রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ
রাজমালা চতুৰ্থ ভাগ

সপ্তম অধ্যায় – পরগণে নুরনগর

সপ্তম অধ্যায় – পরগণে নুরনগর

চাকলে রোসনাবাদ মধ্যে নুরনগর সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও উন্নত পরগণা। ইহার পরিমাণ অধুনা ১৫১ বর্গমাইল হইতে কিঞ্চিদধিক। কিন্তু প্রাচীনকালে ইহার পরিমাণ বোধ হয় তাহার দ্বিগুণ ছিল। সরাইলের কিয়দংশ এই পরগণা হইতে গৃহীত। তদ্ব্যতীত এই পরগণার খণ্ড অংশ দ্বারা অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরগণা সৃষ্ট হইয়াছে। ॥৫৫৩॥

এই পরগণা সরাইলের প্রকৃতি বিশিষ্ট; ইহার পূর্বাংশ পর্বতের উপতটস্থ বলিয়া তাহার প্রকৃতি কিঞ্চিৎ স্বতন্ত্র, সরাইলের ন্যায় এই পরগণাটিও নদী স্রোতে প্রবাহিত কদমরাশী দ্বারা গঠিত। জলাভূমি সকল প্রথমত নানাপ্রকার তরুগুল্মে আচ্ছাদিত থাকে, তদ্রূপ এই পরগণাটিও তরুগুল্মে আচ্ছাদিত ছিল।

এই তরুগুল্ম সমাচ্ছন্ন পরগণাটি কাহার যত্ন ও পরিশ্রমে সুন্দর শস্য শ্যামল সমতল ক্ষেত্রে পরিণত হইয়ছে? কে “তাগাবি” আখ্যাবিষ্টি অর্থ ব্যয় করিয়া এই “বিরলমনুষ্য বসতি” পরগণাকে লোকালয়ে পরিপূর্ণ করিয়াছে? প্রাচীন সনন্দাদি দর্শনে ইহাই উপলব্ধি হয় যে, তালুকদার ও লাখেরাজদারগণ বহু অর্থ ব্যয় ও শরীরের রক্ত জল করিয়া পরগণে নুরনগরের আবাদ উন্নতি করিয়াছেন। ৩০।৩৫ বৎসর পূর্বে “তাগাবি” দিয়া প্ৰজা বসত করাইবার প্রথা প্রচলিত ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে যৎকালে রোসনাবাদ কোম্পানি বাহাদুরের খাসে ছিল, সেই সময় কোম্পানির কর্মচারিগণ এই পরগণার আবাদের জন্য বিশেষ যত্ন ও চেষ্টা করিয়াছিলেন।

আইন আকবরীতৈ বাঙ্গালার যে ওয়াসীল তুমর জমা সংযুক্ত রহিয়াছে তাহাতে এই পরগণার নাম লিখিত হয় নাই। প্রকৃতপক্ষে মোগল সম্রাট জাহাঁগীরের অধিকারের ॥৫৫৪॥ পূর্বে এই পরগণা মুসলমান সাম্রাজ্য ভুক্ত হয় নাই। পূর্বে বর্ণীত হইয়াছে যে তৎকালে এই পরগণা “হিউং, বিউং ও কৈলারগড়” এই তিন ভাগে বিভক্ত ছিল

১০০৯ হইতে ১০৩৫ ত্রিপুরাব্দের মধ্যবর্তী কালে মোগলগণ ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্র অধিকার করেন। মোগলদিগের অধিকৃত প্রদেশ “সরকার উদয়পুর” আখ্যা প্রাপ্ত হয়। সরকার উদয়পুর ৪টি পরগণায় বিভক্ত হইয়াছিল। তদানীন্তন মোগল শাসনকর্তা হিউং, বিউং, ও কৈলারগড নামক প্রদেশত্রয়কে সম্মীলিত করত স্বীয় নামানুসারে “নুরনগর পরগণা গঠন করেন। তৎকালে নুরনগরের অধিকাংশ ভূমি বন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এজন্য মোগল শাসনকর্তা নুরুল্লা খাঁ (বানুরুল্লাবেগ) তালুকদারি প্রথা প্রবর্তন পূর্ব নরুনগরের আবাদ উন্নতির চেষ্টা করিয়াছিলেন

নুরুল্লা খাঁ কায়স্থ রামধর (প্রকাশ্য কায়েত রামধর) কে নুরনগরের চৌধুরীর পদে নিযুক্ত করেন। প্রাচীনকালে চৌধুরীগণ স্বীয় পদের বৃত্তিস্বরূপ নানকার প্রাপ্ত হইতেন। তদনুসারে তিনি নানকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। অনেকগুলি স্থান তিনি তালুকস্বরূপ প্রাপ্ত হন। তদ্ব্যতীত অন্যান্য ॥৫৫৫॥ স্থান বহুসংখ্যক ব্যক্তিকে তালুকরূপে বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। সেই সকল তালুকদার হইতে রাজস্ব আদায় পূর্বক রাজকীয় ধনাগারে অর্পণ করা রামধরের প্রধান কাৰ্য্য ছিল।

উল্লিখিত ঘটনার পর মহারাজ কল্যাণ মাণিক্য ত্রিপুরার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি নুরনগরের তালুকদারগণ সহিত কিরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহা আমরা অবগত নহি। কিন্তু নুরনগর পরগণার মধ্যে তিনি তাম্রশাসন দ্বারা নিষ্কর প্রদান করিয়াছিলেন। সেই সকল শাসনপত্র পাঠে প্রতীয়মান হইবে যে, এই বনাকীর্ণ পরগণায় আর্য্য উপনিবেশ সংস্থাপনই তাহার প্রধান অভিপ্রায় ছিল।

১৫৭৩ শকাব্দের ১৪ই মাঘের তাম্রশাসনে লিখিত আছে যে, বউরখাড় গ্রামের জঙ্গলাবৃত স্থানে সাত দ্রোণ ভূমি মুকুন্দবিদ্যাবাগীশকে প্রদত্ত হইয়াছিল। অনুসন্ধান দ্বারা নির্ণীত হইয়াছে যে, বিদ্যাবাগীশ মহাশয় রাঢ়দেশবাসী ছিলেন। মহারাজ কল্যাণ মাণিক্য সেই মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতকে স্বীয় অধিকার মধ্যে সংস্থাপন করিবার জন্য নুরনগরের অন্তর্গত বাউরখাড়া গ্রামে এই নিষ্কর প্রদান করেন। ॥৫৫৩।। তাঁহার অধস্তন ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম পুরুষ অদ্যাপি সেই গ্রামে বাস করিয়া, পৈত্রিক ব্রহ্মোত্তর ভোগ করিতেছেন।

উল্লিখিত শাসনপত্রের প্রায় তিন মাস অন্তে মহারাজ কল্যাণ মাণিক্য রতিদেব চক্রবর্তী নামক অন্য একজন ব্রাহ্মণকে তলাবায়েক গ্রামে ৩॥ দ্রোণ জঙ্গলাবৃত ভূমি ব্রহ্মোত্তর দান করেন।

নুরনগর পরগণা যে তৎকালে কিরূপ অবস্থাপন্ন ছিল তাহা এই সকল সনন্দ দ্বারা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। কল্যাণ মাণিক্যের জ্যেষ্ঠপুত্র মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্যের অনেকগুলি তাম্রশাসন আমরা দর্শন করিয়াছি। গোবিন্দ মাণিক্যের তাম্রশাসনগুলির অপর পৃষ্ঠে তাঁহার উজির “শ্রীবিশ্বাস নারায়ণের” নাম উৎকীর্ণ রহিয়াছে। গোবিন্দ মাণিক্যের তাম্রশাসন নুরনগর অপেক্ষা মেহেরকুল পরগণায় অধিক পরিমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়।

গোবিন্দ মাণিক্যের জ্যেষ্ঠপুত্র মহারাজ রামমাণিক্যের ১০৯৩ ত্রিপুরাব্দের ৫ই জ্যৈষ্ঠের৩ একখণ্ড সনন্দের প্রতিলিপি আমাদের হস্তগত হইয়াছে, তাহাতে লিখিত আছে যে, “শ্রীসংগ্রাম নারায়ণ চৌধুরী” কে মুনিঅন্ধ গ্রামে ৫১ দ্রোণ ভূমি নিষ্কর প্রদত্ত হইল। ॥৫৫৭॥

রামমাণিক্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহারাজ রত্নমাণিক্যের অনেকগুলি সনন্দ আমরা দর্শন করিয়াছি। এই সকল সনন্দ দ্বারা নুরনগরের তালুক সমূহের ইতিহাসের কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যাইতেছে। একখণ্ড জীর্ণ সনন্দের প্রতিলিপি এস্থলে উদ্ধৃত হইল। (এই সনন্দের কথা ৯৭ এবং ৯৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হইয়াছে।)

… তু মাণিক্য দেব বিষম সমরবিজয়ী রাজমালা… শ্রীকারকোণবর্গে বিরাজতে হন্যৎ … রাজধানী হস্তিনা… উদয়পুর নুরনগর পরগণার জমিদার, মজুমদার, তালুকদার রায়ত বর্গে ভূমি আবাদ ক… পাট্টা দিলাম, ইহার প্রতি বৎসর এক দস্তুর খোদকাস্থা আমরা দ্রোণ ভূমি ৬ ছয় তঙ্কা, পাইকাস্তা আম ৪ চাইর তঙ্কা, ফসলী দ্রোণভূমি ২ দুই তঙ্কা, ভূমি আবাদ হইলে এই দস্তুরে জমানবন্দী করিয়া রাজস্ব… দিবার নাহয়; পরম সন্তোষে ভূমি আবাদ করিয়া রাজস্ব গণিয়া ভোগ করুক, কিন্তু ভেট… র্চ্চা পঞ্চক পর… ণার সদামদ মহাফীক দিবাএ, আর কোন দিন কার্য্যে… ভিত হেনে মাগন করি… বাম দুই… র মাস যে… ইতি শকাব্দা ১৬১৮ তারিখ ১১ বৈশাখ সন ১১০৫…।৪ ॥৫৫৮।

তৎকালে জঙ্গলা ভূমি আবাদ করিয়া তালুকের উন্নতি করা নিতান্ত কষ্টকর ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার ছিল। ত্রিপুরার রাজসরকারি আবাদি তালুক সমূহের যে সমস্ত প্রাচীন পাট্টা দৃষ্ট হইয়াছে, তাহার সমস্তগুলিতেই প্রায় নিম্নলিখিত কয়েকটি কথা লিখিত আছে :- “এই চৌহুদ্দি মধ্যে খিলা ও বটখিলা ও জঙ্গলা কুদালকোপ ও কুড়ালকোপ দোরবস্ত জমি বাড়ী আবাদ করিবার তোমারে তালুকদারি পাট্টা দেওয়া গেল”।[৫] এই ভয়ানক কাণ্ড কারখানা করিয়া যাইয়া কোন কোন ব্যক্তি সর্বস্বান্ত হইয়া দেশ ছাড়িয়া পলায়ন করিত 1 ইহাকে ভং (ভঙ্গ) দেওয়া বলিত। এইরূপ অবস্থায় ফেরারী তালুক অন্য তালুকদারকে “গছাইয়া” দেওয়া হইত। এই “ভঙ্গ” ও “গছানীর” সংবাদ আমরা বাল্যকাল হইতে লোক পরম্পরায় শ্রবণ করিয়া আসিতেছি। সম্প্রতি মহারাজ রত্ন মাণিক্য ও তৎপরবর্ত্তী নরপতিগণের কতকগুলি সনন্দে তাহার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।

একপ্রকার অবস্থায় কোন তালুকদার “ভং” দিলে যদি তাহার তালুক অল্পকাল মধ্যে বিশেষ লভ্যজনক হইবে, এরূপ ॥৫৫৯॥ বিবেচনা হইত তবে মহারাজ তাহা “নিজতালুক” করিয়া লইনে।

মহারাজ ধর্মমাণিক্যের রাজ্যাভিষেকের কিছুকাল পরে বাঙ্গালার নবাব ত্রিপুরা সমতলক্ষেত্রে অধিকার করত তাহাতে মোগল জমিদার নিযুক্ত করিয়াছিলেন।[৬] মুরাদবেগ নামক এক ব্যক্তি (বোধ হয় বলদাখালের জমিদারবংশীয়) পরগণে নুরনগর প্রাপ্ত হন। তিনি নুরনগরের নাম পরিবর্ত্তন পূর্বক ইহাকে “মুরাদনগর” আখ্যা প্রদান করেন। তৎপ্রদত্ত একখণ্ড তালুকদারী পাট্টা এস্থলে উদ্ধৃত হইল।

স্বস্তি :- শ্রীলশ্রীযুক্ত মির্জ্জা মুরাদ বেগ আনাং শ্রীকারকোণবর্গে সমাজ্ঞেয়ং পরং মদুফত নুরনগর (হাল) মুরাদনগর ডিহি কুকি হা… মৌজে সুলতানপুর ও নওয়ামুড় অজঙ্গল আবাদ করাইবার পাট্টা শ্রীমধুসূদনকে দিলাম পুত্র পৌত্র তার পুরুষানু দ্রোণ প্রতি শিক্ক ৪ চারি রূপাইয়া দিবা এই জমিন আবাদকারি ও খানেবাড়ীর ভোগ স্বত্ব অজমঙ্গলী মুরাদনগরের দস্তুর পাইবা আমি ও তৌজি মাহাফিক পাইব ইতি ১১২৩ তারিখ৮ ১ কাৰ্ত্তিক। ॥৫৬০।

এই সনন্দোক্ত সুলতানপুর অধুনা রুঠী আখ্যায় আখ্যাত হইয়া থাকে। কিন্তু জমিদারী সংক্রান্ত কাগজে ইহাকে “রুঠী ওরফে সুলতানপুর” লেখা হয়। এই মধুসূদন রুঠীর বিখ্যাত গুপ্ত বংশের পূর্বপুরুষ, মধুসূদনের উক্ত তালুক অধুনা “তালুক রাজেন্দ্র গুপ্ত” বলিয়া আখ্যাত হয়। রাজেন্দ্রের অধস্তন চতুর্থ ও পঞ্চম পুরুষগণ এক্ষণ সেই তালুক ভোগ করিতেছেন।

দ্বিতীয় যুদ্ধে মহারাজ ধর্মমাণিক্য মোগলদিগকে জয় করিয়াছিলেন। তৎপর নবাব ত্রিপুরেশ্বর সহিত সন্ধি করিলেন। সেই সন্ধিদ্বারা নুরনগরের তালুক সমূহের জমা পঁচিশ হাজার টাকা মহারাজ নবাবকে প্রদান করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। দিল্লীর সম্রাট এই সংবাদ শ্রবণ করত নুরনগরের রাজস্ব পঁচিশ হাজার টাকা সাময়িক জায়গীর উল্লেখে বাদ দিয়াছিলেন। ॥৫৬১॥ নুরনগরের তালুকদারগণ চিরকাল শাস্ত্রবিদ্যা অপেক্ষা শাস্ত্রবিদ্যায় অনুরাগী এবং এজন্য তাঁহারা তাঁহাদের প্রতিবেশী সরাইলের ভদ্রলোকদিগের পশ্চাতে পড়িয়া রহিয়াছেন। প্রাচীন কথা উল্লেখের পূর্বে বর্ত্তমান শতাব্দীতে তাহারা যে কয়েকটি কাণ্ড করিয়াছেন তাহার ২/১টি এস্থলে উল্লেখ করা গেল।

১। ভৈরব বাজারের বিখ্যাত দাঙ্গা একটি ছোট খাট যুদ্ধ বিশেষ। ইহাতে বিটঘরের দেওয়ান পরিবার নররুধিরে মেঘনার শ্যামসলিল লোহিত করিয়া মুক্তাগাছার জমিদার বাবু ভবানী কিশোর আচার্য্য চৌধুরীকে কিরূপ লাঞ্ছিত করিয়াছিলেন, তাহা বৃদ্ধদিগের নিকট শ্রবণ করিলে অদ্যাপি শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া থাকে।

২। ঢাকায় বিখ্যাত জমিদার ওয়াইজ সাহেব মুক্তাগাছার জমিদারবাবু ভবানীকিশোর আচার্য্যের সহিত একটি জমিদারী অধিকার লইয়া ভয়ানক দাঙ্গায় প্রবৃত্ত হইলেন। আচার্য্য মহাশয় নিরুপায় হইয়া নুরনগরের তালুকদারগণ নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। নুরনগরের লাঠিয়ালগণ দলে দলে যাইয়া আচার্য্য মহাশয়ের পক্ষাবলম্বন পূর্বক সাহেবের লাঠিয়ালদিগকে পরাজিত করিল। সাহেব এই সংবাদ ॥৫৬১॥ অবগত হইয়া মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বাহাদুরকে লিখিলেন “মহারাজ! রক্ষা করুন, নুরনগরের তালুকদারগণ আমার সর্বনাশ করিতে সমুদ্যত হইয়াছে।” তদনুসারে মহারাজ নুরনগরের প্রধান প্রধান তালুকদারকে লিখিলেন, “তোমাদের লোকদিগকে মুক্তাগাছা হইতে ফিরাইয়া আন, আর কাহাকেও তথায় যাইতে দিও না।”[৯]

৩। বর্ত্তমান ত্রিপুরেশ্বরও একদিন নুরনগরের তালুকদার নিকট সাহায্য গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।[১০]

অধুনা যদিচ তালুকদারগণ দুর্বল হইয়া পড়িয়াছেন, কিন্তু ব্রিটিশ শাসিত ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ও মধ্যভাগে যাঁহারা এরূপ বিক্রম প্রদর্শন করিয়াছেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তাঁহারা কিরূপ পরাক্রমশালী ছিলেন তাহা ক্ষণকাল চিন্তা করিলে অনুমিত হইবে।

মহারাজ মুকুন্দ মাণিক্যের একখণ্ড সনন্দের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। তাঁহার আত্মহত্যার পর রাজবংশে ভীষণ আত্মকলহ উপস্থিত হয়। ইন্দ্ৰমাণিক্য ও জয়মাণিক্য সিংহাসন অধিকার করিবার জন্য নরুধিরে ত্রিপুরা রঞ্জিত ॥৫৬৩। করিতে লাগিলেন। নুরনগরের পরাক্রমশালী তালুকদারগণ ইন্দ্রমাণিক্যের পক্ষ অবলম্বন করেন। মেহের কুলের তালুকদার হরিনারায়ণ চৌধুরী প্রভৃতি জয়মাণিক্যের সহায় হইয়াছিলেন। ভীষণ যুদ্ধে জয়মাণিক্যকে জয় করিয়া ইন্দ্রমাণিক্য রাজদণ্ড ধারণ করেন। জয়মাণিক্যের পতনের সহিত মেহেরকুলের তালুকদারগণের অধঃপতন সংসাধিত হয়। নুরনগরের তালুকদারগণের কৃতকার্য্যের পুরস্কার স্বরূপ ইন্দ্রমাণিক্য তাঁহাদিগকে যে সনন্দ প্রদান করেন তাহা এস্থলে উদ্ধৃত হইল।[১১]

স্বস্তি :- শ্রীশ্রীযুক্ত ইন্দ্ৰমাণিক্য দেব বিষম সমবিজয়ী মহামহোদয়ী রাজানামাদেশোয়াং শ্রীকারকোণবর্গে বিরাজতে হন্যৎ পরং রাজধানী হস্তিনাপুর সরকার উদয়পুর পরগণে নুরনগরের চৌধুরিয়ান ও নেওগিয়ান ও তালুকদারগণের জঙ্গলবুড়ি মৌরসী নবাবের সেরেস্তার আগত তালুক পরগণা মজকুরের জমা ফিরানী (মিলানী) মতে দিতেছে এইক্ষণ চলেমা দরখাস্ত করিল অতএব বত্রিশ অঙ্গষ্ঠ ডাঙ্গের সতর ডাঙ্গের নলে হাসীলা জমি জরিপ হইয়া সাবেক দস্তুর খানেবাড়ী আবাদীমিনা ফি দ্রোণ ৩ কাণি ৪ গণ্ডা ৩ কাণি ষোল কড়া বাদে মহাফিক জায় নিরেখ মতে বাকীজমি জমাবন্দি হইয়া দশোত্তরা ও ॥৫৬৪॥ সরঞ্জামি সুদামদ মাহাফিক বাদে বাকী জমা লওয়ার জন্য পুত্র পৌত্রাদি ক্রমে এই সকল দফার অন্যথা না হইব এবং তাহারগ বিনা দরখাস্তে জরিপ না হইব ইতি সন ১১৫৩ তারিখ ৭ আশ্বিন

আসামী – ফি দ্ৰোণ – নিরেখ

আসামী - ফি দ্ৰোণ - নিরেখ

সনন্দ সমূহ পৰ্য্যালোচনা দ্বারা অনুমিত হইতেছে যে ব্রিটিশাধিকারের পূর্বে নুরনগরের তালুকগুলি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। ১-মকবরী জমাব; ২- নিরেক মকবরী। ॥৫৬৫।।

মকবরী জমার তালুক :- ত্রিপুরেশ্বরগণ স্বীয় প্রিয়পাত্র স্নেহভাজন কর্মচারীগণ ব্যতীত অন্য কাহাকেও প্রায় এইপ্রকার তালুক প্রদান করিতেন না। মকবরী জমার তালুক প্রায়ই নিজ তালুক হইতে দেওয়া হইত। এই শ্রেণীর তালুকের সংখ্যা অতি অল্প।

নিরেক মকবরী তালুক :- “জঙ্গল বুড়ি” অর্থাৎ “কোদাল কোপ” ইত্যাদি কার্য্য দ্বারা যত জঙ্গল পরিষ্কার করত “তাগাবী” দ্বারা প্রজাবসত করাইয়া এই সকল তালুক গঠিত হইয়াছিল। তালুকের ভূমি আবাদ হইলে রাজ সরকারী নির্দ্দিষ্ট নলে তাহা জরিপ হইত। আবাদী ভূমির এক পঞ্চমাংশ (৩ পণ ৪ গণ্ডা) মতন, জীবিকা বা আবাদিমিনা উল্লেখে তালুকদারগণ নিষ্কর প্রাপ্ত হইতেন। অবশিষ্ট চারিপঞ্চমাংশ আবাদি ভূমির রাজস্ব নির্ধারিত নিরেখে ধার্য্য করা হইত। এইরূপে জমাবন্দী করিয়া তালুকদার মালিকানা স্বরূপ শতকরা দশ টাকা ও তহশীল খরচ বাদ পাইতেন। অবশিষ্ট রাজস্ব অবধারিত হইত। এই নিয়মে তালুকদারদিগের চারিপ্রকার লভ্য ছিল।

১- রাজসরকার হইতে যে নলে ভূমি পরিমাপ হইত তালুকদারগণ তদপেক্ষা ছোট নলে প্রজাপত্তন করিতেন। ॥৫৬৬॥

২- আবাদিমিনা বা মতন বা জীবিকা দ্বারা এক পঞ্চমাংশ লভ্য ছিল।[১২]

৩- তালুকদারদিগের রাজসরকার হইতে যে নিরেখ অবধারিত ছিল, তালুকদারগণ তদতিরিক্ত নিরেখ প্রজার নিকট ভূমির পত্তন করিতেন।

৪- এই সকল বাদে অবশিষ্ট মোট স্থিত হইতে তাহারা নির্ধারিত মালিকানা ও তহশীল খরচ প্রাপ্ত হইতেন।

এই নিয়মে কোন তালুকের ভূমি ভাগ করিতে হইলে দ্রোণ প্রতি ১১ কাণি ৬ গণ্ডা ২ কড়া ২ ক্রান্ত তালুকদারদের প্রাপ্য এবং ॥৫৬৭ ৪ কাণি ১৩ গণ্ডা ১ কড়া ১ ক্রান্ত জমিদারের প্রাপ্য অবধারিত হয়।[১৩] তদনুসারে ভূমির উপস্বত্ব জমিদার ও তালুকদার মধ্যে ভাগ করিতে হইলে, শত টাকায় ৭০ টাকা ১৩ আনা ৪ পাই তালুকদারের প্রাপ্য এং ২৯ টাকা ২ আনা ৮ পাই জমিদারের প্রাপ্য অবধারিত হয়।[১৪] তদতিরিক্ত নিরেখ মকবরীর জন্য তালুকদারগণের আরও কিছু লভ্য ছিল। ॥৫৮৮।।

ব্রিটিশাধিকারের পর যৎকালে রোসনাবাদ ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণের শাসনাধীনে ছিল, তৎকালে ইজারাদারি প্রথা প্রবর্তিত হয়। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ৩০শে জানুয়ায়ী পত্রে বোর্ড ইজারা বিলির জন্য রেসিডেন্টকে অনুমতি করেন। তদনুসারে কখন বা খণ্ডাকারে কখন বা সমগ্র পরগণা এক ব্যক্তিকে ইজারা দেওয়া হইত।

রেসিডেন্টগণের শাসনকালে চাকলে রোসনাবাদের জরিপ হইয়াছিল। এরূপ জরিপ কতবার হইয়াছে তাহা স্থির বর্ণনা করা সুকঠিন। দেশের তদানীন্তন অবস্থা অনুসারে বিশুদ্ধ জরিপ নিতান্ত অসম্ভব ছিল। জরিপের দ্বারা যে কাগজ প্রস্তুত হইয়াছিল তাহাও পূর্ণ অবস্থায় প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে না।

রেসিডেন্ট সাহেবগণ নুরনগরের আবাদ উন্নতির জন্য বিশেষ চেষ্টা ও যত্ন করিয়াছেন। মনোহর রায়, রামশরণ সেন প্রভৃতি ইজারাদার নামীয় আমলাদারির সহিমোহরাঙ্কিত নকল আমাদের হস্তগত হইয়াছে, তাহাতে লিখিত আছে, “চৌধুরীয়ান, নেওগীয়ান ও তালুকদারান” ॥৫৬৯॥ প্রভৃতিকে “খ্যাতির জমা দিলাসা ও ছল্লি করিয়া” “জমিন আবাদ তরদুদ করাহ”। যে সকল তালুকদার আবাদের জন্য বিশেষ যত্ন করিয়াছেন, তাহাদিগকে রেসিডেন্ট সাহেবগণ নিষ্কর প্রদান পূর্বক উৎসাহিত করিয়াছেন।[১৫]

ভূমি আবাদের জন্যই কোম্পানি বাহাদুর সায়েরাত জমা উঠাইয়া দিয়াছিলেন। ইহা একটি বিশেষ আশ্চর্য্যজনক ও কৌতুকাবহ যে, সায়রাত জমা রহিত করিয়া গবর্ণমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছেন। আবাদের জন্য পরিশ্রম করিয়াছিলেন তালুকদারগণ, কিন্তু ভাগী হইলেন মহারাজ বাহাদুর।

ইজারাদারগণের নামীয় আমলাদারীতে প্রকাশ যে, জরিপ জমাবন্দি দ্বারা যে জমা ধার্য্য হইত, ইজারাদারগণ তদনুসারে রাজস্ব গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। অতিরিক্ত হাসিলা জমির জন্য লিখিত হইয়াছে যে, “যে জমিন হাসিলা পাও তাহার নিরেখ পাট্টা বাহাল রাখিয়া খাজনা লইবা।”

বুলার সাহেবের জমাবন্দির পর যৎকালে মহারাজ রাজধর মাণিক্যের সহিত আট সন মেয়াদে চাকলে রোসনাবাদের বন্দোবস্ত হইয়াছিল, তৎকালে যে আদেশপত্র প্রচারিত হয় তাহার একখণ্ড সহিমোহরাঙ্কিত নকল আমরা দর্শন করিয়াছি। তাহাতে লিখিত আছে :- ॥৫৭০॥

“চাকলে রোসনাবাদ :-

রাজা রাজধরমাণিক্যের দেওয়ান কালীচরণকে হুকুম হইল যে, মেঃ জন বোলহর সাহেব মফস্বল চাকলা মজকুরের যেমতরূপ নিরিখবন্ধী মোকরর করিয়াছে এক্ষণে ইজারাদার সেই মাফিক রাইয়ত গয়রহ স্থানে খাজনা উশুল তহশীল করিবেক কিছু বেশী লইবেক না। কেননা এমসনে আট সনা বন্দোবস্তে রাজার সহিত কিছু বেশী বন্দোবস্ত হয় নাই।”

১১৯৭ বঙ্গাব্দে (১২০০ ত্রিপুরাব্দে) মনোহর রায়কে বার্ষিক ২১০০১ টাকা শিক্কা জমায় পরগণে নুরনগর ইজারা দেওয়া হইয়াছিল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় বাঙ্গালার সর্বপ্রকার তালুক জমিদারী হইতে খারিজ করিয়া লর্ড কর্ণওয়ালিস তালুকদারগণ সহিত তাহাদের মহাল বন্দোবস্ত করিবার প্রস্তাব করেন। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ৩রা ফেব্রুয়ারীর মিনিটে তাহা ঘোষণা করা হয়। নুরনগরের অল্প কয়েকজন তালুকদার খারিজের জন্য যত্নবান হইয়াছিলেন। অধিকাংশ তালুকদার আশু লভ্যজনক প্রলোভনে বাধ্য হইয়া কেবল যে খারিজের প্রার্থনা করেন নাই এমত নহে, যাহারা খারিজে প্রার্থনা করিয়াছিলেন তাঁহাদের বিরুদ্ধাচরণ করত মহারাজ রাজধর মাণিক্যের কৃপাভিখারী হইয়াছিলেন। বুলার সাহেব তালুকদারগণের আচরণে বিরক্ত হইয়া রিপোর্ট করেন ॥৫৭১॥ যে, “চাকলে রোসনাবাদের উত্তরভাগে খারিজের উপযুক্ত তালুক নাই”।[১৬] সুতরাং নুরনগরের হতভাগ্য তালুকদারগণের অদৃষ্টে খারিজ হওয়া ঘটিল না। সমগ্র চাকলে রোসনাবাদ মহারাজ রাজধরমাণিক্যের সহিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হইল। উক্ত বন্দোবস্তে নুরনগরের রাজস্ব ১৮৯৩৯ টাকা ৮ আনা নির্ণীত হয়।

যে সকল তালুকদার খারিজের প্রার্থী ছিলেন তন্মধ্যে রামমোহন দাস নামক জনৈক তালুকদার খারিজের জন্য মহারাজ রাজধর মাণিক্যের নামে রীতিমত মোকদ্দমা উপস্থিত করেন। দেশময় এরূপ প্রবাদ আছে যে, রামমোহনের সাক্ষীগণ রাজসরকার হইতে নিষ্কর ভূমি ও অন্যান্য প্রকার ধন সম্পত্তি লাভ করত রামমোহনের প্রতিকূলে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিলেন। এই সকল সাক্ষীদিগের মধ্যে কায়েত রামধরের কুলতিলক শ্যাম সুন্দর ধর চৌধুরী, খাণ্ডব ঘোষের বংসাবতংশ কৃষ্ণকান্ত ঘোষ মজুমদার এং লেশীয়াড়ার দাস বংশজাত চণ্ডীপ্রসাদ মজুমদারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নুরনগরের জনৈক গ্রাম্য কবির গীতিতে ইহাদের নাম এখনও শুনিতে পাওয়া যায় ১৭ যাহা হউক ॥৫৭২। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারী জিলা কোর্ট রামমোহনের মোকদ্দমা তাঁহার প্রতিকূলে নিষ্পত্তি করেন। তদনন্তর তিনি (ঢাকা) প্রভিনসিয়েল কোর্টে আপিল করিলেন। আপীল আদালত ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জুন নিম্ন আদালতের হুকুম স্থির রাখেন।

বুলার সাহেবের প্রোক্ত চিঠি এবং রামমোহন দাসের মোকদ্দমার জিলা কোর্ট ও প্রভিনসিয়েল কোর্টের নিষ্পত্তির দ্বারা নুরনগর পরগণার জমিদার ও তালুকদারের মধ্যে অনন্ত কলহের বীজ রোপিত হইল। মহারাজ ও তাহার কর্মচারিগণ ভাবিলেন নুরনগরের তালুক রক্ষা করা না করা তাঁহাদের স্বেচ্ছাধীন। বিদ্যাকুটের বলরাম বর্মন রামমোহন দাসের সাহায্যকারী ছিলেন। সুতরাং মহারাজ রাজধরের ক্রোধাগ্নি প্রথমত বর্মণ মহাশয়কে ভস্মীভূত করিবার জন্য প্রজ্জ্বলিত হইল। মহারাজ বলক্রমে তাহার তালুক অধিকার করিলেন। বিচার আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করত তাহার পুত্রগণ সেই তালুক পুন প্রাপ্ত হন। কিন্তু অৰ্দ্ধশতাব্দী ॥৫৭৩। ব্যাপী মোকদ্দমার ব্যয় ভার বহন করিয়া তাঁহারা হৃতসর্বস্ব হইলেন। এস্থলে আমরা সেই মোকদ্দমার কথা উল্লেখ করিব।

বলরাম বর্মণ প্রথমত মোকদ্দমা আরম্ভ করেন; তাঁহার মৃত্যুর পর পুত্রদ্বয় রঘুনাথ বিশ্বনাথ ও রাজকৃষ্ণ সেই মোকদ্দমায় পক্ষভুক্ত হন। বলরামের পৌত্র ও প্রপৌত্রগণের সময়ে এই মোকদ্দমা শেষ হয়। প্রথম আদালত বৰ্ম্মন বাদীগণের মোকদ্দমা অগ্রাহ্য করেন, আপীলে ঢাকা প্রভিনসিয়েল কোর্ট ১৮১৭ খ্রি. ১৮ই এপ্রিলের নিষ্পত্তি দ্বারা তাঁহারা তালুকটি ডিক্রী প্রাপ্ত হন এবং এরূপ অবধারিত হয় যে, এই তালুকের জমা নুরনগর পরগণার প্রথানুসারে অন্যান্য তালুকের ন্যায় ধার্য্য হইবে। এই তালুকের পূর্ব জমা ৫৯০ টাকা ছিল। তালুকদারগণ তাহাই প্রদান করিতে স্বীকৃত ছিলেন। মহারাজের পক্ষে বার্ষিক ১৭৭২ টাকা এগার আনা খাজনা পাওয়ার প্রার্থনা হইয়াছিল। এই তর্ক মীমাংসার জন্য উক্ত মোকদ্দমা প্রায় ৩২ বৎসর কাল ত্রিপুরা জেলা কোর্ট ঢাকা প্রভিন- সিয়েল কোর্ট, মুরসিদাবাদ প্রভিনসিয়েল কোর্ট এবং কলিকাতাস্থ সদর দেওয়ানী আদালতে বারংবার যাতায়াত করিয়াছে। অবশেষে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে মার্চ পাশ্ববর্ত্তী কয়টি তালুকের জমার সহিত “হারাহারি” মতে ৭৪৫ টাকা ১ আনা ৮ গণ্ডা ৩ কড়া ১ দন্তি শিক্কা অবধারিত হইয়াছিল।১১ ॥৫৭৪

পরিবর্তনশীল জমার তালুকের রাজস্ব অন্যান্য তালুকের সহিত হারাহারি মতে অবধারণ করার কথা বিশেষরূপে পরিলক্ষিত হইতেছে। প্রিভিকাউন্সেল ও কলিকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিগণ বারংবার এই প্রথা অবলম্বন করিয়াছেন।[১৯]

১৮১২ খ্রিস্টাব্দে নুরনগরের দর ইজারাদার, কাইতলা নিবাসী মাণিক্যরাম বর্দ্ধন (প্রকাশ্য বেচুরায় নামে তাঁহার তালুকের জমা বৃদ্ধির প্রার্থনা করেন; পূর্বে এই তালুকের জমা ৬৩৬০ আনা ছিল, দরইজারাদার তালুকের তদানীন্তন স্থিত অনুসারে ৩৪৩৯ টাকা ১২ আনা বার্ষিক কর ধার্য্যের প্রার্থনা করেন। কিন্তু জেলা ত্রিপুরার তদানীন্তন জজ ইউলিয়াম মার্টিন সাহেব ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর, দরইজারদারের পূর্বাপেক্ষা বর্দ্ধিত জমা নুরনগরের তালুক সমূহের উপর হারাহারি করিয়া তদনুপাতে ইজারা ধার্য্য করিত ৮১০ টাকা উক্ত তালুকের বার্ষিক জমা অবধারণ করেন।[২০] এই ॥৫৭৫॥ তালুকে মোট স্থিতের উপর অবধারিত রাজস্ব ভাগ করিলে প্রতীতি হইবে যে, মার্টিন সাহেবের উক্ত নিষ্পত্তি দ্বারা মোট স্থিতের প্রায় পঞ্চমাংশ জমিদারের প্রাপ্য নির্ণীত হইয়াছিল।

মহারাজ দুর্গামাণিক্য, রামগঙ্গামাণিক্য ও কাশীচন্দ্র মাণিক্যের শাসনকালে নুরনগরের তালুকদারগণের সহিত রাজসরকারের উল্লেখযোগ্য বিরোধ উপস্থিত বলিয়া বোধ হয় না। কিন্তু মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য সিংহাসন আরোহণ করিয়াই তালুকদারদিগের সহিত বিরোধে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার বন্দোবস্ত সংক্রান্ত কর্মচারী রাজকিশোর দেওয়ান ও কমলাকান্ত বক্সী প্রভৃতির অত্যাচার কাহিনী যাহারা আমরা বৃদ্ধ দিগের নিকট শ্রুত হইয়াছি তাহা স্মরণ করিলে শরীর রোমাঞ্চিত হয়।[২১]

এই সময়ে চারি প্রকার উপায়ে তালুকদারদিগকে জ্বালাতন করা হইয়াছিল। প্ৰথমত বন্দোবস্তের জন্য অত্যাচার দ্বিতীয়ত বেবন্দোবস্তী তালুক সমূহে ক্রোক॥৫৭৬।। সাজোয়াল (খাস তহশীলদার) নিযুক্ত করা, তৃতীয়-আহুত বন্দোবস্ত, চতুর্থ জমাবৃদ্ধির মোকদ্দমা।

বন্দোবস্ত উপলক্ষে যে সকল অত্যাচার হইত এক্ষণ তাহা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। ক্রোক সাজোয়ালগণ গরীব তালুকদার ও প্রজার প্রতি অনেক অত্যাচার করিত। এক ব্যক্তির তালুক অন্য ব্যক্তিকে বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়াকে আহুত বলিত।[২২]

এই সময় যে সকল জমা বৃদ্ধির মোকদ্দমা উপস্থিত হইয়াছিল, তম্মধ্যে তালুক নন্দকুমার চৌধুরীর অধিকারিণী চন্দ্রকলা চৌধুরাণীর নামীয়[২৩] এবং তালুক গৌরী দাস॥৫৭৭॥ ভট্টাচার্য্যের অধিকারী কীত্তিচন্দ্র ন্যায় বাগীশ[২৪] প্রভৃতির নামীয় মোকদ্দমা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উভয় মোকদ্দমায় বুলার সাহেবের পূর্বোক্ত (১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারীর) চিঠি এবং রামমোহন দাসের মোকদ্দমার জেলা আদালতের ও প্রভি- নসিয়েল কোর্টের নিষ্পত্তি পত্র অবলম্বন করিয়া আদালত অবধারণ করেন যে, “নুরনগরের তালুক তকইসসী এবং তালুকদার কেবল দশোত্তর মালিক।”

উল্লেখিত নিষ্পত্তি পত্র দ্বারা যে কেবল পরিবর্তনশীল তালুকের স্বত্বাধিকারীগণ উৎপীড়িত হইয়াছিলেন, এমত নহে, মকররী জমার তালুকগুলিকে বিনষ্ট করিবার জন্য রাজকর্মচারীগণ নানাপ্রকার উপায় অবলম্বন করিতে লাগিলেন। চন্দ্রকাল চৌধুরাণীর নামীয় উক্ত মোকদ্দমায় ত্রিপুরার জজস্কিপউইথ্ সাহেব লিখিয়াছিলেন যে, “বিরোধীর তালুক তকসিসী ব্যতীত অন্য কিছু হইতে পারে না, কারণ ইহা নুরনগরে অবস্থিত।” কি চমৎকার সিদ্ধান্ত! নুরনগরের মধ্যে হইলেই তাহা তসিসী তালুক হইবে।।৫৭৮॥ ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার জজ ফাউল সাহেব অবধারণ করিলেন যে, “অত্রত্য পূর্বতন বিচারপতিগণ যদিচ বুলার সাহেবের চিঠির প্রতি নির্ভর করিয়া বিচার কার্য্য নির্বাহ করিয়াছেন; কিন্তু আমি এই চিঠিকে প্রমাণ স্বরূপ গ্রহণ করিতে পারি না।”[২৫] ফাউল সাহেবের নিষ্পত্তির বিরুদ্ধে মহারাজ কলিকাতা হাইকোর্টে আপীল করেন। মাননীয় বিচারপতি জষ্টিস জেকসন ও জষ্টিস দ্বারকানাথ মিত্র অবধারণ করেন যে, বুলার সাহেবের চিঠি প্রমাণ সম্বন্ধে নিতান্ত অকর্মণ্য[২৬]। এই সময় হইতে মহামান্য হাইকোর্ট ও জেলাকোর্টে দ্বারা চাকলে রোসনাবাদের উত্তর বিভাগের কতকগুলি তালুক মকররী ও অপরিবর্তনশীল জমার সাব্যস্ত হইয়াছে।

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মকররী তালুককে তসিসী শ্রেণীতে আনয়ন করিবার জন্য মহারাজের কর্মচারিগণ যে আশ্চর্য কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহা বিস্ময়জনক। কয়েকটি॥৫৭৯॥ মোকদ্দমায় বিবাদী পক্ষে মহারাজ রামগঙ্গা মাণিক্যের মোহরাঙ্কিত চিঠি দাখিল হইয়াছিল। সেই চিঠি সম্বন্ধে মহারাজের পক্ষ হইতে বলা হইল যে ইহা চোরাই মোহর দ্বারা প্রস্তুত করা হইয়াছে। বিচারাদালত অবশ্যই এরূপ উত্তরে প্রীতিলাভ করিতে পারিলেন না। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার জজ ফাউল সাহেব মহারাজের প্রতিকূল ঐ সকল মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করেন]২৭]। হাইকোর্টের আপীলে মাননীয় বিচারপতি কেম্পও পন্টিফিক্স সাহেব ফাউল সাহেবের নিষ্পত্তি স্থির রাখিয়াছিলেন।[২৮]

দীর্ঘকাল যাবৎ ত্রিপুরেশ্বর লাখোরাজদার ও তালুকদারগণ সহিত মোকদ্দমা করিয়া আসিতেছেন। অনেক মোকদ্দমায় বিবাদি পক্ষে পূর্ববর্তী মহারাজ গণের মোহরাঙ্কিত চিঠি সত্য বলিয়া অবধারণ করিয়াছেন; কিন্তু একটি মোকদ্দমাতেও রাজসরকার হইতে কোন চিঠির সত্যতা স্বীকার করা হয় নাই।[২৯] ॥৫৮০।

বর্তমান মহারাজের রাজ্যাধিকার হইতে ১৮৯১ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত নুরনগরের তালুকদারগণ সহিত অনেকগুলি মোকদ্দমা হইয়া গিয়াছে। তাহারা কতকগুলি মহারাজের[৩০] আর কতকগুলি মোকদ্দমা তালুকদারগণের অনুকূল নিষ্পত্তি হইয়াছে।[৩১] আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তাহার আলোচনা করিতে ইচ্ছা করি না। এক্ষণ আমরা বন্দোবস্ত ও ডৌল (কবুলিয়ত) ও চিঠি (পাট্টা) সম্বন্ধে আলোচনা করিব।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে কি প্রণালীতে জমা ধার্য হইত, তাহা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। মহারাজ ইন্দ্রমাণিক্যের সনন্দে ও রামমোহন দাসের মোকদ্দমার ॥৫৮১॥ নিষ্পত্তি পত্রে তালুকদারের মালিকানা “দশোত্তর” লিখিত হইয়াছে। এই দশোত্তরা শব্দের অর্থ যে শতকরা ১০ টাকা ইহা সর্ববাদী সম্মত। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্ত্তী এবং ১২৮১ ত্রিপুরাব্দের পূর্ববর্ত্তী, তালুকদারের সহিত মহারাজের বন্দোবস্তী ডৌল ও চিঠি সমূহে দশোত্তরার পরিবর্তে “দশহিস্যা” শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। দশহিস্যা শব্দের সাধারণ অর্থ, দশভাগ। এদেশে হিস্যা শব্দ প্রয়োগ দ্বারা জমিজমার ভাগ করিতে হইলে ১৬ অংশে বিভক্ত করা হয়। সুতরাং সর্বসাধারণে “দশহিস্যা” শব্দের অর্থ ১৬ ভাগের ১০ ভাগ এরূপ বুঝিয়া থাকেন।[৩২]

দশোত্তরা পরিবর্ত্তে কেন দশহিস্যা শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছিল তাহার লিখিত প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে না, কিন্তু প্রাচীন ॥৫৮২॥ তালুকদারগণ নিকট এরূপ শ্রুত হওয়া গিয়াছে যে, রামমোহন দাসের খারিজের মোকদ্দমার সময় মহারাজ রাজধর মাণিক্য সমগ্র তালুকদারমণ্ডলীকে সন্তুষ্ট রাখিবার জন্য এইরূপ পরিবর্তন করিয়াছিলেন। ফসলের পরিবর্তন দ্বারা যৎকালে মকররী নিরিখের পরিবর্তন হইয়া আসিতেছিল, তৎকালে সহজ উপায় জমা হ্রাস বৃদ্ধি দ্বারা শান্তি স্থাপন জন্য মালিকানা দশহিস্যা ও তহশীল খরচ তালুকদারের প্রাপ্য বলিয়া ডৌলে লিখিত হইয়াছিল। এই নিয়মে শত টাকায় ৭২॥o টাকা তালুকদারের প্রাপ্য অবশিষ্ট ২৭॥০ টাকা জমিদারের প্রাপ্য হইতেছে। প্রকৃতপক্ষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে তালুকদারগণের দেয় রাজস্ব “দশোত্তরা” বা “দশহিস্যা” নিয়মে কদাকস্মিনকালে ধার্য্য হয় নাই। ১২১৫ ত্রিপুরাব্দ হইতে ১২৮১ ত্রিপুরাব্দের পূর্ব পর্য্যন্ত নুরনগর তালুকের বন্দোবস্তী বহুসংখ্যক ডৌল ও পাট্টা আমরা দর্শন করিয়াছি। তাহার সমুদয় গুলিরই অভ্যন্তরে “তালুক মজকুরের সেওয়ায় দেবোত্তর ও ব্রহ্মোত্তর ও খয়রাত ও খামার ও খানেবাড়ী হুজুরের বাহালি মিনাহায় তালুকদারি দশহিস্যা ও পাটওয়ারিয়ান তহশীল খরচ সেওয়ার খারিজান সময় আগতীয়ান” ইত্যাদি কতকগুলি বাধা বোল লিখিত আছে। ॥৫৮৩।। কিন্তু তাহার নিম্নভাগে অর্থাৎ তপছিলে জমা ধার্য্যের স্থলে (মথন ও নলের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া) গুজাস্তা জমার উপর টাকা প্রতি ৫ গণ্ডা ১০ গণ্ডা কিম্বা এক আনা দুই আনা ইজাফা ধরা হইয়াছে। কোন স্থলে গুজাস্তা জমার উপর মোটে (বিলমোক্তা) কিছু ইজাফা বা কমি ধরা হইয়াছে, এই নিয়মে বন্দোবস্ত করার রীতি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর হইতে চলিয়া আসিতেছে। জরিপ জমাবন্দি দ্বারা তালুক সমূহের স্থিত অবগত হইয়াও রাজসরকার এই নিয়মের অন্যথা করেন নাই। ১২৮১ ত্রিপুরাব্দে যদিচ ডৌল পাট্টার ফারম পরিবর্তিত হইয়াছিল এবং “দশহিস্যা” শব্দ কর্তন করিয়া তৎপরিবর্তে “স্থিতের দশাংশের একাংশ” লেখা হইয়াছিল, কিন্তু তপছিলে জমা হ্রাস বৃদ্ধির নিয়ম পরিবর্তিত হয় নাই, তাহা পূর্ববৎ চলিয়া আসিতেছে।[৩৪] ॥৫৮৪॥

১২৭৪ ত্রিপুরাব্দে হইতে রাতিব (দেবার্চ্চন খরচ), গুদারা (খেয়াঘাটের খরচ), নৌকাভাড়া (তহশীল কর্ম্মচারীগণের যাতায়াতের খরচ) ও বাট্টা[৩৫] প্রভৃতি আবওয়াবগুলি জমার সামিল ভুক্ত করা রেজেষ্টরীকৃত ডৌল সমূহে প্রকাশ পাইতেছে।

অধুনা রাজসরকার তালুকদারের সর্বপ্রকার লভ্য বিনষ্ট করত মোট স্থিতের শতকরা ২০ টাকা তালুকদারের প্রাপ্য, অবশিষ্ট ৬০ টাকা মহারাজের প্রাপ্য অবধারণ করিতে যত্নবান হইয়াছেন। প্রবল ও দুর্বলের সংঘর্ষে দুর্বলের বিনাশ অনিবার্য্য। নুরনগর ও তদন্তর্গত পরগণা সমূহের ॥৫৮৫॥ তালুক সংখ্যা সার্দ্ধ দ্বিসহস্রের অধিক হইবে। অনন্ত মোকদ্দমার স্রোতে পড়িয়া যে অধিকাংশ তালুক বিনষ্ট হইবে, ইহা বলা বাহুল্য।

আগততালুক : -নুরনগরের মধ্যে তালুকদারগণের অধীনে যে সমস্ত তালুক আছে, তাহাকে “আগত-তালুক” বলে। প্রকৃতি অনুসারে ইহাকে দরতালুক বলা যাইতে পারে। রাজকর পরিশোধ সম্বন্ধে তালুকদারগণ তাঁহাদের মারফতদার মাত্র। আগত- তালুক শব্দের ব্যাখ্যা করিতে যাইয়া অনেকে অনেক অর্থ করিয়াছেন, কিন্তু আমাদের বিবেচনায় তৎসমস্ত সম্পূর্ণ সমীচীন নহে। “আগত” অর্থ আসিয়াছে, সুতরাং আসিয়াছে যে তালুক তাহাই আগত-তালুক। সে সময় নিয়মিত রূপে রাজকর পরিশোধ করা নিতান্ত কষ্টকর ছিল এবং কর আদায় জন্য রাজকর্মচারীগণ দুর্বল তালুকদারের প্রতি শারীরিক উৎপীড়ন। করিতে ত্রুটি করিতেন না। তৎকালে দুর্বল তালুকদারগণ স্ব স্ব তালুক, প্রতিবেশী বলবান তালুকের অন্তর্ভুক্ত করিয়া আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহুকাল পূর্বে এইরূপ আগত তালুক গঠন প্রথা প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল।[৩৬] ॥৫৮৬॥ উত্তরকালে কোন তালুকের অংশ কিম্বা খণ্ড ভূমি ক্রেতাগণও আগত-তালুকদার বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন।

নুরনগর পরগণার সমস্ত তালুক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহু পূর্ববর্ত্তী। তালুকদারগণের বংশবৃদ্ধি ও বিক্রয় দ্বারা অধিকাংশ তালুকের নাম পরিবর্তিত হইয়াছে। তাহার কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হইল। ১-একমাত্র কায়েৎ রামধরের তালুক দ্বারা, দর্পনারায়ণ চৌধুরী, রঘুনাথ চৌধুরী, নন্দকুমার চৌধুরী, কাশীনাথ চৌধুরী, কৃষ্ণচন্দ্র চৌধুরী, রাজরতন চৌধুরী, শ্যামরায় চৌধুরী প্রভৃতি অনেক তালুক সৃষ্ট হইয়াছে। ২-মাইজখাড় গ্রামে চৈতন্য বল্লভ দাস নামে জনৈক “জঙ্গলবুড়ি” তালুকদার ছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে তাঁহার উত্তরপুরুষ কন্ঠমণি সেই তালুকে স্বীয় নাম জারি করেন। তদনন্তর সেই কন্ঠমণি তালুক হইতে হরিমণি, শিবরাম সাহা অন্নপূর্ণা গোবিন্দচন্দ্র ঘোষ প্রভৃতি অনেক তালুক সৃষ্ট হইয়াছে। অধুনা মূল তালুকের চতুর্থাংশ মাত্র কন্ঠমণি নামে পরিচিত হইয়া থাকে। ৩- বিদ্যাকুটের শর্ম্মা তালুক হইতে বিখ্যাত ॥৫৮৭॥ মোহরী বংশের রামগোবিন্দ শৰ্ম্মা প্রভৃতি তালুক সৃষ্ট হইয়াছে। এইরূপ ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হইতে পারে।

দর তালুক :- নিজ তালুকের কথা পূর্বে বলিয়াছি। তালুকদারদিগের উচ্ছিন্ন করিয়া ক্রমে মহারাজ নিজ তালুকের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতেছেন। এই সকল নিজ তালুক হইতে, ১২৮৮ ত্রিপুরাব্দ হইতে কতকগুলি দরতালুক দেওয়া হইয়াছে। প্রথমত নজর গ্রহণে তালুক দেওয়া হইবে বলিয়া ঘোষণা করা হয়, ১২৮৮ ত্রিপুরাব্দের আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে নজর ডাক হইয়া রাশি রাশি টাকা আগরতলার রাজকোষে দাখিল হইয়াছিল। নজর দাখিল হইলে রাজকর্মচারিগণ বলিলেন, “আকরখননাদি প্রভৃতি অন্যান্য মূল স্বত্ব ব্যতীত কেবল মাত্র খেরাজি স্বত্ব দরতালুক উল্লেখে এবং তালুকের প্রকৃত স্থিত যাহাই হউক না কেন, শতকরা ২০ টাকা দরতালুকদারের এবং ৮০ টাকা মহারাজের প্রাপ্য, এইরূপ ভাবে স্থিত মিল করিয়া, পাট্টা কবুলিয়ত লিখিত হইবে।” এই কথা শ্রবণে তালুক গ্রহীতাগণ নিতান্ত নিরুপায় হইয়া পড়িলেন; ব্রিটিস সীমারেখার বহির্ভূত স্থানে টাকা অর্পণ করিয়াছেন, আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিবার উপায় নাই। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া নানা প্রকার যন্ত্রনা ভোগ করিয়া, কেহ এক বৎসর, কেহ দেড় বৎসর, কেহ বা ততোধিককাল পরে রাজ কর্ম্মচারিগণের ইচ্ছানুরূপ কবুলিয়ত দাখিল করিয়া পাট্টা ॥ ৪৮৮॥ প্রাপ্ত হইয়াছে[৩৭]। অদ্যাপি কোন কোন ব্যক্তি ঐরূপ দরতালুক গ্রহণ করেন নাই। তাঁহাদের টাকা ও তাঁহাদিগকে প্রত্যর্পণ করা হয় নাই। ॥৫৮৯।।

.

টীকা

১. প্রাচীনকালে প্রত্যেক পরগণায় এক একজন চৌধুরী নিযুক্ত করা হইত। সেই পরগণায় শান্তি ও রাজস্ব সরবরাহ করাই তাঁহাদের কার্য্য ছিল।

২. ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তালুকদিগকে স্থানীয় মানবগণ ভূঁইয়া (ভৌমিক) বলিত। নুরনগর পরগণায় হিন্দু মুসলমান অনেক ভূঁইয়া বংশ বর্তমান আছেন তন্মধ্যে কোন কোন ব্যক্তির তালুক বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। তাহারা স্ব স্ব সমাজে সম্মানিত।

৩. রামমাণিক্যের মৃত্যুকালে ১০৯২ না হইয়া ১০৯৩ ত্রিপুরাব্দ হইবে।

৪. পং বগাসাইর অন্তর্গত “দেওয়ান চকবস্তা” নামক বৃহৎ তালুকের ১২০৫ ত্রিপুরাব্দের ১লা বৈশাখের পাট্টার সহি মোহরাঙ্কিত নকল হইতে এই সকল কথা উদ্ধৃত হইল।

৫. Dharma Manikya succeeded. The Nawab of Murshidabad deprived him of large portion of territory on the plains, locating Mogul Zeminders in them.
(J. A. S. B. Vol. XIX. P. 553)

৬. ১১২৩ বঙ্গাব্দে ১১২৬ ত্রিপুরাব্দে

৭. এই ঘটনাটি ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে জানুয়ারির একখণ্ড নিষ্পত্তিপত্রে এইরূপ লিখিত হইয়াছে, “জাহাঙ্গীরনগর সহরে চৌধুরীয়ান (নুরনগরের) খাজনা সরবরাহ করাইতেন। রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের আমলে অনন্ত মধুসূদন চৌধুরী খাজনা বাকী রাখিয়াছিল, রাজা গোবিন্দমাণিক্য বাকী খাজনা আপন জিম্বা রাখিয়া পরগণা মজকুর আপন এক্তারে আনিয়াছিল।” রাজকীয় বংশাব- লীর সহিত ধর চৌধুরীদিগের বংশাবলী ঐক্য করিলে দৃষ্ট হইবে যে, এস্থলে গোবিন্দ মাণিক্য না হইয়া ধর্মমাণিক্য হইবে। কারণ অনন্ত ও মধুসূদন কায়েত রামধরের অতি বৃদ্ধ প্রপৌত্র। ইহারা কখনই কল্যাণ মাণিক্যের পুত্রের সমসাময়িক হইতে পারে না।

৮. মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বাহাদুরের “শ্রীরামাজ্ঞা” মোহরাঙ্কিত এরূপ দুই খানি চিঠি আমাদের হস্তগত হইয়াছে তাহা উদ্ধৃত করা নিষ্প্রয়োজন।

৯. দুর্গাঙ্গির কথাটা বোধ হয় মহারাজ বিস্মৃত হন নাই।

১০. ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের একখণ্ড সহি মোহরাঙ্কিত নকল হইতে উদ্ধৃত।

১১. যমুনা দেব্যা নামীয় (তালুক রামজয় ঠাকুরের) ১২৫৬ ত্রিপুরাব্দের ১৭ই আষাঢ়ের পাট্টায় এরূপ আবদিমিনা দ্রোণ প্রতি তিন কাণি চার গণ্ডার উল্লেখ দৃষ্ট হয়। দেওয়ানের চকবস্তা প্রভৃতি অন্যান্য তালুকের পাট্টাতে আবাদিমিনার কথা লিখিত আছে। অদ্যাপি ত্রিপুরেশ্বর তরহার পার্বত্য রাজ্যে যে সকল জঙ্গল আবাদি তালুক প্রদান করিতেছেন, তাহার পাট্টাতে আবাদি মিনা দ্ৰোণ প্ৰতি তিন কাণী ৪ গণ্ডার উল্লেখ রহিয়াছে (রিয়াং দফার দেবপ্রসাদ চৌধুরী প্রভৃতির নামীয় বড় বিলনীয়ার আবাদী তালুকের ১২৮০ ত্রিপুরাব্দের ১৩ই কার্ত্তিকের পাট্টা দ্রষ্টব্য) এই শ্রেণীর তালুকদারগণ নওয়াখালীতেও ওই “মথন” বাদ পাইয়া থাকেন— ( Hunter’s Statistical Account of Bengal Vol. VI P. 308)

১২. ১। তালুকদারের প্রাপ্য আবাদিমিনা বা মথন : ৩ কাণী ৪ গণ্ডা
২। তালুকদারের মালিকানা ও তহশীল খরচ পঞ্চমাংশ : ৩ কাণী ৪ গণ্ডা
*৩। তালুকদারী নল ও প্রজা পত্তনী নলের প্রভেদ
কাণী প্রতি ৬ গণ্ডা ২ ক্ৰান্ত

হিসাবে দ্রোত প্রতি :

৪ কাণী ১৮ গণ্ডা ২ কড়া ২ ক্রান্ত
————————-
১১ কাণী ৬ গণ্ডা ২ কড়া ২ ক্রান্ত

জমিদারের প্রাপ্য বিশিষ্ট :

৪ কাণী ২৩ গণ্ডা ২ কড়া ১ ক্রান্ত
————————-
১ দ্ৰোণ

* তালুকদার ও প্রজার মধ্যে এইরূপ নলের প্রভেদ প্রাচীনকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। দেখুন :-

১। ১৮৭৫ ইং ৩ নং আপীল। জিলে ত্রিপুরার জজ সাহেবের ১৮৭৬ ইং ৩১ শে মার্চের নিষ্পত্তি। মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য আপীল্যান্ট। ভগবান চন্দ্র ধর গং রেস্পণ্ডেন্ট।

২। ৫০৬ নং ১৮৭১ ইং। কসবায় মুনসেফের ১৮৭২ ইং ৩১ শে ডিসেম্বরের নিষ্পত্তি। মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য বাদী। হরচন্দ্র ভট্টাচার্য্য গয়রহ বিবাদী। এইরূপ ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে।

১৩. নওয়াখালীর অন্তর্গত চরপার্বতীর সেটেলমেন্ট অফিসার পরিবর্তনশীল জমির তালুক জমা নির্ণয় করিতে যাইয়া শত টাকায় ৭০ টাকা তালুকদারের প্রাপ্য এবং ৩০ টাকা জমিদারের প্রাপ্য অবধারণ করিয়াছেন। See the decision of Babu Suresh Chandra Sinha, Dy. Collector of Noakhali in char Parbati settlement cases. 3rd November, 1894

১৪. দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা বিটঘর নিবাসী গঙ্গাপ্রসাদ নিয়োগীর নামীয় নিষ্কর সনন্দের কথা উল্লেখ করতে পারি।

১৫. Letter from Mr. J. Butter, To the collector of Tipperah 13th January 1792.

১৬. সেই গ্রাম্য কবির গীতাংশ, ‘যাহা অদ্যাপি নুরনগরবাসীদিগের নিকট শ্রুত হওয়া যায়, তাহা এস্থলে উদ্ধৃত হইল। কিন্তিৰ্য্যস্য স জীবতি।
শ্যামাধরী লক্ষ্মীছাড়া। কৃষ্ণকান্ত ভাতে মরা।।

চণ্ডীপ্রসাদ অতি বুড়া। তিনজনাতে মিছিল খারা

** সাক্ষী দিয়ে তারা। কল্লে মোদের দফা সারা॥

১৭. ৩০ নং মতফরকা সন ১৮৪৯ ইং ত্রিপুরার জজ মেঃ টমাস ব্রুস সাহেবের ১৮৯৪ ইং ২৭ শে মার্চের নিষ্পত্তি (রোবকারী)।
হরসুন্দরী জওজে নীলকন্ঠে বৰ্ম্মণ মতোফা … মজহরা
মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বাহাদুর … তরফছানী

১৮. Weekly Reporter Vol. VII P. 235. Vol. IX P. C. P. 3; Vol. XIX. P. 142.

১৯. ৩৯৬৬ নং, নিষ্পত্তির তারিখ ১৮১২ ইং ১১ই সেপ্টেম্বর। রামসন্তোষ দে দরইজারদার বাদী, মাণিক্যরাম বর্দ্ধন বিবাদী।

২০. হিন্দুদিগের মধ্যে অনেকেই ময়না, তোতা প্রভৃতি পক্ষী প্রতিপালন করিয়া থাকেন। তাঁহারা আগ্রহের সহিত সেই পাখীকে ইষ্টদেবতার নাম (“রাধাকৃষ্ণ” “শিবদুর্গা” প্রভৃতি শব্দ) উচ্চারণ করিতে শিক্ষাদান করেন। কিন্তু মহারাজ বাহাদুরের বন্দোবস্ত কর্মচারী কমলাকান্ত বকসীর প্রতিপালিত ময়না শিক্ষা করিয়াছিল ‘কালিকা! জুতামার, জুতামার, জুতামার, জুতামার।

২১. এই তাহুত প্রথা দ্বারা সর্বদা নররুধিরে নুরনগর রঞ্জিত হইত, ত্রিপুরার তদানীন্তন জজ মেটকাফের একখণ্ড নিষ্পত্তিপত্র হইতে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করিয়া তাহার দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিতেছি :

Raj Chandra Biswas holds possession of a Talooq, his right to which dates prior to the Deceenial settlement. Nilcomal Bhattacharjee taking a Patta from the Maharaja of Tipperah which the latter had no power to grant or the former to accept, Proceeds to oust him. This leads to hot blood and mutual aggression on each other Ryats’

২২. Appeal No. 6475, decided on 2nd August, 1843. By the Judge of Tipperah.

২৩. কীৰ্ত্তিচন্দ্র ন্যায়বাগীশ এবং অন্যান্য আপীল্যান্ট মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বাহাদুর রেস্পডেন্ট। সদর আমিন রায় রামলোচন ঘোষ বাহাদুরের ১৮৪০ ইং ২৩শে জানুয়ারী নিষ্পত্তির বিরুদ্ধে আপীল। ত্রিপুরার করিনিলিয়াস কার্ভে সাহেবের ১৮৪১ ইং ৩০ শে মার্চের নিষ্পত্তি।

২৪. ২২৬ নং ১৮৬৯ ইং আপীল। বীরচন্দ্র যুবরাজ আপীলান্ট, রামকিশোর দেব গং রেস্পাডেন্ট। ত্রিপুরার জজ সাহেবের ১৮৭০ খ্রিঃ ২১ শে মার্চের নিষ্পত্তি। ২৫. খাস আপিল ৯২৮ নং ১৮৭০ ইং। বীরচন্দ্র মাণিক্য আঃ। রামকিশোর দেব গং রেঃ। ১৮৭০ ইং ৫ই সেপ্টেম্বরের নিষ্পত্তি।

২৬. ১, ২, ৩, ৪ নং ১৯৭২ ইং আপীল। জাহ্নবা গং আঃ। বীরচন্দ্র মাণিক্য রেঃ। ১৮৭২ ইং ৩০শে ডিসেম্বরের নিষ্পত্তি।

২৭. খাস আপীল ৮৭০, ৮৭১, ৮৭২, ৮৭৩ নং ১৮৭৩ ইং। বীরচন্দ্র মাণিক্য আঃ। রাধচরণ লস্কর গং রেঃ। নিষ্পত্তির তারিখ ১৮৭৪ ইং ১২ ফেব্রুয়ারী।

২৮. মহারাজের পক্ষে কেম্পবল সাহেব বাদী, শিবদাস চক্রবর্ত্তী নামীয় জাল মোহরের মোকদ্দমায় রাজসরকার পক্ষে বিশুদ্ধ মোহর প্রদর্শন জন্য যে সকল চিঠি দাখিল করিয়াছিলেন। সম্প্রতি সেটেলমেন্ট অফিসার সমক্ষে রাজসরকার হইতে তাহাও কৃত্রিম বলিয়া প্রকাশ করা হইয়াছে।

২৯. যে সকল মোকদ্দমায় মহারাজ জয়লাভ করেন সেগুলিকে আমরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিতে পারি, ১- একতরফা ডিক্রি, ২- যোগসাজেসী ডিক্রি, ৩- বিতর্কিত ডিক্রি। যোগসাজেসী মোকদ্দমাগুলি ডিক্রি হওয়ার পরেই ডিক্রিপ্রাপ্ত জমা হইতে প্রচুর পরিমাণে বাদ দিয়া বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। কোন কোন স্থলে পূর্বে জমায় রাজস্ব পরিশোধ হইতেছে।

৩০. পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।

৩১. কয়েকটি জমাবৃদ্ধির মোকদ্দমায় বিচারপতিগণ দশ হিস্যা শব্দের অর্থ শতকরা দশ টাকা করিয়াছেন। মহারাজ যেরূপ মকররী তালুককে তকসিসী শ্রেণীতে সন্নিবিষ্ট করিবার জন্য যত্ন করিতেছেন, সেইরূপ তকসিসী তালুকের জমা বৃদ্ধির মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে মকররী অবধারণ জন্য চেষ্টা করিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহারা তালুক পরিবর্তনশীল জমার সাব্যস্ত হইলে কি নিয়মে জমা ধাৰ্য্য হইবে, তৎসম্বন্ধে কোন প্রমাণ উপস্থিত করেন না। সুতরাং মহারাজের আরজি ও তৎপ্রদত্ত বাচনিক প্রমাণ দ্বারা দশ হিস্যা অর্থ শতকরা দশ টাকা অবধারিত হইয়া থাকে।

৩২. ডৌল হইতে যে কয়েকটি কথা উদ্ধৃত করা হইয়াছে; তাহার সকলগুলি শব্দ সমভাবে সকল ডৌলে ব্যবহৃত হয় নাই।

৩৩. ইহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমরা ত্রিপুরার সাবজজ আদালতের ১৮৭৭ ইং ৩৫ নং, মহারাজা বাহাদুর বাদী ও অফীকন্নেছা বিবাদীনির নামীয় জমা বৃদ্ধির মোকদ্দমায় ১২৮৪ বঙ্গাব্দের ১৬ অগ্রহায়ণের বাদী মহারাজের প্রদত্ত একখণ্ড দরখাস্ত হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি : “উপরোক্ত নম্বরের মোকদ্দমায় প্রতিবাদী সহিত রফামতে তালুক মজকুরের সাবেক জমা ১০৫০ টাকার উপর ফি টাকাতে তিন আনা হিসাবে ইজাফা ১৯৬ টাকা ১৪ আনা ও বাট্টা গং বাবত ৯০ টাকা ৬ আনা ৬ পাই একুনে মং ১৩৩৭ টাকা ৪ আনা ৬ পাই জমায় ১২৮৭৬ সন হইতে এগার সনা মেয়াদে আমার সরকারে ডৌলকবুলিয়‍ দাখিল করাতে বন্দোবস্তী চিঠি দেওয়া হইয়াছে।”

৩৪. টাকা প্রস্তুত হয় গবর্ণমেন্টের টাকাশালে, সেই টাকায় “কম ওজন বাট্টা” নুরনগরের তালুকদারগণ ত্রিপুরার মহারাজকে পরিশোধ করিয়া থাকেন। কসবার সভায় বক্তৃতাকালে আমরা যখন বে-আইনী আবওয়াবের কথা উল্লেখ করি, তৎকালে মহারাজের জনৈক প্রধান-কর্মচারী বলিয়াছিলেন যে, ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের আট আইন প্রচারের পর হইতে এই সকল আবওয়াব বন্ধ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু তাহার ইহা স্মরণ করা উচিত ছিল যে, বচিয়ারা নিবাসী দয়াময়ী প্রভৃতির নামীয় ১২৯৮ ত্রিপুরাব্দের (১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের) ২৭ শে ভাদ্রের বর্ত্তমান মহারাজের প্রদত্ত পাট্টাতেও “রাতিব, গুদারা, নৌকাভাড়া পনের আনা এবং “কমওজন বাট্টা তিন আনা” স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে।

৩৫. কতকগুলি আগত তালুকের ইতিহাস, আগত তালুক শব্দের অর্থ এবং নিম্নলিখিত নিষ্পত্তি দ্বারা আমাদের মত পোষণ করিতেছি। আপিলেন্ট ডিক্রির বিরুদ্ধে আপীল ৪৯০ নং ১৮৮০ ইং। বীরচন্দ্র মাণিক্য আঃ। দীননাথ দাস গং রেঃ। হাইকোর্টের ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে এপ্রিলের নিষ্পত্তি।

৩৬. আমরা কতকগুলি দর তালুকের পাট্টা দর্শন করিয়াছি। আদর্শস্বরূপ রামলোচন বর্দ্ধন তালুকের হিং আট আনার বাবত ঈশানচন্দ্র নামীয় ১২৮৯ ত্রিপুরাব্দের ১লা শ্রাবণের পাট্টার কথা উল্লেখ করিতে পারি। এই পাট্টা ১৮৭৯ ইং ২৪শে সেপ্টেম্বর কসবা সবরেজেষ্টার কর্তৃক রেজেষ্টারী হইয়াছে। মজকুর :- পূর্বোক্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *