অধ্যায় তেরো – বর্তমান সময়
ময়মনসিংহ পুলিশ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ সদর
‘স্যারে এমনে আতকা গিয়ান হারায়া ফালাইলো ক্যান?’ প্রশ্নটা নবীন কনস্টেবল আবদুল্লাহর। ‘ডাক্তারে তো কইলো তেমন কিছু না। তাইলে এমন জোয়ান একটা মানুষ হুদাই অজ্ঞান অইয়া গেল?’
আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা এই মুহূর্তে বসে আছে ময়মনসিংহ পুলিশ হাসপাতালের বাইরে। একটু আগেই অসুস্থ বাশারকে ভেতরে রেখে এসেছে ওরা। শেষ মোড়ের ওখানে বাশার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটার ভেতরে যাবার পর ওরা গাড়িতেই বসে অপেক্ষা করছিল, হঠাৎ দেখতে পায় বাশার দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে থেমে গেল। রাস্তা পারাপাররত বাশারের সামনে দিয়ে একটা ট্রাক চলে যাবার পরেই দেখে রাস্তার ওপরে পড়ে আছে সে। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠে দুজনেই জিপ থেকে নেমে দৌড় দেয় ওদিকে।
রাস্তার ওপরে একেবারে চিত হয়ে পড়ে আছে বাশার। হাতের ছড়ি, আর মাথার ক্যাপ পড়ে গেলেও সানগ্লাসটা তখনো চোখেই ছিল। আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা প্রথমে ভেবেছিল, তাদের স্যার হয়তো অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। কিন্তু প্রাথমিক চেক করেই বুঝতে পারে সে আহত না। দুজনে মিলে কোনো মতে ধরে তাকে সোজা নিয়ে আসে পুলিশ হাসপাতালে। হাসপাতালে নিয়ে আসার পথে অবশ্য অনেকটাই ঠিক হয়ে যায় সে। তবে পুরোপুরি সচেতন ছিল না। আর থেকে থেকেই বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছিল। ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর ডিউটি ডাক্তার প্রাথমিকভাবে চেক করে জানায় গুরুতর কিছু নয়, সম্ভবত হিট- স্ট্রোকে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ওদেরকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে রোগীকে ভেতরে নিয়ে যায়।
হাসপাতালের লবিতেই অপেক্ষা করছিল ওরা এমন সময় বাশার রমিজ দারোগার মোবাইলে কল করে জানায় ও ঠিক আছে একটু পরেই বেরিয়ে আসবে, ওরা যেন জিপে গিয়ে অপেক্ষা করে।
‘হুন, তুই যে কতা জিগাইছোস এইডার উত্তর দিতে হইলে ডেরাইভার অইয়া লাভ নাই, এইডার উত্তর জানতে অইলে পাইলট দরকার,’ রমিজ দারোগা ফিচকি হাসি দিয়ে পকেটে হাত ঢুকালো।
‘মানে কী, পাইলট পাইবেন কই?’ আবদুল্লাহকে হতভম্ভ দেখাচ্ছে।
ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে রমিজ দারোগা পকেট থেকে পাইলট সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করে ঠোঁটে সিগারেট লাগাল। আবদুল্লাহর দিকে দেখিয়ে প্যাকেটটা নেড়ে বলল, ‘পাইলট, বুঝছোস? হা-হা।’
‘ও পাইলট সিগারেট, হেইডা কইলেই তো হইতো।’
‘শুন, মাইনষের জীবনডা বহুত আজিব কিসেমের।’ বলে সে একগাদা ধোঁয়া ছাড়ল।
পাইলট সিগারেটের কটু গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল আবদুল্লাহর। কোনো মতে কাশি চেপে চুপচাপ বসে রইল সে।
‘ক্যান আজিব কইতাছি, জীবনে চাহিদার শেষ নাই আবার কোনো কিছু অর্জনের যন্ত্রণারও শেষ নাই। যেমন ধর, তুই এহন কনস্টেবল। তোর জীবনে বড়ো একটা অর্জন হইলো তুই পুলিশে চাকরি পাইছোস। জানি না ক্যামনে পাইছোস, গেরামের বাড়িত কয় বিগা জমি বেচছোস…তয় পাইছোস। এহন তোর স্বপ্ন অইলো জীবনে আরো বড়ো অইতে অইবো। এহন তুই কনস্টেবল, কয় বছর পরে যদি তুই প্রমোশন না পাস তাইলে এই কনস্টেবলের পোস্ট তোর বিরক্ত লাগবো। আবার যদি তুই প্রমোশন পাস তাইলে আবার হের উপরে ক্যামনে উডবি হেই চিন্তায় পইড়া যাবি। মানে যন্ত্রণার শেষ নাই আরকি,’ বলে সে আবারো ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসতে লাগল। তার ঠোঁটের ফাক দিয়ে বেরিয়ে আসা কটুগন্ধ যুক্ত ধোঁয়া, টিটকারির হাসি আর নিকোটিনের প্রভাবে তৈরি হওয়া হাসি আর কাশি মিলেমিশে একাকার।
আবদুল্লাহ মনে মনে বলল, জিগাইলাম কী, আর এই লোক বক-বক করতাছে কী।
‘তয়,’ ধোঁয়া ছাড়া শেষ করে আবারো শুরু করল রমিজ দারোগা। ‘জীবনে এমন কিছু সময় আহে যখন সবকিছু, সবকিছু মানে স—ব কিছু ব্যর্থ অইয়া যায়। তোর জীবনের শুরু থাইক্কা শেষ পর্যন্ত তুই যা করছোস যেই উদ্দেশ্য নিয়া করছোস তোর কাছে ব্যর্থ মনে অইবো, তোর কাছে বাইচ্চা থাহার কোনো কারণ থাকবো না, কাছের পত্যেকডা মানুষ দূরে সইরা যাইবো। বুঝছোস? ধনী আর গরিব নাই এমন সময় সবার জীবনেই আহে, একবার অইলেও আহে,’ বলে সে সিগারেটের মোথাটা জিপের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে নিজের মুখটা আবদুল্লাহ আরেকটু কাছে নিয়ে এলো, ‘আমাগো বাশার স্যারের দেখছোস? হেয় এহন এইরহম একটা সময় পার করতাছে। হের চোক্ষের দিকে চাইয়া দেহিস, তোর নিজের চোখ যদি ঠিক থাহে তাইলে বুজতে পারবি হেয় অইলো ডুবন্ত মানুষ। যে কিনা শেষ আশা হিসেবে এই মরা-ধরা কেইসটারে আঁকড়াইয়া ধরতে চাইতাছে। বুঝছোস?’ সে মুখটা আরেকটু বাড়িয়ে দিল আবদুল্লাহর দিকে।
আবদুল্লাহ ভয়ে মুখটা পিছিয়ে নিলো খানিকটা। ‘সেইটা আপনে বুঝলেন ক্যামনে? আপনে এত নিশ্চিত ক্যামনে কন?’
কঠিন দৃষ্টিতে আবদুল্লাহর দিকে তাকাল রমিজ দারোগা। ‘আমার বয়স কত? মানে আমারে দেখলে কত মনে অয়?’
একটু দ্বিধার সঙ্গে আবদুল্লাহ জবাব দিল, ‘পঞ্চাশের উপরে, ষাইটের কাছে।’
‘তাইলে আমি এহনো এই পোস্টে কী করি?’
আবদুল্লাহ কোনো উত্তর দিল না।
‘তোর বাশার স্যারে এহন যে অবস্থায় আছে আমি গত দশ বছর ধইরা হেই অবস্থার ভেতরে বাস করতাছি। এহন বুঝছোস?’
আবদুল্লাহ কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই জিপের জানালায় টোকা পড়ল। বাশার ফিরে এসেছে। ওকে দেখে দুজনেই নেমে এলো জিপ থেকে।
‘সরি, আমি আসলে হঠাৎ তীব্র গরম আর কাজের চাপে অসুস্থ বোধ করছিলাম।’
‘স্যার, এহন ঠিক আছেন?’ আবদুল্লাহ জানতে চাইল। প্রশ্নটা করার সময়ে চকিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো রমিজ দারোগার দিকে।
‘হ্যাঁ, একদম ঠিক, চলো রওনা দেওয়া যাক,’ বলে ও জিপের সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসল। রমিজ দারোগা পেছনে উঠে বসতেই জিপ ছেড়ে দিল আবদুল্লাহ।
‘স্যার, আপনারে বাসায় নামায়ে দিবো, নাকি থানায় যাবেন?’
‘হুম?’ ওসি ডেকেছে কাজেই থানায় যেতেই হবে। ‘থানায় চলো,’ বলে বাশার আবারো ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল। ও মুখে যত যাই বলুক না কেন ভেতরে ভেতরে জানে কিছুই ঠিক নেই। আজ বিকেলের ঘটনাটা ওর শরীরে কোনো প্রভাব সৃষ্টি না করলেও মনের ভেতরে তীব্র ভীতি জাগিয়ে তুলেছে। কারণ ও জানে আজ বিকেলে ও শারীরিক কোনো দুর্বলতা বা অসুস্থতার কারণে অজ্ঞান হয়নি, হয়েছে মানসিক কারণে। আর এও জানে একবার যেহেতু ঘটেছে ব্যাপারটা, কাজেই এই ঘটনা আবারো ঘটতে পারে। এখানেই ওর ভয়।
সব নষ্টের গোড়া ওই ট্রাকটা, আজ বিকেলে দেখা একটা ট্রাক। সেদিনও এরকমই একটা ট্রাক ছিল, জায়গাটাও ছিল উন্মুক্ত এক হাইওয়েতে। আজকের ঘটনার সঙ্গে পার্থক্য শুধু একটাই ওইদিন ছিল তীব্র বৃষ্টি আর আজ বিকেলে ছিল রোদ। আজ বিকেলের ঘটনা ফেলে আসা অতীতের সেই বাজে সময়টার ‘দেজা ভ্যু’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সিটে হেলান দিয়ে ডানহাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে বাঁ হাতের আংটিটা ধরে মোচড়াতে লাগল। আংটিটা ছেড়ে দিয়ে ডান হাতটা চোখের সামনে তুলে ধরল বাশার। এই হাত, এই হাতটাই সবকিছুর স্বাক্ষী। এইহাত দিয়ে নিজের মাকে কবর পর্যন্ত দিতে পারেনি, এই হাত দিয়েই সেই বৃষ্টির রাতে গুলি করে মেরেছিল ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু, সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে। সেই অন্ধকার বৃষ্টির রাত, সেই পাহাড়ি রাস্তা, সেই ট্রাক দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এসেছিল আজ বিকেলে।
‘স্যার, থানায় চইল্লা আইছি,’ আবদুল্লাহর কথায় হুঁশ ফিরে এলো বাশারের।
‘হুম, জিপটা পার্ক করে ভেতরে অপেক্ষা করো। আমি ওসিসাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে তোমাদেরকে পরবর্তী কাজের নির্দেশনা জানাবো,’ বলে ও জিপ থেকে নেমে থানার মূল দরজার দিকে রওনা দিল। দু-কদম এগিয়েই আবারো ফিরে এলো জিপের কাছে। আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগার দিকে তাকিয়ে একটু দ্বিধার সঙ্গে বলে উঠল, ‘ইয়ে, তোমাকে ধন্যবাদ, আবদুল্লাহ; আর আপনাকেও রমিজসাহেব। আজ বিকেলে তোমরা না থাকলে আমার হয়তো আরো বেশি সমস্যা হতে পারতো,’ বলে ও অস্বস্তি কাটানোর জন্যে মৃদু কাশি দিয়ে বলল, ‘আর এই ব্যাপারটা থানায় জানানোর কোনো দরকার নেই। বুঝেছ?’ বলে ও ভেতরের দিকে রওনা দিল।
ওর শেষ প্রশ্নের জবাবে আবদুল্লাহ মাথা নাড়লেও রমিজ দারোগা চুপ মেরে রইল।
বাশার সোজা চলে এলো থানার ভেতরে। ওসির রুমের দিকে এগোতে যাবে দায়িত্বরত আইটি অফিসার তৌফিক পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে বস নাকি অসুস্থ হয়ে গেছিলেন?’ এই থানায় ডিউটির অল্প কয়েকদিনে এই ছেলেটার সঙ্গেই ওর সবচেয়ে ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছে।
ছেলেটার প্রশ্ন শুনে গুঙিয়ে উঠল বাশার। এই হয়েছে আজকের যুগের সমস্যা, মানুষ পৌছানোর আগেই খবর পৌঁছে যায়। এটা নিশ্চিত, এটা রমিজ দারোগার কাজ। একারণেই ব্যাটা তখন চুপ করে ছিল।
কোনো মতে মুখে খানিকটা হাসি ফুটিয়ে তুললো বাশার। ‘আরে নাহ, তেমন কিছু না। গরমে হঠাৎ একটু খারাপ লাগছিল তাই আরকি। আচ্ছা ওসিসাহেব…’ ও প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাচ্ছিল কিন্তু সাব-ইন্সপেক্টর তা হতে দিল না।
‘আরে কী বলেন! আমি তো শুনলাম হাসপাতাল পর্যন্ত নাকি যেতে হয়েছিল।
‘ধুর মিয়া! কী যে বলো না, অনেক মনের জোর খাটিয়ে মুখের হাসিটা ধরে রেখেছে বাশার। ‘ওই আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগা জোর করে নিয়ে গেল। আর আমিও ভাবলাম গ্যাস্ট্রিকটা অনেকদিন ধরে ভোগাচ্ছে, এই সুযোগে একটু দেখিয়ে আসি।’
‘ও আচ্ছা, তাই বলেন। আমি তো আরো ভাবলাম কী-না-কী। তা কাজের কী অবস্থা? কোনো অগ্রগতি হলো?’ তৌফিক নামের সুদর্শন ছেলেটার হাতে একটা কলম, সেটার কোনায় বাঁধিয়ে মাথা থেকে পুলিশি টুপিটা খুলে ফেলল সে। জেল দেওয়া ঘন চুল কপালের সঙ্গে একেবারে লেপ্টে আছে।
‘অগ্রগতি বলতে তেমন কিছু না তবে কিছুটা স্পেসিফিকেশনের দিকে এগিয়েছি। আচ্ছা, ওসি মল্লিক আমাকে ডেকেছিল। তোমার সঙ্গে পরে কথা বলছি। আগে তার সঙ্গে দেখা করে আসি,’ বলে বাশার ঘুরতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে তৌফিক বলে উঠল, ‘আরে বস, এত তাড়াহুড়ার কিছু নাই। সে কখন বেরিয়ে গেছে।’
‘বেরিয়ে গেছে?’ একটু বোকা হয়ে গেছে বাশার। ‘অহ, তাহলে আমাকে যে বলল…মানে আমাকে খবর পাঠাল অবশ্যই যেন আমি আজকের ঘটনা মৌখিকভাবে রিপোর্ট করে তাকে জানাই আর কেসের সমস্ত অগ্রগতির লেটেস্ট আপডেট জানাই। আমি আরো বাসায় না গিয়ে দৌড়ে এলাম,’ বলে বাশার একবার কাঁধ ঝাঁকালো।
‘হাহা, বস, আপনি এখানে নতুন এসেছেন তো তাই ওসিস্যারের ব্যাপারে জানেন না,’ বলে সে তার মুখটা বাশারের একেবারে কাছে নিয়ে এলো। ‘শুনুন বস, ওসিস্যারের ব্যাপারে আপনাকে একটা গোপন ফর্মুলা জানাই। এই ফর্মুলা মানলেই আপনি একমাত্র তার সঙ্গে ভালোভাবে চলতে পারবেন। ওসিস্যার যে কাজটা বেশি সিরিয়াসলি করতে বলবে সেটা করবেন না, আর যেটা সে মোটেই গুরুত্ব দিয়ে বলবে না, সেটা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে করবেন,’ বলে সে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো।
বাশার এক মুহূর্ত গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইল তৌফিকের দিকে, তারপর দুজনেই প্রায় একসঙ্গে হেসে উঠল।
‘ভালো বলেছ,’ বলে ও টুপিটা আবারো মাথায় পরে নিয়ে রওনা দিয়েই আবারো ঘুরে তাকাল। ‘তৌফিক?’
‘জি, বস।’
‘তুমি তো এই থানার আইটিতে কাজ করো তাই না?’
‘হ্যাঁ, বস।’
‘আচ্ছা,’ বলে ও থেমে গেল। ‘তোমার ডিউটি টাইম আর কতক্ষণ আছে? মানে তুমি অফিসে আছো আর কতক্ষণ?’
‘বস, ডিউটি তো আজকের মতো শেষ তবে থানায় আছি আরো ঘণ্টাখানেক। আজ আমার আবার স্পেশাল ডেট আছে,’ বলে সে আবারো বাশারের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো।
বাশার মনে মনে ভাবল এই ছেলেটা এভাবে কথায় কথায় চোখ টিপে কেন। মুদ্রাদোষ নাকি?
‘তোমার আজ ডেট আছে! ডেট থাকলে সবাই আগে-ভাগে বাসায় গিয়ে পোশাক বদলে ডেটে যায় আর তুমি দেরি করে যাবে…মানে কী? ‘
আরে বস, এইটাই তো মজা। আমার আবার এই পোশাকে ডেটে যেতে বেশি ভালো লাগে, হা-হা। সবাই বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।’
বাশার আবারো কিছু না বলে কাঁধ ঝাঁকালো। ‘দুনিয়াতে কত পাগল দেখবো। যাই হোক তুমি ডেস্কে থাকো। আমি আবদুল্লাহ আর রমিজ দারোগাকে ছুটি দিয়ে আসছি। তোমার সঙ্গে আমার কাজ আছে।’
‘ওকে, বস।
বাশার দ্রুত পায়ে চলে এলো বাইরে। বাইরে এসে দেখল আবদুল্লাহ জিপের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছে। আর রমিজ দারোগাকে দেখা গেল না আশপাশে কোথাও। নিশ্চিত বিড়ি টানতে গেছে। এই লোক বিড়ি ছাড়া এক দণ্ড টিকতে পারে না।
‘আবদুল্লাহ।’
‘জি, স্যার,’ বাশারের ডাক শুনে সঙ্গে সঙ্গে পিঠ সোজা করে দাঁড়াল ছেলেটা। ‘শোনো, আজকের মতো তোমার আর থাকতে হবে না। কাল সকাল থেকে আমরা কাজ শুরু করব। কাল তোমার ডিউটি টাইম কয়টায়?’
ছেলেটার কাছ থেকে ডিউটি টাইম শুনে বিদায় নিয়ে চলে আসছিল বাশার পেছন থেকে আবদুল্লাহ জানতে চাইল, ‘স্যার, আপনি এহন ঠিক আছেন?’
ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে জবাব দিল বাশার। ‘হ্যাঁ, ঠিক আছি।’ বলে ও চলে এলো থানার ভেতরে।
মূল করিডরটা পার হয়ে চলে এলো আইটি সেকশনে। বাশার রুমের সামনে গিয়ে নক করতে গিয়ে দেখতে পেল রুমের দরজা একেবারে হাট করে খোলা। ও নক করার জন্যে হাত উঠিয়েও নামিয়ে নিলো। ঢুকে পড়ল সরাসরি।
ভেতরে একটা বেশ বড়ো ডেস্কটপ কম্পিউটার। একপাশে সিসিটিভির ফুটেজ দেখা যাচ্ছে একটা বড়ো মনিটরে। আর অন্যপাশে একটা বড়ো রেডিয়ো মেশিন। এটার মাধ্যমে ওরা সবধরনের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ রক্ষা করে। গতদিনের দেখা আইটি রুম আর আজকের দেখা আইটি রুমের মাঝে আকাশ-পাতাল ফারাক না,
মহাশূন্য আর মহাতলের ফারাক।
এতসব জিনিসপত্রের ভিড়ে ছোটো একটা চেয়ার পেতে ডেস্কটপটার সামনে বসে আছে আইটি সেকশনের প্লেবয় তৌফিকুর রহমান।
ওকে দেখতে পেয়ে হেসে উঠল সে। ‘আরে বস, আসেন আসেন গরীবের সার্কাসে হাতির পাড়া। আপনার আগমনে কী যে আবেগ আপ্লুত!’
‘ওই মিয়া, ফাইজলামি করো!’ বাশারের কপট রাগ দেখে সে আরো জোরে হেসে উঠল।
‘বস, আপনেরে কই যে বসতে দেই,’ বলে সে মিটি-মিটি হাসতে লাগল। তার ভেতরে বসতে দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই চোখে পড়ছে না।
‘আজাইরা কথা ছাড়ো, আমি একটা জরুরি কাজে এসেছি।’
‘কী বলেন। এত তাড়াতাড়ি এই আখাম্বা কেসের লিড বাইর করলেন কেমনে?’
‘এটা দেখো,’ বলে ও তৌফিকের দিকে একটা ছোটো কাগজ বাড়িয়ে দিল। ‘এখানে একটা তারিখ, সাল আর সম্ভাব্য সময় লেখা আছে,’ এই সময়টাই ও পুরনো বন্ধু রুবেলের কাছ থেকে বের করেছিল। ‘আমি ধারণা করছি এই সময়টাতেই গাড়িটা পানিতে পড়েছিল।’
‘তাই নাকি!’ কাগজটা হাতে নিতে নিতে বলতে লাগল তৌফিক। একেবারে নির্দিষ্ট তারিখ কীভাবে বের করলেন? ওই নতুন ল্যাবের ওদের মাধ্যমে?’
‘আরে নাহ! ওইসব ল্যাব-ফ্যাব দিয়ে পুরো কাজ হয় নাকি। আসল দুনিয়ার কাজ লা্যবে হয় না বুঝেছ?’ বলে বাশার একটা টেবিলের ওপরে উঠে বসল। ‘তবে প্রাইমারি লিড ওখান থেকেই পেয়েছিলাম। ওটা না হলে একেবারে নির্দিষ্ট সময়টা বের করা যেত না।’
‘আপনি কি এই দিন তারিখের ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত?’
‘পুরোপুরি নিশ্চিত বলে তো আর কিছু নেই, তবে প্রায় নিশ্চিত।’
‘আচ্ছা, তাহলে এখন কী করতে চান?’
‘তোমার কাছে আমি দুটো ব্যাপার জানতে চাই, প্রথমত ওই সময়ে ময়মনসিংহ শহরে কয়জন বিদেশি নাগরিক অবস্থান করছিল। আদৌ করছিল কি না, এই ব্যাপারটা কি বের করা সম্ভব?’
তৌফিক একটু ভাবল, সম্ভব। তবে এইটা আমার সেকশন না। ওইটা লিয়াজোঁ অফিসার আনাম ভাইরে দিলে সে একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে। হয়তো ফরেন মিনিস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আমি যতটুকু জানি ওদের এই ধরনের একটা ডাটাবেইজ থাকে। কোন দেশি কয়জন নাগরিক কোথায় আছে, কোন শহরে অবস্থান করছে, কী পারপাসে আছে এসবের একটা রেকর্ড থাকে। সেটা ফরেন মিনিস্ট্রিতে না এনএসআই না ডিবি না ডিজিএফআই সেইটা বস আমি জানি না। তবে আনাম ভাই এইটা বের কইরা দিতে পারবে। আর পরেরটা?’
‘পরেরটা হলো, যে সময়টা এখানে লেখা আছে সেই সময়ে বা সেই সময়ের আশপাশের সময়ে কোনো কিছু ঘটেছিল কিনা। মানে আমি জানতে চাচ্ছিলাম সেই সময়ে এই ময়মনসিংহ শহরে বড়ো ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছিল কি না।’
‘একেবারে এই সময়টাতেই?’
‘না-না, এই সময়টার আশপাশে। মানে এই দিন-তারিখটার এক সপ্তাহ রেডিয়াসের ভেতরে কিছু ঘটেছিল কি না, আমার জানা দরকার,’ বলে ও একটু থামলো। ‘প্রশ্ন হলো, এই থানার পুরনো রেকর্ড কি সফট কপিতে মানে কম্পিউটারে রাখা হয় নাকি হার্ড কপিতে?’
‘আরে বস, কী যে বলেন, এইসব জায়গায় এখনো পুরোপুরি সফট কপি মানে ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করতে আরো সময় লাগবে। আমরা সরকারি লোকজন এখন হয়া গেছি পুরনো কৌতুকের মতোন। যেখানে ওস্তাদের লাঠি অর্ধেক পানিতে পড়ছিল আর অর্ধেক পড়ছিল ডাঙ্গায়। আর তাই লাঠির অর্ধেক হয়া গেছে বাঘ আর বাকি অর্ধেক হয়া গেছে কুমির। আমরা মুখে-মুখে হয়ে গেছি ডিজিটাল। কিন্তু কাজে এখনো আধা ‘ডিজি’ আর আধা ‘টাল’,’ বলে সে হাসতে লাগল।
তৌফিকের কথা শুনতে শুনতে বাশারের নাক কুঁচকে উঠল। এই ছেলেটার সব ভালো কিন্তু সমস্যা একটাই, অতিরিক্ত কথা বলে। ‘তোমার হাসি শেষ হয়েছে? তাহলে এখন কাজের কথা বলো।’
‘ওহ শিওর, বস। মাইন্ড করলেন নাকি?’
‘না, এখনো করিনি। এই থানায় রেকর্ড কীভাবে রাখা হয়?’
‘বেশিরভাগ রেকর্ড এখনো ফাইল আকারে হার্ড কপিতেই রাখা হয়। ধীরে- ধীরে সব হার্ড কপিকে সফট করে ফেলা হবে। তবে এখন পর্যন্ত হার্ড কপিতেই রাখা আছে। গত তিন বছর পর্যন্ত সমস্ত কেস ফাইল সফটে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর আগ পর্যন্ত সব কেস এখনো কাগজের ফাইলেই রাখা।
‘আচ্ছা তাহলে, আমার এগারো বছর আগের কেস ফাইল দরকার। ওটা এই মুহূর্তে আছে কোথায়?’ বাশার জানতে চাইল।
‘ওটা এই থানার আর্কাইভেই রাখা আছে। থানার পেছনের ভবনে একটা স্টোর রুম আছে। পুরনো সব কেস ফাইল ওই স্টোর রুমেই রাখা থাকে। আরে ওই স্টোর রুমের দায়িত্ব তো রমিজ দারোগার ওপরেই।’
‘অহ্ হো, ওই ব্যাটা আবার চলে গেল কি না কে জানে,’ বাশার আনমনেই ঘড়ি দেখল। ‘পুরনো ফাইল দেখতে চাইলে নিয়ম কী?
‘নিয়ম তো অনেক কড়া কিন্তু এর ভেতরে ব্যবস্থা আছে। প্রথমে আবেদন করতে হয়। অনুমতি মিললে একটা ফর্ম ফিলাপ করে জমা দিয়ে দায়িত্বরত অফিসারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে একজন অফিসারসহ ওখানে যেতে হয়। তবে এত কাহিনি করার দরকার পড়ে না। আপনি রমিজ দারোগারে বললেই সে আপনারে একটা ফর্ম দিবে সেটা ফিলাপ করলেই চাবি দিয়ে দিবে আপনারে।’
‘ঠিক আছে, তাহলে দেখি রমিজ দারোগা আছে কিনা। আর তোমার সময় থাকলে তুমিও চলো, আমার সাহায্য লাগতে পারে।’
বাশারের প্রস্তাব শুনে একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল সে, ‘ডেট আছিল, বস। আচ্ছা যাউকগা। শালী একটু অপেক্ষা করলে মইরা যাবে না। চলেন।’
দুজনে মিলে থানার মূল প্রবেশ দরজার কাছে চলে এলো। দরজার কাছে বসে থাকা সেন্ট্রিকে প্রশ্ন করবে তার আগেই দেখতে পেল একটা জিপের গায়ে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকছে আর দুই কনস্টেবলের সঙ্গে আলাপ করছে রমিজ দারোগা। বাশার দূর থেকেই তাকে ডাক দিল। বাশারের ডাক শুনে সে সিগারেটটা এমনভাবে ফেলে দিল যেন ওটা একটা পচা মাছ। সিগারেট বিদ্যুৎ-গতিতে ফেললেও সে এগোল খুব ধীর গতিতে। তার যথারীতি লশকরী চালে সে এগিয়ে এলো বাশারের দিকে।
‘স্যার, ডাকছিলেন?’
‘রমিজসাহেব, আপনি এখনো আছেন দেখছি?’ বাশার তার উপস্থিতিতে একটু অবাকই হয়েছে।
‘জি, স্যার। ভাবলাম যদি আপনের কোনো দরকার পড়ে,’ বলে সে তেলতেলে একটা হাসি দিল।
লোকটার জবাব শুনে গা জ্বলে উঠল বাশারের। এই লোক মুহূর্তের ভেতরে এত সুন্দর মিথ্যে কথা বানিয়ে বলতে পারে, সত্যিই তুলনাহীন। ‘বুঝতে পেরেছি। শোনেন, এই থানার আর্কাইভের চাবি কি আপনার কাছে থাকে?’
‘নানা, স্যার। কী যে কইন। আমারটাইন থাকবো ক্যারে। এইহানের অফিসো জমা থাহে। আমার দায়িত্বে আরকি।’
‘ওই এক কথাই। আমার একটু আর্কাইভে ঢুকতে হবে। আপনি ব্যবস্থা করেন তো, বাশার দ্রুত কাজ সেরে বাসায় ফিরতে চাচ্ছে। হঠাৎই খুব ক্লান্তি লাগছে ওর।
‘স্যার, এত রাইতে অহন এই ঝক্কি। এইডা তো বহুত ঝামেলা আর…’
হঠাৎই রাগের পারদ চট করে ওপরে উঠে গেল বাশারের। বিকেলের ঘটনাটার পর লোকটার প্রতি একটু দুর্বলতা কাজ করছিল হঠাৎই সেটা উবে গিয়ে চট করে রাগ উঠ গেল ওর। কড়া চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে শক্ত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই বাজে ঘটনাটা ঘটার হাত থেকে ওকে আর রমিজ দারোগা দুজনকেই উদ্ধার করল তৌফিক ছেলেটা।
‘আরে, ভাই! কী যে বলেন। ঝামেলা তো কি হইছে। স্যারের এখন দরকার মানে দরকার। খুলতে হবে,’ বলে সে একহাতে রমিজ দারোগাকে ধরে টানতে টানতে ভেতরের দিকে নিয়ে চলল।
হঠাৎ ভেতর থেকে উঠে আসা রাগের মাত্রাটাকে সামলানোর জন্যে চুপচাপ কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল বাশার। এভাবে হুট-হাট রেগে যাওয়া ব্যাপারটাকে ও নিজে সবসময় খুব ঘৃণা আর বিরক্তির চোখে দেখে এসেছে। পুলিশের চাকরিতে অনেককেই অকারণে মেজাজ হারাতে দেখে নিজে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছে। আর এখন নিজেই কিনা প্রায় কারণ ছাড়াই চট করে রেগে উঠছে! খারাপ, খুব খারাপ। এভাবে হুট করে জ্ঞান হারানো, চট করে রেগে ওঠা, এসব হলো নিজের ওপরে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারানোর লক্ষণ। এভাবে বারবার নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকলে কখন কোথায় টক্কর খেয়ে জীবনের মোড় ভীষণ খারাপ একটা দিকে ঘুরে যাবে কে জানে।
শেষ কথাটা মনে হতেই মনে মনেও হেসে উঠল। এখন যে অবস্থায় আছে এরচেয়ে খারাপ অবস্থা আর কী হতে পারে? চাকরিতে ডিমোশন, মান-সম্মান হারানো, পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়া, মাকে হারানো, বন্ধুকে হারানো…সবই তো শেষ, এরচেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে? ভাবতে ভাবতেই থানার ভেতরের দিকে রওনা দিল ও। ভাবনাগুলো কতটা ভুল এব্যাপারে কোনো ধারণাও নেই ওর। সময় আরো কতটা খারাপ হতে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারলে এতকিছুর পরেও নিজেকে ওর সুখীই মনে হতো।
ভেতরে ঢুকে রমিজ দারোগার ডেস্কের সামনে এসে বাশার দেখতে পেল ওরা ফর্ম আর চাবি নিয়ে প্রায় প্রস্তুত। ফর্মটা ফিলাপ করে জমা দিয়ে ওরা রওনা দিল আর্কাইভের দিকে। থানার মূল ভবনের পেছনে ঘাসে ঢাকা ছোট্ট আঙ্গিনাটা পার হয়ে চলে এলো তিনতলা ভবনের পেছনের অংশে। এই ভবনটা মূলত অফিসারদের থাকার মেস হলেও একটা অংশ এখনো নানা ধরনের অফিসিয়াল কাজে ব্যবহার করা হয়। এরই একটা ভাগ হচ্ছে আর্কাইভ।
মাত্র সন্ধে হলেও জায়গাটা বেশ অন্ধকার। মোবাইলে টর্চ জ্বেলে ওরা তালা দেওয়া রুমটার সামনে চলে এলো। টর্চের আলোতে পুরনো তালাটাতে একটার পর একটা চাবি মিলিয়ে দেখতে লাগল রমিজ দারোগা আর তৌফিক। বাশার অপেক্ষা করছে। তালাটা দেখে ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছে। জোরে একটা বাড়ি দিলেই ভেঙে পড়বে যে তালা সেটা খোলার জন্যে কতই না আয়োজন। বাশারের মনে হলো. এই তালা আসলে তালা না, এই তালা হলো দেশের সরকারি আমলাতন্ত্রের প্রতীক।
‘স্যার, খুলে গেছে। চলেন ভেতরে যাই,’ রমিজ দারোগা যেন তালা খোলাতে ভীষণ প্রীত হয়ে উঠেছে।
বাশার একবার ভালোভাবে লোকটার দিকে দেখল। ওর ধারণা এই লোক মোটেই নিশ্চিত ছিল না এই চাবিগুলো দিয়ে তালাটা খুলবে কি না। ‘শেষবার কবে এই রুমের তালা খুলেছিলেন আপনি?’ লোকটার হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা যেন ছুড়ে দিল বাশার। সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল হাসিটা যেন একটু ম্লান হয়ে গেল। ‘স্যার, স্যার,’ মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভ্যাবলা হাসি দিল সে। ‘স্যার, মনে নাই।’
‘হুম, বুঝতে পেরেছি। চলেন কাজে নেমে পড়ি,’ বলে ও অন্ধকার রুমের ভেতরে পা রাখল। ঝড়ের বেগে ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল রমিজ দারোগা। ঝড়ের বেগেই সে সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে দিল।
‘ধন্যবাদ,’ রমিজ দারোগার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ গদ-গদ হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে তার আগেই তৌফিককে ভেতরে ঢোকার ইশারা করে রুমের ভেতরে পা রাখল ওরা।
একটা থানার আর্কাইভ হিসেবে রুমটা আরো অনেক ভালো হওয়া উচিত ছিল কিন্তু ভেতরটা যথেষ্ট নোংরা না হলেও অবস্থা বেশি সুবিধেরও না। দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সারি-সারি স্টিলের র্যাকের ভেতরে ফাইল স্তূপ করে রাখা। সুইচ দেওয়ার পরেও ভেতরটা এখন মোটামুটি আলোকিত কিন্তু তারপরও এত বড়ো কক্ষের অন্ধকার পুরোপুরি দূর করতে হলে আরো অনেক বেশি বাল্বের প্রয়োজন।
র্যাকের সারিগুলোর দিকে তাকিয়ে শিস দিয়ে উঠল তৌফিক। তার বিস্মিত ভাব দেখে বাশার অনুমান করল এই ছেলে এর আগে কখনো এখানে আসেনি।
‘কী, মজা লাগছে দেখে?’ মজার ছলেই ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল বাশার। ‘এখানকার অবস্থা এইরকম হবে আমি জীবনেও কল্পনা করিনি।’
‘ওয়েলকাম টু রিয়েল ওয়ার্ল্ড বয়, অ্যাপার্ট ফ্রম ইয়োর ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড,’ বলে হাসিমুখে র্যাকের সারির দিকে এগিয়ে গেল।
তৌফিক একটা ফাইল তুলে ধরতেই সেটা থেকে একরাশ ধুলো ঝড়ে পড়ল। ‘ছ্যাহ! কতদিন পর পর এখানে সব কেস ফাইল রাখা হয়?’
‘উম, বছরে একবার বেশি অইলে দুইবার,’ রমিজ দারোগা দরজার কাছ থেকেই উত্তর দিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে ওদের সঙ্গে কাজে যোগ দিতে আগ্রহী।
বাশার স্টিলের র্যাকের সঙ্গে নম্বর মিলিয়ে দেখল। প্রতিটা র্যাকে কোন বছরের ফাইল রাখা আছে সেই সাল দেওয়া আছে। তবে কোনো মাসের নাম দেওয়া নেই। বাশার নম্বর মিলিয়ে নির্দিষ্ট র্যাকের সামনে এসে দাঁড়াল। বিরাট লম্বা র্যাক। ও এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে তৌফিককে ডাক দিয়ে অন্য প্রান্ত থেকে শুরু করতে বলল।
‘রমিজসাহেব, আপনিও হাত লাগান আমাদের সঙ্গে। আমি এই প্রান্ত থেকে দেখবো। তৌফিক, তুমি অন্য প্রান্ত থেকে দেখবে। আর রমিজ উদ্দিন আপনি মাঝখানের ফাইলগুলো চেক করবেন,’ বলে ও নির্দিষ্ট মাস আর তারিখ বলে বুঝিয়ে দিল কোন সময়ের কেস ফাইলগুলো ওদের দরকার।
পুলিশের কাজের ব্যাপারে বেশিরভাগ মানুষ তাদের ডিউটি আর অ্যাকশনগুলোর খবর রাখে, কিন্তু এর বাইরেও পুলিশি পেশার আরেকটা বড়ো অংশ রয়েছে…সেটা হলো ফাইল ওয়ার্ক।
প্রতিটি থানায় কাজ যেমনই হোক সেই কাজের ফাইল জমা হবে পাহাড় সমান। এখানেও একই অবস্থা। নির্দিষ্ট বছরটার নির্দিষ্ট মাস আর সপ্তাহের ফাইলটা খুঁজে বের করার জন্যে একের পর এক ফাইল ঘেঁটে চলল তিনজনে। টানা আধা ঘণ্টা ফাইল ঘাঁটার পর হঠাৎ রমিজ দারোগা একটা ফাইল ঝপাৎ করে র্যাকের মধ্যে রেখে দুই হাতে জোরে একটা তালি দিয়ে উঠে বলল, ‘আমার এইখানে নাই। থাকলে আইন্নেগো ওইখানে থাকতে পারে।’
কেউ তার কথার জবাব দিল না। বাশারের মনে একটাই চিন্তা, ফাইলটা খুঁজে বের করা। আর তৌফিকের মনেও একটাই চিন্তা কীভাবে নির্দিষ্ট ফাইলটা বের করে সে ডেটিংয়ে যাবে। কাজ সে-ই আগে শেষ করল।
‘বস, আমার এখানেও নেই। থাকলে আপনার ওখানেই আছে।’
বাশার একটু অবাক হয়েই নিজের হাতের শেষ ফাইলটা র্যাকে রেখে দিয়ে বোকার মতো তাকাল দুজনার দিকে।
‘কী ব্যাপার, কী হলো?’ তৌফিক অবাক হয়ে জানতে চাইল। ‘আপনার আবারো শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’
‘নাহ, আমি ঠিক আছি কিন্তু আমি ফাইলটা পেলাম না। তোমরাও পেলে না, তাহলে সেটা গেল কোথায়?’
‘এটা কীভাবে সম্ভব?’
‘আমারো সেটাই প্রশ্ন, এটা কীভাবে সম্ভব? রমিজ সাহেব আপনি ফাইলগুলো ঠিকমতো চেক করেছিলেন তো নাকি? নাকি মাঝে মাঝে বাদ দিয়ে গেছেন?’
‘কী যে কইন, স্যার? আমি…’
‘আমাদেরকে আবোরো সবগুলো ফাইল দেখতে হবে,’ অনেকটা ঘোষণার সুরে বলে উঠল বাশার।
ওর কথা শুনে প্রায় গুঙিয়ে উঠল দুজনেই।
‘কিছু করার নেই। এবার চেক করতে হবেই সেই সঙ্গে সিরিয়ালি সাজাতে হবে ফাইলগুলো। চলো, শুরু করি। যত আগে শুরু ততো আগে শেষ। কাজেই লেটস্ স্টার্ট,’ বলে ও একটা ফাইল টেনে নিলো।
আরো প্রায় দেড় ঘণ্টা টানা কাজ করার পর ওরা নির্দিষ্ট বছরের প্রায় সবগুলো কেসওয়ার্কের ফাইলগুলোকে এক সিরিয়ালি সাজাতে সক্ষম হলো। আর সেটা করার পর বোকা বনে গেল উপস্থিত তিনজনেই।
ওই নির্দিষ্ট বছরের প্রায় পুরোটা সময়ের সবগুলো কেসওয়ার্ক আছে; কিন্তু যে তারিখটা ওরা খুঁজছে সেই তারিখের দুইদিন আগে থেকে সাত দিন পরে পর্যন্ত, অর্থাৎ মাঝখানের নয়দিনের কোনো রেকর্ড নেই। ওরা দুই-তিনবার চেক করে নিশ্চিত হলো আসলেই নেই রেকর্ডগুলো
‘এর মানে কি? এটা কীভাবে সম্ভব?’ তৌফিক অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। তার জেল দেওয়া চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। গরমের ভেতরে টানা কাজ করতে করতে লাল দেখাচ্ছে ফর্সা চেহারা।
‘ইরম কাহিনি তো হুনি নাই, মায়েরে বাপ,’ মোটাসোটা রমিজ দারোগা ও কুল-কুল করে ঘামছে।
ওদের কারো কথার জবাব না দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলো বাশার। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে সে।
‘এর মানে খুবই সহজ; হয় কেউ রেকর্ডগুলো চুরি করেছে, আর না হয় কারো নির্দেশে ওগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে,’ বলে ও একটু থামলো।
‘কেউ একজন চায়নি ওই সময়ে কী ঘটেছিল সেটা জানাজানি হোক, কিন্তু ঘটনাচক্রে পুকুরের নিচ থেকে গাড়িটা বেরিয়ে পড়াতে আমরা এমন কোনো ঘটনাটার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি যেটাকে অতীত থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।’