অধ্যায় ত্রিশ – বর্তমান সময়
বাউন্ডারি রোড, ময়মনসিংহ
‘আচ্ছা, এই ঠগীদের উৎপত্তি কোথা থেকে?’ রিফাত হেনরি স্লিম্যানের ঘটনা বর্ণনা করছে এমন সময় বাশার জানতে চাইল
‘এদের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মিথই প্রচলিত আছে। তবে ঠগীদের অস্তিত্বের ব্যাপারে সবচেয়ে পুরনো যে মিথগুলো প্রচলিত আছে তার মধ্যে অন্যতম একটা হলো এরা নাকি পারস্যের রাজা জেরেক্সিসের সেনাবাহিনীর একটা অংশ ছিল।’
‘জেরেক্সিসকে চিনতে পেরেছো তো?’ রিফাতের কথার মাঝখানে জয়া বলে উঠল। ‘সেই যে স্পার্টার রাজা লিওনাইডাসের তিনশ সৈন্যের সঙ্গে যার বাহিনীর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই জেরেক্সিস। এই অংশটা আমি জানি,’ বলে সে রিফাতের দিকে তাকাল বলার অনুমতির জন্যে। রিফাত মাথা নাড়তেই সে শুরু করল। ‘আমি যতদূর জানি, সেটা ভুল হলে তুমি ঠিক করে দিয়ো প্লিজ। জেরেক্সিসের সেনাবাহিনীর একটা অংশ নাকি এশিয়ান বংশদ্ভূত ছিল। এই বাহিনীর আবার একটা অংশ নাকি ছিল যাদের একমাত্র অস্ত্র ছিল চামড়ার ফালি। ওরা নাকি চামড়ার ফালি গলায় পরিয়ে মানুষ খুন করত।’
‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। জেরেক্সিসের বাহিনীর এই অংশটা আদৌ ঠগীদেরই পূর্বপুরুষ ছিল কি না সেটা সঠিকভাবে বলা কিংবা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক যে ওদের সঙ্গে ঠগীদের অনেক মিল আছে। প্রচলিত আছে পারস্য যুদ্ধ শেষ হবার পর নাকি এই চামড়া বাহিনীর একটা অংশ পায়ে হেঁটে ভারতে চলে আসে। হয়তো ওরাই এই ভারত উপমহাদেশে ঠগী সংস্কৃতির গোড়াপত্তন করে। তবে এদের অরিজিনের ইতিহাস যাই হোক না কেন, এরা যে অনেক প্রাচীন সেই ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই। কারণ ভারতের ইলোরাতে অনেক প্রাচীন গুহাতে ওদেরকে নিয়ে অনেক দেয়াল-চিত্র আছে। অনেক মূর্তি আছে। তবে এইসব দেয়াল-চিত্রগুলোতে দেখা যায় রুমাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে ঠগী বাহিনী। কেউ শিকারের গলায় রুমাল পরাচ্ছে। কেউ শিকারকে খুন করার পর পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করছে। কেউ আবার ভবানীর পুজো করছে। কিছু কিছু ছবিতে দেখা যায় দেবী তার সন্তানদের আশীর্বাদ করছে। এই আরকি।’
‘আচ্ছা সব বুঝলাম, ঠগী কারা, কোথা থেকে এসেছে এসবও বুঝলাম,’ ঠগী যারাই হোক আর তাদের ইতিহাস যাই হোক সেই ব্যাপারে বাশারের তেমন আগ্রহ নেই। সে বরং বর্তমান নিয়ে বেশি আগ্রহী। ‘তো এর সঙ্গে বিজয় আচার্যের সংযোগটা হলো কীভাবে?’ বাশার প্রশ্ন করল।
‘সেই সিন্দুকের জিনিসপত্র ক্লেইম করে তো সে পেল না, কিন্তু ওগুলো নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেল। সেই জিনিসগুলোর ভেতরে এক ইংরেজ অফিসারের ডায়েরি ছিল। ডায়েরিটার অর্ধেকের বেশি পোকায় কেটে নষ্ট হয়ে গেছিল কিন্তু প্রথম যে অংশটুকু ঠিক ছিল সেটুকু পড়ে বিজয় জানতে পারে : তার পূর্বপুরুষদের একটা অংশ ঠগী ছিল। সেখান থেকে সে ঠগীদের নিয়ে গবেষণা শুরু করে। আগেই তো বলেছি ঠগীরা ছিল কালী সাধক। বিজয় নিজেও কালী সাধনা শুরু করে। এথেকে সে জানতে পারে ঠগীদের আইকনিক কালী মূর্তি ছিল যেটা সারা বিশ্বে ‘টুইন কালী’ নামে পরিচিত। কথিত আছে এই মূর্তির নাকি অস্বাভাবিক শক্তি আর ক্ষমতা আছে,’ রিফাতের কথার মাঝখানে থামিয়ে দিল বাশার।
‘আসলেই কি আছে? নাকি এগুলো সবই গালগল্প?’ ও জানতে চাইল।
‘যেকোনো মিথ গালগল্প থেকেই তৈরি হয়। যেকোনো ব্যাপারে প্রথমে গালগল্প তৈরি হয় তারপর সেটা থেকে ধীরে ধীরে কিছু সত্য মিশে অথবা না মিশে তৈরি হয় মিথ,’ জয়া বলে চলল। ‘কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে সেটা গরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো কিছু মানুষের সেটা বিশ্বাস করা আর না করা নিয়ে। আর যেকোনো অ্যান্টিক জিনিসের ক্ষেত্রে এধরনের মিথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিথ যত বাড়তে থাকে অ্যান্টিক নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনা ততো বাড়তে থাকে। আর মানুষের জল্পনা- কল্পনা যত বেশি অ্যান্টিকের দামও ততো বেশি।’
‘আমি আপনার সঙ্গে পুরোপুরি একমত, রিফাত জয়ার সঙ্গে সহমত পোষণ করল। ‘এই টুইন কালীর ব্যাপারটাও একইরকম। সেই ব্রিটিশদের সময় থেকে, বিশেষ করে স্লিম্যানেরসঙ্গে ঠগীদের সংঘর্ষের পর থেকেই এই টুইন কালী নামক জোড়া কালী মূর্তি বিখ্যাত হয়ে ওঠে। হিন্দু দেবী মডার্ন কালচারে যেরকম বিখ্যাত, ঠগীরাও ঠিক একই রকম রহস্যময়। যেমন উদাহরণ দিচ্ছি; ইংরেজি ‘Thug’ শব্দটা আসলে এসেছে এই ঠগীদেরই ইংরেজি নাম ‘Thugee’ থেকে। এমনকি বাংলা শব্দ ‘ঠগ’ কিংবা বাংলা বাগধারা ‘ঠগ বাছতে গা উজার’ এইসবেরও উৎপত্তি ঠগীদের ঘিরেই। এ তো গেল ঠগীদের বৃত্তান্ত। অন্যদিকে হিন্দু দেবী মা কালীও মডার্ন কাল্টগুলোর একটি। হিন্দুদের দেবী হবার পাশাপাশি খ্রিস্টানদেরও তাকে নিয়ে নিজস্ব মতবাদ আছে,’ এই পর্যন্ত বলে রিফাত হেসে উঠল। ‘এমনকি অনেক আধুনিক সেলিব্রেটিও কালী সাধনা করে, তাকে কাল্ট হিসেবে মানে।’
‘তাই নাকি? যেমন?’
‘যেমন ধরো পপ গায়িকা মাইলি সাইরাস। সে খুবই সুপরিচিত কালী সাধক। প্রায়ই দেখবে বিভিন্ন ভঙ্গিতে সে কালীর নকল করে জিহ্বা বের করে ছবির পোজ দেয়। আলবেনীয় বংশোদ্ভুত বৃটিশ গায়িকা ডুয়ালিপাও জ্বিভ বের করে পোজ দেয়। সে অবশ্য কালী সাধক কিনা জানায় যায়নি। তবে এদের মতো এরকম আরো অনেক আছে।’
‘ছাগলামি আরকি,’ বাশার বলে উঠল।
‘সেটা তোমার কাছে মনে হতে পারে তবে অনেকের কাছে এটাই সিরিয়াস ব্যাপার। প্রশ্নটা পাগলামির নয়, প্রশ্নটা হলো ঠগী আর কালী দুটোই সেই প্রাচীন যুগ থেকেই বহুল আলোচিত আর রহস্যময় বিষয়। আর এই রহস্যের কেন্দ্রে চিরকালই আবর্তিত হয়েছে এই জোড়া কালী মূর্তির নাম। তো যাই হোক, বিজয় তার পূর্বপুরুষের ঠিকুজি কুঠি থেকে জানতে পারে এই জোড়া কালী মূর্তির একটা চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। অন্য কালী মূর্তিটা নাকি বিখ্যাত ঠগী শিকারি উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যানের রাইট হ্যান্ড কর্নেল জেমস ম্যাকফি ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে তার পরিবারের সদস্যরা সেটা স্থানীয় মিউজিয়ামে দিয়ে দেয়। সেটা নাকি ইংল্যান্ডের সেই মিউজিয়ামেই রাখা আছে।
‘এই মূর্তি নিয়ে কথা বলতেই বিজয় প্রথমবারের মতো আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। তার কথায়, তার পরিবারের ইতিহাসের ওপরে দখল দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। সে প্রস্তাব দেয় কোনোভাবে যদি ময়মনসিংহের ইতিহাসের এই হারিয়ে যাওয়া অংশটা উদ্ধার করা যায় তবে দারুণ হবে। আমি নিজেও দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়ে যাই। আর তাছাড়া ওর নিজের ইতিহাস শুনে ছোটোবেলা থেকে সংগ্রামের কথা শুনে আমি খানিকটা প্রভাবিতও হয়ে যাই। ও সবসময় হাতে এরকম একটা আংটি পরে থাকত,’ বলে ও জয়ার হাতের একটা আংটির দিকে নির্দেশ করল।
নিজের হাতের আংটিটা দেখিয়ে হেসে উঠল জয়া। ‘এরকম? আমি এটা কিনেছি নিউ মার্কেট থেকে। এটার ওপরে বসানো প্রজাপতিটা খুব ভালো লেগে গেছিল আমার।’
‘বিজয়ের আংটিটা দেখে প্রথমদিনই আমি অবাক হয়ে যাই। কারণ আংটিটাতে একটা গুবরে পোকার ছবি ছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই গুবরে পোকার ছবিওয়ালা আংটি কেন পরে থাকে ও। জবাবে ও আমাকে জানায় ও ব্যক্তিগতভাবে ফ্রানৎজ কাফকার বিরাট ভক্ত। নিজেকে ও মনে করত কাফকার বিখ্যাত সৃষ্টি ‘মেটামরফোসিস’ এর গ্রেগর সামসার মতো। গ্রেগর সামসা মানুষ থেকে গুবরে পোকায় রূপান্তরিত হয়েছিল আর ও বলত ওর নিজের রূপান্তর নাকি এখনো শেষ হয়নি। যাই হোক আমি আর ও মিলে সরকারিভাবে খোঁজ লাগাতে শুরু করি কীভাবে সেই টুইন কালীকে দেশে নিয়ে আসা যায়। সেই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দশজন উপদেষ্টার একজন ছিল আমার আত্মীয়। আমরা তাকে গিয়ে ধরলে উনি আন্তর্জাতিকভাবে খোঁজ খবর শুরু করেন। সেই সময়েই ডেভিড এসে জোটে আমাদের সঙ্গে। সে নিজেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায় সে ইংরেজ সরকারের একজন প্রতিনিধি। চাইলে সে এটার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।
‘তার প্রস্তাব শুনে আমি আর বিজয় খুশি হয়ে উঠি। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এটা- ওটা করতে করতে আমরা তখন বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তবে আমি তখনো জানতাম না যে বিজয় আর ডেভিড দুজনেই আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে। দুজনে আসলে দুধরনের মতলব নিয়ে কাজ করছিল। বিজয় আমাকে ধোঁকা দিচ্ছিল কারণ সে আমাকে বলেছিল ময়মনসিংহের ইতিহাসের একটা অংশ সেই সঙ্গে তার পরিবারের ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া একটা অংশ নিয়ে গবেষণা করতে চায়, আসলে সে চাইছিল অন্য কিছু। অন্যদিকে ডেভিড বলেছিল সে ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধি, সে আসলে ছিল একজন আন্তর্জাতিক অ্যান্টিক চোর। তবে বিভিন্ন মহলে তার যোগাযোগ ছিল খুবই ভালো। সে আমাদেরকে ব্যবহার করে টুইন কালীকে মিউজিয়াম থেকে বের করে এই দেশে আনতে চাইছিল যেকোনোভাবে। এরা দুজনে কখন একসঙ্গে হয়েছে কখন মিউজিয়ামে ডাকাতির পরিকল্পনা করেছে আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি,’ বলে রিফাত একটু থামলো।
‘ডাকাতির ঘটনাটা যখন ঘটে ঠিক ওই সময়েই মূর্তিটার সিকিউরিটি ছিল সবচেয়ে কম। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো আমার ধারণা ছিল ডেভিড আর বিজয় মিলে চুরি করলেও ডেভিড ছিল বহুত চালু মাল, সে ঠিকই বিজয়কে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। আর তার কাছে ধোঁকাবাজির শিকার হয়ে বিজয় বোকার মতো তার ফাঁদে পা দিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো যদি ডেভিড পানিতে ডুবে মরে থাকে, বিজয় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মরে থাকে তবে টুইন কালী কোথায় গেল? এতদিন ধরে সবাই যা ভেবে এসেছিল সবই তো ভুল প্রমাণ হয়েছে আপনি পুকুরের নিচ থেকে ডেভিডের মৃতদেহ উদ্ধার করার পর।’
‘টুইন কালী এই শহরেই আছে,’ অনেকটা ঘোষণা দেওয়ার মতো করে বলে উঠল জয়া। ‘আর সেটা এই শহরের চৌহদ্দির ভেতরেই আছে। কারণ শশীলজ থেকে ডাকাতি হয়েছে রাত আটটায়। আপনার বন্ধুর ভাষ্য অনুযায়ী ডেভিড পানিতে ডুবেছে রাত এগারোটার দিকে। নিশ্চয়ই সে এর মধ্যেই কোথাও মূর্তিটা সরিয়ে ফেলেছে।
‘এখানে অবশ্য আরেকটা ভার্সন আছে। আমরা একজন মানুষকে স্কিপ করে গেছি। বিজয়ের একজন সহকারী ছিল। মোক্তার নাম, ময়মনসিংহেরই দাপুনিয়ার এক ছেলে, খুব চালু। সে প্রায় এই পুরো ব্যাপারটাতেই বিজয়ের সঙ্গে ছিল। ডাকাতির ঘটনার পর ওই ছেলেকেও আর দেখা যায়নি।’
জয়া একটু রাগের সঙ্গে রিফাতের দিকে তাকাল। ‘আপনার কি মনে হয়, ডেভিডের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিমিনালকে এই দাপুনিয়ার ছেলে বোকা বানিয়ে কালী মূর্তি নিয়ে পালিয়েছে?’
‘আমি ঠিক সেটা বলিনি,’ রিফাত একটু যেন বিব্রত। ‘অমি যেটা বলছি এমনও তো হতে পারে বিজয় ডেভিডকে মেরে মূর্তিটা নিয়ে পালিয়ে ছিল তারপর কোনো কারণে তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হয়, আর গিয়ে সে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়ে।’
‘সেটা খুবই দুর্বল যুক্তি। আর সেক্ষেত্রেও তো মূর্তিটা এই শহরেই রয়ে গেছে, ‘ জয়া বাধা দিয়ে বলে উঠল। ‘কারণ বিজয়ই যদি ডেভিডকে মেরে থাকে তবে সে-ও তো মূর্তিটা নিয়ে পালাতে পারেনি।’
‘এক মিনিট, আমরা এতটা উত্তেজিত না হই,’ বাশার বলে উঠল। ওর ইনভেস্টিগেটিভ মাইন্ড ওকে বলছে পরিস্থিতি অ্যানালাইসিস করে দেখতে। ‘আমার ধারণা ডেভিড বা বিজয় কিংবা মোক্তার যার কথাই বলি না কেন, সত্যি যদি আমরা পুরনো রহস্যের কিনারা করতে চাই তবে আমাদেরকে এখান থেকে শুরু করতে হবে,’ বলে ও টেবিলের ওপরে রাখা বাক্সটা দেখিয়ে বলল। ‘এভাবে মুখেমুখে দিনরাত তর্ক করলেও কাজের কাজ কিছু হবে না। তারচেয়ে আমাদের কাছে এভিডেন্স যা আছে সেগুলো নিয়ে শুরু করতে হবে। আর শুরুটা আমরা এখান থেকেই করব।’
আর এখানে যদি কিছুই না পাই, তবে?’ প্রশ্নটা জয়ার।
ট্রাস্ট মি, বাশার, আমি কিছুই বাদ দিইনি। এই ঘটনার পরে যখন ডেভিডকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না, বিজয় মারা গেল…আমি ছিলাম পুলিশের সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে। ওরা আমার জীবন স্রেফ শেষ করে দিয়েছিল তবে আমার ভাগ্য ভালো ছিল দুটো কারণে। একদিকে আমার পরিবার ছিল প্রভাবশালী, অন্যদিকে আমার সঙ্গে আসলে বিজয় কিংবা ডেভিডের এই ডাকাতির ব্যাপারে কোনো সংযোগ ছিল না, সেটা আমি সবাইকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলাম কারণ ওপর মহল থেকে তখন চাপ আসছিল পুরো ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেবার। কর্তৃপক্ষ তখন আমার সঙ্গে একটা চুক্তিতে আসে। আমি সব হজম করে নেবো, এর বিনিময়ে আমাকে তারা আর ঘাঁটাবে না। আমি এই ঘটনার পরে বিদেশ চলে গেলাম পড়তে। যাই হোক, তখন আমি কোনো কিছুই বাদ দিইনি পরীক্ষা করতে। কাজেই আমি মনে করি এখানে খুব বেশি কিছু নেই, একটানা বলে রিফাত থামলো।
‘আমারও একই অভিমত, আমাকে যখন এই কেস থেকে বাদ দেওয়া হলো তখন আমিও ব্যক্তিগতভাবে কম চেষ্টা করিনি কিন্তু সত্যি কথা হলো ডাকাতির সময় থেকে শুরু করে ওই কয়েক ঘণ্টা আসলে কী ঘটেছিল তার কিছুই বের করা যায়নি,’ জয়া মৃদু কাঁধ ঝাকিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো।
বাশার বড়ো করে দম নিলো একবার, ‘ঠিক আছে, আমি নিশ্চিতভাবে বলছি না যে কিছু পাওয়া যাবেই; তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে দেখতে চাই। দেখো এখানে একটা ব্যাপার বলি, রিফাত্ কিংবা জয়া তোমরা কেউই ট্রেইন্ড ইনভেস্টিগেটর না, আর আমি পরিস্থিতি যতটুকু বুঝতে পেরেছি ঘটনা ঘটার পর থেকে কর্তৃপক্ষ হয় ডাকাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের ধরার চেষ্টা করেছে আর না হয় ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কাজেই এভিডেন্সগুলোকে ট্রেইন্ড কোনো ইনভেস্টিগেটর পরীক্ষা করে দেখেনি। তাই আমি যা-যা আমাদের হাতে আছে সব পরীক্ষা করে দেখতে চাই। আগে এগুলো দেখবো এরপরে পুকুরের নিচের গাড়ি থেকে যা যা পাওয়া গেছে সেগুলো ঘেঁটে দেখবো আরেকবার। কারণ এবার আমাদের সঙ্গে রিফাত আছে। আর সে এই পুরো ব্যাপারটাতে সংশ্লিষ্ট ছিল কাজেই আমরা শুরু করতে পারি,’ বলে বাক্সটা খুলে জিনিসপত্রগুলো টেবিলে ছড়িয়ে দিল। অনেকগুলো ছোটো ছোটো বই, পেপারের কাটিং, পার্চমেন্টসহ আরো বেশ কিছু জিনিস ছড়িয়ে পড়ল টেবিলের ওপরে।
***
গাড়ির ভেতরে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে অন্যমানুষের প্যানপ্যানানি শোনা যে কি বিরক্তিকর কাজ যে না করেছে সে জীবনেও বুঝতে পারবে না। আর লোকগুলো কারা সেটাও তো দেখতে হবে। একটা পুলিশ, একটা সাংবাদিক আর একটা, ওইটারে কী বলে সে জানে না। তবে শেষেরটা একটা সেরকম মাল ছিল। সকালবেলা তারে ধরার অভিজ্ঞতা মনে আসতেই শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল। বিরক্তিকর কথা শুনতে শুনতে তার মধ্যে ঝিমানো ঝিমানো একটা ভাব চলে এসেছিল হঠাৎ একটা কথা শুনে সে ঝটকা দিয়ে উঠে বসল। মনে হয় এইবার কিছু একটা পেয়েছে ওরা।
***
প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেছে ওরা কাজ শুরু করেছে। এরমধ্যে প্রতিটি পেপার ক্লিপিং, প্রতিটা ব্রশিয়ার থেকে শুরু করে প্রতিটা ছোটো ছোটো বইসহ সবার ইন্টারভিউয়ের রেকর্ড ঘেঁটেছে ওরা। কিছু এখনো বাকি আছে কিন্তু রাত এখন প্রায় দশটা বাজতে চলেছে।
‘আমার একটা ব্রেক দরকার,’ রিফাত বলে উঠল। ‘এক কাজ করি, বুয়াকে বলি রাতের খাবার দিয়ে দিতে।’
‘আরে না না, পাগল নাকি, শুধু-শুধু এসব ঝামেলা করার কোনো মানেই হয়না,’ জয়া বলে উঠল। ‘আমরা বাইরে খেয়ে নেব।’
‘আশ্চর্য কাণ্ড! আমাদের মধ্যে এখনো ফরমাল সম্পর্ক আছে নাকি। আর আমি বুয়াকে আগেই বলে দিয়েছি সবার জন্যে রান্না করতে। বাশার, তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?’
‘না না,’ বলে ও জিনিসপত্র দেখতে লাগল। দুটো ছোটো ছোটো সিডির আনকোরা প্যাকেট তুলে ধরে রিফাতের কাছে জানতে চাইল, ‘এগুলো কীসের সিডি? প্যাকেটই খোলা হয়নি দেখছি।’
রিফাত খাবার আয়োজন করার জন্যে রওনা দিয়েছিল বাশারের প্রশ্ন শুনে ফিরে তাকাল। ‘ওহ, এগুলো। এগুলোও রয়ে গেছে। শশীলজে প্রদর্শনীয় আয়োজন করার পর যেদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় আমি দুটো ছেলেকে ঠিক করেছিলাম পুরো অনুষ্ঠান ভিডিয়ো করতে। ওরা ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে এসে সেটআপ করে সব ঠিক ঠাক করে আমার আর বিজয়ের ইন্টারভিউও নিয়েছিল, শশীলজের টুকরো টুকরো কিছু অংশ, সেই সঙ্গে প্রদর্শনীর জিনিসপত্রেরও কিছু কিছু অংশ ভিডিয়ো করেছিল। প্রাথমিক কাজ শেষ করেও ওরা ক্যামেরা-ট্যামেরা সেট করে প্রধান অতিথির জন্যে অপেক্ষা করছে এমন সময়ই তো ডাকাতি হয়ে গেল। তারপর পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যায়। ওরা ভিডিয়ো করলেও আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এই ঘটনার বহু পরে সব যখন মিটে গেছে তখন একদিন এসে আমাকে যা-যা ফুটেজ ছিল সেগুলো একসঙ্গে দুটো সিডিতে রাইট করে দিয়ে গেছিল। আমার ততোদিনে এই ঘটনার ওপর থেকে মন উঠে গেছে, আর তাছাড়া আমি তখন বিদেশ যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি তাই আর ওগুলো খুলে দেখিনি। ওভাবেই রয়ে গেছে।’
বাশার মনে মনে ভাবল তারমানে এখানে ডাকাতির সময়ের ফুটেজ রয়ে গেছে। ভেতরে-ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল ও। ‘তোমার কাছে সিডি-ডিভিডি প্লেয়ার জাতীয় কিছু আছে?’ সিডির কভার খুলতে খুলতে জানতে চাইল ও।
‘ল্যাপটপ এনে দিচ্ছি কিন্তু ওগুলো নিয়ে পরে বসবে। আগে খেয়ে নাও,’ রিফাত বলে উঠল ।
বাশার সিডিগুলো রেখে উঠে দাঁড়াল। জয়া ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল। ‘স্যারকে খুব খুশি মনে হচ্ছে, ম্যাডাম বলতেই একেবারে খেতে রওনা দিয়ে দিল,’ বলে সে খিক খিক করে হেসে উঠল।
‘কী যে বলো না,’ বাশার একটু বিব্রত।
‘কী যে বলি, তাই না! যেভাবে সারাদিন তাকাচ্ছিলে একে অপরের দিকে, সে তো আমি দেখিনি। আমি তো অন্ধ,’ জয়া ফোড়ন কাটতে কাটতে বলল।
রিফাত ফিরে আসতেই ওরা খেতে বসে গেল। ‘আচ্ছা একটা ব্যাপার আমার জানার ছিল,’ খেতে খেতেই বাশার জানতে চাইল। ‘এই ঠগীরা তো নিছক ডাকাত ছিল না। এরা এরকম করত কেন? এত নিয়মনীতি, এত আইনকানুন এত রিচুয়াল! কারণ কী?’
‘কারণ এটা ওদের জন্যে আসলে কোনো পেশা বা জীবনধারনের পাথেয় ছিল না, বরং তাদের কাছে এটা ছিল একটা ধর্ম। যারাই ঠগী হতো যেকোনো ধর্মের লোক নির্বিশেষে সবাই মা ভবানীর পুজো করত আর ভাবতো ওদের এই সমস্ত কর্মকাণ্ড আসলে তাদের মা ভবানীর জন্যে,’ বলতে লাগল রিফাত। ‘আমার ব্যক্তিগত মতামত যদি জানতে চাও তবে আমি বলবো, ওরা…ওরা আসলে রিপু আক্রান্ত ছিল।’
‘রিপু, সেটা আবার কী?’ বাশার অবাক হয়ে খাওয়া থামিয়ে জানতে চাইল।
‘কেন ষড়রিপুর কথা শোনোনি? কাম-ক্রোধ-লোভ-মদ-মোহ-মাৎসর্য?’ বাশারের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে রিফাত জানতে চাইল। ‘আমার ব্যক্তিগত অভিমত যদি শুনতে চাও তবে বলবো, ওরা ছিল সপ্তরিপুতে আক্রান্ত।’
‘কাম-ক্রোধ-লোভ-মদ-মোহ-মাৎসর্য,’ বাশার বাঁ হাতের আঙুলে গুনলো। ‘আমি তো এখানে দেখতে পাচ্ছি রিপু হলো ছয়টা, তবে সপ্তরিপু কোথা থেকে এলো?’
‘অ্যানথ্রপলজিক্যাল ফিলোসফিতে রিভার্স থিয়োরি বলে এক ধরনের থিয়োরি প্রচলিত আছে। এ থিয়োরিতে সবকিছু উলটো করে দেখা হয়। ভালো-মন্দ, সৃষ্টি-ধ্বংস সবই এখানে উলটোভাবে প্রচলিত। রিভার্স থিয়োরি অনুযায়ী মানুষের রিপু আসলে ছয়টা নয় বরং সাতটা। ভেঙে বলছি। ধরো ইংরেজিতে বলা হয় সেভেন ডেডলি সিনস। মানে রিপু হলো সাতটা, তবে বাংলায় রিপু ছয়টা কেন। সপ্তম রিপুটা হলো আসক্তি, যেটাকে সহজভাবে বলতে গেলে ভক্তি-এক্সট্রিম ডিভোশন। রিভার্স থিয়োরিতে ব্যাপারটাকে এভাবে বলা হয়; ‘এক্সট্রিম ডিভোশন ক্রিয়েটস ইভিল’। মানে মাত্রাতিরিক্ত ভক্তি মাত্রাহীন খারাপ। যেমন ধরো প্রতিদিনই খবরের কাগজ খুললে দেখতে পাবে ধর্মের নামে দাঙ্গা, যুদ্ধ, বোমাবাজি। এর মানে না বুঝে অতিরিক্ত ভক্তি কখনো কখনো খুবই খারাপ। ঠগীদের ব্যাপারটা অনেকটা তেমনই। ঠগীরা ছিল তাদের দেবী মা ভবানীর প্রতি অতিরিক্ত পরিমাণে অনুরক্ত। তাদের এই অতিমাত্রায় ভক্তির বহিঃপ্রকাশ ছিল এই ফাঁস দিয়ে খুন।’
‘হুম, বুঝলাম। তবে…’ বাশার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই জয়া পাশ থেকে কথা বলে উঠল। ‘বিজয় নিজেও এই সপ্তরিপুতেই আক্রান্ত হয়েছিল, যেকারণে সে-ও নিজে ঠগী হতে চাইত,’ আনমনেই বলে উঠল সে।
‘একদম ঠিক, আমি আপনার কথা সাপোর্ট করি। টুইন কালীকে হাত করার চেষ্টার পেছনে ডেভিডের উদ্দেশ্য ছিল মূর্তিটা চুরি করে বিক্রি করা। কিন্তু আমার বিশ্বাস বিজয়ের ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল। মূর্তির দাম নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা তার ছিল না। সে আসলে তার পূর্বপুরুষের মতো ঠগী হতে চাইত। সে আসলে নিজের ভেতরের সত্তাকে নিয়ে সন্তুষ্ঠ ছিল না, সে চাইত নিজেকে আরো বেশি কিছু ভাবতে, আরো বেশি কিছু করতে। সেটারই বহিঃপ্রকাশ ছিল এই ঠগী চৰ্চা।’
‘এই একুশ শতকে ঠগী! ভাবতেও তো হাস্যকর লাগে,’ বাশার বলে উঠল। ‘হাস্যকরের কিছু নেই। এই একুশ শতকে অনেক কিছুই ঘটে যা হাস্যকর কিন্তু ঘটে চলেছে। এই যুগেও নারীদেরকে পাথর মেরে মেরে ফেলা হয়। এই আধুনিকতার যুগেও মানুষ মানুষের মাংস খায়। এই যুগেও যুদ্ধের নামে শত-শত শিশু হত্যা করা হয়। হয় না?’ জয়ার নাকের পাটা ফুলে উঠেছে, সে বেশ উত্তেজিত। ‘এই যুগেও মানুষ ধর্মের নামে বোমা মারে, মানুষ বলি দেয়, দেয় না? তবে? এই যে আমি হাতে প্রজাপতির ছবি আঁকা অষ্টধাতুর আংটি পরে আছি, এটা হাস্যকর না? তুমি বলো, এই যে তুমি আধুনিক শিক্ষিত একটা ছেলে, তোমার বাঁ হাতে ওই অদ্ভুত দেখতে মেয়েদের আংটিটা পরে আছো কেন? কিছু হলেই দেখি একটু পর পর ওটা চেপে ধরে বিড়বিড় করে কী জানি বলো। এটাও তো হাস্যকর, হাস্যকর না? কিন্তু তুমি করো তো? করো না?’
জয়ার শেষ কথাটা শুনে বাশারের মুখ লাল হয়ে উঠল। সে খাওয়া থামিয়ে জয়ার চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। ‘হ্যাঁ, অবশ্যই হাস্যকর। কারণ এই আংটিটা আসলে আংটি না,’ বলে ও আংটি পরা বাঁ হাতটা দেখাল। ওটার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল। ‘এটা আসলে কী জানো। আমার মায়ের শেষ স্মৃতিচিহ্ন। আমি যেদিন মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিদেশে পড়তে যাই সেদিন মা তার হাত থেকে খুলে এটা আমাকে দিয়ে বলেছিল; সবসময় এটাকে সঙ্গে রাখতে। যে মা ছিল আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। সে-মায়ের মৃত্যুর সময়ে আমি তার পাশে ছিলাম না। যে মায়ের মৃত্যু বদলে দিয়েছিল আমার পুরো জীবনটা। সেই এলোমেলো জীবনটা যখন ধ্বংসের মুখে, তখুনি সবেচেয়ে কাছের বন্ধুর পরামর্শে আমি পুলিশে যোগ দিয়েছিলাম। সেই বন্ধুকেও আমি নিজ হাতে খুন করেছি,’ বলে ও ভেজা চোখে জয়ার দিকে তাকাল।
জয়ার দৃষ্টি অনেকটাই নরম হয়ে এসেছে। কিন্তু বাশার বলেই চলেছে। ‘যে দুজন মানুষের জন্যে আমার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার দরকার ছিল তারাই আমাকে রেখে চলে গেছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমিই তাদের মৃত্যুর জন্যে দায়ী। যখন তুমি তোমার পরিবার, তোমার বন্ধু-বান্ধব, তোমার ক্যারিয়ার সব হারাবে তখন অবশ্যই এরকম হাস্যকর কিছু একটা আঁকড়ে না ধরলে তুমি বাঁচতে পারবে না,’ বলে ও বাঁ হাতে চোখ মুছলো। ‘এক্সকিউজ মি,’ বলে ও টেবিল থেকে উঠে হাত মুখ মুছে ফিরে এলো ড্রইং রুমে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে চালিয়ে দিল দুটো সিডির প্রথমটা। এটাতে বিশেষ কিছু নেই। প্রাথমিক কিছু ভিডিয়ো, এর-ওর ইন্টারভিউ। রিফাতকে দেখা গেল শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন তার বয়স ছিল আরো অনেক কম, দেখতে আরো চোখ ধাঁধানো সুন্দরী ছিল। বাশার তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো। প্রথম সিডিটা বের করে এবার দ্বিতীয়টা লাগাল। রিফাতের কথামতো এটাতেই ডাকাতির সবকিছু থাকার কথা। সিডিটা প্লে হতে হতে জায়গামতো চলে এলো। বাশার ভীষণ উত্তেজনার সঙ্গে দেখতে লাগল প্রায় পুরো ডাকাতির ঘটনাটাই রেকর্ড হয়ে আছে এটাতে। জয়া গতদিন যেভাবে বলেছিল ঠিক সেভাবেই ঘটেছে ব্যাপারটা। ও মনোযোগ দিয়ে ডাকাতিটা দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে এসে থেমে গেল। আবার রিওয়াইন্ড করে দেখল। তারপর আবার, তারপর আবার।
‘বাশার, আমি দুঃখিত। যদি আমি ব্যক্তিগত কোনো আক্রমণ করে থাকি না বুঝে…’।
ও জয়ার দিকে না তাকিয়েই তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। আরেকবার ভিডিয়োর একটা বিশেষ অংশ দেখল। তারপর জয়ার দিকে তাকিয়ে অনেকটা ঘোষণার মতো করে বলল, ‘টুইন কালী যেখান থেকে ডাকাতি হয়েছিল ওটা এখনো ওখানেই আছে।’
‘মানে?’ রিফাত একটা কফির মগ হাতে এইমাত্র প্রবেশ করেছে ড্রইং রুমে। বাশারের শেষ কথাটা শুনতে পেয়েছে সে। ‘মানে, তুমি বলতে চাইছ ওটা এখনো শশীলজেই আছে?’
‘সেটা কীভাবে সম্ভব?’ জয়া গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করল।
‘সম্ভব, কারণ প্রমাণ আছে এখানে,’ বলে ও ল্যাপটপটা ফিরিয়ে ধরল ওদের দুজনার দিকে। এখানে দেখ। ডাকাতরা গাড়ি থেকে নেমে এসে অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে একদিকে সারি দিয়ে দাঁড় করাচ্ছে। ‘ডাকাতির সময়টা ভালোভাবে খেয়াল করো। এই যে রিফাত, এই যে বিজয় সবাই একদিকে, শুধুমাত্র একজন বাদে। ডেভিড। দেখ সে দাঁড়িয়ে আছে ডাকাতদের পেছনে।
‘এইবার এখানে দেখো,’ বলে বাশার একটা জায়গায় ফোকাস করল। ডাকাতরা প্রদর্শনীর জিনিস কালো রঙের ব্যাগে ভরছে। প্রথমেই টুইন কালীর মূর্তিটা এক ডাকাত পলিথিনের মতো দেখতে একটা ব্যাগে ভরে ফেলল। ভরে সে সরে এলো ওখান থেকে। বাকি ডাকাতরা যখন অন্যদের নিয়ে ব্যস্ত সে এসে দাঁড়িয়ে গেল ঠিক ডেভিড যেখানে দাড়িয়ে আছে তার সামনে। সবার অলক্ষ্যে চট করে ব্যাগটা চালান করে দিল ডেভিডের হাতে।
‘সর্বনাশ,’ আনমনেই বলে উঠল রিফাত।
সর্বনাশের এখনো বাকি আছে,’ বলে ও ভিডিয়োটা আরেকটু এগিয়ে দিল। ‘এবার দেখো, ডাকাতরা অন্যান্যদের নিয়ে ব্যস্ত, কালো ব্যাগটা হাতে নিয়ে ডেভিড পেছন থেকে গায়েব হয়ে গেল। ফিরে এলো একটু পরেই। তখন তার হাতে ব্যাগটা নেই।
‘তারমানে তারমানে কালী মূর্তিসহ ব্যাগটা সে কোথাও রেখে এসেছে,’ জয়া বলে উঠল। ‘আর সেটা অবশ্যই শশীলজের ভেতরেই হবার কথা। কারণ এই
সময়ের ভেতরে সে আর কোথাও সরতে পারার কথা নয়।’
‘কিন্তু এর মানে এই না যে টুইন কালী এখনো ওখানেই আছে। সে তো ওটা অন্যকারো হাতেও দিতে পারে,’ জয়া বলে উঠল
‘না, ওটা সে শশীলজেই রেখেছে। কারণ আছে,’ রিফাত কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলতে লাগল। ‘কারণ শশীলজ সে খুব ভালো চিনত। সে আমাকে বলেছিল শশীলজ নিয়ে অনেক মিথ আছে। এই প্রদর্শনীর বছর দুয়েক আগে নাকি একবার সে আর তার বন্ধু মিলে প্রায় তিনমাস ধরে শশীলজের ওপরে গবেষণা করেছে। আর তখনই সে নাকি এই টুইন কালীর ব্যাপারে জানতে পারে। এরপরে আমরা যখন টুইন কালী বিষয়ক খোঁজ-খবর করতে থাকি তখন সে আগ্রহী হয়।
‘তারমানে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াল, ডাকাতির সময়ে ডেভিড কালী মূর্তি নিয়ে শশীলজের ভেতরে গায়েব হয়ে যায় আর ফিরে আসে খালি হাতে। তারমানে মূর্তিটা শশীলজের কোথাও আছে। কারণ সে মূর্তিটা সরানোর সময় পায়নি যদি পেত তবে সেটা পুকুরের নিচে তার গাড়িতে থাকত,’ বলে বাশার একে একে দুজনার দিকে দেখল। ‘সেটা যেহেতু ছিল না, কাজেই মূর্তি এখনো শশীলজেই আছে।’
***
বাশারের শেষ কথাটা শুনে কানে হেডফোন পরে থাকা মানুষটার মুখে দুইকান পর্যন্ত বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠল। এতক্ষণে মজা পেতে শুরু করেছে সে। তবে এখুনি সে কিছুই করবে না, শুধুই অপেক্ষা করবে। ওরা মিলে শশীলজে অভিযান চালিয়ে বেড়াক। যদি কিছু পায় তখন পর্দায় হাজির হবে সে। তবে সে-জন্যে প্রস্তুতি লাগবে, লোক লাগবে। হাসি মুখেই সে মোবাইলটা বের করে কল দিল তার নিয়োগকর্তার নম্বরে।