সপ্তম অধ্যায় – অগ্রহার ব্যবস্থার গোড়াপত্তন (৩০০-৬৫০ খ্রীষ্টাব্দ)
প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ থেকে সপ্তম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সাড়ে তিনশ বছর এক অসামান্য সৃজনশীল যুগ বলে প্রতিভাত। সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখায় অভূতপূর্ব উৎকর্ষ দেখা যেতে থাকে। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ধ্রুপদী রূপ এই আমলেই মূর্ত হয়। সাধারণভাবে এই সময়সীমা ‘গুপ্ত যুগ’ বলে পরিচিত। ‘গুপ্ত যুগ’ কথাটি কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক কালক্রম নয়; কারণ গুপ্ত সাম্রাজ্য আঃ ৩১৯-২০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৫৫০ বা ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিরাজমান ছিল। কিন্তু গুপ্ত শাসনকালে যে সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা দেখা যায় তা শুধুমাত্র গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ ছিল না। সাংস্কৃতিক জীবনের কিছু বিশেষ লক্ষণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের বাইরে ও গুপ্তশাসনের অবসানের পরও সক্রিয় ছিল। ফলে ‘গুপ্ত যুগ’ কথাটির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ব্যাপকতর সংজ্ঞা আছে।
গুপ্ত সম্রাটদের আমলে গুপ্ত সাম্রাজ্য নিঃসন্দেহে উত্তর ভারতের প্রধানতম রাজনৈতিক শক্তি ছিল। কিন্তু দাক্ষিণাত্যে রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুপ্তদের প্রায় সমকক্ষ বাকাটক বংশীয় রাজারা রাজত্ব করছিলেন। তাঁরা কেবলমাত্র গুপ্তদের সমকালীন অন্যতম প্রথম সারির রাজনৈতিক শক্তি নন, দুই প্রধান সাম্রাজ্যের মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মৈত্রী ও সহযোগিতার কথাও রাজনৈতিক ইতিহাসে সুবিদিত। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে উত্তর ভারতে গুপ্তদের অধীনস্থ শক্তিগুলি স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করে এবং পারস্পরিক ক্ষমতা বিস্তারের দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়। এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ক্রমে কনৌজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কনৌজকে কেন্দ্র করে সুবৃহৎ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার কৃতিত্ব অবশ্যই পুষ্যভূতি বংশীয় হর্ষবর্ধনের (আদি রাজ্য স্থান্বীশ্বর, আধুনিক থানেশ্বর, হরিয়ানা) প্রাপ্য। তবে কনৌজের আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে শশাঙ্কের নেতৃত্বে গৌড়ের প্রতিরোধও সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম মুখ্য ঘটনা। গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবসানের পর আরও বেশ কিছু দিন দাক্ষিণাত্যে বাকাটক আধিপত্য বিরাজ করেছিল, বাকাটক বংশের পতনের পর দাক্ষিণাত্যের মধ্য ও পশ্চিমভাগে বাতাপীর চালুক্য রাজাদের উত্থান দেখা যায়। ষষ্ট ও সপ্তম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যের রাজনীতির মুখ্য আকর্ষণ চালুক্য ও দক্ষিণ ভারতের (কাঞ্চীপুরম অঞ্চলের) পল্লববংশের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতার লড়াই। বিভিন্ন রাজশক্তির উত্থান পতন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার দরুন রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলেও (৫৫০ খ্রীঃ-রপর এই পালাবদলের গতি দ্রুততর হয়েছিল) রাজনৈতিক স্থিতি মোটের উপর বিঘ্নিত হয়নি। এমনকি পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি ও ষষ্ঠ শতকের গোড়ায় মধ্য এশীয় হূণদের অভিযানে রাজনৈতিক অবস্থা নিতান্ত সাময়িকভাবেই আলোড়িত হয়েছিল; তা-ও এই অভিযানের ফল উত্তর ভারতেই দেখা যায়—দাক্ষিণাত্যের ক্ষেত্রে তার প্রভাব নেই বললেই চলে।
কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে রাজনৈতিক সুস্থিতির এই পরিমণ্ডলে সাংস্কৃতিক বিকাশের অনুকূল পরিবেশ পাওয়া গিয়েছিল। এরই সঙ্গে সাংস্কৃতিক জীবনের বস্তুগত ভিত্তি সম্বন্ধে যথাযথভাবে অবহিত হওয়া দরকার। রাজনৈতিক পরিবেশের মতই অর্থনৈতিক অবস্থা সাংস্কৃতিক জীবনকে বহুক্ষেত্রেই প্রভাবিত করে। সাড়ে তিনশ বছর ব্যাপী আলোচ্য আমলের অর্থনৈতিক জীবনে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপের কিছু পরিচয় সমকালীন তথ্যসূত্রে বিধৃত; তবে যে লক্ষণটি এই সময়কার অর্থনৈতিক জীবনকে বিশিষ্টতা দিয়েছে তা হল ‘অগ্রহার’ ব্যবস্থা। অতি সংক্ষেপে এই ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য ধর্মস্থান বা পুরোহিত সম্প্রদায়ের উদ্দেশে নিষ্কর ভূসম্পদ দান। এই ভূসম্পদ গ্ৰামদান বা নির্দিষ্ট পরিমাণ ভূখণ্ড দানের মাধ্যমে গ্রহীতার উদ্দেশে হস্তান্তরিত হত। ব্রাহ্মণ, দেবমন্দির ও বৌদ্ধবিহারের উদ্দেশে এই জাতীয় নিষ্কর ভূসম্পদ দানের কথা জানা আছে। যদিও এই প্রকার ভূমিদানের নজীর প্রাক ৩০০ খ্রীষ্টাব্দে সাতবাহন আমলে অজানা ছিল না, কিন্তু এই ব্যবস্থার ব্যাপকতা ও নিয়মিত রূপ সর্বপ্রথম ৩০০ খ্রীঃ-এর পর থেকেই দেখা যেতে থাকে। খ্রীঃ ৩০০-এর আগে ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে পৃষ্ঠপোষকতা করার রেওয়াজ নিশ্চয়ই ছিল; তবে সেই পৃষ্ঠপোষকতা সাধারণত ব্যক্তিগত উদ্যোগের মারফৎ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি দানের মাধ্যমে ঘটত। শক, সাতবাহন, কুষাণ, ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজারা নিশ্চয়ই বৌদ্ধবিহারে দান করতেন, কিন্তু পাশাপাশি বহু বণিক, কারিগর ও পেশাদারী বৃত্তির মানুষও অনুরূপ দান করতেন। কিন্তু ৩০০ খ্রীঃ এর পর থেকে ব্রাহ্মণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দানের জন্য ভূসম্পত্তিই মূলত হস্তান্তরিত হতে থাকে ও এই দানের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর ভূমিকা ক্রমেই প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। এই নতুন পদ্ধতি ও ব্যবস্থার ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা ও বিশেষত কৃষি অর্থনীতি কি আকার নিল, তা এই অধ্যায়ের প্রধান আলোচনার বিষয়।
ভূসম্পদ হস্তান্তরের ঘটনা সাধারণত তামার ফলকে রাজকীয় ‘শাসন’ হিসেবে উৎকীর্ণ হয়েছে; এই জাতীয় তামার ফলক বা ‘তাম্রপটু’ আলোচ্য সময়ের অর্থনৈতিক ইতিহাস জানার প্রধান ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপাদান। সমকালীন মুদ্রা ও উৎখনন থেকে পাওয়া বিবিধ পুরাবস্তুও তথ্যসূত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। সৃজনশীল সাহিত্যেও (যেমন কালিদাসের কাব্য) তৎকালীন জীবনযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়, যদিও তা খুব নিয়মিত নয়, সর্বদা বাস্তাবানুগও নয়। ধর্মশাস্ত্রগুলির মধ্যে নারদ ও বৃহস্পতির স্মৃতিগ্রন্থের উপযোগিতা অনস্বীকার্য। অমরকোশ-এও সমকালীন জীবনের নানা সংবাদ পাওয়া যায়। সমসাময়িক ইতিহাসের তথ্য বাণভট্টের হর্ষচরিত, দণ্ডীর দশকুমারচরিত জাতীয় রচনাতেও উপস্থিত। এই আমলে অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক তথ্যসূত্র আছে; এগুলি হল চীনা পরিব্রাজক ফাহিয়েনের বিবরণ (পঞ্চম শতকের প্রথম দিকে ভারতে আগমন), কসমাস ইন্ডিকোপ্লয়েস্টেস-এর ক্রিশ্চিয়ান টপোগ্রাফী (ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে রচিত) ও চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ (ভারত ভ্রমণকালে ৬২৯ থেকে ৬৪৫ খ্রীঃ)। হিউয়েন সাঙ-এর অভিজ্ঞতা দুটি সূত্রে বিধৃত: প্রথমটি তাঁর স্বরচিত ভ্রমণবৃত্তান্ত তা-তাং-সি-ইউ-কি (বা সংক্ষেপে সি-ইউ-কি) ও দ্বিতীয়টি সমন হুই-লির লেখা হিউয়েন সাঙের জীবনী।
॥ ২ ॥
অর্থনৈতিক অবস্থার আলোচনা করতে গেলে যে বিষয়টি প্রথমেই নজরে পড়ে তা হল কৃষি অর্থনীতির অব্যাহত গুরুত্ব। আগেই বলা হয়েছে এই সময়ে তাম্রপট্ট দ্বারা অগ্রহার জমি দানের বহু নিদর্শন পাওয়া যায়। তাম্রপট্রগুলির থেকে ভূসম্পদ হস্তান্তরের যেমন খবর পাওয়া যায়, তেমনই কৃষি অর্থনীতির প্রাসঙ্গিক তথ্যও জানা যায়। তাই কৃষি অর্থনীতি সম্বন্ধে তথ্যের পরিমাণও সম্ভবতঃ শিল্প বা বাণিজ্যের থেকে বেশী।
কৃষি উৎপাদন সমগ্র উপমহাদেশেই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ও সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই সম্ভবত কৃষিজীবী। সপ্তম শতকের প্রথমার্দ্ধে হিউয়েন সাঙ কার্যত গোটা উপমহাদেশই ভ্রমণ করেছিলেন; ফলে প্রত্যক্ষদর্শীর মতামত তাঁর রচনায় দেখা যায়। তিনি সমগ্র উপমহাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বচ্ছল কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার কথা বলেছেন; বহু ফলনশীল ভারতীয় কৃষি অর্থনীতির প্রশংসাই তিনি করে গিয়েছেন। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে ধান উৎপাদনই ছিল সর্বপ্রধান। কালিদাসের কাব্যে বঙ্গের ধানের প্রসিদ্ধির কথা উল্লিখিত; গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় যে বহুরকম ধানের চাষ বিশেষত শালি ধান—হত সে কথাও কালিদাস জানিয়েছেন। হিউয়েন সাঙ-এর বর্ণনায় আছে যে মগধের ধান ছিল সুগন্ধী ও সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা তা বিশেষ পছন্দ করতেন। তিনি রাজস্থানের বৈরাট অঞ্চলের আর এক প্রকার ধানের বর্ণনা দিয়েছেন যে ধান ষাট দিনে পাকত। হর্ষচরিতে বলা হয়েছে স্থান্বীশ্বরে ধান ও গম দুইই উৎপন্ন হত; হরিয়ানার অপেক্ষাকৃত কম আর্দ্র জলবায়ু সম্ভবত গম ফলানোর পক্ষে অনুকূল ছিল। বাণভট্ট স্থান্ধীশ্বরে আখ চাষেরও উল্লেখ করেছেন; এই আখ পৌণ্ড্র জাতীয় ছিল। পৌণ্ড্র নামটি ‘পুণ্ড্র’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘পুণ্ড্র’ দেশ বলতে উত্তরবঙ্গের ভূখণ্ডকে বোঝাত, যে ভূখণ্ড বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া জেলার অন্তর্ভুক্ত। উপরের আলোচনা থেকে অনুমান করা চলে যে পুণ্ড্র দেশের আখ ছিল বিশেষ প্রসিদ্ধ, এবং এই জাতীয় আখ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ফলানো হত। কালিদাসের রঘুবংশ-এ শুধু আখ উৎপাদনের কথাই নেই, কৃষক রমণীরা আখ গাছের ছায়ায় বসে ধান গাছের শোভা দেখছেন, এমন একটি অনুপম বর্ণনাও আছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ধান ও আখ যুগপৎ চাষ করার রেওয়াজ ছিল। অর্থাৎ একই সঙ্গে খাদ্যশস্য ও পণ্যশস্যের উৎপাদন পদ্ধতি জানা ছিল। অপর কয়েকটি পণ্যশস্যের উল্লেখ পাওয়া যাবে অমরকোশে: এগুলি হল তুলো, তিল, সর্ষে ও নীল। এর মধ্যে তুলো ও নীল বস্ত্রশিল্পের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ; আর তিল ও সর্ষে থেকে তেল উৎপাদন হত। দক্ষিণ ভারতের সুগন্ধী উৎপাদন এ যুগেও অব্যাহত ছিল; অমরকোশে দক্ষিণ ভারতের গোলমরিচ, এলাচ ও সুপারী উৎপাদনের উল্লেখ দেখা যাবে। বরাহমিহির তাঁর বৃহৎসংহিতায় জানিয়েছেন যে জাফরান উৎপন্ন হত কাশ্মীরে।
বিভিন্ন ধরনের ফসল সম্ভবত উৎপন্ন হত বিভিন্ন প্রকার জমিতে; অমরকোশে যেমন নানা রকম ফসলের কথা জানা যায়, তেমনই জমির প্রকারভেদের বিষয়ও উল্লিখিত। অবশ্য কোন ফসল কোন রকম জমিতে ফলানো হত সে বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দেখা যায় না। অমরকোশে অন্তত বারো রকম জমির কথা বলা হয়েছে: (১) ‘উর্বরা’, (২) ‘ঊষরা’, (৩) ‘মরু’, (৪) ‘অপ্রহত’ (যে জমিতে লাঙ্গল চালানো হয়নি), (৫) ‘সাদ্বল’ (ঘাস জমি), (৬) ‘পঙ্কিল’, (৭) ‘জলপ্ৰায়মনুপম্’ (যে জমি জলের কাছে অবস্থিত), (৮) ‘কচ্ছ’ (জলা বা জলমগ্ন), (৯) ‘শর্করা’, (১০) ‘শর্কাতী’, (১১) ‘নদীমাতৃক’ ও (১২) ‘দেবমাতৃক’ (যে জমিতে প্রাকৃতিক সেচের ব্যবস্থা আছে)। কিন্তু লেখমালায় বিভিন্ন জমির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তার নাম অমরকোশের তালিকা থেকে অন্যরকম। প্রাচীন বাংলা থেকে গুপ্তকালীন যে তাম্রশাসনগুলি পাওয়া গিয়েছে সেখানে বিভিন্ন প্রকার জমির নাম দেখা যায়: (১) ‘ক্ষেত্র’—ক্ষেত্র বলতে সাধারণভাবে যে কোনও জমিই বোঝায়; কিন্তু গুপ্ত তাম্রশাসনে ‘ক্ষেত্র’ কথাটি কৃষিজমির সমার্থক, অর্থাৎ যে জমিতে উৎপাদন সম্ভব। এই অর্থেই ‘বাপক্ষেত্র’ (যে ক্ষেত্রে বীজ বপন করা হয়েছে বা বীজবপন করা যায়) কথাটি ধর্মাদিত্যের ফরিদপুর ব্যবহৃত (এই তাম্রশাসন ধর্মাদিত্যের তৃতীয় রাজ্যবর্ষে সম্ভবত খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে উৎকীর্ণ)। (২) ‘অপ্রহত’ (যে জমিতে চাষ হয়নি); (৩) ‘খিল’ বা ‘খিলক্ষেত্র’–‘খিল’ বলতে সাধারণত পতিত জমিকে বোঝায়; তবে নারদস্মৃতি অনুসারে এক বছর অকর্ষিত থাকলে জমি ‘অর্দ্ধখিল হয়, তিন বছর অকর্ষিত থাকলে ‘খিল’ ও পাঁচ বছর অকর্ষিত থাকলে তা ‘অরণ্যে পরিণত হয়। ‘অপ্রহত’ ও ‘খিল’ কথা প্রায় সমার্থক; কিন্তু গুপ্ত তাম্রশাসনে বহুবার ‘অপ্রহত’ ও ‘খিল’ দুই শব্দই একই সঙ্গে বলা আছে। ফলে মনে করা চলে যে এই দুই পরিভাষার মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য আছে। ‘অপ্রহত’ বলতে বোধহয় একেবারে অনাবাদী জমি বোঝাত, কিন্তু ‘খিল’ বা ‘খিলক্ষেত্র’ সম্ভবত আবাদী জমি কিন্তু যা চাষ না করে পরিত্যক্ত অবস্থায় রাখা ছিল। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে কোনও জমিতে টানা কিছু সময় চাষ করার পর তাকে ইচ্ছে করেই অকর্ষিত রাখার প্রথা ভারতে অজানা নয়; এর দ্বারা বহু-ব্যবহৃত জমির উর্বরতা শক্তি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। (৪) ‘অপ্রদ’ বা ‘অপ্রদা’—এই শব্দটির অর্থ খুব নিশ্চিত নয়। দামোদরপুর থেকে পাওয়া পাঁচটি তাম্রশাসন সম্পাদনা ও অনুবাদ করার অসামান্য কৃতিত্বের যিনি অধিকারী, সেই প্রসিদ্ধ সংস্কৃতজ্ঞ রাধাগোবিন্দ বসাক ‘অপ্রদা’ ভূমি বলতে এমন জমি বোঝান, যা আগে কখনও দেওয়া হয়নি। প্রাচীন ভারতীয় লেখমালা বিষয়ে প্রবাদপুরুষ দীনেশচন্দ্র সরকারের মত হল ‘অপ্রদা’ এমন জমি যা হস্তান্তরিত করা যায় না। কিন্তু এই দুই ব্যাখ্যা খুব সন্তোষজনক মনে হয় না; বসাক ও সরকার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেই অর্থ দুটি ধরলে লেখমালায় ‘অপ্রদা’-র পরিবর্তে ‘অপ্রদত্ত’ (যা পূর্বে দেওয়া হয়নি) ও ‘অপ্রদেয়’ (যা দেওয়া যায় না) শব্দ ব্যবহারই শ্রেয় ছিল। ‘অপ্রদা’ কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ গ্রহণ করাই বোধহয় এ ক্ষেত্রে ঠিক হবে: যা কিছু দেয় না তা-ই ‘অপ্রদ’ বা ‘অপ্রদা’। এই শব্দ যখন ভূখণ্ডের বিশেষণ হিসেবে প্রযুক্ত হয় তখন সম্ভবত এমন জমি বোঝায় যেখানে কোনও উৎপাদন হয় না। অর্থাৎ এই কথাটি ‘অপ্রহত’ শব্দের প্রায় কাছাকাছি অর্থ বোঝাত। প্রায় এইরকম ভূখণ্ডই গুপ্তকালীন প্রাচীন বাংলায় ‘আদ্যস্তম্ব’ বলে অভিহিত; অর্থাৎ যে জমি আদিম লতাগুল্ম, ঝোপঝাড়ে আচ্ছন্ন। এই জাতীয় জমিতে জাতীয় কর্ষণ হয়েছে বলে মনে হয় না, ফলে এই প্রকার ভূখণ্ড ফলপ্রসূ নয়। (৫) ‘অপ্রতিকর’, ‘উৎপ্রতিকর’, ‘শূন্যপ্রতিকর’—এই তিনটি শব্দ প্রায় সমার্থক এবং শব্দগুলি এমন জমির প্রসঙ্গে ব্যবহৃত যা থেকে কোনও কর বা রাজস্ব আদায় করা যায় না। এই জমি অনুর্বর, অকৃষ্ট ও অনাবাদী হওয়ার দরুন কোনও ফসল তাতে ফলে না, সুতরাং, রাজস্বও তা থেকে পাওয়া যায় না। (৬) ‘অরণ্যে’র কথা ২২৪ গুপ্তাব্দে (=৫৪৪ খ্রীঃ) উৎকীর্ণ দামোদরপুর তাম্রশাসনে জানা যায়।
তাম্রশাসনগুলি যেহেতু বিক্রয় ও দানের মাধ্যমে জমি হস্তান্তরের ঘটনার সাক্ষ্য দেয়, ফলে এই জাতীয় তথ্যসূত্রে জমির নানা প্রকারভেদের মত জমির মাপ নেবার পদ্ধতির কথাও বলা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া বারোটি তাম্রশাসনের সাক্ষ্য বিশেষ মূল্যবান; এই তাম্রশাসনগুলি অধিকাংশই পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি বা উত্তরবঙ্গ এলাকায় পাওয়া গিয়েছে এবং গুপ্ত শাসকদের সময়ে উৎকীর্ণ (এগুলির তারিখ গুপ্তাব্দ ১১৩ থেকে ২২৪ পর্যন্ত; অর্থাৎ ৪৩৩ থেকে ৫৪৪ খ্রীঃ পর্যন্ত)। এ ছাড়াও গুপ্ত শাসকদের অব্যবহিত পরবর্তী আমলের বঙ্গ অঞ্চলের (ঢাকা-বিক্রমপুর-ফরিদপুর অঞ্চল, বাংলাদেশ) তিন শাসকের তাম্রশাসনগুলিতেও জমির মাপ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাবে (এই লেখগুলি ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উৎকীর্ণ)। সাধারণতঃ তিনটি শব্দ জমি মাপ করার জন্য ব্যবহৃত: ‘আঢ়বাপ’, ‘দ্রোণবাপ’ ও ‘কুল্যবাপ’। ‘দ্রোণবাপ’ ও ‘কুল্যবাপ’—এই দুই এককই সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত। সাধারণত আট ‘দ্রোণবাপে’ এক ‘কুল্যবাপ’ হত। জমির মাপের সর্বোচ্চ একক ছিল ‘পাটক’, যার উল্লেখ মাত্র একটি গুপ্ত তাম্রশাসনেই পাওয়া যায়; তথ্যসূত্রটি হল বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর (কুমিল্লা জেলা, বাংলাদেশ) তাম্রশাসন (গুপ্তাব্দ ১৮৮=৫০৭ খ্রীঃ)। পাঁচ ‘কুল্যবাপ’ ছিল এক ‘পাটকের সমান; অতএব চল্লিশ ‘দ্রোণবাপে’ এক ‘পাটক’ হত। “বাপ’ শব্দটির তাৎপর্য অনুধাবন করা দরকার; ‘বাপ’ কথাটি বীজ বপনের সঙ্গে জড়িত। মনে হয়, এক ‘দ্রোণ’ বা এক ‘কুল্য’ পরিমাণ বীজ যে আয়তনের ক্ষেত্রে ছড়ালে কৃষির পক্ষে প্রশস্ত হত, তাই যথাক্রমে দ্রোণবাপ ও কুল্যবাপ-এর একক হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। অর্থাৎ এই জাতীয় পরিমাপ ব্যবস্থায় ও পদ্ধতিতে রৈখিক মাপ নেওয়ার বদলে একটি ক্ষেত্রে বীজবপনের এলাকা হিসাবে জমি মাপা হচ্ছে। প্রাচীন বাংলার তাম্রশাসনে প্রদত্ত অথবা/এবং বিক্রীত ভূখণ্ড মাপার জন্য দুইখানি ‘নল’ (‘নলাভ্যাম্’) ব্যবহৃত হত; এই নলের কোনও নির্দিষ্ট বা নির্দ্ধারিত মাপ ছিল না—কারণ লেখমালায় কখনও এই নল দুটি আট×নয় (‘অষ্টকনবকনলাভ্যাং’), নয় × নয় (‘নবকনবকনলাভ্যাং’) এবং ছয় × ছয় (ষট্ক-নড়ৈরপবিঞ্ছ্য’) বলে বর্ণিত। মনে হয় দুটি নল দিয়ে ক্ষেতের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে মাপা হত। কিন্তু নলগুলির একক বা দৈর্ঘ্য-প্রস্থের নির্ধারিত হিসাব জানা যায় না। তবে এটুকু বোঝা যায় যে নল দ্বারা জমি মাপার সময় রৈখিক মাপই নেওয়া হত। জমিতে বীজ বপনের পরিমাণের উপরও যে জমির মাপ করা হত তা ‘কুল্যবাপ’, ‘দ্রোণবাপ’ শব্দেই প্রতীয়মান। ‘কুল্যবাপ’, ‘দ্রোণবাপ’ বলতে হাল আমলের কি পরিমাণ জমি বোঝায় তা আন্দাজ করা শক্ত, তবে ‘কুলব্যাপ’ ও ‘দ্রোণবাপ’ শব্দ দুটি আধুনিক আমলেও প্রচলিত; কিন্তু তাদের মাপ এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পৃথক হয়ে যায়। দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে ১ ‘আঢ়বাপ’=৪-৫ বিঘা; ১ ‘দ্রোণবাপ’=১৬-২০ বিঘা, ১ ‘কুল্যবাপ’=১২৮-১৬০বিঘা। শচীন্দ্রকুমার মাইতির অভিমত নিম্নরূপ: ১ ‘আঢ়বাপ’=১-১ বিঘা; ১ ‘দ্রোণবাপ’=৪-৬ বিঘা ও ১ ‘কুল্যবাপ’=৩৮-৪৮ বিঘা। বাংলার গুপ্তবংশীয় তাম্রশাসনে জমি মাপার জন্য যে সময়ে ‘আঢ়বাপ’, ‘দ্রোণবাপ’ ও ‘কুল্যবাপ’ প্রভৃতি এককের কথা জানা ছিল, সমকালীন দাক্ষিণাত্যে বাকাটক রাজ্যে একটি ভিন্ন মাপ দেখা যায়—‘নিবর্তন’। মনে রাখা দরকার ‘নিবর্তন’ এই এককটি দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন আমল থেকে পরিচিত। দাক্ষিণাত্যে বাকাটকরা জমির মাপ করার ক্ষেত্রে বোধহয় পূর্ববর্তী আমলের পদ্ধতি ও একককে ব্যবহার করতেন। গুপ্তোত্তর পর্বে বলভীর মৈত্ৰক বংশের লেখমালায় ‘পাদাবর্ত্ত’ নামক একটি জমি মাপ করার এককের উল্লেখ আছে। শচীন্দ্রকুমার মাইতির গবেষণা থেকে মনে হয় যে এক ‘পাদাবর্ত্ত’ ছিল আধুনিক এক ফুটের কিছু বেশী। জমির পরিমাপ করার জন্য বিভিন্ন রকম এককই কেবল ছিল না, এই এককগুলির সহাবস্থান সম্ভবত ভূমিব্যবস্থায় আঞ্চলিক তারতম্যের ইঙ্গিতবহ।
হস্তান্তরযোগ্য জমির দাম কেমন ছিল, সে বিষয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় বাংলার তাম্রশাসনগুলিতে। পাঁচটি দামোদরপুর তাম্রশাসনে (দুটি কুমারগুপ্তের—গুপ্তাব্দ ১২৪ ও ১২৮=৪৪৪ ও ৪৪৮ খ্রীঃ; দুটি বুধগুপ্তের—একটির তারিখ নেই, অপরটির তারিখ গুপ্তাব্দ ১৭৬=৪৯৬ খ্রীঃ ও একটি সম্ভবত বিষ্ণু (?) গুপ্তের—গুপ্তাব্দ ২২৪-৫৪৪ খ্রীঃ)। পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অন্তর্গত (অর্থাৎ উত্তরবঙ্গে) জমির দাম ‘কুল্যবাপ’ প্রতি ৩ স্বর্ণদীনার। অথচ ঐ একই এলাকায় ‘কুল্যবাপ’ প্রতি জমির দাম যে ২ স্বর্ণদীনার হত তার পরিচয় পাওয়া যাবে বৈগ্রাম (১২৮ গুপ্তাব্দ=৪৪৮ খ্রীঃ), জগদীশপুর (গুপ্তাব্দ ১২৮=৪৪৮ গুপ্তাব্দ) পাহাড়পুর (১৫৯ গুপ্তাব্দ=৪৭৯ খ্রীঃ) এবং নন্দপুর (গুপ্তাব্দ ১৬৯=৪৮৯ খ্রীঃ) তাম্রশাসনগুলিতে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের বাংলায় আধিপত্য শেষ হবার অব্যবহিত পরই বঙ্গ অঞ্চলে ধর্মাদিত্য, সমাচারদেব ও গোপচন্দ্র নামে যে তিন স্বাধীন রাজা রাজত্ব করতেন, তাঁদের লেখমালায় জমির দাম প্রতি ‘কুল্যবাপে’ ৪ দীনার ছিল (ধর্মাদিত্যের দুটি ফরিদপুর তাম্রশাসন—একটি তারিখবিহীন, অপর তাঁর তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ; সমাচারদেবের তারিখবিহীন ঘুঘরাহাটি তাম্রশাসন ও গোপচন্দ্রের মল্লসারুল তাম্রশাসন—রাজ্যাঙ্ক ৩৩)। উত্তরবঙ্গে ও পূর্ববঙ্গে জমির দামের পার্থক্য সহজেই নজরে পড়ে। এই পার্থক্য আঞ্চলিক তারতম্যজনিত হতে পারে। তবে উত্তরবঙ্গের হস্তান্তরিত জমি বেশীরভাগই অনাবাদী, পতিত জমি (‘অপ্রদাপ্রহত খিলক্ষেত্র’); কিন্তু বঙ্গ অঞ্চলের জমি ছিল ফসল ফলানোর পক্ষে উপযুক্ত (‘বাপক্ষেত্র’)। উর্বর উৎপাদনশক্তিসম্পন্ন জমির দাম অনাবাদী ভূখণ্ডের তুলনায় বেশী হলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
প্রাচীন বাংলার গুপ্তকালীন তাম্ৰশাসনগুলি প্রকৃতপক্ষে জমি ক্রয়বিক্রয়ের দলিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভূখণ্ড ক্রয় করার পর তা কোনও ব্রাহ্মণ এবং/অথবা দেবমন্দির বা বৌদ্ধবিহারে দান করা হত। এই দান নিষ্কর (‘অগ্রহার’), চিরকালীন (‘অক্ষয়নীবি’) ও অনবসিত জমি (‘ভূমিচ্ছিদ্ৰন্যায়’) দানের শর্তে দেওয়া হত। ‘ভূমিচ্ছিদ্রনায়’ পরিভাষার অর্থ যে জমিতে কোনও কৃষিকাজ বা বসতি নেই, সেই জাতীয় জমি লেনদেনের রীতিপদ্ধতি। তাম্রশাসনগুলি বিচার বিশ্লেষণ করলে জমি হস্তান্তর করার একটি নির্দিষ্ট ছক বা পদ্ধতি চোখে পড়ে; ঐ পদ্ধতি বা ছকে সামান্য কিছু বৈচিত্র্য বাদ দিলে মোটামুটি নির্দ্ধারিত রূপ আছে। এই জাতীয় তাম্রশাসনের শুরুতেই গুপ্তাব্দের হিসাবে সন তারিখ, গুপ্ত সম্রাটের নাম, তাঁর অধীনস্থ পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির (ভুক্তি=প্রদেশ) প্রশাসকের পরিচয়, প্রাদেশিক শাসকের অধস্তন জেলাশাসকের নাম (“বিষয়াধিকারী’; ‘বিষয়’=জেলা, “অধিকারী’=ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী); জেলাশাসকের কর্মস্থান ও জেলাপ্রশাসনের জন্য গঠিত সমিতি জাতীয় সংগঠনের সদস্যদের নাম বলা হত। এর পর ভূমিক্রয়েচ্ছু ব্যক্তির আবেদন জেলা প্রশাসনের সামনে পেশ করা হত। এই প্রসঙ্গে সম্ভাব্য ক্রেতা পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির কোন অঞ্চলের কি প্রকার জমি, কিরকম দাম দিয়ে ও কেন ক্রয় করতে ইচ্ছুক তাও লিপিবদ্ধ করা হত। এই জাতীয় আবেদন পেশ করার পর তা যথাযথ পরীক্ষা করে দেখতেন (‘অবধারণ’) ‘পুস্তপাল’ বা জেলাধিকরণে প্রশাসনিক দলিল দস্তাবেজের ভারপ্রাপ্ত রাজকর্মচারী। সাধারণত আবেদনগুলি মঞ্জুর হত। এর পরে ভূমিক্রয়েচ্ছু ব্যক্তি নির্দিষ্ট দাম দিয়ে (প্রতি কুল্যবাপ দুই, তিন বা চার দীনার) জমি ক্রয় করতেন। জমি কিনে সাধারণত তা কোনও ব্রাহ্মণকে তাঁর যাগযজ্ঞ পূজার্চনার খরচ নির্বাহের জন্য অথবা কোনও মন্দিরকে তার খরচ মেটাবার জন্য দান করা হত। অর্থাৎ একই জমি দুইবার হস্তান্তরিত হত। ক্রেতা সব ক্ষেত্রেই জমি কিনছেন রাষ্ট্রের কাছ থেকে; কারণ অধিকাংশ জমিই অনাবাদী পতিত ভূখণ্ড—যে জাতীয় জমির উপর প্রাচীন ভারতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী রাজকীয় বিশেষ অধিকার বর্তায়। কেবলমাত্র বৈন্যগুপ্তের শাসনকালে কুমিল্লা জেলায় একটি বৌদ্ধবিহারকে সরাসরি এগারো পাটক অনাবাদী জমি (পাঁচটি পৃথক খণ্ডে) দান করা হয়েছিল; ঐ জমির আয় থেকে বিহারে মেরামত, ভিক্ষুদের আহার, বাসস্থান, ঔষধ, বিহারে ধূপ দীপ জ্বালাবার খরচ মেটানো হত (‘গন্ধপুষ্পদীপধূপাদি প্রবর্তনায় তস্য ভিক্ষুসংঘস্য চ চীবর পিণ্ডপাত শয়নাসন গ্লানপ্রত্যয় ভৈষজ্যাদি পরিভোগায় বিহারে চ ফুট্ট প্রতি-সংস্কার করণায়’)। জমি হস্তান্তরের পর্ব চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হলে জমির সীমা বর্ণনা করা হত। এই সময়ে প্রদত্ত জমিটিকে অন্যান্য ভূখণ্ড থেকে দুটি নল দ্বারা পৃথক করা হত (‘অষ্টকনবকনলাভ্যামপবিঞ্ছ্য’)। এর পরে জমির চারিপাশের সীমানা চিহ্নিত করা হত; এই সীমানা চিহ্নকরণের সময় স্থানীয় গ্রামবাসী বা তাঁদের প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তিরা উপস্থিত থেকে তা দেখতেন (‘প্রত্যবেক্ষ’)। জমির সীমা চিহ্নিত করার জন্য ছাই দিয়ে দাগ দেওয়া হত; যদিও এই দাগ চিরস্থায়ী বলে বর্ণিত (‘চিরকালস্থায়িনা তুষাঙ্গারাদিনা’), এই ব্যবস্থায় প্রদত্ত জমি সঠিক চিহ্নিত হত কি না সন্দেহ। তাই গুপ্ত-পরবর্তী মল্লসারুল তাম্রশাসনে প্রদত্ত জমির চারিপাশে পাকা খুঁটি বসানো হয়; খুঁটিগুলির গায়ে পদ্ম ও অক্ষমালার নকশা ছিল (‘কীলকশ্চাত্র কমলাক্ষমালাঙ্কৃতাঃ’) প্রদত্ত জমিতে বেড়া লাগাবার (‘কৃতকলন’) উল্লেখও পাওয়া যায় (ধর্মাদিত্যের তৃতীয় রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ ফরিদপুর তাম্রশাসন)৷ জমি হস্তান্তরের পদ্ধতি ও এত খুঁটিনাটি বিষয় সম্বন্ধে বিশদ তথ্য পূর্ববর্তী আমলে প্রায় দেখা যায় না।
বিক্রয় ও দানের পর যে ভূখণ্ডগুলি পুরোহিত সম্প্রদায় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চুড়ান্ত ভাবে লাভ করতেন তা চিরকালীন ছিল; যেহেতু প্রাচীন বাংলার হস্তান্তরিত ভূখণ্ডগুলি অধিকাংশই অনুৎপাদক পতিত জমি, তাই এগুলি থেকে রাজস্ব পাওয়া যেত না এবং ব্রাহ্মণ দানগ্রহীতাও এই জমির উপর নিষ্কর অধিকার লাভ করতেন। কিন্তু এইভাবে দুইবার হাতবদলের মারফৎ ভূখণ্ড দান করার সমতুল্য নজীর প্রাচীন বাংলার বাইরে বিশেষ নেই; মধ্য ভারতে, পশ্চিম ভারতে ও দাক্ষিণাত্যে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে যে জমি দেওয়া হত তা সরাসরি রাজকীয় দান ও ঐ ভূখণ্ডগুলিতে চাষবাস প্রচলিত ছিল। উপরিউক্ত এলাকাগুলি থেকে যে তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছে, তাতে দেখা যায় জমি ও গ্রাম দুই-ই দান করা হত। এই ভূমিদানের সময় প্রশাসনের তরফ থেকে উচ্চপদস্থ রাজপুরুষরা থাকতেন, গ্রামের সম্ভ্রান্ত মানুষ ও ‘কুটুম্বী’রাও (জমির মালিকানা আছে এমন কৃষক) উপস্থিত থাকতেন; রাজকীয় দলিল দ্বারা প্রদত্ত ভূসম্পদ ‘অগ্রহার’ বা করমুক্ত করা হত। গ্রাম ও জমি দানের মধ্যে পার্থক্য আছে; ভূমিখণ্ড দান করলে প্রদত্ত ভূমিখণ্ডের উপর দানগ্রহীতার মালিকানা স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু গ্রামদান করলে গ্রামের পূর্ণ মালিকানা দানগ্রহীতাতে বর্তায় না; তিনি ঐ গ্রাম থেকে প্রাপ্য রাজস্ব ভোগ করার অধিকারী হন, যে রাজস্ব সচরাচর রাজকোশে দেয়। প্রাচীন বাংলার বাইরে ভূসম্পদ দান করার সবচেয়ে বেশী ও সবচেয়ে নিয়মিত নজীর দেখা যায় দাক্ষিণাত্যে যে এলাকায় গুপ্তদের সমকালীন বাকাটক বংশীয় রাজারা ক্ষমতাসীন ছিলেন। বাকাটকদের তাম্রশাসনগুলি পাঠোদ্ধার, সম্পাদনা ও অনুবাদ করার প্রধান কৃতিত্ব ভি. ভি. মিরাশি ও অজয় মিত্র শাস্ত্রীর। সাম্প্রতিক কৃষ্ণমোহন শ্রীমালী এই তাম্রশাসনগুলির ভিত্তিতে যে গবেষণা করেছেন তাও উল্লেখের দাবী রাখে। বাকাটক আমলে পঁয়ত্রিশটি গ্রাম অগ্রহারে পরিণত করার দৃষ্টান্ত আছে, তার মধ্যে কুড়িটিই প্রবরসেনের সময়ে (৪২০-৫২ খ্রীঃ) প্রদত্ত। এই গ্রামগুলি অগ্রহার করার সময় বহু নিয়মিত ও অনিয়মিত কর রহিত হয় (মকুব করা করের তালিকা পরে আলোচিত)। ঋদ্ধপুর তাম্রশাসনে ভূমিদানের সময় দানগ্রহীতাকে জমির সংলগ্ন চারজন কৃষকের বসতবাটীও দান করা হয়েছিল ( ‘সহ কৰ্ষক-নিবেশনানি চত্বারি’)। যাবৎমল তাম্রপট্টেও জমি দেবার সময় দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণকে সংলগ্ন দুটি বাসগৃহ দান করা হয়েছে (‘নিবেশদ্বয়ং’)। একইভাবে পৌনি তাম্রশাসনে ভূমিদানের সঙ্গে নিবেশন বা বাড়ীঘর দেবার প্রসঙ্গ উল্লিখিত। গ্রাম ছাড়াও ব্রাহ্মণদের ভূখণ্ড দেওয়া হত। অন্তত তেরটি ভূখণ্ড দানের দৃষ্টান্ত তাম্রশাসনে দেখা যাবে, তার মধ্যে দশটিই প্রবরসেনের আমলে প্রদত্ত। এই ভূখণ্ডগুলির আয়তন বিশ ‘নিবর্তন’ থেকে আট হাজার ‘নিবর্তন’ পর্যন্ত। প্রবরসেনের পান্ধুরনা তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে দুই হাজার ‘নিবর্তন’ পরিমাণ বৃহদায়তন ভূখণ্ড দানের সঙ্গে মাত্র চারজন ব্রাহ্মণের নাম উল্লিখিত। ঐ একই রাজার আমলে উৎকীর্ণ চম্মক তাম্রশাসনে আট হাজার ‘নিবর্তন’ জমি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং দানগ্রহীতা হিসেবে মাত্র উনপঞ্চাশ জন ব্রাহ্মণের নাম পাওয়া যায়। বাকাটক শাসনে একজন ব্রাহ্মণকে একাধিক গ্রাম দেবার ঘটনাও অজানা নয়। ব্রাহ্মণ তথা পুরোহিত সম্প্রদায়ের লোকেরা যে রাজকীয় অনুগ্রহের দ্বারা প্রচুর পরিমাণ ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। শুধু ব্রাহ্মণরা নয়, বৌদ্ধ বিহারগুলিও যে ভূসম্পদ লাভ করত, তার নজীর প্রাচীন বাংলার কুমিল্লা জেলায় আবিষ্কৃত বৈন্যগুপ্তের তাম্রশাসন থেকে বোঝা যায়। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে ভারতে আগত দুই চীনা পরিব্রাজক ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাঙ তাঁদের বিরণীতে জানিয়েছেন যে বৌদ্ধ বিহারগুলি যথেষ্ট পরিমাণ ভূসম্পত্তির অধিকারী ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে রাজকীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা মারফৎ ভূসম্পদ দানের নজীর প্রাক ৩০০ খ্রীঃ পর্বে বেশী নেই। বাকাটক লেখমালায় ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে গ্রামের বদলে গ্রাম ও জমির বদলে জমি দান করার রেওয়াজের নজীরও অজানা নেই।
নিয়মিতভাবে ভূসম্পদের উপর মালিকানা বা ভোগাধিকার পাওয়ায় ব্রাহ্মণ/পুরোহিত সম্প্রদায়ের বহু ব্যক্তির এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে অর্থনৈতিক সুবিধা জমা হয়েছিল বিস্তর। হস্তান্তর করারপর গ্রাম বা ভূখণ্ডটিকে শুধু নানারকম কর থেকে রেহাই দেওয়া হত না, পাইক বরকন্দাজদের প্রদত্ত এলাকায় যথেচ্ছ প্রবেশের ক্ষেত্রেও বাধা উপস্থিত ছিল। লেখমালায় গ্রাম দানের বা ভূমি দানের সময় ‘অচাটভাটপ্রবেশ্য’ বা ‘চাটভাট অপ্রাবেশ্য’ কথা দুটির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ‘চাট’ ও ‘ভাট’ বলতে নিয়মিত ও অনিয়মিত রক্ষী বাহিনী বোঝায়, যাঁরা সাধারণত স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতেন। তাঁরা সম্ভবতঃ স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের কাজেও প্রশাসনকে সহায়তা করতেন। প্রদত্ত গ্রামে বা ভূখণ্ডে তাঁদের প্রবেশের উপর বাধানিষেধ আরোপিত হবার তাৎপর্য কি, এ ব্যাপারে রামশরণ শর্মার বিশ্লেষণটি প্রণিধানযোগ্য। শর্মার মতে দানগ্রহীতা কেবলমাত্র ভূসম্পদ ও গ্রাম থেকে প্রাপ্য রাজস্বই ভোগ করতেন না, পাইক বরকন্দাজদের পরিবর্ত্তে দানগ্রহীতাই গ্রামীণ আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার ও রাজস্ব সংগ্রহের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র ব্যবস্থাদি প্রবর্তন করতেন। অর্থাৎ শর্মার বিচারে এই জাতীয় ঘটনায় দানগ্রহীতা প্রশাসনিক ও বিচার সংক্রান্ত অধিকারও পেতেন; অন্যভাবে বলতে গেলে রাষ্ট্র যেন প্রায় স্বেচ্ছায় দানগ্রহীতার সমর্থনে রাজস্ব সংগ্রহেরও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রশাসনিক অধিকার ত্যাগ করত। ফলে দানগ্রহীতা যে আঞ্চলিক ভিত্তিতে কিছুটা ক্ষমতাবান হয়ে উঠবেন, এমন অনুমান শর্মা করেছেন। এই ক্ষমতার সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত করতে হবে দানগ্রহীতার ভূসম্পদ, যা দানগ্রহীতার স্বচ্ছলতা নিঃসন্দেহে বাড়িয়েছিল। আরও একটি প্রাসঙ্গিক মন্তব্য এখানে অনুচিত হবে না। ব্রাহ্মণ বা কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জমির মালিকানা বা ভোগাধিকার বা দুই-ই পেতে পারেন, কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই দানগ্রহীতা প্রত্যক্ষভাবে ঐ জমিতে চাষ করতেন না; কারণ প্রাচীন ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ সহ উচ্চবর্ণভুক্ত ব্যক্তিরা নিজেরা কৃষিকাজে লিপ্ত থাকতেন না; বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষুরাও যে এই নিয়মের বাইরে ছিলেন একথা মনে করার কারণ নেই। অথচ প্রদত্ত জমি বা গ্রামগুলিতে যথাযথ চাষবাস না হলে জমি থেকে আয় হবে না; ভূসম্পদজনিত আয় না থাকলে ব্রাহ্মণের জীবনধারণ, পূজার্চনা ও বৌদ্ধ বিহারের সংস্থান বিপন্ন হয়ে পড়ে। তাই অনুমান করা যুক্তিযুক্ত যে, দানগ্রহীতারা তাঁদের ভূসম্পদ চাষ করার জন্য কৃষক নিয়োগ করতেন। এই কৃষকরা কেবলমাত্র চাষই করতেন; তাঁরা সম্ভবত জমির মালিক ছিলেন না; তাই তাঁদের আর্থিক অবস্থা দানগ্রহীতার তুলনায় দীনতর ছিল বলেই মনে করা চলে। এই ব্যবস্থা কার্যত দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধবিহারকে ভূম্যধিকারীতে পরিণত করে; ভূম্যধিকারী হিসেবে দানগ্রহীতাদের প্রতাপ, আর্থিক সুযোগ ও ক্ষমতা অবশ্যই বেড়েছিল। এই ক্ষমতা-বৃদ্ধি সম্ভবত দীনতর কৃষকের পক্ষে শুভ হয়নি, কারণ এই অবস্থায় তাঁদের অস্তিত্ব ক্রমেই ভূম্যধিকারীর উপর নির্ভরশীল হবার সমূহ সম্ভাবনা। সমকালীন স্মৃতিকাররা ভূমি ব্যবস্থায় তিনটি স্তরের উল্লেখ করেছেন: (১) ‘মহীপতি’, (২) ‘স্বামী’ ও (৩) “কর্ষক’-কে। ‘মহীপতি’ অবশ্যই রাজা; ‘স্বামী’ বলতে জমির মালিক ও ‘কর্ষক’ বলতে চাষীকে বোঝায়। লক্ষ্যণীয় যে ‘স্বামী’ ও ‘কর্ষক’ শাস্ত্রকাররা পৃথক উপাদান হিসেবে বিচার করেছেন; এর তাৎপর্য, ভূস্বামী নিজে জমি চাষ করতেন না, আর কৰ্ষক জমির মালিক ছিলেন না। এই ত্রিস্তর ব্যবস্থায় রায়তের অনুপস্থিতি আমাদের নজর এড়ায় না। প্রাক ৩০০ খ্রীঃ পর্বে কৰ্ষক ও দেশের রাজার ভিতর আর কোনও উপাদান দেখা যায় না; কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে কৃষি উৎপাদনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সময়েও রাজা ও কৃষক এই দুই উপাদানের উপস্থিতিই চোখে পড়ে। তাম্রশাসনের দ্বারা অগ্রহার সৃষ্টির প্রধান ফল ভূমি-বিন্যাসের ক্ষেত্রে এক ক্ষমতাবান ভূম্যধিকারী অর্শ্ববর্তী শ্রেণীর উদ্ভব।
অগ্রহার ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশী উপকৃত হয়েছিলেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষ; অর্থনৈতিক সুবিধা তো তাঁরা পেতেনই, তার সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থাতেও তাঁরা সক্রিয় অংশ নিতে শুরু করেন বলে রামশরণ শর্মার অভিমত। শর্মার ধারণা যে, ভূম্যধিকারী অন্তবর্তী শ্রেণীর উত্থান প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা ওঅধিকারকেসঙ্কুচিত করে দেয়। শর্মার এই যুক্তিবিন্যাস জোরালো হলেও সর্বজনগ্রাহ্য নয়। কারণ চম্মক তাম্রশাসনে ভূমিদান করার পর রাজা প্রবরসেন দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে সন্দেহাতীত হুঁশিয়ারী জারী করেছিলেন: এই সতর্কবাণীতে ব্রাহ্মণদের পক্ষে গর্হিত কর্মের একটি দীর্ঘ তালিকা আছে; তালিকাভুক্ত অপরাধের মধ্যে রাজদ্রোহ অন্যতম। প্রবরসেন স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে রাজদ্রোহ সমেত বিবিধ গর্হিত আচরণে যদি দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণরা লিপ্ত হন, তাহলে রাজা তাঁদের উদ্দেশে প্রদত্ত জমি কেড়ে নেবেন, এবং এই পদক্ষেপ নিলে রাজা ভূমি অপহরণের দোষে দোষী হবেন না। এই ঘোষণাটি প্রকৃতপক্ষে রাজার অর্থনৈতিক ও সার্বভৌম অধিকার অটুট থাকার দিকেই নির্দেশ করে; তবে ব্রাহ্মণরা যে ভূস্বামীতে পরিণত হলে রাজদ্রোহ ঘটাবার মত ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে পারেন, তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত হয়তো এই রাজকীয় নির্দেশে উপস্থিত।
রামশরণ শর্মা ও তাঁর অনুসরণে রমেন্দ্রনাথ নন্দী ও কৃষ্ণমোহন শ্রীমালী মনে করেন যে অগ্রহার ব্যবস্থা নিয়মিত হবার দরুন রাজা বহু পরিমাণ কৃষিজ রাজস্ব হারাতেন; কারণ প্রদত্ত এলাকাকে করমুক্ত করাই রীতি ছিল। তাঁদের ধারণায় অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ও রাজকোষের উপর চাপ পড়েছিল! এই প্রসঙ্গে শর্মা বাণভট্টের হর্ষচরিতের একটি তথ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। হর্ষচরিতে বলা হয়েছে যে হর্ষবর্ধনের কোশের অর্থ যে সব খাতে ব্যয় হত, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করা। বাণভট্ট জানিয়েছেন, হর্ষবর্ধনের সামগ্রিক ব্যয়ভারের মধ্যে এক-চতুর্থাংশই এই জাতীয় পৃষ্ঠপোষকতার জন্য খরচ হত। শর্মা মনে করেন ব্রাহ্মণ ও ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলিকে মদত দেবার জন্য রাজা যে সব আর্থিক সুবিধা ও সুযোগের ব্যবস্থা করতেন (অগ্রহার নীতি সহ), তার বিষম আর্থিক প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু একথা অস্বীকার করা কঠিন হবে যে অগ্রহার করার বহু ঘটনাতেই পতিত, অনুর্বর, অনুৎপাদক (এবং সেহেতু রাজস্ববিহীন) জমি হস্তান্তরিত হয়েছিল। ব্রাহ্মণদের যখন এই জাতীয় ভূখণ্ড দেওয়া হত এবং এই জাতীয় জমি থেকেই দানগ্রহীতাদের সংস্থান হত, তখন বুঝতে কষ্ট হয় না যে ব্রাহ্মণরা কোনও না কোনও ভাবে ঐ অনুর্বর জমিকে চাষের আওতায় আনতেন। অতএব অগ্রহার সৃষ্টির দ্বারা বহু সময়ে অনাবাদী জমিকে আবাদী এলাকায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এটি নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির বদলে কৃষি উৎপাদন বাড়িয়েছিল। এছাড়া অনাবাদী পতিত ভূখণ্ড—যা রাষ্ট্রীয় অধিকারে ছিল—কার্যতঃ রাষ্ট্রের পক্ষে অর্থনৈতিক দায়স্বরূপ; অন্তত প্রাচীন বাংলায় এই জাতীয় জমি বিক্রী করে রাষ্ট্র অনাবাদী অঞ্চলের বোঝা কমাত; তদুপরি জমি বিক্রী করলে প্রশাসন তৎক্ষণাৎ নগদ অর্থ পেত। তাই প্রাচীন বাংলার তাম্রশাসনে জমি ক্রয়ের আবেদন যখন ‘পুস্তপাল’ অনুমোদন করতেন, তখন তাঁর যুক্তি ছিল এই জাতীয় পতিত জমির হাতবদল ঘটলে রাজার কোনও আর্থিক বিরোধ বা ক্ষতি হবে না (‘এবম্বিধোৎপ্রতিকর ভূমিদানেন ন কশ্চিৎ রাজার্থবিরোধঃ’)। অতএব অগ্রহার নীতিতে অন্তর্বর্ত্তী ভূম্যধিকারীর উত্থান মেনে নিলেও তার দ্বারা রাষ্ট্রের আর্থিক ও সার্বভৌম অধিকার সঙ্কুচিত বা বিপন্ন হত কি না, বলা কঠিন। বাকাটক শাসনগুলির উপরে শ্রীমালীর মন্তব্য এখানে দেওয়া যেতে পারে। শ্রীমালী দেখিয়েছেন প্রাক-প্রবরসেন আমলে (অর্থাৎ ৪২০ খ্রীঃ এর আগে) বাকাটকরা যে ছয়টি গ্রাম দিয়েছিলেন, তার মধ্যে পাঁচটি গ্রাম অবস্থিত ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০-৬০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এলাকায়। অর্থাৎ ছয়টির মধ্যে একটি গ্রাম ছিল আপেক্ষিকভাবে সমতলভূমিতে। প্রবরসেনের সময় যে কুড়িটি গ্রাম দেবার কথা জানা যায়, তার মধ্যে এগারটির অবস্থান সমতল ভূমিতে, যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ মিটারের কম; বাকী নয়টি গ্রাম ৩০০-৬০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট অঞ্চলে অবস্থিত। বেশীর ভাগ গ্রামই ওয়ার্ধা ও বাণগঙ্গা নদীর উপত্যকায় অবস্থিত ছিল; প্রবরসেন উত্তর তাপ্তী উপত্যকাতেও ভূসম্পদ দান করেন। এই গ্রামগুলি নদীর উপত্যকায় থাকায় তা নিঃসন্দেহে কৃষির সহায়ক হয়েছিল। প্রাক ৩০০ খ্রীঃ পর্বে এই সব এলাকাতে এত বেশী গ্রাম সন্নিবেশ ঘটেনি; অতএব গ্রামের সংখ্যাবৃদ্ধি কৃষি অর্থনীতির প্রসারের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। অগ্রহার ব্যবস্থা সমকালীন ভূমিবিন্যাস ব্যবস্থায় যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল তাতে সংশয় নেই; কিন্তু এই নতুন পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক সমস্যার চাইতে কৃষি অর্থনীতির প্রসারের সম্ভাবনাই বোধহয় বেশী দেখা যায়।
॥ ৩ ॥
কৃষি অর্থনীতির আলোচনার পর এবার শিল্পোৎপাদনের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। কারিগরী শিল্পের তালিকা অমরকোশে পাওয়া যায়। এই তালিকায় উল্লিখিত শিল্পের অনেকগুলি ধাতু-নির্ভর; শিল্পোৎপাদনে ধাতুর ব্যবহার বোধহয় ক্রমশঃ বাড়ছিল। ধাতুর কারিগরদের মধ্যে কর্মকার বা কামারের গুরুত্ব বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। কর্মকার লোহার অস্ত্রশস্ত্র ও দৈনন্দিন প্রয়োজনের নানাবিধ তৈজসপত্র তৈরী করতেন। কালিদাসের বর্ণনায় কামারের তৈরী লোহার হাতুড়ির (‘অয়োঘন’) কথা জানা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননও লোহার অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের বহু দৃষ্টান্ত হাজির করেছে। লোহার ব্যবহারের সম্ভবতঃ শ্রেষ্ঠ নজীর দিল্লীর কাছে অবস্থিত মেহেরৌলি-র লৌহস্তম্ভ। এই লৌহস্তম্ভে একটি ক্ষুদ্র লেখতে চন্দ্র নামক অতি পরাক্রান্ত এক রাজার সামরিক সাফল্যের বর্ণনা আছে; লেখটির ব্রাহ্মী হরফ সম্ভবত চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের বৈশিষ্ট্য ও চিহ্ন বহন করছে। ফলে ঐ স্তম্ভটির নির্মাণ কালও চতুর্থ বা পঞ্চম শতক বলেই নির্দেশ করা যায়। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে তৈরী এই লৌহস্থম্ভটিতে এখনও মরচের লেশমাত্র চিহ্ন নেই; সমকালীন ধাতুশিল্পের এটি নিঃসন্দেহে এক চমকপ্রদ নিদর্শন, যা আজও সকলেরই বিস্ময় জাগায়। কর্মকার কখনও কখনও সমকালীন সাহিত্যে ‘লোহাকার’ নামেও অভিহিত। বাকাটক লেখতে লোহানগর বলে যে জায়গার নাম পাওয়া যায়, কৃষ্ণমোহন শ্রীমালীর মতে ঐ অঞ্চলে কর্মকারদের নিয়মিত বসতি থাকা সম্ভব। লোহা ছাড়াও কাঁসা ও সোনার মত ধাতুর ব্যবহার যে অব্যাহত ছিল তার সাহিত্যগত নজীর প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। শ্রীমালী বাকাটক লেখতে কাংসকারক ও সুবর্ণকারক নামে যে দুটি গ্রামের নাম দেখেছেন, সেগুলি অবশ্যই কাঁসারী ও সোনার কারিগরদের দ্বারা অধ্যুষিত গ্রাম ছিল। বাকাটক রাজ্যে নুনের উৎপাদনের পরোক্ষ উল্লেখ সমকালীন তাম্রশাসনে পাওয়া যায়। বাকাটক শাসকরা একাধিকবার নুন উৎপাদনের উপর প্রাপ্য শুল্ক মকুব করেছিলেন, যা অবশ্যই ঐ এলাকায় নুনের উৎপাদনের সাক্ষ্য বহন করে। নুনের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় অপর একটি শিল্পসামগ্রী ছিল মৃৎপাত্র; কুম্ভকার যে মৃৎপাত্র তৈরী করছেন, তার নিয়মিত বর্ণনা সমকালীন সাহিত্যে উপস্থিত। এই বর্ণনার সমর্থনে চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যায় উৎখনন থেকে: রাজঘাট, অহিচ্ছত্র ও ভিটাতে উৎখনন চালিয়ে পাওয়া গিয়েছে নানা আকারের বাটী, ঘড়া, পাত্র ও পাত্রের ঢাকা। ৫৯২ খ্রীঃ উৎকীর্ণ ও গুজরাট থেকে পাওয়া একটি তাম্রশাসনে কুম্ভকার ও কুম্ভকারের তৈরী মাটীর পাত্রের উল্লেখ আছে। দৈনন্দিন জীবনে ‘সূত্রধর’ বা ছুতোর এর প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। ৫০৭ খ্রীঃ-এর একটি শাসনে (বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর তাম্রশাসন) ‘বৰ্দ্ধকি’ বা সূত্রধরের কথা বলা আছে। সূত্রধর ‘রথকার’ বলেও পরিচিত ছিলেন। তৈলোৎপাদনের কথা জানা যায় স্কন্দগুপ্তের আমলের ইন্দোর (প্রাচীন ইন্দ্রপুর) তাম্রশাসন থেকে (গুপ্তাব্দ ১৪৬=৪৬৬ খ্রীঃ)। যন্ত্রবিদ কারিগর বোধহয় ‘বিলাল’ নামে অভিহিত হতেন (বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর তাম্রশাসন দ্রষ্টব্য)। প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্প ছিল বস্ত্রশিল্প। অমরকোশে তন্তুবায় ও তাঁর তৈরী সুতোর উল্লেখ দেখা যায়। দামী ও মোটা দুইরকম কাপড়ই যে তৈরী হত, তার পরিচয় অমরকোশে আছে। দামী কাপড়ের মধ্যে রেশমজাত বস্ত্রের কথা উল্লেখ করা চলে। এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় পশ্চিম ভারত থেকে। প্রাচীন মালবের দশপুর বা আধুনিক মান্দাসোর থেকে কুমারগুপ্ত ও বন্ধুবর্মনের সময়ে উৎকীর্ণ (৪৩৬ ও ৪৭৩ খ্রীঃ) একটি লেখতে প্রথিতযশা একদল রেশম শিল্পীর কথা বলা হয়েছে। এই রেশম শিল্পীরা ছিলেন মূলত লাট বা গুজরাট অঞ্চলের বাসিন্দা; কিন্তু পরে তাঁরা মালব দেশে চলে আসেন। তাঁদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি তাঁদের মূল বৃত্তি অর্থাৎ রেশমবস্ত্র উৎপাদনেই যুক্ত ছিলেন; কিন্তু রেশমশিল্পীদের মধ্যে কয়েকজন তাঁদের বৃত্তি পরিবর্তন করেন। এই ঘটনাটি আলোচ্য আমলের সামাজিক গতিময়তার ইঙ্গিতবহ—শিল্পীরা শুধু তাঁদের এলাকায় বদল ঘটালেন না (গুজরাট থেকে মালব), তার সঙ্গে কেউ কেউ বৃত্তিও পাল্টেছিলেন। বস্ত্র শিল্পের সঙ্গে কাপড় রং করার কারিগরের বৃত্তি বোধহয় ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। ৫৯২ খ্রীঃ-এর বিষ্ণুষেণ তাম্রশাসনে ‘চিম্পক’ বলে যে কারিগরদের কথা জানা যায় তাঁরা সম্ভবত কাপড় রং করার কাজে যুক্ত ছিলেন। ঐ লেখতে নীলের গামলার (নীলডুম্ফক’) কথাও বলা হয়েছে বস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে নীলের ব্যবহার বিশেষ প্রয়োজনীয় ছিল, সন্দেহ নেই। বস্ত্র বয়নের জন্য সুতা রেশমের ব্যবহার ছাড়াও পশমের উপযোগিতা বোধহয় একেবারে অজানা ছিল না। ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে উৎকীর্ণ মল্লসারুল তাম্রশাসনে ‘ঔর্ণস্থানিক’ নামক এক রাজকর্মচারীর উল্লেখ আছে। তিনি ঊর্ণস্থান বা পশম উৎপাদন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। রেশম ও পশমজাত কাপড় সম্ভবত উচ্চবিত্ত মানুষ ব্যবহার করতেন। সম্পন্ন ও সম্রান্ত সম্প্রদায়ের রুচি মেটাতেই সম্ভবত হাতীর দাঁতের কাজ করা হত। ভিটাতে উৎখননের ফলে হাতীর দাঁতের তৈরী নানা বিলাসব্যসনের উপকরণ পাওয়া গিয়েছে—স্যার জন মার্শালের মতে ঐ সামগ্রী সম্ভবত চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে নির্মিত। কারিগরী শিল্পের তালিকায় সুরা উৎপাদনের কথাও বলা উচিত। সমকালীন সাহিত্যে সুরার বহু প্রকরভেদের উল্লেখ দেখা যায়। বিষ্ণুষেণের শাসনে (৫৯২ খ্রীঃ) ‘কল্লার’ বা সুরা প্রস্তুতকারীর কথা বলা হয়েছে। বাকাটক শাসন মধুকাজ্ঝরি নামে যে গ্রামটির কথা বলা আছে, তা সম্ভবত সুরা প্রস্তুতকারীদের বসতি বলে অনুমান করা চলে। বিবিধ শিল্পের যে তালিকা এখানে দেওয়া হল তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই বললেই হয়; তবে নুন উৎপাদনের উপর রাষ্ট্রের কিছু কর্তৃত্ব ছিল বলে অনুমান করা যায়। অবশ্য ফা হিয়েনের বিবরণীতে শ্রীলঙ্কায় মুক্তো চাষ ও উৎপাদনের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে রাজকীয় নিয়ন্ত্রণের কিছু ইঙ্গিত আছে।
কারিগরী শিল্পের প্রসঙ্গে শিল্প সংগঠনগুলির কথা না বললে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ‘শ্রেণী’ বা গিল্ড জাতীয় সংগঠনগুলির উল্লেখ এই আমলের লেখমালায় আছে; তবে খ্রীঃ পূঃ ১৭৫ থেকে খ্রীঃ ৩০০ পর্যন্ত সময়সীমায় লেখমালায় ‘শ্রেণী’র উল্লেখ যত পরিমাণে পাওয়া যায়, তার তুলনায় আলোচ্য যুগে ‘শ্রেণী’র কথা কম দেখা যায়। মালবের দশপুরে রেশম শিল্পীদের ক্রিয়াকলাপের যে বিবরণ আছে, তা থেকে স্পষ্টই দেখা যায় যে তাঁরা একটি ‘শ্রেণী’ বা গিল্ডের সদস্য ছিলেন। আগেই বলা হয়েছে যে তাঁরা গুজরাট থেকে মালবে এসেছিলেন এবং মালবের আসার পর রেশম শিল্পীদের কেউ কেউ বৃত্তি বদল করেছিলেন। ঐ লেখ অনুসারে রেশম শিল্পীদের মধ্যে কোনও কোনও ব্যক্তি তীরন্দাজি, ‘গণক’, ‘কথাবিদ’ (কথক), প্রভৃতি বৃত্তি ধারণ করেন। প্রথমতঃ এই জাতীয় বৃত্তি বদলের নজীর ‘শ্রেণী’র সংগঠনের পক্ষে শুভ হয় না; পেশাগত ঐক্যই ‘শ্রেণী’-র সাফল্যের অন্যতম কারণ। তার উপর রেশম উৎপাদন ত্যাগ করে ‘শ্রেণী’র কিছু কিছু সদস্য যে সববৃত্তি নিলেন, তা সরাসরি ধনোৎপাদক বৃত্তি নয়। তাহলে কি বুঝতে হবে যে পশ্চিম ভারতে পঞ্চম শতকের দ্বিতীয় পদে শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থায় কোনও সংকট দেখা দিয়েছিল, যার ফলে একটি ‘শ্রেণী’ তার স্থায়ী এলাকা ত্যাগ করে ও তার সদস্যদের একাংশ হঠাৎ বৃত্তি বদল করেন? ৪৬৬ খ্রীষ্টাব্দে ইন্দোর (প্রাচীন ইন্দ্রপুরে) একটি ‘তৈলিক শ্রেণী’ ছিল (তেল উৎপাদকদের গিল্ড); এই ‘শ্রেণী’টির প্রধান বা ‘প্রমুখ’ ছিলেন জীবন্ত (স্কন্দগুপ্তের ইন্দোর তাম্রশাসন, গুপ্তাব্দ ১৪৬ দ্রষ্টব্য)। আগের পর্বের মতই গিল্ডগুলি বোধহয় ব্যাঙ্কের ভূমিকা পালন করছিল। ইন্দোরের ‘তৈলিকশ্রেণী’তে অর্থলগ্নী করা হয়েছিল চিরকালীন ভিত্তিতে; ঐ আমানত করা অর্থের উপর যে সুদ পাওয়া যাবে, তা দিয়ে স্থানীয় সূর্য মন্দিরে প্রতি দিন দীপ জ্বালাবার জন্য দুইপলা করে তেলের সংস্থান হবে। একইভাবে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রাচীন মালব দেশে একটি ‘শ্রেণী’তে ২০ দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) চিরস্থায়ী আমানত হিসেবে লগ্নী করেন। তাঁর পুত্র প্রথম কুমারগুপ্তও ১৩ বা ১২ দীনার পরিমাণ অর্থ দুইবার ‘শ্রেণী’তে গচ্ছিত রেখেছিলেন। এই জাতীয় আমানতের উদ্দেশ্য ছিল মূল অর্থের উপর প্রাপ্য সুদ দিয়ে কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নানা প্রকার সুবিধার ব্যবস্থা করা।
এই আমলের ‘শ্রেণী’সংগঠনের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, সংগঠনগুলি নিজেদের সীলমোহর ব্যবহার করত। এই জাতীয় সীলমোহর বা সীলমোহরের ছাঁচ প্রচুর পাওয়া গিয়েছে বৈশালীর (উত্তর বিহার) প্রত্নক্ষেত্র থেকে। অন্ততঃ ২৭০টি সীলমোহরে ‘শ্ৰেষ্ঠী-সার্থবাহ-কুলিক-নিগম’/ ‘কুলিক-নিগম’ | ‘প্রথম কুলিক’ প্রভৃতি কথা উৎকীর্ণ আছে। ‘নিগম’ কথাটি পেশাদারী সংগঠনের প্রতিশব্দ এবং ‘শ্রেণী’ কথার সমার্থক। ‘কুলিক নিগম’ বলতে কারিগরদের সংগঠন বোঝায়, যে সংগঠনের প্রধান সম্ভবত ‘প্রথম কুলিক’ বলে অভিহিত। কারিগরদের মতই শ্ৰেষ্ঠী ও সার্থবাহ (বণিক সম্প্রদায়) নিজ নিজ সংগঠন বোধহয় গড়ে তুলেছিলেন। বিভিন্ন সংগঠনগুলির মুখপাত্ররা বোধহয় একটি বৃহত্তর সার্বিক সংগঠনের অন্তর্গত ছিলেন; এই বৃহত্তর সংগঠনটি ‘শ্রেষ্ঠী-সার্থবাহ-কুলিক নিগম’ নামে সীলমোহরে উল্লিখিত। গিল্ডের নানা প্রকার কাজকর্ম নিবার্হের জন্য ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে পেশাদারী সংগঠনগুলি এই সীলমোহর ব্যবহার করত। এই জাতীয় সীলমোহর ব্যবহারের ঘটনা প্রাক, ৩০০ খ্রীঃ পর্বে জানা নেই। ঘটনাটি সম্ভবত আলোচ্য আমলে গিল্ডের স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্বের পরিচয় বহন করে। পেশাদারী সংগঠনের পরোক্ষ দৃষ্টান্ত প্রাচীন বাংলার তাম্রশাসনগুলিতেও আছে। পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অধীনস্থ জেলাগুলিতে জেলাশাসনের ব্যাপারে বিষয়পতি বা জেলাশাসককে যে সব বেসরকারী ব্যক্তি সহায়তা করতেন, তার মধ্যে ‘প্রথম কুলিক’ উল্লেখযোগ্য। তিনি সম্ভবত ‘কুলিক’ বা কারিগরদের প্রতিনিধি ছিলেন। একই ভাবে ঐ তাম্রশাসনগুলিতে ‘প্রথম কায়স্থ’ বলে যাঁর উল্লেখ রয়েছে, তিনি সম্ভবত কায়স্থ বা করণিকদের প্রধান। কুলিক ও কায়স্থ বা করিণকরা যে নিজ নিজ পেশাদারী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সে বিষয়ে সংশয় নেই।
পেশাদারী সংগঠন গুলির সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা ধর্মশাস্ত্রে পাওয়া যায়: এই প্রসঙ্গে বৃহস্পতি ও নারদ স্মৃতির অনুশাসন বিশেষ প্রয়োজনীয়। বৃহস্পতি ও নারদ ‘শ্রেণী’র সামূহিক চরিত্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কোনও পেশাদারী ব্যক্তি যখন তাঁর বৃত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও ‘শ্রেণী’র সদস্যপদ পেতে চাইতেন, তখন তাঁকে চারটি পর্যায়ের ভিতর দিয়ে যেতে হত (বৃহস্পতি ১৭.৭ দ্রষ্টব্য): (১) ‘কোষ’ চারিত্রিক বিশুদ্ধতার জন্য শুদ্ধিজাতীয় পরীক্ষা, (২) ‘লেখক্রিয়া’—‘শ্রেণী’র নিয়মাবলী মানার ব্যাপারে লিখিত প্রতিজ্ঞা বা অঙ্গীকারপত্র, (৩) ‘মধ্যস্থ’—নতুন সদস্যকে উত্তমরূপে জানেন, এমন কোনও ব্যক্তিকে নতুন সদস্যের নির্ভরযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে থাকতে হত। ‘শ্রেণী’র সদস্যদের ভিতর পারস্পরিক বিশ্বাস থাকা যে অপরিহার্য, এ বিষয়ে নারদ ও বৃহস্পতির স্মৃতি সহমত। ‘শ্রেণী’গুলির পরিচালন ব্যবস্থায় বোধহয় আগের তুলনায় জটিলতা বেড়েছিল; ‘প্রমুখ’ বা ‘শ্রেণী’র সভাপতি উত্তরোত্তর বেশী পরিমাণে ‘কার্যচিন্তক’দের উপর নির্ভর করতেন বলে স্মৃতিগ্রন্থের বিধান থেকে অনুমান করা চলে। ‘শ্রেণী’র অন্তর্ভুক্ত কারিগররা যখন কোনও কাজ নেবেন তখন তার সম্পাদন যেন সমবায় প্রথায় হয়, এ ব্যাপারে নারদস্মৃতিতে স্পষ্ট বিধান আছে (পৃঃ ১২৪, পৃঃ ১৩৩)। প্রত্যেক সদস্যই সমান পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করবেন; যদি কেউ বেশী বা কম পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করেন, তাহলে শ্রেণীর খরচ, লাভ বা ক্ষতির ক্ষেত্রে সদস্যের দায় বা লভ্যাংশ আনুপাতিক হারে ধার্য হবে। যদি কোনও একজন সদস্য ‘শ্রেণী’র অপর সদস্যদের অনুমোদন ব্যতিরেকে বা ‘শ্ৰেণী’র আপত্তি সত্ত্বেও কোনও কাজের দ্বারা ‘শ্ৰেণী’র সামূহিক সম্পদের হানি ঘটান। তাহলে বৃহস্পতিস্মৃতি অনুসারে (পৃঃ ৩৩৬-৩৩৭) তিনি যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন। এই বিধানের মধ্যে দিয়ে ‘শ্রেণী’র সামূহিক সংগঠনের চরিত্রটি ফুটে উঠেছে। সংঘ বা ‘শ্রেণী’র সদস্য যদি চুক্তির খেলাপ করেন তাহলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ (‘সম্বিৎ ব্যতিক্রম’) বলে সাব্যস্ত হবে, এই বিধান নারদ ও বৃহস্পতি-স্মৃতিগ্রন্থে পাওয়া যায়।
‘শ্রেণীগুলির গুরুত্ব যে কতটা ছিল, তার অন্যতম নির্ভরযোগ্য প্রমাণ এই যে, ‘শ্রেণী’র নিয়মগুলির আইনগত মর্যাদা ধর্মশাস্ত্রে স্বীকার করা হয়েছে। নারদের মতে (১০.৩) ‘শ্রেণী’র নিয়মগুলির দ্বারাই ‘শ্রেণী’র সদস্যদের আচরণ বিচার করা হবে; দোষী সদস্যদের উপর বিচারের ও দণ্ডদানের অধিকারও ‘শ্রেণী’র আছে, এবং দেশের রাজা ‘শ্রেণী’র আইন অনুসারে কোনও দোষী ‘শ্রেণী’, সদস্যের বিচারকে অনুমোদন করবেন। অর্থাৎ এই বিধানের মধ্যে দিয়ে গিল্ডের নিয়ম ও প্রথাকে প্রায় দেশের আইনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ‘শ্রেণী’র বিশেষ ও স্বতন্ত্র মর্যাদার ইঙ্গিত এই বিধানের মধ্যে স্পষ্ট। তবে সাধারণত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ‘শ্রেণী’র ক্রিয়াকলাপে না ঘটলেও তা একেবারে অজানা ছিল না। ধর্মশাস্ত্রকারদের মতে যদি শ্রেণীর সভাপতি বা ‘প্রমুখ’ এবং ‘কার্যচিন্তকদের’ ভিতর ব্যাপক গোলযোগ বাধে অথবা পরিচালকগণ অসৎ হয়ে পড়েন বা ‘শ্রেণী’র সভাপতি যদি ‘শ্রেণী’র স্বার্থবিরোধী কাজ করেন, তবে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের জন্য ‘শ্রেণী’র সদস্যগণ আবেদন জানাতে পারেন। তবে এই জাতীয় হস্তক্ষেপের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত আলোচ্য যুগে জানা নেই; ফলে ‘শ্রেণী’র বিশেষ মর্যাদা ও অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছিল বলে মনে হয় না।
॥ ৪ ॥
সমকালীন সূত্র থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তার আলোচনা এই পর্বের বিষয়বস্তু। কালিদাসের কাব্যে নানা প্রকার ‘বিপণি’ বা দোকানের বর্ণনা আছে। তিনি সুরার দোকানের বর্ণনাও দিয়েছেন। কালিদাস ‘আপণমার্গ’ বলতে সম্ভবত এমন এক পথের কথা বলেছেন যার দুই পাশে দোকান ছিল। অমরকোশে ব্যবসা-বাণিজ্য বলতে ‘ক্রয়বিক্রয়’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যের জগতে শ্ৰেষ্ঠী ও সার্থবাহের উজ্জ্বল ভূমিকা সমকালীন বহু সূত্রে বলা হয়েছে। অমরকোশে ‘শ্রেষ্ঠী’র ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত ধনী অভিজাত বণিক হিসেবে, যিনি কখনও কখনও বণিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করতেন। সার্থবাহ ও শ্রেষ্ঠীর পার্থক্য সম্বন্ধে অমরকোশে সচেতনতা দেখা যায়। গোশকটের কাফেলা নিয়ে একদল বণিক বহু পণ্যসামগ্রী নিয়ে দূরদূরান্তের পথ পাড়ি দিতেন; এই জাতীয় বণিকদের নেতা সার্থবাহ বলে অভিহিত। সেই দিক থেকে বিচার করলে সার্থবাহও বিশেষ এক ধরনের বণিকদের নেতৃত্ব দিতেন। লেখমালাতেও সার্থবাহ ও শ্রেষ্ঠীর যথেষ্ট উল্লেখ আছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের বাংলার তাম্রশাসনগুলিতে বণিকদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। এই তাম্ৰশাসনগুলিতে দেখা যায় যে ‘বিষয়পতি’ বা জেলাধিকারিককে সহায়তা করার জন্য জেলাস্তরে একটি সমিতি ছিল, তার অন্যতম দুই সদস্য ছিলেন ‘নগরশ্রেষ্ঠী’ ও ‘সার্থবাহ’। ‘নগরশ্রেষ্ঠী’ কথাটি অনেক পণ্ডিত পেশাদারী সংগঠনের সভাপতি অর্থে নিয়েছেন; তাঁরা ‘নগরশ্রেষ্ঠী’কে মধ্যযুগীয় সুরাটের নগরসেঠের পূর্বসূরী বলে মনে করেন। কিন্তু প্রাচীন বাংলার জেলা পর্যায়ে এই জাতীয় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীর অস্তিত্ব খ্রীঃ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে কল্পনা করা কঠিন। তাই নগরশ্রেষ্ঠীকে আক্ষরিক অর্থে—জেলার প্রধান নগরের অগ্রগণ্য শ্রেষ্ঠী বা ব্যবসায়ী হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। সার্থবাহ কথার তাৎপর্য আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই জাতীয় বেসরকারী ব্যক্তি যখন সরকারী প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তখন বোঝা যায় যে তাঁরা তাঁদের পেশার প্রতিনিধি স্বরূপ ছিলেন এবং তাঁদের পেশাও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। শ্ৰেষ্ঠী ও নগরশ্রেষ্ঠীর সীলমোহর বৈশালীর উৎখনন থেকে পাওয়া গিয়েছে। কারিগরদের মত বণিকরাও সম্ভবত পেশাদারী সংগঠন গড়ে তোলেন। এমনই একটি বণিক সংগঠন ‘বণিকগ্রাম’ নামে ৫৯২ খ্রীঃ বিষ্ণুষেণের শাসনে স্থান পয়েছে। ‘গ্রাম’ কথাটি বসতি অর্থে এখানে ব্যবহৃত হয়নি; ‘গ্রাম’ কথাটির অর্থ এক্ষেত্রে সমূহ বা সমষ্টি (তুলনীয় গুণগ্রাম, স্বরগ্রাম প্রভৃতি)। অর্থাৎ ‘বণিকগ্রাম’ বলতে বণিকদের সামূহিক সংগঠনই বোঝাবে। লেখমালাটিতে বলা হয়েছে রাজা বিষ্ণুষেণ ‘বণিকগ্রাম’ নামক বণিক সংগঠনটিকে গুজরাট উপকূলের নিকটস্থ লোহাট নামক অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই কারণে বিষ্ণুষেণ তাঁর আদেশনামাকে ‘আচারস্থিতিপত্র’ নামে অভিহিত করেছেন। এই আদেশনামায় বণিকদের নানা রকম সুযোগ সুবিধা—কর ছাড় সহ—দেওয়া হয়েছিল। মোটামুটিভাবে সমগ্র উপমহাদেশেই যে ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য যাতায়াত করা মোটামুটি সম্ভবপর ছিল, তা ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণী থেকে স্পষ্ট হবে। বিশেষত হিউয়েন সাঙ প্রায় সমগ্র উপমহাদেশে স্থলপথে পরিভ্রমণ করেছিলেন। আভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য নদীপথের ব্যবহার অজানা ছিল না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় প্রাচীন বাংলার তাম্রশাসনগুলিতে। খেয়াল রাখা দরকার যে প্রাচীন বাংলা নদীমাতৃক অঞ্চল হওয়ায়—বিশেষতঃ গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে—নদীপথে যাতায়াত সুলভ ছিল। তাই এই অঞ্চলে জলযান তৈরী বা মেরামত করার জায়গা (‘নাবাতক্ষোণী’) অজানা ছিল না; নৌকো বা জলযান যেখানে নিয়মিত দাঁড়াত তা লেখমালায় ‘নৌদণ্ডক’ বা ‘নৌবন্ধ’ বলে উল্লিখিত হয়েছে।
বৈদেশিক বাণিজ্যে এই পর্বে উপমহাদেশের ভূমিকা কেমন ছিল? প্রাক ৩০০ খ্রীঃ পর্বে রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য ভারতকে আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। কিন্তু তৃতীয় শতকের শেষার্ধে প্রাচ্যের তথা ভারতের সঙ্গে রোমের বাণিজ্য সম্পর্কে ভাঁটা পড়ে; তার প্রধান কারণ রোম সাম্রাজ্যের পতনোন্মুখ অবস্থা ও প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যে রোমের ক্রমবর্ধমান অনীহা। এর ফল ভারতের সমুদ্র বাণিজ্যে পড়তে বাধ্য। সমুদ্র বাণিজ্যের পরিমাণ ভারতে সম্ভবত কমে গিয়েছিল। তবে রোম-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে মন্দা আসার যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তাতে সম্ভবত খানিকটা ভারসাম্য আসে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বাইজানন্টিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর (৪৭৩ খ্রীঃ-এ রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর)। কনস্টান্টিনোপলের শাসকরা প্রাচ্যের সঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্যে আগ্রহী ছিলেন। তবে রোম-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কের তুঙ্গ অবস্থায় ভূমধ্যসাগর ও ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য চলত মূলত লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে এবং এই বাণিজ্যে আরবী ও ইথিওপীয় বণিকদের ভূমিকা সুবিদিত। কিন্তু রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর কনস্টান্টিনোপল থেকে প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য মূলত পারস্য উপসাগরের মারফৎ শুরু হয়। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সমকালীন সর্বপ্রধান শক্তি ছিল ইরানের সাসানীয় বংশ। আরব সাগরে সমুদ্র বাণিজ্য সম্বন্ধে বাইজানটাইন ও সাসানীয় শাসক উভয়েই আগ্রহী ছিলেন ও তাঁদের মধ্যে এই বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তারের জন্য রেষারেষিও ছিল। পারস্য উপসাগরের উত্থানের ফলে ভারতের পশ্চিম উপকূলের কিছু বন্দর আবার সজীব হয়ে ওঠে। ষষ্ঠ শতকের শেষে রচিত কসমাস ইণ্ডিকোপ্লয়েস্টেস-এর ক্রিশ্চিয়ান টপোগ্রাফী গ্রন্থে কোঙ্কন উপকূলের চৌল (সিবোর) ও কল্যাণ (ক্যালিয়েনা) বন্দরের গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছে। এখানে কল্যাণ বন্দরের পুনরুত্থান বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। এই বন্দর খ্রীঃ প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে শক-সাতবাহন প্রতিদ্বন্দ্বিতার দরুন সাময়িকভাবে তার গুরুত্ব হারিয়েছিল। কসমাস এর সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় খ্রীঃ ষষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এই বন্দর আবার কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পায়। তবে কসমাসের বিবরণীতে দক্ষিণ এশিয়ার যে অঞ্চল সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে তা শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্যকভাবে কসমাস উপলব্ধি করেছিলেন। আরব সাগরে সমুদ্র বাণিজ্যে ভারতের পশ্চিম উপকূলের বন্দরগুলির ভূমিকা যে একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি, তার আরও একটি নিদর্শন সপ্তম শতকে দেখা যায়। দাক্ষিণাত্যের চালুক্যবংশীয় রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী (৬১০-৪২) পারস্যের রাজা দ্বিতীয় খসরুর সঙ্গে দৌত্য সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এ বিষয়ে আল টবারীর সাক্ষ্য আলোকপাত করে। এই দৌত্যকর্ম কেবলমাত্র কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না, এই জাতীয় বৈদেশিক যোগসূত্রের পিছনে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রেরণা অনুমান করা অসঙ্গত হবে না। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে দ্বিতীয় পুলকেশী পুরী দ্বীপ বা বর্তমান এলিফ্যাণ্টা দ্বীপ (বম্বের নিকট অবস্থিত) জয় করেন। সমুদ্রের ভিতর একটি দ্বীপ দখল সম্ভবত আরব সাগরে বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপের দৃষ্টিকোণ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
পূর্ব উপকূলে বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ চলত প্রধানত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে। প্রাচীন বাংলার প্রধান বন্দর তাম্রলিপ্ত (বর্তমান তমলুক, মেদিনীপুর জেলা) এই সময়ে তার খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছিল। এই বন্দরের প্রশংসা ফাহিয়েন ও হিউয়েন সাঙ—দুই চীনা পরিব্রাজকের লেখনীতেই বিধৃত। ফাহিয়েন ভারত থেকে চীনে ফেরার পথে তাম্রলিপ্ত থেকে জাহাজে পাড়ি দিয়ে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত যান, তারপর শ্রীলঙ্কা থেকে একটি চীনা বাণিজ্যপোতে চড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে বহু বিপদ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত চীনদেশে পৌঁছন। এই বর্ণনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে তাম্রলিপ্ত বন্দর বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরের পূর্বাংশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। প্রাচীন বাংলার সমতট অঞ্চলও (কুমিল্লা, নোয়াখালি এলাকা, বাংলাদেশ) ধীরে ধীরে দূরপাল্লার সমুদ্র বাণিজ্যে আত্মপ্রকাশ করছিল। হিউয়েন সাঙ জানিয়েছেন যে সান-মো-তা-তা দেশটি মূলত বাণিজ্যের কারণে প্রসিদ্ধ এবং এই এলাকার সঙ্গে ছয়টি দূর দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। এই ছয়টি অঞ্চল সম্বন্ধে হিউয়েন সাঙ-এর স্পষ্ট ধারণা অবশ্য ছিল না, তবে তাঁর বর্ণনা থেকে ধারণা হয় যে ঐ অঞ্চলগুলি নিম্ন বর্মা উপকূলভাগ ও শ্যামদেশের উপকূল অঞ্চলকে বোঝাত। হিউয়েন সাঙ আরও জানিয়েছেন যে ওড্র বা উৎকল দেশে চরিত্র ও কঙ্গোদ বন্দর দুটিও দূরপাল্লার সমুদ্র বাণিজ্যে অংশ নিত। সুদূর দক্ষিণ ভারতে পল্লব ভূখণ্ডের অন্তর্গত কাঞ্চীপুরম ও মহাবলীপুরম অঞ্চল ছিল প্রধান সমুদ্র বাণিজ্যকেন্দ্র। পল্লবদের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিয়মিত সমুদ্র বাণিজ্যের উপর বাহাদুর চন্দ্র ছাবরা ও নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর গবেষণা থেকে এই বাণিজ্যের গুরুত্ব বোঝা যায়।
বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে মুদ্রাব্যবস্থা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। গুপ্ত সম্রাটগণ প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বর্ণমুদ্রার প্রবর্তন করেছিলেন। গুপ্ত মুদ্রাভাণ্ডার (‘হোর্ড’) নানা অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে ও তার দ্বারা গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার উচ্চমান সম্বন্ধে নিঃসংশয় হওয়া যায়। তবে স্কন্দগুপ্তের আমল থেকে গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার ওজন ১২৪ গ্রেণ থেকে বাড়িয়ে ১৪৪ গ্রেণ করা হয়; কিন্তু স্বর্ণমুদ্রার ধাতব বিশুদ্ধি ক্রমশ কমতে থাকে; গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তিম অবস্থায় স্বর্ণমুদ্রাগুলিতে স্বর্ণের পরিমাণ থাকত মুদ্রার ওজনের অর্ধেকেরও কম। গুপ্তরা রৌপ্যমুদ্রা চালু করেছিলেন ঠিকই; কিন্তু এই জাতীয় মুদ্রা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলেই প্রথম প্রস্তুত হয়। প্রকৃতপক্ষে এই মুদ্রা পশ্চিম ভারতের শক ক্ষত্রপ রৌপ্য মুদ্রার আদলে তৈরী হয়। গুপ্তদের রৌপ্যমুদ্রাগুলি মূলত গুজরাট অঞ্চলে ব্যবহৃত হত। গুজরাটে বহির্বাণিজ্যের জন্য এই মুদ্রাগুলি হয়তো কিছুটা গুরুত্ব পেয়েছিল। ভারতের সঙ্গে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের বাণিজ্য সম্পর্কের অকাট্য প্রমাণ পূর্ব রোমান সম্রাটদের মুদ্রা প্রাপ্তি। মুদ্রাগুলির প্রাপ্তিস্থান মূলত দক্ষিণ ভারতে এবং বিশেষতঃ কেরল ও তামিলনাড়ুর সীমান্তবর্তী (কোয়েম্বাটুর অঞ্চলে) এলাকায়। এর থেকে অনুমান করা যায় যে বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মালাবার উপকূলের বন্দরগুলির মধ্য দিয়ে প্রচলিত ছিল। গুপ্তদের স্বণ ও রৌপ্যমুদ্রার অসামান্য সৌকর্য থাকা সত্ত্বেও অস্বীকার করা কঠিন হবে যে তামার মুদ্রা গুপ্ত বংশীয় রাজারা খুব বেশী পরিমাণে তৈরী করেননি। এর আগের পর্বে অরাজতান্ত্রিক কৌম গোষ্ঠীগুলিতেও তাম্রমুদ্রা প্রচলিত ছিল; তাম্রমুদ্রার ব্যাপক ব্যবহারে খ্রীঃ পঞ্চম থেকে সপ্তম শতকে ভাঁটা পড়েছিল বলে কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন। (তবে গুপ্ত আমলের পূর্ববর্তী যুগের তাম্রমুদ্রা লেনদেনের কাজে ব্যবহার করা হত তা অনুমান করা যায়। বৰ্দ্ধমানের কাছে মঙ্গলকোটের উৎখনন থেকে গুপ্ত স্তরে প্রচুর পরিমাণে কুষাণ তাম্রমুদ্রার উপস্থিতি চোখে পড়ে।) তাম্রমুদ্রা প্রধানত দৈনন্দিন তৈজসপত্র কেনাবেচার জন্য লাগে, আর স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রা সাধারণত বৈদেশিক বা দূরদূরান্তের বাণিজ্যে ব্যবহৃত হয়। তাহলে কি দৈনন্দিন জীবনে মুদ্রার ব্যবহার কমে গিয়েছিল? রামশরণ শর্মা এইরূপই মনে করেন। তিনি দেখিয়েছেন ফাহিয়েনের বিবরণ অনুসারে নিত্যকার লেনদেন কড়িতে চলত। অতএব এমন অনুমান নিতান্ত ভুল বোধহয় হবে না যে, সমকালীন অর্থনীতিতে বোধহয় মুদ্রামনস্কতা আগের চেয়ে হ্রাস পেয়েছে। দৈনন্দিন বাণিজ্যিক লেনদেনে ভাঁটা পড়লে হয়তো তাম্রমুদ্রার ব্যবহারে হ্রাস হতে পারে। গুপ্তরা যদিও মুদ্রাভিত্তিক অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, গুপ্তদের সমসাময়িক দাক্ষিণাত্যের বাকাটক বংশীয় রাজাদের ভূখণ্ডে কিন্তু এতাবৎ কোনও মুদ্রার সন্ধান পাওয়া যায়নি। অথচ দাক্ষিণাত্যে বাকাটকদের প্রতিবেশী বিষ্ণুকুণ্ডিন ও শক ক্ষত্ৰপরা নিয়মিত মুদ্রা ব্যবহার করতেন। বাকাটকরা এমন এক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন যেখানে মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা তুলনামূলক ভাবে কম ছিল। রামশরণ শর্মার মতে বাকাটকদের মুদ্রারহিত অর্থনীতি কার্যত এই অঞ্চলে বাণিজ্যের অবক্ষয়ের পরিচয় বহন করে। কৃষ্ণমোহন শ্রীমালী বাকাটকদের লেখমালাগুলি বিচার করে দেখিয়েছেন যে এই তথ্যসূত্রে মাত্র একজন বণিকের কথা জানা যায়, তাঁর নাম চন্দ্র। এই ঘটনাও তাঁর মতে ব্যবসায় বাণিজ্যের আপেক্ষিক অবক্ষয়ের চিহ্ন বহন করছে। সামগ্রিকভাবে বাণিজ্যিক সংকোচনের সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না; অন্তত এটুকু বলা যায় যে রোম-ভারত বাণিজ্যের সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উপমহাদেশের যে ভূমিকা দেখা গিয়েছিল, তার তুলনায় খ্রীঃ ৩০০-৬৫০ পর্বের বাণিজ্য—বিশেষত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য—বোধহয় হ্রাস পেয়েছিল। তবে তারই মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জগুলির সঙ্গে দূরপাল্লার সমুদ্র বাণিজ্য সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ের মন্দা অবস্থাকে কিছুটা রোধ করেছিল। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে নগরায়ন সংক্রান্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে নগরগুলির খাদ্য সংস্থান অবশ্যই আসত কৃষিপ্রধান গ্রামীণ এলাকা থেকে, তবে নগরগুলির সমৃদ্ধি নির্ভর করত প্রধানত কারিগরী শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে। খ্রীঃ ৩০০-৬৫০-এর সময়সীমায় বোধহয় কারিগরী শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য কৃষির তুলনায় কিছুটা গুরুত্ব হারিয়েছিল। অগ্রহার নীতির দ্বারা কৃষির প্রসার ঘটানোই এই আমলের অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান বিশেষত্ব। এই অবস্থায় কি নগরজীবন ও নগরায়নের উপর কি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল? প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও হিউয়েন সাঙের ভ্রমণ বিবরণীর ভিত্তিতে রামশরণ শর্মা মনে করেন উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে—বিশেষত গাঙ্গেয় উপত্যকায়—নগরগুলি অবক্ষয়ের পথে চলছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক দিক দিয়ে নগরায়নের সবচেয়ে সমৃদ্ধ পরিচয় পাওয়া যায় খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতক থেকে খ্রীঃ তৃতীয় শতকের সময়সীমায়। উত্তর ভারতের অনেকগুলি সমৃদ্ধ নগর ক্রমে অবসন্ন হয়ে পড়ছিল, রামশরণ শর্মা ও তাঁর অনুগামীরা এই মতে বিশ্বাসী। এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা পরবর্তী অধ্যায়ে করা হবে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বাৎস্যায়নের কামসূত্র গ্রন্থে নগরজীবনের সমৃদ্ধ রূপই দেখা যায়। বাৎসায়ন কাম ও বাসনা চরিতার্থ করার জন্য যে-যে বিধান দিয়েছেন, তা প্রধানত নগরবাসী উচ্চবিত্ত স্বচ্ছল মানুষকে উদ্দেশ করে; এই জাতীয় ব্যক্তি কামসূত্রে ‘নাগরক’ বা নগরের বাসিন্দা বলে অভিহিত। নাগরকের জীবনে শহুরে লোকের আমোদ, প্রমোদ, শখ শৌখিনতার সকল উপকরণই সুলভ ছিল। যথেষ্ট অর্থ না থাকলে ও নাগরিক জীবনের সাংস্কৃতিক দিকটি সক্রিয় না থাকলে নাগরকের জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য। তাই বাৎস্যায়নের কামসূত্র নগরের অবক্ষয়ের তুলনায় প্রাণবন্ত নগরজীবনেরই আভাস দেয়। দক্ষিণ ভারতে দুই বিখ্যাত তামিল মহাকাব্য শিলপ্পাদিকারম ও মণিমেখলাই (রচনাকাল পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দী)—কাবেরীপট্টিনম নগরের সমৃদ্ধ অবস্থারই পরিচয় দেয়। এই দুই গ্রন্থ থেকে বোঝা যায় যে কাবেরীপট্টিনম নগরী বহু দেশী বিদেশী বণিকের কর্মতৎপরতায় মুখর ছিল। দেশী ও বিদেশী বণিকদের বাসস্থান, কারিগরদের বাসস্থান, দোকানবাজার শহরের বিভিন্ন মহল্লায় অবস্থিত ছিল। সমুদ্রতীরস্থ এই নগরে বাতিঘরও ছিল বলে তামিল মহাকাব্যে বলা হয়েছে। পুরাতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে মনে হয় এই নগর পঞ্চম, ষষ্ঠ শতক অবধি সমৃদ্ধ অবস্থায় ছিল। ফলে রামশরণ শর্মা আলোচ্য আমলে সামগ্রিকভাবে নগরের অবক্ষয়ের যে নজীর দেখিয়েছেন তার ব্যতিক্রম অলভ্য নয়। তবে উত্তর ভারতের অনেকগুলি শহরই তাদের জীবনীশক্তি হারিয়েছিল বা হারাবার পথে চলেছিল, এ বিষয়ে রামশরণ শর্মা পুরাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যগত প্রমাণ হাজির করেছেন।
॥ ৫ ॥
আগেই বলা হয়েছে যে আলোচ্য পর্বের অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চার পক্ষে অন্যতম প্রধান উপাদান লেখমালা। লেখমালা যেহেতু প্রধানত অগ্রহার সৃষ্টির কারণেই লিখিত, তাই অগ্রহার ব্যবস্থানুযায়ী বহু কর মকুবের ঘটনাও এই উপাদানে স্থান পেয়েছে। কর ছাড় দেবার তথ্য এই প্রসঙ্গে বিশেষ তাৎপর্যবাহী, কারণ তার থেকে বোঝা সম্ভব স্বাভাবিক ভাবে রাষ্ট্র কোন কোন খাতে রাজস্ব সংগ্রহ করত।
গুপ্ত ও বাকাটকদের লেখমালায় যে সব কর ও কর থেকে পরিহারের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে ভূমি রাজস্ব ছিল সর্বপ্রধান। ভূমি রাজস্বের পরিমাণ বা হার কি ছিল, সে বিষয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। সাধারণভাবে প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রতত্ত্বে রাজা উৎপাদনের এক ষষ্ঠাংশ পাবার অধিকারী এবং সেই কারণেই তিনি ‘ষড়ভাগিন’ বলে অভিহিত। আলোচ্য আমলেও ভূমি রাজস্বের হার এক ষষ্ঠাংশ থাকলে বিস্মিত হবার নেই। এই সম্ভাবনার সমর্থন পাওয়া যায় প্রাচীন বাংলার তাম্রশাসনগুলিতে। এই তাম্রশাসনগুলিতে ভূমিদানের প্রশংসা করা হয়েছে, বলা হচ্ছে, ভূমিদাতার যে পুণ্য অর্জন হয় রাজা তারও এক ষষ্ঠাংশ পেয়ে থাকেন। এক ষষ্ঠাংশ পরিমাণ ভূমিরাজস্ব সাধারণত লেখমালায় ‘ভাগ’ বলে আখ্যাত। লেখমালায় ‘কর’ ও ‘উপরিকর’ নামক যে দুই রাজস্ববোধক পরিভাষা জানা যায় তার সঠিক অর্থ নিৰ্দ্ধারণ করা কঠিন; তবে দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে মুখ্য ও গৌণ রাজস্ব ‘কর’ ও ‘উপরিকর’ নামে পরিচিত ছিল। আরও একটি ভূমিরাজস্বের কথা লেখমালায় আছে, যার নাম ‘উদ্ৰঙ্গ’। স্থায়ী প্রজার উপর যে কর বসানো হত তাকে ‘উদ্ৰঙ্গ’ বলা হত বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা; উদ্ৰঙ্গ জাতীয় কর সংগ্রহকারী কর্মচারী ‘ঔদ্ৰঙ্গিক’ নামে লেখমালায় উল্লিখিত (দ্রষ্টব্য-গোপচন্দ্রের মল্লসারুল লেখ)। কৃষি উৎপাদনের উপর যে কর নেওয়া হত তার আরও দুটি নাম জানা গিয়েছে: পশ্চিম ভারতের মৈত্রক রাজ্যে ‘ধান্য’ বলে যে কর নেওয়া হত, তা নিঃসন্দেহে উৎপন্ন ফসলের উপর ধার্য করা হত (ধরসেনের মালিয়া তাম্রশাসন দ্রষ্টব্য); কৃষকের উপর ‘হালিককর’ নামক কর ধার্য হত উত্তর ভারতে (শর্বনাথের খো তাম্রশাসন দ্রষ্টব্য)। কৃষিজ উৎপাদনের উপর ‘ভাগ’ ছাড়াও আরও নানা খাতে কর নেওয়া হত বলে মনে হয়।
ভূমি রাজস্ব সম্ভবত ফসলের মারফৎ নেওয়া হত। নগদ অর্থে যে কর নেওয়া হত, তা লেখমালায় ‘হিরণ্য’ বলে কথিত (‘হিরণ্য’ কথার সাধারণ অর্থ সোনা; কিন্তু রাজস্ব ব্যবস্থায় কথাটির পারিভাষিক মানে আছে—নগদ দিয়ে প্রদেয় রাজস্ব ‘হিরণ্য’ বলে আখ্যাত)। কারিগরী শিল্পের উপর ও বণিকদের কাছ থেকে নগদ কর আদায়ের সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। বৃত্তির উপর কর নেবার প্রকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া যাবে বিষ্ণুষেণের তাম্রশাসনে (৫৯২ খ্রীঃ)। এই তাম্রশাসন অনুসারে কাংসকার, বস্ত্রশিল্পী, অস্ত্রনির্মাতা (‘কাংস্য-দোষ্য-যুধ’), সুরা প্রস্তুতকারী (‘কল্লার’), রঙ্গকার, তাঁতী, চর্মকার (‘চিম্পক-কোলিক-পদকার’), কর্মকার, সূত্রধর, নাপিত ও কুমোর (‘লোহাকার-রথকার-নাপিত-কুম্ভকার’)-এর উপর কর নেওয়া হত। তবে আলোচ্য তাম্রশাসনটি বিচার করলে মনে হয় কারিগররা উৎপন্ন দ্রব্যের একাংশ দিয়ে করভার মেটাতে পারতেন, অর্থাৎ নগদ দিয়ে কর দান করা আবশ্যিক ছিল না। নুন উৎপাদনের উপর রাষ্ট্র যে কর আদায় করত, সেই ধারণা সম্ভবত খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ শতক থেকেই প্রচলিত ছিল; এই আমলেও তার ধারাবাহিকতা লক্ষ্যণীয়। নুনের উপর কর নেবার নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে বাকাটক লেখমালায়। গুজরাট উপকূলে ব্রোচের কাছে নুন উৎপাদনের কথা হিউয়েন সাঙ-এর বর্ণনায় পাওয়া যায়; অনুমান করা চলে যে এ ক্ষেত্রেও নুন উৎপাদনের উপর রাজস্ব নেওয়া হত।
বণিকদের উপর কি পরিমাণ কর ধার্য হত তারও সঠিক বৃত্তান্ত আমাদের অজানা। প্রাচীন বঙ্গে (ঢাকা-ফরিদপুর-বিক্রমপুর অঞ্চলে) ষষ্ঠ শতকের মধ্য ভাগে উৎকীর্ণ লেখমালায় ‘ব্যাপারকারণ্ড্য’ নামক যে রাজকর্মচারীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তিনি সম্ভবত ‘ব্যাপার’ বা বাণিজ্যের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে, বাণিজ্য থেকে কর আদায় করার দায়িত্বও তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। অন্যতম বাণিজ্যিক কর ছিল ‘শুল্ক’ যা সাধারণত পণ্যের গমনাগমনের উপর ধার্য হত; শুল্ক সংগ্রাহক কর্মচারী লেখমালায় ‘শৌল্কিক’ নামে আখ্যাত। ৫৯২ খ্রীঃ বিষ্ণুষেণের তাম্রশাসনে বিদেশ থেকে প্রত্যাগত বণিক ও বিদেশ যাত্রায় উদ্যত বণিকদের উপরে কর নেবার উল্লেখ দেখা যায়। সামগ্রিকভাবে বিচার করলে কৃষিখাত থেকে প্রাপ্য রাজস্ব সংক্রান্ত পরিভাষাই অধিক পরিমাণে লেখমালায় দেখা যাবে। সেই তুলনায় বাণিজ্য ও শিল্প উদ্যোগের উপর আহৃত করের নাম সংখ্যায় কম। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা অযৌক্তিক হবে না যে, আলোচ্য আমলে কৃষি থেকেই মূলত সম্পদ সংগৃহীত হত; কিন্তু খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক থেকে খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত বাণিজ্য ও কারিগরী শিল্প থেকে প্রভূত কর আহরণের কথা আমাদের জানা আছে। সম্পদ উৎপাদন ও সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
রাজস্ব ব্যবস্থার যে দিকটি আলোচ্য পর্বকে বিশেষ রূপ দিয়েছে তা হল পীড়নমূলক করের সংখ্যা বৃদ্ধি। এই জাতীয় পীড়নমূলক কর ছিল ‘বিষ্টি’ বা বাধ্যতামূলক বেগার শ্রম দান। খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে ‘বিষ্টি’ না চাপিয়ে মহাক্ষত্ৰপ রুদ্রদামন নিজের মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন; তার দুই বা তিন শতাব্দী পরে বাকাটক রাজ্যে ‘বিষ্টি’ নেবার প্রবণতা বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। বাকাটক তাম্রশাসনে ‘সর্ববিষ্টি’ পরিভাষার উল্লেখ থেকে মনে হয় নানা ভাবে এই ‘বিষ্টি’ চাপানো হত। ‘বিষ্টি’র আধিক্য নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষ ও দরিদ্রতর কৃষক সম্প্রদায়ের পীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রসঙ্গে বাৎস্যায়নের কামসূত্রের একটি তথ্যকে পেশ করা যেতে পারে। কামসূত্রকার উল্লেখ করেছেন যে কৃষক রমণীরা বিনা পারিশ্রমিকে স্থানীয় ভূস্বামীকে বিবিধ সেবাদান করত: যেমন, তার শস্য ঝাড়াই বাছাই করা, তার ফসলের গোলায় শস্য ভর্তি করে দেওয়া প্রভৃতি। এই ঘটনা ‘বিষ্টি’ প্রথার দিকে নির্দেশ করে; এর দ্বারা কৃষককে শোষণের পথ প্রশস্ত হয়েছিল।
পণ্ডিতদের মতে আলোচ্য আমলে করের সংখ্যা পূর্ববর্তী আমলের তুলনায় বেশী ছিল। এর দ্বারাও প্রজার উপর আর্থিক চাপ পড়ত। বাকাটক লেখমালায় নিয়মিত রাজস্বের পাশাপাশি বহুরকম অনিয়মিত কর চাপানো হত: অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত আদায় কার্যত নিয়মবহির্ভূত উপঢৌকনের রূপ নিতে পারত। গ্রামে উৎপন্ন দুধ, মধু, ফল, ফুল, চর্ম, অঙ্গার (জ্বালানী/কাঠকয়লা), বৃষ ও ধেনু প্রভৃতি আদায় করার নজীর বাকাটক লেখমালায় স্পষ্টভাবে উল্লিখিত। মনে হয়, রাজস্ব সংগ্রহকারী রাজকর্মচারীরা গ্রামে গেলে গ্রামবাসী নিয়মিত কর প্রদান ছাড়াও উপরিউক্ত খাতে বিধিবহির্ভূত উপঢৌকন দিতে বাধ্য থাকতেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষক সমাজের উপর প্রভূত চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনাকে বাতিল করা যায় না।
॥ ৬ ॥
এই অধ্যায়ের প্রারম্ভিক মন্তব্য হিসেবে আলোচ্য যুগের অসামান্য সাংস্কৃতিক অবদানের কথা বলা হয়েছিল। সাধারণভাবে ধারণা আছে, এই প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক অবস্থা অনুরূপ সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক জীবন ব্যতিরেকে ঘটা সম্ভব ছিল না। সামগ্রিকভাবে উপমহাদেশের আর্থিক সাবস্থা কেমন ছিল, এই আলোচনায় সচরাচর ফা-হিয়েনের একটি মন্তব্য দাখিল করা হয়ে থাকে। ফা-হিয়েন মধ্যদেশের (উত্তর ভারতের বৃহদংশ) সচ্ছল অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন; তাঁর বর্ণনায় সাধারণ মানুষের সমৃদ্ধ অবস্থার ইঙ্গিত আছে। গুপ্ত আমলের স্বর্ণমুদ্রার প্রাচুর্য ও অসামান্য শৈল্পিক উৎকর্ষ, সমকালীন সাহিত্যে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যের উজ্জ্বল বর্ণনা, কামসূত্রে বর্ণিত নগরজীবনে বিলাসব্যসনের চিত্র, কালিদাসের কাব্যে আর্থিক সমৃদ্ধির নানা বিবরণের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকরা বহু সময়েই আলোচ্য আমলটিকে ‘সুবর্ণ যুগ’ বলে চিহ্নিত করেন।
কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে আর্থিক সমৃদ্ধির যে চিত্রটি ফুটে ওঠে, তার বাস্তবতা নিয়ে যে সন্দেহ থেকে যায়, আমাদের আলোচনা থেকে তা বোঝা কঠিন নয়। আর্থিক সুযোগ সুবিধা ও সমৃদ্ধি বোধহয় সমাজের উচ্চকোটি মানুষই পেয়েছিল; আপামর জনসাধারণ যাবতীয় বৈষয়িক উন্নতি ও সুবিধা ভোগ করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। অগ্রহার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে কৃষির প্রসার ঘটেছিল ঠিকই, কিন্তু ভূমি ব্যবস্থায় অন্তর্বর্তীদের দ্রুত উদ্ভব ও উত্থান দেখা গিয়েছিল। কৃষক যে ক্রমশই অধিকতর প্রকারের করভারে পীড়িত হচ্ছিল তাতে সন্দেহ নেই; ‘বিষ্টি’ জাতীয় পীড়ন কখনওই সাধারণ কৃষিজীবীর পক্ষে কল্যাণকর হয়নি। অন্য দিকে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবাণিজ্যে ভাঁটার সম্ভাবনাকে বাতিল করা মুশকিল; এর প্রতিকূল প্রভাব অবশ্য সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে ব্যাহত করতে পারেনি। তার কারণ, অগ্রহার ব্যবস্থার দ্বারা কৃষি অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটেছিল ব্যবসাবাণিজ্য জলপথে হ্রাস হওয়া ছাড়াও স্থলপথের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বোধহয় আগের তুলনায় কমই ছিল; তার প্রধান কারণ মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় যাযাবর হূণ জাতির উপদ্রব ও অভিযান, যার প্রত্যক্ষ অভিঘাত গুপ্ত সাম্রাজ্যে ও তার অব্যবহিত পরের যুগে পড়েছিল। তবে হূণদের সামরিক ও রাজনৈতিক সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ায় সমকালীন সামাজিক-আর্থিক জীবনযাত্রা বোধহয় একেবারে ব্যাহত হয়নি। মুদ্রা ব্যবহারে সংখ্যাল্পতাও এই আমলের অর্থনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য: অন্তত বাকাটকদের এলাকায় প্রায় মুদ্রারহিত অর্থনীতির জন্ম হয়েছিল। কৃষি অর্থনীতির উপর সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপ পড়া অসম্ভব নয়; তেমনটি ঘটলে তার ফলশ্রুতি সুখকর হওয়া কঠিন। কৃষি অর্থনীতির প্রাধান্য এবং কারিগরী শিল্প ও ব্যবসায়ে আপেক্ষিক সঙ্কোচন দেখা দিলে অর্থনীতি ক্রমশ গ্রামকেন্দ্রিক হয়ে যাবার প্রবণতা লাভ করে। এই লক্ষণগুলির মধ্যে সামগ্রিক আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ নেই। তাই সুবর্ণযুগের ধারণা কষ্টকল্পিতই মনে হয়। আপামর জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান অতি উন্নত ছিল, এমন ধারণা সুবর্ণযুগের কল্পনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মিশে থাকে। তার সমর্থনে ঐ আমলের প্রমাণ দেওয়া কঠিন। অতীতের কোনও পর্বে সুবর্ণযুগের সন্ধান করা যে বৃথা চেষ্টা, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝা-এর এই মন্তব্য আলোচ্য যুগের অর্থনীতির প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য।