সন্ন্যাসী রূপকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

সন্ন্যাসী রূপকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

(১)

১৯৭৫ সালে ‘নতুন সুর নতুন গান’ শিরোনামে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি এল পি রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল৷ যার মধ্যে অন্যের সুর ছাড়াও শিল্পীর নিজের রচিত সুরের গান ছিল৷ গায়ক ও সুরস্রষ্টা উভয় ভূমিকায় তিনি তাতে স্বাক্ষর রেখেছেন৷ সেই এল পি প্রকাশের সময়ে আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় শ্রীঅমিতাভ চৌধুরি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে যে অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন, তারই কিছু অংশ,—

‘নামে হেমন্ত, কণ্ঠে চিরবসন্ত৷ ফুলে ফুলে রঙিন কণ্ঠ কালের যাত্রার সঙ্গে আরও পুষ্পিত, আরও সুরভিত৷ সেই কবে ১৯৩৭ সালে প্রথম রেকর্ড দিয়ে জয়যাত্রা শুরু৷ আর এই ১৯৭৫ সালেও সংগীতের প্রত্যেকটি শাখায় তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য৷’

তাঁর অস্তিত্ব উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো যে চিরকালীন তা আজও সত্য তারই স্বাক্ষর রাখতে চলেছে এই প্রবন্ধ ৷

শ্রী অমিতাভ চৌধুরি আরও লিখেছিলেন, ‘গীত সুধার তরে পিপাসিত চিত্ত অসংখ্য অনুরাগী আমারই মতো তাঁর গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাল্য, কৈশোর, যৌবন অতিক্রম করে প্রাক পঞ্চাশে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছে৷ তবু সেই দূরাগত সুরধ্বনি স্মৃতির মণিকোঠা পেরিয়ে আজও অমলিন৷ আজও সেই অনুভুতির দীপ্যমানতা বয়ে নিয়ে চলেছে বাংলা গানের ইতিহাসের শ্রোতাকে, উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে৷ অমিতাভ চৌধুরি লিখেছেন, ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এখন শুধু একটি নাম নয়৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটি কিংবদন্তি৷ বাংলা কাব্যগীতির প্রাচীন ধারায় জোয়ার এনেছেন তিনি৷ তাঁর কণ্ঠে আছে সুডোল আওয়াজ, আছে উদাত্তভঙ্গি, আছে স্বপ্নালুতা৷ বয়স যত বেড়েছে, ততই গভীরতর হয়েছে এই ত্রি-শক্তি৷ কাব্য-গীতির সবরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষায়, নতুন কোনও ছন্দের বা মেজাজের গানে, তিনি বরাবর সসম্মানে সফল৷ কণ্ঠের জাদু দিয়ে ভাবের বিকাশে আজও তিনি তুলনাহীন৷ রবীন্দ্র সংগীত, আধুনিক, হিন্দি গীত, ভজন— সব শ্রেণীর গানে তাঁর অনায়াস অধিকার৷ তবু বিশেষ করে বাংলা আধুনিক গানে তিনি যোগ করেছেন অতিরিক্ত মাত্রা, নতুন মেজাজ৷ কথা ও সুর আলিঙ্গনাবদ্ধ কাব্যগীতির নির্ভরযোগ্য অছি এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কী সুরকার হিসেবে, কী গায়ক হিসেবে তাই দীর্ঘকাল অপ্রতিদ্বন্দ্বী৷

এত দরদ, এত সজীবতা নিয়ে এই গুণী জানি না কেমন করে গান করেন৷ আমরা তাঁর মুগ্ধ অনুরাগীরা অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি৷’

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গোড়ার জীবনের গাওয়া কিছু রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানি একটি এল পি প্রকাশ করেন৷ তাতে শিল্পী পরিচিতি হিসাবে নিচের মন্তব্যটি লেখা ছিল— যেটা অনুধাবনযোগ্য৷

“HEMANTA MUKHERJI is considered to be amongst the fore most exponents of Rabindra Sangeet in the country. He, himself a composer of no mean order, possesses that easy versatility when by what ever type of song he decides to sing, he does it in a manner as if born to it. It is that rare talent that gives him effortless mastery over the stylised form of rendering associated with Tagore songs.”

একটি বাংলা কবিতার দুটো লাইন আছে ‘ঘুমিয়ে আছে সকল পিতা সব শিশুরই অন্তরে৷’ ইংরেজি সাহিত্যের একটি প্রবাদ আছে “Morning shows the day”-যে কোনও জীবনকে চিনতে হলে তার বালক, কিশোর অবস্থা থেকেই তাকে জানতে হয়৷

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন মিত্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র৷ ক্লাসে শিক্ষক আসেননি৷ সবাই মিলে গান শুরু করেছেন৷ সেদিন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহাশয়ও অনুপস্থিত৷ সহকারী প্রধান সেদিন শিক্ষায়তনের ভারপ্রাপ্ত৷ ক্লাসে হট্টগোল শুনে ক্লাসে এসেছেন৷ তখন সবাই নীরব৷ প্রশ্ন করলেন, কে কে গান গাইছিলে৷ মুখ ফুটে কেউ কিছু বলল না৷ হেমন্ত উঠে দাঁড়িয়ে সত্যকে স্বীকার করল এবং শাস্তিস্বরূপ স্কুল থেকে তার নাম কাটা গেল৷ যদিও পরে প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের সহৃদয়তার আবার বিদ্যালেয় পড়বার সুযোগ পেলেন, আর হেমন্তর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সততা এবং প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করার জীবন সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল৷ যার স্নায়ুতে, রক্তে, অনুভবে, অস্তিত্বে সংগীতের প্রবাহ জাহ্নবীর মতো পবিত্র, গতিশীল, কোনও প্রতিকূলতা কি তার বেগ থামাতে পারে? পিতা চাইতেন তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার হোন কিন্তু সন্তানের সমস্ত সত্তা জুড়ে তো সংগীত৷ অবাধ্য সন্তান নয়, পিতামাতার প্রতি অনুগত তথাপি জন্ম জন্মান্তরের সংস্কার কোথায় যাবে? ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহ’— গীতার এই বাণী তো জীবিকা নির্ভর পরাধীন জাতি কল্পনা করতে পারে না৷ তাই কোন পথে জীবন বিকশিত হবে ভাবার সুযোগ কলিকালে কম৷ কোন পথে দুটো পয়সা রোজগার হবে সেটাই প্রাথমিক চিন্তা৷ কিন্তু ভগবান যার হাত ধরে আছেন তার আবেগ থামাতে পারে এমন কোনও পার্থিব শক্তি নেই৷ ঈশ্বর তাঁর হাত ধরেছেন৷ হাত ভরিয়ে দিয়েছেন, করেছেন রাজা৷

স্কুলের অন্যতম সহপাঠী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রথম জীবন থেকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রেরণা, পরামর্শদাতা, কার্যকরী সহযোগী৷ হেমন্তর সুখে, সাফল্যে খুশি, দুঃখে, বাধায় বেদনার্ত এবং নতুন করে জেগে ওঠার আন্তরিক ইন্ধনদাতা৷ স্কুলের অনুষ্ঠানে গান গাইবার সুযোগ পাচ্ছে না হেমন্ত, এই ব্যথা বন্ধু সুভাষের প্রাণে বাজে৷ তার যেন মুখচোরা হেমন্তকে নামী শিল্পী তৈরি করার মহা দায়৷ বিভিন্ন জলসায় যাতে প্রিয় বন্ধু সুকণ্ঠ হেমন্ত গান গাইতে পারে— তার জন্যে সুভাষের মাথাব্যথা৷ অন্তরের এই তাগিদ থেকেই সুভাষ হেমন্তকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর পরীক্ষায় বসানোর আয়োজন করে এবং হেমন্ত যোগ্যতার সঙ্গে সেই যাচাইতে তার দক্ষতার পরিচয় ও প্রমাণ রাখে৷ এরপর রেডিওর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ক্রমশ ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়ে উঠতে লাগল৷ সে ইতিহাস পরে বলছি৷ তার আগে একটা ঘটনার কথা বলব৷ যে ঘটনা হেমন্তকে ভাবিয়েছিল৷ সুরের সাগরে ভাসতে শিখিয়েছিল৷ এই অভিব্যক্তি তাঁর নিজেরই প্রকাশিত ভাষা৷

‘ঠাকুমা যেদিন মারা গেলেন সেদিন বিরাট একটা ছন্দপতন হল আমাদের সংসারে৷ কিন্তু ঠাকুমা তো সেটা বুঝতে দিলেন না কাউকে৷ কত সহজ সরলভাবে শেষ করলেন জীবনের পর্ব৷ সুর তাল লয় ঠিক রেখে৷ ঠিক যেন সংগীতের মতো৷ তাহলে চেষ্টা করলে এই জীবনকেও সুরে বাধা যায়৷ এই কথাটাই আমার মনে বারবার ঘোরাফেরা করছে, সব জিনিসের মধ্যে একটা সুর আছে৷ সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, হতাশা কোনওটাই সুরের আওতার বাইরে নয়৷ প্রচণ্ড প্রকাশটা ঠিক সুরে না হলে সেটা মিষ্টি না লেগে তেতো লাগবে৷ তেমনি দুঃেখর কান্নাটাও বীভৎস ঠেকবে যদি না বিলাপটা সুরে সুরে বেরিয়ে আসে৷ এই সুরকেই সেদিন বোধহয় আমি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম৷ আজও সেই সুরের সন্ধানে এগিয়ে চলেছি৷’

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়ক তথা শিল্পী সত্তা এবং সুরস্রষ্টার বিকাশটাও সেই সুরাদর্শেরই সুর, তাল, লয়ে, ছন্দে বাঁধা৷

রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্যগুলো রচিত হল কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হল না, তাহলে কেমন হত তার প্রমাণ পাওয়া যায় গীতিনাট্যগুলো রেকর্ড করার ইতিহাস অনুধাবন করলে৷ সমস্ত গীতিনাট্যের নায়ক কণ্ঠ ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের, কেবল একটি ছাড়া৷ সেটা চিত্রাঙ্গদা৷ তাতে তিন দিকপাল রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নায়কের কণ্ঠে গেয়েছিলেন—তিনজন চিত্রাঙ্গদা৷ কিন্তু গ্রামোফোন কোম্পানি পরে বাধ্য হলেন ওই চিত্রাঙ্গদা পুনরায় রেকর্ড করতে যাতে চিত্রাঙ্গদা (কুরূপা, সুরূপা) দুজন কিন্তু অর্জুন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একা৷ একজন বললেন, দেবব্রত বিশ্বাসের মতো ‘অহো কি দুঃসহ স্পর্ধা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঠিক বলতে পারেননি৷’ দেবব্রত বিশ্বাসের মহান শিল্পী সত্তা, সাঙ্গীতিক অনুভূতি ও তার যথাযথ অভিনব প্রকাশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও বলা যায় অর্জুন-ক্ষত্রিয়, তার অভিব্যক্তি শৌর্যে বীর্যে রূপায়িত করবে প্রজ্ঞা-প্রদীপ্ত তেজ৷ যা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অভিপ্রেত গায়নের দ্বারা চরিত্রানুযায়ী যথার্থ৷ কারণ ক্ষত্রিয় ধর্মপরায়ণ৷ কেবল শক্তিমান নয়৷

সলিল চৌধুরির সৃষ্টি ‘গাঁয়ের বধূ’ স্বর্ণযুগের উদ্বোধনী সংগীত৷ কিন্তু যে সময়ে এই গান রচিত হয়েছিল, তখনকার সংগীত জগতের পরিমণ্ডলের মধ্যে অধিষ্ঠিত থেকে, এমন এক যুগপট পরিবর্তনের গানকে বেছে নেওয়ার মতো মেধাদীপ্ত, সাহসী প্রগতিশীল শিল্পীর অবদান, সংগীত স্রষ্টার সঙ্গে একই নায়কত্ব দাবি করে না কি? যুগের হাতে নতুন জীবনবোধকে তুলে দিতে গেলে যে সাগর-গভীর, আকাশ-উদার স্বর— ব্যঞ্জনাময় দেব-মাধুর্যের কণ্ঠের প্রয়োজন, বিধাতার অকৃপণ কৃপা বর্ষণে তারই প্রাণময় প্রকাশ হয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মধুর আওয়াজে৷ একটি ধর্মগ্রন্থে পড়েছি৷ ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আছে ‘শিল্পকে যে দেব শিল্প মনে করে— সে-ই শিল্পের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করতে পেরেছে৷ এই শিল্পছন্দে সেই মহাশিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়৷’ বাস্তবিকই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গায়ক ছিলেন না৷ তিনি ছিলেন যথার্থ শিল্পী— দেবশিল্পী৷’ অনুভূতির দেবত্ব নির্যাসে সিঞ্চিত হয়ে তাঁর স্বর প্রস্ফূটিত করত স্বর্গের পারিজাতকে৷ জড় বিজ্ঞান যার ব্যাখ্যা দিতে পারে না, চৈতন্য বিজ্ঞান অনির্বচনীয় উপলব্ধিতে বিস্তৃত হতে হতে ছুঁয়ে ফেলে সেই আকাশকে৷ সলিল চৌধুরি বলতেন, হেমন্তদা বা লতা যখন আমার গানের শিল্পী তখন কল্পনা আমার দিগন্ত ছাড়িয়ে যায়৷ Sky is my limit’.

বর্তমান অস্থিরতার যুগে anti melody যেভাবে জীবনকে বিপন্ন করেছে, সংগীতকে গ্রাস করেছে, সেই সময়ে King of melody হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক৷ তাঁর গাওয়া গানকে নতুন করে, নতুন প্রজন্মের জনমানসের সামনে হাজির করার প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি৷

গান্ধীজি চলে গেলেন৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রেডিওতে সংগীত মাধ্যমে তার দুঃখের অভিব্যিক্ত প্রকাশ করতে গাইলেন ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’৷ কোনও তালবাদ্য নেই, কেবল যতির জায়গায় রয়েছে একটি করে বেদনা বিমূর্ত দীর্ঘশ্বাস৷ ঠিক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মর্মধ্বনিরই আওয়াজ, তার সেই জীবন বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি ‘দুঃখের কান্নাটাও বীভৎস ঠেকবে যদি না বিলাপটা সুরে সুরে বেরিয়ে আসে৷’ তেমনি ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’র আনন্দোচ্ছ্বাস ও ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’র গভীর জীবনবোধ যথাযথ অভিব্যক্তিতে অভিদ্যোতিত৷ এমনকি ‘মায়ামৃগ’ ছবির রেস খেলা যুবককের কণ্ঠ তরঙ্গের ওঠাপড়াও জীবন্ত করে তুলেছিলেন, ‘যারে যা, শোন শোন গেরোবাজ’ গানটিতে৷

আবার ফিরে আসি রেডিওর কথায়৷ তখনকার দিনে রেডিওর কাজ ছিল সবদিক থেকে এক বিরাট আকর্ষণের বিষয়৷ তখন তো আর দূরদর্শন আসেনি৷ বোম্বে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এই রেডিওর সঙ্গে যোগাযোগ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত জীবন ইতিহাসের অনেকটাই জুড়ে আছে৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনের কথা লিখতে বসে লিখছেন, ‘রেডিও স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে অডিশানের ব্যাপারটাকে আর তেমন আমল দিলাম না৷ সব ব্যাপারে এটাই আমি করে থাকি৷ কোনও কিছুর জন্য এগিয়ে যাই ঠিকই, দরকার মতো কাজও করি, কিন্তু তার ফল কী হবে সে নিয়ে আর মাথা ঘামাই না৷ হলে ভাল, নইলে মন খারাপ করে লাভ নেই৷ এটাই আমার স্বভাব৷ এই স্বভাবটার জন্যেই অযথা হা-হুতাশের আক্রমণ থেকে মন আমার চির মুক্ত৷’

এ যেন নব্য যুগের অর্জুন৷ নতমস্তকে গীতার বাণী অনুসরণ করে চলেছেন—

”কর্ম্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন
মা কর্ম্মফল হেতু র্ভুমা তে সঙ্গোহস্তকর্ম্মণি”

অর্থাৎ কর্মেই তোমার অধিকার, কর্ম্মফলে কখনও তোমার অধিকার নেই৷ কর্মফল যেন তোমার কর্ম প্রবৃত্তি হেতু না হয়, কর্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়৷

সমস্ত জীবন এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অগ্নিপ্রাণ, দেব শিল্পী৷ ‘বিশ সাল বাদ’ ছবিতে অজস্র অর্থ আয় করলেন৷ এরপর ‘কোহরা’ ছবিতে লোকশান কুড়িয়ে বিধ্বস্ত, চলে গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ৷ রাজার মতো সম্মান৷ এক সংগীত শিল্পীর সম্মান কতটা উচ্চতায় উত্তীর্ণ হতে পারে তার ইতিহাস রচনা হল৷ আত্মজীবনী ‘আনন্দধারায়’ লিখছেন, ‘আমার জীবনদর্শন অন্যরকমের৷ গুদামে আগুন লেগেছে, সব পুড়ে ছাই৷ তাই বলে বসে বসে কাঁদব? কাঁদলে আমার গুদাম ভর্তি হবে? যাতে আবার নতুন করে গুদামে মাল ভরা যায় তার চেষ্টা করতে হবে৷ আমি জানি জীবনে সুখও আছে, দুঃখও তেমনি আছে৷ সুখ দিব্যি এগিয়ে চলেছে, হঠাৎ দুঃখ এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ এই সুখ দুঃখ দুটি ভাইয়ের দাপাদাপি আমাদের ওপর সবসময় বয়ে চলেছে৷ দুটোকেই ডাইনে বাঁয়ে রেখে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে৷’ আবার সেই গীতার বাণীরই প্রতিধ্বনি—

‘দুঃখেস্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষুবিগতস্পৃহঃ৷
বীতরাগ ভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে৷৷’

অর্থাৎ সুখ দুঃখে সমভাবাপন্ন, ভয়, ক্রোধহীন স্থিতধী পুরুষ লিখছেন, ‘মনটাকে ঠিক করবার জন্যে আমি তাই বিদেশ ভ্রমণের একটা খসড়া করে ফেললাম৷ যাই ঘুরে আসি কিছুদিন বাইরে থেকে৷ আমি বেরিয়ে পড়লাম৷ চলে গেলাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ৷ সেখানে কী খাতির৷ ভাবতেই পারিনি, একজন সামান্য সংগীত শিল্পীর এত কদর হতে পারে৷ বিদেশে এমন সমাদর প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ব্যক্তিদের বরাতে জুটে থাকে৷ সেই সমাদর পেলাম আমি৷ বিমানবন্দরে নামার পর থেকেই শুরু হল আদর আপ্যায়ন৷ গাড়ি করে যাচ্ছি, তার ধারাবিবরণী রিলে করে শোনানো হচ্ছে রেডিও শ্রোতাদের৷ আমার গাড়িকে অনুসরণ করছে প্রায় একশো গাড়ি৷ সে কী সম্মান৷ যেন কোনও দেশের রাজা মহারাজা এসেছে৷’

আমরা একটা সুন্দর ফোটা ফুলকে দেখি কিন্তু খতিয়ে দেখি না বা দেখার প্রয়োজন বোধ করি না তার ফুটে ওঠার ইতিহাসকে৷ কত রৌদ্র জল ঝড় তুফান অতিক্রম করে শিশিরের স্পর্শ পেয়ে, চাঁদের আলো পেয়ে সেই ফুলটা বেড়ে ওঠে, এ খবর জানলে ফুলটার প্রতি হৃদয় আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যায়৷

আবার একটু রেডিওর বিষয়ে উল্লেখ করি৷ বেতার শিল্পী হওয়ার পর সেখানে ঘনঘন যাতায়াত শুরু হয় এবং একে একে বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গে বাড়ে আত্মীয়তা৷ বাণীকুমারই রেডিওতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে প্রথম ফিচারে সুর করার সুযোগ করে দেন৷ মহালয়ার সারা রাত জেগে ভোরবেলায় অনুষ্ঠান করে সিঙাড়া, জিলিপি খেয়ে বাড়ি ফেরার পরমানন্দ অনুভব করেন বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিকের প্রীতিপূর্ণ মঙ্গল দৃষ্টির সুবাদে৷

গায়ক ও সুরশিল্পী উভয় সত্তার বিকাশের পথে নিশ্চিতভাবে যে সূর্যশিখাটি পথ দেখিয়েছিল সেই সমুজ্জ্বল শিখাটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ৷ এ তাঁর নিজেরই স্বীকারোক্তি৷ লিখেছেন, ‘ভরসা ছিল শুধু রবীন্দ্রসংগীত৷ রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম আর ভাবতাম কত কথা, কত সুর৷ কোন বাণীর কী সুর হওয়া উচিত, সেটা পেয়েছিলাম ওই রবীন্দ্রনাথের গান থেকে৷ রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য শুনেছি বিভোর হয়ে, গেয়েছি প্রাণ ঢেলে৷ সুরের কম্পোজিশন দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি৷ আর তখন ভেবেছি কি প্রচণ্ড শক্তিমান সুরকার এই রবীন্দ্রনাথ৷’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই অভিব্যক্তির প্রমাণ রেখেছেন তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডে৷ তাঁর গায়ন ভঙ্গিতে, সুর সৃষ্টিতে৷ একটা ছোট্ট উদাহরণ স্বরূপ দুটি গানের উল্লেখ করা যায়৷ ‘হারানো সুরের’— ‘আজ দুজনার দুটি পথ’ সৃষ্টিটা মৌলিক অথচ মনে হয় গানটির মধ্যে জড়িয়ে আছে, ‘আমার এ পথ তোমার পথের থেকে’ গানটির আবেশ ও অনুভব৷ ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী’ গানটির সুর রচনার কাঠামোটি রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্যের কায়দায় ছন্দের গতি নিয়ন্ত্রিত৷ এত বড় জীবনের ছত্রে ছত্রে এসব ভাবধারা লুকিয়ে আছে৷ সব তো লেখা সম্ভব নয়, — মাঝে মাঝে দু চারটির আভাস দেওয়াই সম্ভব৷

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিস্তৃত সংগীত জীবনের ইতিহাসে ক্ষুদ্র, মাঝারি, বিরাট, নানা ধরনের মানুষের অবদান আছে৷ কারোর প্রীতি, কারোর ভালবাসা, কারোর শ্রদ্ধা, এসব ছিল তাঁর চলার পথের পাথেয়, অনুষঙ্গ, আলো৷ বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক রেডিও জীবনের সংযোগের মহান সেতু৷ শৈলেশ দত্তগুপ্ত তাঁর জীবনে, সংগীত জগতের পরিধিকে প্রসারিত করার পথে অভিভাবকের দায় পালন করেছেন৷ তাঁরই স্নেহধন্য হয়ে হেমন্ত-কুঁড়ি, ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে৷ হরিপ্রসন্ন দাস, হেমেন গুপ্তর মতো ব্যক্তিত্বরা চলচ্চিত্রের দরবারে পৌঁছে দিতে হাত ধরেছেন৷ হরিপ্রসন্ন দাস তাঁকে নিমাই সন্ন্যাসে প্রথম নায়কের কণ্ঠে নেপথ্যসংগীত শিল্পী হিসেবে সুযোগ দেন এবং তাঁরই সহকারী হয়ে ছবির সুরকার হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাতেখড়ি৷ সলিল চৌধুরি গাঁয়ের বধূ, রানার, অবাক পৃথিবী, পথে এবার নামো সাথী গানের মারফত পুষ্টি জুগিয়েছেন তাঁর প্রগতিশীল ভাব বোধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে৷ বাংলা ছায়াছবির জগতে নেপথ্য গায়ক হিসেবে শীর্ষে তুলে নিয়ে যেতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজের সুরকে যেমন কাজে লাগিয়ে ছিলেন তার থেকে কম বড় অবদান বোধহয় নয় নচিকেতা ঘোষের৷ পৃথিবী আমারে চায়, ইন্দ্রাণী, স্ত্রী, বন্ধু, অসমাপ্ত ইত্যাদি ছবি তাঁর সার্থক স্বাক্ষর৷ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, রতু মুখোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার প্রমুখ অনুজ সুরকাররাও তাঁর স্নেহধন্য সহযোগিতায় বহু ভাল কাজ তাঁকে দিয়ে করাতে পেরেছেন৷ গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে কাজটাই ছিল বড়৷ মানুষকে ছোট-বড় ভাবে মাপবার কোনও মানসিকতাই তাঁর মধ্যে ছিল না৷ একটা গান নিয়ে তাঁর কাছে কোনও কাজের জন্য কেউ গেলে কখনও বলতেন না, কবে গানটা তোলাবে? বলতেন, কবে শেখাবে? এই শেখা শব্দটির মধ্যে যে আনুগত্য, নিষ্ঠা, সংগীতানুরাগ প্রকাশ পেত, তা আজকের প্রজন্মের কাছে একটা দৃষ্টান্তস্বরূপ৷ আরও অনেক ঘটনা আছে যা উত্তরসূরিদের কাছে স্থাপন করতে পারে শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতিবোধ, সংগীতবোধ, বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক জীবনের বোধের প্রতীকী প্রকাশের দৃষ্টান্ত৷ দেব কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়ন-জাদুকরির কথা লিখে বোঝানো যায় না৷ আমার এক ছাত্র যখনই তাঁর গায়নের প্রসঙ্গে কোনও কথা বলে, বলে থাকে ভগবানের কণ্ঠের গান৷ এই বোধ উঠে আসার পশ্চাতে যে বিরাট সাঙ্গীতিক ইতিহাস তারই আরও দু-একটা উদাহরণের উল্লেখ করছি৷

যতদূর মনে পড়ছে ছবিটির নাম শবাব৷ একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, রাজকুমারীর ঘুম আসছে না, রাজকুমারী অস্থির৷ সারা ভারতের ওস্তাদরা আসছেন রাজকুমারীকে ঘুম পাড়াতে৷ কিন্তু ওস্তাদিতে তার ঘুম ছুটে যাচ্ছে৷ সব শেষে এল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর৷ রাজকুমারীর চোখে নেমে এল তন্দ্রা৷ এ ছবির সংগীত পরিচালক সবার প্রণম্য নৌশাদ সাহেব৷ যাঁর সাঙ্গীতিক বোধ ও বোধি প্রশ্নাতীত৷ আসলে পাণ্ডিত্যে বা ওস্তাদিতে শিল্প-নন্দন তত্ত্ব বিকশিত হয় না৷ তার জন্য চাই শিল্পী৷ মার্গ সংগীত, শিল্প-সৌন্দর্য ব্যতিরেকে একটা পাণ্ডিত্যের বা ওস্তাদির মুনশিয়ানায় সমৃদ্ধ, এ চিন্তা সত্যও নয়, জীবনবোধের পরিপূরকও নয়৷ এই স্বীকৃতিই পাওয়া যায় নৌশাদ সাহেবের আয়োজনে৷

আমার একটি গান রেকর্ডিং চলছে৷ গানটি খুবই সুগীত হয়েছে৷ সংগীত পরিচালক হিসাবে আমার খুবই পছন্দ৷ তবু তিনি বললেন না, ‘অনলবর্ষী তৃতীয় নয়ন’ শব্দগুলো ভাল উচ্চারণ করতে পারিনি৷ বলছেন গানটি আবার গাইব এ এক জ্বলন্ত শিক্ষা৷ স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ নেই৷ তাই প্রতিটি স্বরক্ষেপণের সময় স্বরবর্ণের সঠিক প্রকাশ না হলে কথাটা অস্পষ্ট আসবে৷ তাতে শ্রোতার মনস্কতায় ব্যাঘাত ঘটে৷ এছাড়া শব্দের শেষ বর্ণ হারিয়ে গেলেও, বিষয়বস্তু সাময়িক আড়াল হয়ে যায়৷ এই ধরনের শিক্ষিত সজাগ চেতনা নিয়েই তিনি সংগীত পরিবেশন করতেন৷ অথচ এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অন্য সময়ে একটি গানে হয়ত যে পর্দাটি লাগাবার কথা সেটা যথাযথ লাগাতে পারেননি, কিন্তু সেটা তাঁর কাছে পাস হয়ে গেল কারণ তিনি সবথেকে আগে লক্ষ্য রাখতেন বিষয়বস্তুর ওপর৷ বিষয়বস্তুর নাটকীয়তা উতরে গেলেই তাঁর অনুমোদন৷ সিনেমার গান গাইতে গিয়ে প্রশ্ন করতেন, ছবিতে গানটি কার ঠোঁটে থাকবে অর্থাৎ পর্দার শিল্পীর কণ্ঠের সঙ্গে নিজের কণ্ঠের মিল করাতে হবে৷ আর জিজ্ঞাসা করতেন, গানটি বহির্দৃশ্য না অন্তর্দৃশ্যের— সেই অনুযায়ী গলায় আওয়াজ দিতে হবে৷ এসব চিন্তাভাবনা আজ আর প্রায় দেখাই যায় না৷ আবার উচ্চারণের প্রসঙ্গ টেনে বলছি, এই উচ্চারণ সম্পর্কে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নিজস্ব মতামত সবটাই লিপিবদ্ধ করছি৷ তিনি লিখছেন, ‘প্রথম জীবনে আমি পঙ্কজদাকে অনুসরণ করে গান গাইতাম৷ সেই ছাপটাই আমাকে এতদিন এগিয়ে নিয়ে এসেছে৷ তাই নিজস্ব একটা ভঙ্গির দিকে নজর দিলাম৷ প্রথমে নজর দিলাম উচ্চারণের দিকে৷ খুব স্পষ্ট হওয়া চাই৷ সেই সঙ্গে থাকা চাই মিষ্টত্ব…’ সেই থেকে জয়যাত্রা শুরু হল হেমন্ত কণ্ঠের জাদুকরির৷ এ প্রসঙ্গে বলতেই হয়, এই হেমন্তকণ্ঠী হওয়ার চেষ্টায় পরবর্তী অনেক শিল্পী এল৷ এবং সেই থেকে জন্ম নিল অমুককণ্ঠী, তমুককণ্ঠীর প্রবণতা৷

আমার একটা গান রেকর্ডিং হচ্ছে৷ একটি টেক আমার পছন্দ৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গম্ভীরভাবে রেকর্ডিং রুমে চলে গিয়ে রেকর্ডিস্টকে প্রশ্ন করলেন৷ গলা কোথায়? তিনি বললেন, কেন আমি তো কাঁটা ধরে কাজ করছি৷ তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি কাঁটা ধরে কাজ করবেন? শিল্পীর উপস্থিতি (Presence) কোথায়?’ অর্থাৎ রেকর্ডিং আঙ্গিকভাবে সঠিক হলেও, Voice Placing-এ Artist-এর Presence দিতে পারছে না৷ এ বিষয়টা আজকের প্রজন্মের সামনে আর একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে৷ আজকের প্রজন্মের কাছে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ভাষায়, এই যে গানবাজনার বদলে বাজনাগানের উপস্থাপনা— বাজনার দাপটের নিচে গানের কবর চলছে সেই প্রেক্ষিতে হেমন্তদার এই উক্তি অত্যন্ত অনুধাবনযোগ্য৷ তাঁর কণ্ঠস্বরের প্রতি এতটাই আস্থা ছিল যে, বাজনদারদের ঠিকমতো না পাওয়ার অজুহাতে তাঁর গান গাওয়া আটকাত না৷ একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে৷ হেমন্তদার একটা গানের Recording আছে৷ বিখ্যাত এক তবলাবাদকের বাজাতে আসার কথা যিনি সমস্ত কাজে দেরিতে আসেন৷ অথচ হেমন্তদা ঘড়ির কাঁটার আগে চলতেন— তিনি জানেন, ওই তবলাবাদক বাজাতে আসার কথা৷ Studio-তে ঢুকেই এক বাঁশিবাদককে ডেকে বললেন, ‘তুমি তো একটু তবলা বাজাতে পার— দাও তো গানটায় ঠেকা, একটু Practice করি৷’ একটু Practice করেই Recordist-কে বললেন, ‘নাও Record কর৷’ তিনি Record করে চলে গেলেন তিনটি গান— পরে ওই নির্দিষ্ট বাদক Floor-এ এসে বাকি Musicianদের হাসির খোরাক হলেন৷ আর একটা ঘটনা৷ আমার ওঁকে দিয়ে একটা গান Recording করার ব্যাপার— Musician পাচ্ছি না, তাই recording dateটা পিছোতে চাইলাম৷ উনি Musician-এর জন্য Recording পেছনো সমর্থন করলেন না৷ বললেন, ‘কী যে বল অভিজিৎ, রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন দেশ চলছে আর Musician-এর জন্য রেকর্ডিং বন্ধ হবে? না না, তুমি চিন্তা কোরো না, ও আমি গলাবাজি করে মেরে দেব৷’ গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা সংগীত জগৎকে উপহার দিয়েছেন অজস্র সংগীত সেই ‘কথা ক’য়োনাক’ থেকে শুরু করে অনেক অনেক গান৷ গাঁয়ের বধূ, রানার, অবাক পৃথিবী, পথে এবার নামো সাথী, শোন কোনও একদিন, আমার গানের স্বরলিপি, তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই, সবাই চলে গেছে, এমন একটা ঝড় উঠুক, বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা, ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না… আরও কত৷ বাংলা চলচ্চিত্রে কান্দো কেনে মন, পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে, নীল আকাশের নিচে, ও নদীরে, সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা, খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার, পলাতক ছবির সব গান, মুছে যাওয়া দিনগুলি, মৌ বনে আজ মৌ জমেছে, মালতী ভ্রমরের অসংখ্য, অসংখ্য৷ গায়ক হিসাবে হিন্দি ছায়াছবির বেশ কিছু গান অমর হয়ে আছে, যার মধ্যে শর্ত, জাল, নাগিন, পিয়াসা, বিসশাল বাদ, কোহরা আরও অনেক৷ এই সব গানেরও সঙ্কলন প্রকাশ করতে হলে চাই আরও বেশি কিছু লেখার পাতা৷

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত জীবনের অনেক পাতার ইতিহাসের বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠা শ্রদ্ধেয় শশধর মুখোপাধ্যায়ের অবদানের আলোয় উদ্ভাসিত৷ কলকাতার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বইয়ের হেমন্তকুমার হয়ে ওঠার পশ্চাতে যাঁর অকৃত্রিম আন্তরিক সহযোগিতা ছিল, তাঁর নাম শ্রী শশধর মুখোপাধ্যায়, ফিল্মিস্থানের কর্ণধার৷ তিনি পাকা জহুরি— তার জহর চিনতে ভুল হত না৷ বহু বিখ্যাত সুরকারের জন্মদাতা তিনি৷ খুব খাটাতেন সবাইকে, সুযোগ দিতেন, তারপর গিনি সোনাটি বের করে আনতেন৷ ‘শর্ত’ ছবির ‘ন’ইয়ে চাঁদ’ গানটির একুশটি মুখরা সুর করিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে৷ তাঁর তত্ত্বাবধানে আনন্দমঠ থেকে শুরু করে পর পর ছবি হচ্ছে, সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কাজ করছেন, হয়ত গানও দু-একটা চলছে, কিন্তু ছবি লাগছে না৷ ক্লান্ত, সন্ত্রস্ত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চুপি চুপি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন৷ সংবাদটি পৌঁছে যায় মিঃ মুখার্জির কানে৷ তাঁরও জেদ, সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে তিনি যে সোনার সন্ধান পেয়েছেন তার প্রকাশ ঘটিয়েই ছাড়বেন৷ সব শেষ এবার সেই বিশ্বাসকে রূপ দিল ‘নাগিন’৷ রাতারাতি হেমন্তকুমার হিন্দি ফিল্মি জগতের সম্রাট৷ শুরু হল কলকাতা থেকে আবার ডাকাডাকি৷ ভুলি নাই, সন্দীপন পাঠশালা ইত্যাদি ছবির সংগীত পরিচালক তখন ঝড়ের হাওয়ার পাখি৷ বোম্বাই, মাদ্রাজ, কলকাতায় ছুটোছুটি৷ নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী, বাংলা Basic গানের রেকর্ড, ভারতবর্ষ ও তার বাইরে সংগীতানুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ, বোম্বাই-এর ছবিতে সুরের কাজ, ভারতবর্ষের অন্যান্য ভাষায় সুরের কাজ, বিশেষ করে কলকাতার বড় বড় বাংলা ছবির সংগীত পরিচালনা, এ সব নিয়ে ভোরবেলা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলতে হল সেই King of Melody-কে৷ এমন নিষ্ঠাবান কর্মী সংসারে বিরল৷ শরীরে অসুবিধা, কাজ করতে করতে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে, কিংবা পা ভেঙে গেছে, ক্রাচ বগলে, তাও কাজ করে চলেছেন৷ কি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, ভালবাসা কাজের প্রতি৷ ছোট কাজ না বড় কাজ এসব ভাবেননি৷ তাঁর কাছে কাজ-কাজই৷ গুণী, গুণীই৷ দযা, দান, মহানুভবতার প্রদীপ্ত, অনির্বচনীয় অনুভবের এক দেবতা শিল্পী৷ যেন ভগবানের নিপুণ হাতে গড়ে ওঠা এক জীবন্ত বিগ্রহ৷

(২)

বাংলা সংগীতে আমরা বেশ কিছু সুরকার পেয়েছি৷ যাঁরা একাধারে কণ্ঠশিল্পী হিসাবেও যেমন সুদক্ষ, সুরস্রষ্টা হিসাবেও অবিসংবাদিতভাবে সার্থক৷ যেমন সর্বশ্রী পঙ্কজকুমার মল্লিক, শচীনদেব বর্মন৷ আর ডি বর্মন, বাপি লাহিড়ী মূলত সংগীত পরিচালক তবু অনেক গান সার্থক ভাবে গেয়েছেন৷ বাপির

পিতা কণ্ঠশিল্পী অপরেশ লাহিড়ী৷ সংগীত পরিচালক হিসেবেও অনেক কাজ করেছেন৷ এক সময়ে আমরা পেয়েছি সুধীরলাল চক্রবর্তী, অখিলবন্ধু ঘোষ, দিলীপ সরকার, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায়কে৷ অসাধারণ কিছু ভাল গান পেয়েছি মান্না দে ও মৃণাল চক্রবর্তীর কাছে — কিছু সুবীর সেনের কাছে৷ আমার বন্ধুবর জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় তো এখনো চলমান৷ এঁরা সবাই দক্ষ গায়ক৷ দক্ষ সুর রচয়িতা৷ তবে পঙ্কজকুমার মল্লিক, শচীনদেব বর্মনের মতো উভয় সত্তায় উল্লেখযোগ্যভাবে সার্থক বলতে আমি বুঝি দু’জনকে৷ এক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অন্যজন শ্যামল মিত্র— যাঁরা স্বকীয় প্রকাশে বাংলা সংগীত নির্মাণে বিভিন্ন স্রোতের প্রবাহের বৈচিত্র্যে, পূর্ণ সংগীত পরিচালকের দাবি করতে পারেন৷ ডঃ ভূপেন হাজারিকার অবদান অনস্বীকার্য কিন্তু তা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা শ্যামল মিত্রের সুরের মতো বিচিত্রগামী নয়৷

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গায়ক হিসাবে পাঁচ জনের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ, কিন্তু বাংলা চিত্রসংগীত জগতে তিনি সম্রাট, সুরস্রষ্টা হিসাবে৷ চলচ্চিত্রে গান করতে গেলে দৃশ্যের অনুভবকে পরিস্ফুটিত করাই হচ্ছে প্রাথমিক শর্ত— যা নির্মাণ আঙ্গিক বুদ্ধি থেকেও হৃদয় সম্পৃক্ত হওয়ার উজ্জ্বলতায় সার্থক হতে হবে৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছায়াছবির সুরে গান নির্মাণ করেননি — তিনি গানকে ছবির সংলাপ করে দিয়েছেন৷ ফুলেশ্বরী, শাপমোচন, পলাতক, হারানো সুর, শেষ পর্যন্ত এইরকম কিছু ছবি পাঠকবর্গ যদি দয়া করে আর একবার দ্যাখেন আমার এই অভিমতের সঙ্গে আপনারা সহমত হবেন-ই — এ আমি জোর দিয়ে বলতে পারি৷ আমার এক পরিচিত মানুষ ৫২ বার হারানো সুর দেখেছেন কেবল গান দুটির জন্যে অথচ পুলকবাবুর মুখে শুনেছি, ও দুটি গান প্রথমে উত্তমবাবুর পছন্দ হয়নি৷ এমনকি ‘আজ দুজনার দুটি পথ’ গানটির বদলে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার এ পথ তোমার পথের থেকে/অনেক দূরে গেছে বেঁকে’ লাগাবার চিন্তা প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল৷

আবার বলব হেমন্তদার সৃষ্টি করা গান — তা নির্মাণ ছিল না, ছিল প্রসব৷ সলিল চৌধুরির গান সৃষ্টি ও নির্মাণ দুই৷ তা নিয়ে গবেষণা চলে৷ শেখবার অনেক কিছু আছে৷ আর হেমন্তদার গান সমস্ত ভাব-বীর্য ও ভাব-শোণিতে মিশ্রিত এক স্বাভাবিক জন্ম৷ সিজার বেবি নয়৷ সলিল চৌধুরির নির্মাণ চূড়ান্ত প্রসব যন্ত্রণা থেকে উঠে এসে মস্ত বড় সার্জেনের হাতে সিজার হয়েছে৷ হেমন্তদার সুরে পাড়াগাঁয়ের দাইয়ের হাতে প্রসব হওয়া সন্তান৷ সলিলদার নির্মাণ কম্পোজার-এর৷ হেমন্তদার গান বৈতালিকের৷ সলিলদার গানে আমরা জেগে উঠি, বেঁচে উঠি, চলতে শিখি, সংগ্রামী হই — হেমন্তদার গানে নির্জনে বসে কাঁদতে পারি৷ আলিঙ্গনে ভালবাসতে পারি৷ তাঁর গানে প্রতিবাদ নেই, বিদ্রোহ নেই, জ্বালা নেই, আছে বৈষ্ণবের মতো রস-মাধুর্য৷ সলিলদার নির্মাণ নিয়ে গবেষণা করা যায়৷ হেমন্তদার গান নীরবে অনুভব করতে হয়৷ সলিলদার গানে সলিলদা নিজে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকেন, হেমন্তদার গানে হেমন্তদা আপন অস্তিত্ব ভাব সাগরে বিলীন করে দেন৷ সলিলদার গানে সলিলদাকে ভুলতে পারি না৷ হেমন্তদার গানে হেমন্তদাকে ভুলে গিয়ে বিষয়বস্তুর মধ্যে নিজেকে দেখতে পাই৷ শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ব্রহ্ম কখনও উচ্ছিষ্ট হয় না, কারণ তার স্বরূপ কেউ বলতে পারে না৷ আমার মনে হয় সমস্ত সূক্ষ্ম অনুভূতিই ব্রহ্ম বস্তু, যা উচ্চারণে ঠিক ঠিক ব্যক্ত করা যায় না৷ হেমন্তদার সুরের গান হৃদয়ের অনুচ্চারিত অব্যক্ত ধ্বনি— রস গ্রহণে যা উপভোগ৷ শ্রবণে যা শুধু আনন্দ৷ ফুলেশ্বরী বারবার দেখি আর ভাবি এই ছবির যদি সংগীত পরিচালক হতাম কী করতাম? ওই ছবির গান নিয়ে গবেষণা চলে না কারণ ওই সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন করা যাবে না৷ দৃষ্টি বিনিময়ের মতো এর মাধুর্য, রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মতো আত্মিক সহবাসের নির্যাস৷ দেহ-বুদ্ধি ও বোধ অতিক্রম করে প্রেম যখন বোধিসত্ত্ব হয় তখনই এই প্রকাশ সম্ভব৷ ফুলেশ্বরী ছবিটির গান যখন শুনি ছবির সঙ্গে, তখন মনে হয় হেমন্তদা দেবতা, আমি মানুষ৷ এই ছবির ‘আমি দেখতে ভালবাসি’ — গানের সুর শুনলে গৌর প্রেমের বৈরাগ্যে মন আচ্ছন্ন থাকে, — মন সত্যি সত্যি তিন কাঠা ‘জমির’ মালিকানা নিয়ে তখন বিচলিত হয় না৷

হেমন্তদার সুর সৃষ্টির মূল প্রেরণা রবীন্দ্রসংগীত৷ এ তাঁর নিজের অভিমত৷ ভি শান্তারাম, শিবশক্তি বলে একটি ছবিতে সুর দেওয়ার জন্যে তাঁকে আহ্বান করেন এবং প্রশ্ন করেন ‘তুমি পারবে এই ছবিতে, মিউজিক দিতে?’ হেমন্তদা সমস্ত শ্যামাটি শুনিয়ে দেন এবং মনে মনে বলেন, আমার কাছে খনি আছে৷ ছবিটা অবশ্য পরে হয়নি — হলে আমরা নিশ্চয় একটা অভিনব কিছু পেতাম৷ রবীন্দ্রনাথকে হেমন্তদা কত আন্তরিক নিষ্ঠভাবে আত্মীকরণ করেছিলেন, তা ‘মন নিয়ে’ ছবিটির ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী’ শুনলে বোঝা যাবে৷ গানটির মধ্যে যে opera style ব্যবহার করেছেন তার সুরের চলনে, একেবারে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য থেকে আয়ত্ত নির্মাণ বুদ্ধিমত্তা৷ আবার ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’ — গানটির অন্তরায় অরুণাচলের বুকে/তুমি জাগালে দীপ্তমুখে — একেবারে রবীন্দ্রসংগীত আঙ্গিকের স্টাইল-এ নির্মিত৷ আবার হেমন্তদা কিন্তু রক্ষণশীল মোটেই না — তার হৃদয় উদার অঙ্গন নাহলে ও চলমানতার বিশ্বাস না থাকলে স্বর্ণযুগের উদ্বোধনই হত না৷ সলিল চৌধুরির সংগীত ‘গাঁয়ের বঁধূ’ দিয়ে যে সাংগীতিক মহাযাত্রা শুরু হয়েছিল তারই ফলশ্রুতিতে এক ঝাঁক নব সংগীত নির্মাতা ও শিল্পী সমৃদ্ধ স্বর্ণযুগের সৃষ্টি৷ আমি হলফ করে বলতে পারি সেই সময়ে ওই গান রেকর্ড করার বুকের পাটা কারও ছিলই না, এমনকি নির্বাচনের সাহসই ছিল না৷ মনে পড়ে ঘটনাটি৷ হেমন্তদাকে সলিলদা পর পর গান শোনাচ্ছেন— আর হেমন্তদা বলছেন, সবই তো কোরাস গান— আর গরম গরম৷ কিছু একক ও নরম গান শোনাতে পার? সলিলদার ঝুলিতে ছিল না — সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে বললেন একটা গান আছে — সবটা তৈরি হয়নি — কিন্তু দুপিঠে করতে হবে৷ হেমন্তদা সেটুকু শুনে রাজি হলেন এবং গানটি পুরো তৈরি করে আনতে বললেন৷ পরে ‘সেই গাঁয়ের বধূ’ গান প্রকাশিত হওয়ার পর পার্ক সার্কাসের একটি অনুষ্ঠানের ৭টায় আমি, ৯টায় সলিলদা ও রাত ১২টায় হেমন্তদা — তিনবার গাওয়া হল৷ তারপর গানটি দিয়ে সৃষ্টি হল একটি যুগের, যার নাম স্বর্ণযুগ৷ সলিল চৌধুরি আমার গুরু তথাপি বলছি, ঈশ্বরের দূতের মতো সলিল চৌধুরিকে আবিষ্কার করেছিলেন হেমন্তদা৷ অথচ দেখেছি শেষ দিন পর্যন্ত সলিলদার প্রতি কত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি৷ সলিলদাও বলতেন, ভগবান যদি গান গাইতেন তবে তা হেমন্তদার গলায়৷ হেমন্তদা যেদিন চলে গেলেন, সলিলদা চোখ মুছতে মুছতে নিচে নেমেছেন৷ সলিলদা জানতেন তাঁর সৃষ্ট সুর হেমন্তদাকে কতটা নাড়া দিত আর তাঁর গান হেমন্তদার কণ্ঠে কতটা জীবন্ত হত৷ আর আমিও বুঝেছি অন্য সুরকারের সুরের মাধুর্য তিনি কতটা বুঝতেন ও মূল্যায়ন করতে পারতেন, তাঁর নিজস্বভাবে সুর নির্মাণ বোধের অন্তর আলোয়৷ আমার নির্মিত ‘সবাই চলে গেছে’ ও ‘এমন একটা ঝড় উঠুক’ প্রকাশিত হওয়ার দিন ১৫ বাদে ওঁর বাড়ি গেছি — ঘুমোচ্ছিলেন, উঠে আমায় দেখেই বললেন, ‘ও তুমি এসেছ? তোমার গান খুব ভাল৷ দশ বছর৷’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম৷ মানুষটা জ্যোতিষ নাকি৷ ১৫ দিন হল গান প্রকাশিত আর বলে দিলেন গান ১০ বছর চলবে৷ সত্যিই জ্যোতিষ — সেই গান আজও জনপ্রিয়৷ এখনও ‘এমন একটা ঝড় উঠুক’ বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীরা রিমেক করে৷ অনুষ্ঠানে গায়৷ কেবল নিজে দক্ষ, সার্থক সুরস্রষ্টা বলেই অন্যের উৎকর্ষ বুঝতে পারতেন৷ আর অসম্ভব পছন্দ করতেন নতুন নতুন পথে চলা৷ ভারতীয় ঐতিহ্য সংগীতের বাহনে চেপে কী অসাধারণ সব সৃষ্টি৷ কীর্তন ও লোকগানকে একটা নতুনভাবে তুলে ধরেছেন আধুনিক নির্মাণে৷ মান্না দে-র গাওয়া ‘ওগো চন্দ্রবদনী’ সেই কীর্তন ব্যবহারের একটা সার্থক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত৷ সঞ্চারীতে গিয়ে একটা জাত কীর্তনের ফর্মাটকে একেবারে ছবির দৃশ্য ও সাংগীতিক প্রয়োগে চরম সৃষ্টিশীলতার ছাপ রেখেছেন৷ অনেক সময় শোনা গেছে হেমন্তদা নিজে গেয়েছেন বলে উতরে গেছে, কিন্তু এই ‘ওগো চন্দ্রবদনী’, ও ‘কোকিলা তোরে শুধাই রে’৷ পলাতক-এ রুমাদির গাওয়া গান, ফুলেশ্বরীতে অনুপ ঘোষালের কণ্ঠে গীত গান, ভালবাসা ভালবাসাতে শিবাজির কণ্ঠে, পরিণীতা ছবিতে আরতির গাওয়া ‘লাজে রাঙা, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘কুসুম দোলায়’ নায়িকা সংবাদে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ প্রভৃতি গান এমন কি অতল জলের আহ্বান ছবিতে সুজাতা চক্রবর্তীর গাওয়া ‘ভুল সবই ভুল’ সুপারহিট—যে সুজাতা চক্রবর্তী ওই একটাই বাংলা গান বোধহয় গেয়েছেন৷ লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘যদিও রজনী’ এ সব গান শুনলে তাকে সুরসম্রাট না বলে উপায় নেই৷ হিন্দি চলচ্চিত্রেও তাঁর অসম্ভব সব ভাল ভাল সৃষ্টি আছে৷

Basic record-এর কম কাজ করেছেন৷ নিজের গান ছাড়া৷ তবু তার মধ্যেই প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গীত দুটি গান (১) ‘আমায় দোষ দিয়োনা আর’ (২) ‘বড় সাধ জাগে’ দুটি অমর সৃষ্টি৷ শুনলে চোখে জল না এসে পারে না৷ হৈমন্তীর গাওয়া ‘বৃষ্টি তুমি চোখের পাতা ছুঁয়ো না’, কিশোরবাবুর গাওয়া ‘আমার পুজার ফুল’ এরকম অজস্র হিট আছে৷ গায়ক হিসাবে যেমন তিনি দেবশিল্পী, সুরকার হিসেবেও তিনি পরম বৈষ্ণব৷ তাঁর সুরের Melody এক বৈষ্ণবের অন্তর্নিহিত প্রেমের মতো সুষমামণ্ডিত ও সুন্দর৷ সুরস্রষ্টা হিসেবে আমার জীবনে তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিশারি৷

আজীবন রবীন্দ্র মন্ত্রে দীক্ষিত এই ঋত্বিককে রবীন্দ্রভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চিনতে ভুল করেননি৷ উভয়েই তাঁকে ডিলিট উপাধিতে সম্মানিত করেছে৷ রবীন্দ্রনাথের মতো সংগীত-স্রষ্টাকে অন্তরের সিংহাসনে স্থাপন করে সংগীত সৃষ্টি যে কোনও অবস্থাতেই অনায়াস, এই ছিল তাঁর ধারণা৷ তাই হেমন্ত কুমার ইংরেজি ছবির সুর সংযোজনা করতেও পিছিয়ে যাননি৷ দুঃসাহসিক ঘোড়া কোনওদিন অজানার পথে ছুটতে ভয় পাননি৷ তাঁর অন্তরের মন্ত্র, ‘অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে/অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন তরে৷’ সাংসারিক দায়বদ্ধতায় তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সাধক, সংগীত আরত্রিকে ভক্ত-পূজারী বাউল৷ জীবনের সব সুরের তারকে বেঁধেছিলেন রবীন্দ্র-একতারার তারে৷ আর তারই মূর্ছনায় মানুষ প্রকৃতি, পৃথিবী, ফুল, সংসার, সাধনা সব একাকার হয়ে তাঁর গানের ধারা কে করে ছিল সাগর মুখে প্রবাহিত৷ তাঁর কথা স্মরণ করলে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের দুটি কলি মনে বাজতে থাকে, মনে হয় তপঃক্লিষ্ট মহাজীবনের অভিযাত্রী আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে গাইছেন,

‘যখন শুষ্ক প্রহর বৃথা কাটাই
চাহি গানের লিপি তোমার পাঠাই’৷

মহান হৃদয়ের মানুষ তার বহু স্বাক্ষর আছে — দু’চারটে না বললে এত বড় মাপের শিল্পী ও সুরস্রষ্টার অনুভব ক্যানভাসের রঙ ও ছবিটা আঁকাই হবে না — আর ক্যানভাস যথাযথ না হলে মূল চিত্রটাই ফ্যাকাসে হয়ে যায়৷ সম্পূর্ণ ঈশ্বরে নির্ভরশীল এই নিরহঙ্কারী মানুষটা জীবন ও শিল্পকে খুব সহজভাবে নিতে পেরেছিলেন৷ প্রধান কারণ তিনি নিয়তিবাদী ছিলেন না, ছিলেন ঈশ্বরবিশ্বাসী, দরদি ও মরমি মানুষ৷ অন্তরটা ছিল আকাশের মতো বিশাল৷ স্তম্ভ ব্যক্তিত্বের মধ্যে মিশ্রিত ছিল এক বুক স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসা৷ সংসারের সাধনায় ছিলেন নিঃস্বার্থ, বাউল, সমর্পিত প্রাণ৷ কেবল দুবেলা দুটি অন্ন জুটলেই হল৷ সাবেকী ভাব— বিয়ে বাড়ি গেলে লুচি আর বোঁটাযুক্ত বেগুন ভাজা চাই-ই-চাই৷ ধোপাবাড়ির সাদা পোশাক ছাড়া কোনও চাহিদা নেই — কোনও দাবি নেই সংসারে৷ কলকাতায় শহরে কয়েকটি বাড়ি, তাতে বাস করছেন ভায়েরা৷ নিজে ভাড়াবাড়িতে৷ এর জন্যে কোনও উত্তাপ নেই৷ মাস গেলেই একটা বড় অঙ্কের অর্থ চলে যেত বিভিন্ন মানুষের কাছে৷ তার মধ্যে কিছু ছিল তাঁদের পরিবারের জন্যে বরাদ্দ কিছু যাঁরা হেমন্ত — হেমন্ত হয়ে ওঠার পেছনে তাঁদের অবদানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের চলার পথকে সুগম করেছেন৷ তাঁর এই বাউল প্রাণের ছাপ বারবার এসে পড়েছে তাঁর সৃষ্টিতে৷ বিশেষ করে আবারও একবার উল্লেখ করব ফুলেশ্বরীর সেই গান— ‘আমি দেখতে ভালবাসি৷’ একটু বিশ্লেষণ করি৷ ছবির দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে সৎ মা ব্যথিত অন্তরে নিজের গর্ভস্থ সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করতে বলছেন তাঁর সতীনপুত্র ছোট ছেলেকে, কারণ বড় ভাই তার তিন কাঠা জমি অন্যায়ভাবে দখল করেছে৷ স্বভাব বাউল ছোট ভাই, তাঁর কাব্য সংগীত রচনার জন্যে গাছতলাকেই বেছে নিয়েছে — তার বক্তব্য ‘ও সব জমিটমি দিয়ে কি হবে?’ আর সৎ মা হয়ে যখন তার পক্ষে স্বীয় গর্ভস্থ সন্তানের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে চাইলেন৷ ‘স্বভাব বাউল কবি ম্লান হেসে তৃপ্ত হৃদয়ে বললো৷ ‘তবেই দ্যাখো কে জিতল?’ এই দৃশ্যে রচয়িতা কবি চরিত্রের যে বৈরাগ্যের প্রকাশ তাতে আমরা যে অনবদ্য প্রেম সংগীতটি পেলাম — তা রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানের বিচরণ-ভূমি, যে মন্দির বা বাগানের পুষ্প সুশোভিত আবেশ, শুধু তা পেলাম না — পেলাম চৈতন্যপ্রেমে বিভোর এক জাত বাউলকে, যে গামছা কাঁধে এলো গায়ে — ‘হাঁটুর ওপর কাপড় উঠিয়ে গাছতলায় বসে সংগীত রচনা করে আকাশের পানে চেয়ে — মুগ্ধ নয়নে মুক্ত প্রকৃতি দর্শন করে আর গান গায়৷ এ গান শুনে আমি নিজের মধ্যে নিজেকে বিশ্লেষণ করে দেখেছি সংসারে আমি নিজেকে সেই প্রত্যাশাহীন সেবায় নিয়োজিত করতে পারিনি — তাই এই সুর আমি করতে পারতাম না — কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সংসারে প্রাণ সমর্পিত সেবক — ভাবে অনুভবে বৈষ্ণব, বাউল তাই তাঁর পক্ষে এই সুর করা সম্ভব৷ তাঁর চরণে শতকোটি প্রণাম জানাই৷

একবার পুজোয় আমার সুরে গাইবেন সব স্থির৷ সবাই জেনে গেছেন তিনি এবার পুজোয় আমার সুরে গাইবেন৷ কিন্তু হঠাৎ একটা প্রয়োজনে তিনি আমায় জানালেন তাঁকে এবার মুকুল দত্তের রচিত গান গাইতে হবে তাই আমার গান গাইতে পারছেন না৷ আমি খুবই অসুবিধায় পড়লাম৷ পুজোয় তিনি গাইবেন বলে না গাইলে আমার জীবিকার জীবনে একটা ধাক্কা আসবে৷ আমি খোলাখুলি জানালাম৷ সবাই জেনে গেছে৷ কাজটি না হলে আপনার কিছু হারাবার নেই কিন্তু আমার অনেকটাই ক্ষতি হবে — কারণ সবাই জানে আপনি আমার পুজোর গান করছেন৷’ তিনি phone করলেন৷ বললেন, ‘ঠিক আছে মুকুলের লেখা আমার সুর করা একটা গান আছে এক পিঠে ওই গানটা রাখব আর অন্য Side-এ তোমার একটা গান থাকবে৷ কিন্তু দুটোই তোমার সুর বলে থাকবে৷ সেই গানটি, ‘আমিও পথের মত হারিয়ে যাবো৷’ অপর পিঠে আমার রচিত-সুরোরোপিত ‘অনেক অরণ্য পার হ’য়ে’৷ দুটির রয়্যালটি আমিই পেলাম৷ তিনি অনুজ অনুজার প্রতি ছিলেন ঠিক অভিভাবকের মতো৷ ছোট ছোট কত কথা মনে পড়ে — আর মনে হয় মানুষের মধ্যে দেবতা দর্শন করতে পারার সৌভাগ্য আমরা অর্জন করেছি যাঁরা তাঁকে দেখেছি৷ কাছে এসেছি, মিশেছি৷ হিমালয়ের মতো দূরত্ব রেখে বাড়ির ফোয়ারার জলের মতো জীবনকে ভিজিয়ে দিতে পারতেন৷ মনে পড়ে প্রথম জীবনে যখন পরিচয় হল— ঠিক অভিভাবকের মত বললেন, ‘জানবে tution-ই লক্ষ্মী— একটা ছোট্ট গাড়ি কিনে নেবে, —আমি কিনেছিলাম৷’ তারপর প্রথম যখন গাড়ি কিনে তাঁকে জানালাম— ফোনেই বললেন, ‘ভাল গ্যারেজ পেয়েছ তো?’ কত বাস্তব বোধ অথচ কত ভালবাসা ও আন্তরিকতা সমৃদ্ধ৷ গান গাইবেন, সুর করবে কে? যার হৃদয় আকাশের মতো উদার, সাগরের মতো গভীর, মাটির মতো সহনশীলা মাতৃসুধা ঝরা বসুন্ধরা৷ ঘটনাগুলো ছোট ও সাধারণ কিন্তু শিল্প নন্দন বোধ ও বোধির অঙ্গনের এইগুলোই সেই বীজ, সেই চারা, যা পরবর্তীকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামে এক মহীরুহ সংগীত অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছিল৷ একটা ছবি আমার করার কথা— কিন্তু প্রযোজকের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে হল না৷ পরবর্তী সংগীত পরিচালক নির্দিষ্ট হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ ছবিটির গান*** recording-এ আগের দিন হেমন্তদা জানতে পারেন আর পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেন, [তিনিই হেমন্তদাকে নেবার মধ্যস্থতা করেছিলেন] ‘পুলক বলনি তো এটা অভিজিতের করার কথা?’ পুলকবাবু বলেছিলেন—’প্রযোজকের সঙ্গে গোলমাল হওয়ার কারণে এ ছবিটি অভিজিৎবাবুর হত না কিন্তু ছবিটি হাতছাড়া হয়ে অন্য কেউ করাতে উনি যে দুঃখটা পেতেন— আপনি করাতে ততটা দুঃখ পাবেন না৷’ হেমন্তদা কথাটা চুপ করে শুনলেন! ছবিটির আবহ সংগীত যেদিন শেষ হল— অর্থাৎ ছবির সাংগীতিক কাজের শেষ দিন হেমন্তদা আমার কাজের দক্ষতা ও সৃষ্টিশীলতা নিয়ে এমন কথা বলেছিলেন প্রযোজককে সে কথা আমি নিজ কলমে উদ্ধৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করি৷ কেবল আমার প্রতিই তার একচ্ছত্র ভালবাসা ছিল এমন তো নয়৷ তাঁর ভালবাসার হৃদয় নদী চির কল্লোলিনী হয়ে নিরবধি বয়ে গেছে— ভালবাসায় ছুঁয়ে গেছে তার চলার পথের সমস্ত গ্রাম, দেশ, মাটিকে৷ তাই তাঁর বয়ে চলা দুধারের স্পর্শযুক্ত মৃত্তিকা পেয়েছে তার সিক্ত স্নেহ রস৷ অনুষ্ঠানে গেছেন বাইরে৷ সঙ্গে অনুজ-অনুজা শিল্পীরা রয়েছেন৷ রাতে খবর নিচ্ছেন সবার খাওয়াদাওয়া হয়েছে কি না৷ ঘড়িতে alarm দিয়ে রাখছেন৷ নিজেকে সকাল সকাল উঠতে হবে, ছোটদেরও জাগিয়ে দিতে হবে৷ যেন অভিভাবকের দায়৷ অতুলনীয়৷ বাইরে অনুষ্ঠানে যাবেন৷ যে ট্রেনে যাবার কথা আগের ট্রেনটিতে যাবেন৷ পাছে কোনও কারণে ট্রেন যদি দেরি করে, অনুষ্ঠান আয়োজকদের অসুবিধা হবে৷ একটি অনুষ্ঠান শেষে মূকাভিনেতা শ্রীযোগেশ দত্ত-র প্রয়োজনে আপন যাত্রা স্থগিত রেখে নিজের টিকিটের স্থান তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন৷ বাংলা সংগীতের পরিবারের যেন তিনি এক দায়বদ্ধ অভিভাবক৷ এই বিবেকহীন, প্রেমহীন যুগে এসব কথা বলতে চোখে জল আসে৷

শেষ দিকে যখন গলা নষ্ট হয়ে গেছে তখনও তিনি কেন গাইছেন সে কথা যাঁরা জানতেন, তাঁরা তাঁকে মনে মনে প্রণাম করতেন৷ কেন গাইছেন প্রশ্ন করতেন না৷ তিনিও জানতেন তাঁর ‘দেবকণ্ঠে’ মালিন্যের ছাপ পড়েছে৷ সেই অবস্থাতেও কেউ ভাল বললে, বলতেন, ‘ অনেকদিন তো ভাল শুনেছো৷ এবার একটু খারাপ শোন৷’ আবার একদিন বেলাদি ভাল বলায়—উত্তরে বললেন, ‘কাকে কী বোঝাচ্ছ?’ কেন অপটু কণ্ঠ নিয়ে গাইতেন তা একটা ঘটনা বলে বোঝাব৷ একটি ক্যাসেটে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে দুটি গান গেয়ে দেওয়ার জন্যে দু’বছর ধরে একজন পীড়াপীড়ি করছে— রাজি হয়েও সময় দিতে পারছেন না৷ হঠাৎ একদিন নিজেই ফোন করে বললেন, ‘যদি কালকের মধ্যে দশ হাজার টাকা দাও— চারটে গান গেয়ে দেব— চাও তো পুরো ক্যাসেটটা গেয়ে দেব৷’ যার প্রস্তাব সে তো সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘আমি আসছি আপনার কাছে’— উনি পুরো ক্যাসেট গেয়ে দিলেন৷— ব্যক্তিটি তাঁকে কুড়ি হাজার টাকা দিলেন৷ হেমন্তদা বললেন, ‘তুমি বাঁচালে’— আমার একটা টাকা আসতে দেরি আছে৷ মাসটা কাবার হলেই বাড়ি বাড়ি খাম পাঠাতে হবে— না হলে তাদের সংসারে অসুবিধা হবে৷’ শুনেছি যেদিন চলে গেলেন হাসপাতালের বিছানায় শুতে শুতে বলেছিলেন, ‘খামগুলো যেন সময়মতো জায়গায় জায়গায় পৌঁছে যায়৷’

‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’, ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’— এসব গানই তাঁর জীবনের অন্তিম সংগীত৷ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার বহু পূর্বে তিনি পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন৷ আমায় গুরুদেব শ্রী পরমানন্দ সরস্বতী রচিত আধুনিক কবিতা নির্ভর তিনটি গান তিনি রেকর্ড করেছিলেন—সেই রেকর্ডিং-এ যাচ্ছি—পাশে বসে আছি— নানা গল্প করছেন—একটা বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বললেন, কণ্ঠে পূর্ণ নির্লিপ্ততার সুর— ‘জীবনের সবচেয়ে ওপরটাও দেখেছি, সব চেয়ে নিচেটাও দেখছি, মধ্যিখানটাও দেখেছি— আর কি দরকার—এই বেশ আছি৷’ তাঁর কণ্ঠে তখন বাজছে একটি গান, ‘চিরবন্ধু’, —চির নির্ভর, চির শান্তি—তুমি হে প্রভু৷’ হয়ত শেষ জীবনে নিজেকে আরও প্রত্যক্ষভাবে সমর্পণ করেই গেয়েছিলেন, ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে/ নিয়ো না নিয়োনা সরায়ে৷’

আমি কিন্তু তাঁর এই জীবনটাকে পূর্ণ নৈবেদ্য দেওয়া অভিব্যক্তি থেকে গীতার নিষ্কাম কর্মের সৌরভ অনুভব করি আর তাঁর অতীন্দ্রিয় সন্ন্যাসী কণ্ঠে ধ্বনিত হতে শুনি কবি রবীন্দ্রনাথের সেই গান—

‘আমি আছি তোমার সভার দুয়ার দেশে
সময় হলেই বিদায় নেব কেঁদে হেসে৷
মালায় গেঁথে যে ফুলগুলি
দিয়েছিলে মাথায় তুলি
পাপড়ি তাহার পড়বে ঝরে দিনের শেষে৷
উচ্চ আসন না যদি রয় নামব নিচে
ছোট ছোট গানগুলি এই ছড়িয়ে পিছে৷
কিছু তো তার রইবে বাকি
তোমার পথের ধুলা ঢাকি
সব গুলি কি সন্ধ্যা হাওয়ায় যাবে ভেসে?

(৩)

মহাপ্রভু বলেছেন, ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ যা তুমি চাও সব নিজের জন্যে৷ এতে তোমার মুক্তি নেই— একমাত্র প্রেম ভক্তিতেই হয় সম্পূর্ণ সমর্পণ৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁর শান্তিনিকেতন গ্রন্থে একই বাণীর প্রতিধ্বনি করেছেন— ‘আমাদের মুক্তি মোক্ষ নয় আমাদের মুক্তি প্রেম৷’ বাস্তবিকই সর্বধর্ম সমন্বয়ের মধ্যেও বোধের প্রকৃত মিলন নেই— বৈচিত্রের মধ্যে একটা সমঝোতা আছে, কিন্তু একের সঙ্গে অন্যের ধর্ম-সহবাসে একটি নির্দিষ্ট বোধের জন্ম হচ্ছে না— যা বৈষ্ণবের প্রেম ভক্তির পূর্ণ পরিপূর্ণতার মধ্যে আছে৷ একটি সার্থক শিল্পী বা সঙ্গীত সাধকের জীবনেও তাই, Versatile দক্ষতা থাকাটাই শেষ বা সর্বোচ্চ সার্থকতা নয়৷ তার পরিণত রসবোধই তার প্রকাশের মুক্তি৷ ভারতবর্ষে Vesatile শিল্পী অনেক এসেছে৷ তাঁদের বিভিন্নতার উৎকর্ষে তাঁরা সমৃদ্ধ কিন্তু তাঁদের সমস্ত কাজের দ্বান্দ্বিক অবস্থানের মধ্যেও এক মর্মবোধের পরিপূর্ণতায় তাঁরা ঐশী হয়ে উঠতে পারেননি— যা করতে পেরেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— যাঁকে বলা যায় শাস্ত্রীয় ভাষায়, দেবশিল্পী৷ যিনি সমস্ত বিভিন্নতা ও বিচিত্রতাকে তাঁর সাংগীতিক অভিব্যক্তি দিয়ে একটি আত্মবোধের মৌলিক রস মাধুর্যময় নান্দনিক রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ সঙ্গীত পরিচালকেরা বার বার তাঁর ওই গান্ধর্ব্য প্রতিভার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন৷ জীবনে যুদ্ধ আছেই কিন্তু সেটা জীবনের পরিণতি নয়— জীবনের পরিপূর্ণতা শান্তিতে, সঙ্গীতে৷ আর এই কথা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সঙ্গীত পরিচালকেরা বুঝেছেন যে এই শিল্পসত্তার অধিকারী একমাত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ তাই নৌশাদ ‘শাবাব’ ছবিতে তাঁর কণ্ঠের সৌন্দর্যকে ব্যবহার করেছেন, ওস্তাদ ও পণ্ডিতদের বিকল্প হিসেবে ও সঙ্গীতকে জীবন শান্তির সঙ্গীত হিসেবে রসিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনে৷ সন্ন্যাসী রাজা ছবিতে মান্নাদের মতো মহান সুদক্ষ অপ্রতিদ্বন্দ্বী সঙ্গীত শিল্পীর কণ্ঠে সমস্ত গান গাওয়ানো সত্ত্বেও সর্বশেষ নচিকেতা ঘোষ ‘কা তব কান্তা’ মুক্তি শ্লোকটি উচ্চারণ করার জন্যে বেছে নিলেন ভগবানের দ্রুপদী কণ্ঠস্বরের অধিকারী সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে৷ আর কেবল কণ্ঠস্বরই এর কারণ নয়— তা হলে অমিতাভ বচ্চন বা অম্বরীশ পুরীকে দিয়ে সে কাজ হতে পারত৷ আসলে প্রয়োজন ছিল বোধিদীপ্ত বোধের সাংগীতিক ঐশিক প্রকাশ৷ তাই কেবল গলার আওয়াজ বা কেবল সাংগীতিক দক্ষতাই নয়— প্রয়োজন ছিল ঈশ্বরের রহস্যের অস্তিত্বের মতোই এক অজানা, অচেনা কিছু লীলারস সম্পৃক্ত অনির্বাচনীয় ধ্বনি৷

সুর নির্মাণে বা কণ্ঠদানে অনেকেই তাঁর স্বকীয় রূপ তথা Style-কে বজায় রেখে কাজ করেন— যেমন সলিল চৌধুরি, তাঁর সমস্ত নির্মাণে তাঁর নিজস্ব ছাপ রেখে গেছেন, আবার শিল্পীদের মধ্যেও অনেকেই [নাম উল্লেখ করছি না]— বিষয়বস্তুর প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি না রেখে তাঁর নিজস্ব কণ্ঠস্বরটা পাচ্ছেন কি না সেই দিকে খেয়াল রাখেন৷ কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কি সুর রচনায়, কি কণ্ঠদানে, সব সময় মিটিয়ে দেন বিষয়ের দাবিকে এবং আমি জোর দিয়ে বলতে পারি তাতে তিনি তো হারিয়ে যানইনি বরঞ্চ সেটাই তাঁকে অধিক বিস্তৃতি ও মৌলিকতা দান করেছে৷ তাই তিনি সঙ্গীত পরিচালকদের কাছে ও চিত্র-পরিচালকদের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠে নিজেকেই Versatile করতে পেরেছেন৷ কৌরব পাণ্ডবদের অস্ত্র পরীক্ষায় দুর্যোধন গুরুদেব ও ভায়েদের দর্শন করার মতো মূল্যবোধের কাজ করা সত্ত্বেও বিনাশিত হয়েছিল, কিন্তু অর্জুন কেবল তাঁর মূল লক্ষ্য পাখির চোখে দিকে দৃষ্টি রাখায় পাণ্ডবেরা জয়ী হয়েছিলেন৷ প্রতিটি কাজের মধ্যে করণীয় সত্য দৃষ্টি সজাগ চাই৷ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘প্রাণের সঙ্গে যে শিল্পের যোগ নেই তা শিল্পই নয়৷’ — এই সত্যের বোধের বিকৃতি কখনও ঘটেনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনে৷ শুধুই তাই নয় তাঁর এই শুদ্ধ সংস্কার যুক্ত অনুভূতি খুব স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই চরমবোধকে রূপ দিয়ে গেছে৷ তাঁর সুরারোপিত সম্ভবত প্রথম জীবনের ছবি, ‘প্রিয়তমা’-তে স্মরণের এই বালুকা বেলায়— গানটি সুরারোপ করার সময় এবং গাইবার সময়, ‘তুমি চলে গেছো— দূরে— বহু দূরে’— এই ‘দূরে৷ বহু দূরের সুর ও rendeing যদি কেউ অনুধাবন করেন দেখবেন দুরে, বহু দুরে কিভাবে সুর করেছেন এবং গায়নে প্রকাশ করেছেন৷ শব্দ দুটি উচ্চারণে ও সুর সংযোজনায় বিরহের বোধকে দিগন্ত বিস্তৃত করেছেন৷ আমি তখন ছাত্র কিন্তু সিনেমার ওই বেদন মুহূর্তকে কিভাবে সঙ্গীতায়ন করেছিলেন, ভেবে বিস্মিত, অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম৷ আজও আমায় যদি ওই গান কেউ গাইতে বলেন— আমি সে ভাবেই render করব, একেবারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একলব্য শিষ্যের মতো— আর গানের বাণীকে এই ভাবেই যথাযথ রূপে সঙ্গীতায়ণ করব৷ সঙ্গীত নির্মাণে ও পরিবেশনায় তাঁর এই সহজিয়া সজাগবোধ তাঁর সমস্ত জীবনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিধৃত৷ পণ্ডিত বা ওস্তাদ যাঁরা তাঁরা অনেক জেনেও তাঁর শিল্পচিত্ত ব্যবহার করতে পারেননি— তাঁদের ভেতরের শিল্পীকে তাঁরা পাণ্ডিত্য বা ওস্তাদীর অস্ত্র দিয়ে খুন করেছেন— কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যেখানে, যতটুকু শিখেছেন তা এমনইভাবে গ্রহণ করেছেন এবং আত্মীকরণ করেছেন, যে তিনি তাঁর নির্মাণে সেই জানাকে এনে অজানা নতুন সৃষ্টির চলমানতায় মিশিয়ে দিয়েছেন এবং নিজস্ব ধারায় একটি মৌলিক রূপ দিয়েছেন৷ তাঁর নির্মাণ ও পরিবেশনা সত্য সাধনায় সঙ্গীতকে জীবন দিয়েছে৷ দ্রুপদী জ্ঞান সম্পৃক্ত শিক্ষার পাখোয়াজি আওয়াজই সঙ্গীত নয়— অন্তত সুর জীবন ও প্রেম সম্মত নয়— হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দ্রুপদী গান্ধর্ব্য আওয়াজ নিয়ে প্রকাশে যেন বৈষ্ণবের মতো পদাবলী গেয়েছেন৷ আর তাঁর এই সুর করণের সহজিয়া গতি ও কণ্ঠস্বরের তরঙ্গ, শুদ্ধ উচ্চারণে, কিভাবে লীলায়িত করতেন তা বোঝাতে আমি ঘটনার উল্লেখ করছি৷

তাঁর স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের মুখে শুনেছি উনি একটা গানে সুর করতে বসে বেশি রগড়া-রগড়ি করতেন না৷ ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে সহজ স্বাভাবিক সাবলীলভাবে সুরটা না এলে উঠে পড়তেন৷ তখন আর ওটা নিয়ে বসে থাকতেন না৷ তিনি সুরে স্বতঃস্ফূর্তভাবকে খুবই গুরুত্ব দিতেন৷ নিজের সাহিত্য চর্চা ছিল প্রথম জীবন থেকে৷ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক দিকে একান্ত বন্ধুত্ব ছিল— আবার নিজের জীবনবোধও ছিল উচ্চমানের— সব মিলিয়ে শিল্পকে জীবন সম্মত করাটি ছিল তাঁর স্বাভাবিক স্বভাব৷

(৪)

তাঁর এই সহজিয়া গতিকে বজায় রাখার জন্যে গীত রচয়িতাদের অধিকাংশ সময়ে গানের পূর্ণ বাণীর মুখড়া নিজে লিখে দিতেন৷ এই সমস্ত কর্মকাণ্ড রবীন্দ্রনাথের বাণী ‘যে শিল্পের সঙ্গে প্রাণের যোগ নেই, তা শিল্প নয়’,— তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়৷ বিষয়কে বাদ দিয়ে পর্দার সার্কাস করা তাঁর সহজাত ছিল না৷ তিনি স্বভাব শিল্পী৷ স্বভাব রূপকার৷

তিনি কতটা বিষয়নিষ্ঠ তা প্রথম ছবির গান গাওয়াতে গিয়েই বুঝেছিলাম৷ ছবির নাম ‘অশ্রু দিয়ে লেখা৷’ গান গাইবার আগে কখনও বলতেন না গান তুলে দিতে বলতেন কবে শেখবে? তাৎপর্যপূর্ণ, তাঁর মূল শিল্প বোধের প্রেক্ষিতে৷ সেই ছবির গানটা শেখাতে বসার সঙ্গে সঙ্গে দুটি প্রশ্ন করলেন, (১) গানটি কার ঠোঁটে থাকবে (২) গানটি outdoor না in door. প্রচণ্ডভাবে বিষয়নিষ্ট না হলে এমন ভাবে situation এবং চরিত্রের অবস্থান কেউ জানতে চাইবে না৷ যে অভিনেতার মুখ দিয়ে গানটা প্রকাশ হবে তা যদি উত্তম কুমারের হয় তবে কণ্ঠের আওয়াজ এক হবে আর যদি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হয় তবে অন্য আওয়াজ,-এই তারতম্য তিনি রক্ষা করে তবে গানটি গাইবেন এই ছিল বস্তুনিষ্ঠা৷ আর গানটি যদি outdoor হয় তবে কণ্ঠস্বরের উদাত্ততা বজায় রাখতে হবে, এবং যদি indoor হয় তবে intimacy-র জন্যে তা অন্যরকম হবে,— এও দৃশ্যানুগত্য তথা শিল্পনিষ্ঠতা৷

‘আমার গানের স্বরলিপি’ গানটি যে শিল্পী ‘আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোন’, — বানী ও সুরটি প্রকাশের সময় সমস্ত কণ্ঠস্বরের মধ্যে সময়ের ইতিহাসকে সাংগীতিক ভাবে প্রকাশ করলেন, ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’ গানটিতে ‘গত রজনীর অশ্রু তিমিরে ভেঙেছ অন্ধকারা’ বলতে গিয়ে বিগত জীবন ও সদ্যপ্রাপ্ত জীবনের মেলবন্ধ রসরূপ কল্পকে জীবন্ত করে তুললেন কণ্ঠ মাধুর্যে, তিনিই আবার ‘মায়ামৃগ’ ছবিতে রেসুড়ে, বে আক্কেলে, খামখেয়ালি বাউলের অথচ ভালমানুষের চরিত্রে যখন ‘যারে যা’— বলে পায়রা ওড়ালেন তখন তাঁর কণ্ঠে সেই দ্রুপদী আওয়াজ বাজালেন না— মূল্যবোধের sofistication তখন হালকা জীবনের বে-আক্কেলে লঘুধ্বনির প্রতিবেদনে প্রকাশিত হল— কেবল তাই নয় সমস্ত গানটি গাইবার সময় সুরকার মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় যেমন দৃশ্যের চরিত্রগুলো বদলের সঙ্গে সঙ্গে সুরের বদল করেছেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও চরিত্রগুলোর সম্মুখীন হওয়ার সময় চরিত্রগুলোর অবস্থান অনুযায়ী কণ্ঠের আওয়াজকে বদল করেছেন, বড় আওয়াজের গলার যেমন বিচরণে বিস্তৃতি দেবার সুযোগ সুবিধা আছে তিনি তা সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করলেন— with full acting— প্রায় সংলাপের মত৷ কেবল এই একটি গানই তাঁর versatile কণ্ঠ দক্ষতার অনেকখানি প্রকাশ৷ তাঁর মত সম্ভ্রান্ত কণ্ঠশিল্পীর পক্ষে vocal intoxication প্রকাশ করার ক্ষেত্রে অনেকখানি কিন্তু-বোধের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কথা৷ অথচ যদি ‘আসমানী কবুতর’,— গানটি শোনা যায়— বোঝা যাবে এই অভিব্যক্তিও তিনি তাঁর গলায় প্রকাশ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হননি৷ আবার ‘জীবন পুরের পথিকরে ভাই’ গাইতে গিয়ে কণ্ঠদানেও সুর সংযোজনে মেঠো গায়ক হতে তাঁর কোনও দ্বিধা বা অসুবিধা হয়নি৷ অথচ মজার বিষয় এই সমস্ত গানেই মাথা উঁচু করে বেঁচে আছেন একটি তকমায়—তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ তাঁর অনুগামী প্রজম্মের শিল্পীরা তাঁর গান গাইতে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাই বাঁচাতে পেরেছেন তাঁদের ‘হেমন্তকণ্ঠী’— অভিধাকে৷

আমি বিভিন্ন প্রবন্ধে কিছু কথা বারবার উচ্চারণ করি— তার মধ্যে একটা কথা হচ্ছে— ‘প্রয়োগ শিল্প লিখে বোঝানো যায় না৷’ তবু লিখতে হয়, আ-প্রাণ চেষ্টা করতে হয় নানা ভাষা ও অভিব্যক্তি দিয়ে যাতে যথাযথ উৎকর্ষ অনুধাবন করার জন্যে যেন ‘পাঠকবর্গ সেই সব শিল্প সৃষ্টিগুলোকে নিয়ে সোজাসুজি বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন— যাতে ওই বিশেষ শিল্পটির রস মাধুরী পাঠককে আবেগে আপ্লুত করতে পারে৷ যেমন ধরুন—

‘মন নিয়ে’— ছবিতে ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী’— গানটির দৃশ্যকল্প ও singing rendering. দৃশ্যটির উপস্থাপনা রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের ভঙ্গিতে সৃষ্ট— হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুরে দুটি style-কে গ্রহণ করলেন, একটি opera minded রবীন্দ্র সৃষ্ট নৃত্যনাট্যের সুর প্রকৃতি এবং যেখানে দ্রুত গতিতে Double ছন্দে গীত হচ্ছে— সেখানে তালের দ্বিগুন করার বুদ্ধি আবার ভাষা সাজানোর ব্যঞ্জনায় কিছুটা র্যাপ style এর উচ্চারণ— আর সঙ্গে বস্তুনিষ্ট হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ভাব ও বিষয়নিষ্ট স্বরক্ষেপনের ওঠাপড়ার তরঙ্গ৷ কল্পনা করা যায় ওই কণ্ঠেই গীত ফুলেশ্বরী ছবিতে সেই জীবন বাউলের গান— ‘আমি দেখতে ভালবাসি’৷ একেই বলে স্বকীয় সত্তা বজায় রাখা Versatile প্রতিভা৷

মনে পড়ে ‘শ্যামা’ গীতিনাট্যের একটা ঘটনা৷ তখন 78 রেকর্ডের যুগ৷ তখন একটি record হলে তার অনুমোদনের জন্যে rehearsal বাড়িতে পাঠানো হত Sample disc৷ শ্যামার Sample এসেছে— হেমন্তদা শুনছেন আমি পাশে বসে আছি৷ কোটালের ভূমিকায় তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় দাপটে গাইলেন একটা loud tone-এ ‘ধর ধর ওই চোর ওই চোর’— হেমন্তদা বজ্রসেনের ভূমিকায় কণ্ঠের চরম নমনীয়তা বজায় রেখে একেবারে anti climax দীনতায় গেয়ে উঠলেন ‘নই আমি নই চোর নই চোর— আমি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠেছি— হেমন্তদা মৃদু হাসতে হাসতে বললেন, ‘এ ছাড়া আমার উপায় ছিল না৷ তরুণ, জর্জদা [দেবব্রত বিশ্বাস]-র কাছ থেকে training নিয়ে এসেছে৷ নাটকটির সামগ্রিক বিষয় ও বোধ কতটা ব্যঞ্জনাময় ভাবে আত্মস্থ হলে তবে এই অসাধারণ ভাবে render করা যায় তা অনুধাবনীয়৷ আর এই বিষয়নিষ্টতাই হেমন্তদার versatile singing এর চাবি কাঠি৷ নিজে কোনও কাজে কখনও নিজেকে তুলে ধরতেন না৷ তুলে ধরতেন বিষয়ের প্রতি আনুগত্যকে৷ এই কারণেই দ্বিজেন্দ্রগীতি নজরুলগীতি, ভক্তিমূলক, দেশাত্মবোধক যে কোনও গান গাইতে গিয়ে সেই গানটির উৎকর্ষকে প্রাধান্য দিয়ে তার মর্মবোধকে তুলে ধরতেন৷ আর সঙ্গীত পরিচালকেরা তাঁর এই দৃশ্যকল্পকে যথাযথভাবে সাংগীতিক রূপ দেওয়ার দক্ষতা লক্ষ্য করে কেবল ওই কণ্ঠের আবেদন ব্যবহার করার জন্যে সুরকে তাঁর গাওয়ার সুবিধার মতও কখনও কখনও করে দিতেন৷ অনিল বাগচীর মত শক্ত সুরের রচয়িতাও সেই প্রবণতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি৷

মনে পড়ছে আর একটি আমার শোনা ঘটনা৷ দমদমে প্লেন থেকে নেমে সোজা শ্যামবাজারে নচিকেতা ঘোষের বাড়ি হাজির৷ বন্ধু ছবির গান শিখবেন৷ শেখা হল ‘মউ বনে আজ’৷ নচিদা দ্বিতীয় গান ‘মালতী ভ্রমরের’ সেই শুনিয়েছেন, তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন— বাবা এই গান আমি গাইতে পারব না, আপনি মানবকে খবর দিন৷ নচিদাও একজন masterpiece composer— সৃষ্টিতে দুশো ভাগ বিষয়নিষ্ঠ তিনি জানেন ওই আওয়াজ ছাড়া, ওই situation আবেগে এত সুন্দর করে প্রকাশ করতে চাই যে বিষয়নিষ্ঠ বোধ তা ওই শিল্পীরই আছে৷ নচিদা নাছোড়বান্দা— না আপনাকেই গাইতে হবে৷ নচিদা জানেন৷ আর হেমন্তদাও তাঁর খামতি জানেন, আবার কোথায় তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সেটাও বোঝাতে পারেন৷ শেষ পর্যন্ত হেমন্তদাই গাইলেন আর কি হল সে তো সবাই জানেন৷ আমি শুধু পাঠকবর্গকে বলব, ওতে দেখবেন— ‘ওগো মিতার দানাটা একটু গোল হয়ে গেছে কিন্তু, সঞ্চারী যা গাইলেন তা ভারবর্ষের কোনও শিল্পী এই রূপ দিতে পারতেন না৷ এমনিতেই সঞ্চারী গাইতে শিল্পীরা ভয় পায় কারণ গানটা ওখানে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু হেমন্তদার কলিজায় জোর এমন যে অন্তরা একবার গেয়ে সঞ্চারী ২ বার গেয়েও ধরে রাখতে জানতেন গানটা, ঝুলতে দিতেন না৷ শাপমোচনের ‘বসে আছি পথ চেয়ে’-র মত গানেও সঞ্চারী repeat করেছেন৷ বাংলা গানে সঞ্চারী হচ্ছে গানের আত্মা আর আত্মা অভিসারী বলেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দেবশিল্পী৷

বৈষ্ণবীয় ভালবাসায় পরকীয়া প্রেম একটা ঐশী বিভূতি-সম্পৃক্ত৷ কিন্তু আমাদের দেশে তাকে নিয়ে গ্রাম্য খেউড়ের অভাব নেই৷ উপায় কি? সাধারণ মানুষ ওই উচ্চবোধে বোধিদীপ্ত হতে পারে না৷ তার লীলারস সম্ভোগ করতে হলে রাধাকৃষ্ণের যে মৃন্ময়ীকে ধরে চিন্ময়ীর দেহাতীত সাধনা তা তো আধ্যাত্মিক সাধনা, সেটা যে কেউ সহজে বুঝে যাবে এমনটা বাস্তব নয়৷ কিন্তু হেমন্তদা গীত ও সুরারোপিত ও মুকুল দত্ত রচিত ‘যখন ডাকলো বাঁশি তখন রাধা যাবে যমুনায়’— গানটি শুনলে বুঝবেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আকাশ হৃদয় বুকে যে প্রেমসঙ্গীত ছিল, তা ঐশিক বোধের সম্পদ৷ এই সুউচ্চ অনির্বচনীয় চেতনা প্রদীপ্ত যে সঙ্গীত স্রষ্টা ও কণ্ঠশিল্পী, তিনিই যখন রেসুরের মুখে ‘যা উড়ে যা’ গাইতে গিয়ে তাঁর স্বভাবের কাছে পৌঁছে যান তখন মনে হয়, বোঝা যায় এই শিল্পীর Vesalility গড়ে উঠেছে বিষয়নিষ্ঠতার আনুগত্যে আর সঙ্গে আছে তাঁর একটা মেরুদণ্ড বোধের শক্ত Spinal Chord. তিনি শব্দ উচ্চারণের সময়েও শব্দকে মূল বোধের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রকাশ করতেন৷

গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে একসময় তাঁর খুব নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক ছিল৷ তিনি এক সময় সক্রিয় অংশ নিয়েছেন বলে শোনা যায়৷ একটা নতুন কিছু তাঁর কাছে এলে তাঁর মধ্যে অসম্ভব একটা পরিণত বোধ কাজ করত, যা তাঁকে অনেক শিল্পীর থেকে এগিয়ে রেখেছিল বেশ কিছু আগে৷ যার জন্যে নতুনত্ব কখনও তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি৷ সলিল চৌধুরি under ground অবস্থায় আছেন সেই সময় তিনি ‘অবাক পৃথিবী’— গান রেকর্ড করে ফেললেন৷

হাজার সাংগীতিক বৈচিত্র্যর সম্ভার নিয়েও তিনি তাঁর স্বকীয়তায়, নির্ভেজাল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ তাবড় তাবড় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পারদর্শী শিল্পীরা ওস্তাদিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে পরাজিত করতে সক্ষম হলেও শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে পারেননি৷ তার মস্ত প্রমাণ যেমন শবাব ছবির ‘ও চন্দন কি পলনা’৷ তেমনই আনারকলির ‘জাগ দরদে’— যেন মোগল period-এ পৌঁছে দেয়৷ এই স্বরাবেগ যেন আকবরের সভাসংগীত হয়ে উঠেছে৷ ওস্তাদ হাজার গান গেয়েও এই বোধকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারবে না৷ আবার ‘শ্যামাতে ক্ষমিতে পারিলাম না’— বা ‘চণ্ডালিকায়, ‘কল্যাণ হোক কল্যাণীর’ যে চরিত্র স্বভাবকে যথাযথ করে কণ্ঠের আবেগ ও রঙকে রূপ দেওয়া এ এক সজাগ বোধের শিল্প নৈপুণ্য৷ কোনও উপমায় তাঁর পরিচয় করানো যায় না বরঞ্চ বলা ভাল৷ তোমার তুলনা তুমি৷

প্রকৃতি একটাই— কিন্তু তার মধ্যেই আকাশ মাটি, সাগর নদী, ফুল পাখি আবার ঝড়বৃষ্টি রোদ ঋতুর রঙ বদল৷ তেমনই versatile হেমন্ত কণ্ঠ৷ কণ্ঠ একটি কিন্তু বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ৷ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, কাজি নজরুল ইসলাম, ভক্তি সম্পৃক্ত সঙ্গীত, স্বদেশ গান, বিবিধ বিচিত্র গামী বাংলা সঙ্গীত তাঁর পরিবেশনায় নানা রসের রস ভাণ্ডার৷ তাঁর শিল্প সৃষ্টি পাহাড়ি ঝর্নার মত৷ গিরিগম্ভীরতা থেকে উৎসারিত হয়ে— নির্ঝরের প্রবাহে বহুধা বিভক্ত নদনদী৷ তাঁর গীত গান যেন রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি মনে করিয়ে দেয়—

‘নানা সুরের আকুল ধারা
মিলিয়ে গিয়ে আত্মহারা
একটি নমস্কারে৷’
প্রভু একটি নমস্কারে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *