সপ্তম অধ্যায় – মানবসম্পদের উজ্জীবন ও উন্নয়ন

সপ্তম অধ্যায় – মানবসম্পদের উজ্জীবন ও উন্নয়ন

অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের লক্ষ্য অর্জনের পথে বিরাট চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর তা হচ্ছে, সম্পদের দক্ষ ও সুষম বন্টনের জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, সে লক্ষ্যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করা। ব্যক্তি মানুষকে শৃঙ্খলা, সচেতনতা ও সংহতির সাথে দক্ষ ও কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে। সব কিছু করার জন্য ইচ্ছুক ও আগ্রহী হতে হবে। উন্নয়নের পথে সকল বাঁধা অতিক্রমের জন্য ত্যাগ স্বীকারে ব্রত হতে হবে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি, সামষ্টিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা হ্রাস এবং সার্বিক মাকাসিদ অর্জনের লক্ষ্যের সাথে সংগতি রেখে মানুষকে তাদের আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ প্রবণতা পরিবর্তনে স্বপ্রণোদিতভাবে ইচ্ছুক হতে হবে।

কিন্তু শুধুমাত্র অনুপ্রেরণা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক কিছু আশা করা যায় না। তাদের যথাযথ যোগ্যতা এবং সক্ষমতা থাকতে হবে, যা আসে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান হতে। যদি উভয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা যায়, তবে শুধুমাত্র উপদেশ বা অনুপ্রেরণা দ্বারা মানুষের কর্মক্ষমতার বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগান যাবে না, তথা অর্থনীতিকে বেশি দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।

প্রেষণা

যদি মানুষকে যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ করা না যায় তবে কোনো ব্যবস্থাই সম্পদ ব্যবহারে দক্ষতা অথবা উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিতরণে সমতা আনতে পারে না। ব্যক্তি মানুষকে তার সর্বোচ্চ কর্মক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে উদ্বুদ্ধকরণ এবং সীমিত সম্পদের সর্বাধিক দক্ষতার সাথে ব্যবহার নিশ্চিতকরণের আবশ্যিক শর্ত রয়েছে। সে শর্ত হচ্ছে, ব্যক্তি মানুষটির নিজস্বার্থ ও সুযোগ সুবিধা যেন যথাযথভাবে চরিতার্থ ও সংরক্ষিত হয়। সমাজতন্ত্র ছিল অবাস্তব ও অতি সরলীকরণ, কেননা এটি আশা করেছিল, মানুষ নিজের স্বার্থ হতে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও দক্ষতার সাথে কাজ করবে। ফলে সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। পুঁজিবাদ অবাস্তব, কেননা এটা ধরে নিয়েছে যে, ব্যক্তিস্বার্থ ও সমাজস্বার্থ সব সময় সমঞ্জস্যপূর্ণ হবে। পুঁজিবাদের সেকুলার ও ইহজাগতিক পরিপ্রেক্ষিত এমন কোনো উজ্জীবনী প্রক্রিয়ার উন্মোষ ঘটাতে পারেনি, যা মানুষকে সামাজিক স্বার্থে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে, বিশেষত যখন ঐ সামাজিক স্বার্থ সরাসরি ব্যক্তিস্বার্থের পরিপন্থি হয়।

মানুষের ব্যক্তিস্বার্থের মাঝে একটি নৈতিকতার অনুভূতি সৃষ্টি করা না গেলে মানুষকে একই সাথে দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতায় উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব নয়। মানুষকে নৈতিকতার অনুভূতি দ্বারা উজ্জীবিত করা গেলে তা ব্যক্তিস্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও সমাজস্বার্থকে সে বিঘ্নিত করবে না। কিন্তু মানুষকে নৈতিকতা মেনে চলার জন্য উদ্বুদ্ধকরণে শুধুমাত্র ওয়াজ নসিহতের উপর নির্ভরশীলতা বাস্তবসম্মত নয়। নৈতিক মূল্যবোধের স্ফূরণ ও উজ্জীবন ঘটাবার জন্য প্রয়োজন আর্থ-সামাজিক অবস্থার এমন পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস, যাতে আর্থ-সামাজিক সুবিচারকে বিঘ্নিত না করেই কেবলমাত্র মানুষ তার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে পারে।

আর্থ-সামাজিক সুবিচার

অধিকাংশ মুসলিম দেশে বস্তুগত পারিতোষিকের বন্টন প্রণালী প্রবলভাবে বৈষম্যপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ মানুষ তাদের শ্রম, সৃজনশীলতা ও উৎপাদনশীলতার জন্য ন্যায্য পাওনা হতে বঞ্চিত। স্বাভাবিকভাবে তারা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে। তাদের উদ্যম, উৎসাহ ও দক্ষতা দারুণভাবে ভাটা পড়েছে। দুটি প্রধান কারণ এর জন্য দায়ী। প্রথমত, বাস্তবতাবর্জিত ও পক্ষপাতদুষ্ট সরকারি নীতিমালা; এবং দ্বিতীয়ত, গ্রাম ও নগর উভয় অঞ্চলে মুষ্টিমেয় হাতে সম্পদ ও ক্ষমতার কুক্ষিগতকরণ।

বাস্তবতাবর্জিত ও পক্ষপাতদুষ্ট সরকারি নীতির পৃষ্ঠপোষতার উৎপাদন উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্যের মূল্য যথার্থ না রেখে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশেষ শ্রেণীর প ক্ষে বিকৃত করা হয়েছে। বর্গাচাষী, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজীবি এবং শ্রমিক শ্রেণীর আয় তাতে ভীষণভাবে কমে গেছে। ক্রয় ক্ষমতা না থাকায় তাদের দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়ের চাহিদা স্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। উৎপাদন উপকরণ তাই স্বল্প আয়ের মানুষের মৌলিক দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে না। বিত্তশালীদের বিলাসী চাহিদার খাতে তা প্রবাহিত হয়েছে। অংশত সরকারি নীতি, শোষণমুলক অর্থননৈতিক ব্যবস্থার ফলে গুটিকয়েক হাতে সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল চলে আসছে। অবাধ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার দ্বার রুদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর শোষক শক্তিও দূরভিসন্ধিমূলক পারস্পরিক গাঁটছড়া বাধায় অধিকতর শক্তিশালী হয়েছে। জনসাধারণের দুর্দশা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে।

গ্রামীণ উন্নয়ন

কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পের (SME) প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং গ্রামীন এলাকায় ভৌত ও আর্থিক অবকাঠামো উন্নয়নকে ব্যাহত করেছে। গ্রামীন এলাকার কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর আয় দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। উন্নত বীজ, সার ও নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করার সামর্থ্য কৃষকের নেই। গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে মানুষের অভিবাসন বেড়েছে। নগরে মজুরির হার আরো হ্রাস পেয়েছে। জীবনযাত্রা দুরূহ হয়ে উঠেছে।

নগর উন্নয়ন এবং বৃহৎ কল-কারখানা ও ব্রবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতি করকারের পক্ষপাতিত্ব সুবিদিত। উচ্চ ট্যারিফ হার, কম সুদে বিশাল অংকের ঋণ সরবরাহ ও ভর্তুকির মাধ্যমে প্রাপ্ত তুলনামূলক সুবিধা এদের মুনাফার পাহাড় ফাঁপিয়ে তুলছে। গ্রাম ও শহরে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পের প্রতিযোগিতার শক্তি খর্ব হয়েছে। কতিপয় হাতে ক্ষমতা ও সম্পদের কুক্ষিগতকরণ তীব্রতর হয়েছে। এ নগরমুখী শিল্পায়ন হতে সরকারের কর রাজস্ব বাড়তে পারত। কিন্তু শিল্প ও বণিকদের সর্বতোভাবে কর ফাঁকি দেবার প্রচেষ্টা করকারকে সে রাজস্ব আয় থেকেও বঞ্চিত করেছে। অপরদিকে শহরাঞ্চলে শ্রমিকের সংখ্যাধিক্য মজুরির উপর নিম্নচাপ সৃষ্টি করেছে। নগরায়ণ ও শিল্পায়নে শমিকের বিপুল অবদানের পুরস্কার হতে তারা বঞ্চিত হয়েছে।

শুধুমাত্র এটাই যথেষ্ট নয় যে, কৃষ্টি, মাঝারি ও ক্ষুদ্র এবং ব্যষ্টিক শিল্পের প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ পরিহার করা প্রয়োজন। আর্থ-সামাজিক ব্যাপক পরিবর্তন আশু প্রয়োজন, যাতে শ্রমজীবি মানুষ, ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী ও বিনিয়োগকারী, রপ্তানিকারক বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পায়।

ভ্রান্তনীতি সংস্কার

ইসলামী অনুশাসন দাবি করে যে, মালিকপক্ষ শ্রমিক কর্মচারিকে নিজ পরিবারের সদস্যের মতো মনে করবে। শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার সাথে আচরণ করবে। তাদের কল্যাণের প্রতি খেয়াল রাখবে। প্রকৃত মজুরি এমন হবে, যাতে শ্রমিক তার পরিবারবর্গ নিয়ে মানবোচিত জীবনযাপন করতে পারে। শ্রমিক মালিকের মাঝে থাকবে দীর্ঘকালনি সুসম্পর্কের সেতুবন্ধন। শ্রমিকদের প্রদান করা হবে যথাযথ প্রশিক্ষণ, কাজের নিরাপত্তা এবং মুনাফার ন্যায্য হিস্যা।

অথচ বিপরীত চিত্রটাই লক্ষণীয়। প্রত্যহ ১০ থেকে ১৪ ঘন্টা কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও পারিশ্রমিক এতই সামান্য যে, পরিবার পরিজন নিয়ে সর্বনিম্ন প্রয়োজন মেটাতেই শ্রমিককে হিমশিম খেতে হয়। উপরন্তু কর্মেরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কর্ম উৎপাদনশলিতা, শ্রমিকের সংখ্যাধিক্য, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি মজুরির নিম্নহার ও কর্মের নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী মর্মে নিওক্লাসিকাল অর্থনীতিবিদগণ ধারণা দিতে চেষ্টা করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে এ ব্যাখ্যা যথাযথ নয়। শোষণমূলক ব্যবস্থাই বস্তুত এ দুর্দশার জন্য দায়ী। নৈতিকতা বিবর্জিত শোষক শক্তিসমূহের যোগসাজশ, ইনসাফহীন সরকারি নীতি, সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রাপ্তির সুযোগের অভাব প্রভৃতি কার্যকারণ এ পরিণতির জন্য দায়ী। শোষক গোষ্ঠীসমূহের শক্তি যদি খর্ব করা না যায়, তবে শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি ইনসাফ করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিকট হতে উদ্দীপনাময় ও দক্ষ কাজও আশা করা যায় না।

শুধুমাত্র ন্যূনতম মজুরি আইন প্রণয়ন দ্বারা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। কেননা প্রথমত এটাকার্যকর করা কঠিন। আর যদি প্রয়োজনে করাও হয়, তাহলে এর দুটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। প্রথমত, মালিকপক্ষ প্রকৃত যে মজুরি দেবে এবং কাগজে কলমে যা দেখাবে তার মাঝে শুভংকরের ফাঁক থেকে যেতে পারে। ফলে একদিকে শ্রমিক তার প্রকৃত আইনানুগ মজুরি পেল না, অন্যদিকে মালিকপক্ষ খাতাপত্রে হিসেবে দেখিয়ে সরকার হতে কর রেয়াত পাবার সুযোগ পেয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ন্যূনতম মজুরি ও বেকার সমস্যার আরো অবনতি ঘটতে পারে।

তাই প্রয়োজন সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের এক নীতিমালা অনুসরণ, যা বর্তমান শোষণযন্ত্রের ধার ভোঁতা করে দেবে। সে পন্থা হবে, প্রথমত শ্রমিকের উৎপাদনশলিতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ; দ্বিতীয়ত, গ্রাম ও শহরে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সমপ্রসারণ। এ ধরনের সৃজনশলি কর্মসূচির মৌলিক উপাদানসমূহ হবে: (ক) উন্নততর বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে উৎপাদনশলিতা বৃদ্ধি; (খ) ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পখাতে প্রতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা সমপ্রসারণ; (গ) সাধারণ মানুষের নৈমিত্তিক দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন এবং আয় ও সম্পদের তীব্র বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যে অর্থনীতির সার্বিক পুনর্গঠন। মুনাফার শ্রমিকের অংশীদারীত্ব ও শিল্প কারখানায় শেয়ার-স্টকে যত ব্যাপকভাবে সম্ভব শ্রমিকের মালিকানা প্রদানের মাধ্যমে উপযুক্ত কর্মসূচিকে আরো শক্তিশালী করা যায়।

প্রত্যেক শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের মুনাফার অংশীদারীত্ব প্রদানের জন্য স্কিম প্রণয়ন করতে হবে। মুনাফার একটি নির্ধারিত হিস্যার একাংশ শ্রমিকদের বোনাস হিসেবে প্রদান করতে হবে। বাকি অংশ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, কাজের পরিবেশ উন্নয়ন, চিকিৎসা সুবিধা, সন্তানের শিক্ষা ভাতা, গৃহায়ন ও খাদ্য ভর্তুকিতে ব্যয় করা হবে। মুনাফা বৃদ্ধির সাথে শ্রমিকের মজুরি নীতি কতগুলো উল্লেখযোগ্য সুফল বয়ে আনবে।

যেমন-

(ক) শ্রমিকদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং উৎপাদনশলিতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে;

(খ) ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকের অংশগ্রহণের অধিকার মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করবে এবং এটা হবে মুসলিম সমাজের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্যের পুনরুজ্জীবন;

(গ) উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে শিল্পকারখানায় সাধারণভাবে উৎপাদন ও মুনাফা বৃদ্ধি পাবে, ফলে মুনাফা হ্রাস বা লোকসানের সময় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন পড়বে না;

(ঘ) ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের কারণে মুনাফা সম্পর্কে সঠিক তথ্য শ্রমিকদের জানা থাকবে; এর ফলে মালিক পক্ষের কর প্রদান এড়াবার প্রবণতা হ্রাস পাবে, অবশ্য কর ব্যবস্থারও সংস্কার সাধন করতে হবে;

(ঙ) অর্থনীতিতে বাঞ্ছিত প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে, বিনিয়োগ ও সামষ্টিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

শিল্প-কারখানায় শ্রমিকের মালিকানা লাভ সম্পদ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করবে। ইকুইটির মালিক হওয়ায় শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের ব্যাপারে যত্নবান হবে। মোট কথা মালিকানায় অংশীদারিত্ব ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের ফল শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত সৃষ্টি হবে। শ্রমিক অসন্তোষ হ্রাস পাবে ও দক্ষ, সচেতন কর্মীবাহিনী গড়ে উঠবে। সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে।

মানবসম্পদের উজ্জীবন ও উন্নয়ন

বিনিয়োগ সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় স্বর্ণ মজুদের মতো অনুৎপাদনশীল কার্যকলাপ হ্রাস পাবে। সমাজে শ্রমিকের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। শ্রমিকদের মালিকানা লাভের নীতি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মতো পুঁজিবাদী দেশে স্বীকৃতি লাভ করেছে। মুসলিম দেশে এ ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহ সঞ্চার না হবার কোনো কারণ নেই।

ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী ও শেয়ারহোল্পারদের ন্যায্য পাওনা প্রদান

প্রশাসনিক খামখেয়ালীপনা ও বৃহৎ কর্পোরেট শিল্পের দুর্নীতির কারণে মুসলিম দেশে ডিপোজিটর ও শেয়ারহোল্ডারদের কম মুনাফা দেয়া হয়। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী ও বিনিয়োগকারীরা এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো না কোনোভাবে তাদের মুনাফার হিস্যা আদায় করে নেয়। বড় বড় শিল্পপতি ও বণিকরা সঞ্চয়ের সিংহভাগ বিদেশে জমা রাখে। উদ্দেশ্য দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও ট্যাক্স দেয়া হতে রেহাই পাওয়া। উপরন্তু বিদেশী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হতে অধিক লাভের সুযোগ গ্রহণ করা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব শিল্পপতি ও বণিক সমাজ আবার অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের জন্য দেশীয় ব্যাংক হতে অত্যন্ত সুলভ হারে বিপুল ঋণ সুবিধা লাভ করছে। ফলে বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য এ হতে সুদের হার বেশি রাখার পক্ষে যুক্তি দেখানো সংগত নয়। কেননা এতে বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। বরং যুক্তিসংগত ও সমীচীন আচরণ হবে ইকুইটির মাধ্যমে পুঁজি সরবরাহের ব্যবস্থা করা এবং ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণদানকারী সংস্থাকে শরীয়াহর আলোকে পুনর্বিন্যস্ত করা। এর ফলে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী ও বিনিয়োগকারীরা তাদের ন্যায্য পাওনা পাবে। সেই সাথে সম্পদের বিতরণগত দক্ষতা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।

উৎপাদক, রপ্তানিকারক ও ভোক্তাদের প্রতি ন্যায়বিচার

বৈদেশিক মুদ্রার বাস্তবতাবর্জিত বিনিময় হার ও দ্রব্য মূল্যের অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। উচ্চ ট্যারিফ জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাশ্রেণীর দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। এসব ব্যবস্থা সাধারণ মানুষ ও দেশের উন্নয়নের স্বার্থে গৃহীত হয় মর্মে প্রচারণ চালানো হয়। এ প্রচারণা আসলে প্রহসন। বস্তুত এসব যুক্তির কোনো সারবত্তা নেই। এসব ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে ধনিক ও ক্ষমতাশালীদের কায়েমী স্বার্থকে রক্ষা করে। এ স্বার্থবাদী মহল দুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাস্তবানুগ নীতি গ্রহণ, মৌলিক চাহিদা অনুযায়ী জিনিসের সরবরাহ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সমপ্রসারণ নীতি গ্রহণে সরকারকে বাধাগ্রস্ত করে।

যে কর্মসূচি সাধারণ মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে গুটিকয়েক মানুষের সম্পদের স্পীতি ঘটায়, শরীয়াহর আলোকে তা সমর্থনযোগ্য নয়। গরীব জনসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেমন, যাকাত ও অনুরূপ তহবিল হতে রিলিফ সাহায্য প্রদান, মৌলিক দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন উৎসাহিত করার জন্য উৎপাদককে সুযোগ-সুবিধা প্রদান, সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধি ও নানা সুযোগের সমপ্রসারণ।

নৈতিক পরিপ্রেক্ষিত

শ্রমসাধ্য ও দক্ষ কাজ আদায়ের জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক থাকা প্রয়োজন। তবু কাজে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা নিশ্চিতকরণের জন্য এটাই যথেষ্ট নয়। ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ প্রবণতা প্রভাবিত করার জন্য আরো কিছু প্রয়োজন। বিভিন্ন মুসলিম দেশের ঝোঁক পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র যেদিকেই হোক না কেন, তারা মোটামুটি সেকুলার দর্শনকেই গ্রহণ করে নেয়। মনজিলে মকসুদে পৌঁছার জন্য এসব দেশে বর্তমানে ইসলামের সেই সঞ্জীবনী প্রাণশক্তিসুধা বা কারিশমা নেই, যা মানুষকে অতীতে বিশাল আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মানুষের চরিত্রের আমূল পরিবর্তনে ইসলামের সেই উজ্জীবনী শক্তিকে ব্যবহার করে বিপুল সম্ভাবনার সেই রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিতে হবে। বৈদেশিক দুঃশাসন ও বহু প্রজন্ম ধরে নৈতিকতার অবক্ষয়ের ফলে মুসলিম জনগণ তাদের ঈমান ও বিশ্বাসের গভীরতম মর্মবাণীর সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। তাই পুনরায় সেই সজীব ঈমানের রক্তবীজকে মহীরূহে রূপান্তর করতে হবে যা মানবিকতার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দেবে।

অনেকে মনে করেন, মানুষের নৈতিক চরিত্রে পরিবর্তন আনয়ন সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া ব্যয় সম্পর্কে অমূলক আশংকা ব্যক্ত করা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে নৈতিক চরিত্র পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ আমাদের সমাজেই রয়েছে। সুদূর পল্লী অঞ্চলের প্রান্তসীমায় রয়েছে অন্তত একটি মসজিদ। এসব মসজিদ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংবাদ মাধ্যম এবং সমাজ সংস্কার ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসমূহকে যদি এ লক্ষ্যে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে মানুষের মধ্যে নৈতিক উদ্দীপনা সৃষ্টির কর্মসূচির সুচারু রূপায়ণ ব্যয়বহুল বা অতিরিক্ত সময় সাপেক্ষ হবার কোনো কারণ নেই। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মসজিদের ইমাম, কলেজ-বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজকর্মীদের এ প্রক্রিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। রচনা করতে হবে চরিত্র গঠনমুলক পুস্তিকা ও সাহিত্য। আয়োজন করতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলের যথাযথ প্রশিক্ষণের। প্রয়োজনীয় এ ইসলামী সাহিত্য রচনা কঠিন কোনো কাজ নয়। ইসলামের মূল উৎস কোরআন ও সুন্নাহ সর্বাবস্থাতেই রয়েছে। উপরস্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম চরিত্রের উপাদান, স্রষ্টা ও সৃষ্ট জীবের নিকট জবাবদিহিতা ও দায়িত্ব তথা ইসলামের বিভিন্ন দিকের উপর অসংখ্য মনীষীর গবেষনালব্ধ অসংখ্য অমূল্য লেখার ভাণ্ডার জমা হয়ে আছে। সরকারের আশু দায়িত্ব হচ্ছে, এসব উপায়-উপকরণ, সাজ-সরঞ্জাম ও প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ব্যবহার করে জনগণের বিপুল কর্মক্ষমতাকে সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়নের কাজে লাগানো।

চরিত্র গঠনের সময় সাপেক্ষতার আশংকা অবশ্য বাস্তবানুগ। যদি সমাজ অর্থনীতির উন্নতির জন্য চরিত্রের সংস্কার ও উজ্জীবন প্রয়োজনীয় হয়, তবে সে লক্ষ্যে অবশ্যই কাজ করতে হবে। এ উদ্যোগ গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা সমাজ পরিবর্তনের ধারাকেই শুধু বিলম্বিত করবে। মুসলিম দেশসমূহে মানুষের চারিত্রিক গুণাবলী উন্মেষের জন্য সামাজিক আন্দোলন চলছে। কিন্তু সরকারি অবহেলা ও ঔদাসীন্য, সঠিকভাবে বলতে গেলে সরকারের প্রবল বিরোধিতার মুখে তা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বরং এটাই কাঙ্ক্ষিত ছিল, সরকার নৈতিকতা বর্জিত সেকুলারিজমের নামাবলী ছুঁড়ে ফেলে সমাজ পরিবর্তনে ইসলামী ধারাকে বেগবান করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। তা হলেই মানুষের নৈতিক জাগরণ ও মনোবিপ্লব দ্রুততর হতো। ফলশ্রুতি হিসেবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাফল্যের শিখরে পৌঁছাত। যদি তা না করা হয় তবে নৈতিক অবক্ষয়ের ক্রমবর্ধমান ধারা মানুষকে আরো বেশি পশুত্বের দিকে নিয়ে যাবে। অথচ সর্বজনবিদিত যে, মানুষের চরিত্র ও গুণাবলীর উপরই সমাজ ও অর্থনীতির উন্নতি ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে যথাযথভাবে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের কাজে ব্যবহার করে ইসলামের মূল্যবোধের পরিপন্থি নানা আনুষ্ঠানিকতা ও আচার-আচরণ সর্বস্ব অপচয়মূলক বিলাস-ব্যসন, আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান প্রভৃতি সম্পদ ধ্বংসকারী অভ্যাসের মূল্যোৎপাটনে সহায়তা করা যায়। সরকারকে সর্বশক্তি নিয়োগ করে ধনী- গরীব, অভিজাত-আনভিজাত নির্বিশেষে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সম্পদ অপচয়কারী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে হবে এবং সম্পদ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

পারঙ্গমতা

ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, নৈতিক সচেতনতা ও উপযুক্ত সামাজিক পরিবেশ মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন। তবে দক্ষতা ও ন্যায়পরতা অর্জনের জন্য তা যথেষ্ট নয়। দু’জন মানুষ সমানভাবে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে উভয়ের কর্মদক্ষতা সমান নাও হতে পারে। কর্মক্ষমতার পার্থক্য শুধুমাত্র জন্মগত নয়। সাধারণ শিক্ষা, বিশেষ প্রশিক্ষণ ও অর্থসংস্থানের দ্বারা কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তাই সাধারণভাবে অদক্ষ গরীব মানুষের জন্য শিক্ষা, বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

সাধারণ শিক্ষা ও বিশেষ প্রশিক্ষণ

মানবসম্পদ উন্নয়ন, সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অমূল্য অবদান এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শিক্ষা সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক সুযোগের দুয়ার খুলে দেয়। তাই যথার্থভাবেই শিক্ষাকে মানুষের মাঝে ‘মহাসাম্য সংস্থাপনকারী’ এবং সমাজ প্রগতির চালিকাশক্তি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু শিক্ষা খাতে সম্পদ বরাদ্দে মুসলিম দেশের সরকারসমূহ ক্ষমার অযোগ্য উদাসীনতা দেখিয়েছে। এমনকি মুসলিম দেশসমূহে শিক্ষার প্রাথমিক ধাপ সাক্ষরতা কর্মসূচিকেও তেমন অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়নি। নারী শিক্ষা, যার উপর সুস্থ, সবল ও চরিত্রবান বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেড়ে ওঠা নির্ভর করে তাকে নিদারুণভাবে অবহেলা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন যাবত এ ধরনের অমার্জনীয় অবহেলা মুসলিম সমাজের ভিতে ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে।

শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করা। মুসলিম সমাজে সৃজনশীলতা, কর্মপ্রেরণা ও কর্মদক্ষমতার যে বিপুল ভাণ্ডার সুপ্ত রয়েছে, শিক্ষা তার জীয়নকাঠি। প্রত্যেকটি ছাত্র-ছাত্রীকে ইসলামের মৌলিক ও গভীর গুণাবলীতে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে হবে। শুধু এটাই যথেষ্ট নয়। তাদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনার বিষয়ে যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

মুসলিম দেশের বর্তমান সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থা ছাত্রসমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ সম্পন্ন ও ইসলামী গুণাবলী সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। একই সাথে যুগের চাহিদা অনুযায়ী তাদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও জ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখায়ও দক্ষ করে তুলতে পারেনি। পর্যপ্ত পরিমাণ বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ব্যবস্থাপনার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানসমূহের অভাবে অগণিত প্রতিভাবান ছাত্রের কাছে এসব উচ্চশিক্ষার দিগন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক যুগের সিলেবাস অনুযায়ী চালু কলাবিদ্যার মান্ধাতার আমলের প্রতিষ্ঠানসমূহ হতে ডিগ্রি নিয়ে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী বেরিয়ে আসছে। অফিস-আদালতের কেরানির চাকরির জন্য এসব ডিগ্রিধারীদের চলছে নিরন্তর প্রচেষ্টা। সেসব পদসমূহও ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে। একদিকে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী দক্ষ জনশক্তির প্রকট অভাব, অন্যদিকে বাড়ছে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বেকারের মিছিল। বিত্তশঅলীরা দেশে বা বিদেশে তাদের সন্তানদের জন্য উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করে নিচ্ছে। অথচ বিত্তহীন মানুষের দরিদ্র সন্তান, যাদের আয় ও সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য এ ধরনের শিক্ষার আরো বেশি প্রয়োজন, তাদের সামনে সকল সুযোগের দুয়ার রুদ্ধ। ধনী-দরিদ্রের গগণচুম্বি ব্যবধান আরো বেড়ে চলেছে। যেন বিত্তহীন মানুষদের চিরস্থায়ী দরিদ্র্যের অন্ধকূপে ফেলে রাখার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। মুসলিম সমাজের আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য পূরণ ও যুগের দাবির প্রতি সাড়া দিতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

এসব শিক্ষার সিলেবাসে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও ব্যবহারিক ইসলামী মূল্যবোধের দৃঢ় সংযোজন প্রয়োজন। উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শাখা-প্রশাখা সারাদেশে সুলভ ও সুগম্যভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে দূরতম গ্রামের একটি দরিদ্র বিধবার সন্তান বা শহরে বস্তির একটি মাতৃহারা সন্তানও উপযুক্ত শিক্ষার প্রশস্ত সুযোগ হতে বঞ্চিত না হয়। শিক্ষাব্যবস্থার মানবৃদ্ধি সন্তানও উপযুক্ত শিক্ষঅর প্রশস্ত সুযোগ হতে বঞ্চিত না হয়। শিক্ষাব্যবস্থার মানবৃদ্ধি ও সুলভে সবার জন্য দ্বারা অবারিত করে দেয়া হবে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূরীকরণের পথে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। প্রত্যেক মানুষের আন্তর্নিহিত সুপ্ত গুণাবলী বিকাশের সুযোগ প্রাপ্তি এবং অর্জিত দক্ষতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ মৌলিক অধিকার। অত্রুপ উপযুক্ত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সরকারের মুখ্য ও অপরিহার্য দায়িত্ব।

অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা

শিল্প-বাণিজ্যের মালিকানাকে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে আবদ্ধ না রেখে সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষের মাঝে ছাড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। দরিদ্র মানুষের জন্য আর্থিক ঋণ ও সাহায্যের দুয়ার খুলে দিতে হবে। ইসলামী সাম্যের যে অমীয় বাণী আমরা শুনতে পাই তা অর্জনে এ পন্থা সহায়ক হবে। সাধঅরণ মানুষের আর্থিক পুঁজি সরবরাহের প্রতিবন্ধকতাসমূহ যদি অপসারণ করা না যায়, তবে সার্বজনীন ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা মানুষের দক্ষতা ও আয়ের পরিমাণ কিছু বৃদ্ধি মাত্র ঘটতে পারে, কিন্তু সম্পদ বৈষম্য হ্রাসে এ উন্নত শিক্ষা কোনো বূমিকা রাখতে পারবে না। ইসলামী সাম্যের সমাজ গড়ার কথা হবে একটি ফাঁকা বুলি মাত্র। সৌভাগ্যবশত পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্রের চেয়ে এক্ষেত্রে ইসলাম সুস্পষ্ট সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। ইসলামী চেতনা ও মূল্যবোধসঞ্জীবিত একটি অর্থব্যবস্থা ইসলামী জীবনব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে। সে ব্যবস্থা আর্থ-সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় পুরোপুরি সক্ষম। দশম অধ্যায়ে এ বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *