অধ্যায় পঁচিশ – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ
কালীবাড়ি, মধুপুর, তালুকদার পরিবারের আবাসস্থল
মৃত মানুষ কী ফিরে আসতে পারে!
তালুকদার পরিবারের পুত্রবধূ জোহরা আনজুমান আরা তালুকদারের মনের ভেতরে বারবার শুধু একথাটাই ঘুরে-ফিরে আসছে। তবে মৃত মানুষ ফিরে না এলেও, জীবিত মানুষ তো ফিরে আসতেই পারে। তার স্বামী সিরাজউদ্দিন তালুকদার আসলেই বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে—সেটা না জানা পর্যন্ত কিছুতেই বলা সম্ভব নয়, সে আদৌ ফিরে আসবে নাকি আসবে না।
নিজের শোবার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কোনোভাবেই ধেয়ে আসা চোখের জল আটকাতে পারল না জোহরা। দোতলা কাঠের বাড়িটাতে নিজের শোবার ঘরের জানালার সামনে দাঁড়ালে পুরো বাড়িটাই চোখে পড়ে। জানালা দিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টির ভেতরেও বাড়ির উঠানে কাজ করছে কিছু লোকজন। গত কয়েকদিন যাবৎ টানা ধান সিদ্ধ করা হচ্ছে। তাই রোজ সকালে রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির কাজের লোকেরা ধানগুলোকে উঠানে শুকাতে দিয়েছিল কিন্তু বিধি বাম বিকেলবেলা ধান গোলাঘরে তুলে আনার আগেই বৃষ্টি।
সকাল থেকে কাজে ব্যস্ত থাকলেও কিছুতেই আসলে তার মনোযোগ নেই। তার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। নিজের হারিয়ে যাওয়া স্বামীর একটা ছোট্ট খোঁজ পাবার জন্যে মনটা আনচান করছে। সে-খবরই আসার কথা। তাই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে উঠানের কর্মব্যস্ততা ছাড়িয়ে তার মন আর দৃষ্টি দুটোই বারবার ছুটে যাচ্ছে বাড়ির পেছনের রাস্তাটার দিকে। যার খবর নিয়ে আসার কথা সে ওদিক দিয়েই আসবে।
জানালার পাশ থেকে সরে এলো সে। এভাবে ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে অসহ্য লাগছে জোহরার। দোতলা থেকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচের খাবার ঘরে নেমে এলো জোহরা। সেখানে চেয়ারের ওপরে রাখা একটা শাল তুলে নিয়ে মাথায় ঘোমটা জড়িয়ে বেরিয়ে এলো বারান্দায়। তালুকদার পরিবারের বউয়েরা কখনোই বাড়ির বাইরের বারান্দায় নিজেদের মুখ দেখায় না। বাড়ির পেছনের অংশে তাদের জন্যে আলাদা উঠান আছে, স্নানের জন্যে রয়েছে আলাদা পুকুর, প্রয়োজনীয় কাজের জন্যে আলাদা ইঁদারা।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার মনে পড়ে গেল বাড়ির বউদের ভেতরে সেই প্রথম যে এই প্রক্রিয়া ভেঙেছিল। কতই-বা বয়স ছিল তখন তার? আজ এত বছর পরেও ঠিক মনে পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিগুলোও ঝাপসা থেকে ঝাপসাতর হয়ে পড়ে। সময় পেরুলেই ‘আজ’ কত সহজেই না ‘কাল’ হয়ে যায় ভাবতে অবাকই লাগে।
গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ভেতরে নির্জন বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরো শৈশব যেন ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে সে যখন এই বাড়ির বউ হয়ে আসে তখন তার বয়স ছিল মাত্র তেরো কি চৌদ্দ। সামাজিকতার প্রেক্ষাপটে বরং একটু দেরি করেই বিয়ে হয়েছিল তার। কারণ ছিল তার বাবা। জোহরার বাবা ছিল খুলনা এলাকার বনেদি পরিবারের ছেলে। এগারো ভাই-বোনের ভেতরে জোহরা ছিল সবার ছোটো। যেকারণে বাড়ির কঠিন নিয়ম আর ধর্মীয় অনুশাসনের প্রভাব খুব বেশি তার ওপরে পড়েনি। একারণেই যেসব কাজ তার ভাই বোন কিংবা বাড়ির লোকেরা করার কথা ভাবতেও পারতো না, সেসব দুষ্টুমি অবলীলায় করে বেড়াত জোহরা। জোহরার এরকম আনন্দময় জীবনের পেছনে ওর বাবার ভালোবাসা আর প্রশ্রয়ই ছিল মূল কারণ। একে তো ছোটো সন্তান তার ওপরে জোহরার প্রতি তার বাবার অতিরিক্ত ভালোবাসার একটা কারণ ছিল। এই গল্পটা জোহরা ওর মায়ের কাছ থেকে শুনেছিল।
জোহরার জন্মের আগে ওর বাবা গেছিল হজ করতে। তখনকার সময়ে হজ মানেই বিরাট আয়োজন আর এলাহি ব্যাপার। কারণ তখন হজে যাবার উপায় ছিল একটাই; পায়ে হেঁটে। তাই বিরাট কাফেলাসহ লোকজন হজের জন্যে বেরিয়ে পড়তো লম্বা সময়ের জন্যে। জোহরার বাবার কাফেলা যখন মিশর পার হচ্ছে তখন তাদের সঙ্গের গাইড, মানে যাকে মোয়াল্লেম বলা হয়, সে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ভীষণ মরুর গহিনে পথ হারিয়ে ফেলে তাদের কাফেলা।
কোনোভাবেই সঠিক পথ বের করতে না পেরে তারা যখন মরতে বসেছে তখন তারা আল জোহর নামের একটা মরুদ্যানে এসে পানি খুঁজে পেয়ে কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যায়। সেখানেই জোহরার বাবা নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে যদি এ যাত্রা ভালোভাবে হজ করে দেশে ফিরতে পারে তবে সে আরেকটা সন্তানের জন্ম দিবে আর তার নাম রাখবে জোহরা, সেই মরুদ্যানের নামে। যাতে জীবনের প্রতি পদে চলতে গিয়ে এই সন্তানকে দেখে সে তার নবজন্মের কথা মনে করতে পারে। এরপরে মেয়ে সন্তানের জন্ম হলে তার নাম রাখা হয় জোহরা।
বাইরের টিপটিপ বৃষ্টি দেখতে দেখতে জোহরা বারান্দায় এসে একটা ঝুল চেয়ারে বসে পড়ল। মন পড়ে গেল ওর বাবার কথা।
সময়টা সপ্তাদশ শতকের শেষভাগ। প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ তখন সবেমাত্র শেষ হয়েছে। যুদ্ধ চালাতে গিয়ে ইংরেজ সরকারের কোষাগার তখন গড়ের মাঠ। এমন সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্যে আবারো লর্ড কর্নওয়ালিসকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এর আগে কর্নওয়ালিস তার প্রখর বুদ্ধিমত্তা আর শক্তিশালী পদক্ষেপ দিয়ে অনেক কিছুই করে গেছে। এবারও তাই তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তবে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে।
লর্ড কর্নওয়ালিস ক্ষমতায় আরোহন করা মাত্রই ফন্দি-ফিকির খুঁজতে থাকে : কীভাবে ইংরেজ সরকারকে এই অর্থনৈতিক দূরবস্থা থেকে উদ্ধার করা যায়। ঠিক তার আগের লর্ড করের মাত্রা বাড়িয়ে চেষ্টা করেছিল কিন্তু কাজ হয়নি। তাই সে তার ধূর্ত মস্তিষ্ক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কুটিল আইন বের করে। সূর্যাস্ত আইন।
এই আইনের আওতায় কোনো প্রজা বা জমিদার যদি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের সূর্যাস্তের ভেতরে নিজের বকেয়া খাজনা পরিশোধ করতে না পারে তবে তার জমিদারি ইংরেজ সরকার করায়ত্ত করে নিয়ে খাজনা আদায় করে নিতে পারবে। এই ব্যবস্থার ফলে বহু জমিদার, বহু ভূসম্পত্তির মালিক নিজেদের সব হারিয়ে পথে বসে। এইসব মানুষদের ভেতরে একজন ছিল জোহরার বাবা। সব হারিয়ে সে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর্থিক সামাজিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষটা যখন সব হারিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধেয়ে চলেছে এমন সময় তার সাহাযার্থে এগিয়ে আসে তারই বন্ধু, রমিজউদ্দিন তালুকদার।
এই মানুষটার কথা জোহরা ছোটোবেলা থেকে বাবার মুখে শুনে আসলেও ছোটোবেলার পর থেকে তাকে কখনো দেখেনি। জোহরার বাবা যেমন খুলনা এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ, ঠিক একইভাবে রমিজউদ্দিন তালুকদার ময়মনসিংহের মধুপুরের গড় এলাকার সম্ভ্রান্ত ও প্রতাপশালী পরিবারের মানুষ। একসঙ্গে পড়ালেখা করার সময়ে তাদের পরিচয়। জোহরার বাবা সবসময়ই রমিজউদ্দিন তালুকদারের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখতো তার অত্যাধিক ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে। কিন্তু তালুকদার জোহরার বাবাকে অত্যন্ত পছন্দ করত। একারণেই জোহরার বাবার অসুস্থতার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে চলে আসে ওদের বাড়িতে। কিন্তু ওদের কপাল ছিল খারাপ। খুব অল্প সময়ের ভেতরেই জোহরার বাবা মারা যায়, আর ওর বাবার মৃত্যুশোক কাটার আগেই মাও সবাইকে ছেড়ে চলে যান।
রমিজউদ্দিন তালুকদার গোঁড়া হতে পারে কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ ছিল সে। জোহারার বাবা-মা দুজনেই প্রস্থান করার পর পরিস্থিতি বিবেচনা করে সে বুঝতে পারে জোহরাকে এভাবে বাড়িতে রাখা যাবে না, অন্যদিকে তার কোনো আত্মীয়ও জোহরার দায়িত্ব নিতে চাইছিল না। তাই রমিজউদ্দিনের সামনে তখন একটাই পথ খোলা ছিল। নিজের বড়ো ছেলের বউ মারা গেছে কিছুদিন আগে, তাই সে জোহরাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে।
জোহরার বয়স তখন তেরো। আর ওর স্বামীর বয়স চল্লিশের ওপরে। জোহরার স্বামী সিরাজ উদ্দিনের প্রথম ঘরের বড়ো সন্তানের বয়স তখন জোহরার চেয়ে কম করে হলেও সাত আট বছর বেশি। বিয়ের পরে জোহরা নিজের চারপাশে অন্য এক ভুবনের অস্তিত্ব আবিস্কার করে। তালুকদার পরিবার চলত কঠিন ধর্মীয় অনুশাসনে। এক কথায় বলা চলে তাদের চলাফেরা, বেশভূষা, পারিবারিক আর সামাজিক রীতিনীতি সবই কঠিন ধর্মীয় অনুশাসনে মোড়ানো থাকে।
তবে জোহরা অবাক হয়ে আবিস্কার করে এই ধর্মীয় অনুশাসনের বেশিরভাগটাই আসলে রমিজউদ্দিন তালুকদার নিজে মেনে চলে আর বাকি পুরোটাই মেনে চলতে হয় পরিবারের মেয়েদের। পরিবারের বেশিরভাগ পুরুষ বলতে গেলে এই ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরেই অবস্থান করে। শুধু তাই নয়, রমিজউদ্দিন তালুকদার নিজে যেমন শক্ত মানুষ সেই হিসেবে নিজের সন্তানদের সেভাবে গড়ে তুলতে পারেনি। নিজে বেশ শিক্ষিত হবার পরও তার সাত ছেলের প্রায় কেউই তেমন পড়ালেখা করেনি। অন্যদিকে পারিবারিক বিরাট ব্যবসার প্রায় পুরোটাই সে নিজে পরিচালনা করে। তার পারিবারিক রীতিনীতি থেকে শুরু করে ব্যবসা কোনোটাতেই তার কোনো ছেলেদের তেমন অংশগ্রহণ নেই।
বিয়ে হবার পর থেকেই জোহরাকে তাদের পারিবারিক আইন-কানুন কঠিনভাবে মেনে চলতে হতো। এইসব কঠিন নিয়ম-কানুন আর পারিবারিক কাজের পর জোহরা খুব বেশি একটা সময় পেত না। কিন্তু এর ভেতরেই সে নিজে থেকে চেষ্টা করত তালুকদার পরিবারের ব্যবসা বোঝার, অন্যদিকে নিজে নিজে পড়ালেখা করার চেষ্টাও করত। এই দুটোর কোনোটাই সম্ভব হতো না যদি না জোহরার স্বামী, সিরাজউদ্দিন তালুকদার তার প্রতি সহনশীল না হতো। বিয়ের পর প্রথম প্রথম সিরাজউদ্দিন তালুকদার মানুষটা জোহরাকে একরকম এড়িয়েই চলত। আর নিজের চেয়ে দ্বিগুণ বয়সি স্বামীকে জোহরা ভয় পেত
কিন্তু ধীরে ধীরে তারা পরস্পরকে আবিষ্কার করতে থাকে। জোহরাকে এড়িয়ে চলার কারণও আবিস্কার করে। সেটা হলো প্রথম স্ত্রীর জন্যে সিরাজউদ্দিন তালুকদারের অপরিসীম ভালোবাসা। নিজের স্ত্রী মারা যাবার পরও তার প্রতি সিরাজের ভালোবাসা এতটুক কম হয়নি। এই ব্যাপারটা আবিস্কার করার পর মানুষটার প্রতি জোহরার সম্মান বাড়তে থাকে। অন্যদিকে জোহরার পড়ালেখা শেখার আগ্রহ সিরাজউদ্দিন তালুকদারকে বেশ আনন্দ দিত। তাই সে নিজেও চেষ্টা করত তার স্ত্রীকে যতটা সম্ভব সহায়তা করার। কিন্তু গ্রামের পরিবেশে ওইরকম অবস্থায় এক নারীকে পড়ালেখা শেখানো এতটা সহজ ছিল না। তাই জোহরা সাহস করে একদিন রমিজউদ্দিন তালুকদারের মুখোমুখি হয়ে তার পড়ালেখা শেখার ইচ্ছা ব্যক্ত করে।
ব্যাপারটা ছিল একরকম অবিশ্বাস্য। রমিজউদ্দিন তালুকদার জোহরার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বেশ সময় নিয়ে এটা-ওটা জানতে চান। জোহরার জানার ইচ্ছে আর পড়ালেখা করার ইচ্ছে সত্যিই তাকে প্রভাবিত করে। তবে জোহরার প্রস্তাব শুনে রমিজউদ্দিন তালুকদার একটু চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ তখনকার দিনে একটা মুসলিম পরিবারের কোনো মেয়েকে কোনো পুরুষ শিক্ষক এসে পড়াবে সেটা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে তাকে পড়ানোর মতো আর কেউ নেই। রমিজউদ্দিন তালুকদার সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা করে বসে সে নিজেই জোহরাকে পড়াবে। যদিও সে নিজের প্রাত্যহিক ব্যস্ত জীবনে সময় পেতো খুবই কম। তবুও প্রতিদিন রাতের আহার সম্পন্ন করার পর জোহরাকে নিয়ে পড়াতে বসতো সে।
পড়ানোর প্রাথমিক বিষয় ছিল আরবি আর ফার্সি ভাষা। কিন্তু জোহরার আগ্রহের কারণে ধীরে ধীরে ইতিহাস আর ভূগোল আর গণিতও অন্তর্ভূক্ত হয়। রমিজউদ্দিন তালুকদার নিজে শিক্ষিত ছিল, এছাড়াও সে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। আর দীর্ঘদিন পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তার ব্যাবসায়িক জ্ঞানও ছিল অপরিসীম। কিন্তু কখনোই সে নিজের সন্তান বা নিজের নাতি-নাতনিদের কাউকেও পড়ালেখার বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে পারেনি। তাই মনের মতো ছাত্রী পেয়ে নিজের জ্ঞান উজাড় করে দেয় মানুষটা। অন্যদিকে বৈষয়িক জ্ঞান থেকে শুরু করে তালুকদার পরিবারের ব্যবসা পর্যন্ত সবকিছুই ধীরে ধীরে আয়ত্ত করে নিতে থাকে জোহরা। এভাবে নির্বিঘ্নেই চলে যায় আরো বেশ কয়েক বছর।
তালুকদার পরিবারের বড়ো ছেলের বউ মানেই বাড়ির বড়ো বউ। আর এধরনের পরিবারে বড়ো বউয়ের প্রভাব থাকে অন্যরকম। আর পড়ালেখা করার কারণে আর রমিজউদ্দিন তালুকদারের স্নেহভাজন হবার কারণে তালুকদার পরিবারে জোহরার শক্ত একটা অবস্থান তৈরি হয়ে যায়। পারিবারের অভ্যন্তরীণ অনেক সিদ্ধান্তও জোহরাই নিতে শুরু করে।
সব ভালোভাবেই চলছিল তবে এর মাঝেও একটা ঘটনা ঘটে যা আবারো ক্ষণিকের জন্যে হলেও জোহরার পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দেয়। জোহরা প্রথম সন্তান জন্ম দেবার সময়ে শারীরিকভাবে খুবই জটিল এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গর্ভের সন্তান জন্ম দেবার সময়েই মারা যায় আর ধাত্রী ঘোষণা করে জোহরা আর কোনোদিন সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। আরো একবার অপরিসীম দুর্ভাগ্য জোহরার পৃথিবীকে অন্ধকার করে দেয়। এই শোক পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠার আগেই আবারো এমন এক ঘটনা ঘটে যার ফলে শুধু জোহরা নয়, পুরো তালুকদার পরিবারের ভাগ্য এক নিমিষে পালটে যায়।
রমিজউদ্দিন তালুকদার হঠাৎই এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। শুধু রমিজউদ্দিন তালুকদারের মৃত্যুই নয়, এই দুর্ঘটনায় বিরাট আর্থিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হয় তালুকদার পরিবার। ঘটনাটা ঘটেছিল কোনো এক তীব্র শীতের রাতে। কী ঘটেছিল বলার আগে তৎকালীন মধুপুর এলাকার প্রেক্ষাপট বলে নেওয়াটা জরুরি।
সেই সময়ে তালুকদার শুধুই একটা পারিবারিক উপাধিই ছিল না বরং জমিদারদের মতো এটারও একটা গুরুত্ব ছিল। নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিজমা-অর্থাৎ যাদের ‘তালুক’ থাকত তাদেরকেই সরকার কর্তৃক তালুকদার উপাধি দেওয়া হতো। রমিজউদ্দিন তালুকদাররা বহু আগে থেকেই পারিবারিকভাবে তালুকদার উপাধি প্রাপ্ত ছিল। সত্যি কথা হলো তারা শুধু তালুকদার উপাধি প্রাপ্তই নয় তাদের পারিবারিক আরো অনেক বেশি গুরুত্ব ছিল অত্র মধুপুর অঞ্চলে।
ধর্মীয়ভাবে তারা মুসলমান হওয়াতে অত্র হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় সবচেয়ে বড়ো মুসলমান পরিবার হিসেবে তাদের একটা গুরুত্ব তো ছিলই, সেইসঙ্গে ব্যাবসায়িক কারণেও তালুকদার পরিবার ছিল এই এলাকার অন্যতম পরিবার। অত্র এলাকার প্রাণ যে দুটো ব্যবসা সেই দুটোর মূল পরিচালক ছিল তালুকদার পরিবার প্রায় শতবছর ধরে তারাই ছিল এই এলাকার নিয়ন্ত্রক ও হর্তাকর্তা। এমন সময় দেশের উত্তর বঙ্গ থেকে স্থানান্তর হয়ে আচার্য জমিদারদের পরিবার যখন এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করল খুব স্বাভাবিকভাবেই দুই পরিবারের মধ্যে একটা সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি কারণ রমিজউদ্দিন তালুকদার ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ।
সে খুব ভালোভাবেই জানত : যতই বহিরাগত হোক না কেন, একে তো ধর্মীয় কারণে তারা এই এলাকায় একটা সুবিধা পাবে, তার ওপরে আবার আচার্য পরিবারের বিত্ত-সম্পদ তাদের তুলনায় অনেক বেশি। তাই শুরু থেকেই সরাসরি যেকোনো সংঘর্ষ এড়ানোর জন্যে অবশ্যম্ভাবী যা-যা করণীয় সেগুলো ঠিকমতোই পালন করে চলত সে। বর্তমান রাজা সূর্যকান্ত আচার্যের পিতা আর রমিজউদ্দিন তালুকদারের ভেতরে এক ধরনের অলিখিত চুক্তি বজায় ছিল দীর্ঘ সময় ধরে।
কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ অবস্থা ভেঙে পড়ে সূর্যকান্ত আচার্যের পিতার মৃত্যুর পরেই। সূর্যকান্তের বাবার মৃত্যুর পর দিয়ে প্রথমে যথা নিয়মে সূর্যকান্তের বড়ো ভাই রমাকান্ত আচার্য তাদের পারিবারিক জমিদারির দায়িত্ব পায়। তবে অল্প সময়ের ভেতরেই ছোটো ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এলাকা ছেড়ে পালাতে হয় তাকে। অন্যদিকে সূর্যকান্ত জমিদার হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একের পর এক সংঘর্ষ লাগতে থাকে তালুকদার পরিবারের সঙ্গে।
রমিজউদ্দিন তালুকদার ছিল পাকা ব্যবসায়ী। আগে থেকেই সবকিছু অনুধাবন করতে পেরেছিল সে। সে আন্দাজ করতে পেরেছিল সূর্যকান্ত জমিদার হলে তার সঙ্গে লাগার চেষ্টা করবে, কিন্তু সে এমনভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল যেখানেই সূর্যকান্ত হাত বাড়ানোর চেষ্টা করত রমিজউদ্দিনের পূর্বপ্রস্তুতির কারণে সে কিছুতেই সুবিধে করে উঠতে পারছিল না। পেছন যুদ্ধে খুব বেশি সুবিধে করতে না পেরে সূর্যকান্ত আচার্য সরাসরিই রমিজউদ্দিনকে একটা প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবটা ছিল খুবই জঘন্য। এমনকি রমিজউদ্দিন তালুকদারের মতো ঠান্ডা মাথার মানুষও এই প্রস্তাব শুনে দিগবিদিক হারিয়ে রেগে ওঠে। সূর্যকান্তের প্রস্তাব মেনে নিতে হলে রমিজউদ্দিনকে তার কাঠের ব্যবসার প্রায় পুরোটাই ছেড়ে দিতে হবে। সরাসরিই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে সে।
জোহরার এখনো মনে পড়ে সেই রাতের কথা। প্রতিদিনের মতো রাতের আহার সারার পর রমিজউদ্দিন তালুকদার জোহরার সঙ্গে পড়ালেখা ও ব্যাবসায়িক আলাপ ইত্যাদি নিয়ে বসতো। তখন বেশ শীত পড়েছে। ধুমছে চলছে ফসলের কাজ। হাজার হাজার মন ধান কেটে-শুকিয়ে-সিদ্ধ করে তারপর আবার শুকিয়ে গুদামজাত করা এলাহি কারবার। ওইদিন রমিজউদ্দিন অত্যন্ত ব্যস্ত দিন কাটিয়েছে। জোহরা ভেবেছিল সে তার সঙ্গে বসবে না। কিন্তু রাতের খাবার পর ঠিকই জোহরার ডাক পড়ে। যথারীতি জোহরা তার বইপত্র নিয়ে হাজির হয় রমিজউদ্দিনের বসার ঘরে।
সে ঘরে ঢুকে দেখতে পায় রমিজউদ্দিন বেশ গম্ভীর মুখে বসে আছে। জোহরাকে বইপত্র হাতে প্রবেশ করতে দেখে তাকে বইপত্র নামিয়ে রাখতে বলে। জোহরা পরিষ্কার মনে করতে পারে রমিজউদ্দিন তালুকদার তার কাছে ওইদিন কী কী বলেছিল। সে প্রথমেই খুব আফসোস করছিল তার ছেলেদের কাউকেই সে নিজের মতো করে মানুষ করতে পারেনি বলে। সে জোহরাকে জানায় তার যদি কিছু হয়ে যায় তবে জোহরা যেন এইসব দেখে রাখে। কারণ যেকোনো ছেলের চাইতে জোহরা তার পারিবারিক ব্যবসার ব্যাপারে বেশি জানে। রমিজউদ্দিনের মতো শক্ত মানুষের এই চেহারা জোহরা কখনো কল্পনা করতে পারেনি। যে লোক কখনো তার পরিবারের মেয়েদেরকে বাড়ির বাইরে মুখ দেখাতে দেয়নি সেই লোক কোন অবস্থায় পড়লে তার পুত্রবধূকে বলে তার ব্যবসার হাল ধরতে? তবে সত্যি কথা হলো ওইদিন রমিজউদ্দিনের আচরণ জোহরার কাছে অনেকটাই বাড়াবাড়িই মনে হয়েছিল। কিন্তু সত্যি সত্যি এর কয়দিনের ভেতরেই ঘটনা ঘটে যায়।
সূর্যকান্ত আচার্যের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই রমিজউদ্দিন খুব সাবধানে চলাচল করছিল, তার দেহরক্ষীর সংখ্যাও সে বৃদ্ধি করেছিল। তার ধারণা ছিল সূর্যকান্ত তার ওপরে প্রতিশোধ নিতে ছাড়বে না। কিন্তু বিপদ আসে সম্পূর্ণ ভিন্ন দিক থেকে। সেবার প্রচণ্ড শীত পড়েছিল। সেই সঙ্গে ফসল তোলার চাপের কারণে সময়টাও যাচ্ছিল খুব ব্যস্ততার সঙ্গে। একারণে সবাই খেয়েই দ্রুত ঘুমিয়ে যেত। এরপরে আবার সকাল সকাল উঠে কাজে লাগতে হবে। এমনি এক তীব্র শীতের রাতে হঠাৎ খবর আসে তালুকদার পরিবারের কাঠের গুদাম আর ধানের গোলায় নাকি চোর ঢুকেছে। রমিজউদ্দিন তালুকদার প্রাথমিকভাবে তার লোকদের পাঠায় কিন্তু তারা ফিরে না আসাতে সে নিজেই ওদিকে রওনা দেয় অস্থির হয়ে। পরিবারের সবাই মানা করার পরও সে কারো কথা শোনেনি। জোহরার এখনো মনে পড়ে একটা কুপি হাতে রমিজউদ্দিন তালুকদারের দেহায়বয়বটা সেদিন মিলিয়ে গেছিল কুয়াশার ভেতরে। সেই মানুষ আর কোনোদিনই ফিরে আসেনি।
রমিজউদ্দিন তালুকদার বেরিয়ে যাবার একটু পরেই ওরা বাড়ি থেকে দেখতে পায়-তালুকদার পরিবারের কাঠের গুদাম আর ধানের গোলা দাউ দাউ করে পুড়ছে। তীব্র শীতের রাতে শুকনো আবহাওয়ায় একসারিতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তালুকদার পরিবারের সম্পদের একটা বড়ো অংশ। সেই সঙ্গে রমিজউদ্দিন তালুকদার নিজেও। আগুন কীভাবে লেগেছিল আর সেই আগুনের ভেতরে রমিজউদ্দিন তালুকদার কীভাবে গিয়ে পড়েছিল—সেটা পুরোপুরি কখনোই উদ্ধার হয়নি। জোহরা পারিবারিক দায়িত্ব নেওয়ার পরে আবিস্কার করেছিল রমিজউদ্দিন তালুকদারের পাহারাদাররাই তার সঙ্গে বেইমানি করেছিল। সূর্যকান্তের কাছ থেকে টাকা খেয়ে ওরাই গোলা ঘরে আগুন লাগিয়ে তাতে ছুড়ে দিয়েছিল বৃদ্ধ রমিজউদ্দিনকে। যদিও জোহরা তাদের সবাইকে একে একে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছিল, তবে সেটা অনেক পরের ঘটনা।
পারিবারিক সম্পদ আর পরিবারের পিতাকে হারিয়ে তালুকদার পরিবার একরাতের ব্যবধানে পথে বসে যায়। তাদের অর্থ কিংবা সম্পদের যে খুব কমতি ছিল তা নয়। যে পরিমাণ গহনা পরিবারের মেয়েদের কাছে ছিল তা দিয়েই কয়েক পুরুষ বসে খাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা সেটা নয়, সমস্যা হলো যেকোনো প্রতিষ্ঠান চলতে হলে শক্ত ও দক্ষ একজন পরিচালক দরকার। এতবড়ো একটা পরিবারও বিরাট ব্যবসা সামলানোর মতোই। এই পরিবারে তেমন কেউই ছিল না তখন। তার ওপরে আবার সূর্যকান্তের চাপ, সবমিলিয়ে রমিজউদ্দিন তালুকদারের ছেলেরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। একে তো তারা বাপের ব্যবসার কিছুই জানত না তার ওপরে রমিজউদ্দিনের মৃত্যুর সুযোগে সূর্যকান্ত বিভিন্নভাবে তাদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে একেবারে দিশেহারা করে তোলে।
এমতাবস্থায় তারা যখন কিছুতেই বুঝতে পারছে না কী করবে। সুযোগ বুঝে সূর্যকান্ত তাদের পুরো পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠায়। যদিও টাকার পরিমাণটা উপযুক্ত হিসেবের চেয়ে অনেক কম তবুও যে টাকা তারা পাবে সেটাও অনেক। তালুকদার পরিবারের ছেলেরা যখন সবকিছু প্রায় বিক্রি করে ফেলার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছে এমন সময় এগিয়ে আসে জোহরা। সে তালুকদার পরিবারের ছেলেদের মতের বিপক্ষে গিয়ে পুরো পরিবারের ব্যবসা ও পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়।
যদিও খুব সহজে সেই কাজটা সে করতে পেরেছিল তা নয়। কারণ রমিজউদ্দিন তালুকদারের কোনো ছেলেই এটা মেনে নিতে রাজি ছিল না, তার ওপরে সূর্যকান্তের প্রভাব তো ছিলই। সবমিলিয়ে কোনোভাবেই জোহরা এদের সঙ্গে পেরে উঠতো না, যদি তার স্বামী সিরাজউদ্দিন তালুকদার তাকে পূর্ণ সহযোগিতা না করত। জোহরার স্বামী যতই অকর্মণ্য হোক না কেন জোহরা তার স্বামীকে এটা বোঝাতে পেরেছিল যে এভাবে নিজেদের পৈত্রিক ভিটেমাটি বিক্রি করে পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে অসম্মানের আর কিছু হতেই পারে না। আর সিরাজউদ্দিন তালুকদারও সেটা তার ভাইদেরকে বোঝাতে সক্ষম হয়। কিন্তু সবাই মিলে জোহরাকে সময় দেয় ছয় মাস। এর ভেতরে যদি পরিবার ও ব্যবসা গুছিয়ে এই এলাকায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে না পারে তবে আগের কথাই বহাল থাকবে, ওরা সূর্যকান্তের কাছে সব বিক্রি করে এলাকা ছেড়ে চলে যাবে।
দায়িত্ব তো নিজের কাঁধে তুলে নিলো, কিন্তু সব কীভাবে সামলাবে সেটা ভেবে প্রথমে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে জোহরা। তবে নিজে থেকে না পারলেও তাকে সার্বিক সহযোগিতা করে সিরাজউদ্দিন তালুকদার। জোহরা প্রথমেই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটা বুঝতে পারে তার একটা শক্তিশালী ডানহাত দরকার। আর সেই শক্তিশালী ডানহাত কে হতে পারে সেটাও খুব পরিষ্কার ছিল। মানুষটা আর কেউ নয় তালুকদার পরিবারের প্রধান নায়েব, মুন্সি মজিদ।
রমিজউদ্দিন তালুকদার যদি বটবৃক্ষ হয়ে থাকে তবে সেই বটবৃক্ষের গোড়া ছিল এই বুড়ো মুন্সি। পারিবারিক ব্যবসা থেকে শুরু করে এলাকা নিয়ন্ত্রণের একটা অংশ সামলাত এই বুড়ো মুন্সি। ছোটোখাটো মানুষটার পারিবারিক উপাধি মুন্সি হলেও সে ওই পেশায় যায়নি। বরং সে ব্যবসায়ী নায়েব উপাধি নিয়ে তালুকদার পরিবারের সমস্ত ব্যবসা সামলাত। জোহরা তাকে ডেকে পাঠিয়ে পরামর্শ করতে বসে। মুন্সি তাকে খুব সহজ কয়েকটা উপায় বাতলে দেয়। প্রথমেই তাদের বাহ্যিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সেজন্যে গঠন করতে হবে লাঠিয়াল বাহিনী। কথাটা জোহরার মনে ধরে। কারণ একই প্রয়োজন জোহরা নিজেও অনুধাবন করতে পারছিল।
তালুকদার পরিবারের একটা অংশের বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের বোয়াল চর এলাকার লোকজন। বোয়াল চরের লোক হবার কারণে এদেরকে ডাকা হতো বোয়ালি। অসাধারণ লাঠিয়াল আর প্রচণ্ড হিংস্র এই বোয়ালিরা বছরে দুইবার নদী পার হয়ে এই পাড়ে আসত ফসলের কাজ করার জন্যে। প্রচণ্ড আগ্রাসী ধরনের এই বাহিনীটা শুধুমাত্র রমিজউদ্দিনের কথা শুনত কারণ রমিজউদ্দিন তাদেরকে নদী ভাঙনের সময়ে আশ্রয় দিয়েছিল। মুন্সির মাধ্যমে জোহরা এদেরকে ডেকে পাঠায়। জোহরা ডেকে পাঠানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরদিন নদী পার হয়ে চলে আসে পঞ্চাশজনের মতো মানুষ।
এরা এসেই জোহরাকে মা-জননী ডেকে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে। এদের ভেতর থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী দেখে ত্রিশজনকে বেছে নেয় সে আর মুন্সি মিলে। এই ত্রিশজনকে নিয়ে ওরা গঠন করে লাল পাগড়ি বাহিনী। প্রত্যেকের পরনে থাকবে সাদা ফতুয়া, লাল পাগড়ি আর লুঙ্গি। এই লাল পাগড়ি বাহিনীই ওদের বাড়ি থেকে শুরু করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পাহারা দিবে, সেই সঙ্গে ওদের যাবতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, এমনকি কোথাও কোনো বিপদ দেখা দিলেও এরাই সেটা সামলাবে। নায়েব মুন্সিকে দেওয়া হয় এই দলের দায়িত্ব। মুন্সির নেতৃত্বে এই লাল পাগড়ি দল অত্র এলাকায় তালুকদার পরিবারের প্রভাব তো ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়ই, সেই সঙ্গে এরা সূর্যকান্তের জন্যে আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়।
জোহরা নিজের পারিবারিক ভিত একটু শক্ত করার পর থেকেই ভাবছিল সূর্যকান্তকে একটু হলেও ভয় দেখাতে হবে। কারণ রমিজউদ্দিন মারা যাবার পর থেকেই সূর্যকান্তের লোকেরা কমবেশি ওদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করার জন্যে নানা ধরনের ছোটোখাটো অপরাধ করে আসছিল। যেমন ওদের কাঠের ব্যাপারীদের ভাগিয়ে নিয়ে যচ্ছিল, খোলা মাট থেকে তাড়িয়ে নিয়ে যচ্ছিল ওদের গরু, ওদের কোনো লোককে একা পেলে উলটোপালটা মার দেওয়া। এমনকি দীর্ঘ দিন ধরে এই এলাকার ঘোড়ার হাটের ইজারা দিয়ে আসছিল তালুকদার পরিবার, সেটাও ছিনিয়ে নিয়েছিল সূর্যকান্তের লোকেরা।
তাই জোহরা সিদ্ধান্ত নেয় সূর্যকান্তের ওষুধ এবার তাকেই উলটো ধরে গেলানো হবে। এতদিন ধরে তারা যা করে আসছিল লাল পাগড়ি বাহিনী এবার সেটাই ফিরিয়ে দেওয়া শুরু করে। দুই পক্ষের মধ্যে ছোটোখাটো সংঘর্ষের তোড়ে একরকম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। সেই সঙ্গে অত্র এলাকার সবচেয়ে বিখ্যাত নাম হয়ে ওঠে জোহরা। একজন মহিলা এরকম করতে পারবে কেউ ভাবতেও পারেনি। একে একে হারানো সব ব্যবসা আবারো ফিরে আসতে শুরু করে ওদের কাছে। অন্যদিকে অস্থির হয়ে ওঠে সূর্যকান্ত। তার অস্থির হবার আরো একটা কারণ তার বড়ো ভাই এক বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছিল। সূর্যকান্ত চাইছিল সেটাকে চালিয়ে যেতে। সে নিজের বিরাট প্রাসাদ বানাতে চলেছে। যে কারণে সে সবকিছু নিজের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো, কিন্তু বাস্তবে ঘটছিল সব উলটো।
অন্যদিকে এলাকাতে দেখা দিয়েছিল ডাকাতের উপদ্রব। পুরো ভারতবর্ষ যুদ্ধে বিধ্বস্ত। যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকেরা ইংরেজদের কাছে হেরে ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে। যুদ্ধের অস্ত্র নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছিল সাধারণ মানুষের ওপরে। ডাকাতের উৎপাতে অস্থির হয়ে উঠেছিল একদিকে ব্রহ্মপুত্রে পানি অন্যদিকে মধুপুর জঙ্গলের রাস্তা।
সূর্যকান্ত আর তালুকদার পরিবারের ভেতরে সংঘর্ষ যখন তুমুল পর্যায়ে, ঠিক এমন সময়ে জোহরা জানতে পারে সূর্যকান্ত নাকি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্যে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করছে। সূর্যকান্ত যদি সত্যি-সত্যি ইংরেজদের এলাকাতে প্রবেশের সুযোগ দেয় তারা অবশ্যই সূর্যকান্তকে সাহায্য করবে, আর সূর্যকান্তের পক্ষে থাকা মানেই জোহরাকে তারা ধরে নেবে শত্রু হিসেবে। এমনিতেই মুসলমানদের ব্যাপারে ইংরেজদের বিরক্তি কাজ করত। তাই এই খবর শুনে জোহরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে।
মুন্সিকে ডেকে জরুরি আলোচনা করে সে। সব শুনে মুন্সি তাকে অভয় দেয়। সে জোহরাকে জানায় সূর্যকান্ত যদি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্যে ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তবে প্রয়োজনে ওরাও করবে। জোহরা বেশ অবাক হয়ে জানতে চায়-সেটা আসলেই সম্ভব কি না। মুন্সি মজিদ তার পানের রসে রাঙানো দাঁত বের করে হেসে ওঠে। সে জোহরাকে বলে অবশ্যই সেটা সম্ভব কারণ কামাল শেঠ নামে একজন ব্যবসায়ীকে সে চেনে যে দীর্ঘদিন যাবৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। চাইলে সে তার মাধ্যমে অবশ্যই যোগাযোগ করতে পারবে।
মুন্সির কথামতোই কামাল শেঠকে গোপনে ডেকে পাঠানো হয় তালুকদার বাড়িতে। মুন্সি, জোহরা আর জোহরার স্বামী সিরাজউদ্দিন কথা বলে কামাল শেঠের সঙ্গে। অত্যন্ত ধুরন্ধর ব্যবসায়ী কামাল শেঠ প্রথমে কিছুই স্বীকার করতে চায়নি, কিন্তু লাল পাগড়ি বাহিনীর ভয় দেখাতেই সে স্বীকার করে যে ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা তো করেই সেই সঙ্গে এই এলাকার সমস্ত খবর সে-ই ইংরেজদের কাছে সরবরাহ করে। সে এটাও নিশ্চিত করে যে সূর্যকান্ত সত্যিই ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আর দুয়েকদিনের মধ্যেই তারা এই এলাকায় পা রাখবে। এমন সময় মুন্সি তার কাছে জানতে চায় যদি সূর্যকান্ত তাদের সঙ্গে সমোঝোতায় আসতে পারে তবে ওদের পক্ষেও সেটা সম্ভব কি না। কামাল শেঠ জানায় সেটা একমাত্র ওদের সঙ্গে কথা বললেই বের করা সম্ভব। ওরা চাইলে সে ইংরেজদের সঙ্গে আলোচনা করার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। ওরাও সেটাই চাইছিল।
এর কয়েকদিন পরেই ইংরেজরা পা রাখে বৃহত্তর এলাকায়, সেই সঙ্গে সূর্যকান্তের আতিথ্য গ্রহণ করে। তখনো ওরা কামাল শেঠের কাছ থেকে কিছুই জানতে পারেনি। ইংরেজরা যেদিন এলাকায় প্রবেশ করে তার পরদিন রাতে কামাল শেঠ চুপিচুপি মুন্সির সঙ্গে দেখা করে জানায় আগামিকাল ইংরেজরা এলাকা ত্যাগ করবে। সেটা করার আগে আগামিকাল রাতে ওরা দেখা করতে রাজি হয়েছে। জোহরা নিজেই ইংরেজদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে যেতে চাইলে মুন্সি তাকে বাধা দেয়। সে জানায় প্রথমেই একজন মহিলার যাওয়াটা ঠিক হবে না। কাজেই সিদ্ধান্ত হয় জোহরা নয়, বরং মুন্সি আর জোহরার স্বামী সিরাজ দুজনে মিলে যাবে দেখা করতে। তারা দুজনে মিলে দেখা করতে যায় পরের দিন। সেটা ছিল আজ থেকে বেশ কয়েকদিন আগে।
এরপর তারা আর ফিরে আসেনি। আর কোনো খবরও পাওয়া যায়নি তাদের।
বারান্দায় বসে থাকা চেয়ার থেকে হঠাৎ করে ঝট করে উঠে দাঁড়াল জোহরা। বৃষ্টিভেজা পথ ধরে কেউ একজন এগিয়ে আসছে। এই গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ভেতরেও ঘোড়ার ওপরে বসে থাকা মূর্তিটা একেবারে স্বচ্ছন্দ। কাদা মাখা পথটা দিয়ে ঘোড়াটাকে নিয়ে আসছে একেবারেই সপ্রভিত ভঙ্গিতে। এভাবে একজনই ঘোড়া চালাতে পারে এই এলাকায়। সেই মানুষটা আর কেউ নয়…মুন্সি মজিদের ছেলে, মুন্সি মানিক।
জোহরা উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার কিনারায় আসতে আসতেই ঘোড়াটা এসে দেউড়ির কাছে থেমে গেল। ওটা থামার আগেই ঘোড়ার ওপর থেকে লাফিয়ে নেমে এলো শুকনো-পাতলা দেখতে মানিক। বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা এক চাকরের হাতে ঘোড়াটাকে ধরিয়ে দিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে এলো বারান্দার ওপরে।
মাথায় সাদা পাগড়ি, খালি গা আর সাদা ধুতি পরনে মানিককে দেখে বোঝার কোনো উপায়ই নেই সে অভিজাত পরিবারের ছেলে। তাকে দেখলে যে কেউ ভাববে হয় সে কাঠের কলে কাজ করে অথবা কোনো কুমোর কিং বা ছুতোরের শিক্ষানবিশ। জোহরা দেখতে পেল বৃষ্টিতে ভিজে মানিকের চোখ জোড়া টকটকে লাল হয়ে আছে। যদিও অন্য যেকোনো সময় হলে আগে মানিকের যত্ন নিতে বলত সে কিন্তু এখন কিছুই না বলে স্রেফ তাকিয়ে রইল তার দিকে।
মানিকও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জোহরার দিকে। সেকেন্ডেরও কম সময় ধরে চোখে চোখে কথা হলো দুজনার। তারপর মানিক বলে উঠল, ‘খবর পেয়েছি, তয় বাবা কিংবা সিরাজচাচার খবর অহনো কিছুই জানি না। ইংরেজগুলার ব্যাপারেও না,’ বলে সে মাথা নাড়তেই ভিজে পানি গড়িয়ে পড়ল পাগড়ির নিচ থেকে। ‘কিন্তু কামাল শেঠ এহন কই আছে সেইটা জানি, লাল পাগড়ি তিনজনরে পাহারায় রাইখা আসছি।’
কথাটা শুনে জোহরার শরীর জুড়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মানিককে ভেতরে যাবার ইশারা করল সে। কিন্তু ভেতরে যাবার আগেই মানিক জোর গলায় বলে উঠল, ‘সময় নাই।’
মানিক তুই ভেতরে যা, আগে শরীর মুছে কাপড় বদলা, তারপর কথা, জোহরা ওকে ভেতরে যাবার ইশারা করল আবার। মানিক কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল, একবার মাথা নেড়ে বলল, ‘বেশি দেরি হই গেলে পরে আমারে দুষ দিয়ো না,’ বলে সে চলে গেল ভেতরে।
জোহরা আবারো এসে দাঁড়াল বারান্দায়। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি এখন বড়ো বড়ো ফোঁটায় রূপ নিয়েছে, সেই সঙ্গে নেমে আসছে রাতের অন্ধকার। জোহরা মনে মনে ভাবল এই অন্ধকার কি প্রকৃতির, নাকি ওর জীবনের অথবা তালুকদার পরিবারের। বহু আগেই নিজের পরিবার শেষ হয়ে গেছে, এখন এই পরিবারই ওর নিজের পরিবার। কিছুতেই সে এই পরিবারের ভাগ্যে অন্ধকার নেমে আসতে দিবে না।
নায়েব আর ওর স্বামী সিরাজ ইংরেজদের সঙ্গে দেখা করতে যাবার পর অধীর আগ্রহে ও অপেক্ষা করছিল। কারণ ইংরেজদের সঙ্গে ওদের আলোচনাটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ওর অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়নি। সন্ধে থেকে রাত, রাত থেকে ভোর, ভোর থেকে দিন। কিন্তু তারা ফিরে আসেনি। না নায়েব, না তার স্বামী গোপনে দেখা করতে যাবার কারণে ওদের সঙ্গে একজন বিশ্বস্ত প্রহরী বাদে আর কেউই ছিল না। এমনকি সে-ও ফিরে আসেনি। প্রথমে জোহরা ভেবেছিল হয়তো রাত বেশি হয়ে যাবার কারণে তারা আর বাড়িতে ফেরেনি। হয়তো কাচারি ঘরে রয়ে গেছে কিংবা আসন্ন হাটের প্রস্তুতির জন্যে বাজারে চলে গেছে। কিন্তু সেখানে লোক পাঠিয়ে জানা গেল সেখানেও যায়নি তারা।
কোথাও তাদের খবর না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে জোহরা। সর্বপ্রথম যার ব্যাপারে সন্দেহ লাগে সেটা হলো জমিদার সূর্যকান্ত। জোহরা মনে মনে ধরেই নেয় নিশ্চয়ই নায়েব আর তার স্বামীর অন্তর্ধানের পেছনে জমিদারের হাত আছে। হয়তো ইংরেজদের ওপরে তার লোকেরা নজর রাখছিল নায়েব আর সিরাজকে পেয়ে তাদের কোনো ক্ষতি করেছে। এই ভাবনা অনুযায়ী জোহরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করার কথা যখন ভাবছে ঠিক তখুনি জানতে পারে : শুধুমাত্র মুন্সি আর সিরাজই নয়, ওদের সঙ্গে ইংরেজ অফিসারদের নাকি কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রথমে ব্যাপারটা শুনে জোহরা ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি, কিন্তু পরে খবর আসে—ঘটনা সত্যি। জোহরা অনুধাবন করে যদি তাই ঘটে থাকে তবে এর পেছনে অন্য কারো হাত আছে। সে ভেতরের খবর বের করার জন্যে মুন্সির পালকপুত্র মানিককে ডেকে পাঠায়। মুন্সির ছেলে হবার পরও মানিক এ বাড়িতেই বলতে গেলে বেড়ে উঠেছে।
মাতৃত্ববঞ্চিত জোহরার সঙ্গে মানিকের সম্পর্ক অনেকটা ছোটো ভাই আর ছেলের মাঝামাঝি। বাপের খবর না পেয়ে সদ্য যুবক মানিক কদিন ধরে পাগল প্রায় হয়ে গেছে। জোহরা ডেকে এনে এব্যাপারে বলতেই কাজে লেগে যায় সে। লাল পাগড়ি বাহিনীর সর্দারের সঙ্গে মিলে খবর নিয়ে আসে যে ইংরেজ বাহিনীর অফিসারেরা গায়েব হয়ে গেছে আর তাদের সূত্র সন্ধান করার জন্যে আরো ইংরেজ অফিসারেরা মাদ্রাজ থেকে থেকে রওনা দিয়েছে।
জোহরা বুঝতে পারে পরিস্থিতি খুবই খারাপ রূপ নিয়েছে। যেকোনো সময় এমনকি ইংরেজদের সৈন্যবাহিনীও চলে আসতে পারে এই এলাকায়। এই অবস্থায় আসলে ওরা কী করবে বুঝতে না পেরে অপেক্ষা করতে থাকে।
এমন সময় ইংরেজ অফিসারেরা আসার পর একটু অবাকই হয় সবাই। ওরা ভেবেছিল নিজেদের অফিসারের গায়েব হবার খবর শুনে পুরো বাহিনী পাঠিয়ে দেওয়া হবে, সেখানে ছোটো একটা দল এসে পৌঁছায় মাত্র। তাতেও আবার সাদা চামড়ার লোক মাত্র দুজন। সত্যিকথা হলো ইংরেজরা অনেক ভাব দেখালেও সত্যিকার অর্থে তাদের লোকবল যে আসলে কতকম সেটা সাধারণ ভারতীয়রা জানেই না।
ইংরেজদের দলটার ওপরে নজর রাখতে পাঠায় ও মানিককে। মানিক নজর রাখতে গিয়ে একবার প্রায় ওদের হাতে ধরা পড়তে বসেছিল। তবে ওদের ওপরে নজর রাখতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার আবিস্কার করে মানিক : কামাল শেঠ নায়েব আর সিরাজ মূলত কামাল শেঠের মাধ্যমেই ইংরেজদের সঙ্গে দেখা করতে গেছিল। ওরা গায়েব হবার পর থেকেই কামাল শেঠকে পাওয়া যচ্ছিল না। নায়েব, সিরাজ আর ইংরেজ অফিসারদের সঙ্গে সে-ও গায়েব হয়েছে কিনা, সেটাও বোঝা যাচ্ছিল না। অবাক বিষয়, হাটের দিন সে ঠিকই এসে হাজির হয় জায়গামতো। তারমানে সে হারায়নি বরং গা ঢাকা দিয়ে ছিল। হাটে না গেলে তার বিরাট ব্যাবসায়িক ক্ষতি হয়ে যেত, তাই ওখানে যেতে বাধ্য হয়েছে। আরো অবাক ব্যাপার কামাল শেঠ হাটে একজন সাদা চামড়ার মানুষের সঙ্গে কথা বলছিল। এরকমটা হওয়া প্রায় অসম্ভব। যাকে এমনিতেই পাওয়া যাচ্ছিল না তাকে একেবারে হাটে দেখা যাবে, তাও একজন ইংরেজের সঙ্গে সেটা এক কথায় অসম্ভব ব্যাপার।
বাজারে কামাল শেঠের ওপরে নজর রাখতে গিয়ে এক পর্যায়ে অন্য এক গণ্ডগোলের সুযোগে শেঠকে হারিয়ে ফেলে মানিক। কামাল শেঠকে হারিয়ে সে জোহরাকে এসে খবর দেয় শেঠকে কী অবস্থায় কোথায় দেখেছে। জোহরা সব শুনে তাকে লাল পাগড়ি বাহিনী নিয়ে জলদি রওনা দিতে বলে, সঙ্গে এও জানিয়ে দেয় যেকোনো মূল্যে শেঠকে তার খুঁজে বের করতে হবে। কারণ শেঠের ওপরে এখন অনেক কিছু নির্ভর করছে। সেই যে লাল পাগড়িদের তিনজনকে নিয়ে বেরিয়ে গেছিল মানিক ফিরে এলো এখন। জোহরা মাথার ভেতরে কিছু চিন্তা-ভাবনা গুছিয়ে নিয়ে ভেতরে এসে ঢুকলো।
রান্নাঘরে এসে দেখল মাটিতে পাটি পেতে মানিক খেতে বসেছে। ইতিমধ্যেই সে পরনের ভেজা পোশাক পরিবর্তন করে শুকনো কাপড় পরেছে। জোহরা মানিকের সামনে গিয়ে একটা পিঁড়িতে বসে পড়ল।
ওকে দেখতে পেয়েই মানিক কথা বলতে শুরু করল খাওয়া বাদ দিয়ে ‘ছোটোমা,’ মানিক ওকে সবসময় ছোটোমা বলেই ডাকে। আর অন্য সবার সামনে ডাকে ছোটো বেগম বলে।
‘আগে খেয়ে নে,’ জোহরা ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল ছেলেটা একেবারেই নিজের উত্তেজনা সামলাতে পারছে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে। তবে ওর উত্তেজনাকে পাত্তা দিলে চলবে না। বরং ওকে শান্ত করে সব শুনতে হবে। বহু আগেই জোহরা বুঝতে শিখেছে কৈশোরের চপলতাকে শান্ত করতে পারলে অনেক কাজে লাগানো সম্ভব আর সেটাকে বাড়তে দিলে সব ধ্বংস হওয়াও সম্ভব। ‘লাল পাগড়িরা কোথায়?’
‘তুমি তো আমার কথাই শুনতাছো না। কামাল শেঠরে বাইর করলাম কেমন হেইডা শুনো।’
‘শুনুম, আগে তুই বল, ওরা কোথায়?’ জোহরার কণ্ঠস্বর ভীষণ শক্ত।
‘ওগোরে কামাল শেঠের পাহারায় রাইখা আসছি,’ বলে সে আরেক লোকমা ভাত মুখে পুরে দিল। সেটাকে সামলে নিয়ে বলতে লাগল। ‘বহুকষ্টে বাইর করছি হেরে। এইবার আর হারান যাইবো না। আমি নিচ্চিত হালায় কিছু একটা জানে, ‘ যে এই পর্যন্ত বলতেই জোহরা কড়া চোখে ফিরে তাকাল তার দিকে। বাজে ভাষার ব্যবহার সে কখনোই সহ্য করে না। মানিক তার চোখের দিকে তাকিয়ে একটু যেন মিইয়ে গেল। চোখে-চোখেই সে দুঃখিত বলে আবারো বলতে শুরু করল। ‘লাল বাহিনী রাইখা আসছি, ওরা শেঠরে এক্কেরে চক্ষে চক্ষে রাখবো। হে লড়লেও লগে- লগে লড়ব।’
‘ওরে উঠায়া আনোস নাই ক্যান?’
‘জানতাম তুমি এইডা জিগাবা, এপ্লেগাই কইতে চাইতাছিলাম হেরে ক্যামনে পাইলাম,’ আবারো বলতে শুরু করল সে। ‘দুফরে তো হেরে বাজারে হারাইয়াই ছিলাম। এরপরে হেরে আর পাইনা। ওইদিকে বাজারে লাগল গণ্ডগুল। এনু তুমারে আরেকটা জিনিস জানাইরাহি। বাজারে ওই নতুন ইংরেজ অফিসারেরা নাকি ঘুড়া চুর ধরছে,’ মানিকের কথাটা শুনলেও খুব একটা পাত্তা দিল না জোহরা। ওরা ঘোড়া চোর ধরে বেড়াক তাতে ওর কোনো আগ্রহ নেই। আগে মূল ঘটনা জানা দরকার।
‘এসব প্যাচাল বাদ দিয়ে মূল ঘটনা বল। কীভাবে খুঁজে বের করলি শেঠকে?
‘হেইডাই তো কইতাছি। ইংরেজরা ঘুড়া চোরগর পিছে লাগার পরে বাজারের তো বারোডা বাইজ্জা গেল। আমি বাড়িত ফিরা আইসা তুমারে সব কইলাম। এন থাইক্কা বাইর হইয়া চিন্তা করতাছি কামাল শেঠরে কই পাওয়া যাইতে পারে। এমন সময় খবর পাইলাম কাঠকলের বাজারে এক লাল পাগড়ি নাকি ওই ইংরেজ সাবরে দেখছে?’
একটু চমকে উঠল জোহরা। ‘কোন ইংরেজ, যারা হারিয়ে যাওয়া অফিসারদের খুঁজে বের করতে এসেছে?’
‘নানা, হেরা না। হেরা তো ওই ঘুড়া চুর লইয়া ব্যস্ত,’ মানিক ভাত মুখে দিতে দিতে বলল।
‘তাহলে এইটা আবার কে?’ জোহরা বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা।
‘এইটা হইলো আমাগো মতোন সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ইংরেজ। এই ব্যাটারেই কামাল শেঠের লগে দেখছিলাম বাজারে,’ মানিক এই পর্যন্ত বলতেই জোহরা জানতে চাইল, ‘সেই ইংরেজদের ওই দল থাইক্কা আলাদা মনে হইলো ক্যান?’
‘হেরে তো একবারও হেগো লগে দেহি নাই। আর হেরা পুরা মধুপুর দাপায়া বেড়াইতাছে আর এই ব্যাডা কেমুন জানি পলায়া পলায়া বেড়ায়। যাই হোক, আর হেয় কাপরও ইংরেজগোর মতোন পিন্দে না। হেরে দেইখা চিনবারই পারতাম না। কারণ হাটবারের কারণে তো অনেক বাইরের ব্যাপারী আইছে। তয় হেরে এক লাল পাগড়ি চিনবার পারে কারণ হের লগে একটা চামড়ার ব্যাগ আছিল। বাজারো কামাল শেঠের লগে কতা কউনের সময় আমিও ব্যগটা দেখছি। হেই ব্যগটা দেইখাই লাল পাগড়ি হেরে চিন্না আমারে খবর পাড়ায়। আমার ক্যান জানি মনে অয় এই ব্যাডা কামাল শেঠরে খুঁইজ্জা বাইর করবই। কারণ বাজারে গণ্ডগুল লাগুনে হেয় শেঠের লগে কথা শেষ করবার পারে নাই। তো লাল পাগড়ি আর আমি হের পিছে লাইগ্গা রইলাম। দেখলাম হেয় পরথম কাঠ গুদাম থাইক্কা বাজারে গেল। হেন থাইক্কা বহু ঘোড়াঘুরি কইরা বিকাল দিকে বেগুনবাড়ি সরাইখানা গিয়া উঠল। বুঝলাম ব্যাডা এইহানেই উঠছে। ভাবতাছি লাল পাগড়িরে রাইখা আমি অন্যদিকে খুঁজ করমো এমুন সময়ে দেহি কামাল শেঠ ঘুড়ার গাড়ি কইরা সরাইখানার ভেতরে ঢুকলো। আর আমি চইলা আসলাম তুমারে জানাইতে।’
‘ভালো করছোস, তারমানে কামাল শেঠ আর ওই লোক এহনো অইখানেই আছে?’
মানিক কিছু না বলে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
‘কয়জন লাল পাগড়ি আছে ওইখানে?’ জোহরা চিন্তিত মুখে জানতে চাইল।
‘তিনজন। হেরা দুইজনের মধ্যে কেউ ওইহান থাইক্কা লড়লেও খবর পাইয়া যাবো।’
‘সেটা যথেষ্ট নয়,’ জোহরা উঠে দাঁড়াল। ‘লাল পাগড়িদের ভেতর থেকে পনেরো জনকে তৈরি হতে বল। আমরা একটু পরেই রওনা দিবো। কামাল শেঠের সঙ্গে আমি নিজে কথা বলতে চাই। ওকে যদি এখানে আনা সম্ভব না হয় তবে তাকে যেখানে পাওয়া যাবে আমি নিজেই সেখানে যাবো। লাল পাগড়ি বাহিনী আর পালকি তৈরি করতে বল। লুকাচুরি অনেক হইছে। আর না। শেঠের সঙ্গে সরাসরি কথা কইতে হবে এইবার।’
বলে জোহরা ভেতরে নিজের কক্ষে চলে এলো। পুরনো দিনের কাঠের আলমারির ভেতর থেকে বের করল নিজের স্বামীর কালো একটা পোশাক। একটু ঢিলা হলেও বেশি করে কুঁচি দিয়ে সেটা পরে নিলো নিজের গায়ে। লোহার তৈরি বড়ো একটা ট্রাঙ্ক খুলে বের করল রমিজউদ্দিনের রেখে যাওয়া তলোয়ার আর একটা পিস্তল। একটা বড়ো বন্দুকও আছে কিন্তু সেটা সঙ্গে নেওয়া ঝামেলা হবে ভেবে রেখে দিল। ধুতি আর ফতুয়া পরে মাথায় পাগড়ি চাপিয়ে কোমরের একপাশে পিস্তল নিয়ে হাতে তলোয়ারসহ যখন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল অন্য এক মানুষকে আয়নায় আবিস্কার করল সে।
মনে মনে নিজেকে শক্ত করে ও পা রাখল কক্ষের বাইরে। প্রথমেই ওকে দেখতে পেল বাড়ির কাজের মেয়ে। কিছুই না বলে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল সে। ও হেঁটে বাইরে আসতে আসতে পুরো বাড়ির যারাই দেখতে পেল ওকে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ও তলোয়ার হাতে যখন বাইরে এসে দাঁড়াল পালকি বাহক আর লাল পাগড়ি তো বটেই এমনকি মানিকও হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তালুকদার বাড়ির কোনো মেয়ে তো দূরে থাক ওরা সম্ভবত এই জীবনে কোনো মেয়েকেই এধরনের পোশাক পরা অবস্থায় কল্পনাও করেনি। জোহরা কাউকে পাত্তা না দিয়ে সোজা উঠে বসল পালকিতে। ও উঠে বসায় একটু পরেই চলতে শুরু করল পালকি, সঙ্গে অন্যান্য লোকজন। ওরা বেশ খানিকটা এগোনোর পর হঠাৎ মানিক পুরো বহরকে থামতে বলে টোকা দিল পালকির একপাশে।
জোহরা জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার, থেমে গেল কেন সবাই?’
‘ছোটো মা, এক লাল পাগড়ি খবর নিয়া আসছে। কামাল শেঠ নাকি সরাইখানা থেকে বাইর হইয়া কার লগে জানি দেহা করবার জন্যে এইদিকেই আসতাছে।’
‘এদিকে মানে কোথায়? আর সে কারো সঙ্গে দেখা করার জন্যে আসছে এটা লাল পাগড়ি জানতে পারল কীভাবে?’
‘ছোটো মা, কামাল শেঠ সরাইখানা থেকে বিদায় নেওয়ার সময়ে সেই ইংরেজের সঙ্গে কথা বলছিল তারই কিছুটা কানে আসছে ওগোর।’
‘স্রেফ শোনা কথা থেকে তুই আমার কাছে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্যে এসেছিস? কামাল শেঠ এমনিতেই ধুরন্ধর লোক সে হয়তো বুঝে গেছে কেউ তার ওপরে নজর রাখছে। তাই সবাইকে ভুল পথে চালানোর জন্যে এমনটা করছে।’
‘না, ছোটো মা। আমাদের লোকেরা শুনেছে সে নাকি এখানে কার থেকে টাকা উসুল করবার আইছে।’
এক মুহূর্ত ভাবল জোহরা। এরকম ঝামেলায় থাকার পরও কামাল শেঠ টাকার ব্যাপারে ছাড় দেবে না। কাজেই ব্যাপারটা সত্য হতে পারে। ‘ঠিক আছে, এক কাজ কর। আমরা আরেকটু এগিয়ে অপেক্ষা করি। তুই লাল পাগড়িদের নিয়া ওইখানে যায়া ওরে ধইরা নিয়া আসবি,’ বলে সে একটু থামলো মুহূর্তের জন্যে। মানিককে একা পাঠিয়ে ভুল করছে কিনা ভেবে নিলো মুহূর্তের জন্যে। নাহ, এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
‘ঠিক আছে, তুই যা। কোনো ভুল করিস না। ‘
মানিক লাল পাগড়িদের কয়েকজনকে নিয়ে চলে যেতেই আরেকটু সামনে এগিয়ে জঙ্গলের মাঝে ফাঁকা একটা জায়গায় পালকি থামাতে বলল। এতক্ষণ পালকির ফাঁক দিয়ে অন্ধকারের ভেতরে তাকিয়ে দেখতে দেখতে বিরক্ত লাগছিল। এখন ফাঁকা জায়গায় পালকি থামাতেই নেমে এলো জোহরা। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই। সকালটা ছিল রোদেলা, বিকেল থেকে সন্ধের পর পর্যন্ত সময়টা গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে কেটেছে এখন আবার বৃষ্টি থেমে আকাশে থালার মতো গোল চাঁদ উঠেছে
অন্যান্য দিন এই সময়ে সাধারণত ঘুমিয়ে যায় সে। আজকে রাতের এই জেগে থাকাটা বেশ উপভোগই করত সে, যদি মাথায় এত্তোগুলো দুঃশ্চিন্তা না থাকত। পালকি থেকে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে পাহারাদার আর পালকি বাহকেরা সরে গেছে। একপাশে ফাঁকা জায়গাতে জোছনার ভেতরে পায়চারি করতে লাগল জোহরা। ওর হিসেবে কামাল শেঠের অবস্থান যেখানে থাকার কথা সেখান থেকে তাকে ধরে আনতে আধা ঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। কারণ জায়গাটা খুব একটা দূরে না এখান থেকে। কিন্তু এক ঘণ্টা পার হবার পরও যখন কেউই এলো না তখন বেশ একটু চিন্তিত হয়ে উঠল সে। আরো আধা ঘণ্টা সময় কোনোরকম ঘটনা ছাড়াই নিশ্চুপ কেটে গেলো। অস্থির লাগছে জোহরার। এবার কিছু একটা করতে হবে।
লাল পাগড়িদের সর্দারকে সামনে বাড়তে ইশারা করল সে। আবারো পালকিতে চড়ে বসল ও। তবে না উঠলেও চলত কারণ আরেকটু এগোতেই লোকজনের হাঁক-ডাক শুনতে পেল। চেনা গলাটা মানিকের আর অচেনা গলাটা সম্ভবত কামাল শেঠের। পালকি দাঁড় করানোর নির্দেশ দিল ও।
মানিকদের গলা থেমে গেছে। নিজের পোশাক সামলে নিয়ে মুখে একটা কাপড় জড়িয়ে ও নেমে এলো পালকি থেকে। ওর ঠিক সামনেই হাঁটু গেড়ে বসে আছে কামাল শেঠ। তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মানিক, অন্যপাশে লাল পাগড়ি বাহিনীর প্রধান নিতাই। নিতাইয়ের হাতে সব সময়ের মতোই একটা লম্বা চকচকে কাঞ্চন বাঁশ দিয়ে তৈরি লাঠি। জোহরা কামাল শেঠের সামনে দাড়িয়ে মুখ থেকে কালো কাপড়ের আবরণ সরিয়ে ফেলল।
ওকে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে মুখ হাঁ হয়ে গেল তার। পোশাকের কারণে প্রথমে সে বুঝতে পারেনি, এখন বুঝতে পেরে বাকিদের মতোই তাজ্জব হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে চোখে মুখে ভয় আর বিপদের ছায়া খেলতে লাগল। দুইবার মুখ খোলার পরে আওয়াজ বেরুল তার মুখ দিয়ে। ‘বেগম,’ বলে একবার ঢোক গিলে সে আবারো যোগ করল, তালুকদার বেগম।
‘কামাল শেঠ, তোমাকে এখানে ধরে আনার কোনো ইচ্ছেই ছিল না কিন্তু আমি নিরুপায়,’ জোহরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কামাল শেঠের দিকে। ‘শেঠ, তুমি জানো আমার স্বামী কোথায়, আর ওর বাবা?’ বলে সে মানিকের দিকে দেখাল। ‘ওরা শেষবার তোমার সঙ্গে বের হয়ে গেছিল। তুমি আমাকে জানাবে, ওরা কোথায় আছে, কী হয়েছে ওদের?’
‘বেগম সাহেবা আমি কিছুই জানি না, আমি তো আপনাগর ভালার জন্যেই…’
‘শেঠ, তুমি একটা নিচ মনের মানুষ। যে মানুষ ফিরিঙ্গিদের টাকা খেয়ে নিজের মানুষদের খবর অন্যদেরকে সরবরাহ করে সে অন্যের ভালোর জন্যে কিছু করে না, তুমি টাকা নিয়েছিলে মুন্সি আর আমার স্বামীকে ইংরেজদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে,’ বলে ও একটু থামলো। উত্তেজনায় কথা আটকে আসছে। ‘ঠিক আছে, সেটা তোমার ব্যবসা। কিন্তু টাকার বিনিময়ে তুমি তাদেরকে যদি টোপের মুখে নিয়ে গিয়ে থাকো শেঠ, তবে তোমার খবর আছে,’ জোহরা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল তার আগেই কামাল শেঠ একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর পায়ের ওপরে।
শেঠকে ওর দিকে এগোতে দেখে চট করে একপা পিছিয়ে গেল জোহরা। শেঠ মাটিতে শুয়ে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার মতো মাটিতে মুখ রেখে চিৎকার করতে লাগল। ‘বেগম সাহেবা, আমি হাছা কইতাছি। আমরা এই এলাকার তাবৎ মানুষ তালুকদার বাড়ির নুন খায়া বড়ো অইছি। হেগো লগে বেইমানি করার কতা চিন্তাও করতে পারি না।’
জোহরা একবার মাটিতে পড়ে থাকা শেঠকে দেখল আরেকবার দেখল মানিককে। মানিক মাথা নেড়ে ওকে এই লোকের কথা বিশ্বাস করতে মানা করল। জোহরা লাল পাগড়ির সর্দার নিতাইকে ইশারা করল শেঠকে মাটি থেকে তুলতে। নিতাই লাঠিটা আরেকজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের সুপারি গাছের মতো মোটা দুই হাত দিয়ে শেঠকে বাচ্চা ছেলের মতো শূন্যে তুলে ফেলল।
জোহরা লোকটার দিকে এগিয়ে এলো। ‘শেঠ, তুমি একটা বেইমান, শয়তান। তবে সত্যি যদি তালুকদার বাড়ির নুনের প্রতি তোমার কোনো কৃতজ্ঞতা থেকে থাকে তবে তুমি আমাকে এক্ষণ জানাবে আমার স্বামী আর মুন্সির কী হয়েছে? না জানালে নিতাই তোমার দুই হাত শরীর থেকে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে। এক্ষুণি।’
শেঠ আবারো হাউমাউ করে উঠতে যাচ্ছিল তার আগেই নিতাইয়ের দুই হাতের চাপ খেয়ে গোঁ গোঁ করতে লাগল। জোহরা নিতাইকে ইশারা করল চাপ কমাতে। ‘শেঠ, কথা বলো। আমারে জানাও, কী হইছিল সেদিন।
‘বেগম সাহেবা আমি হাছাই জানি না ওইদিন আসলে কী হইছিল,’ বলে সে বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিতে লাগল। ‘তয় খালি নায়েব আর সিরাজ তালুকদারই না ওই ইংরেজরা শুদ্ধা সবাই গায়েব হই গেছে। হাছা কতা অইলো ওইদিন রাইতে আমি নায়েব সাইব আর সিরাজ ভাইরে ইংরেজগো ক্যাম্পের বাইর পর্যন্ত দিয়া চইলা আইছিলাম। কারণ নায়েব সাইবই আমারে হেগো লগে থাকতে মানা করছিল।’
জোহরা ভাবতে লাগল। ঘটনা সত্য হলে হতেও পারে কারণ নায়েব কোনোভাবেই চাইবে না শেঠ তাদের আলোচনায় থাকুক। জোহরা কিছু বলার আগেই শেঠ বলে চলেছে। ‘হেরা রাজনীতি আর ব্যবসা নিয়া আলোচনা করব আমি ওইহানে থাইক্কা কী করুম। আর ওইখানে মেঘালয়ের রাজার চরও আছিল, হেইলাল্গাই…’
‘এক মিনিট, শেঠ। তুমি কীভাবে জানতে ওখানে তারা কী নিয়ে আলোচনা করত, আর মেঘালয়ের রাজার লোক থাকবে সেটাও তোমার জানার কথা না,’ জোহরার মনে কিছু একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে।
‘আমি, আমি, জানতাম,’ হঠাৎ জোহরার প্রশ্নবাণে একটু হতচকিত হয়ে গেছে কামাল শেঠ। আর এই চমকে গিয়েই ভুলটা করে বসল সে। ‘হেরা আমারে কইছিল ক্যাম্পে যাওনের আগে।’
কথাটা শোনামাত্রই জোহরা বুঝতে পারল কামাল শেঠ মিথ্যে কথা বলছে। সিরাজ কিংবা নায়েব দুজনার একজনও ইংরেজদের সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা করবে সেটা কামাল শেঠকে জানানোর কোনোই কারণ নেই। তারমানে শেঠ নিশ্চয়ই লুকিয়ে তাদের আলোচনা শুনেছিল। ‘শেঠ তুমি মিথ্যে বলছ,’ শেঠের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বলল জোহরা। ‘তুমি লুকিয়ে ওদের আলোচনা শুনছিলে তাই না?’
শেঠ পুরোপুরি হতভম্ভ হয়ে গেছে। সে কিছু বলার আগেই জোহরা কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তলটা বের করে সোজা চেপে ধরল শেঠের গলায়। ‘শেঠ, সত্যি কথা বলো, না হলে…’ জোহরার এই হঠাৎ অগ্নিমূর্তি দেখে মানিক আর নিতাইও চমকে গেছে। ওরা কি করবে বুঝে ওঠার আগেই আবারো কামাল শেঠ হাউমাউ করে উঠল।
শেঠের কান্নাকে পাত্তা না দিয়ে জোহরা জানতে চাইল, ‘কী শুনছিলি তুই?’
‘আমি আমি বেশি কিছু শুনি নাই। হেরা ক্যাম্পে ঢুকুনের পরে আমি পিছে দিয়া গিয়া হেগো কতা শুনতে থাহি। ওইখানে ইংরেজরা ছিল পাঁচজন, মুন্সি, সিরাজ ভাই আর মেঘালয়ের এক বড়ো ব্যবসায়ী আছিল। আমি জানি ওই লুক আসলে ঘুড়ার ব্যবসা করলেও হে মেঘালয়ের রাজার চর। হেরা কথা শুরু করার এট্টু পরেই মেঘালয়ের ওই ব্যবসায়ীর লগে মুন্সি আর সিরাজ ভাইয়ের কথা কাটাকাটি লাইগ্গা যায়। এইডা দেইখা আমি ওইখান থাইক্কা সইরা আসি। বাইরে আইসা দেহি হেই লুক নিজের পাহারাদার নিয়া গটগট কইরা ক্যাম্প থাইক্কা বাইর হইয়া গেল। এরপরে আমি আর ওইহানে থাকার সাহস পাই নাই।’
জোহরার মনে দ্রুত ভাবনা চলছে। ‘তারমানে তুই বলতে চাস ইংরেজদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে মেঘালয়ের ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে ওদের ঝামেলা হয়; তারমানে তারা ওদের কোনো ক্ষতি করে থাকতে পারে?’
হইতে পারে, বেগম সাহেবা? আমি জানি না,’ বলে কামাল শেঠ ফোঁপাতে লাগল। জোহরা লোকটার মুখের নিচ থেকে পিস্তলটা সরিয়ে নিলো। ‘ওদেরকে কোথায় পাওয়া যাবে? ওই মেঘালয়ের ব্যবসায়ীকে, নাকি ওরা ইতিমধ্যেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে?’
‘বেগম সাহেবা হেরা হাটের জন্যেই আসছিল। আইজ হাটবার শেষ, আইজই আলীগড়ের দিকে রওনা দেওয়ার কতা।’
তুই জানিস ওরা কোন পথ দিয়ে যাবে?’ পাশ থেকে মানিক জানতে চাইল। এতক্ষণ সে চুপচাপ শুনছিল।
‘হেরা এইহান থাইক্কা রাশশাহি অইয়া কলিকাতা যাবে, হেন থেইক্কা আলীগড়। হেরা কুনদিক দিয়া যাবে আমি জানি না তয় হেরা কুনহানে ক্যাম্প করছিল হেইডা আমি জানি।’
‘তুই আমাদেরকে ওইখানে নিয়া যাবি,’ এটা বলতেই সে চট করে আবারো জোহরার সামনে মাটিতে শুয়ে পড়ল।
জোহরা একটু পিছিয়ে গেল। কেন জানি ওর কাছে লোকটার এই অতিভক্তি একেবারেই ভালো লাগছে না। ‘শেঠ, মাটি থেকে ওঠ।’
‘বেগম সাহেবা এইসব ব্যবসায়ীদের লইয়াই আমার কাম হেগো বিরুদ্ধে গেলে বাল-বাচ্চা নিয়া না খাইয়া মরতে অইবো।’
‘আর আমি যা বলি সেটা যদি না শোন তবে বাল-বাচ্চা না দেইখাই মরতে হবে, বুঝছোস?’ জোহরার কণ্ঠস্বরও পাথরের চেয়েও বেশি কঠিন।
কামাল শেঠ একটু চিন্তা করল। ‘ঠিক আছে আপনেরা কয়েকজন আমার সঙ্গে আসেন,’ বলে সে একটু থেমে ভাবল। ‘সবাই মিল্লা না। সবাই গেলে হেরা আগেই টের পাইয়া গেলে সমইস্যা অইতে পারে। তারচেয়ে আগে দুই একজন আমার লগে চলেন। আগে পরিস্থিতি বুইজ্জা লন। তারপর যা করার কইরেন। তয় আগে বইল্লা নেই। আমি হেগোরে দেহাইয়া দিলেই আমারে বিদায় দিবেন। আমি হেগো সামনে যাইতে পারুম না।’
জোহরা চুপচাপ ভাবতে লাগল। লোকটা কোনো প্রতারণা করার চেষ্টা করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে।
‘কুনো জরুরত নাই, গেলে আমরা সবাই…’ মানিক কথাটা শেষ করার আগেই জোহরা কথা বলে উঠল। ‘কত দূরে জায়গাটা, এখান থেকে?’
‘বেশি দূরে না। ঘরের অন্যপাশে বইদের কাছাকাছি। এইখান থাইক্কা মাইল দুইয়ের ভেতরেই অইবো।’
জোহরা ফিরে তাকাল মানিকের দিকে। ‘কামাল শেঠ ভুল বলেনি। আমাদের সবার সেখানে যাওয়াটা ঠিক হবে না।’
‘কিন্তু এই ব্যাটা যদি কোনো চাল চাইল্লা থাকে, তাইলে?’ জোহরার সিদ্ধান্ত মানিক মেনে নিতে পারছে না।
‘কিছুই করার নেই। সত্য বের করতে হলে এখন এই ঝুঁকিটুকু নিতেই হবে, বলে একটু থামলো জোহরা। ও নিজেও আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না এইভাবে ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক হচ্ছে কি না। তবে এই ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া আসলে কিছু করারও নেই কারণ মেঘালয়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই এলাকার গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাবসায়িক সম্পর্ক আছে। এত লোক লস্কর নিয়ে ওখানে গেলে যদি একটা যুদ্ধাবস্থা দেখা দেয় তবে সেটা পরিস্থিতি আরো ঘোলা করতে পারে। তার চেয়েও বড়ো কথা ওদের সঙ্গে বড়ো ধরনের কোনো ঝামেলায় জড়ালে সিরাজ আর মুন্সির কী হয়েছিল সেটা আর বের করা যাবে না।
ভাবনা-চিন্তা গুছিয়ে নিয়ে আবারো কথা বলে উঠল জোহরা। ‘আমরা সবাই এখান থেকে একসঙ্গেই রওনা দিবো। কামাল শেঠের সঙ্গে শুধু তুই আমি আর নিতাই যাবো। বাকিরা পথেই কোনো জায়গায় অবস্থান করবে যাতে খবর পাঠালে যেকোনো সময়ে ওরা জরুরি ভিত্তিতে সাহায্য করতে পারে। বোঝা গেছে আমার কথা?’ সবাই মাথা দোলালো। শুধুমাত্র মানিক চুপচাপ তাকিয়ে আছে জোহরার দিকে। জোহরার এই সিদ্ধান্ত সে মেনে নিতে পারছে না।
পালকি বাহিনীকে বাড়ির দিকে পাঠিয়ে দিয়ে জোহরাও এবার বাকি সবার সঙ্গে পায়ে হেঁটে রওনা দিল গন্তব্যের দিকে। মাইলখানেক এগিয়ে ভাওয়াল গড়ের শেষ মাথায় এসে বাকিদেরকে অপেক্ষা করতে বলে কামাল শেঠকে নিয়ে জোহরা, মানিক আর নিতাই রওনা দিল মেঘালয়ের ব্যবসায়ীদের ক্যাম্পের দিকে।
***
‘হুজুর, এইবার কী করবেন? এরা তো দুইদল দুই দিকে যাবো মনে হইতাছে, শংকরের চোখে একইসঙ্গে কৌতূহল আর ভয় খেলা করছে।
তবে শংকর যে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করছে সেই একই ব্যাপার ম্যাকফিকেও ভাবিয়ে তুলেছে। ঘরের ভেতরে কামাল শেঠের অপহরণকারীদের অনুসরণ করে এসে ওরা যখন দেখতে পেল ছেলেদের পোশাক পরা একজন মহিলা তাকে জেরা করছে। আর সেই মহিলাও যে কেউ নয় অত্র এলাকায় সবচেয়ে প্রভাবশালী দুই পরিবারের একটির কর্ত্রী, ব্যাপারটা জানতে পেরে বেশ অবাক হয়ে যায় ম্যাকফি। আসলে কী ঘটছে বোঝার জন্যে আকুল হয়ে ওঠে ও।
ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে জেরার এক পর্যায়ে দেখতে পায় ওরা চলতে শুরু করেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাকফি সিদ্ধান্ত নেয় অনুসরণ করতে হবে। কারণ ওর মন বলছে রাতের বেলা এই অদ্ভুত ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। এই ঘটনার সাখে অফিসারদের অন্তর্ধানের কোনো না কোনো সংযোগ অবশ্যই আছে। তাই শংকরের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সে পিছু নেয় ওদের। মাইলখানেক পিছু-পিছু চলার পর। ওরা এখন ঘন জঙ্গলের কিনারায় পৌঁছে গেছে। এখানে এসে এখন দলটা দুই ভাগ হয়ে দুইদিকে রওনা দিয়েছে তাই শংকর জানতে চাচ্ছে এবার কী করবে ম্যাকফি।
ম্যাকফির মনে কোনো দ্বিধা নেই। কারণ তার মনে হচ্ছে ব্রিটিশ অফিসারদের অন্তর্ধানের ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনার কোনো-না-কোনো সংযোগ অবশ্যই আছে।
শংকর তুমি এক কাজ করো, মহাবীর সিং আর জোনাথনের কাছে গিয়ে জানাও এখানে কী ঘটেছে, তোমাদের অপেক্ষা করার দরকার নেই। তোমরা সোজা চলে যাও কাচারি বাড়িতে। আমি এদের পিছু নিয়ে দেখি এরা কোথায় যায়, কী করে।
প্রবল আপত্তিতে মাথা নাড়তে লাগল শংকর, ‘হুজুর, সেইটা কেমনে সম্ভব। আপনি এই এলাকা কিচ্ছু চিনেন না। কিছু যদি নাও হয় তাও ফিরবেন ক্যামনে?’
‘এত চিন্তা করলে হবে না। তুমি ওদের খবর দাও। আমি কাজ সেরে ঠিকই কাচারিতে ফিরতে পারব। যাও,’ ম্যাকফি একটু তাড়াহুড়ো করছে কারণ সে দেখতে পাচ্ছে সামনের দুটো দলের বড়োটা থেমে আছে আর ওদেরকে রেখে ছোটো দলটা জঙ্গলের ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছে। দেরি করাটা একদম ঠিক হবে না। ‘শংকর, যাও।’ বলেই ও ঝোপ-ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে রওনা দিল যেদিকে ছোটো দলটা অদৃশ্য হয়েছে সেদিকে।
খানিকটা ঘুর পথে এসে ও চলে এলো যেখান দিয়ে দলটা এগিয়ে গেছে সেদিকে। এখানকার জঙ্গল খুব বেশি ঘন না কিন্তু জোছনা থাকার পরও অন্ধকারের ভেতরে দেখতে সমস্যা হচ্ছে। ম্যাকফি অন্ধের মতোই আরো বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল। কিন্তু সামনে কারো ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। না কামাল শেঠ, না লাল পাগড়ি না বাকি দুজনার একজনেরও।
বিরক্তির আওয়াজ বেরিয়ে এলো ম্যাকফির মুখ দিয়ে। শংকরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটু দেরি করে ফেলেছে ও। হারিয়ে ফেলেছে দলটাকে।
***
জোহরা, মানিক, নিতাই আর কামাল শেঠ একটানা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল। ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসাতে জঙ্গলের ঘনত্ব অনেকটাই পাতলা হয়ে এসেছে তবে পথ বন্ধুর হয়ে উঠেছে খুব। একটু আগের জোছনা বিদায় নিয়ে আকাশ বেশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। আবারো যেকোনো সময়ে বৃষ্টি হতে পারে মনে হচ্ছে।
জোহরা হাঁটতে হাঁটতে একবার কামাল শেঠকে দেখল। লোকটা বেশ নেতিয়ে পড়েছে। তাকে একহাতে ধরে আছে মানিক। অন্যদিকে লাঠি হাতে সতর্ক নিতাই। যতই পরিশ্রমী হোক তিনজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে জোহরা।
‘আর কত দূর?’ হাঁপাতে হাঁপাতে জানতে চাইল সে। কেউ জবাব দেওয়ার আগেই পেছনে একটা শব্দ শুনে তিনজনেই চমকে উঠল।
থেমে দাঁড়িয়েছে সবাই। ‘কী ব্যাপার, নিতাই? এই বনে কি বাঘ আছে?’ উৎকণ্ঠিত স্বরে জানতে চাইল জোহরা।
‘নয়, বেগম সাহেবা এদলা ওয়াক্তে তো বাঘ থাকুইনের কতা নয়, তয় মাইচ্ছা বাগের কুনো সময়-গময় নাই,’ নিতাই লাঠি বাগিয়ে ধরে পেছনটা জরিপ করছে। ‘বেবাগতে হুঁশিয়ার রাহুইন।’
ওরা আরো বেশ খানিকটা এগিয়ে একটা সরু পায়ে চলা পথের প্রান্তে এসে থামলো। ‘হগ্গলে সাবধান,’ বলে সে সাবধানে আগে বাড়ল। আরেকটু এগোতেই সামনে এগোনোর পর কিছু চোখে পড়ার আগে কানে এলো ঘুঙরুর শব্দ আর গানের আওয়াজ।
ব্যাপার কি? এখানে গানের আওয়াজ আসছে কোথা থেকে, মনে মনে ভাবল জোহরা। আরেকটু এগোতেই জবাব পাওয়া গেল। সামনে আলো দেখা যেতেই কামাল শেঠ সবাইকে ইশারা করল নিচু হতে। ওরা ধীরে ধীরে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোল।
একটু আগের বৃষ্টি-বৃষ্টি ভাব অনেকটাই কমে গেছে। আকাশ এখন পরিষ্কার। কালচে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে ঘোলাটে চাঁদ। ঠিক জোছনা না হলেও
একেবারে অন্ধকারও বলা যাবে না। তবে অন্ধকার হলেও ওদের দেখতে কোনো সমস্যা হতো না কারণ সামনে বেশ আলো।
যেখান থেকে নাচ-গানের শব্দ ভেসে আসছে ওটাই যে মেঘালয়াদের ক্যাম্প এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এদেশিদের থেকে ওদের তাঁবুর আকৃতি আর ধরন একটু আলাদা হয়ে থাকে। ক্যাম্পের চারপাশে বসানো মশালের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ক্যাম্পের সামনের অংশ।
পায়ে চলার পথের পাশেই একটু ফাঁকা জায়গা দেখে বসানো হয়েছে বড়ো বড়ো তিনটে তাঁবু। তাঁবুর একপাশে চলছে রান্নাবান্নার আয়োজন। অন্যপাশে প্রহরার কাজে নিয়োজিত লোকজন থাকার কথা কিন্তু সেখানে এই মুহূর্তে কেউই নেই। কারণ সবাই তিনটে তাঁবুর সামনের ফাঁকা জায়গাটায় এসে জড়ো হয়েছে।
ঠিক তাঁবুর সামনে ফাঁকা জায়গাটায় তক্তপোশের আসন বসানো হয়েছে। সেখানে বসে আছে কয়েকজন। তাদের ঠিক পাশেই মাটিতে বসে আছে গরিব চেহারার কিছু লোক। ওদের ভেতরে কয়েকজনের হাতে খঞ্জনি ছোটো তবলা আর মাদুলি জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। এই মুহূর্তে তিনজনে ওগুলোতে সুর তুলেছে, ওদের ঠিক সামনেই গোঁফওয়ালা স্বাস্থ্যবান চেহারার একজন মানুষ সুর তুলে গান গাইছে। দেশি বাদ্যযন্ত্র আর গানের সুরে-সুরে ঘুঙরু পরে গোল জায়গাটাতে নাচছে দশ-বারো বছরের সুন্দর দেখতে একটা ছেলে। ছেলেটার নিম্নাঙ্গে মেয়েদের মতো পোশাক, পায়ে ঘুঙরু, খালি গা আবার মাথায় পাগড়ি। গানের তালে তালে নাচছে ছেলেটা।
চারপাশে উৎসব উৎসব পরিবেশ। এদের মাঝে হঠাৎই জোহরার নিজেকে খুব অপাঙতেয় মনে হলো। অভিজাত ঘরের বউ সে। এভাবে নিজের স্বামীর খোঁজে মরিয়া হয়ে জঙ্গলের ভেতরে চোরের মতো কয়েকজন সম্ভ্রান্ত মানুষের ওপরে নজর রাখছে ব্যাপারটা ভাবতেই নিজেকে খুব ছোটো মনে হলো জোহরার। হয় সে মেঘালয়াদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে আর না হয় চলে যাবে এখান থেকে। সামনে তাকিয়ে দেখল গান থেমে গেছে ক্যাম্পে। সবাই খোশগল্প করছে। একটু আগে গান গাইতে থাকা মোটা গোঁফের লোকটাকে দেখা গেল মেঘালয়াদের প্রধানের কানে কানে কিছু একটা বলছে। তার কথা শুনে সর্দার লোকটা খুশিতে মাথা নাড়ল।
আর না, মনে মনে ভাবল জোহরা। সে পাশ ফিরে মানিককে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই গায়ক লোকটা সর্দারের সম্মতি পেয়ে তালি দিয়ে উঠল সেই সঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘হুজুরের তেষ্টা পেয়েছে, তাম্বাকু লাও।’
জোহরা হঠাৎ খেয়াল করল ওদের মাঝে কামাল শেঠ নেই। ওরা যখন মনোযোগ দিয়ে সামনে দেখছিল কামাল শেঠ কখন উঠে গেছে কেউ খেয়ালই করেনি। সঙ্গে সঙ্গে ঝট করে সামনে ফিরে বোকা বনে গেল জোহরা। কামাল শেঠ তার বিরাট বপু নিয়ে মেঘালয়াদের ক্যাম্পের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে চলেছে, তার পিছু নিয়েছে মানিক। জোহরা আর নিতাই কী করবে বুঝে ওঠার আগেই অন্য ঘটনা ঘটতে শুরু করল।
গোঁফওয়ালা গায়ক লোকটা তামাক আনার কথা বলে তালি দিতেই কোথায় যেন তীক্ষ্ণ গলায় একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। প্রায় একই সঙ্গে ক্যাম্পের চারপাশে আরো কয়েকটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। জোহরা চমকে উঠে সামনে তাকাল। একটু আগের হাসি-আনন্দে মশগুল ক্যাম্প এই মুহূর্তে পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। একটু আগে আগুনের সামনে বসে থাকা ভুখা-নাঙ্গা লোকগুলো হাতে কিছু একটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মেঘালয়াদের ওপরে। জোহরা দেখতে পেল চারপাশ থেকে হঠাৎ সুশৃঙ্খল আক্রমণে একে একে লুটিয়ে পড়ছে ক্যাম্পের প্রহরীরা। একদিকে ক্যাম্পের ভেতরে লোকজনের মৃত্যুনাদ অন্যদিকে কামাল শেঠ আর মানিক ছুটে চলেছে ওইদিকেই।
চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল জোহরা। সামনে তাকিয়ে দেখল : শুধু প্রহরীরাই না মেঘালয়াদের সর্দারও লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। এতক্ষণে ও পরিষ্কার দেখতে পেল আসলে কী ঘটছে ওখানে। মেঘালয়াদের সর্দারের গলায় একটা হলুদ রঙের রুমাল পরিয়ে পেছন থেকে সর্বশক্তিতে টানছে গোঁফওয়ালা সেই গায়ক লোকটা। এমনকি নাচতে থাকা পিচ্চি ছেলেটাও যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে, গায়ক লোকটা রুমাল টানছে আর পিচ্চি ছেলেটা দুই হাতে চেপে ধরেছে মৃত্যুরত লোকটার পা। আধ মিনিটেরও কম সময়ের ভেতরে ক্যাম্পের মধ্যে দশ থেকে বারোজন মানুষ মারা পড়ল। ঠিক এমন সময়ে ক্যাম্পের ভেতরে চলতে থাকা মৃত্যু-বুহ্যের ঠিক মাঝখানে গিয়ে পড়ল দৌড়াতে থাকা বিশ্বাসঘাতক কামাল শেঠ, তার ঠিক পেছনেই মানিক।
ওদেরকে প্রথমে দেখতে পেল গায়ক লোকটা। সে সবেমাত্র মেঘালয়াদের সর্দারকে খুন করে তার গলা থেকে ফাঁসটা খুলে আনছিল এমন সময় তার দৃষ্টি পড়ল দুজনার ওপরে। বিজাতীয় ভাষায় কিছু একটা বলে উঠতেই তার দলের দুজন দুপাশ থেকে ধরে টেনে মাটিতে শুইয়ে দিল কামাল শেঠকে। সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের ভেতরে তার গলায় একই রকম দেখতে হলুদ ফাঁস পরিয়ে দিল আরেকজন। বোকার মতো দৌড়াতে দৌড়াতে ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছিল মানিক, এই দৃশ্য দেখে ভয়ে উলটো দিকে দৌড় দিল কিন্তু দশ-পনেরো গজ এগোনোর আগেই গায়ক লোকটা পেছন থেকে ধরে ফেলল তাকে। শক্তিশালী হাতে পেছন থেকে জাপটে ধরে মাকড়শার মতো দক্ষতায় গলায় ফাঁস পরিয়ে টান দিল।
জোহরা যেখানে বসে আছে সেখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মাটিতে পড়ে তড়পাতে থাকা মানিকের মুখটা। গলায় ফাঁস পরিয়ে টান দিতেই তার চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল জোহরা। কিন্তু লাল পাগড়িদের সর্দার নিতাই তো আর ভয় পাবার লোক নয়। গায়ক লোকটা মানিককে মাটিতে ফেলে দিতেই একটা ছোটোখাটো গর্জন করে লাঠি হাতে জোহরার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল সে। ঝেড়ে দৌড় দিল মানিককে সাহায্য করার জন্যে।
ওদিকে মানিককে মাটিতে ফেলে দক্ষহাতে ফাঁসে টান দিয়েছে গায়ক। নিতাইয়ের গর্জন শুনেও তার কাজে বিরতি দিল না সে। নিতাইকে তেড়ে আসতে দেখে স্রেফ একটা কনুই নিচু করে মালিকের ঘাড়ের পেছনে চাপ দিয়ে ধরে অন্যহাতে ফাঁসটা দিয়ে আরো জোরে টান দিল। নিচ থেকে ফাঁসের টান আর ওপর থেকে কনুইয়ের চাপে মানিকের গর্দানটা পাটকাঠির মতো মট করে ভেঙে গেল।
অন্যদিকে নিতাই দৌড়ানো অবস্থাতেই মাথার ওপরে তার কাঞ্চন বাঁশের লাঠি তুলে শূন্যের ভেতরে চালিয়ে দিল ওটা। তার লক্ষ্য ছিল মানিকের ওপরে উঠে বসা গায়কের মাথা। সব ঠিক থাকলে নিতাইয়ের মোটা লাঠির এক বাড়িতেই গায়কের মাথা ভর্তা হয়ে যেত। কিন্তু সেটা হলো না। কারণ মানিকের শরীরের ওপরে বসা অবস্থাতেই লাঠিটাকে আসতে দেখে সে নিজের শরীরটাকে স্রেফ পেছনে ঢলে পড়তে দিল লোকটা। ফলে নিতাইয়ের তেল চকচকে লাঠির কোনাটা শূন্যে শুধু পাক খেলো একবার।
লাঠির বাড়ি ছুটে যেতেই নিতাই শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। অন্যদিকে গায়ক শোয়া অবস্থাতেই এক গড়ান দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিশালদেহী নিতাই শরীরের ভারসাম্য ফিরে পাবার আগেই সে মাটি থেকে এক খাবলা কাদামাটি তুলে নিয়ে ছুড়ে মারলো নিতাইয়ের চোখে-মুখে। গায়ক সেটা ছুড়ে মারতেই সদ্য শরীরের ভারসাম্য ফিরে পাওয়া নিতাইয়ের চোখে তো বটেই নাকে-মুখেও ঢুকে গেল মাটি। এক হাতে লাঠি ধরে থাকা অবস্থায় নিজের অজান্তেই তার অন্য হাত চলে গেল চোখের কাছে। এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাল গায়ক।
তার হাতে ধরা হুলুদ রঙের রুমালটা দুইবার শূন্যে ঘুরিয়ে বিশেষ কায়দায় সেটা ছুড়ে মারলো নিতাইয়ের দিকে। কিন্তু নিতাইয়ের গলা নয় তার লক্ষ্য ছিল নিতাইয়ের হাতের লাঠি। রুমালটা নিখুঁত লক্ষ্যে পেঁচিয়ে গেল লাঠিটার গায়ে। দক্ষ হাতে শক্ত টান দিতেই নিতাইয়ের সাধের লাঠি হাতছাড়া হয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। লাঠি হাতছাড়া হতেই অন্ধপ্রায় নিতাই একটা গর্জন করে তেড়ে গেল গায়কের দিকে। কিন্তু তার রাগ আর শক্তি কোনোটাই কাজে লাগল না। বিশালদেহী নিতাইয়ের হালকা-পাতলা সুঠামদেহী গায়কের সামনে কোনো পাত্তাই পেল না। নিতাইকে ভীম বেগে ছুটে আসতে দেখে গায়ক একপাশে সরে গেল, ফলে নিতাই যখন তার কাছাকাছি চলে এসেছে সে একলাফে নিতাইয়ের গায়ের জামা ধরে ছুটন্ত নিতাইয়ের একেবারে ঘাড়ের ওপরে উঠে পড়ল।
নিতাই যত শক্তিশালীই হোক, ছুটন্ত অবস্থায় পূর্ণ বয়স্ক একজন মানুষের ওজন সহ্য করতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে। ভীষণ জোরে মাটিতে ঠুকে গেল তার নাক। গায়ক এমনিতেই প্রায় নিতাইয়ের গায়ের ওপরেই উঠে পড়েছিল, নিতাই মাটিতে পড়তেই বনবিড়ালের মতো উঠে এর তার পিঠের ওপরে, পেঁচিয়ে ধরল ঘাড়। নিতাই মাটিতে পড়ে স্থির হবার আগেই সে তার গলায় ফাঁস পরিয়ে পাশবিক দক্ষতার সঙ্গে টান মারলো ওপরের দিকে। নিতাইয়ের দেহটা স্রেফ দুইবার খাবি খেল শূন্যে। আরো শক্ত করে ফাঁস চেপে ধরল গায়ক। নিতাই দুইহাতে মাটি খামচে ধরে এগোনোর চেষ্টা করছে ওদিকে গলায় ফাঁসের টানে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে জিভ, দুই চোখ দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ওই দুটোও কোঠর থেকে টুপ-টুপ করে বেরিয়ে আসবে। নিতাই আরেকটু এগোনোর চেষ্টা করতেই গায়ক আরো জোরে চেপে ধরল ফাঁস। নিতাইয়ের চোখ দুটো বেরিয়ে না এলেও দাঁতের ফাঁক দিয়ে আধ হাত বেরিয়ে আসা জিভের পেছনে মট করে ভেঙে গেল কণ্ঠার হাড়।
আর সহ্য করতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠল জোহরা। ওর মনে হতে লাগল পেটের ভেতর থেকে টকটক পানি উঠে আসছে। যেকোনো সময় ভাসিয়ে দিতে পারে বমি করে। তবে বমি হলো না ওর, যা হলো সেটা আরো খারাপ। নিতাইকে নিকেশ করে গলা থেকে রুমালটা খুলে আনছিল এমন সময় ঝোপের পেছন থেকে উদ্ভট আওয়াজ শুনে ঝট করে সেদিকে ফিরে তাকাল গায়ক
শরীরটাকে একটু সামলে মুখ তুলে সামনে তাকিয়েই জমে গেল জোহরা। গায়ক লোকটা এখনো নিতাইয়ের দেহের ওপরে বসে আছে, এক হাতে ধরে আছে নিতাইয়ের গলা থেকে খুলে নেওয়া রুমালটা। স্থির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে জোহরার লুকিয়ে থাকা ঝোপটার দিকেই।
মৃত্যুর আতঙ্কের সঙ্গে জোহরা অনভব করল সে ধরা পড়ে গেছে। তবে তারচেয়েও বেশি আতঙ্কে ওর দম বন্ধ হয়ে এলো কারণ কেউ একজন পেছন থেকে মুখ চেপে ধরেছে ওর।