সপ্তম অধ্যায়—চণ্ডমুণ্ড বধ

সপ্তম অধ্যায়—চণ্ডমুণ্ড বধ

ঋষি কহিলেন, অনন্তর শুম্ভের এ‌ই প্রকার আজ্ঞা প্রাপ্ত হ‌ইয়া চণ্ডমুণ্ড-প্রমুখ দৈত্যগণ চতুরঙ্গবল-সমন্বিত হ‌ইয়া অস্ত্রসমূহ উত্থাপিত করত গমন করিল। তাহারা গমন করিয়া দেখিল যে, প্রকাণ্ড সুবর্ণময় হিমাচলশিখরে সিংহের উপর দণ্ডায়মানা হ‌ইয়া দেবী মৃদু মৃদু হাস্য করিতেছেন। সে‌ই অসুরগণ ও তাহাদের সমীপবর্ত্তী অন্যান্য অসুরগণ দেবীকে এ‌ই প্রকার অবলোকনান্তে (দেখার পর) চাপাকর্ষণ (ধনুকে টান দেওয়া) ও অসি (তলোয়ার) গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহাকে ধারণ করিবার (ধরার) নিমিত্ত উদ্যোগ করিল। তখন অম্বিকা সে‌ই সকল শত্রুর প্রতি সাতিশয় ক্রোধ করিলেন। সে‌ই কোপে দেবীর বদন তৎক্ষণাৎ কালীবর্ণ হ‌ইয়া গেল। অনন্তর দেবীর ভ্রুকুটী-কুটিল ললাট-ফলক হ‌ইতে শীঘ্র আশ্চর্য্য খট্বাঙ্গ-ধারিণী (খাটের পায়ার মত দেখতে মুগুর ধারণ করে আছেন যিনি), নরমালা-বিভূষণা, অসিপাশায়ুধা (অসি ও পাশ নামক অস্ত্র ধারণ করে আছেন যিনি), করাল-বদনা ও কৃষ্ণবর্ণা এক দেবী নিষ্ক্রান্তা হ‌ইলেন। সে‌ই দেবীর পরিধান ব্যাঘ্রচর্ম্ম ও মাংস সকল শুষ্ক; তিনি দেখিতে অতি ভয়ঙ্করী। তাঁহার বদন অতি বিস্তৃত, জিহ্বা লক্‌ লক্‌ করিতেছে, সূতরাং তাঁহার আকৃতি অতিশয় ভয়জনিকা (ভয় জাগায়)। তাঁহার নয়ন গাঢ়নিমগ্ন (ভেতরে ঢোকা বা কোটরাগত) ও রক্তবর্ণ এবং তাঁহার ভয়ঙ্কর নাদে দিক্‌ সকল আপূরিত। ১-৭

অনন্তর সে‌ই ভয়ঙ্করী দেবী দৈত্য-সৈন্য-সমূহের উপর বেগে পতিত হ‌ইয়া মহাসুর সকলকে বিনাশ করিতে করিতে অসুরদিগের সৈন্যগণকে ভক্ষণ করিতে লাগিলেন। দেবী—পার্ষ্ণিরক্ষক (সেনাবাহিনীর পশ্চাৎ অংশ যারা রক্ষা করে), অঙ্কুশগ্রাহী যোদ্ধা (হাতির চালক বা মাহুত) ও ঘন্টার সহিত হস্তি সমূহকে এক হস্তে গ্রহণ করিয়া মুখে নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন এবং অশ্ব, রথ ও সারথির সহিত যোধগণকে (যোদ্ধাদের) গ্রহণপূর্ব্বক মুখে নিক্ষেপ করিয়া অতি ভয়ঙ্কররূপে চর্ব্বন করিতে লাগিলেন। কাহাকে কেশে, কাহাকে গলদেশে, কাহাকে বা পাদ (পা) দ্বারা আক্রমণ করিয়া, বিমর্দ্দিত করিতে প্রবৃত্তা হ‌ইলেন। সে‌ই সকল অসুর-নিক্ষিপ্ত শস্ত্র ও মহাস্ত্রনিকরকে দেবী রোষপূর্ব্বক মুখে গ্রহণ করত দশন (দাঁত) দ্বারা চর্ব্বন করিতে লাগিলেন। বলবান্‌ প্রকাণ্ডশরীর অসুরগণের সৈন্যসমূহকে এ‌ই প্রকারে মর্দ্দিত করত দেবী কাহাকেও ভক্ষণ করিলেন, কাহাকেও বা বিতাড়িত করিলেন। কোন কোন অসুর খড়্গাঘাতে বিনষ্ট হ‌ইল, আবার কেহ কেহ বা খট্বাঙ্গ-তাড়িত অথবা দন্তাগ্র দ্বারা প্রহৃত হ‌ইয়া বিনাশ প্রাপ্ত হ‌ইল। অসুরগণের সে‌ই মহতী সেনা ক্ষণকালমধ্যে বিনাশিত হ‌ইল দেখিয়া চণ্ডাসুর, অতি ভীষণা সে‌ই কালীদেবীর প্রতি বেগে ধাবমান হ‌ইল এবং মুণ্ডাসুর সে‌ই ভীমাক্ষী (ভয়ঙ্কর চোখ যার) দেবীকে অতি ভয়ঙ্কর শরবৃষ্টি ও সহস্র সহস্র চক্র নিক্ষেপ করত আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। সে‌ই চক্রসমূহও সে‌ই দেবীমুখে প্রবিষ্ট হ‌ইতে লাগিল এবং প্রবেশকালে সে‌ই চক্র সকল মেঘমধ্যে প্রবেশোন্মুখ বহুসূর্য্য-মণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। অনন্তর ভৈরবনাদিনী কালীদেবী অতিক্রোধে ভয়ঙ্কর হাস্য করিতে লাগিলেন। হাস্যকালে করালমুখ-মধ্যে দুর্দ্দর্শ (দুর্নিরীক্ষ্য বা দর্শন করা দুঃসাধ্য) দন্ত-সমূহের প্রভায় তিনি উজ্জ্বল হ‌ইলেন। তখন দেবী মহাসিংহের উপর উত্থানপূর্ব্বক চণ্ডাসুরের প্রতি ধাবমানা হ‌ইলেন এবং কেশাকর্ষণ করত সে‌ই অসি দ্বারা তাহার মস্তক ছেদন করিলেন। চণ্ডকে নিপতিত দেখিয়া মুণ্ড, দেবীর প্রতি ধাবিত হ‌ইল। তখন দেবী ক্রোধে তাহাকেও খড়্গাঘাত দ্বারা ধরাশায়ী করিলেন। ৮-২০

অনন্তর হতাবশিষ্ট সৈন্যগণ (সেনাবাহিনীর বাকি অংশ যারা নিহত হয় নি) সুমহাবীর্য্য (মহাবীর) চণ্ড ও মুণ্ডকে নিপাতিত দেখিয়া ভয়াতুর হ‌ইয়া দিগ্‌দিগন্তরে পলায়ন করিল। তৎপরে চণ্ড-মুণ্ডাসুরের মস্তক গ্রহণ করত কালী, কৌষিকী দেবীর নিকট উপস্থিত হ‌ইয়া প্রচণ্ড অট্টহাসের সহিত বলিলেন, আমি মহাপশু চণ্ডমুণ্ড নামক অসুরদ্বয়কে হনন করিয়া তোমার নিকট উপহার প্রদান করিলাম; কিন্তু তুমি যুদ্ধযজ্ঞে নিজে‌ই শুম্ভ ও নিশুম্ভকে হনন করিবে। ঋষি কহিলেন, সে‌ই চণ্ড ও মুণ্ড নামক মহাসুরদ্বয়কে তদবস্থায় (সে‌ই অবস্থায়) আনয়ন করিতে দেখিয়া কল্যাণী চণ্ডিকা দেবী কালীকে অতি মধুর বাক্যে বলিলেন, “হে দেবি! চণ্ড ও মুণ্ডকে গ্রহণ করিয়া তুমি উপস্থিত হ‌ইয়াছ, এ‌ই জন্য লোকমধ্যে তুমি চামুণ্ডা বলিয়া কীর্ত্তিত হ‌ইবে।” ২১-২৫

সপ্তম অধ্যায় সমাপ্ত॥৭॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *