সপ্তম ও অষ্টম শতকে হাদীস চর্চা

সপ্তম ও অষ্টম শতকে হাদীস চর্চা

পূর্ববর্তী আলোচনা প্রায় সাড়ে ছয়শত বৎসর পর্যন্ত বিস্তৃত। হিজরী সপ্তম শতকের শেষাধ্যে মুসলিম জাহানের উপর ধ্বংস ও বিপর্যয়ের এক প্রবণ ঝঞ্ঝা- বাত্যা প্রাবাহিত হইয়া যায়। ৬৫৮ হিজরী সনে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ার বিশাল অঞ্চলে তাতারদের সর্বগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় তাহারা ‘হলব’ ধ্বংস করিয়া দামেশকের দিকে অগ্রসর হয়। মিসরে তখন আইয়ুবী শাসন অবস্থিত; কিন্তু তাহাও তৈলহীন প্রদীপের মত নিস্প্রভ প্রায় হইয়া আসিয়াছিল। মামলুকদের কর্তৃত্বই সর্বত্র প্রধান ও প্রবল হইয়া উঠে। সপ্তম শতকের মুসলিম জাহানের উপর তুর্কী প্রাধান্য স্থাপিত হইতে শুরু করে। অপর দিকে সমগ্র মাগরিব (উত্তর পশ্চিম আফ্রিকা) এলাকায় মাগরেবী বার্বার জনগোষ্ঠীর শাসন সংস্থাপিত হয়।

এক কথায়, এই সময় সমগ্র মুসলিম জাহানের উপর সভ্যতার সূর্যাস্তকালীন অবস্থা বিরাজিত ছিল। মুসলিমগণ চরিত্র, ঈমান ও শৌর্য-বীর্য সকল দিক দিয়াই দুর্বলতর হইয়া পড়ে। তাহাদের পারস্পরিক প্রবল হিংসা-বিদ্বেশ, মতবিরোধ ও অবসাদ তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে নিস্প্রাণ ও মৃত্যু-প্রায় করিয়া দিয়াছিল। মুসলিমগণের এক দেশ হইতে অন্য দেশ পরিভ্রমণ ও বিরাট মুসলিম জনতার সহিত গভীর ঐক্য সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার কোন প্রবণতাই কোথাও পরিলক্ষিত হইত না। এমন কি হাদীসের সন্ধানে যে মুসলিমদের দেশ পর্যটন ছিল এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গৌরবের বিষয়, এই শতকে জ্ঞান-কেন্দ্র ও দূরে দূরে অব্স্থানকারী মনীষী ও মুহাদ্দিসদের মধ্যে জ্ঞানগত সম্পর্কসূত্র সম্পূর্ণ ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদের চিন্তা ও মনীষা ভোঁতা হইয়া যাইতে লাগিল, জ্ঞান-পিপাসুদের মধ্যে দূর-দূরান্তর পরিভ্রমনের সুযোগে জ্ঞান আহরণের কোন তৎপরতাই ছিল না। ফলে হাদীস সংগ্রহ ও উহার বর্ণনা পরস্পরার ধারাবাহিকতার পথ রুদ্ভ হইয়া আসে। এক্ষণে কেবলমাত্র উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস বর্ণনার অনুমতি লওয়া ও কিছু সংখ্যক হাদীস তাঁহার নিকট হইতে লিখিয়া লওয়ার মধ্যেই হাদীস চর্চার সময় কাজ সীমাবদ্ধ হইয়া পড়ে। হাদীসের সন্দ এই সময় কেবলমাত্র এক ‘বরকত’ লাভের উপায়ে পরিণত হয়।

কিন্তু ইহা চূড়ান্ত এ একমাত্র কথা নহে। এই সময়ও কিছু সংখ্যক তেজস্বী মনীষীর সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁহারা হাদীস-সন্ধান ও সংগ্রহেনর প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত তৎপরতার পুনরুজ্জীবন সাধন করেন। তারা দূর দূর কেন্দ্রে পরিভ্রমণ করেন ও মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস লিখিয়া লইবার উদ্দেশ্যে তাঁহার সম্মুখে আসন গাড়িয়া বসিতে লাগিলেন। এই পদ্ধতিতে হাদীস শিক্ষাদান হাদীস-বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ইমলা’ (********************)। মুহাদ্দিস মসজিদের একপাশে সপ্তাহের নির্দিষ্ট একদিনে আসন গাড়িয়া বসিতেন, তাঁহাকে ঘিরিয়া চতুর্দিকে বসিতেন হাদীস শিক্ষার্থী লোকেরা। মুহাদ্দিস মুখে হাদীস পাঠ করিতেন, শিক্ষার্থিগণ তাহা নিজ নিজ কাগজে লিখিয়া লইতেন। এই পর্যায়ের মুহাদ্দিসের মধ্যে আল-হাফেজ আবুল ফযল জয়নুদ্দীন আবদুর রহীম ইবনুল হুসাইন আল-ইরাকীর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি যেমন হাদীসের যুগ-ইমামা ছিলেন, তেমনি ছিলেন বহু সংখ্যক মুল্যবান গ্রন্হের প্রণেতা। তিনি হাদীস লিখাইবার জন্য চার শতেরও অধিক মজলিস অনুষ্ঠান করিয়াছেন। তাঁহার ছাত্র ইবনে হাজার বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি ৭৯৬ হিজরী সনে হাদীস লিখাইতে শুরু করেন। ফলে রাসূলের হাদীস চর্চা বন্ধ হইয়া যাওয়ার পর তনি উহাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি চার শতেরও অধিক মজলিসের অনুষ্ঠান করেন এবং ইহার অধিকাংশ বৈঠকে তিনি কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যেই সুসংবদ্ধ ও সুরক্ষিত এবং কল্যাণাদানকারী হাদীসসমুহ লিখাইয়া দিয়াছেন।

[********************]

তিনি ৮০৬ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।

এই পর্যায়ে দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য মনীষী হইতেছেন শিহাবুদ্দীন আবুল ফযল আহমদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাজার আল-আসকালানী। তিনি হাদসের শুধু হাফেজই ছিলেন না, এই শতকের হাদীসের হাফেজদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। এই শতকে তাঁহার সমতুল্য মুহাদ্দিস আর কেহই ছিলেন না। তিনি ৮৫২ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। তাঁহার সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস সংগ্রহের জন্য দেশভ্রমণ ও দুনিয়ায় হাদীস চর্চার প্রাধান্য সামগ্রিকভাবে তাঁহার পর্যন্ত আসিয়া শেষ হইয়া যায়। তাঁহার সমসাময়িক যুগে তিনি ব্যতীত অপর কেউই হাদীসের হাফেজ হন নাই। তিনি বিপুল সংখ্যক গ্রন্হ রচনা করিয়াছেন ও এক হাজারেরও অধিক মজলিস অনুষ্ঠান করিয়া হাদীস লিখাইয়াছেন।

[********************]

হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানীর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্হ হইতেছে বুখারী শরীফের শরাহ ‘ফতহুল বারী’। ইহা বিরাট দশটি খণ্ডে বিভক্ত। ইহার ভূমিকা স্বতন্ত্র এক গ্রন্হ হিসাবে প্রকাশিত, উহার নামঃ ********************।

[********************]

তাঁহার নিজস্ব একখানি হাদীস সংকলনও রহিয়াছে। তাহা হইতেছে ******************** ইহা আহকাম সংক্রান্ত হাদীসের এক বিশেষ সংকলন।

আলেম সমাজে এই গ্রন্হখানিও বিশেষভাবে সমাদৃত হইয়াছে।

[********************]

ইবনে হাজারের ছাত্র ইমাম সাখাভীও এই পর্যায়েল এক উল্লেখযোগ্য প্রতিভা। তিনি তাঁহার বিখ্যাত ‘ফতহুল মুগীস’ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ******************************************************

আমি মক্কা শরীফে হাদীস লিখিয়াছি। কাহেরার বিভিন্ন ও বহু সংখ্যক স্থানেও এই কাজ করিয়াছি এবং এখন পর্যন্ত যতগুলি মজলিসে হাদীস লিখাইবার কাজ করিয়াছি, তাহার সংখ্যা প্রায় ছয়শত হইবে।…………. আর সব কাজেরই মূল হইতেছে নিয়্যত।

[********************]

কিন্তু হাদীস ‘ইমলা’ করানোর এই পদ্ধতিও আর বেশি দিন কার্যকর হইয়া থাকিতে পারে নাই। পরবর্তী সময়ের হাদীসবিদগণ পূর্ববর্তীদের সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহ লইয়াই অধিক মশগুল থাকেন। উহা হইতে হাদীস সঞ্চয়ন, সংক্ষিপ্ত সংস্করণ রচনা, হাদীস গ্রন্হের ব্যাখ্যা প্রণয়ন প্রভৃতি কাজেই তারা মনোযোগ দান করেন। আর ইহাও মুসলিম জাহানের মাত্র কয়েকটি শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং অতি অল্প সংখ্যক লোকই এই কাজে মনোনিবেশ করিয়াছিলেন মাত্র।

বিভিন্ন দেশে হাদীস চর্চা

সপ্তম, অষ্টম ও উহার পরবর্তী শতকসমূহে মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চলে হাদীসের চর্চা, শিক্ষাদান ও প্রচার সাধিত হইয়াছে। এই সময়ে মাগরেবী দেশসমূহেই (উত্তর পশ্চিম আফ্রিকায়) ইহার প্রসারতা সর্বাধিক ছিল। কিন্তু উহার পর দুইটি বিরাট মুসলিম দেশে হাদীস চর্চার ব্যাপকতা পরিলক্ষিত হয়, একটি মিসর এবং অপরটি হিন্দুস্থান (ভারতবর্ষ)। বাগদাদে তাতারী আক্রমণের ফলে আব্বাসীয় খিলাফতের পতন মুসলিম মনীষা ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এক মর্মান্তিক ঘটনা। তাতারগণ বাগদাদের ইসলামী গ্রন্হাগার হইতে লক্ষ লক্ষ গ্রন্হ হরণ করিয়া লইয়া দজলা নদীতে নিক্ষেপ করে ও উহার উপর এই গ্রন্হস্তুপ দ্বারা পুল নির্মাণ করিয়া দেয়- যেন তাহাদের সৈন্যবাহিনী সহজেই নদী অতিক্রম করিতে পারে। ইহার পরই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎসকেন্দ্র বাগদাদ হইতে অন্যত্র স্থানান্তরিত হইয়া যায়। প্রথমে মিসর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান- বিশেষত ইলমে হাদীসে সমৃদ্ধ ও ফুলে-ফলে সুশোভিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। এই সময়ে মিসরে হাদীসের যেরূপ চর্চা ও প্রসার হয় তাহাকে অনায়াসেই তৃতীয় হিজরী শতকের হাদীস চর্চার সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। কিন্তু অতঃপর এখানেও হাদীস চর্চার এই প্রচণ্ড মার্তণ্ড অস্তোন্মুখ হইয়া পড়ে। হাদীসের জ্ঞান-চর্চা অতঃপর অন্যান্য দেশের দিকে প্রবাহিত হয়। দেখা যায়, হাদীস জ্ঞানের সূর্য মিসরে অস্তমিত হইয়া ভারতের আকাশে উদিত ও ভাস্বর হইয়া দেখা দিয়াছে। ভারতে তখন প্রকৃতপক্ষেই হাদীস-চর্চার স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। ( বিস্তারিত আলোচনার জন্য এই গ্রন্হের ‘পাক ভারতে ইলমে হাদীস’ শীর্ষক অধ্যায় দ্রষ্টব্য।)

মিসরের এই পতন যুগেও হাদীসের চর্চা মোটেই হয় নাই, একথা বলা যায় না। বরং ইতিহাস আমাদের সম্মুখে এই সময়ও ইলমে হাদীসের বিরাট ও অবিস্মরনীয় খেদমতের দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করে। মিসরে তখন মামলুকদেরই রাজত্ব কায়েম ছিল। এই মামলূক বাদশাহদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞান-স্পৃহা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। বহু বাদশাহ ছাত্র হিসাবে একালের মুহাদ্দিসদের সম্মুখে আসন গাড়িয়া বসিয়াছেন। রাজ ভাণ্ডার উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিয়াছেন হাদীস শিক্ষার বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে।

এই সময়ও মিসরে কয়েকজন হাদীসের ইমাম বর্তমান ছিলেন। হাদীসসমূহ উহার পূর্ণ ও বিশুদ্ধ সনদসহ তারা মুখস্থ করিয়াছেন। পিপাসুরা তাঁহাদের নিকট হইতেই হাদীস শিক্ষা করিতেন এবং হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে লোকেরা তাঁহাদের সম্মুখেই ভীড় জমাইত।

তাঁহাদের মধ্যে নিম্নলিখিত হাদীসবিদগণ উল্লেখযোগ্যঃ

১. জাহের বরকুক

২. ইমাম আকমালূদ্দীন আল-বাবরতী

৩. ইবনে আবুল মজদ

৪. আল-মুয়াইয়িদ

৫. শামসুদ্দীন আদ-দেয়ারী আল-মুহদ্দিস।

[********************]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *