অধ্যায় একুশ – বর্তমান সময়
হোটেল মোস্তাফিজ ইন্টারন্যাশনাল, ময়মনসিংহ
নিশ্বাস যেন বুকের ভেতরে চেপে বসতে চাইছে। বড়ো করে একবার দম নিয়ে ঘড়ি দেখল বাশার। এগারোটার ওপরে বাজে, আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা আসছে না কেন। এই খবর বের করতে তো এতক্ষণ লাগার কথা নয়।
ওরা আসতে আসতে সে মাথার ভেতরে সবকিছু আরেকবার যাচাই বাছাই করে নেওয়ার চেষ্টা করল। বাঁ হাতের আংটিটা ডান হাতের মুঠোয় চেপে ধরে পুরো ব্যাপারটাকে সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল মাথার ভেতরে। ব্যক্তিগত আর কর্মজীবন দুটোর অবস্থাই ভয়াবহ খারাপ। নিজের মা মারা গেছে, মায়ের লাশটা দেখা তো দূরে থাক আজতক তার কবরটা পর্যন্ত দেখার ভাগ্য হয়নি। নাকি নিজের গোয়াতুমির কারণে দেখতে পারেনি? হতে চেয়েছিল জ্ঞান বিতরণকারী, হয়ে গেছে আইন প্রয়োগকারী। সেখানেও চমৎকার একটা ডিমোশন আর বদলি নিয়ে এসেছে সেই শহরে যেখানে সে জীবনেও আসতে চায়নি। যাই হোক, সেখানে এসেও কপাল খারাপ এখানকার ভারপ্রাপ্ত ওসি ওরই এক সময়কার বন্ধু যেকিনা এখন তার শত্রু রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ধরিয়ে দিয়েছে এমন এক কেস যার কোনোকূল- কিনারা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হলো…
‘স্যার কি ঘুমাই গেলেন নাকি?’ বেশ বয়স্ক ড্রাইভার ওর দিকে তাকিয়ে সামনের সিট থেকে জানতে চাইল।
‘নাহ, ঘুমানোর সুযোগ কই। এখনো নাস্তাই করতে পারলাম না,’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল ওর। ‘বাসিত মিয়া, তুমি তো বহু বছর ধরে পুলিশে আছো।’
‘জি স্যার, তা প্রায় বিশ বছর তো হবেই,’ বলে বুড়ো ড্রাইভার একটু হাসল।
‘কখনো শুনছো, মরা মানুষ জ্যান্ত হইতে?’
‘না স্যার, বহু তরঙ্গের কাহিনি শুনছি কিন্তু এরকম শুনি নাই,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। তয় স্যার মরা মানুষ জ্যান্ত হইতে না দেখলেও বহু জ্যান্ত মানুষরে চোখের সামনে মরতে দেখছি। আর মরণেরও বহু পন্থা আছে। কিছু কিছু মরণ আছে শারীরিক মরণের চেয়ে বেশি খারাপ। স্যার আপনে আমার চেয়ে বয়সে ছোটো। তাই কইতাছি, আপনে কোনো ভুল করলে ওসি কিন্তু আপনের বারোটা বাজায় ছাড়বো। হেয় যে আপনের পিছে লাগছে এইটা এখন কোতয়ালি থানার উপেন সিক্রেট। আর কাউরেই বিশ্বাস কইরেন না, স্যার।’
‘হুম, বুঝতে পেরেছি। ধন্যবাদ, বাসিত মিয়া। কথাগুলো আমি মনে রাখবো, ‘ বলে মাথার পুলিশি টুপি খুলে ভিউ মিররে চেহারাটা একবার দেখে নিলো ও। হাজার হলেও একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, তা সে যেমনই হোকনা কেন। ‘বাসিত মিয়া, তুমি চলে যাও। একটু পরেই আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা আসবে, আমি ওদের সঙ্গে কাজে নামবো।
ড্রাইভার বিদায় নিতেই বাশার টুপিটা আবারো পরে নিয়ে হোটেল মোস্তাফিজের প্রবেশ পথের দিকে এগোল। হোটেলের সামনের ছোটো পেট্রল পাম্পটা পার হয়ে পায়ে চলা পথটা ধরে চলে এলো প্রবেশ পথের কাছাকাছি। কাচের বিরাট সুইং ডোরটা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে যাবে এমন সময় অপর পাশ থেকে ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসা আরেকজন মানুষের সঙ্গে ধাক্কা লাগল ওর। লোকটা ওরই মতো লম্বা হবে। পরনে জিন্সের শার্ট, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছিল।
সে আর বাশার একই সময়ে সুইং ডোরটা ঠেলে প্রবেশ করতে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা লাগতেই লোকটার হাত থেকে ছুটে গেল ফোনটা। আর বাশারের হাত থেকে ছুটে গেল সুইং ডোরের হাতল। হাতল ছুটে যেতেই কাচের ভারী পাল্লাটা ছুটে এলো সোজা লোকটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটার কোমর ধরে খপ করে টেনে তাকে সরিয়ে নিলো বাশার। লোকটাও ওর ইউনিফর্মের কাঁধ খামচে ধরে নিজের পতন সামলালো।
‘সরি ভাই, সরি,’ নিজেকে সামলে নিয়ে বাশারকে ধন্যবাদ জানাল লোকটা।
‘সাবধানে হাঁটেন ভাই, চোখের মাথা খেয়ে আসছেন নাকি সকালবেলা!’ মেজাজটা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে বাশারের। নিজের টুপি আর ইউনিফর্ম সামলে নিয়ে সামনের দিকে এগোল। হোটেলের রিসিপশন আর লাউঞ্জ পার হয়ে চলে এলো দোতলার রেস্তোরাঁয়। বেলা একটু পড়তির দিকে হলেও এখনো অনেকেই বসে নাস্তা করছে। ভেতরে প্রবেশ করে একবার চোখ বুলিয়েই একপাশের টেবিলে বসে নাস্তা করতে দেখল জয়া সরকারকে।
মনে মনে ভাবল, যে গায়ের রং! দুই মাইল দূর থেকেও চোখে পড়বে। কাছে এসে দেখল অনেক খাবার তার টেবিলের ওপরে। ওকে দেখে কোনো হাই-হ্যালো না কিচ্ছু না বলে খিক খিক করে হাসতে লাগল। জয়ার হাসি দেখে বাশারের গরম মেজাজ আরো গরম হয়ে গেল।
‘কী ব্যাপার, এত হাসির কী হলো?’ একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল ও।
জবাব না দিয়ে আরো কিছুক্ষণ নীরবে হাসল জয়া। ‘হেভি একটা রোমান্টিক দৃশ্য দেখলাম। আহা কী ধাক্কা আর, আর কী উদ্ধার। আপনি তো মশাই সহজেই সিনেমার নায়ক হয়ে যেতে পারেন। এই পুলিশের চাকরিতে পড়ে আছেন কেন?’ বলে সে আবারো হাসতে লাগল।
‘মজা নেন?’ বাশার তাকিয়ে দেখল এই টেবিল থেকে নিচের প্রবেশ পথটা দেখা যায়। বাশারের গা জ্বলে উঠল মহিলার কথা শুনে।
‘নিতেই পারি,’ ডিম পোচসহ বাটার টোস্টের একটা অংশ মুখে পুরে বলতে লাগল জয়া সরকার। ‘কারণ আমার তো আর আপনার মতো ফাটছে না যে মুখ- চোখ গম্ভীর করে নাস্তা না করেই কাজে বেরিয়ে যাবো।’
বাশারের মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেল। ‘আচ্ছা, আমার ফাটছে! আপনার যদি কোনো আগ্রহই না থাকে তাহলে নিজের কাজ-কর্ম ফেলে এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন। আর শোনেন, আপনাকে কে বলেছে আমি নাস্তা করিনি? ফুল ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি আমি।
বাশারের গরুগম্ভীর কথা শুনেও বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না মহিলার মধ্যে। হ্যাঁ, হ্যাঁ। অবশ্যই। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর শোনেন আমি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কারো চাকর নই। যেটা আমার আগ্রহ সেটাই আমার কাজ- কর্ম। আমি এখানে এসেছি যাতে নিজের পুরনো কৌতূহল মেটাতে পারি। আর এই সুবাদে একজন ব্যর্থ পুলিশ অফিসারের কোনো সাহায্য হয়ে যায় তবে ক্ষতি কী?’
মহিলার শেষ কথাটা শুনে ঝট করে উঠে দাঁড়াল বাশার। ‘দেখুন, আমার মনে হয় না আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারব। আপনার চিন্তা-ভাবনা যদি এরকম হয় …’
‘আস্তে স্যার,’ মহিলাও ওর সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেছে। ‘সরি, আমি বেশি কথা বলে ফেলেছি। ঠিক আছে, আমরা একে-অপরকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি সেটাই। ঠিক আছে?’
নিজেকে শান্ত করল বাশার। এই মহিলার সঙ্গে অযথা ঝামেলা করে লাভ নেই। ও যতটুক বুঝতে পারছে এর স্বভাবই এমন। ‘ঠিক আছে,’ বলে ও বসে গেল। ওয়েটার এসে চা দিয়ে গেল মহিলার সামনে।
‘এই শোন্,’ ওয়েটারকে বলল মহিলা। ‘স্যারের জন্যে চা নিয়ে আয়। স্যার তো নাস্তা করেই এসেছে। নাকি ঠান্ডা কিছু। শোন্, স্যারের জন্যে একটা ঠান্ডা কোক নিয়ে আয়,’ বলে সে আরেকটা মৃদু হাসি দিয়ে চায়ে চুমুক দিল। ‘এবার বলেন, কাজের কতদূর? উকিলকে খুঁজে বের করতে পেরেছেন?’
‘লোক পাঠানো হয়েছে,’ বাশার এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি।
‘ওহ, লোক পাঠিয়েছেন! এখনো খবর বের করতে পারেননি?’ বলে জয়া সরকার তার হাত ব্যাগ থেকে একটা মার্লবোরো অ্যাডভান্স সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ঠোটে লাগাল।
‘সমস্যা নেই, ওরা খবর নিয়ে সোজা এখানে চলে আসবে।
জয়া কিছু না বলে তাকিয়ে রইল বাশারের দিকে। মনে হলো সে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করছে। জয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে গতদিনের সেই গভীর পানিতে তলিয়ে যাবার অনুভূতি হলো বাশারের। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ সরিয়ে নিলো। চোখ তো নয়, যেন ভয়ংকর ফাঁদ।
ওয়েটার এসে বাশারের সামনে কোক রেখে গেল। কোকের বুব্দুদের দিকে তাকিয়ে খালি পেটের ভেতর থেকে ঢেকুর উঠে এলো বাশারের। খালি পেটে কোক! মনে মনে ঢোক গিললোও।
‘ম্যাডাম,’ ওয়েটারের ডাকে ধ্যান ভাঙলো জয়ার। ‘কী?’
‘ম্যাডাম, এখানে স্মোক করা বারণ,’ ওয়েটার খুব অস্বস্তির সঙ্গে বলল।
‘তোর বাপের হোটেল?’ জয়া হঠাৎ এমন ধমকে উঠল থতমত খেয়ে গেল ওয়েটার।
‘না, ম্যাডাম।’
‘তাইলে চুপ থাক, আর না হয় যার সমস্যা হয় তারে ডাইক্কা আন,’ বলে গজগজ করতে লাগল জয়া। একবার ওকে দেখল আরেকবার বাশারের ইউনিফর্মের দিকে তাকিয়ে পালিয়ে বাঁচলো ওয়েটার।
ছেলেটাকে ধমকানোর কোনো দরকার ছিল? ওর কী দোষ?’ বাশার কোকের বোতল হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, এখনো ঢোক গেলেনি।
ফালতু কথা বাদ দেন। কাজের কথা শোনেন। কোথা থেকে শুরু করব বলেন। গতদিন জানি কোনো পর্যন্ত বলেছিলাম?’
‘কালী মূর্তি,’ বাশার সাহস করে একটা ঢোক দিতেই কার্বোনেটেড বেভারেজ ওর গলা আর বুক জ্বালিয়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল। ‘ডাকাতি হওয়া মূর্তিটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওটাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে কথা বলছিলাম আমরা।’
‘কিন্তু কীভাবে?’ চিন্তিত মুখে জানতে চাইল জয়া। ‘যেটা এতদিনে সম্ভব হয়নি, এতদিন পরে সেটা কীভাবে বের করা সম্ভব?’
বাশার এখনো ভাবছে। বহুদিন পরে ওর নিজের ভেতরের পুলিশি সত্তাটা অনুভব করতে পারছে। গতকাল সারারাত সে ঘটনাগুলো ধাপে-ধাপে বসিয়ে একটা সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে।
কী ব্যাপার, কিছু বলেন?’ খানিকটা ধমকেই উঠল জয়া।
বাশার পাত্তাও দিল না। আরো কিছুক্ষণ পরে সে জবাব দিল। মুখের সামনে তুলে ধরল নিজের হাতের তিনটে আঙুল। ‘তিন একে তিন, বিজয়, ভুয়া প্ৰতিনিধি আর মিউজিয়ামের কিউরেটর,’ তিনটে আঙুল দেখাল ও।
‘প্ৰথমে গেল বিজয়, পুড়ে মরলো সে,’ বলে একটা আঙুল ভাঁজ করে ফেলল। ‘এরপরে গেল ভুয়া প্রতিনিধি, ডুবে মরলো সে,’ বলে আরেকটা আঙুল নামালো। ‘রইল বাকি এক; কিউরেটর, তাকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। এই রহস্য উন্মোচন করতে হলে তার সহায়তা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সে কে, সে কোথায় আছে তার সঙ্গে দেখা করা জরুরি।’
‘এক্সকিউজ মি, ম্যাডাম,’ পেছনে থেকে মার্জিত গলা শুনে ফিরে তাকাল জয়া। ম্যানেজার গোছের একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ‘ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না আমাদের এখানে আসলে স্মোক করা…’
‘বারণ?’ ম্যানেজারের কথাটা জয়া শেষ করল। ম্যানেজার কোনো জবাব দেওয়ার আগেই হাতে ধরা সিগারেটটাতে জোরে একটা টান দিয়ে ধোঁয়াটা সরাসরি ম্যানেজারের মুখে ছেড়ে সিগারেটের মোথাটা চায়ের পিরিচে চেপে নিভিয়ে দিল। ‘খুশি?’ বলে ও বাশারের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বলল, ‘চলেন, বেরোই।’
বাশার আর জয়া মিলে বেরিয়ে এলো বাইরে। ‘মানুষের সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করেন কেন আপনি। ম্যানেজারের সঙ্গে এরকম না করলে কী হতো?’ এই মহিলার আচরণে বিরক্ত বাশার। জয়া কিছু বলার আগেই সে মোবাইল বের করে আবদুল্লাহকে কল দিল। কল ধরল রমিজ দারোগা। সে জানাল কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। কথা শেষ করে জয়ার দিকে তাকিয়ে ও দেখল জয়া হাসছে। পুরনো সেই শ্লেষমাখা হাসি।
‘আপনি কেন পুলিশের চাকরিতে দিনদিন অবনতি করছেন, আমি বুঝতে পারছি,’ জয়ার বলার ধরনটাই এমন, কটু কথা হবার পরও বাশারও হেসে উঠল।
ওরা হেটেলের বাইরে বেরিয়ে দেখতে পেল আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা দাঁড়িয়ে আছে জিপের সামনে।
‘কাজ হয়েছে? জানতে চাইল বাশার। তাদেরকে জয়ার কথামতো পাঠানো হয়েছিল মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের পারিবারিক উকিলের কাছে।
‘স্যার, কাজ হইছেও, আবার হয়ও নাই,’ আবদুল্লাহ এগিয়ে আসতে আসতে বলতে লাগল।
‘এই চুপ,’ তাকে ধমকে উঠল রমিজ দারোগা। ‘বেশি কতা কয় এই পোলা। স্যার কাম অইছে। উকিলের লগে দেহা অইছে।’
‘কী বলল উকিল?’ রমিজ দারোগা অতি-উত্তেজিত থাকলেও বাশার শান্তভাবেই জানতে চাইল।
‘স্যার, যেই উকিলসাইবের নাম ঠিকানা আপনে দিছিলেন সে তো বাইচ্চা নাই,’ আবদুল্লাহ বেশ ইনোসেন্ট চেহারায় জবাব দিল। গতদিন প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনে বসে আলোচনা শেষে জয়াই এই উকিলের ঠিকানা বাশারকে দিয়েছিল। এই উকিল হলো মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের পারিবারিক উকিল। বাশারের বক্তব্য ছিল যেহেতু সেই ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের একজনের সংশ্লিষ্টতা আছে কাজেই তাদের ব্যাপারে খোঁজ করতে হবে। আর সেটার জন্যে প্রাইমারি সোর্স ছিল আচার্য পরিবারের পারিবারিক উকিল। সকালে জয়ার সঙ্গে দেখা করতে আসার আগে তাই আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগাকে ও পাঠিয়েছিল ওদের উকিলের চেম্বারে।
‘তাহলে আপনি যে বললেন উকিলের সঙ্গে দেখা হয়েছে?’ বাশার প্রশ্ন নিয়ে তাকাল রমিজ দারোগার দিকে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ধরালো একটা। খালি পেটে কোক এরপর এবার সিগারেটের ধোঁয়া মুখে ঢুকতেই মুখটা আরো বিস্বাদ হয়ে গেল।
মুক্তাগাছা জমিদার পরিবারের সবকিছু সামলাইতো যেই উকিল সেই উকিল মইরা গেছে। তবে হেই জমিদার পরিবারের সব কিছুর দায়িত্বে আছে আগের উকিলের ছেলে। তার লগেই আমাদের দেখা হইছে।’
‘আচ্ছা,’ বাশার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জিপের সিটের ওপরে এসে বসে পড়ল। ওর সামনেই একপাশে রমিজ দারোগা আর আবদুল্লাহ আর অন্যপাশে দাঁড়িয়ে জয়া মোবাইল ঘাঁটছে।
‘কী বলল এই উকিল?’
‘খুব বেশি কিছু জানাইতে পারে নাই। কারণ এই পরিবারের সবকিছু নাকি তার বাবাই দেহাশোনা করতেন। বাবা মরার পরে সেয় পারিবারিকভাবে দায়িত্ব পেলেও খুব বেশি কিছু জানে না। আর খুব বেশি কিছু জানুনেরও নাই। কারণ কেউ তো নাই।’
‘মানে,’ হঠাৎ চমকে ওঠাতে বাশারের গলায় ধোঁয়া আটকে কাশি চলে এলো। ‘কেউ নেই মানে কী? ‘
‘মানে হেরা তো বাইচ্চা নাই,’ এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে কথা বলে উঠল রমিজ দারোগা। ‘সেই এগারো বছর আগে হেগো শেষ বংশধর মরার পরে এহন দেশে আর কেউই নাই।
‘স্যার,’ এই যে, বলে আবদুল্লাহ একটা কাগজ বাড়িয়ে দিতে গেল বাশারের দিকে। রমিজ দারোগা কমলা রঙের কাগজটা ছোঁ দিয়ে নিয়ে নিলো তার কাছ থেকে। ওটা কেড়ে নিয়ে বাড়িয়ে দিল বাশারের দিকে।
‘কী এটা?’ বাশার একটু অবাক হয়েই জানতে চাইল।
‘স্যার, এইটা সেই কিউরেটরের নাম ঠিকানা,’ বলে রমিজ দারোগা বত্রিশ ভোল্টের একটা হাসি দিল। ‘উকিলে যখন বলল সে এই ব্যাপারে বেশি কিছু জানে না আসলে তার বাপে সব জানত, তখন সে পুরান ফাইল বাইর কইরা কইলো এই ব্যাপারে জানতে চাইলে সেই সময়ে মিউজিয়ামের কিউরেটর ছিল যে হেয় আপনেগো সাহাইয্য করতে পারব। কইয়া সে তার নাম আর মিউজিয়ামের ঠিকানা লেইখা দিল।’
এইটুকু কাজ করতে পেরে রমিজ দারোগার বিপুল আনন্দ দেখে বাশার আফসোসের সঙ্গে একবার মাথা নেড়ে জিপ ছাড়ার নির্দেশ দিল।
রমিজ দারোগার দেওয়া চিরকুকটা হাতে নিয়ে বাশার দেখল তৎকালীন কিউরেটরের নাম লেখা : রিফাত মজুমদার।
‘এই, জিপ ছাড়ো,’ এবার জায়গামতো খোঁজ নেওয়ার একটা সুযোগ এসেছে।