অধ্যায় চৌত্রিশ – বর্তমান সময়
শশীলজ, কাচারি রোড, ময়মনসিংহ
‘তাজ্জব ব্যাপার! এইৱহম তো কিছু দেহি নাই কুনো সময়,’ রমিজ দারোগা অবাক হয়ে বলে উঠল শশীলজের স্নানাগারের খুলে যাওয়া অন্ধকার প্যানেলটার দিকে তাকিয়ে।
বাশার নিজেও বেশ অবাক হয়ে গেছে; এরকম কিছু সে নিজেও আসলে কল্পনা করেনি। একবার প্যানেলটার দিকে তাকাল ও আরেকবার বাইরে দেখল। শেষ বিকেলের আলো কমে গিয়ে ইতিমধ্যেই সন্ধে নামতে শুরু করেছে।
‘রমিজ সাহেব, আবদুল্লাহ-আপনারা দুজনেই বাইরে চলে যান। আমাদের জিপটাকে পুকুর পাড়ের যতটা সম্ভব কাছাকাছি এনে রাখেন। আর শোনেন,’ বলে সে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখল। ‘এখুনি থানায় এই ব্যাপারে জানানোর দরকার নেই। আগে দেখি কী পাওয়া যায়। একটু সাবধানে থাকবেন,’ কেন জানি বাশারের মনে অজানা আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে। বারবার গতকাল দুপুরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ওই লোকটা রিফাতের বাড়িতে কীভাবে পৌঁছেছিল এখনো সে বুঝে উঠতে পারেনি। কাজেই সাবধান থাকতে হবে।
দুজনকেই বিদায় দিয়ে ও ফিরে এলো সদ্য খুলে যাওয়া অন্ধকার প্যানেলটার মুখের সামনে। রিফাত আর জয়া মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে দেখার চেষ্টা করছে ভেতরে। ‘এভাবে হবে না,’ বলল ও পকেট থেকে ছোটো কিন্তু শক্তিশালী একটা লাইট বের করল। ‘আমাদেরকে ভেতরে যেতে হবে,’ বাশার লাইট মেরে দেখছে ভেতরে। প্যানেলটার আকৃতি হবে চার ফিট বাই পাঁচ ফিট। গহ্বরের মুখটা একেবারেই অন্ধকার। তবে ওটার দিকে তাকিয়ে বাশারের খুব বেশি বড়ো মনে হলো না প্যানেলটা। ‘আমি ভেতরে ঢুকছি। চাইলে তোমরা আসতে পারো।
‘কিন্তু যদি আটকে যায়?’ রিফাতের ভয়ার্ত গলা।
‘সমস্যা কী? আটকে গেলে রমিজ দারোগা আর আবদুল্লাহ তো আছেই,’ জবাব দিল বাশার। তার গলা একেবারেই শান্ত। ‘তবে হ্যাঁ, পুরনো দিনের এইসব জায়গায় অনেক ধরনের বুবি ট্র্যাপ থাকে, কাজেই সাবধান,’ বলে সে চলে এলো বাশারের পেছনে। বাশার লাইট হাতে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। জায়গাটাকে আসলে প্যানেল না বলে ছোটো একটা করিডর বলা উচিত। বাশার লাইট হাতে ছয় সাত ফিটের মতো এগিয়ে গেল সামনেই করিডর শেষ হয়ে আসছে। করিডরটার শেষ মাথায় এসে দেখল বাঁয়ে মোড় নিয়েছে ওটা। বাঁয়ে আরো কয়েক ফিট এগোনোর পর ছোটো একটা কামরার মতো জায়গায় প্রবেশ করল ওরা। একটু স্যাঁতসেতে ভাব থাকলেও এতক্ষণ জায়গাটা একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর শান বাঁধানো থাকলেও ছোটো কামরাটাতে প্রবেশ করতেই দেখা গেল ওটার একটা পাশ ধসে গেছে। মেঝে দেওয়ালেরও বিভিন্ন অংশে উঠে গেছে চলটা।
‘আমার মনে হয় এটা জমিদারদের কোনো গোপন পথ ছিল। হয়তো আসামের সেই ভূমিকম্পে ধসে গেছে জায়গাটা কিন্তু এর মুখটা ঠিকই কার্যকর রয়ে গেছে,’ রিফাত আনমনেই বলে উঠল।
‘আর সেই জায়গাটা ঠিকই ডেভিড তার রিসার্চে বের করে ডাকাতির সময়ে কাজে লাগিয়ে ফেলেছে,’ বলে বাশার ইশারা করল কামরাটার ভাঙাচোড়া ধ্বংস স্তূপের একপাশে। ভাঙাচোরা স্ল্যাব আর এটা ওটার ছোটো একটা স্তূপের পাশেই রাখা একটা কালো রঙের ব্যাগ।
‘সর্বনাশ! এই ব্যাগটাই তো, রিফাতের কথাটা শেষ করে দিল জয়া। ‘ডেভিডের হাতে ছিল,’ বলেই সে হাঁটু গেড়ে গিয়ে বসে পড়ল ব্যাগটার সামনে। পলিথিনের খচখচে শব্দ তুলে আলগা করে ফেলল মূর্তিটার বাইরের আবরণ। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ঘনকালো রঙের একটা মূর্তি। ফিট তিনেক উঁচু মূর্তিটার এখানে-ওখানে ময়লা লেগে সাদা হয়ে আছে। দুয়েক জায়গায় সবুজ শ্যাওলাও দেখা গেল কিন্তু মূর্তিটার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে, কোথায় যেন একটা কালচে আভিজাত্য আছে, সেই সঙ্গে যেন একটা সম্মোহনী ক্ষমতা।
মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে এর কারিগরের প্রশংসা না করে পারল না বাশার। কালীর ভেতর থেকে শক্তি, ক্ষমতা আর অন্ধকারের অন্য এক জগতের হাতছানি টের পাওয়া যায়। মনে মনে নিজেকে গালি দিল বাশার। কল্পনাশক্তি বেশি হয়ে যাচ্ছে।
জয়া এখনো মূর্তিটার সামনেই বসে আছে। আলতো করে হাত বুলাচ্ছে ওটার গায়ে। ‘এতদিন পর, অবশেষে,’ সে খুব আবেগি হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বাশার বেরসিকের মতো বাধা দিল। ভারী মূর্তিটা দুই হাতে তুলে ধরে আবারো পলিথিন মুড়িয়ে ফেলল। ‘আমাদেরকে যেতে হবে। এখান থেকে যত দ্রুত সরে পড়া যায় ততোই ভালো। চলো চলো।’
বাশার মূর্তিটা প্রথমে দুই হাতে নেওয়ার চেষ্টা করল। আকৃতির তুলনায় মূর্তিটা ভারী। ওটাকে কাঁধের ওপরে তুলে নিলো সে। রিফাতকে নির্দেশ দিল আলো হাতে আগে থাকতে। আর জয়াকে বলল, ‘তুমি আগে যাও। গিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে তোমার গাড়িটা পুকুরের পাড়ে নিয়ে এসো।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে আগে আগে রওনা দিল। বাশার মাঝখানে আর রিফাত ওর পেছনে। প্যানেল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতেই রিফাত জানতে চাইল। ‘এটা এভাবে খোলাই থাকবে নাকি বন্ধ করে দিতে হবে?’
এক মুহূর্ত ভাবল বাশার। ‘আপাতত এরকমই থাক, পরে বন্ধ করে দেওয়া যাবে। আবদুল্লাহ বা রমিজ দারোগাকে বলবো এটা বন্ধ করে দিতে। আসলে এই মুহূর্তে আমি এটা নিয়ে চিন্তিত আছি,’ বলে ও মূর্তিটা দেখাল। ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটাকে নিরাপদ কোথাও নিতে না পারলে স্বস্তি পাচ্ছি না। ‘
ওরা দুজনে মিলে স্নানাগার থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। বাইরে একেবারেই অন্ধকার হয়ে গেছে। কিন্তু বাইরে এসে জিপ, জয়ার গাড়ি কিংবা আবদুল্লাহদের কাউকেই দেখতে পেল না ও। ‘কী ব্যাপার, সব গেল কোথায়?’
‘হ্যালো, ম্যান,’ অচেনা একটা গলা ভেসে এলো অন্ধকারের ভেতর থেকে সেই সঙ্গে ধাতব একটা শব্দ। পুলিশের চাকরি করে এই ধাতব শব্দ চিনতে না পারার কোনোই কারণ নেই।
অস্ত্র লোড করার শব্দ। আওয়াজ শুনে বাশার অনুমান করল মাঝারি সাইজের কোনো অস্ত্র। পিস্তলের চেয়ে বড়ো, বন্দুকের চেয়ে অবশ্যই ছোটো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মানুষটা। গতকালের সেই লোক। এই লোকই রিফাত সেজে ওদের সঙ্গে কথা বলেছিল। এই লোকের সঙ্গেই গতকাল ওর হাতাহাতি হয়েছিল। লোকটাকে দেখা মাত্রই বাশার হাতের মূর্তিটা ফেলে দিয়ে পিস্তল বের করে আনলো নিজের কোমর থেকে। একহাতে রিফাতকে আড়াল করল নিজের পেছনে।
‘আস্তে অফিসার,’ বাশার দেখল লোকটার হাতে একটা নল কাটা শটগান। এটা দিয়ে গুলি করলে শরীরে ফুটবলের সমান গর্ত হবে। যদিও অস্ত্রটা ওর দিকে তাক করা না। ওটার নল মাটির দিকে। তবুও ও চিৎকার করে অস্ত্র ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দিল।
‘আরে, আপনাকে বললাম না ধৈর্য ধরতে। যদিও পুলিশ হিসেবে আপনি যথেষ্টই স্ট্যামিনা রাখেন। আমি ইমপ্রেসড। তবে লাভ নেই অফিসার। একটু আমার পেছনে তাকান। লোকটার পেছনে একটা ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠেই নিভে গেল কিন্তু তাতেই যা দেখার দেখে নিয়েছে বাশার। দুইপাশে দুজন মানুষ পিস্তল ধরে আছে, আর তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রমিজ দারোগা আর আবদুল্লাহ।
‘বুঝতেই পারছেন পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে, কাজেই যা বলি শুনুন, মন দিয়ে শুনুন,’ বলেই লোকটা মৃদু হাসি দিল। এই হাসিকে বলে বিজয়ের হাসি।
বাশার থ্রিলার বইতে পড়েছে এরকম পরিস্তিতিতে নাকি মানুষের গলা শুকিয়ে যায়, শিড়দাড়া বেয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত নামতে থাকে।
ও মনে মনে ভাবল থ্রিলার বইতে যা পড়েছে ব্যাপারটা ভুল নয়।