প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

সপ্তম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) শেষ জীবন (৬২৮-৬৩২ খ্রি.)

সপ্তম অধ্যায় – হযরত মুহাম্মদ (স)-এর শেষ জীবন (৬২৮-৬৩২ খ্রি.)

বিদেশে দূত প্রেরণ (৬২৮ খ্রি.)

হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (স) বহুদর্শী ও ধর্মজ্ঞ শিষ্যগণকে ধর্ম প্রচারার্থে চতুর্দিকে প্রেরণ করেন। বিভিন্ন রাজ্যের সম্রাট ও রাজপুত্রগণকে কুসংস্কাররূপ অন্ধকার হতে সত্যধর্মের জ্যোতিতে আনয়ন করবার জন্য তাদের নিকট আমন্ত্রণলিপিসহ দূত প্রেরিত হয়। সীলমোহর করা আমন্ত্রণলিপি আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাসী, রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস, পারস্য-অধিপতি খসরু পারভেজ, আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা মুকাউকাস, বসরার শাসনকর্তা হারিস-বিন- আবিসাম এবং ইয়ামামার শাসক হাওজা-বিন-আলীর নিকট পাঠানো হয়।

হযরত মুহাম্মদ (স) আবিসিনিয়ার নৃপতি নাজ্জাসীর নিকট পত্রসহ একজন দূত পাঠান এবং তিনি শ্রদ্ধাভরে পত্র গ্রহণ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস সাদরে ও সসম্মানে মুসলিম দূত দেহিয়াতল-কালবিকে অভ্যর্থনা করেন কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বিনীতভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে অসমর্থতার কথা জানান। অহংকারী অগ্নি-উপাসক পারস্যের রাজ দ্বিতীয় খসরু হযরতের প্রেরিত দূত আবদুল্লাহ ইবন হোজাইফার মারফত একটি পত্র পেয়ে সগর্বে চিৎকার করে বলেন, “একি! যে ব্যক্তি আমার ক্রীতদাস, সেই ব্যক্তি আমাকে পত্র লিখিবার সময় আমার নামের পূর্বে তার নাম লিখিতে সাহসী হয়েছে?” একথা বলে ক্রোধবশে পত্রটি ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। রাসূলুল্লাহ (স) এই সংবাদ শ্রবণ করে মন্তব্য করেন, “আমার পত্রকে যেমন সে ছিঁড়ে ফেলেছে ঠিক তেমনিভাবে মুসলমানগণের হাতে তাদের রাজ্যও ছিন্নবিছিন্ন হবে।” হযরতের এই মহান ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। হাতিব-ইবন-আবি-বালতাকে আলেকজান্দ্রিয়ার রোমক শাসনকর্তা মুকাউকাসের নিকট একটি আমন্ত্রণলিপিসহ প্রেরণ করা হয়। পত্র পাঠ করে তিনি বলেন, “তিনি নিশ্চয়ই সেই পয়গম্বর, যাঁর আগমন সম্বন্ধে হযরত ঈসা (আ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।” ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে মুকাউকাস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারে নি। জিয়াউদ্দীনের মতে, “মুকাউকাসের নিকট লিখিত হযরতের পত্রটি সম্ভবত মুসলিম যুগের সর্বপ্রাচীন আরবী লিখিত লিপি।” বসরার শাসনকর্তা হারিস-বিন-আবি – সামের নিকট ওহাব-আসাদিকে প্রেরণ করা হয়। শত্রুভাবাপন্ন হারিস হযরতকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে রোমক সম্রাটের নিকট সাহায্য চাইলে তিনি তাকে ক্ষান্ত হতে উপদেশ দেন। ইয়ামামার শাসনকর্তা হাওজা-বিন-আলী হযরতের দূতকে সাদরে গ্রহণ করেননি। সিরিয়ার গাচ্ছান বংশীয় খ্রিস্টান রাজা সুহরাবিল মুসলিম দূতকে মুতায় হত্যা করেন। আমীর আলী বলেন, “আন্তর্জাতিক নীতির এরূপ জঘন্য অবমাননা পরবর্তীকালে ইসলামের সাথে খ্রিস্টান জগতের সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দূত প্রেরণ দ্বারা অমুসলমান নৃপতিদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বানে আরবের ভৌগোলিক সীমারেখা বৃদ্ধি পায় এবং আরবের ইসলাম সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করে।”

খাইবারের যুদ্ধ (৬২৮ খ্রি.)

ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাকতায় লিপ্ত ইহুদী সম্প্রদায় মদিনা হতে বিতাড়িত হয়ে সিরিয়া সীমান্তের নিকটবর্তী খাইবার নামক স্থানে বসতি স্থাপন করে। বনু নাজির ও বনু কুরাইজা গোত্রের ইহুদীগণ ইসলামকে ধ্বংস করবার উদ্দেশ্যে মোনাফেক দলের নেতা আবদুল্লাহ-বিন-উবাই এবং বনু গাতাফান ও অন্যান্য বেদুঈন গোত্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র শুরু করে। খন্দকের যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে ইহুদীগণ মুসলিম বাহিনীর উপর প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে বেদুঈন গোতের সহযোগিতায় ৪,০০০ সৈন্যের একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে (৭ম হিজরীর মহররম মাসে) হযরত ইহুদীদের সমূলে ধ্বংস করবার জন্য ২০০ অশ্বারোহীসহ ১,৬০০ মুসলিম যোদ্ধা নিয়ে খাইবারের দিকে যাত্রা করেন। খাইবার এবং বনু খাতাফানদের মধ্যে যাতায়াত রুদ্ধ করে ইহুদীদের অবরোধ করা হয়। আল-নাইম ও কামুস দুর্গ মুসলমানগণ অধিকার করবার পর আল- সুলালীম দুর্গ অবরোধ করা হয়। হযরত আলী (রা) বীরবিক্রমে এই যুদ্ধ করেন বলে হযরত তাকে ‘আসাদউল্লাহ’ (আল্লাহর সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তাঁকে বিখ্যাত ‘জুলফিকার’ তরবারি প্রদান করেন।

দীর্ঘদিন অবরোধের পর খাইবারের ইহুদী সম্প্রদায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। হযরত তাদেরকে ক্ষমা করে নির্বিঘ্নে সেখানে বসবাস করবার অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ইহুদীগণ হযরতকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করে। হারিসের কন্যা জয়নব খাইবারের যুদ্ধে পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রণের জন্য বিষ প্রয়োগে হযরতকে হত্যা করবার প্রচেষ্টা করে। খাদ্যে বিষ প্রয়োগের ফলে হযরতের সাহাবী বিসর-বিন- ব’রা মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু বিষ মিশ্রিত সামান্য খাদ্য মুখে দেওয়ায় সৌভাগ্যক্রমে হযরতের জীবন রক্ষা পায়। বিসরের মৃত্যুর জন্য জয়নবকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, কিন্তু সমগ্র ইহুদীদের উপর কোন প্রকার অত্যাচার করা হয়নি। হযরতের মহানুভবতার এটি একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। কিন্তু তাবারীর মতে, জয়নবকে ক্ষমা করা হয়। আমীর আলী বলেন, “নবীর জীবন রক্ষা পেল কিন্তু বিষের ক্রিয়া তাঁর শরীরে বিস্তৃতি লাভ করায় পরবর্তী জীবনে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং পরিশেষে তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।” ইহুদীদের বিপর্যয়ের পর তাদের বাধ্যতামূলক কর প্রদান করবার ব্যবস্থা করা হয়। দুর্গে প্রাপ্ত মাল-ই-গনিমত বা ধন-সম্পত্তির এক-পঞ্চমাংশ সরকারের জন্য নির্ধারিত করে অবশিষ্ট সৈন্য-সামন্তের মধ্যে বিতরণ করা হয়। প্রদানপূর্বক ইহুদীদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ এবং জান-মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দান করা হয়। ইহুদীদের নাশকতামূলক কার্যকলাপের উল্লেখ করে ওয়াট বলেন, “মদিনায় বসতির প্রথম দিকে একটি দুঃখজনক ঘটনার সূত্রপাত হয়; ইহুদীদের কার্যকলাপে মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ নষ্ট হয়।”

মূলতবী হজ্ব হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তানুযায়ী হযরত মুহাম্মদ (স) ৬২৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ২,০০০ সাহাবী নিয়ে উমরাহ হজ্বব্রত পালনের জন্য মক্কায় যাত্রা করেন এবং তিন দিন অবস্থানের পর মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। মূইরের বর্ণনায়, “মক্কার উপত্যকায় সংঘটিত ইহা (হজ্বব্রত পালন) একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে ইহা সত্যই অসাধারণ দৃশ্য ছিল। মক্কার উচ্চ ও নীচ সমস্ত নাগরিক বাসস্থান ত্যাগ করে তিন দিনের জন্য প্রাচীন শহরের বাইরে চলে যায়। অন্যদিকে স্বদেশত্যাগী নব-দীক্ষিতেরা বহুদিন নির্বাসনে কাটাবার পর দলে দলে জন্মভূমিতে আসিল, শৈশবের বেলাভূমি পরিদর্শন করল এবং নির্ধারিত স্থানে হজ্বব্রত পালন করল।” মক্কাবাসীরা মুসলমানদের ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার অপূর্ব দৃষ্টান্ত দর্শন করে মুগ্ধ হয়ে যায়।

মুতার যুদ্ধ (৬২৯ খ্রি.)

হুদায়বিয়ার সন্ধি (মার্চ, ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) হতে মক্কা বিজয় (জানুয়ারি, ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত সময়ে মুসলমানগণ ১৭টি অভিযান পরিচালনা করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মুতা অভিযান। রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ সিরিয়ার সামন্তরাজ সোহরাবিল-বিন-আমর- গাচ্ছানি হযরতের প্রেরিত দূত হারিস-বিন-উমাইয়াকে মুতায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই বিশ্বাসঘাতকতামূলক হত্যার উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ৩,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী গঠন করে হযরত স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতাহেতু এই বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করা হয় তাঁর দত্তক পুত্র জায়েদ-বিন-হারিসকে। আরব উপজাতি ও বায়জানটাইন সৈন্য দ্বারা গঠিত প্রায় এক লক্ষাধিক বাহিনীর সম্মুখীন হয়ে মুসলমানগণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। তাদের প্রিয় সেনাপতি জায়েদ, জাফর ও আব্দুল্লাহ শহীদ হন। সমূহ বিপর্যয় হতে মুসলিম বাহিনীকে রক্ষা করেন বীরশ্রেষ্ঠ খালিদ বিন-ওয়ালিদ। অসীম বীরত্ব এবং দক্ষতা প্রদর্শন করে খালিদ মুতার যুদ্ধে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। হযরত তাঁর তেজস্বিতা ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘সায়ফুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর তরবারি খেতাবে ভূষিত করেন।

মক্কা বিজয় (৬৩০ খ্রি.)

৬২৪ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত বদরের যুদ্ধ থেকে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয় পর্যন্ত মক্কার আভ্যন্তরীণ অবস্থার অবনতি ঘটে। বদরের যুদ্ধ কুরাইশ গোত্রকে দুটি দলে বিভক্ত করে। আবু জেহেল এবং আবু সুফিয়ান এই দুই গোত্রের নেতৃত্ব দান করেন। আরবের কোন কোন গোত্র আবু জেহেলকে অথবা আবু সুফিয়ানকে স্বীকৃতি দান করে। বদরের যুদ্ধে মখজুম গোত্রের সাফওয়ানের সঙ্গে আবদুস শামস গোত্রের আবু সুফিয়ানের যে বৈরীভাবের উদ্ভব হয় উহুদের যুদ্ধে তা আরও প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। সাফওয়ান গোত্র মনে করত যে, উহুদের প্রান্তরে মুসলমানদের বিপর্যয়ই যথেষ্ট কিন্তু আবু সুফিয়ান এবং আমর-বিন-আল-আসের অভিপ্রায় ছিল মুসলমানদের পশ্চাদ্ধাবন করে মদিনা নগরী অধিকার করা। গোত্র-স্বার্থ ও রাজনৈতিক অনৈক্য বিধর্মীদের শক্তি হ্রাস করে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদনে আবু সুফিয়ানের কোন প্রকার হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় নি। মক্কাবাসীরা সাফওয়ান, সুহাইল এবং আবু জেহেলের পুত্র ইকরামার নেতৃত্বে হযরতকে হজ্ব পালনে বাধা দান করে কিন্তু পরিশেষে সন্ধি করতে বাধ্য হয়। আবু সুফিয়ানের নিষ্ক্রিয়তার মূলে ছিল তাঁর কন্যা উম্মে হাবিবার ইসলাম ধৰ্ম গ্রহণ এবং হযরতের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও প্রভাব। হযরত (স) উম্মে হাবিবাকে পরবর্তীকালে বিবাহ করেন।

হুদায়বিয়ার সন্ধি শুধু উমরা হজ্ব পালনের নিশ্চয়তা দান করে নি, বরং মক্কা বিজয়ের সূচনা করে। বয়োঃবৃদ্ধ এবং ধর্মান্ধ মক্কার পৌত্তলিকগণ পিতৃধর্মকে পরিত্যাগ করতে পারে নি। কিন্তু অপেক্ষাকৃত তরুণ মক্কাবাসীগণ হযরতের সত্য প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। বিশেষ করে খালিদ-বিন-ওয়ালিদ, আমর-বিন-আল- আস ও উসমান-বিন-তালহার ইসলাম গ্রহণ বিধর্মীদের মনে প্রভাব বিস্তার করে।

মক্কা বিজয়ের অপর একটি কারণ ছিল হুদায়বিয়া সন্ধি-চুক্তির অবমাননা। হযরতের সঙ্গে মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ গোত্র বনু খোজার প্রতি কুরাইশদের আনুগত বনু বকরের নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচার মক্কা অভিযান এবং বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। বনু বকর গোত্রের একজন কবি ব্যঙ্গাত্বক কবিতা রচনা করে হযরতের অবমাননা করলে বনু খোজার লোকেরা তাকে হত্যা করে। এর ফলে নওফল-বিন-মুয়াবিয়া গোপনে কুরাইশদের সাহায্যে বনু খোজাকে আক্রমণ করে। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে স্বাক্ষরকারী সাফওয়ান, সুহাইল ও ইকরামা প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্যভাবে বনু বকরকে সহায়তা করলে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ হয়। হযরত এতে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে সন্ধির শর্তানুযায়ী বনু খোজাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।

যুদ্ধ এড়াইবার জন্য হযরত কুরাইশদের নিকট তিনটি প্রস্তাব সম্বলিত একটি পত্রসহ শান্তিদূত প্রেরণ করেন। প্রস্তাবগুলো ছিল : (১) অন্যায়ভাবে নিহত বনু খোজা গোত্রের লোকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; অথবা, (২) বনু বকর সম্প্রদায়কে সকল প্রকার সাহায্য প্রদানে বিরত থাকতে হবে; অথবা, (৩) হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলী বাতিল ঘোষিত হবে। হযরতের দূত মক্কা হতে মদিনা ফিরে জানালেন যে, কুরাইশগণ তৃতীয় প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে। এতে হযরত (স) তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত মক্কা অভিযানের সমস্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ইত্যবসরে মক্কাবাসীদের বিভেদ ও বৈষম্যের কথা উপলব্ধি করে আবু সুফিয়ান স্বয়ং মদিনায় গমন করে শান্তি প্রস্তাব করলে হযরত তাহা প্রত্যাখ্যান করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় মুসলমানগণ ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জানুয়ারি (১০ই রমজান, অষ্টম হিজরী) হযরতের সুযোগ্য নেতৃত্বে মক্কা অভিযান করেন।

হযরত মুহাম্মদ (স) উপলব্ধি করেন, মদিনায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলেও মক্কা বিজয় ব্যতীত আরবে ইসলাম সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হবে না। আবু সুফিয়ানের মত ইসলামের চরম শত্রুও সুদূর মদিনা গমন করে হযরতের নিকট কাকুতি-মিনতি করে তাঁর দয়া ও করুণা প্রার্থনা করেন। ইহা হতেই প্রমাণিত হয় যে, বিধর্মী কুরাইশ গোত্রের ক্ষমতা ও প্রভাব বিলুপ্তির পথে। মহানুভব হযরত আবু সুফিয়ানকে আত্মসমর্পণের পর ক্ষমা করেন এবং তাঁর ইচ্ছায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন।

দীর্ঘ আট বৎসর পর (৬২২-৩০) হযরত তাঁর প্রিয় জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করেন। আবু সুফিয়ান তাঁকে মক্কায় স্বাগত অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। সাফওয়ান, ইকরামা এবং সুহাইল একত্র হয়ে মখজুম গোত্রের লোকজনসহ হযরতকে বাধা প্রদানে অগ্রসর হয়। পথিমধ্যে হযরত আব্বাস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মক্কায় গমন করেন এবং কুরাইশগণের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেন, “অবরুদ্ধ মক্কা নগরীর দক্ষিণাংশে খালিদ, উত্তরাংশে জুবাইর এবং আল্লাহর রাসূল স্বয়ং আনসার-মোহাজেরিন ও বনু খোজা গোত্রের দ্বারা গঠিত সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করছেন।” আবু সুফিয়ানও আত্মসমর্পণের জন্য কুরাইশদের উদ্বুদ্ধ করেন। মুসলমানগণ যখন কা’বা ঘরে প্রবেশ করতে থাকে তখন ইকরামার নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক কুরাইশ বিক্ষিপ্তভাবে মক্কার দক্ষিণ ফটকে বাধা দান করে, কিন্তু খালিদ বীরবিক্রমে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত করেন। এই সংঘর্ষে ২৩ অথবা ২৪ জন কুরাইশ নিহত হয় এবং মুসলমানদের পক্ষে বনু খোজা গোত্রের দুই ব্যক্তি প্রাণ হারায়। সুতরাং বলা যায় যে, মুসলমানগণ বিনা রক্তপাতে এবং বিনা বাধায় মক্কা জয় করেন।

প্রিয় মাতৃভূমি হতে নির্বাসিত হযরত মুহাম্মদ (স) দীর্ঘ আট বৎসর পর মক্কা নগরীতে বিজয়ীর বেশে প্রত্যাবর্তন করেন। হিট্টি মক্কা বিজয়কে “প্রাচীন ইতিহাসে একটি তুলনাবিহীন মহাবিজয়” বলে অভিহিত করেন। সীজার, আলেকজান্ডার ও নেপোলিয়নের দেশজয় নিরীহ জনসাধারণের রক্তপাতের ইতিহাস, কিন্তু হযরত নির্বিঘ্নে বিনা প্রতিবন্ধকতায় মদিনা হতে অভিযান করে মক্কা বিজয় করেন। বিনা রক্তপাতে কোন দেশ জয় হয়নি, কেবল মক্কা জয়ই একমাত্র ব্যতিক্রম বলে মনে করা হয়। মক্কা বিজয় সমগ্র আরব দেশ বিজয়ের সমতুল্য ছিল।

মক্কা বিজয় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মহানুভবতার একটি অবিস্মরণীয় ও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। দীর্ঘ তের বৎসর কুরাইশগণ হযরত ও তাঁর অনুসারিগণের উপর নৃশংস অত্যাচার ও নির্যাতন করে। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর হযরত তাদের প্রতি কোন প্রকার প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নাই। আমীর আলী বলেন, “বিজয়ের মুহূর্তে মহানবী (স) অতীতের যন্ত্রণা-দুর্ভোগের কথা ভুলে গেলেন, সমস্ত আঘাত-নির্যাতন ক্ষমা করলেন এবং মক্কাবাসীদের প্রতি সাধারণ সর্বজনীন ক্ষমা ঘোষণা করেন।” কেবল চারিজন দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া মুসলিম সৈন্যবাহিনী কোন প্রকার লুঠতরাজে নিয়োজিত ছিল না, কোন গৃহ লুণ্ঠিত হয়নি, কোন মহিলার শালীনতাহানি করা হয়নি, বিধর্মীদের ইসলাম গ্রহণে প্রভাবান্বিত করা হয়নি, প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থায় কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করা হয়নি। হযরতের প্রতিনিধি আত্তার- বিন-আসিদের তত্ত্বাবধানের কুরাইশগণ মক্কায় শাসনকার্য নির্বাহ করতে লাগল। এমনকি পলাতক বিধর্মী ইকরামা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করে। মূইর বলেন, “যে মক্কাবাসীরা এতদিন যাবৎ হযরত মুহাম্মদ (স)-কে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে সেই মক্কাবাসীদের প্রতি তাঁর মহানুভবতা সত্যই প্ৰশংসনীয়।”

মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে মক্কা বিজয় দ্বারা ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার বীজ নিহিত ছিল। এছাড়া হযরত উপলব্ধি করেন যে, নব- প্রতিষ্ঠিত ধর্মের শক্তি বৃদ্ধি করতে হলে মক্কার সামরিক শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে এবং মক্কা আয়ত্তে আসলে বহির্বিশ্বেও তাঁর ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। মক্কা বিজয় আরব দেশের একীকরণে সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়। উদারতা, মহানুভবতা ও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা হযরত বিধর্মী কুরাইশদের মন জয় করতে চাহেন। মক্কায় প্রবেশ করে পবিত্র হেরেম শরীফে গমন করে হযরত সাত বার কা’বাগৃহ তাওয়াফ করেন এবং সেখানে রক্ষিত ৩৬০টি দেব-দেবীর মূর্তি ধ্বংস করবার আদেশ দেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, হযরত একখানি ষষ্টি নিয়ে দেবমূর্তিগুলোর সম্মুখে গেলেন এবং সেই ষষ্টিত অগ্রভাগের আঘাতে মূর্তিগুলো ভূপাতিত হতে লাগল। সেই সময় হযরত “সত্য উপস্থিত হয়েছে, অসত্য লোপ পেয়েছে, নিশ্চয়ই অসত্য লুপ্ত হবে–”[১] এই আয়াত পড়েতে লাগলেন। হযরত আব্বাস (রা) বলেন, “যেদিন হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কা জয় করেন, সেই দিন তিনি ৩৬০টি দেব-মূর্তি ধ্বংস করেন। আরববাসিগণ ঐ সকল দেব-মূর্তির পূজা করত এবং তাদের নিকট বলি দিত।” দেব-মূর্তি ছাড়া কা’বাগৃহের দেয়ালে অঙ্কিত ম্যাডোনার প্রতিকৃতি ছাড়া বিভিন্ন ছবিও মুছে ফেলা হয়।”[২] পবিত্র কা’বা শরীফ হতে পৌত্তলিকতার সর্বশেষ চিহ্নগুলো দূরীভূত হলে আল্লাহর একত্ববাদের নীতি সুদৃঢ়রূপে হেরেম শরীফ তথা মক্কা ও আরব দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর গৃহে হযরত সাহাবীদিগকে নিয়ে নামাজ পড়ে ইসলামের বিজয় ঘোষণা করেন। মক্কায় অবস্থানকালে হযরত দুইজন সেনাধ্যক্ষকে নাখলায় উজ্জা দেবীর মূর্তি এবং হুদাইল গোত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শুয়াকে ধ্বংস করবার আদেশ প্রদান করেন। ফলে, সমগ্র আরব দেশে বিশেষ কয়েকটি স্থান ব্যতীত মিথ্যার উপর সত্যের, অধর্মের উপর ধর্মের অন্যায়ের উপর ন্যায়ের, অন্ধকারের উপর আলোকের বিজয় ঘোষিত হয়।

[১. কুরআন শরীফ, ১৭ : ৮১-৮৩।

২. ইমামুদ্দীন মাতা মেরীর প্রতিকৃতি অবলুপ্তির কথা বলেন (মুসলমানদের রাজনৈতিক ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৭৪), কিন্তু থমাস আরনল্ডের মতে, যীশুকে ক্রোড়ে নিয়ে মাতা মেরীর ছবি হযরত শ্রদ্ধাভরে মুছতে নিষেধ করেন। (ইসলামের চিত্রশিল্প, পৃষ্ঠা ৭)]

মক্কা বিজয়ের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ আরব গোত্রের বেদুঈনগণ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ধর্মীয় অপেক্ষা রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগের জন্যই বেদুঈনগণ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। নিকলসন বলেন, “পবিত্র নগরীর আত্মসমর্পণে আরব দেশে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অপর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না। তাঁর কার্য সমাধা হল। বিভিন্ন বেদুঈন গোত্রের প্রতিনিধিগণ কুরাইশদের বিজেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করল এবং কেবল শত্রুপক্ষকে লুঠতরাজ করবার অভিপ্রায়েই নিষ্পৃহভাবেই ইসলামের প্রতি আস্থাভাজন হল।” এই কথার সমর্থনে জোসেফ হেল মন্তব্য করেন, “এরূপে হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর বহু বিলম্বিত আকাঙ্ক্ষার চরম সীমায় উপনীত হন।” মক্কা বিজয় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সহৃদয় উদারতা, রাজনৈতিক সূক্ষ্ম- দৃষ্টি, প্রশাসনিক দক্ষতা, কূটনৈতিক প্রজ্ঞার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এবং এর ফলেই তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি পায়। মক্কা বিজয় ইসলামের আন্তর্জাতিকীকরণে সহায়তা করে।

হুনাইনের যুদ্ধ (৬৩০ খ্রি.)

মক্কা বিজয়ের ফলে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটে। কিন্তু মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী অঞ্চলে হাওয়াজিন ও সফীক গোত্রদ্বয় ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পৌত্তলিকতার কেন্দ্র কা’বা মুসলমানদের আওতাভুক্ত হলে এই বিধর্মী গোষ্ঠী তৌহিদবাদকে উচ্ছেদ করে মূর্তিপূজা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এবং পবিত্র আল্লাহর গৃহ পুনর্দখলের চেষ্টা করে। বেদুঈনদের সহযোগিতায় এই দুই গোত্র মক্কার তিন মাইল দূরবর্তী হুনাইন উপত্যকায় ২০,০০০ সৈন্য সমাবেশ করে। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি (৮ম হিজরীর ৬ই শওয়াল) মুসলমান ও কুরাইশদের একটি সম্মিলিত বাহিনী মক্কা ত্যাগ করে। মক্কায় অবস্থানের তিন সপ্তাহের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে এই বিশাল শত্রুর সম্মুখীন হতে হয় এবং বীরশ্রেষ্ঠ খালিদের নেতৃত্বে ১২,০০০ মুসলিম সৈন্য হুনাইনের প্রান্তরে শত্রুর মোকাবিলা করে। শত্রুপক্ষের লোকেরা মহিলা, শিশুসন্তান ও পশুসহ যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়। মুসলমান সৈন্যগণ যখন সংকীর্ণ পার্বত্যপথ অতিক্রম করেছিল তখন পার্বত্য গুহায় লুক্কায়িত বেদুঈনগণ সহসা অবিশ্রান্ত সুতীক্ষ্ণ শর বর্ষণ করতে থাকে। এতে দিশাহারা হয়ে মুসলমানগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করতে থাকে। কিন্তু হযরত (স) সেই ভীষণ বিপজ্জনক মুহূর্তেও বিচলিত না হয়ে মুসলমান সৈন্যদিগকে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসতে আহ্বান করতে থাকেন। তাঁর আহ্বানে মুসলমান সৈন্যগণ যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসে এবং বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করে শত্রুদিগকে পরাজিত করে। এই যুদ্ধে প্রায় ৬,০০০ শত্রুসৈন্য বন্দী হয় এবং ২৪,০০০ ভেড়া, ২৮,০০০ উষ্ট্র, ৪১,০০০ তোলা রূপা এবং অন্যান্য সমর উপকরণ মুসলমানদের হস্তগত হয়। মাত্র চারি অথবা পাঁচজন মুসলমান সৈন্য হুনাইনের যুদ্ধে নিহত হন।

তায়েফ বিজয় (৬৩০ খ্রি.)

হুনাইনের যুদ্ধে পরাজিত বিধর্মীরা তায়েফ দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। হযরত মুহাম্মদ (স) আবু মুসার অধিনায়কত্বে একটি বিশাল মুসলিম বাহিনী তায়েফে প্রেরণ করেন। যে তায়েফবাসী একদিন মহানবী (স)-কে প্রস্তর দ্বারা আঘাত করেছিল, মুসলিম বাহিনীর আক্রমণে তারা ভীত ও জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে এবং মদিনার শাসনাধীনে হযরতের আনুগত্য স্বীকার করে ও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়।

হুনাইন ও তায়েফ বিজয়ের গুরুত্ব

মক্কা বিজয়ে ইসলামের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও বিধর্মী বেদুঈন গোত্র হাওয়াজিন পৌত্তলিকতা এবং মক্কায় বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠার জন্য হযরতের বিরোধিতা করে। বনু সফীক ও বনু হাওয়াজিন গোত্রের পরাজয়ে অপর কোন আরব গোত্র ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে সাহসী হয় নি। পক্ষান্তরে, হযরতের বশ্যতা ও আনুগত্য স্বীকারে তারা ব্যগ্র হয়ে উঠে। বিরোধিতার অবসানে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মদিনা একটি আন্তর্জাতিক নগরীতে পরিণত হয়।

তাবুক অভিযান (৬৩০ খ্রি.)

আরবের ইহুদীগণ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর হস্তে কয়েকবার পরাজয় বরণ করে সিরিয়ার সংলগ্ন খাবার অঞ্চলে নাশকতামূলক কার্যে লিপ্ত হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর হযরত বায়জানটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবারে দূত পাঠাইলে তাকে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর হুনাইন ও তায়েফে ইসলামের বিজয়ে হিরাক্লিয়াস ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তদুপরি মুতার যুদ্ধে খ্রিস্টানদের পরাজয় এবং ইহুদীদের প্ররোচনা তাঁকে উত্তেজিত করে তোলে। গাস্সানীদের সহযোগিতায় ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে লক্ষাধিক সৈন্যসহ বায়জানটাইন-বাহিনী মদিনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (স) এই সংবাদ পেয়ে সিরিয়া গমনের বাণিজ্যিক পথটিকে নিরাপদ রাখবার জন্য সিরিয়া সীমান্তস্থিত তাবুক নামক স্থানে শত্রুপক্ষের গতিরোধ করেন। মুসলিম বাহিনীতে ১০,০০০ অশ্বারোহী এবং ৩০,০০০ পদাতিক সৈন্য ছিল। এই যুদ্ধে হযরত আবুবকর (রা) তাঁর সমস্ত সম্পত্তি, হযরত ওমর (রা) তাঁর অর্ধেক সম্পত্তি এবং হযরত ওসমান (রা) ১,০০০ স্বর্ণমুদ্রা, ১,০০০ উষ্ট্র এবং ৭০টি অশ্ব যুদ্ধ তহবিলে দান করেন। বিশেষ কোন যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রয়োজন হয় নি; কারণ, মুসলমানদের যুদ্ধে জয়লাভ অবশ্যম্ভাবী মনে করে বায়জানটাইন বাহিনী সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ না হয়ে পলায়ন করে। মহানবী ২০ দিন তাবুক অবস্থান করে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। কথিত আছে যে, হযরত (স) জীবনে ছোট-বড় সর্বমোট ২৭টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে তাবুক ছাড়া আরও আটটি যুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তাবুকই ছিল মহানবীর জীবনে সর্বশেষ অভিযান। এ যুদ্ধে অশেষ কষ্ট ভোগ করতে হয় বলে এর অপর নাম “গাজওয়াতুল ওসরাৎ” অর্থাৎ কষ্টের যুদ্ধ। এর অর্থ এই যে, মুসলমান সৈন্যবাহিনী তাবুকে গমনকালে পথিমধ্যে সূর্যের প্রচণ্ড কিরণ ও প্রখর তাপে এবং পানির অভাবে ভয়ানক কষ্ট পায়।

প্রতিনিধি প্রেরণের বৎসর (৬৩০-৬৩১ খ্রি.)

নবম হিজরী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনে এবং বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইবন-ই-হিশাম বলেন যে, এই বৎসর হযরত অসংখ্য প্রতিনিধিকে (ইসলাম ধর্ম গ্রহণের উদ্দেশ্যে) সাদরে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন বলে উক্ত বৎসরকে প্রতিনিধি প্রেরণের বৎসর বা “সানাত-আল-উফুদ” বলা হয়। ওমান, হাজরামাউত, নাজরান, মাহরাহ, বাহরাইন প্রভৃতি যে সমস্ত অঞ্চলে কোন প্রকার অভিযান প্রেরণ করা হয় নি সেই সমস্ত অঞ্চল হতে প্রতিনিধি মদিনায় প্রেরণ করা হয়। মক্কা বিজয়ের অব্যবহিত পরে হযরতের আমন্ত্রণক্রমে এই সমস্ত প্রতিনিধিরা ইসলামের প্রতি একনিষ্ঠ বিশ্বাস স্থাপন করে। ইয়েমেনের অনেক গোত্রও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়।

মাহরাহ এবং ইয়েমেনের খ্রিস্টানগণ ইসলামের তৌহিদে দীক্ষিত হয়। খ্রিস্টান গো বনু হানিফা, বনু তাঘলিব, বনু হারিস, বনু কিন্দা হযরতের নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করে বাৎসরিক কর প্রদানের অঙ্গীকার করে।

তাবুক হতে বায়জানটাইন বাহিনীর পলায়নের পর আইলাহ্-এর খ্রিস্টান শাসনকর্তা এবং মানী আজরুহ্ ও জারবা মরূদ্যানের ইহুদী সম্প্রদায় মুসলমানদের সঙ্গে সন্ধি করে। এই অঞ্চলের খ্রিস্টান ও ইহুদী সম্প্রদায় মুসলমানদের নিকট হতে নিরাপত্তা লাভ করে বাৎসরিক নির্দিষ্ট হারে কর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দান করে। পরবর্তীকালে উক্ত করই ‘জিজিয়া’ নামে পরিচিত হয়।

কুরাইশদের মিত্র বনু আসাদ ছাড়া বনু কা’বও হযরতের নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। ইয়েমেনের বাজিলা গোত্রের নিজস্ব কা’বা ‘জুল খালাসা’ মন্দির ছিল। দশম হিজরীতে হযরতের নিকট তারা প্রতিনিধি প্রেরণ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং তথাকথিত কা’বা ভেঙ্গে ফেলে। এরূপে গোত্রের পর গোত্র হযরতের নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করে পৌত্তলিকতার স্থলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। প্রত্যেক গোত্রকে একখানি লিখিত সন্ধিপত্র প্রদান করা হয় এবং ইসলামের আদর্শ শিক্ষা প্রদানের জন্য একজন করে ধর্মশিক্ষক নিযুক্ত করা হয়।

ইবন-ইসহাক বলেন, “বিভিন্ন গোত্র হতে প্রেরিত প্রতিনিধিদের প্রতি নবীর সৌজন্যসূচক ব্যবহার, তাদের অভিযোগের প্রতি সজাগ দৃষ্টি, তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করবার মত মেধা সমগ্র উপদ্বীপে তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। তিনি মহান, সদাশয় ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরূপে খ্যাতি অর্জন করেন।” প্রতিনিধি প্রেরণের বৎসর ইসলামের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য যে, ইহা কেবল ইসলাম প্রচারেই সহায়তা করে নি, বরং এটি সমগ্র আরব জাতিকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিতে সুসংবদ্ধ করে শক্তিশালী বায়জানটাইন ও পারশ্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করবার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ দান করে। হিট্টি বলেন, “দৃঢ় বিশ্বাস নহে, বরং সুযোগ-সুবিধার জন্য গোত্রগুলো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে; ইসলাম ধর্ম কেবল মৌখিক স্বীকৃতি এবং যাকাত দানেই সন্তুষ্ট ছিল।” এই কথা সত্য যে, পৌত্তলিকতা একটি উন্নত ধরনের ধর্মবিশ্বাস এবং নৈতিক আদর্শে পরিণত হতে পারে নি। আরব বেদুঈনগণ ইসলামের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনপ্রণালী, কঠোর নৈতিক আদর্শ এবং সূক্ষ্ম ধর্মীয় অনুভূতি সাময়িকভাবে গ্রহণ করে; কারণ, হযরত আবুবকর (রা)-এর খিলাফতের সময় আরব গোত্রগুলো ইসলাম বর্জন করে ধর্মদ্রোহিতা শুরু করে।

বিদায় হজ্ব (৬৩২ খ্রি.)

বিভিন্ন গোত্রের নিকট হতে মদিনায় দলে দলে প্রতিনিধি আসতে আরম্ভ করলে হযরত মুহাম্মদ (স) বুঝতে পারেন যে, তাঁর জীবনের মহান কর্তব্য শেষ হয়েছে ও তাঁর জীবন-প্রদীপ ফুরাইয়া আসতেছে। তাই শেষ হজ্বব্রত বা ‘হাজ্বাতুল বিদা’ (বিদায় হজ্ব) পালনের উদ্দেশ্যে ২৫ শে জিলক্বাদ, ১০ম হিজরী অর্থাৎ ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অগণিত সাহাবী সমভিব্যাহারে মক্কার পথে রওয়ানা হন। উল্লেখযোগ্য যে, ৬৩১ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে সূরা বারাত নাজিল হবার পর হযরত আরবের সকল গোত্রকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য ৪ মাস সময় প্রদান করেন এবং বলেন যে, এই সময় অতিবাহিত হবার পর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন প্রকার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না। এর ফলে পর বৎসর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হযরত হজ্ব উপলক্ষে ১,১৪,০০০ জন মুসলমানসহ মক্কায় গমন করতে সক্ষম হন। বিদায় হজ্ব পালনে হযরত তাঁর সকল সহধর্মিণীকে সঙ্গে নিয়ে যান। কুরবানীর জন্য তাঁর সাথে ১০০টি উষ্ট্র ছিল।

যাত্রার দশ দিন পর হযরত মক্কার ছয় মাইল অদূরে দুল হুলায়ফা নামক স্থানে পৌঁছান এবং সেখানে সাহাবিগণসহ হজ্বের পোশাক পরিধান করে একাদশ দিনে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন। কা’বা গৃহের চতুর্দিকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে হযরত মোকামে ইব্রাহিম নামক স্থানে নামাজ আদায় করেন এবং সাফা ও মারওয়া পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে সাতবার দৌড়িয়েছিলেন। জিলহজ্ব মাসের অষ্টম দিনে তিনি প্রথমে মীনা ও নবম দিনে নামিরাহ-আরাফাত ময়দানে উপস্থিত হন। হজ্ব সম্পন্ন করে তিনি আরাফাতের পর্বতশিখরে (জবল রূহমা) দাঁড়িয়ে উপস্থিত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে একটি অবিস্মরণীয় অভিভাষন প্রদান করেন। তাঁর এই শেষ উপদেশবাণী মুসলমানদের হৃদয়ে সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

হযরত মুহাম্মদ (স) আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সমবেত জনসমুদ্রের উদ্দেশ্যে বলেন, “হে মুসলমানগণ, মনোযোগ সহকারে আমার বাণী শ্রবণ কর; কারণ, পুনরায় তোমাদের সাথে মিলিত হবার সুযোগ আল্লাহ আমাকে নাও দিতে পারেন। এই দিন ও এই মাস সকলের জন্য যেরূপ পবিত্র সেরূপ তোমাদের জীবন ও সম্পত্তি মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের পূর্ব পর্যন্ত পরস্পরের নিকট পবিত্র এবং হস্তক্ষেপের অনুপযুক্ত।”

“স্মরণ রাখিও, একদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে দুনিয়ায় তোমাদের প্রত্যেকটি কাজের জন্য আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে।”

“হে ভক্তগণ, তোমাদের সহধর্মিণীদের উপর তোমাদের যেইরূপ অধিকার আছে, তোমাদের উপরও তাদের অধিকার তদ্রূপ। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ এবং তাঁরাই আদেশমত তাদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছে। তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে।”

“সর্বদা অন্যের আমানত হেফাজত করবে এবং পাপ কার্য এড়াইয়া চলবে।” “সুদ-খাওয়া নিষিদ্ধ; খাতকের নিকট হইতে কেবল আসলই ফেরত নিবে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব জাতির ‘রক্তের বদলে রক্ত’ নীতি এখন হতে নিষিদ্ধ হল।”

“দাসদাসীদিগের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করবে। তোমরা যা আহার কর, যে বস্ত্ৰ পরিধান কর, তাদেরকেও অনুরূপ খাদ্য ও বস্ত্র প্রদান করবে। তারা যদি ক্ষমার অযোগ্য কোন ব্যবহার করে, তা হলেও তাদেরকে মুক্তিদান করবে। স্মরণ রাখিও, তারাও আল্লাহর সৃষ্ট এবং তোমাদের মত মানুষ।”

“তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কাকেও অংশীদার করবে না, পরস্বাপহরণ ও অন্যায়ভাবে নরহত্যা করবে না এবং কখনও ব্যভিচারে লিপ্ত হবে না।”

“হে মনুষ্যগণ, আমার বাণী মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করতে চেষ্টা কর। স্মরণ রাখিও, সমস্ত মুসলমান পরস্পরের ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। সমগ্র দুনিয়ার সমুদয় মুসলিম একই অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ। অনুমতি ব্যতীত কেহ কাহারও কোন কিছু জোর করে কেড়ে নিতে পারবে না।”

“স্মরণ রাখিও, বাসভূমি ও বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমান সমপর্যায়ভুক্ত। আজ হতে বংশগত কৌলীন্য প্রথা বিলুপ্ত হল। সে-ই তোমাদের মধ্যে সবচাইতে কুলীন; যে স্বীয় কার্যের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে আগ্রহী।”

“পথ প্রদর্শক হিসেবে তোমাদের জন্য আল্লাহর কালাম (কুরআন শরীফ) ও তাঁর প্রেরিত সত্যের বাহক রাসূলে করিমের চরিত্রাদর্শ (হাদিস) রেখে যাচ্ছিল। যতদিন তোমরা এদের অনুশাসন মেনে চলবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।”

“হে আমার উম্মতগণ, যারা এখানে সমবেত হয়েছে তারা অনুপস্থিত মুসলমানগণের নিকট আমার উপদেশ পৌঁছিয়ে দিবে। যারা অনুপস্থিত তাদেরকে আমার উপদেশের কথা বলবে। উপস্থিত ব্যক্তিগণের চেয়ে তারাই অধিক স্মরণ রাখতে সক্ষম হবে।”

নবী করিম (স) বাণী প্রদানের পর ঊর্ধ্বে হাত তুলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললেন, “হে প্রভু, আমি কি তোমার বাণী সঠিকভাবে জনগণের নিকট পৌছাইতে পেরেছি?” উপস্থিত উম্মতগণ গগনভেদী আওয়াজ করে বলল, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পেরেছেন।” সেই সময় তিনি আল্লাহর নিকট হতে ওহী লাভ করলেন।

“হে মুহম্মদ। আজ আমি তোমার ধর্মকে সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমার উপর আমার নিয়ামতও পূর্ণ করলাম এবং ইসলাম তোমার ধর্মরূপে কায়েম করলাম।” (সূরা মায়দা)

পরিশেষে হযরত আবেগভরা কণ্ঠে আবার সমবেত জনগণকে লক্ষ্য করে বললেন, “তোমরা সাক্ষী, আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। বিদায়! আল-বিদা!”

সাম্য, মৈত্রী, প্রেম, প্রীতি, সত্য, ন্যায়-এর সাধক ও বাহক হযরত মুহাম্মদ (স)-ই একমাত্র নবী যাঁহার জীবদ্দশায় স্বীয় মহান কর্তব্য ও কৃতিত্ব পরিপূর্ণতা লাভ করে; অন্য কোন মহাপুরুষের ক্ষেত্রে এইরূপ ঘটে নাই। তাই তিনি ‘মহানবী’ নামে আখ্যায়িত।

হযরতের ওফাত (৮ই জুন, ৬৩২ খ্রি.)

সাহাবীদের সঙ্গে হজ্ব সমাপনান্তে হযরত মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করে তিনি নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। মদিনায় প্রত্যাবর্তনের পর হযরত (স) অসুস্থ হয়ে পড়েন। হযরতের অসুস্থতার সুযোগ গ্রহণ করে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে তোলায়হা, মুসায়লামা প্রমুখ ভণ্ড নবীর আবির্ভাব ঘটে। ক্রমে ক্রমে হযরতের শিরঃপীড়া বাড়তে থাকে, স্বাস্থ্যহানি ঘটে। একদা মধ্যরাত্রে তিনি “জান্নাতুল বাকী” নামক সামধিক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে তাঁর মৃত সাহাবীদের জন্য পারলৌকিক শান্তি কামনা করেন। পিতৃব্য আবুল আব্বাসের পুত্র ফজল এবং আবু তালেবের পুত্র আলীর স্কন্ধে ভর দিয়ে তিনি শেষবারের মত মসজিদে উপস্থিত হন। নামাজ আদায় করে তিনি সমবেত মুসল্লিগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হে মুসলমানগণ! যদি আমি তোমাদের কারও প্রতি অন্যায় আচরণ করে থাকি, তা হলে এখন তার জবাবদিহি করতে রাজি আছি। যদি আমি তোমাদের কারও নিকট ঋণ গ্রহণ করে থাকি তা হলে আমার সম্পদ হতে সে যেন তা নিয়ে নেয়।” তিনি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন। অবশেষে ৬৩ বৎসর বয়সে ১১ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল (৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই জুন) সোমবার দ্বিপ্রহরে মসজিদে নওয়াবীর হুজরায় হযরত বিবি আয়েশার জন্য নির্দিষ্ট গৃহে তাঁর ওফাত হয় এবং সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চরিত্র

আল্লাহ প্রেরিত পুরুষের মধ্যে প্রথম ছিলেন হযরত আদম (আ) এবং সর্বশেষ হলেন হযরত মুহাম্মদ (স) (খাতাম-আন-নাবীয়ীন)। এই কারণে তাঁকে নবুয়তের সীলমোহরও (Seal of the Prophets) বলা হয়। তিনি কেবল সর্বশেষই নহেন, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ছিলেন একথা ঐতিহাসিকগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন। প্রখ্যাত ইউরোপীয় চিন্তাবিদ কার্লাইল, ঐতিহাসিক গীবন, এইচ. জি. ওয়েল্স রাসূলুল্লাহর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গেছেন।, যদিও মুইর তাঁর কুৎসা রটনা করতে দ্বিধা করেননি। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, “আমি তোমার জন্য তোমার ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেছি এবং তোমার উপর আশীর্বাদ বর্ষণ করেছি।” (৫ : ৩) পৃথিবীর খুব স্বল্পসংখ্যক নবীই তাঁদের জীবদ্দশায় তাঁদের জীবনের সাফল্য দেখবার সুযোগ পেয়েছেন এবং এক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মদ (স) নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান ছিলেন।

আল্লাহর একত্ববাদে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রগাঢ় ও অবিচল বিশ্বাস তাঁর ধর্ম প্রচারে অসাধারণ ধৈর্য ও নিষ্ঠা আত্মপ্রকাশ করেছে। দিকভ্রান্ত মানুষের পথনির্দেশের জন্যই তাঁর আবির্ভাব-এই কারণেই তাঁকে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে অনবরত সংগ্রাম করতে হয়েছে। পাপের পরিবর্তে পুণ্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিজের জীবনের সমস্ত আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করেন-কুরাইশদের অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেন, জন্মভূমি ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেন। একবার তিনি তাঁর পিতৃব্যকে বলেন, “এরা (কুরাইশগণ) যদি আমার দক্ষিণ হস্তে সূর্য এবং বাম হস্তে চন্দ্র এনে দেয় তা হলেও আমি মহাসত্যের সেবা ও নিজের কর্তব্য হতে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত হবে না।” জনৈক ঐতিহাসিক বলেন, “পৃথিবীর মধ্যে যদি কোন মানুষ আল্লাহকে দেখে থাকেন, বুঝে থাকেন ও প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর কোন উপকার করে থাকেন, তবে এটি নিশ্চিত যে, তিনি হচ্ছেন আরবের ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (স)।” অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাসূল (স)-কে যথার্থই ত্রাণকর্তা বলা যেতে পারে; কারণ, তিনি আলোকবর্তিকা হস্তে কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরববাসীদেরকে ন্যায়, সত্য, ঈমান ও শৃঙ্খলার সূত্রে গ্রথিত করেন। সর্বগুণে গুণান্বিত রাসূলকে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং বলেন, “হে মুহাম্মদ! নিশ্চয় তুমি অনুপম চরিত্রের অধিকারী।”

বাল্যকাল হতে রাসূলের প্রতি কুরাইশদের আস্থা ছিল নতুবা তাঁকে ‘আল-আমিন’ অথবা ‘বিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত করা হত না। তাঁর মন ছিল খুবই সংবেদনশীল। নম্রতা, বিনয়, সত্যবাদিতা ও সৎস্বভাব ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কর্তব্যনিষ্ঠা, চারিত্রিক নির্মলতা, পবিত্রতা, সত্যের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। তাঁর সংবেদনশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায় ‘হিলফ-উল-ফুজুল’ অর্থাৎ শান্তি কমিটি গঠনে। হাব-আল-ফুজ্জার অর্থাৎ ‘অন্যায় সমর’ বন্ধের জন্য তিনি ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে এই কমিটি গঠন করেন। তিনি জীবনে কখনই অসত্য, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় গ্রহণ করেন নাই। তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ছিলেন তৎপর। তাঁর অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ফলে তিনি একজন দূরদর্শী কূটনীতিবিদ, দক্ষ সেনাপতি, স্নেহবৎসল পিতা, প্রেমময় স্বামী, সফল ব্যবসায়ী এবং মহান সংস্কারকের যোগ্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন।

হযরত মুহাম্মদ (স) আর্তের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। তাঁর বদান্যতার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। বিপদে ধৈর্য, দয়া-দাক্ষিণ্য, অনুকম্পা তাঁর চরিত্রের ভূষণ ছিল। তিনি বলতেন, “আমি শান্তি প্রদানের জন্য আবির্ভূত হইনি, শান্তি-দূত হিসেবে এসেছি।” তাঁকে মনুষ্য সমাজের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ মনে করা হয়। তিনি ছিলেন নম্ৰ ও মিষ্টভাষী। তিনি কাকেও আঘাত দিয়ে কখনও কথা বলেন নি। দাস-দাসীদের প্রতিও তিনি সদয় ব্যবহার করতেন। তাঁর গোলাম আনাস বলেন, “আমি দশ বৎসর নবী করিমের গোলামী করেছি, কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি কখনও আমার প্রতি বিরক্তিসূচক ‘উহ্’ শব্দটিও উচ্চারণ করেন নি।” জোসেফ হেলের মতে, “হযরত মুহাম্মদ (স) এমনই একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন যাঁকে না হলে বিশ্ব অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তিনি নিজেই নিজের তুলনা তাঁর কৃতিত্বময় ইতিহাস মানব জাতির ইতিহাসে এক সমুজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে।“

রাসূলে করিম (স) ছিলেন ক্ষমতার মূর্ত প্রতীক। স্বীয় ঘাতককে তিনি ক্ষমা প্রদর্শনে দ্বিধা করেন নাই। মক্কা ও তায়েফ বিজয়ের সময় তিনি যে ক্ষমার আদর্শ প্রদর্শন করেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয় করে তিনি কুরাইশদের ক্ষমা প্রদর্শন করেন। করুণার প্রতীক রাসূল নিজেও শত্রুদের প্রতি দুর্ব্যবহার করেন নাই। মূইরের ভাষায়, “যে মক্কাবাসীরা এতদিন ধরে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করেছিল তাদের প্রতি তাঁর এই উদার ব্যবহার সত্যই প্রশংসনীয়।” বিদায় হজ্ব উপলক্ষে তিনি আরাফাত ময়দানে যে শেষবাণী উচ্চারণ করেন তা সর্বকারে সর্বদেশের জন্য একটি ‘মানবিক সনদ’ হয়ে থাকবে। কৌলীন্য, দাসপ্রথা ও নরহত্যা প্রভৃতি অসামাজিক প্রথার তিনি তীব্র প্রতিবাদ করে সাম্য ও মৈত্রীর এক নব যুগের সূচনা করেন।

রাসূলে করিম (স) অতি সরল, সহজ, সাধারণ এবং অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তিনি স্বহস্তে গৃহের কার্য, এমনকি গাভীর দুগ্ধ দোহন, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার ও নিজ জুতা মেরামত করতেন। তাঁর বেশভূষায় আড়ম্বরতা প্রকাশ পায় নি। এতদসত্ত্বেও তিনি ছিলেন মুসলিম জাহানের একচ্ছত্র অধিপতি, সেনাধ্যক্ষ ও রাষ্ট্রনায়ক।

হযরত মুহাম্মদ (স) শ্রমের মর্যাদা দান করতেন এবং তিনি নিজে মদিনার মসজিদ নির্মাণে এবং খন্দকের যুদ্ধে খন্দক অর্থাৎ পরিখা খননে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। কোন কাজকেই তিনি ছোট মনে করতেন না। গাজ্জালী বলেন, “হযরত পালিত পশু-পক্ষীদের স্বয়ং আহার্য দান করতেন, গাভী দোহন করতেন, গৃহ মার্জনা করতেন, খাদেমের সঙ্গে একত্রে খেতেন, ভৃত্যের কাজে সাহায্য করতেন এবং বাজার হতে খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে আনতেন।” চারিত্রিক দৃঢ়তা, নির্ভিকতা, পক্ষপাতহীন বিচার তাঁর জীবনের বিভিন্ন কার্যে প্রতিফলিত হয়েছে। আমীর আলী বলেন, “এত নির্মল, এত কোমল অথচ বীরোচিত স্বভাব-শ্রদ্ধাই নয় বরং ভালবাসাকেই অনুপ্রাণিত করত।”

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কৃতিত্ব : সংস্কারসমূহ

কৃতিত্ব : বৈপ্লবিক পরিবর্তন দ্বারা হযরত মুহাম্মদ (স) আরবের তথা মুসলিম বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব আলোড়ন আনেন তার তুলনা সত্যই বিরল। পরবর্তীকালে ফরাসি বিপ্লবও ইসলামের ভ্রাতৃত্বের নীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

বার্নাড শ’ বলেন, “যদি গোটা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, আদর্শ ও মতবাদসম্পন্ন মানব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একনায়কের শাসনাধীনে আনা হত তবে একমাত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-ই সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতারূপে তাদেরকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন।” একথা অবিসংবাদিত সত্য যে রাসূলুল্লাহ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক ছিলেন।

ধর্মীয় সংস্কার : ভন ক্রেমার বলেন, “নিকৃষ্ট ভক্তিযোগ্য বস্তুপূজা হতে কঠিন এবং অনমনীয় একেশ্বরবাদ-এটিই ছিল ইসলামের ধর্মীয় সংস্কার।” (“From gross fetishism to severe and unbending monotheism–such was the religious reform effected by Islam”) পৌত্তলিকতা, ধর্মীয় কুসংস্কার, বস্তুপূজা প্রভৃতি যখন আরবের ধর্মীয় জীবনকে কলূষিত করছিল তখন হযরত মুহাম্মদ (স) তৌহিদের বাণী প্রচার করেন। কলেমা তৌহিদে একেশ্বরবাদের আমোঘ বাণী ঘোষিত হয়েছে : “আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই; হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর প্রেরিত পুরুষ।” একেশ্বরবাদের মূলমন্ত্রে রাসূলুল্লাহ (স) সমগ্র ইসলাম জগতকে একটি ভ্রাতৃসংঘে আবদ্ধ করেন। হিট্টি বলেন, “নিজে অশিক্ষিত হয়েও হযরত মুহাম্মদ (স) এমন একখানা ধর্মগ্রন্থ প্রদান করেন যাহা আজও বিশ্বের এক-অষ্টমাংশ অধিবাসীর কাছে সমস্ত বিজ্ঞান, ধর্ম ও সাধারণ জ্ঞানের ভাণ্ডাররূপে পরিগণিত।” ইসলামের বিজয়কে ধর্ম অর্থাৎ তৌহিদের বিজয় বলে মনে করা হয়।

সামাজিক সংস্কার : সমাজ সংস্কারক হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স) যে অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করেন তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে তিনি মুসলমানদের একটি জাতিতে পরিণত করেন। তিনিই সর্বপ্রথম রক্ত অথবা কৌলীন্যের পরিবর্তে ধর্মের ভিত্তিতে একটি জাতি গঠন করেন। জুয়া খেলা, মদ্যপান, অহেতুক রক্তপাত, কুসিদ গ্রহণ, ব্যাভিচার প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের সমাজ বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনিই জেহাদ ঘোষণা করেন। তাঁর ভাষায়, “সকল মানুষ সমান, মানুষের মধ্যে উৎকৃষ্ট এবং শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি যিনি আল্লাহর প্রতি সর্বাধিক অনুগত এবং মানুষের সর্বাধিক কল্যাণকামী।” দাস প্রথার মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেন। তিনি ক্রীতদাস জায়েদকে সেনাপতিত্ব দান করেন; হাবসী ক্রীতদাস হযরত বেলাল ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন নিযুক্ত হন। আনাস, সালমান ফারসী ও সুহায়েব রুমী এবং অপরাপর ক্রীতদাসগণ সামাজিক মর্যাদা লাভ করেন।

হযরতের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংস্কারের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি। প্রাক-ইসলামী যুগে নারী পণ্যদ্রব্যের মত অবহেলিত ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ কুরআনের বাণী প্রচার করে বলেন, “পুরুষের নারীর উপর যতটা অধিকার আছে, নারীরও পুরুষের উপর ঠিক ততটা অধিকার রয়েছে।” বিবাহ, বিধবা-বিবাহ, তালাক, স্ত্রীলোকের মৃত পিতা অথবা স্বামীর সম্পত্তি ভোগের অধিকার প্রভৃতি বিধান দ্বারা হযরত সমাজে আমূল পরিবর্তন সাধিত করেন। স্ত্রীদের প্রতি তিনি স্ব্যবহারের নির্দেশ দেন। মায়ের মর্যাদা বৃদ্ধি করে তিনি বলেন, “মায়ের পায়ের তলায় সন্তানের বেহেস্ত।” মন্টোগোমারী ওয়াট বলেন, “হযরত মুহাম্মদ (স) একজন সমাজ সংস্কারক; বস্তুত তিনি নৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি একটি নতুন সামাজিক নিরাপত্তা বিধান এবং একটি পারিবারিক সংগঠন নির্মাণ করেন যা পূর্বের সকল সংগঠন অপেক্ষা উন্নত ধরনের ছিল। বর্তমান মানব সমাজের এক-ষষ্ঠাংশের জন্য তিনি ক্ষমতা এবং সামাজিক কাঠামো তৈরি করেন।”

রাজস্ব ব্যবস্থা : রাসূলে করিম কর্তক প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শাসনব্যবস্থাকে সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনার জন্য একটি সুষ্ঠু ও জনকল্যাণকর রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রের রাজস্বের যে সব উৎস ছিল তন্মধ্যে ‘যাকাত’, ‘জিজিয়া’, ‘খুমস’ অর্থাৎ এক-পঞ্চামংশ, ‘উশূর’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইসলামের অন্যতম প্রধান পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে ‘যাকাত’ একটি এবং নামাজ আদায় ও যাকাত দানের কথা এক সঙ্গে কুরআনে উল্লেখ আছে। যাকাত ‘যাকা’ শব্দ হতে উৎপত্তি হয়েছে এবং ‘যাকা’ অর্থ ‘বৃদ্ধি’ অথবা ‘বিশুদ্ধকরণ’। বিত্তশালী ব্যক্তিদের উদ্বৃত্ত যে পরিমাণ অর্থ স্বেচ্ছায় দুঃস্থ ব্যক্তিদের প্রদান করা হয় তাকেই ‘যাকাত’ বলে। প্রতিটি বিত্তশালী মুসলমানের জন্য এই যাকাত বাধ্যতামূলক। এই যাকাত সম্পদের উপর বৎসরে শতকরা আড়াই ভাগ দান করা হয়। তাবুক অভিযানের পর অমুসলমান খ্রিস্টান ও ইহুদী সম্প্রদায় তাদের জানমালের নিরাপত্তা ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ হতে অব্যাহতি পাবার জন্য মুসলিম রাষ্ট্রকে ‘জিজিয়া’ কর প্রদান করত। এ ছাড়া উৎপাদিত ফসলের এক- দশমাংশ রাজস্ব হিসাবে রাষ্ট্রকে প্রদান করবার যে ব্যবস্থা ছিল তা উশূর নামে পরিচিত ছিল। সেই সঙ্গে যুদ্ধশেষে শত্রুদের যে সব সম্পদ মুসলমানদের দখলে আসত তার এক-পঞ্চমাংশ (খুমস) রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হত এবং অবশিষ্ট সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হত। উপরন্তু, ভূমি-রাজস্ব অথবা খারাজও প্রচলিত ছিল।

রাজনৈতিক সংস্কার : হযরত মুহাম্মদ (স) একটি বিবদমান আরব জাতিকে সুসংবদ্ধ মুসলিম জাতি অথবা উম্মাতে পরিণত করেন। মদিনা সনদ গোত্রপ্রথার বিলোপ সাধন করে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে একটি নতুন জাতির প্রতিষ্ঠা করে। স্বৈরাচারী শাসন অথবা শেখতন্ত্রের পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রে স্বীকৃতি লাভ করে। হিট্টি যথার্থই বলেন, “মদিনা প্রজাতন্ত্রই পরবর্তীকালে বৃহত্তর ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূলক স্থাপন করে।” তিনি আরও বলেন, “আরব জাতির একমাত্র বন্ধন গোত্রপ্রীতি : ইহা একটিমাত্র আঘাতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং ঈমান (বিশ্বাস) এর স্থান অধিকার করে।”

প্রশাসনিক সংস্কার : মদিনায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে রাসূলে করিম (স) সর্বপ্রথম ইসলামী প্রশাসনিক কাঠামো সৃষ্টি করেন। ঐশীতন্ত্র (Theocracy) এবং গণতন্ত্রের সমন্বয়ে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে থাকে। মুসলিম বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক রাসূলুল্লাহ (স) রাষ্ট্রপতি হিসাবে যে ভূমিকা পালন করেন তা পরবর্তীকালের জন্য উদাহরণস্বরূপ। কুরআনের নির্দেশে, স্বীয় বিচার-বুদ্ধি এবং ধার্মিক ও শিক্ষিত মুসলিম সমাজের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ মদিনায় স্থাপন করে সেখানে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কার্য সমাধা করতেন। এই মসজিদই ছিল তাঁর বিচারালয়, প্রার্থনাগার, সরকারি দফতর, সভাগৃহ ও বৈদেশিক দূত ও গোত্রীয় প্রতিনিধিদের সাথে মিলনের স্থান।

শাসন-ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সমগ্র আরব দেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করা হয়; যেমন-মদিনা, খাইবার, মক্কা, তায়েফ, তায়ামা, সানা, ইয়েমেন, হাজরামাউত, ওমান ও বাহরাইন। প্রাদেশিক শাসনকর্তা অথবা ‘ওয়ালী’ শুধুমাত্র ইমামই ছিলেন না, প্রধান সেনাপতি, বিচারক ও প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করতেন। শাসন- ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়করণের ফলে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দূরীভূত হয়। মুসলিম রাষ্ট্রের রাজস্ব প্রধানত পাঁচটি উৎস হতে গ্রহণ করা হত, যথা- যাকাত ও সাদকা, খারাজ, জিজিয়া, গনিমাহ অর্থাৎ যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যাদির এক-পঞ্চমাংশ অথবা খুমস, আল-ফে অর্থাৎ সরকারি খাস জমি।

মুসলিম সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে রাসূলুল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একমাত্র উহুদের যুদ্ধ ব্যতীত তিনি সমস্ত যুদ্ধেই জয়লাভ করেন এবং এটি তাঁর সামরিক দক্ষতা, কুশলতা এবং তেজস্বিতার পরিচায়ক। নিয়মিত সেনাবাহিনী না থাকলেও প্রয়োজনে বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করা সম্ভবপর ছিল। এ কারণে তাবুক অভিযানে ৩০,০০০ সৈন্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।

নবী করিম (স)-এর আমলে শিক্ষাদীক্ষা চর্চা পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পায়; কারণ তিনি স্বয়ং এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এ সময় মসজিদ-মক্তব স্থাপন করে নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রচেষ্টা চালানো হয়। কুরআন পাঠ, শরীয়ত শিক্ষা, লিখন-পাঠ ও ব্যাকরণ শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। হযরত বলেন, “প্রয়োজন হলে পদব্রজে চীনে গমন করে বিদ্যা অর্জন কর।” তিনি আরও বলেন, “শহীদের রক্ত অপেক্ষা জ্ঞানী ব্যক্তিদের কালি অধিকতর পবিত্র।“

অর্থনৈতিক সংস্কার : প্রাক-ইসলামী যুগে আরবে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল না। হযরত মুহাম্মদ (স) একটি শোষণহীন সমাজ গঠনের মানসে অসামাজিক কার্যকলাপ, যেমন- কুসিদ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেন। এর পরিবর্তে তিনি যাকাত, ফিতরা, সকার প্রবর্তন করেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেন। রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক সম্পদ যাতে জনসাধারণ উপভোগ করতে পারে তিনি তারই সুবন্দোবস্ত করেন। বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে গরিব-দুঃখীকে অর্থ সাহায্য প্রদান করা হত।

জাতিগঠক হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)

ইসলামের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে এডওয়ার্ড গীবন বলেন, “এটি এমন একটি স্মরণীয় বিপ্লব যা পৃথিবীর সমস্ত জাতিসমূহের উপর একটি নতুন এবং চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছে।” (“It was one of the most memorable revolutions which has impressed a new and lasting character on the nations of the globe.”) ইসলামের মহান ভ্রাতৃসংঘ এবং প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে হযরত মুহাম্মদ (স) অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি মদিনায় যে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন তা তাঁরই দূরদর্শিতার পরিচায়ক। মদিনা সনদে রাষ্ট্রনায়ক এবং সংগঠক হিসেবে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভার ছাপ রয়েছে। বিবদমান আরব জাতিকে তিনি সুসংবদ্ধ করে শুধু একটি নতুন জাতিতেই পরিণত করেন নি; বরং ইসলাম ধর্ম প্রচার ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কৌলীন্যের পরিবর্তে তিনি ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর একটি সমাজ গঠন করেন। গোত্রপ্রীতির স্থলে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল তাঁর নিকট বিশেষ গুরত্বপূর্ণ। হিট্টি সত্যই বলেন, “আরবের ইতিহাসে রক্তের পরিবর্তে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ গটনের ইহাই প্রথম প্রচেষ্টা!”

খোদাবক্স বলেন, “রাসূলুল্লাহর শিক্ষার প্রধান তাৎপর্য ছিল গোত্রপ্রথার বিলুপ্তি এবং ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ প্রতিষ্ঠা।” উদার এবং সহনশীলতার পরিচায়ক মদিনা সনদে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছিল। বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ববোধ নীতিতে তিনি শুধু একটি সুসংবদ্ধ জাতিই গঠন করেন নি; বরং সর্বপ্রথম এমন একটি অলিখিত সংবিধান তৈরি করেন যা পরবর্তীকালের সংবিধানগুলোর অগ্রদূত ছিল। গীবনের মতে, “মহানবী ধর্মনেতা, রাজনীতিজ্ঞ এবং প্রশাসকের ভূমিকা পালন করেন। উপরন্তু, খোদার উপর প্রগাঢ় আস্থা ও বিশ্বাস ব্যতীত মানব জাতির ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অলিখিত থেকে যেত।” মন্টোগোমারী ওয়াট যথার্থই বলেছেন যে, “রাসূলুল্লাহ তিনটি বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন, যা তৎকালীন সময়ে খুবই বিরল ছিল; যথা- ধর্ম প্রবর্তক হিসেবে তাঁর মেধা, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং প্রশাসক হিসেবে তাঁর অসামান্য নৈপুণ্য।”

মহানবী ছিলেন বিশ্ব-শান্তির পথিকৃৎ। সহিষ্ণুতা, মহানুভবতা ও শান্তির বাণী তাঁর জীবনের কার্যাবলিকে সার্থক করেছে। তিনিই একমাত্র মহানবী যিনি তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কার্যের সফরতা অবলোকন করবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধিকে ‘ফাতহুম মুবিন’ ‘মহা-বিজয়’ বলা হয়েছে। এই চুক্তিটি মুসলমানদের একটি স্থায়ী রাজনৈতিক মর্যাদা প্রদান করে। এর ফলেই রাসূলে করিম ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন রাজদরবারে দূত প্রেরণ করে ইসলামের প্রতি বিধর্মীদের আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করেন। এইভাবে মদিনার ধর্মভিত্তিক সমাজ হতে উত্তরকালে বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য গড়ে উঠে। মরণশীল জীবনের অতি স্বল্প পরিসরে হযরত মুহাম্মদ (স) বিশৃঙ্খল ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে এমন একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র গঠন করেন যা ইতিপূর্বে শুধুমাত্র ভৌগোলিক সংজ্ঞায় পরিচিত ছিল।

বিখ্যাত পণ্ডিত কার্লাইল বলেন, “আরব জাতির জন্য ইহা (ইসলামের আবির্ভাব ) অন্ধকারে আলোর সমতুল্য এবং এটির আলোকে আরব দেশ উদ্ভাসিত হয়েছিল।” মহানবীর শ্রেষ্ঠত্ব ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভবপর নহে, কারণ তিনি “রহমাতুল্লিল আলামিন” অর্থাৎ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের জন্য রহমত বা আশীর্বাদস্বরূপ। তাঁর প্রতিটি কথা ও কার্যকলাপ ভবিষ্যৎ মুসলিম জীবনের পাথেয়। এ কারণে আমীর আলী বলেন, “একটি মহান কার্য চমৎকার এবং বিশ্বস্ততার সাথে সুসম্পন্ন করবার শ্রেষ্ঠ প্রমাণই হচ্ছে তাঁর (পূত-পবিত্র ) জীবন।” আন্তগোত্রীয় বিবাহ, সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র সম্পর্কিত নানাবিধ আইন-কানুন প্রবর্তন দ্বারা তিনি মুসলিম সমাজ তথা ভবিষ্যৎ মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রস্তর স্থান করেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে যথার্থই বলা হয়েছে, “বিশ্বের সমস্ত ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (স) সর্বাপেক্ষা কৃতী (বা সার্থক) ছিলেন।”

মদিনায় নবীর প্রশাসনিক কাঠামো

এডওয়ার্ড গীবন যথার্থই বলেন, “মহানবী ধর্মীয় নেতা, রাজনীতিক এবং প্রশাসকের ভূমিকা পালন করেন। অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতা, নৈপুণ্য ও মেধার জন্য তিনি কৃতিত্ব অর্জন করেন। মদিনায় সনদ সম্পাদনের পর ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্টিত হলে তিনি সর্বপ্রথম একটি প্রশাসনিক কাঠামো সৃষ্টির প্রয়াস পান।” পরবর্তীকালে এটিই মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর সর্বপ্রথম মদিনা মসজিদে তিনি সচিবালয় স্থাপন করেন এবং সেখান হতে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এই মসজিদই ছিল প্রার্থনাগার, বিচারালয়, সচিবালয়, সভাগৃহ ও বৈদেশিক দূত ও গোত্রীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলনের স্থান।

সচিবালয় : রাসূলে করিমের বিশ্বস্ত সচিব ‘কাতিব’ নামে পরিচিত ছিল। নবী করিম (স) তাঁর জীবদ্দশায় আল্লাহর নিকট হতে ‘ওহী’ বা ঐশীবাণী লাভ করেন এবং সেগুলো লিপিবদ্ধ করার জন্য সাহাবীদের নির্দেশ দেন। হযরত ওসমান, হযরত আলী, উবায় বিন–কা’ব এবং যায়েদ বিন সাবিত ‘ওহী’ লিখিয়া রাখতেন। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্ব বিভিন্ন সাহাবীকে অর্পণ করা হয়; যেমন- আল-যুবাইর বিন-আল- আওয়াম এবং আল-যুহাইর বিন আল-সালাত যাকাত ও সাদকা হিসাবে গৃহীত মালের হিসাব রাখতেন। খেজুরের গাছ হতে প্রাপ্ত আয়ের হিসাব রাখতেন হুজাইফা বিন আল-ইয়ামান। রাষ্ট্রীয় আয়ের হিসাব রাখতেন মুয়ানকীর বিন আবি তাতেমা। আল-মুগীরা বিন-শুবা এবং হুসায়েন (হোসেন) বিন নুমীর জাতি ও গোত্রদের মধ্যে সখ্যতা বজায় রাখতেন। জলাশয় এবং আনসার পুরুষ ও রমনীদের হিসাব রক্ষা করতেন আবদুল্লাহ বিন-আরকাম এবং আল-আলা বিন-উকবা। কাতিব হিসাবে রাসূলের পক্ষ হতে বিভিন্ন রাজ দরবারে পত্র লিখতেন যায়েদ বিন সাবিত। অপর একজন সচিব হানযালা বিন আল-রাবী রাসূল (স)-এর সীলমোহর রক্ষণাবেক্ষণ করতেন।

প্রাদেশিক শাসন-ব্যবস্থা : মদিনা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাজধানী এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র ছিল। রাসূলে করিম (স) শাসন-ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সমগ্র আরব দেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তা ‘ওয়ালী’ নামে পরিচিত ছিলেন। মদিনা ব্যতীত অপরাপর প্রদেশগুলো হচ্ছে খাইবার, মক্কা, তায়েফ, সানা, ইয়েমেন, হাজরামাউত, ওমান ও বাহরাইন, আল-জানদ এবং বনু কিন্দা উপগোত্রীয় অঞ্চল। ইবন হিশামের বর্ণনা অনুযায়ী আলী বিন-আবু তালিব নাজরানে, মুয়ায বিন জাবাল ইয়েমেনে, যিয়াদ বিন-লাবিদ হাজরামাউতে, ইয়ালা বিন-উমাইয়া আল-জানদের, আলা-বিন হাজরামী বাহরাইনের ‘ওয়ালী’ নিযুক্ত হন। ওয়ালী ছাড়াও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল বা জিলায় ‘আমিল’ নিয়োগ করা হয়। তাদের প্রধান কাজ ছিল সুষ্ঠুভাবে কর আদায় করা। ইবনে হিশাম ও আত-তাবারী আরব ভূখণ্ডের বিভিন্ন গোত্রের জন্য নিযুক্ত ২৩ জন ‘আমিলের’ উল্লেখ করেন।

রাজস্ব ব্যবস্থা : হযরত মুহাম্মদ (স) নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে সুদৃঢ়ীকরণের জন্য রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলন করেন। তাঁর শাসনামলে রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাঁচটি : (ক) যাকাত, (খ) খারাজ, (গ) জিজিয়া, (ঘ) মাল-ই-গনীমত ও (ঙ) আল-ফে। ইসলামী রাজস্ব ব্যবস্থায় ইসলামী বিধান অনুসারে সচ্ছল মুসলমানদের অবশ্যই প্রদেয় কর হচ্ছে যাকাত। নামাজের পরেই যাকাতের স্থান। যাকাত অর্থ পবিত্রকরণ এবং প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানকে তার স্থাবর সম্পত্তির কিয়দংশ রাজকোষ বা বায়তুল-মালে প্রদান করতে হত। যাকাত প্রধানত সোনা, রূপা, খাদ্য-শস্য, গৃহপালিত জন্তু ও বাণিজ্য দ্রব্যের উপর অর্পিত হত। নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা-রূপা অথবা সঞ্চিত অর্থের ঊর্ধ্বে সম্পদ থাকলে যাকাত প্রদান বাধ্যতামূলক। ২০০ দিরহামের ঊর্ধ্বে যাকাত প্রদান অপরিহার্য। সেই ক্ষেত্রে শতকরা ২.৫ ভাগ যাকাত দিতে হয়। যাকাত হিসেবে গৃহীত কর বিভিন্নভাবে ব্যয করা হয়; যেমন- দুঃস্থ ও অক্ষম ব্যক্তিদের সাহায্যে অভাবগ্রস্তদের অভাব দূরীকরণ, কর আদায়কারীদের বেতন, দাস ও বন্দীদের মুক্তিপণ, ঋণগ্রস্তদের সাহায্যে, জিহাদ ও আল্লাহর পথের পথিকদের সাহায্য। যাকাত হিসেবে প্রদত্ত অর্থকে নিসাব বলে। আয়করের সঙ্গে পার্থক্য এই যে, এটি বাৎসরিক আয়ের উপর নির্ভরশীল নহে। যাকাত ছাড়া ঐচ্ছিক দান বা সাদকার কথা কুরআনে উল্লেখ আছে। আল্লাহর সম্পত্তির জন্য ঐচ্ছিকভাবে এই অর্থ বিভিন্ন জনকে দেওয়া যায়। ভূমিতে উৎপাদিত খাদ্য-শস্য পাঁচ ওয়াক্ত বা পাঁচটি গর্দভের বোঝা অতিক্রম করলে যাকাত দিতে হত। এর পরিমাণ ছিল শতকরা ৫। অনুরূপভাবে ফল, যেমন খেজুর, খুরমা ও আপেল নির্দিষ্ট পরিমাণের ঊর্ধ্বে উৎপাদিত হলে, যাকাত ধার্য করা হত। গৃহপালিত পশুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীবিন্যাস ছিল; যেমন-

উটের সংখ্যা – যাকাত

৫-৯ উট : ৬ মাসের মেষশাবক অথবা ১ বছরের ছাগল
১০-১৪ : ২টি ছাগল
১৫-১৯ : ৩টি ছাগল
২০-২৪ : ৪টি ছাগল
২৫-৩৫ : ১ বছরের উষ্ট্রি
৩৬-৪৫: ২ বছরের উষ্ট্রি
৪৬-৬০ : ৩ বছরের উষ্ট্রি
৬১-৭৫ : ২ বছরের ২টি উষ্ট্রি
৭৬-৯০ : ৪ বছরের উষ্ট্রি
৯১-১২০ : ৩ বছরের ৩টি উষ্ট্রি

গো-মহিষের সংখ্যা – যাকাত

৩০ গো-মহিষ : ৬ মাসের বাছুর
৪০ গো-মহিষ : ১ বছরের গাভী বা ষাঁড়
৬০ গো-মহিষ : ৬ মাসের ২টি বাছুর

মেষ-ছাগলের সংখ্যা – যাকাত

৪০-১২০ মেষ : ৬ মাসের মেষ-শাবক
৪০-১২০ ছাগল : ১ বছরের ছাগল
১২১-২০০ মেষ/ছাগল : ২টি মেষ
২০১-৩৯৯ মেষ/ছাগল : ৩টি মেষ

যাকাতের পর আয়ের উৎস হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল খারাজ বা ভূমি রাজস্ব। অমুসলমান ভূ-স্বামীদের উপর রাসূলে করিম এই কর ধার্য করেন। রোমীয় সাম্রাজ্য (ট্রাইবিউটান সোলি) এবং পারস্যের ‘খাবাগ’ হতে খারাজের উৎপত্তি। রাসূল (স) খাইবার যুদ্ধের পর এই ভূমিকার প্রচলন করেন। বিশেষ করে বিত্তশালী ইহুদী সম্প্রদায় ভূমির উৎপন্ন দ্রব্যের অর্ধেক সরকারকে প্রদান করত। ‘খারাজ’ ও ‘জিজিয়া’ হতে গৃহীত রাজস্ব সেনাবাহিনীদের বেতনের জন্য খরচ করা হত। অমুসলমানদের উপর আরোপিত কর ‘জিজিয়া’ নামে পরিচিত। কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ (স) অমুসলমানদের উপর এই কর ধার্য করেন। এর পরিবর্তে তারা ইসলামী রাষ্ট্রের জিম্মিতে পরিনত হয় এবং রাষ্ট্রের নিকট হতে জান ও মালের নিরাপত্তা লাভ করত; উপরন্তু, তাদেরকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হত না। সাধারণভাবে সকল সক্ষম অমুসলমানকে মাথাপিছু এক দিনার ‘জিজিয়া’ দিতে হত। অবশ্য অপ্রকৃতিস্থ, শিশু, অসুস্থ, দরিদ্র ধর্মযাজকদের ‘জিজিয়া’ হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়। জিজিয়ার অর্থ মূলত সেনাবাহিনীর সাজসজ্জা, রসদ ও বেতন বাবদ খরচ করা হত।

‘গনীমত’ বা ‘খুমস’ অথবা এক-পঞ্চামাংশ কর যুদ্ধলব্ধ দ্রব্য-সামগ্রী হতে গ্রহণ করা হত। গনীমত লুণ্ঠিত দ্রব্যাদিকে বুঝায় এবং বিজিতরা যুদ্ধক্ষেত্র হতে যে সমস্ত সম্পদ আহরণ করত তার এক-পঞ্চমাংশ বায়তুল মালে প্রদান করে অবশিষ্ট চার-পঞ্চমাংশ & নিজেরা বণ্টন করে নিত। এখানেও শ্রেণীবিভাগ ছিল; যেমন- অশ্বারোহী পদাতিক অপেক্ষা দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ পেত। এক-পঞ্চমাংশ সম্পদের মধ্যে নবী করিম ও তাঁর পরিবারবর্গ ও অনাথদের ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করা হত। এ ছাড়া মুসাফির ও দুঃস্থরাও কিয়দংশ পেত।

মুসলিম রাষ্ট্রের আয়ের পঞ্চম উৎস ছিল আল-ফে। বিজিত অঞ্চলে মুসলিম ভূ- স্বামীদের ভূমিকর ‘আল-ফে’ নামে পরিচিত। ফিদাকের সম্পত্তি আল-ফে হিসেবে পরিগণিত হয়। এই ভূমি রাজস্ব মহানবীর আত্মীয়-স্বজন, দুঃস্থ পরিবার ও মুসাফিরদের মধ্যে বিতরণ করা হত। খারাজ ও আল-ফে-এর মধ্যে প্রভেদ হচ্ছে এই যে, ভূমিকর হওয়া সত্ত্বেও প্রথমটি অমুসলমান এবং পরেরটি মুসলমান ভূস্বামীগণ প্রদান করতেন।

সামরিক প্রশাসন : রাসূলে করিমের আমলে কোন নিয়মিত সৈন্যবাহিনী ছিল না। প্রয়োজনে তিনি ‘কাবিলা’ বা গোত্রদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানের আহ্বান করতেন এবং তারা আল্লাহর রাস্তায় ইসলামের গৌরবকে সমুজ্জ্বল করতে মুসলিম বাহিনীতে যোগ দিতেন। রাজনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলা করার জন্য তিনি বহু বার যুদ্ধ করেন এবং বিশেষ করে তাবুক অভিযানে ৩০,০০০ সৈন্য সংগ্রহ করেন। রাসূলে করিম মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন এবং তাঁর নির্দেশে যুদ্ধাভিযান হত। সামরিক কৌশলও তিনি নির্ধারিত করতেন। তিনি বহু যুদ্ধে স্বয়ং অংশগ্রহণ করে তাঁর সামরিক দক্ষতা, প্রজ্ঞা, কুশলতা এবং বীরত্ব প্রদর্শন করেন। সৈন্যবাহিনী গঠনে তিনি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সৈন্য সংখ্যাও নির্দিষ্ট ছিল না। তাঁর যুদ্ধ কৌশল ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বদরের যুদ্ধের পূর্বে রাসূল (স) বার জনের একটি গোয়েন্দাদল আবদুল্লাহ ইবন জাহসের নেতৃত্বে গঠন করে বিধর্মী কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার নির্দেশ দেন। মুসলিম সৈন্যদের শৌর্য-বীর্য ছিল অপরিসীম এবং এই কারণে মুসলিম বাহিনী বদরের যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন সৈন্য নিয়ে কুরাইশদের ১,০০০ সৈন্যের বাহিনীকে পরাজিত করে। উহুদের প্রান্তরে রাসূলের নির্দেশ অমান্য করায় মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয় ঘটে। এই যুদ্ধ চাড়া রাসূলে করিম অপর সমস্ত যুদ্ধে বিজয়ী হন। খন্দকের যুদ্ধে পারস্যবাসী সালমান ফারসীর পরামর্শ অনুযায়ী খন্দক বা পরিখা খনন করে তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। তাঁর সামরিক দূরদর্শিতার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে বদরের যুদ্ধে তাঁর সৈন্য সমাবেশের কৌশল। তিনি তাদের জন্য এমন স্থান বেছে নেন যাতে সূর্যোদয়ের পর সৈন্যদের চোখে সূর্যের কিরণ না পড়ে।

মুসলিম বাহিনীতে পদাতিক ছাড়া তীরন্দাজও ছিল। উহুদের যুদ্ধে ৫০ জন মুসলিম তীরন্দাজ সৈন্য রাসূলের আদেশ অমান্য করে স্থান ত্যাগ করায় মুসলিম বাহিনীর পরাজয় হয়। এই যুদ্ধে রাসূলের চাচা বীর কেশরী আমীর হামজা শাহাদাৎ বরণ করেন। রাসূলের সাহাবগণ ছাড়া বহু গোত্র প্রধান মুসলিম বাহিনীতে নেতৃত্ব দেন। হুদায়বিয়ার সন্ধি রাসুলে করিমের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচায়ক। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সম্ভবত সর্বমোট ২৭টি ছোট বড় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রাচীন আরবের প্রচলিত সামরিক নীতি অনুসারে যুদ্ধের পূর্বে মল্লযুদ্ধ সংঘটিত হয়। বদরের যুদ্ধের প্রারম্ভে মহানবীর নির্দেশে হযরত আমীর হামজা, হযরত আলী ও আবু উবায়দা কুরাইশ পক্ষের নেতা উতবা, শায়বা এবং ওয়ালিদ বিন-উবার সঙ্গে মল্ল যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী অকস্মাৎ আক্রমণ ও দ্রুত পলায়নের রীতি অনুসৃত হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংঘর্ষে এই রীতি গ্রহণ করা হলেও বড় বড় যুদ্ধে তিনি সেনাবাহিনীকে পাঁচ ভাগে (‘তাবীয়া’) বিভক্ত করেন; যেমন-কেন্দ্র, অগ্রভাগ (‘মুকাদ্দাম’), ডান, বাম ও পশ্চাদভাগ (‘সাকা’)। পশ্চাদ্ভাগে অবস্থিত বাহিনী প্রহরীর কাজ করত এবং রসদ সরবরাহ এবং ভারবাহী পশুদের তদারক করত। কুরআনের সুরা সাহাফের চতুর্থ আয়াতে সৈন্যদের সারিবন্দী বা ‘সাফ’ হয়ে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই সারিবন্দী তিন স্তরের হত : সামনে অর্থাৎ প্ৰথম লাইনে (সাফ) বর্শাধারীরা বর্শা হাতে হাঁটুতে ভর করে শত্রুর আক্রমণের অপেক্ষায় থাকবে। দ্বিতীয় সারিতে ব্যুহ রচনা করে তীরন্দাজগণ দাঁড়াবে, তৃতীয় লাইনে থাকবে অশ্বারোহী বাহিনী। যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে বিশেষভাবে ঢাল, বর্শা, তরবারি, ক্ষেপনাস্ত্র বা মানজানিক এবং ‘লুক্কায়িত’ অগ্নিকুণ্ড বা ‘দাববাবাহ’ ব্যবহার করা হত। তখন ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচলন হয়নি।

ধর্ম প্রচার ও ধর্মীয় শিক্ষা : মহানবী ধর্ম প্রচারক হিসাবে অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ভাষায়, “বিশ্বের সমস্ত ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (স) সর্বাপেক্ষা কৃতী বা সার্থক ছিলেন।” মক্কা বিজয়ের পর তিনি (৬৩০-৩২ খ্রি.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে ও দরবারে দূত প্রেরণ করেন। ওমান, হাজরামাউথ, নাজরান, মাহবা, বাহরাইন প্রভৃতি অঞ্চলে প্রতিনিধি প্রেরণ করে ইসলাম প্রচারে ব্রতী হন। ইহা ছাড়া আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান রাজা নাজ্জাসী, বায়জানটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস এবং পারস্যের সাসানীয় সম্রাট ইয়াজদিগার্দের নিকটও দূত প্রেরণ করেন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে রাসূলে করিমের একটি নিজস্ব দফতর ছিল এবং তাঁর নির্দেশে পত্রসমূহ লিখিত হত এবং সীলমোহর করে সেগুলো প্রেরিত হত। মিসরের রাজার নিকট রাসূল (স)-এর লিখিত পত্রটি বিশেষ দূত মারফত প্রেরিত হয়। ধর্ম প্রচারকদের ‘দায়ী’ বলা হত। ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ এবং ইসলামের আলোকে জীবন প্রণালী গঠনের জন্য ধর্মীয় শিক্ষার উপর রাসূলে করিম বিশেষ নজর দেন। মদিনার মসজিদ ছিল ধর্মীয় শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র। হাফেজ, ক্বারী ও আলেমগণ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করতেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন স্থানে মসজিদ-মক্তব স্থাপন করে নিরক্ষরতা দূরীকরণের প্রচেষ্টা চালানো হয়। কুরআন পাঠ, শরীয়ত শিক্ষা, লিখন পাঠ ও ব্যাকরণ শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। হযরত শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, “প্রয়োজন হলে পদব্রজে চীনে গমন করে বিদ্যা অর্জন কর।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *