অধ্যায় ষোল – সময় : ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ
খাগডহর বাজার, ময়মনসিংহ
ঘটনাচক্রে যে ব্যাপারটা বুঝতে ম্যাকফির বেশ সময় লেগেছিল সেইব্যাপারটা জোনাথন আর ডুম্বুর আরো আগেই অনুধাবন করতে পেরেছে। তবে ওদের দ্রুত অনুধাবন করতে পারার পেছনে একটা কারণ আছে।
ওরা বাজার পরিদর্শনের শুরুতেই তিন দলে যখন তিনদিকে রওনা দেয় তখন জোনাথনরা রওনা দিয়েছিল বাজারের বাঁ দিক, মানে উত্তর-পূর্ব দিকে। রওনা দেওয়ার সময়ে সঙ্গী হিসেবে ডুমুরকে পেয়ে জোনাথন প্রথমে বেশ বিরক্ত হয়েছিল। কারণ এই লোকটাকে শুরু থেকেই ওর বেশি সুবিধে মনে হচ্ছে না। কেমন জানি ঝিমায় আর মাঝে-মাঝে অদ্ভুত সব শব্দ করে ওঠে।
ওরা দুজনে মিলে উত্তর-পূর্ব দিকে রওনা হওয়ার একটু পরেই একেবারে ভিন্ন একটা কাজ করল, জোনাথন যেটা সে কখনোই করে না। নিজের বিরাট আকারের বন্দুকটা ধরিয়ে দিল লম্বুর হাতে। সাধারণত নিজের বন্দুক সবসময় সে নিজের কাছে রাখে কিন্তু অতিরিক্ত গরমে আর ধুলোয় চূড়ান্ত বিরক্ত জোনাথনের বন্দুকটা ভারী মনে হচ্ছিল। বন্দুকটা ধরিয়ে দিয়ে শরীরটা টান-টান করে দিল ও।
‘এই ব্যাটা, কোনদিকে যাবো আমরা বল,’ প্রশ্নটা ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করল সে। ডুম্বুর লোকটা ওর প্রশ্নের জবাব দিল না। জবাব অবশ্য জোনাথন আশাও করেনি। কিছু একটা বলা দরকার তাই বলেছে। ডুম্বুর এক হাতে বন্দুকটা ধরে রেখে অন্য হাতটাতে একটা ছোটো কাঠি দিয়ে মাটিতে খোঁচা দিচ্ছে। জোনাথন মনে মনে বিরক্ত বোধ করতে লাগল। এই ব্যাটা কখনোই ওপরের দিকে দেখে না নাকি? সারাক্ষণ তার দৃষ্টি নিচের দিকেই, মনে হয় মাটির দিকে দেখতে দেখতে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে।
‘এই ব্যাটা, চল। আমাদেরকে পুরো বাজার দেখতে হবে। এখানে বসে থাকলে হবে না। যেতে হবে এখন,’ বলে সে ডুম্বুরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। তবে তার ইশারা শোনার বা দেখার মতো মুডে থাকলে তো সে। এক হাতে জোনাথনের বন্দুক শক্ত করে ধরে সে মাটিতে খোঁচা দিতে দিতে একমনে এগিয়ে চলেছে অন্যদিকে। জোনাথন দেখল ডুম্বুর বাজারে প্রবেশের গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
‘এ তো দেখি একবারে উলটো দিকে চলেছে। কী যন্ত্রণা!’ সে ডুম্বুরের একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল বাজারের উত্তর পূর্ব দিকে, যেদিকটা ওদেরকে পরীক্ষ করে দেখতে বলা হয়েছে। ডুম্বুরকে পাশে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল জোনাথন। যদিও বন্দুকটা ডুম্বুরের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তবুও পিস্তলটা প্রস্তুত রেখেছে। কারণ বিপজ্জনক পেশায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বলে বিপদ কখন কোনদিক থেকে আসবে কেউই বলতে পারে না। ওরা বাজারের যে অংশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে সেখানে মূলত সবচেয়ে ভালো আর দামি ঘোড়া-যেগুলো দেশেই বাইরে থেকে আনা হয়েছে—সেগুলোই বিক্রি করা হচ্ছে।
বাঁশ পুঁতে সারি তৈরি করা হয়েছে। খদ্দেরেরা আসছে আর তাদের পছন্দমতো ঘোড়াগুলো দরদাম করছে। জোনাথন হাঁটতে হাঁটতে ঘোড়া বিক্রির জায়গাটা পার হয়ে এলো।
চলতে চলতে ভীষণ বিরক্ত বোধ করছে জোনাথন। এই সারিসারি ঘোড়া দেখতে দেখতে ক্লান্ত লাগছে ওর চোখ। আর এইসব প্রাণির বিষয়ে ওর কোনো আগ্রহও নেই। ওর একমাত্র আগ্রহ অস্ত্র নিয়ে, তাও দূর পাল্লার অস্ত্র। কাজেই এই ঘোড়ার বাজারে ওর বিরক্ত লাগাই স্বাভাবিক।
‘কী রে, কিছুই তো পেলাম না। বাজার তো প্রায় শেষ হতে চলল,’ ডুম্বুরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল জোনাথন। ওর দিকে তাকিয়ে বারবার পেছনে দেখাতে লাগল ও আর স্থানীয় ভাষায় কিছু একটা বলে বোঝানোর চেষ্টা করছে সে। মাথা নাড়ল জোনাথন। ‘কোনো লাভ নেই, যাই বলিস না কেন পুরো বাজারে চক্কর না দিয়ে আমরা যেতে পারব না। বসের নির্দেশ মানতেই হবে।’
কী বুঝল কে জানে ওর কথা শুনে চুপ মেরে গেল ডুম্বুর। ওর পেছন পেছন হাঁটতে লাগল বন্দুকটা হাতে নিয়ে। ঘোড়া বিক্রির অংশটা পার হয়ে ওরা চলে এলো বাজারের প্রায় শেষ প্রান্তে। এখানে ঘোড়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়। মোটা-চিকন নানা ধরনের দড়ি, ছোটো-বড়ো বিভিন্ন ধরনের ঘোড়ার নাল, কাঠের তৈরি, চামড়ার তৈরি বিভিন্ন ধরনের জিন, নানা ধরনের মুখাবরণ থেকে শুরুকরে ঘোড়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হেনতম কোনো জিনিস নেই যা নেই এখানে। এই অংশটাও পেরিয়ে ওরা বাজারের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এলো।
বাজারের এই অংশে এসে এতক্ষণ ধরে ঘোড়া আর ঘোড়া দেখতে দেখতে ত্যক্ত-বিরক্ত জোনাথন এবার একটু ভালো বোধ করল। কারণ বাজারের এই অংশে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে। যদিও কোনো ধরনের আগ্নেয় অস্ত্র নয় বরং নানা- ধরনের স্থানীয় অস্ত্র। জোনাথনের আগ্রহ মূলত আগ্নেয় অস্ত্রের প্রতি হলেও অন্যান্য অস্ত্রও ওর ভালো লাগে। তবে ওর আফসোস হচ্ছে মহাবীর সিংয়ের জন্যে। :হাবীর সিং হলো ছুরি-চাকুর ওস্তাদ।
ঘুরতে ঘুরতে ও মহাবীর সিংয়ের জন্যে একটা স্থানীয় ছুরি কিনলো। জোনাথন দাম চুকিয়ে ছুরিটা নিয়ে কোমরে গুঁজলো।
ওখান থেকে সামনের দিকে এগোচ্ছিল হঠাৎ ছুরি বিক্রেতার একটা কথা ওর কানে বাজতে লাগল। বাজারে জিনিসপত্র নিয়ে প্রবেশ করতে হলে বাজারের কোষাগারে টাকা জমা দিতে হয়। তারমানে যে কোনো ব্যবসায়ী পণ্য নিয়ে বাজারে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই তাকে বাজারের দায়িত্বে যারা আছে তাদের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে তারপর বাজারে প্রবেশ করতে হয়। তারমানে যারা ঘোড়া-ব্যবসায়ী তাদেরকেও এই একই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আর যেহেতু তাদেরকেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় তারমানে বাজারের লোকজনের কাছে সব ঘোড়া-ব্যবসায়ী আর সব ঘোড়ার তালিকা আছে। সেটা করতে পারলে খুব সহজেই জানা যাবে কে কোথাকার ঘোড়া কোথা থেকে এনেছে।
কথাটা মনে হতেই সে থেমে গেল। কিছুটা ইংরেজি আর কিছুটা স্থানীয় ভাষা মিলিয়ে সে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল ডুম্বুরকে। ডুম্বুর কী বুঝল কে জানে তবে সে মাথা নেড়ে সঙ্গে সঙ্গে জোনাথনের একটা হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতে লাগল কোনো একদিকে। জোনাথনও পিছু-পিছু যেতে লাগল ডুম্বুরের। যেতে যেতে সে ভাবতে লাগল এই পাগলটা কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে কে জানে, এর পিছু পিছু যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে কি না সেটাও বুঝতে পারছে না; তবে ওর আসলে কিছু করার নেই। কারণ এখানে না সে কাউকে চিনে, না ঠিকমতো সে কারো ভাষা জানে। কোমরে রাখা বাঁশিটাতে একবার হাত বুলালো সে। একবার ভাবল ওটাকে ফুঁ দিবে কি না, তবে কী মনে করে থেমে গেল। দেখা যাক এই পাগলটা ওকে জায়গামতো নিয়ে যেতে পারে কি না। একটু পরেই এক জায়গায় এসে থেমে গেল সে। জোনাথন প্রথমে বুঝতে পারল না এখানে এসে থেমে গেল কেন, তারপর ওর দিকে তাকিয়ে একদিকে ইশারা করতেই জোনাথন দেখতে পেল বাজারের এক ধারে কয়েকজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ও খুশি হয়ে উঠল ডুমুরের ওপরে।
নাহ, লোকটাকে যতটা পাগল ভেবেছিল আসলে ততোটা পাগল সে নয়।
প্রহরীদের কাছে গিয়ে যা জানতে চাইছে সেটা বলার চেষ্টা করল জোনাথন। ওর কথা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও একজন প্রহরী ওকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলো বাজারের মূল কাচারি ঘরের কাছে। সেখানে বসে থাকা এক হিসেব রক্ষক জানাল ওরা যদি বাজারের ব্যবসায়ী আর ঘোড়ার তালিকা পেতে চায় তবে ওদেরকে আস্তাবলের মূল সহিসের সঙ্গে দেখা করতে হবে। একমাত্র তার কাছেই পরিপূর্ণ তালিকা আছে।
আস্তাবলটা কোনদিকে আছে সেটা প্রহরীদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে ডুম্বুরকে নিয়ে সেদিকে রওনা দিল ও। বাজারের মূল ফটক আর কোষাগারের মূল ভবনের কাছ থেকে অনেকটা সরে এসে ছোটো টিলার মতো একটা জায়গার ওপরে এসে উঠল দুজনে। এখান থেকে জঙ্গলের কিনারায় ঢালের কাছটায় লম্বা সারি দিয়ে বানানো টিনের আস্তাবলটা দেখা যাচ্ছে।
ওরা দুজনেই ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। ঢালটার ঠিক কিনারায় অনেকটা জায়গা সমান করা হয়েছে। সম্ভবত এদিক দিয়েই ঘোড়াগুলোকে ঢোকানো হয় আস্তাবলে, আর অন্যদিক দিয়ে বের করে নেওয়া হয় বাজারে। এমন একটা জায়গায় আস্তাবলটা বানানোর পেছনে আরেকটা কারণ পরিষ্কার বুঝতে পারল জোনাথন। এখানে একটা মাত্র পথ দিয়ে ঘোড়াগুলোকে প্রবেশ আর বের করে নিতে হবে। এতে করে প্রহরীদের হিসেব রাখতে সুবিধে হবে। মনে মনে খুশি হয়ে উঠল জোনাথন। যাক এখানে কিছু একটা পাওয়া গেলে যেতেও পারে।
ওরা আস্তাবলের একেবারে সামনে চলে এলো। দুজন প্রহরী ঘাসের ওপরে কাপড় পেতে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। জোনাথন কিছুক্ষণ তাদেরকে ডাকল কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া গেল না। ও অনুমান করল ব্যাটারা সম্ভবত নেশা করেছে।
জোনাথন প্রহরীদেরকে জাগাতে না পেরে ডুম্বুরের দিকে ফিরে তাকাল। সে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে কী জানি দেখছে একমনে আর হাতের কাঠিটা দিয়ে নেড়ে-চেড়ে মাপ-জোখ করছে।
আবার শুরু হয়েছে এই ব্যাটার তাক-ঝাখ, মনে মনে বলল জোনাথন। তীব্র বিরক্তি নিয়ে সে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ডুম্বুর ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের ওপরে দুই আঙুল রেখে চুপ থাকতে বলল। জোনাথন ডুম্বুরকে ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল। কেন জানি ওর মনে হচ্ছে লোকটা কিছু একটা পেয়েছে। সে কয়েকবার মাপ-জোখ করে হঠাৎ জোনাথনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘ম্যাকফি,’ বলে সে চারপাশে ইশারা করল তারপর যা বলল সেটা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও জোনাথন এটা বুঝতে পারল লোকটা বলতে চাইছে ক্যাপ্টেন এখানে এসেছিল আর সে কোনো একটা ঝামেলায় পড়েছে ও কিছু একটা বলার আগেই ডুম্বুর আবারো ওকে চুপথাকতে বলে আবারো মাটিতে দেখতে লাগল। লোকটার ভাব-ভঙ্গি দেখে খুব একটা সুবিধের মনে হচ্ছে না জোনাথনের। ডুম্বুর মাটিতে দেখার সময়ে ওর বন্দুকটা টিনের চালার সঙ্গে ঠেস দিয়ে রেখেছিল। ওটা হাতে নেওয়ার জন্যে হাত বাড়াতেই সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল দুজনেই।
বাঁশির শব্দ। ওরা বিপদে পড়লে একে অপরকে ডাকার জন্যে আজ সকালে যে বাঁশি দেওয়া হয়েছে সেই বাঁশির শব্দ ভেসে এলো। শব্দটা এতই হালকা আর হঠাৎ হয়েছে যে মুহূর্তের জন্যে জোনাথনের মনে হলো শব্দটা কি সে সত্যিই শুনেছে, নাকি শ্রুতি বিভ্রম? বন্দুকটা হাতে নিয়ে ও ডুম্বুরের দিকে তাকাল। সে-ও মাটি থেকে মাথা তুলে কান পেতে আছে। তারমানে শব্দ সত্যি হয়েছে। দুজনে দুজনার দিকে ফিরে তাকাল। দুজনেই খানিকটা দ্বিধান্বিত আর ঠিক তখুনি আবারো শুনতে পেল শব্দটা। আর এবার একেবারে পরিষ্কার শোনা গেল। অনেকটা পাখির ডাকের মতো তবে তীক্ষ্ণ আর কর্কশ।
এবার দুজনেই চমকে উঠে ফিরে তাকাল আস্তাবলের দিকে। শব্দটা ওটার ভেতর থেকেই এসেছে। বন্দুক হাতে জোনাথন দৌড়ে ঢুকতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই এক লাফে এসে ওকে চেপে ধরল ডুম্বুর। হাতের ইশারায় পাঁচটা আঙুল দেখাল ওকে। মানে কী, কী বোঝাতে চাইছে লোকটা? ভেতরে পাঁচজন মানুষ আছে। কিন্তু থাকলেই কী নিশ্চয়ই ওদের কেউ বিপদে পড়েছে ভেতরে, তা না হলে বাঁশি বাজানোর কথা নয়।
‘আমাদের ভেতরে যেতে হবে,’ জোনাথন নিজেকে ডুম্বুরের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে উদ্যত হতেই ডুম্বুর ইশারা করল ওর পেছনে থাকতে। জোনাথন একবার ওর দিকে ইশারা করে পেছনে এসে বন্দুক বাগিয়ে ধরতেই ডুম্বুর এগিয়ে গেল সামনের দিকে। ওর ঠিক পেছনেই বন্দুক হাতে রওনা দিল জোনাথন।
আস্তাবলটা এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত লম্বা। এর ভেতরে বাঁশ দিয়ে ছোটো ছোটো খোপ। এই খোপগুলোর ভেতরেই রাখা হয় ঘোড়া। পুরোজায়গাটা একেবারেই খালি বলা চলে। বাজারের সময় হওয়াতে প্রায় সব ঘোড়াই বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওরা ভেতরে ঢুকে ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে আসতেই খুব সহজেই আস্তাবলের শেষ প্রান্তে দৃষ্টি চলে গেল।
সেখানে মাটিতে পড়ে আছে একজন আর তার চারপাশে ভিড় করে আছে আরো তিনজন মানুষ। দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের একজন মাটিতে পড়ে থাকা মানুষটাকে লাথি মারলো। আর অন্য একজন ওখান থেকে সরে গিয়ে ঘোড়াগুলোর দিকে এগোতেই ওরা পরিষ্কার দেখতে পেল মাটিতে পড়ে থাকা মানুষটা আর কেউ নয়, ক্যাপ্টেন ম্যাকফি।
জোনাথন খুব দ্রুত পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিলো। এইবার অন্তত ডুম্বুরের অনুমান ভুল হয়েছে। ভেতরে ঢোকার আগে ও ইশারায় বলেছিল ভেতরে মানুষ আছে পাঁচজন কিন্তু দেখা যাচ্ছে তিনজনকে। দুজন দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেনের সামনেই, আর অন্যজন সরে গিয়ে একটা দড়ির টুকরো নিয়ে আসছে, মনে হয় ক্যাপ্টেনকে বেঁধে ফেলতে চাইছে। ওরা দুজন আর প্রতিপক্ষ তিনজন। ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে আর ওদের কাছে সাধারণ অস্ত্র ছাড়া আর কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না।
জোনাথন বন্দুকটাকে ঠিক করে নিয়ে কোমর থেকে পিস্তলটা নিয়ে বাড়িয়ে দিল ডুম্বুরের দিকে। ও ভেবেছিল ডুম্বুর লোকটা হয়তো নিতে চাইবে না অথবা নিলেও দ্বিধা করবে। কীভাবে ধরতে হবে কীভাবে চালাতে হবে সেটা দেখিয়ে দিতে হবে কিন্তু সেরকম কিছুই করতে হলো না। অস্ত্রটা হাতে ধরিয়ে দিতেই অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে সে ওটা পরীক্ষা করে তাক ঠিক করে নিলো। জোনাথন ডুম্বুরের দিকে ইশারায় তিন আঙুল দেখিয়ে তারপর নিজেদেরকে দেখাল। বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। ডুম্বুর স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে অস্ত্রটা ধরলেও সে কোথায় যেন একটু দ্বিধা করছে বলে মনে হলো জোনাথনের কাছে। অতোকিছু দেখার সময় নেই।
এবার ডুম্বুরকে পেছন পেছন আসতে বলে অস্ত্র সামলে সাবধানে ঘোড়াদের জন্যে রাখা একটা খড়ের স্তূপের আড়ালে এসে দাঁড়াল ওরা দুজনে সামনে বন্দুক হাতে জোনাথন, ওর ঠিক পেছনেই পিস্তল হাতে ডুম্বুর। বন্দুক বাগিয়ে ধরে চিৎকার করে উঠল জোনাথন, ‘হল্ট।’
সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো যে যার জায়গায় জমে গেল। দুজন দাঁড়িয়ে ছিল মাটিতে পড়ে থাকা ক্যাপ্টেনের একেবারে শিয়রে, অন্যজন দড়ি হাতে এগোচ্ছিল ক্যাপ্টেনের দিকে। তিনজনই মূর্তির মতো জমে গেল। জোনাথন আরো দুই পা এগিয়ে গেল। এবার পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সবাইকে। লোক বললে ভুল হবে, একজন বেশ জবরজং পোশাক পরা-বয়স্ক মানুষ। আর অন্যদুজন একেবারেই অল্পবয়স্ক বালক। ওরা এগিয়ে যাচ্ছে বয়স্ক লোকটা হঠাৎ অদ্ভুত এক ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল। তাকে ধমক দিয়ে চুপ থাকতে বলবে কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল অন্য ঘটনা।
জোনাথন বন্দুক বাগিয়ে ধরে ওদের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এমন সময় কেউ একজন তীব্র আর্তনাদ করে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওরা দুজনেই চমকে উঠল। কে আর্তনাদ করেছে সেটা বোঝার আগেই ওদের দুপাশের বাঁশের ছোটো খোপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো দড়ির ফাঁস। জোনাথন প্রথমেই দেখল একটা দড়ির ফাঁস এসে টান দিয়ে ওর হাত থেকে ছুটিয়ে নিলো বন্দুকটা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে ও আবিস্কার করল মাটিতে। পায়ে জড়িয়ে আছে আরেকটা দড়ির ফাঁস। পাশে তাকিয়ে দেখল ডুমুরেরও একই অবস্থা। ওরা মাটিতে পড়ে যেতেই খোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আগের লোকগুলোর মতো একই রকম পোশাক পরা আরো দুজন মানুষ।
আস্তাবলে প্রবেশের আগে ডুম্বুর হাতের ইশারায় দেখিয়েছিল ভেতরে পাঁচজন মানুষ আছে। তার অনুমান যে একেবারে ঠিক ছিল এখন সে-ব্যাপারে জোনাথনের আর কোনোই সন্দেহ নেই। তিনজন ক্যাপ্টেনকে বন্দি করেছিল আর বাকি দুজন আড়াল থেকে ওদেরকে পাহারা দিচ্ছিল। বন্দি হবার আগে এটাই ছিল জোনাথনের শেষ ভাবনা।