সপ্তম দৃশ্য – কলকাতার উৎসব রাত্রি

সপ্তম দৃশ্য – কলকাতার উৎসব রাত্রি

চারিদিকের চরম দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যেও কলকাতা যখন হাসে, তখন প্রাণ ভরেই হাসে। কিন্তু দিন-কে-দিন এ হাসি শুকিয়ে আসছে। আমাদের শৈশবেও উৎসব রাত্রে কলকাতার যে প্রফুল্ল মূর্তি দেখেছি, এখন আর তেমনটি দেখি না। পঁচিশ-ত্রিশ বৎসর আগেকার ও এখনকার পূজাপার্বণের মধ্যে প্রভেদ আছে আকাশ-পাতাল। এবং এ প্রভেদের প্রধান কারণ, তখন অল্প টাকার আমোদ হত বেশি, এখন বেশি টাকাতেও উৎসবের আনন্দ পাওয়া যায় অল্প। দুঃখীর সংখ্যা চিরদিনই বেশি থাকে, কিন্তু এখন ধনীর সংখ্যা কমে গেছে। বিশেষ, নতুন ধনীদের প্রাণও সেকালের ধনীদের মতো দরাজ নয়। সেকালের ধনীরা নিজেরা খুশি হয়েই তুষ্ট থাকতেন না, তাঁরা দশজনকে নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করতেন। একালের ধনীরা নিজেরাই খুশি হতে চান বেশি, আর দশজনের জন্যে তাঁরা বড়ো মাথা ঘামান না।

কলকাতার প্রধান উৎসব হচ্ছে, দুর্গাপূজা৭.১— মুসলমানদের যেমন মহরম। কিন্তু দুর্গা প্রতিমার সংখ্যা এখন ক্রমেই অল্প হয়ে আসছে। বৎসর সাত-আট আগেও দুর্গাপূজার উৎসবে পাথুরেঘাটাই কলকাতার আর সব পল্লিকে টেক্কা দিত; অবশ্য এখনও একমাত্র এই পল্লিতে এত বেশি প্রতিমার সংখ্যা কলকাতার আর কোথাও দেখা যায় না। ভাসানের দিন আগে পাথুরেঘাটার পথ লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকত— কারণ এখানে প্রায় একসঙ্গে অনেকগুলি প্রতিমার শোভাযাত্রা বের হত এবং সে একটা দেখবার মতো দৃশ্য ছিল।

দুর্গাপূজার কয় রাত্রেই পাথুরেঘাটায়৭.২ যেন জনতার প্রবাহ বইতে থাকে— লোকের পর লোক, তারপরে লোক, আনাগোনার আর বিরাম নেই। আলোকমালায় পথ সমুজ্জ্বল, ঢাক-ঢোলের ও নহবতের উৎসবোল্লাস জাগানো ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত, সকলের মুখে হাসি, পরনে নতুন কাপড়। পুজো বাড়িগুলিতে এ সময়ে সকলেরই অবাধগতি এবং সন্ধ্যা থেকে অনেক রাত্রি পর্যন্ত দলে দলে লোক প্রতিমা দর্শন করে যায়। ভিড়ের ভিতরে নারীর সংখ্যাও যথেষ্ট। অনেক গরিব ভদ্রলোকের মেয়েও প্রতিমা দেখতে আসে, আর গণিকার তো কথাই নেই। ভিড় হচ্ছে গণিকাদের বড়ো প্রিয়, কারণ তাতে শিকার সংগ্রহের সুবিধা বেশি। তাই তারাও পুরুষ বধ করবার জন্যে যথাসাধ্য মারাত্মক সাজসজ্জা করে জনতার মধ্যে ক্রমাগত যাতায়াত করে। ভিড়ের ভিতরে গুণীর অভাব কখনো হয় না এবং সেই জনতায় গুণীও আছে নানা শ্রেণির। কেউ আসে খালি সৌন্দর্য দর্শনে। গণিকা থেকে শুরু করে ভদ্রমহিলার ঘোমটার মধ্যে এবং পূজাবাড়ির অন্দর পর্যন্ত সর্বত্রই তাদের দৃষ্টি অত্যন্ত সজাগ হয়ে থাকে— উল্লেখযোগ্য সুন্দর মুখ দেখেছে কী তাদের চক্ষু স্থির হয়ে গেছে। এ শ্রেণির গুণীরা অসভ্য হলেও নিরাপদ। কেননা দর্শনেন্দ্রিয়ের তৃপ্তিসাধন ভিন্ন এদের আর বেশি দূর অগ্রসর হবার সাহস নেই। দ্বিতীয় শ্রেণির গুণীরা দর্শন ও স্পর্শন দুই-ই চায়। তারা সবচেয়ে বেশি ঘটার পুজোবাড়ির ফটকের সামনে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে। ভদ্র-অভদ্র দলে দলে নারী আসছে আর যাচ্ছে। মনের মতো মুখ দেখলেই তারা দলের ভেতর ঢুকে পড়ে। বাড়ির সদর দরজা পার হয়েই সাধারণত একটা সংকীর্ণ পথ থাকে। জনতা তার ভিতর দিয়ে যাবার সময়ে পরস্পরের সঙ্গে ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি ও গায়ে পড়াপড়ি অনিবার্য। গুণীরাও তাই চায়! কারণ, এই সুযোগে মন-মজানো চেহারার স্পর্শলাভে তাদের সর্বশরীর পুলকিত হয়ে ওঠে। নারীদের সঙ্গে সঙ্গেই তারা ভিতরে ঢোকে এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবার বেরিয়ে আসে। তারপর আবার নতুন দলের অপেক্ষায় ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কলকাতার কোনো প্রসিদ্ধ ‘ইংরেজি’র প্রফেসরকেও আমি এই দলে দেখেছি। তৃতীয় শ্রেণির গুণীরা আরও বেশি অগ্রসর। তারা এই সুযোগে কুলবধূর সর্বনাশের চেষ্টায় থাকে। চতুর্থ শ্রেণির গুণীরা আসে গণিকা নির্বাচনের জন্য— সাধারণের পক্ষে তারাও নিরাপদ। পঞ্চম শ্রেণির গুণীরা রূপচর্চার কোনো ধার ধারে না। ছোটো ছেটো মেয়েরা ঠাকুর দেখতে যায়, বাগে পেলেই তারা মেয়ে চুরি করে। ষষ্ঠ শ্রেণির গুণীদের দলে চোর, জোচ্চোর, পকেট-কাটা ও গুন্ডাদের ধরতে পারি। তাদের মহিমায় অনেকের গলার হার, কানের গহনা বা পকেটের টাকা অদৃশ্য হয়। জনতার মধ্যে এত রকমের গুণী থাকে, কিন্তু উৎসবের সমারোহের মধ্যে তাদের স্বরূপ চেনা শক্ত কথা। ফি বছরেই কত লোকের উৎসব-হাস্যই যে তারা বিষাদের ছায়ায় বিষণ্ণ করে দেয়, তার আর হিসাব নেই। …বিসর্জনের রাত্রে কলকাতার গঙ্গার তীর ও তার আশেপাশের রাস্তা লোকে লোকে ভরে যায়, অমলিন নব সাজসজ্জায় সে জনতা সকলেরই নয়নরঞ্জন করে। সেদিন নিশ্চিন্ত মিলনের দিন— শত্রুকেও মিত্র বলে আলিঙ্গন করবার দিন। প্রত্যেকের মুখে-চোখেই সে-রাত্রে তাই একটি স্নিগ্ধ, শান্ত ও প্রীত ভাবের আভাস পাওয়া যায়— পথে পথে নমস্কার ও কোলাকুলির দৃশ্য। একটু বেশি রাতে পথে সেদিন মাতালের চেয়ে সিদ্ধিখোরের দলই চোখে পড়ে বেশি। অনেকেরই চোখ ছোটো ছোটো হয়ে যায়, মুখে অকারণ উচ্চ হাস্য ও তুচ্ছ প্রলাপ ফোটে এবং ভাবভঙ্গিতে একটা অবসাদের ভাব জেগে ওঠে। অনেক নাবালকই সেদিন বন্ধুর বাড়িতে সিদ্ধির মাত্রা বাড়িয়ে ফেলে, তারপর বাপ-মায়ের কাছে বকুনি খাবার ভয়ে আর বাড়িতে ঢুকতে পারে না, তাই বেশি রাত পর্যন্ত তারা পথে পথেই ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হয়।

দেওয়ালির রাতে চিৎপুর রোড— বিশেষ করে চোরবাগানের মোড় থেকে মেছোবাজারের মোড় পর্যন্ত— অগুনতি মানুষের মাথার পর মাথা নজরে পড়ে। পথের ধারের দোকান ঘরগুলি আলোকমালায় এবং সুলভ ও কু-শিল্পী অঙ্কিত চিত্রমালায় প্রাণপণে সাজাবার চেষ্টা করা হয়েছে। এসব সাজসজ্জার মধ্যে লোভনীয় বিশেষত্ব তিলমাত্র না থাকলেও রাস্তার লোকগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাই-ই দেখছে। প্রতিবারের প্রতি দোকানখানি ঠিক প্রায় একরকমভাবেই সাজানো হয়, আমার ছেলেবেলা থেকেই এটা লক্ষ করে আসছি। এই একান্ত একঘেয়ে সজ্জা যেন বর্তমানের বিচিত্র নূতনত্বকে প্রকাশ্যভাবে উপহাস করছে। হালুইকরের দোকানের খাবারগুলিও আজ থাকে থাকে বিশেষ কৌশলে সজ্জিত হয়েছে।

আলোকমালার উপরেই বারান্দা; বিলাসিনীদের রূপ আজ দুষ্ট অন্ধকার গ্রাস করতে পারেনি, রং-বেরঙের ছোপানো কাপড় ও ‘নিমা’৭.৩ পরে, মুখে, গলায় ও হাতে পাউডার (অভাবে খড়ি বা চুন) আর ‘রুজ’ (অভাবে আলতা) মেখে, ভুরুকে কৃত্রিম উপায়ে যুক্ত ভ্রূতে পরিণত করে এবং চোখে ‘সুরমা’ টেনে ইহলোকের এই নরকবাসিনীগুলি নিজেদের কদর্যতা যথাসাধ্য গোপন রাখতে চেষ্টা করেছে— যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খোদার ওপরে এই খোদকারী আংশিক বা সম্পূর্ণ রূপেই ব্যর্থ হয়েছে! রাস্তার লোকগুলো শিবনেত্র হয়ে তাদের রূপসুধায় চোখের ক্ষুধা যথাসম্ভব মিটিয়ে নিচ্ছে— কেউ নিতান্ত পচা রসিকতায় তাদের টিটকিরি দিচ্ছে, কেউ নীচ থেকেই একটা অর্থপূর্ণ ইশারা করে নিজেদের মুখ ঢাকবার জন্য ঠোঁট থেকে মাথা পর্যন্ত চাদর জড়িয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ছে, কোনো কোনো দুষ্ট ছোকরা তাদের গায়ে জ্বলন্ত লাল বা নীল দেশলাই কাঠি ছুঁড়ে, কুৎসিত গালাগালি খেয়েও হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে— অনেকে বারান্দার উপরে ছুঁচোবাজি ছাড়তেও ত্রুটি করছে না! …পথের উপরকার আকাশ আজ হরেকরকমের বাজি ও মানুষে বিচিত্র ও শব্দিত এবং বাতাসে বারুদের দুর্গন্ধ। মাঝে মাঝে এক-একটা হাউই বা রকেটের দগ্ধাবশেষ সবেগে নেমে এসে ঠক করে পথিকদের কারোর মাথার ওপরে পড়ে তাকে দস্তুরমতো চমকে দিচ্ছে, কেউ কেউ বাজির পতন থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্যে সন্তর্পণে ছাতা মাথায় দিয়ে পথ চলছে!

কার্তিক ও সরস্বতী পূজা কলকাতার ঘরে ঘরে হয় এবং বিশেষ করে এই দুই দেব-দেবী গণিকাদের অত্যন্ত প্রিয় দেবতা। কিন্তু এর কারণ বোঝা ভারি শক্ত। কার্তিক হচ্ছেন দেব-সেনাপতি, চিরকুমার ও নিষ্কলঙ্ক চরিত্র, তিনি কী করে গণিকাদের প্রিয়পাত্র হলেন? কার্তিক পুজো করে গণিকারা কী আমাদের এই কথাই বোঝাতে চায় যে— ‘স্ত্রী-রা আমাদের প্রধান শত্রু, অতএব তোমরাও চিরকুমার থাকো, আর একনিষ্ঠ হয়ে আমাদের উপাসনা করো?’ এ আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা সত্য হলেও আকাশ থেকে পড়ব না। গণিকার কার্তিক প্রীতির তবু একটা মন-গড়া মানে পাওয়া গেল, কিন্তু মূর্তিমতী বিদ্যার পূজা ‘অবিদ্যা’ নামে খ্যাত জীবগুলির আলয়ে কেন যে হয়, এ সমস্যা একেবারেই দুর্বোধ্য!

এই দুই পূজার রাত্রে গণিকারা বাবুদের প্রণামির দৌলতে রীতিমতো লাভবান হয়, কারণ তারা অধিকাংশ উপপতি ও বন্ধুকেই সাদরে আমন্ত্রণ করে। বাবুদের মধ্যে প্রণামি নিয়ে বেশ টক্করাটক্করিও লেগে যায়, ইনি পাঁচটাকা দিলে উনি দেন দশটাকা এবং তাই দেখে আর এক মহাত্মা হয়তো বিশটাকা ছেড়ে বসেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব যতই বেড়ে ওঠে, গণিকাদের ততই মজা। ভদ্রবাড়ির মতো এখানকার পূজাতেও অতিথিদের আদর যত্ন ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা পান থেকে চুনটি পর্যন্ত খসে না। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে যারা কিছু নিষ্ঠাবান, তারা সাজানো সভায় তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসে, রুপো-বাঁধানো হুকোর বা গড়গড়ার নলে দু-চারটে টান মেরে ও দু-একটা পান খেয়েই কোনো ওজর দেখিয়ে সরে পড়ে— গণিকালয়ে পাত না পেতেই। কিন্তু তবু আহার স্থানে ভদ্রসন্তানেরও অভাব হয় না এবং তারাই দলে ভারী। গণিকার চরণে যারা সর্বস্ব বিকিয়ে দিতে প্রস্তুত, তারা কি কোনো সংস্কারের তোয়াক্কা রাখে? নিমন্ত্রণের দিন অনেক রাত পর্যন্ত উৎসব চলে এবং সম্ভ্রান্ত গণিকারা নাচ-গান আমোদের ব্যবস্থাও করে প্রচুর— অতিথিদের প্রীত্যর্থে। মদের বোতল সেদিন খালি হয় পলকে পলকে! অনেক সময়ে একই বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়ে খুড়ো-ভাইপো প্রভৃতিও পরস্পরের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যান। বাহুল্য, সুচতুর গণিকারা পুজোর সমস্ত খরচ পরিচিত বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে নির্বোধের মাথাতেই হাত বুলিয়ে আদায় করে নেয়। মাঝে এক সুবর্ণ বণিক জাতীয় ছোকরা বাবু কাপ্তেন-সমাজে৭.৪ এই ব্যাপারে যারপরনাই নাম কিনেছিল। সে ছোকরা দু-দিন উড়তে ও বাপের পয়সা ওড়াতে শিখেই সরস্বতী পুজোয় পাঁচ-শো না সাত-শো টাকায় এক জমকালো প্রতিমা গড়ায় এবং পুজোর রাত্রে প্রতিমার মূল্যের অনুপাতে অন্যান্য খরচও করে অসম্ভব রকমের। তার কিছুদিন পরেই যখন শুনলুম যে, ছোকরা ‘ইনসলভেন্সি’ নিয়েছে, তখন কিছুমাত্র অবাক হলুম না। কারণ, এই কাপ্তেন-বাবুদের মনস্তত্ত্ব অতি অদ্ভুত। পুড়ে মরবে জেনেও তারা পতঙ্গের মতো যেচেই আগুনের দিকে এগিয়ে যায়, যেন পুড়ে মরাতেই তাদের আনন্দ। আকণ্ঠ ঋণে ডুবে গেলেও তারা আরও বেশি ডুবে যাবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে, সাঁতার জানলেও কাটবে না। এও একরকম পাগলামি বা আত্মহত্যা আর কী!

ফুলদোলের রাত্রে নিমতলা স্ট্রিটে অপূর্ব এক দৃশ্য দেখা যায়। এ পথে পাশাপাশি নানা দেব-দেবীর সংখ্যা অনেক। প্রায় প্রত্যেক দেবালয়ের সমুখেই প্রকাশ্য রাজপথের ওপরে ছোটো-বড়ো চাঁদোয়া খাটানো হয়, শতরঞ্চি ও চাদর পাতা হয়। এক এক দল লোক এক এক জায়গায় বসে গান-বাজনা শুরু করে। কোথাও একদল বাউলবেশি লোক নাচতে নাচতে গান গায়, কোথাও বৈঠকি গান হয়। কোথাও নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজতে শোনা যায়। নিমতলায় আনন্দময়ীর মন্দিরে যে বৈঠকি গানের আসর বসে, সেটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। সেখানে অনেক নামজাদা গাইয়ে ও বাজিয়ে সেদিন নিজের নিজের কেরামতি দেখিয়ে অর্থাৎ শুনিয়ে দেন। শ্রোতারা প্রায়ই অনাহুত বা রবাহুত। কিন্তু পান প্রভৃতি দিয়ে তাঁদেরও সাদরে অভ্যর্থনা করা হয়। সে রাত্রে এ রাস্তায় অনেক গণিকা ও আধা ভদ্র শ্রেণির যুবতিকে দেখা যায়। রসিক শ্রোতারা কান পেতে গান শোনেন, চোখ রেখে এদের উপরে। যথা সময়ে রসিকরা অবশ্য তাদের পেছনে পেছনে যেতেও ভুলে যান না।

কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় অসাময়িক উৎসবের আসর বসে বারোয়ারি তলায়। এ-ব্যাপারেও বৎসর কয়েক আগে পাথুরেঘাটাই সর্বাগ্রে গণনীয় ছিল। পাথুরেঘাটার বিন্ধ্যবাসিনীর মতো৭.৫ প্রকাণ্ড প্রতিমা আর কোনো বারোয়ারিতে আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। এ প্রতিমাকে বিসর্জনের দিনে কেউ কাঁধে করতে পারত না, একখানা মস্ত লম্বা-চওড়া গাড়িতে বসিয়ে শত শত লোক মিলে টেনে নিয়ে যেত। গাড়িসুদ্ধ প্রতিমার উচ্চতা ছিল আড়াই-তলার কম নয়— সে এক বিরাট ব্যাপার। সেই সঙ্গে আগে সঙেরও আয়োজন ছিল। তিনদিন পুজো হত এবং প্রতি রাত্রে ও দিনে শ্রেষ্ঠ যাত্রা ও পালার কীর্তন প্রভৃতি উপভোগের জন্যে বারোয়ারিতলা বিপুল জনতার সমাগমে গম গম করতে থাকত। বিন্ধ্যবাসিনী পূজার পরেই উল্লেখযোগ্য লোহাপটি ও জোড়াবাগানের বারোয়ারি। এ দুই জায়গাতেই দেবী হচ্ছেন রক্ষাকালী। লোহাপটির ‘বারোয়ারি সং’৭.৬-ও কলকাতায় খুব প্রসিদ্ধ। সেখানে এখনও বারোয়ারির সময় দিনে ও সারা রাত ধরে যাত্রা প্রভৃতি নানা আনন্দের ব্যবস্থা আছে। অধিকাংশ বারোয়ারি উৎসবে সমাগত নারী শ্রোতাদের মধ্যে নিম্নশ্রেণির গণিকার সংখ্যা বেশি।

কলকাতায় রাত্রিকালে আরও নানা উৎসবের অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ ইতিহাস দেওয়া অসম্ভব।

***

টীকা

৭.১ দুর্গাপূজা— বারোয়ারি বা বারো-ইয়ারি দুর্গাপুজোর উৎপত্তি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। শ্রীরামপুরের ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া কাগজ ১৮২০ সালের মে মাসে লেখে যে, শান্তিপুরের ওপারে গুপ্তিপাড়ায় প্রায় বিশ বছর আগে একদল ব্রাহ্মণ সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সর্বজনীন বা বারো-ইয়ারি পুজো শুরু করেন। অর্থাৎ এই হিসেব অনুযায়ী ১৭৯০ সালে বারোয়ারি পুজো শুরু হয়।

ঊনবিংশ শতকে কলকাতার বারোয়ারি দুর্গাপুজোর ছবির মতো বিবরণ পাই হুতোম প্যাঁচার নকশা-য়। আর বারোয়ারি পুজোর কথা বললে সবার আগেই মনে আসে চাঁদা আদায়ের কথা। হুতোম এই চাঁদা আদায়কারীদের “দ্বিতীয় অষ্টমের পেয়াদা” বলেছেন। তখনকার দিনে অষ্টম আইনে খাজনা উশুলের পেয়াদাদের মতোই নিষ্ঠুর ছিল তারা। তবে অনেকেই “চোটের কথা কয়ে বড় মানুষদের তুষ্ট করে টাকা আদায় কত্তেন।” চোটের কথায় তুষ্ট করার গল্পটি ভারী মজার— “আর একবার একদল বারোইয়ারি পুজোর অধ্যক্ষ সহরের সিংগি বাবুদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। সিংগি বাবু সে সময় আফিস বেরুছিলেন, অধ্যক্ষরা চার পাঁচ জনে তাঁহাকে ঘিরে ধরে ‘ধরেছি’, ‘ধরেছি’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। রাস্তায় লোক জমে গ্যালো— সিংগি বাবু অবাক, ব্যাপারখানা কি? তখন একজন অধ্যক্ষ বললেন, “মহাশয়! আমাদের অমুক জায়গায় বারোইয়ারি পুজোয় মা ভগবতী সিংগির উপর চড়ে কৈলাস থেকে আসছিলেন, পথে সিংগির পা ভেঙ্গে গেছে; সুতরাং তিনি আর আসতে পারবেন না, সেইখানে রয়েছেন; আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন যে যদি আর কোন সিংগি যোগাড় কত্তে পার তা হলেই আমি যেতে পারি। কিন্তু মহাশয়! আমরা আজ একমাস নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কোথাও আর সিংগির দেখা পেলাম না; আজ ভাগ্যক্রমে আপনার দেখা পেয়েচি, কোন মতে ছেড়ে দেবো না— চলুন! মার যাতে আসা হয়, তাই তদবির করবেন।’ সিংগি বাবু অধ্যক্ষদের কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে বারোইয়ারি চাঁদায় বিলক্ষণ দশ টাকা সাহায্য করলেন।” সমাচার দর্পণে ১৮৪০ নাগাদ প্রায়ই খবর বার হত, বেহালা অঞ্চলে নাকি বারোয়ারি পান্ডাদের চাঁদার জুলুমে পথ চলা দায়। তাদের পান্ডা স্বয়ং সাবর্ণ চৌধুরীর বাড়ির ছেলেরা, “মান্য সাবর্ণ মহাশয়দিগদের যুবা সন্তানেরা বারোয়ারী পূজার নিমিত্ত অনেক লোকের উপর অত্যাচার করিতে ছিলেন.. স্ত্রী লোকের ডুলি পালকি দৃষ্টি মাত্রই বারোয়ারীর দল একত্র হইয়া তৎক্ষণাৎ আটক করিতেন এবং তাহাদিগের ইচ্ছামত প্রণামী না পাইলে কদাপি ছাড়িয়া দিতেন না।” শেষে চব্বিশ পরগনার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেটন নারীবেশ ধরে এদের পাকড়াও করেন ও জেলে পোরেন। তবে পূজা শেষে ঝামেলাও কম হত না। চুঁচড়োতে একই মূর্তি বৈষ্ণব আর শাক্ত মতে পূজা হয়। প্রথমে বৈষ্ণব, পরে শাক্ত। কিন্তু ঝামেলা বাধল বিসর্জন দেবার সময়ে। বৈষ্ণবরা বলে তারা তো ঘট বিসর্জন দিয়েই দিয়েছে— মূর্তি বিসর্জনের খরচা শাক্তদের। আর “এই বিষয়েতে দুই দলে দাঙ্গা উপস্থিত হইল।” পরে অবশ্য শাক্ত ও বৈষ্ণব দুর্গা আলাদা হয় সিংহের গঠনে, শাক্তের সিংহ সাধারণ ও বৈষ্ণব সিংহ ঘোড়ামুখো হত। মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, বড়োবাজারে এক বাড়িতে ছোট্ট এক দুর্গামূর্তির পুজো হত— যাকে সবাই পুতুল দুর্গা বলত। ডাকের গয়না তখনও চালু হয়নি। মাটির গয়নাই সর্বত্র চলত। অনেকে সন্ধিপূজায় নাপিত দিয়ে বুক চিরে রক্ত সোনার বাটিতে নিয়ে পূজা দিত। ঢুলিরা নীল কোরা কাপড় পরে ‘কাঁইনানা, কাঁইনানা, গিজদা গিজোড়, গিজোড় গিজোড়’ বোল তুলে নাচত, নিয়ম ছিল অনেক। পাত পেড়ে খাওয়াতে হবে অন্তত দশজনকে। ঝি-চাকরকে সন্ধের সময় দিতে হবে জলপান। বিজয়াতে সন্দেশ বা মিষ্টি চলত না— শুধু নারকেল ছাবাই গ্রাহ্য ছিল। সঙ্গে ১৯০৭ সালে দি এমপ্রেস পত্রিকায় ছাপা হয় শোভাবাজার রাজবাড়ির বড়ো তরফের এই দুর্গার ছবি।

৭.২ পাথুরে-ঘাটায়— নাম ছিল নুড়িঘাটা। কালেদিনে নুড়ি হয়ে গেল পাথর। সেই থেকে পাথুরিয়া। বর্ধমান থেকে ব্যবসার সূত্রে কলকাতায় এসে পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটে বাড়ি তৈরি করেন রামরাম ঘোষ। আনুমানিক ১৭৮৪ সালে বাড়িটি তৈরি হয়। কলকাতাবাসের সূচনা করলেও, পাথুরিয়াঘাটা ঘোষ বংশের প্রতিষ্ঠাতা রামরামের ছেলে রামলোচন ঘোষ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। হেস্টিংসের আমলে দেওয়ানও হন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ৪৬ পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন। রামলোচনের তিন পুত্র— শিবনারায়ণ, দেবনারায়ণ এবং আনন্দনারায়ণ। রামলোচনের মেজো ছেলে দেবনারায়ণের ছেলে খেলাৎচন্দ্র ঘোষ ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ১৮৪৬ সাল নাগাদ পুরোনো বাড়ির পাশেই ৪৭ পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটে দুর্গাদালান সহ নতুন বাড়ি তৈরি করে উঠে যান এবং সেখানে দুর্গাপুজো শুরু করেন। দুর্গার নাম বিন্ধ্যবাসিনী। এখন সেটাই পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ি। এই বাড়িতে এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি। এই ভবনেই দেহত্যাগ করেন রামকৃষ্ণ। সেই সময় বাড়ির কর্তা ছিলেন খেলাত ঘোষের ছেলে রামনাথ ঘোষ। কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই বাড়িতে আসতেন। মার্টিন অ্যান্ড বার্নের তৈরি এই বাড়িতে মঠচৌরি চালের মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমায় পুজো হয়। পরানো হয় রুপোলি ডাকের সাজ। রুপোলি তবকে মোড়া সিংহাসনে দেবীর অধিষ্ঠান। পুজোয় ব্যবহার করা হয় রুপোর বাসন। ডাকের সাজের একচালা মা দুর্গার পায়ের কাছে সিংহের বদলে থাকে ঘোটক সিংহ। লুচি-মিষ্টি-মন্ডা ভোগের সঙ্গে থাকে চিনির মঠ। আগে কাশী থেকে এলেও, এখন স্থানীয় মঠই দেওয়া হয় ভোগে। সেই রীতির মতোই বন্ধ হয়ে গিয়েছে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো। ঠাকুর পরিবারের সঙ্গেও এই জায়গার অঙ্গাঙ্গি যোগ। পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা গোবিন্দপুরে নতুন কেল্লা তৈরির জন্য সেখানকার বাসিন্দাদের অন্যত্র জমি দেয়৷ এদিকে তার আগের বছরে সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ফলে জয়রামের ধর্মতলার বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ সব ক্ষতিপূরণ মিলিয়ে যা পেলেন তাই দিয়ে জয়রামের পুত্র নীলমণিরাম বা নীলমণি ঠাকুর উত্তর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে জমি নিয়ে বাড়ি করে সপরিবারে উঠে এলেন৷ প্রতিষ্ঠা হল পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর বংশের৷ নীলমণি বাড়ি করলেও আবার তিনি ওড়িশায় চলে যান চাকরি করতে৷ বাড়ি, পরিবার রইল পরের ভাই দর্পনারায়ণ ও গোবিন্দরাম ঠাকুরের জিম্মায়৷ দর্পনারায়ণের পুত্ররা ও তাঁদের পরিবারবর্গ পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বংশ নামে পরিচিত৷

এই বংশে অনেক কৃতবিদ্য মানুষ জন্মেছেন, তাঁদের মধ্যে গোপীমোহন ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রমানাথ ঠাকুর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য৷ টেগোর ক্যাসল, টেগোর প্যালেস, মরকতকুঞ্জ প্রভৃতি ভবন পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন সদস্য নির্মাণ করেন৷ এর বেশ কিছুকাল পরে, সম্পত্তি নিয়ে নীলমণি ও দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বিরোধ হলে, নীলমণি এক বস্ত্রে স্ত্রী-পুত্র ও গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন নিয়ে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ত্যাগ করে পথে এসে দাঁড়ালে বৈষ্ণবচরণ শেঠের দেওয়া মেছুয়াবাজারের জমিতে কুঁড়েঘর তৈরি করে বসবাস আরম্ভ করলেন৷ পরে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ পেয়ে ১৭৮৪-তে নতুন বাড়ি করলেন৷ সেই বাড়িই আজ জোঁড়াসাকো ঠাকুরবাড়ির রামভবন৷

৭.৩ নিমা— টিউনিক জাতীয় পোশাক। প্রাচীনকালে রোমের অধিবাসীদের সাধারণ পোশাক ছিল টোগা। টোগার আকৃতি ছিল বৃত্তের একটি কাটা অংশের মতো। গ্রিকদের হিমেশন যেমন এক কাঁধের ওপর ফেলা থাকত, রোমানদের টোগাও তেমনিভাবে পরা হত ভাঁজ করা অবস্থায়। টোগার তলায় রোমানরা টিউনিক পরত। গরিবরা শুধু টিউনিক পরত। কালক্রমে প্যালিয়াম পরার ফ্যাশন দেখা দিল। এর অপর নাম ক্লোক। প্যালিয়াম ছিল শিক্ষিত রোমানদের পরিচ্ছদ। এটা একরকম আলখাল্লার মতো ঢিলা পোশাক। গ্রিকরা যেমন তলায় কিটন ও ওপরে হিমেশন পরত, রোমক মেয়েরা তেমনি স্টোলা ও পালা পরত। বাইরে বেরুবার সময় স্ত্রী-পুরুষ সবাই বুট পরত আর বাড়িতে পরে থাকত স্যান্ডাল।

৭.৪ কাপ্তেন সমাজে— কলকাতার নিচুতলার সাহেবদের মধ্যে প্রধান ছিল নাবিকরা। আচার আচরণে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই। নানা অছিলায় ঢুকে পড়ত শহরে। মাতলামি, খুন, ডাকাতি, নানা অপরাধ করত হামেশাই। তাদের বেলাগাম জীবনের জন্য প্রায়ই যৌন ব্যাধির শিকার হতে হত। যা উপার্জন হত, গোটাটাই উড়িয়ে দিত ফুর্তিতে। আর সেখান থেকেই এই ধরনের জীবনযাত্রা কাপ্তেনি নামে পরিচিত হয়।

৭.৫ বিন্ধ্যবাসিনীর মতো— বিন্ধ্যবাসিনী মানে সিংহবাহিনী পার্বতী। ঊনবিংশ শতকে রামধন স্বর্ণকারের খোদিত একটি অদ্ভুত ছবি আমাদের চোখে পড়ে। একটি পঞ্চশাখ মন্দির, গির্জার আদলে, পাশের দুটি মন্দিরের উচ্চতা কম আর তার পাশের দুটির আরও কম। মন্দিরগুলো উঁচু পিঁড়ার ঊপর আছে। দেবী দুর্গা আছেন, সঙ্গে কাত্যায়নী আর ইন্দ্রাণী। নিচে এক ঋষিমশাইও আছেন বটে, কিন্তু গোটা ছবিতে বিদেশি ট্যাপেস্ট্রির ভাব স্পষ্ট। আছে ডানা মেলা অ্যাঞ্জেলরা, আছে ইউনিকর্ন, আছে উপর থেকে ঝোলা শ্যান্ডেলিয়র, মাথায় আছে ব্রিটিশ সিংহ আর তলায় চাবুক হাতে সাহেব আর দুই সিপাই। অ্যাঞ্জেলরা ঠিক তেমনি হাত জোড় করে বসে, যেমনটি চার্চে থাকে। দেবীর সিংহ অবশ্য বৈষ্ণবদের মতাবলম্বী ঘোড়ামুখো। দেবীর তলায় শিব বসে রয়েছেন। শিবের পরে প্ল্যাটফর্মের গা বেয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে। সেই সিঁড়িতে প্রথমে দেবীর নাম, পরে খোদাই ছবি নিয়ে শিল্পীর বক্তব্য।

শ্রী শ্রী বিন্দুবাসিনী

শ্রী রামধন স্বর্ণকারের

এই নিবেদন। সম্প্রতি

পেলেট খোদিত রহিল এখন

এই পেলেট যে করিবে মাত্র হরণ

ভয় পাপ তাহারে আসিবে।

সুকুমার সেন তাঁর “বটতলার ছাপা ও ছবি” বইতে লিখেছেন, “ছবি খুঁটিয়ে দেখে আমার ধারণা হয়েছে যে এই ছবির পরিকল্পনায় সেকালের (অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর) চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ দশকের সবচেয়ে খ্যাতিমান দেশী বিদেশী দু ধরনের ছবি আঁকতে দক্ষ রামধন স্বর্ণকারের মৌলিক শিল্পচিন্তার পরিচয় রয়ে গেছে। মহাদেবীকে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন সমসাময়িক ভাবনায় ব্রিটিশ সিংহবাহিনী রূপে। তুলনা করতে ইচ্ছে হয়, স্বদেশী যুগের প্রারম্ভে অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতা ছবি আঁকার প্রচেষ্টার সঙ্গে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার চিত্রশিল্পীদের আঁকা সবচেয়ে বিশিষ্ট মৌলিক প্রচেষ্টার নিদর্শন বলে রামধন স্বর্ণকারের এই ছবিটির সমধিক মূল্য আছে।”

৭.৬ লোহাপটির বারোয়ারি সঙ— কলকাতাতে সঙের আবির্ভাব হয় বাবু-কালচারের সময় থেকে। নানারকম পোশাক ও রঙিন সাজে সেজে, গান, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদির দ্বারা সৃষ্টি করা হত হাস্যরস। মূলত গ্রামীণ লোকেদের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্টি হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের হাত ধরে এটি চলে আসে শহরাঞ্চলে। অন্যান্য পূজা-পার্বণে সং দেখা গেলেও, গাজন উপলক্ষ্যে এদের সবথেকে বেশি দেখা যেত। প্রথমদিকে প্রান্তিক সমাজের সংস্কৃতি বলে, শহুরে সমাজ এটাকে নিচু চোখে দেখত। পরে ফুর্তিবাজ জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় সং-সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

সেই সময়ে কলকাতার এলাকা বা পাড়াগুলোয় বসতি গড়ে উঠেছিল একই জীবিকা বা একই জাতের মানুষের একত্রিত হওয়ার ভিত্তিতে। যেমন ডোমতলা, কুমোরটুলি, বেনিয়াটোলা, আহিরিটোলা, কাঁসারিপাড়া, জেলেপাড়া, লোহাপটি ইত্যাদি। ঊনবিংশ শতক থেকেই কলকাতা ও হাওড়াতে এই পাড়াগুলো থেকে, অঞ্চলভিত্তিক সঙের শোভাযাত্রা বেরোতে থাকে। কাঁসারিপাড়া অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি তারকনাথ প্রামাণিক, এবং হিন্দু পেট্রিয়ট-এর সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালের পরিচালনায় বের হত কাঁসারিপাড়ার প্রসিদ্ধ সং যাত্রা, প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির দিন। পরবর্তীকালে অবশ্য আহিরিটোলা, খিদিরপুর, বেনিয়াপুকুর, তালতলা, জেলেপাড়া প্রভৃতি এলাকা থেকেও শুরু হয় সং বেরোনো। হাওড়ার শিবপুর, খুরুট, মেদিনীপুর, ঢাকা, হাওড়ার রাধাপুর, শ্রীরামপুর থেকেও বের হত এই সং। বিচিত্র সঙের ফিরিস্তি দিয়েছেন হুতোম অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন সিংহ। হুতোমের লেখা পড়লে মনে হয় সেকালের কলকাতার সংস্কৃতি যেন সঙের রং ঢং-এ মেতে উঠেছে। রঙ্গময় এই বঙ্গদেশে উনিশ শতকে সঙের মিছিলে, এবং সঙের গানে রস পরিহাস ও কৌতুকে সমাজের অসংগতিকে তুলে ধরা ছিল মুখ্য কথা।

সেই দিনে কলকাতার গলি ও রাজপথের বাড়ির বারান্দায়, ছাদে ও জানালায় আবালবৃদ্ধবনিতা সঙের শোভাযাত্রা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। কলকাতা হয়ে উঠত মিলনমেলার নামান্তর। গৃহস্থঘরে অতিথির জন্য তৈরি হত শরবত। থাকত পান তামাকের ব্যবস্থা। দর্শকের জন্য পথের উপর শামিয়ানা টাঙানো হত।

১৯১৭ সালে চুরি গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। জেলেপাড়ায় রচিত হল –

“বিদ্যার মন্দিরে এ সিঁদ কেটেছে কোন চোরে

সখীরা নেকী নাকি পড়ল ফাঁকি

কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে

বিদ্যা সর্ববিদ্যা অধিকারী

দেবের প্রসাদে গুমোর গো ভারী

বিদ্যা নিত্য পূজে আশুতোষে”

ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষক বাঙালি বাবুদের উদ্দেশ্যে লেখা-

“ডাণ্ডা ধরে গাধা পিটলে

ঘোড়া কভু হয় না

ধরে যখন কান মলা দেয়

তখন বাঁকা থাকতে পারে না।”

তথাকথিত ইঙ্গবঙ্গ যুবককে নিয়ে লেখা সঙের গান —

“এখন ছেলেরা এক নতুন টাইপ

চোদ্দ না পেরতে পাকা রাইপ

মুখে আগুন ঢুকিয়ে পাইপ

একমাত্র life ধারণ wife এর চরণ কর্ত্তে ধ্যান

এরা নতুন অর্থ করেন গীতার

ভুল ধরেন পরম পিতার

নৈলে কি তার trial বিনা in হয়।”

হাসির, হাসানোর নানা রং ঢং দেখিয়ে সং ছড়া কাটত —

“হাসি হাসব না তো কি

হাসির বায়না নিয়েছি

হাসি ষোল টাকা মণ

হাসি মাঝারি রকম

হাসি বিবিয়ানা জানে

হাসি গুড়ুক তামাক টানে

হাসি প্যরা গুড়ের সেরা

হাসি হুজুর করে জেরা।”

তৎকালীন বাঙালি সমাজে বছরভর যেসব ঘটনা, দৃশ্য বা কথা দাগ কেটেছে, তা আলোকিত হত সঙের ছড়ায় আর গানে। এরকম তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির প্রতি বিদ্রুপ করার জন্য একটা সামাজিক ঝড় ওঠে, এবং এই সং-সংস্কৃতিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে, স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপে এবং কলকাতাতে প্লেগের মহামারির জন্য, এই সং-যাত্রা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে, ১৯৯৩ সালে আবার নতুন উদ্যোগে জেলেপাড়ার সং শুরু হলেও, সেটা আর আগের মতো প্রসিদ্ধি পায়নি, কারণ সময়টা বদলে যেতে শুরু করেছিল অনেকটাই। বিশ্বায়নের যুগে, এই সং-সংস্কৃতির আর-কোনো চাহিদা তৈরি হয়নি।

এই সং-সংস্কৃতি কলকাতা থেকে প্রায় হারিয়ে গেলেও, তাদের ছড়া-গানের এবং যাত্রার নামের অনেকগুলো কথা এখনও আমরা ব্যবহার করে থাকি। যেমন-

‘এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই’,

‘বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন’,

‘ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে’,

‘খ্যাঁদা পুত্রের নাম পদ্মলোচন’,

‘মদ খাওয়া বড়ো দায় জাত থাকার কী উপায়’।

এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর কলকাতা তথা জেলেপাড়ার সং আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আটের দশকে ‘কলিকাতা কৈবর্ত সমিতি’ আবার নতুনভাবে উপস্থাপিত করে জেলেপাড়ার সংকে। প্রতিবাদ জানানো হয় দাঙ্গা লাগিয়ে বস্তি উচ্ছেদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। ১৯৯৩ সালে ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের উদ্যোগে আবার শুরু হয় জেলেপাড়ার সং সমিতি সংঘ, মিছিল বের করেন শঙ্করপ্রসাদ দে। এঁদেরই মতো কিছু মানুষের উদ্যোগে আজও বেঁচে আছে বাংলা লোকবিনোদনের এই মৃতপ্রায় মাধ্যমটি। সঙ্গে মাদাম বেলানসের তুলিতে সেকালের সং।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *