অধ্যায় সতেরো – বর্তমান সময়
নতুন বাজার, ময়মনসিংহ
আরো আধাঘণ্টা পরে বাশার বেরিয়ে এলো টমির ল্যাব থেকে। হাতে একটা খাকি রঙের খামের ভেতরে সিজিআইয়ের মাধ্যমে উদ্ধার করা সেই ছবি। ইতিমধ্যে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। জিপের কাছে এসে ও দেখতে পেল আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা দুজনেই ঝিমোচ্ছে। হঠাৎ বাশারের মাথায় দুষ্টামি বুদ্ধি চাপলো। জিপের কাছে এসে সিটের ওপরে খামটা রেখে হাত বাড়িয়ে জিপের হর্ন চেপে ধরতেই দুজনেই লাফিয়ে উঠে বসল। জোরে-জোরে হেসে উঠল বাশার।
দুজনে একটু স্বাভাবিক হতেই হাসি থামিয়ে কপট ভঙ্গিতে ধমকে উঠল বাশার, ‘ডিউটির সময়ে ঘুম কীসের?’
‘স্যার, খিদায় তো জান শেষ, কিছু খাইতাম না?’ পেছন থেকে রমিজ দারোগা জানতে চাইল।
এই লোক কি খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কিছুই বোঝে না। ও কিছু বলার আগেই আবদুল্লাহ জানতে চাইল, ‘স্যার, এইহানে কিছু পেলেন?’ ছেলেটার অর্ধ-শুদ্ধ আর অর্ধ-স্থানীয় ভাষা শুনে হাসি পেলেও চেপে গেল বাশার। একটু আগে একবার হেসেছে এখন আবার হাসাটা ঠিক হবে না। আর তাছাড়া এভাবে হেসে উঠলে ছেলেটা মনে কষ্ট পেতে পারে।
‘কাজ হয়েছে, আবার হয়নি। ঘটনা যা ছিল সেটা আরো প্যাঁচ লেগেছে। ওই সময়ে কী ঘটেছিল তা বের করতে পারিনি। তবে সেই লোকটার চেহারা বের করা গেছে যার কঙ্কাল আমরা পানির নিচ থেকে উদ্ধার করেছি।’
‘তাই নাকি? তাইলে তো মানুষটার পরিচয়ই বের করন যাইবে,’ আবদুল্লাহ উত্তেজনার সঙ্গে বলে উঠল 1
‘হ্যাঁ, সেটার জন্যে এই ছবি ঢাকা পাঠানো হয়েছে,’ বাশার সিটে বসে চোখ মুদলো। পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে। যে লোকটার কঙ্কাল ওরা পানির নিচ থেকে উদ্ধার করে এনেছে তাকে আজ সকালে কীভাবে দেখতে পেল কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না ওর। এই ব্যাপারটা এখুনি আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগাকে জানাবে না সিদ্ধান্ত নিলো। তাহলে ওরা আরো ভয় পেয়ে যেতে পারে।
‘স্যার, কুনদিকে যামু?’
আবদুল্লাহর প্রশ্ন শুনে চোখ খুলল বাশার। ‘হুম, চলো আগে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। গাঙ্গিনাপাড়ের দিকে চলো।’
আবদুল্লাহ জিপ ছেড়ে দিতেই আবারো ভাবতে লাগল ও। ছবিটা প্রথম দেখার পর অবিশ্বাসের একটা ঢেউ খেলে যায় ওর মনের ভেতরে। টমিকে সেটা বলতেই সে হইচই শুরু করে দেয়। তার মতে বাশার যা বলছে সেটা হতেই পারে না। কারণ ফেস রিকভারির মাধ্যমে উদ্ধার করা চেহারা অবশ্যই ঠিক হয়। পুরোপুরি না হলেও বেশিরভাগই ঠিক হয়ে থাকে, নিশ্চয়ই বাশার ভুল দেখেছে।
টমির কথা শুনে মুহূর্তের জন্যে বাশারের মনের ভেতরে দ্বিধা তৈরি হয়। সে ভালোভাবে মনে করার চেষ্টা করে সকালবেলা গাড়ির ভেতরে বসে থাকা মানুষটার চেহারা। মনের দ্বিধা দূর হয়ে যায় ওর। জোরদার কণ্ঠে ঘোষণা করে এই চেহারার প্রায় কাছাকাছি চেহারার একজন মানুষকেই ও সকালবেলা লাইব্রেরির সামনে দেখেছে। এবার টমির দ্বিধান্বিত হবার পালা।
দুজনেই মাথা ঠান্ডা করে আবারো ছবিটা দেখতে বসে। বাশার ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখে আরো নিশ্চিত হয় এই মানুষটাকেই সে দেখেছে আজ সকালে। তবে ছবিতে দেখা মানুষটাকে আরো কমবয়স্ক দেখাচ্ছে। এই মানুষটা এই কবছরে আরো বয়স্ক হয়েছে নিশ্চয়ই। একটা সময় পরে ওরা দুজনেই সিদ্ধান্ত নেয় এভাবে ভেবে লাভ নেই। তারচেয়ে ছবিটা দিয়ে ওপর মহলে খোঁজ খবর করে দেখা যেতে পারে এই লোকটার পরিচয় উদ্ধার করা যায় কি না।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ওর মধ্যেও খানিকটা ঝিমুনি চলে এসেছিল হঠাৎ ভিউ মিররে চোখ পড়তেই ঝট করে উঠে বসল ও। পেছনে একটা সাদা গাড়ি আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেও বুঝতে পারল না এটা সকালের দেখা গাড়িটা কিনা। সাদা গাড়ি বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে ভুরিভুরি আছে। কাজেই এটাই সেই গাড়ি কি না অথবা ওদের পিছু নিয়েছে কি না সেটা বোঝা খুবই কষ্টকর ব্যাপার।
‘আবদুল্লাহ, জিপটা পার্ক করো,’ বলেই আবার সামলে নিলো নিজেকে। ‘না, না। পার্ক কোরোনা। দাঁড়াও,’ বলে ও আশপাশে দেখতে লাগল। ওরা গাঙ্গিনাপাড়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। আরেকটু এগোলেই সিকে ঘোষ রোডের মোড়। তার আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা সিনেমা হল আছে। ওর মনে পড়ল, এই হলের আগে একটা গলি আছে। এই গলিটাকে ওরা ডাকত ‘হিসু’ গলি। কারণ একটা সময় কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখতে এসে এই নির্জন গলিটাতে ওরা হিসু করতে ঢুকত।
‘আবদুল্লাহ, সামনে ডানে একটা গলি পাবে। জিপের স্পিড বাড়িয়ে গলিটায় ঢুকে পড়ো।’
ওর কথা মতোই আবদুল্লাহ জিপের স্পিড একটু বাড়িয়ে দিল। একটু পরেই চট করে ঢুকে গেল ওখানে। গলিতে ঢুকতেই জিপটাকে সামনে এগিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দাঁড় করানোর নির্দেশ দিল বাশার। আর নিজে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে চলে এলো রাস্তার মাথার কাছে। যদিও সময় খুবই কম তবুও একবার দেখে নিলো চারপাশটা। আশপাশটা সব বদলে গেলেও গলিটা এখনো আগের মতোই আছে। মূল রাস্তা থেকে পাঁচশো গজের মতো ডানে ঢুকে অনেকটা সোজা এগিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিয়েছে রাস্তাটা। বাঁকের আগে কোনো বাড়ি-ঘর কিংবা দোকানপাট নেই। লোকজনও দেখা যাচ্ছে না।
বাশার যা করতে চাইছে তার জন্যে আদর্শ। ও গলির মাথার কাছে এসে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখা একটা ভ্যানের আড়ালে বসে পড়ল। এর আগেই দেখতে পেয়েছে আবদুল্লাহ জিপটাকে বাঁকের কাছে নিয়ে আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলেছে।
ওর পরিকল্পনা খুব সহজ। যদি সাদা গাড়িটা ওদেরকে অনুসরণ করেই থাকে তবে ওদের পিছু নিয়ে সেটাও ঢুকবে আর একবার ঢুকলে সামনেও বন্ধ আর পেছাতে গেলে ও হাজির হবে পেছন থেকে। আর যদি কোনো গাড়ি ওদের পিছু নিয়ে না থাকে তবে তো পুরো ব্যাপারটাই বোকামিতে…
মনের ভাবনা শেষ করার আগেই গলির মুখে সাদা গাড়িটার নাক দেখতে পেলও। খুব ধীরে ধীরে সেটা ঢুকতে শুরু করেছে গলিটাতে। খানিকটা ঢুকে থেমে গেল, ড্রাইভার মনে হয় পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না।
বাশার মনে মনে ভাবল এইটুকু ঢুকে যদি উলটো চলে যায় তবে সর্বনাশ, আবারো হারাতে হবে গাড়িটা। এখুনি উঠে যাবে কি না ভাবছে তার আগেই গাড়িটা ঢুকতে শুরু করল গলিতে। আরেকটু ঢুকতেই বাঁকের অন্যপাশে আড়াআড়ি দাঁড় করানো জিপটা দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল গাড়ি।
‘এইবার,’ বলে ভ্যানের আড়াল থেকে পিস্তল হাতে বেরিয়ে এলো বাশার। গাড়ির ড্রাইভার গাড়িটা ব্যাকগিয়ারে পেছাতে শুরু করেছে এমন সময় পিস্তলহাতে গাড়িটার পেছনে উদয় হলোও। উলটো রওনা দিতে গিয়ে আবারো থেমে গেল গাড়িটা।
উদ্যত পিস্তল হাতে সামনে এগিয়ে একটানে ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল বাশার, আর সঙ্গে সঙ্গেই বোকা বনে গেল সে।
মনে-প্রাণে বাশার নিশ্চিত ছিল গাড়ির ভেতরে সেই বিদেশি কে দেখতে পাবে। কিন্তু তার পরিবর্তে একজন মহিলাকে দেখে বোকার মতো তাকিয়ে রইল ও।