সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – পূজাবাটী
মহা সমারোহে রাঘব সেনের বাটীতে সপ্তমীপূজা শেষ হইয়া গেল। “পুণ্যশ্লোক রাঘবসেন,’ “দাতা-ভর্তা রাঘবসেন,”
“ক্ষণ-জন্মা রাঘবসেন” এইরূপ নানাপ্রকার গুণানুবাদ করিতে করিতে ব্রাহ্মণমণ্ডলী দলে দলে বিদায় লইয়া চলিলেন এবং অসংখ্য কাঙ্গালীর কোলাহল ও আশীর্ব্বাদে দিমণ্ডল আকুলিত হইতে লাগিল। ক্রমে কাক ও কাঙ্গালীর কলরব কমিল, উচ্ছিষ্ট-পত্র লইয়া বৃষভ ও কুকুরের কলহ থামিল এবং মাছির ভ্যাভ্যানানি ও উমেদারদের ঘ্যানঘ্যানানি নিবৃত্তি পাইল, সন্ধ্যার সহিত শান্তিদেবীর আবির্ভাব হইল।
পুরীমধ্যে শত শত দীপপুঞ্জ প্রজ্জ্বলিত হইল, ধূপ, ধুনা ও গুগ্গুল গন্ধে চতুৰ্দ্দিক আমোদিত হইতে লাগিল এবং শঙ্খ, ঘণ্টা, ঝাঁজর, কাঁসর ও দগড় দামামা বাজিয়া উঠিল। দশভূজার আরতি আরম্ভ হইল। হিন্দুচূড়ামণি, বৈষ্ণব শিরোমণি রাঘবসেন গললগ্নীকৃতবাসে, যুক্তকরে বিশ্বজননীর সম্মুখে আসিয়া অতীব বিনীতভাবে দণ্ডায়মান হইলেন। তাঁহার শিরোদেশে শিখা, নাসিকায় তিলক ও গলদেশে ত্রিকণ্ঠী শোভা পাইতেছিল, বস্তুতঃ এখন তাঁহাকে দেখিয়া কে না বলিবে, রাঘব সেন পরম ধার্ম্মিক, পরম বৈষ্ণব ও পরম ভক্ত?
কিন্তু এখন তাঁহার কার্য্য-সাধক রতন শৰ্ম্মা কোথা? আইস পাঠক, তাহাকে দেখিবেন যদি, নিভৃত পাতালপুরে আইস। সে অভাগা সমস্ত দিন কিছুই খায় নাই, এক বিন্দু জলও পান করে নাই; রাঘব তাহাকে খাওয়াইবার জন্য অনেক যত্ন ও অনুনয় করিয়াছিলেন, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই, সে অনাহারে প্রাণত্যাগ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিল। তাহার জীবনে আর মমতা ছিল না, জীবন তাহার ভার বোধ হইয়াছিল। নানা প্রকার ভয়ঙ্করী চিন্তায় তাহার হৃদয় ভরিয়া গিয়াছিল। অসহ্য-যন্ত্রণায় সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিয়া সন্ধ্যার সময়ে একবারমাত্র নিদ্রিত হইয়াছিল, কিন্তু অন্তর্দাহে সুনিদ্রা হইবার সম্ভাবনা কোথায়? অচিরেই তাহার সে নিদ্রা ভঙ্গ হইল।
“হায়, কি করিলাম!” বলিয়া সে উঠিয়া বসিল; দেখিল, চতুৰ্দ্দিক নিবিড় অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সেই ভয়ঙ্কর স্থানে সে সময়ে গভীরতর অন্ধকার ভিন্ন আর কিছুই দৃশ্যমান ছিল না। সেই ভয়ঙ্কর স্থানে দুই দিবস পূর্ব্বে মাধা ডাকাইত মরিয়াছিল, এবং সেই স্থানেই তাহাকে পুঁতিয়া রাখা হইয়াছিল। রাঘবের পাতালপুরীরূপ কীৰ্ত্তিস্তম্ভমূলে যে কত-শত নরকঙ্কাল প্রোথিত ছিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। রত্নার মনে হইল, যেন সেই অন্ধকাররাশিতে সেই নিবিড়তর তিমিরতরঙ্গে, নৈশাকাশে ধূমকেতুর ন্যায় শত শত নরকঙ্কাল নানা ভঙ্গিতে ক্রীড়া করিয়া বেড়াইতেছে। অপঘাতমৃত্যু হইলে ভূত হয়, রত্নার ইহা ধ্রুব ধারণা ছিল। অকস্মাৎ কি একটা শব্দ হইল, রত্না চমকিয়া উঠিল এবং যেদিক হইতে সেই শব্দ আসিল, সেইদিকে মনোযোগের সহিত কর্ণপাত করিয়া রহিল। তাহার বোধ হইল, কে যেন সাবধান পাদবিক্ষেপে তাহার দিকে চলিয়া আসিতেছে। রত্নাপাখী জিজ্ঞাসিল, “কে ও?”
উত্তর হইল, “কে ও?”
একি প্রতিধ্বনি হইল, না কেহ ব্যঙ্গ করিয়া বলিল ‘কে ও’?
রত্না সন্দেহ ভঞ্জন জন্য পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসিল, “কে তুই?’
উত্তর হইল, “তুই কে?”
ইহা ত প্ৰতিধ্বনি নয়, কে বলিল, ‘তুই কে??
রত্না কহিল, “আমি রতন শর্ম্মা, কিন্তু তুমি কে, মানুষ, না প্রেতাত্মা?”
প্রত্যুত্তর হইল, “আমি কজ্জলা।”
কজ্জলা বলিল, “রতন—ভয় নাই, আমি তোর ঘাড় ভাঙ্গিতে আসি নাই। আমি ভূত হই নাই—আমি মরি নাই—কিন্তু বাঁচিতেও আর ইচ্ছা নাই। মরবার আগে তোকে একবার দেখে মরতে ইচ্ছা হল, তাই তোকে একবার দেখতে এলেম।”
পরক্ষণেই কজ্জলা রত্নার ভুজপাশে আবদ্ধ হইল, রত্নার নয়নযুগল অশ্রুজলে প্লাবিত হইতে লাগিল, যৌবনারূঢ় হইয়া রত্না আর কখনও কাঁদে নাই, হতভাগ্য এইবার কাঁদিল।
“রতন, তুই কাঁদিস কেন? তোর দোষ কি; সকলই আমার অদৃষ্টের দোষ। সকলই আমার এই পোড়া মনের দোষ, রতন!” বলিয়া কজ্জলা মৃদুমধুরস্বরে একটি গান ধরিল, —
“এ পোড়া মনের দশা হত যদি দেখাবার,
হিমাদ্রি গলিয়া হত লবণাম্বু পারাবার।
কেবল নিদাঘকালে, কাঁদে চাতকিনী,
চক্রবাকী কাঁদে সুধু আইলে যামিনী,
(ওরে) আমি কাঁদি দিবানিশি, হৃদিজ্বালা অনিবার।”
কজ্জলা বিকম্পিতকণ্ঠে এই গানটি গাইল, তাহার করুণা মিলিত স্বর-সুধায় রত্নাকে উন্মত্ত প্ৰায় করিয়া তুলিল।
“কজ্জলা, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত নাই, তুই কি আমায় ক্ষমা করবি?” বলিয়া রত্নাপাখী তাহার পদতলে পড়িয়া বালকের ন্যায় কাঁদিতে লাগিল। এইসময়ে একটি আলোকরেখা সেই অন্ধকারময়ী পুরীমধ্যে আসিয়া পড়িল।
কজ্জলা। রতন, কে আসছে, আমি এখন যাই।
রতন। কোথা যাবি?
কজ্জলা। চুলোয়। তুই কি আর আমার মাথা গুঁজিবার জায়গা রেখেছিস?
রতন। তুই বেঁচে এলি কি করে?
কজ্জলা। দেওয়ান গোবিন্দরাম আমায় বাঁচিয়েছেন।
রতন। কি, গোবিন্দরাম! গোবিন্দরাম তোকে বাঁচিয়েছে?
“কেন, শিউরে উঠলি যে?” বলিয়া কজ্জলা উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া প্রস্থান করিল—যে পথ দিয়া আসিয়াছিল, সেই পথ দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল এবং সাবধানে সুড়ঙ্গদ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। এই সুড়ঙ্গ-পথটি রাঘবের দলভুক্ত প্রধান দস্যুগণ ভিন্ন আর কেহই জানিত না।
অপরদিক হইতে একহস্তে প্রদীপ ও অপরহস্তে একখানি পাত্র লইয়া পাপাবতার রাঘব সেন তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল; বলিল, “কি রে রতন, কিছু খাবিনি? সমস্ত দিনটা ত অনাহারে গেল, এই নে, খা। আর আমার কথা ঠেলিসনি, কিছু খা।” বলিয়া তাহার সম্মুখে মিষ্টান্নপূর্ণ পাত্রখানি রাখিয়া দিল।
রত্না কোন কথা না কহিয়া ভোজনে বসিয়া গেল। এখন তাহার চিন্তা দূর হইয়াছে, চিত্তভার বিমোহিত হইয়াছে—এক্ষণে সহজে তাহার আহারে রুচি হইল।
ইত্যবসরে রাঘব সেন একটা কলসী হইতে একঘটী জল গড়াইয়া রত্নার নিকট আসিয়া বসিল; বসিয়া বলিল, “কৈ রে, ফতে-উল্লার ত কোন সংবাদই নাই, সে কোন্ সকালে গেছে, এখনও ত ফিরিল না।”
রতন। না ফিরিল, তা তোমার কি, আর আমারই বা কি?
রাঘব। সে কি রে, সর্ব্বনাশ হবে যে! কি বিপদ ঘটবে, তা কি তুই বুঝতে পারছিসনি? গোবিন্দরাম কি সহজ লোক!
রতন। যদি এতই ভয়, তবে তোমার ব্যবসা ছেড়ে দেওয়া উচিত।
রাঘব। এ বিপদটি কেবল তুই ত ঘটালি, তোকে ত আমি পূৰ্ব্বেই বলেছিলাম, গোবিন্দরাম সামান্য লোক নয়।
রতন। গোবিন্দরামকে তুমি ভয় করগে, আমি তাকে তৃণজ্ঞান করি, আমি যদি বিপদ ঘটাইয়া থাকি, আমিই সে বিপদ নিশ্চয় কাটাইয়া দিব; কিন্তু তারপর তোমার সঙ্গে আর আমার সম্পর্ক থাকবে না—দস্যুবৃত্তি আমি আর করব না।
রাঘব। আচ্ছা, সে বিবেচনা পরে হবে, এখন এক ছিলিম বড় তামাক খাবি কি?
রতন। গাঁজা? এ প্রাণ থাকতে গাঁজা আর আমি খাচ্ছি না। গাঁজাতেই আমার সর্বনাশ হয়েছে, আমার ইহকাল পরকাল কেবল গাঁজাতেই নষ্ট হয়েছে।
রাঘব। কি, তুই গাঁজা খাবিনি? আচ্ছা, দেখা যাবে।
রতন রুক্ষ্মভাবে বলিল, “সেনজা, এখন ঘরে যাও, রাত ঢের হয়েছে, একটু শয়ন করগে, তোমার মাথার উপরে শকুনি উড়ছে, শুয়ে শুয়ে একটু চিন্তা করগে। আজীবন কি কাজ করে আসছ, একবার ভেবে দেখগে। উপস্থিত বিপদের ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকগে। কিন্তু মনে রেখ, রত্নার প্রতিজ্ঞা কখনও ভঙ্গ হয় না। এখন যাও, আর জ্বালিও না।”
রাঘব সেন রত্নাপাখীকে বিলক্ষণ চিনিত। সে আর কোন কথা না কহিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিল। পাতালপুরী পুনর্ব্বার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইল।