেতরে লোকজন গল্প শুরু করে দেয়।
তাঁতের কাপড়ের ব্যবসা করে এরকম একটা দল। ইন্দোরে গেছিল তারা, মাল বিক্রি করে ফিরে আসছে। দুপুরে খেয়ে যাত্রা বিরতিতে আছে এখন। নতুন দলটাকে দেখে তারা খুশি হয়। গল্পে গল্পে আসর জমে ওঠে। হঠাৎ ওদের দলের একজন ওকে ডেকে আড়ালে নিয়ে যায়। উঠে যাবার সময়ে সে শুনতে পায় দলের কেউ একজন ব্যবসায়ী প্রধানের কাছে জানতে চায়, সে তামাক খাবে কিনা। ওরা দুজনে হেঁটে একটু আড়ালে চলে আসতেই পেছন থেকে আবছাভাবে ফিরিঙ্গিয়া শুনতে পায় কেউ একজন চিৎকার করে বলছে, ‘তাম্বাকু লাও, হুজুরকে লিয়ে পান লাও’।
ফিরিঙ্গিয়া আর তার সঙ্গী এটা-ওটা আলাপ করছে আর হাঁটছে কিন্তু ফিরিঙ্গিয়ার মন পড়ে আছে পেছনের সেই ব্যবসায়ীদের ওখানে। তার মন বলছে ওখানে কিছু একটা হচ্ছে যেটা দলের লোকেরা তাকে দেখতে জানতে দিতে চায়না। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে দৌড় দেয় সে।
পেছন থেকে তার সঙ্গী থামাতে চেয়েও পারে না। সেকেন্ডের ব্যবধানে সে দৌড়ে চলে আসে গাছপালার আড়ালে, একটু আগে যেখানে সবাই বসেছিল সেখানে। এপারে আসতেই যা চোখে পড়ে সেটা দেখে মুহূর্তেই থেমে যায় সে। হঠাৎ থামতে গিয়ে দৌড়ানোর ঝোঁক সামলাতে না পেরে মাটিতে পেড়ে যায় ফিরিঙ্গিয়া। গাছপালার আড়ালে থাকার সময়ে ফিরিঙ্গিয়া মনে মনে অনেক কিছু ভেবেছিল কিন্তু চোখের সামনে সে যা দেখতে পায় সেই বীভৎসতার কোনো তুলনা নেই। এমনকি যুদ্ধের ময়দানের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থাকার পরও ফিরিঙ্গিয়ার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।
সেই সাত আটজনের দলের প্রায় সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে গলায় ফাঁস দিয়ে। তীব্র ফাঁসের টানে চোখের মণি জিভ অর্ধেক বেরিয়ে এসেছে একেকজনের। যাদেরকে পরে মারা হয়েছে তাদের দুয়েকজনের গলা থেকে এখনো ফাঁস খোলা হয়নি। বাকিদেরকে মেরে উলটো করে ফেলা হয়েছে। ফিরিঙ্গিয়া দেখতে পেল তার বাপ সেই ব্যবসায়ী প্রধানের পিঠের ওপরে উঠে মৃত লোকটার থুতনির নিচে শক্ত হাতে ধরে কটাস করে লাশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিল। মেরুদণ্ড ভেঙে সে উঠে এলো লোকটার ওপর থেকে। সে সরে যেতেই দুজনে এসে লাশের পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি সব বাইরে বের করে ফেলল। বীভৎস দৃশ্যটা দেখে আরেকটু হলেই পেটের ভেতর থেকে সব উগড়ে দিয়েছিল ফিরিঙ্গিয়া।
মিনিট দশেকের ভেতরেই সব হয়ে গেল। প্রায় প্রতিটা লোকের ভাগ্যে একই পরিণতি ঘটলো। সবাইকে ফাঁস দিয়ে মেরে, ভেঙে দেওয়া হলো মেরুদণ্ড, পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে লাশটা মুড়িয়ে ফেলা হলো সাদা কাপড়ে। ওরা যখন এসব কাজ করছিল, একদল পাহারা দিচ্ছিল আর অন্য দল রাস্তার পাশের একটু নিচু জমিতে মাটি খুঁড়ছিল। ফিট পাঁচেক খোড়া হতেই নিপুণ হাতে সবগুলো লাশ দাফন করে গাছের পাতা দিয়ে সব চিহ্ন ঢেকে ব্যবসায়ীদের সব টাকা পয়সা ভাগ- বাটোয়ারা করে ওরা সেখানে বসেই তামাক টানতে লাগল। ফিরিঙ্গিয়া অনুমান করল সব মিলিয়ে একঘণ্টাও হয়নি আট-দশ জনের সেই দলটা স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে ধরিত্রীর বুক থেকে।
এরকম কিছু হতে পারে সেটা কারো কল্পনাতেও আসবে না। সেদিন সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি। নিজের ভেতরে এক অদম্য উত্তেজনা অনুভব করছিল। এভাবে প্রায় একমাস পথে থাকে ওরা। এই এক মাসে অন্তত দশ থেকে বারোটা এরকম দলকে সুযোগ বুঝে গায়েব করে দেওয়া হয়। প্রতিটি ঘটনাই ঘটে ফিরিঙ্গিয়ার চোখের সামনে কিন্তু তাকে ধরতে দেওয়া হয় না। এটাই নিয়ম। ফিরিঙ্গিয়া আবিষ্কার করে—ওরা নিয়ম ছাড়া কিছুই করে না। প্রত্যেকেরই মূল্যবান জিনিসপত্র টাকা পয়সা লুটের পর প্রাথমিকভাবে জমা থাকে দলনেতার কাছে। তারপর সে নিখুঁত হিসেবে সেগুলো ভাগ করে দেয় সবার মাঝে।
এই একমাসে সে অনেক কিছুই শেখে। সবার আগে শেখে নিয়ম। ঠগীরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল আর নিয়ম-নীতি পরায়ণ। নিয়মেরই বাইরে তারা কিছুই করে না। প্রতিটি কাজ তারা করে সময় মেনে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। সুশৃঙ্খলা আর নিয়মের পরে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো দেবীর নির্দেশ।
ঠগীরা বিশ্বাস করে তারা যা করছে সবই শুধুমাত্র দেবীর প্রতি ভক্তি থেকে করছে, তারা বিশ্বাস করে দেবী সবসময়ই তাদের মাঝে বিরাজমান। সবসময় তিনি ভক্তদের ভালো-মন্দের ব্যপারে খেয়াল রাখছেন, সতর্ক করে দিচ্ছেন, আর সেই সঙ্গে সর্বক্ষণই দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন নির্দেশ। বেশিরভাগ নির্দেশনাই তারা গ্রহণ করে প্রকৃতি আর পশুপাখির নানা ধরনের আচরণ থেকে। এই কারণে ঠগীরা বলে পশু-পাখি আর প্রকৃতি হলো তাদের গণক ঠাকুর, পাজি-পুঁথি। একারণেই তাদের জীবনে শুভ আর অশুভের ফর্দটা বিরাট।
যেমন যাত্রা শুরু হবার পর মাথা থেকে পাগড়ি পড়ে যাওয়া অশুভ, যাত্রার প্রথম কয়দিন আমিষ খাওয়া, মুখে খৌরি করা অশুভ; যাত্রপথে রাস্তায় খরগোশ দেখতে পাওয়া অশুভ, সেক্ষেত্রে যাত্রাপথ পরিবর্তন করতে হবে; রাতের বেলা ঘুঘুর ডাক শুনতে পেলে সেটা চরম অশুভ।
আবার যাত্রার সময়ে মাথার ওপরে কাক ডেকে ওঠা খুবই শুভ, বাড়ি থেকে বের হয়েই কোনো কুকুরের সামনে পড়া শুভ। এরকম হাজারো লক্ষণকে শুভ- অশুভ মেনেই জীবন যাপন করে তারা। এগুলোকেই ওরা প্রতিনিয়ত দেবীর নির্দেশ মনে করে চলে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচালে দুলতে দুলতে ফিরিঙ্গিয়া একে একে এগুলো সব শিখে নিতে থাকে বর্ষীয়ান এক বুড়ো ঠগীর কাছ থেকে। সে জানতে পারে প্রাকৃতিক কোনো লক্ষণ না থাকলেও দেবীর নির্দেশ গণনা করে বের করা যায়।
এই বুড়ো ঠগীই তাকে শেখায় ঠগীদের ইতিহাস, তাদের সংস্কৃতি সেই সঙ্গে ওদের বুলি। ঠগীদের কোনো আলাদা ধর্ম নেই, যে যেই ধর্ম থেকেই আসুক ঠগী হিসেবে দীক্ষা নেওয়ার পর তারা সবাই শুধু ঠগী ধর্মই পালন করে, শুধুমাত্র মা ভবানীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। তার কাছেই ফিরিঙ্গিয়া জানতে পারে ঠগীদের এমনকি নিজেদের ভাষাও রয়েছে। লোক সম্মুখে নিজেদের ভেতরে আলোচনার সময়ে, শিকার করার সময়ে তারা এই বুলিই ব্যবহার করে। এই বুলিকে তারা বলে ‘রামসি’। এই ভাষাতেই দলপতির কোদালকে বলে ‘কাসসি’, শিকারের ওপরে আক্রমণকে বলে ‘ঝিরণী দেয়া’, ‘তাম্বাকু লেও, পান লেও’ অর্থাৎ এবার শিকারের ওপরে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। এরকম হাজারো শব্দ, বাক্য সে শিখে নিতে থাকে। প্রথমবারের যাত্রায় সে প্রতিবার ঝিরণী দেওয়ার সময়ে নিজের ভেতরে সেই হিংস্র সত্তাটাকে বার বার ভিন্নভিন্নভাবে আবিষ্কার করতে থাকে। এতদিনে ফিরিঙ্গিয়া অনুভব করে এবার নিজের ভেতরের সেই খাপখোলা তলোয়ারকে কাজে লাগাতে পারবে। সে ধীরে ধীরে সেই তলোয়ারকে শান দিতে থাকে।
প্রথমবার যাত্রার পরে সে তিন মাসের বিরতির পর আবারো দ্বিতীয় যাত্রায় রওনা দেয়। এই তিনমাস সে শুধু একটা কাজই করেছে-রুমাল দিয়ে খুন করার চর্চা। ঠগীরা এক টুকরো হলুদ কাপড়ের ফাঁসকেই তাদের প্রধান হাতিয়ার মনে করে। ব্যাপারটা খুব সহজ আর জিনিসটা খুবই সুন্দর। দুই ফিট লম্বা সাধারণ কাপড়ের একটা হলুদ রুমাল। অন্য যেকোনো সময়ে ওরা সেটা কোমরেই গুঁজে রাখে কোমর বন্ধনির সঙ্গে। তবে এই রুমালের এক প্রান্তে থাকে একটা পয়সা।
সিঁদুর মাখানো পয়সাটাকে রুমালের এক প্রান্তে গিঁট দিয়ে আটকে রাখা হয়। দিনের অন্যান্য সময়ে কোমর বন্ধনীর সঙ্গে রাখা পয়সা লাগানো সাধারণ এই রুমালই শিকারের সময় হয়ে ওঠে ভয়ংকর অস্ত্র।
দ্বিতীয় অভিযানের সময়ে ফিরিঙ্গিয়া যখন প্রথমবারের মতো একজনের গলায় রুমাল পরায়, তখন সে অনুধাবন করতে পারে বাকি জীবন তাকে এই কাজই করতে হবে। কারণ এরচেয়ে প্রশান্তি সে এর আগে কখনো অনুভব করেনি। এরপরে শপথ গ্রহণের পর সেই তুপানির গুড়। ফিরিঙ্গিয়া বিশ্বাস করে এই গুড় যে একবার মুখে দিয়েছে সে কোনো দিন ঠগী ধর্ম থেকে বেরুতে পারবে না। প্রথমবার তুপানির গুড় মুখে দেওয়ার সময়েই সে সমস্ত অবিশ্বাস আর সন্দেহের দোলাচাল থেকে বেরিয়ে আসে। আজো সেই তিতকুটে মিষ্টি স্বাদের মহিমা… 1
‘সর্দার, ভোজ তৈয়ার হয়ে গেছে,’ হঠাৎ কানের কাছে কেউ একজন বলে উঠল। নেশায় বিভোর চোখ খুলে ফিরিঙ্গিয়া তার বাপের দিকে তাকাল। সে মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই ফিরিঙ্গিয়া খাবার পরিবেশনের আদেশ দিল। খাবার খুব সাধারণ। সাদা ভাত আর দেবীকে উৎসর্গ করা সেই ছাগলের ঝাল মাংস। এমনকি এই বিশেষ ভোজেরও ওদের নিয়মনীতি আছে। খেতে হবে দেবীর সামনে চক্রাকারে বসে, খাবার পর সব ধরনের উচ্ছিষ্টাংশ সাবধানে একসঙ্গে করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে যাতে কারো পায়ের নিচে না পড়ে কিংবা কোনো পশুপাখি সেগুলোকে টানাটানি না করে। এতে দেবীর অসম্মান। অল্প সময়েই খাওয়া হয়ে যেতেই তারা সেখানেই গোল হয়ে আলোচনায় বসল। পরিবেশন করা হলো তামাক আর পান। এই দুটো জিনিসই তাদের মৌলিকত্বের প্রতীক। পান চিবুতে চিবুতে আর তামাক টানতে টানতে এবার আলোচনা চলবে।
বিষয় দুটো : বর্তমান পরিস্থিতি আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।