সন্ন্যাসী এবং ইঁদুরের উপাখ্যান

।।সন্ন্যাসী এবং ইঁদুরের উপাখ্যান।।

ঢাকুরিয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে উপমন্যু গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বললেন “টালিগঞ্জ চ”।

দেবু ব্যাজার মুখে বলল “বাড়ি যাবেন না?”

উপমন্যু সিগারেট ধরিয়ে বললেন “যাব। আগে টালিগঞ্জ চ”।

উপমন্যুর ফোন বাজছিল। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলেন থেকে তার এইচ ও ডি ফোন করছেন। ফোন ধরলেন “বলুন স্যার”।

“ধাপার মাঠের কেসটার আপডেট কী উপমন্যু?” ওপাশের গলাটা একটু অধৈর্য বুঝলেন উপমন্যু। একটু চুপ করে বললেন “দেখছি স্যার। সময় লাগবে”।

“তুমি একা দেখছ কেন কেসটা? একা প্রবলেম হচ্ছে না?”

উপমন্যু বললেন “আমাকে আর একটা দিন সময় দিন স্যার। আমি পরশু ফার্স্ট আওয়ারে আপনাকে জানিয়ে দেব ঠিক কী কী রিকোয়ারমেন্ট আছে আমার এ ব্যাপারে”।

“ওকে। খুব কমপ্লিকেটেড কী?”

“একটু। খানিকটা ইন্সেপশন গোত্রীয় বলতে পারেন। গল্পের ভেতর গল্প আছে”।

“বাহ বাহ। তবে তো ইন্টারেস্টিং বলতে হয়। নোলানপ্রেমী যখন ইনসেপশন খুঁজে পেয়েছে তবে তো ভাবতে হচ্ছে”।

উপমন্যু হাসলেন “তা খানিকটা। ক্রাইমের প্যাটার্ন চেঞ্জ হচ্ছে স্যার। এখন আমরা আপডেটেড না হতে পারলে আমাদেরই সমস্যা বাড়বে”।

“তা বটে। এখন কোথায় যাচ্ছ?”

“দ্য গ্রেট শঙ্কর মুখোপাধ্যায় ডেকেছেন স্যার। তার সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি”।

“শঙ্কর মুখার্জি? এই কেসে?”

“হ্যাঁ। মেয়েটি ওঁর অফিসেই চাকরি করত”।

“ওকে। আশা করব কোন কমপ্লিকেশনশ থাকবে না। থাকলে আমায় জানিও”।

“শিওর স্যার”।

ফোনটা রেখে উপমন্যু জানলার বাইরে তাকালেন। শহরে হালকা ঠান্ডা আছে। একটা হাফ হাতা সোয়েটার নিয়ে বেরোলে ভাল হত মনে হচ্ছিল তার।

টালিগঞ্জের ক্লাবে পৌঁছলেন যখন রাত সাড়ে আটটা বাজে। ক্লাবে ঢুকতে উপমন্যুর বিশেষ সমস্যা হল না।

অত্যন্ত পশ ক্লাব। শঙ্করবাবু উপমন্যুকে নিয়ে একটা আলাদা ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরে আলো কম, এই শীতেও ঘরের তাপমাত্রা হীমশীতল করে রাখা হয়েছে।

শঙ্করবাবু বসে বললেন “স্কচ চলে তো অফিসার?”

উপমন্যু মাথা নাড়লেন। বললেন “নাহ। আজকাল খাই না। লিপিড প্রোফাইল বিপদ সংকেতের ওপর দিয়ে বইছে”।

শঙ্করবাবু বললেন “বেশ, তবে কফি তো নিন”।

উপমন্যু বললেন “তা চলতে পারে”।

শঙ্করবাবু হাতের ইশারা করলেন। একজন শঙ্করবাবুর কাছে এসে মাথা নিচু করল। শঙ্করবাবু কফির কথা বলে দিলেন তাকে। ছেলেটি বেরিয়ে গেলে শঙ্করবাবু বললেন “কাল আমাকে দিন পাঁচেকের জন্য প্যারিস যেতে হচ্ছে। অনেকভাবেই চেষ্টা করলাম যাওয়াটা আটকাতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকানো গেল না”।

উপমন্যু বললেন “নো প্রবলেম। সাবধানে ঘুরে আসুন”।

ঘরে মৃদু শব্দে একটা ইংরেজি গান বাজছে। উপমন্যু গানটা কোথাও শুনেছেন মনে করার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু কিছুতেই মনে আসছিল না গানটা। শঙ্করবাবু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন “মানুষ জীবনে অনেক কিছু চায়। কিন্তু পায় না জানেন তো। ধরুন, যেরকমভাবে সন্তানকে মানুষ করতে চায় একজন অভিভাবক, যদি দেখা যায় সব কিছুর পাল্লায় পড়ে সেই নিজের সন্তানকেই ঠিক করে মানুষ করা গেল না, তখন নিজের শত ঐশ্বর্য থাকলেও দিনের শেষে জিতে যাওয়ার ফিলিংটা আসে না অফিসার”।

শঙ্কর থামলেন। উপমন্যু বুঝতে পারছিলেন শঙ্কর বেশ খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। সামনে থাকা মদের গ্লাসের জন্যই সম্ভবত। উপমন্যু কিছু বললেন না। শুনে যেতে লাগলেন। শঙ্কর বললেন “ছেলেটা যখন ছোট, ওকে কার্শিয়ং এর একটা স্কুলে ভর্তি করালাম। রেখে চলে আসার দিন এত মন খারাপ হল যে ওকে আবার নিয়ে চলে এলাম। ভাবলাম ছেলেই যদি দূরে চলে গেল তাহলে আর কী হল! মা মরা ছেলে, নিজে বিয়ে পর্যন্ত করলাম না কোন দিন আর”।

কফি এসে গেছিল। উপমন্যুকে কফির কাপ এগিয়ে দিলেন শঙ্কর।

উপমন্যু কফিতে চুমুক দিলেন।

শঙ্কর হতাশ গলায় বললেন “টুয়েলভ পাশ করার পর লন্ডনে পড়াতে পাঠাবার ব্যাপারে সব ঠিক করলাম। নিজেই কেঁদে কেটে গেল না। শেষ মেশ আবার কলকাতায় ভর্তি করালাম। এখন শুনছি এখানে এসব ফুল ফুটিয়ে বসে আছে”।

মাথা নাড়তে নাড়তে শঙ্কর সামনে রাখা স্কচের গ্লাসটা এক চুমুকে খালি করে দিলেন। উপমন্যু বললেন “আপনি এখনই এত হতাশ হচ্ছেন কেন শঙ্করবাবু? তদন্ত চলছে এখন। হতে পারে আপনার ছেলে নির্দোষ”।

শঙ্কর বললেন “আপনি বুঝতে পারছেন না অফিসার আমার সমস্যাটা। আমি ভাবতেই পারছি না যে আমার ছেলে এসবে জড়িয়ে পড়েছে”।

উপমন্যু বললেন “বুঝতে পারছি খানিকটা…”

শঙ্কর বললেন “আমি জানি না আপনাকে ঠিক কী বলব… ইউ আর ইন্টেলিজেন্ট এনাফ…”

উপমন্যু বললেন “আপনি প্যারিস ঘুরে আসুন মিস্টার মুখোপাধ্যায়। পরে না হয় এসব নিয়ে চিন্তা করবেন”।

শঙ্কর স্থির চোখে উপমন্যুর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন “ছেলেটার দিকে একটু নজর রাখবেন অফিসার। ওর জন্য আমি মরেও শান্তি পাব না। সন্ন্যাসী আর ইঁদুরের গল্প জানেন তো আপনি?”

উপমন্যু কৌতূহলী হলেন “মানে? বুঝলাম না”।

শঙ্কর গ্লাসে নিজেই স্কচ ঢালতে ঢালতে বললেন “থাক। পরে না হয় একদিন এক্সপ্লেইন করব আপনাকে”।

উপমন্যু বললেন “আপনার স্ত্রীর বাড়ি কোথায় শঙ্করবাবু?”

শঙ্কর হাসলেন “ইউ আর ইন্টেলিজেন্ট অফিসার। ভেরি ইন্টেলিজেন্ট”।

.

।।এক দুগুণে দুই।।

বাড়ির পথ ধরেছে দেবুর গাড়ি। জানলার কাঁচ নামিয়ে চিন্তিত মুখে সিগারেট খাচ্ছিলেন উপমন্যু। দেবু বলল “কাল কিন্তু আপনি আবার ঠান্ডা লাগাবেন স্যার। কাঁচটা তুলে দিন”।

উপমন্যু শুনতে পেলেন না যেন কথাটা। দেবু গজগজ করতে লাগল।

রাত সাড়ে দশটা হয়েছে। শহরের রাস্তায় গাড়ির স্রোত কমেছে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে উপমন্যু বিড় বিড় করে বললেন “সন্ন্যাসী এবং ইঁদুরের গল্প। সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং”।

মোবাইল বের করে নোটপ্যাড খুলে লিখলেন

“নীলম- প্রথমে বলল জয়িতার সঙ্গে খুব বেশি কথা হত না। তখন বলে নি গড়পঞ্চকোটের কথা। পরে জিজ্ঞেস করতে বলল। কেন? নীলমের বয়ফ্রেন্ডের নাম রোহিত মিশ্র। ছেলেটা নীলমের স্কুলের অ্যাকাউন্টান্ট। রোহিতের সঙ্গে কাল কথা বলতে হবে।

শঙ্কর মুখার্জি- ছেলেকে নিয়ে খুশি নন। কোথাও যেন বলতে চাইলেন ছেলে মায়ের মত হয়েছে। কেন? শঙ্কর মুখার্জির স্ত্রীর সম্পর্কে ডিটেলস চাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

অনীশ মুখার্জি- ইয়ং স্কাউন্ড্রেল। ভেবেছে বাবার টাকা থাকলে যা ইচ্ছে করা যায়। গড়পঞ্চকোটে জয়িতার মুখ থেকে জয়িতার প্রেগন্যান্সির কথা শুনে বুঝে উঠতে পারে নি কী করতে হবে। তবে গড়পঞ্চকোটের পরেও জয়িতার চাকরি যায় নি।

আসিফ-রুহি – আসিফকে জয়িতা যেখানে সেখানে জড়িয়ে ধরত, ব্যাপারটা রুহির অপছন্দ ছিল। জয়িতার অ্যাবরশন এদের দুজনের সাহায্যে হয়েছে। কোথায়, কীভাবে হয়েছে? বের করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

বিনয়-কৃষ্ণা- জয়িতার রোজগার বিনয়বাবুর দরকার ছিল। কিন্তু মেয়ে সম্পর্কে কি দুজনেই কম প্রোটেক্টিভ ছিলেন? মা বাবা মেয়ের পিজি মালিককে ফোন করে মেয়েকে ট্র্যাক করার চেষ্টা করবে না? এত বিশ্বাস কি করা যায়?? মেয়ে রাত করে ফিরলে দুজনের কারোই কোন আপত্তি ছিল না?

লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট- জয়িতার অনেক বয়ফ্রেন্ড ছিল (?)। শরীর সম্পর্কে ছুতমার্গ ছিল না (?)। কিন্তু জয়িতাকে কে প্রেগন্যান্ট করেছিল? তমালিকা বললেন জয়িতার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে কিছু জানতেন না। বিশ্বাস হল না। হোয়াটস অ্যাপে রুহিকে জাস্ট একবার বলা ছাড়া জয়িতা তার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে কাউকে কিচ্ছু বলে নি। তার মানে কি যে জয়িতাকে প্রেগন্যান্ট করেছিল সে ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপ কিছুই ইউজ করত না? মিডল এজড কেউ? বিশ্বজিৎবাবু?”

বিশ্বজিৎবাবুর নামটা লিখে সে দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন উপমন্যু। গাড়ি তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। উপমন্যু গাড়ি থেকে নেমে দেবুকে বললেন “কাল সকাল আটটায় আসবি”।

দেবু বলল “ঠিক আছে”।

গাড়ি বেরিয়ে গেল।

উপমন্যু কলিং বেল টিপলেন। তাতান দরজা খুলে রাগী গলায় বলল “বাবা, ক’টা বাজে দেখেছ?”

উপমন্যু হাসলেন “দেখেছি। কী করব বল। এই তো চাকরি”।

তাতান ঠোঁট উলটে বলল “ছাতার চাকরি। কখন ফিরবে কোন ঠিক নেই”।

উপমন্যু বললেন “গীজার চালানো আছে?”

তাতান বলল “হ্যাঁ। দেরী কোর না বেশি। খেয়ে নিও”।

উপমন্যু টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। মিনিট দশেক ধরে স্নান করে চেঞ্জ করে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলেন। পিয়ালী ভাত বাড়ছিলেন। তাকে দেখে গজগজ করতে করতে বললেন “একেকদিন একেকরকম কর। কাল পা না ধুয়েই খেতে বসে পড়ছিলে, আজ আবার দশ মিনিট ধরে স্নান করলে। কী ব্যাপার বল তো? কী হয়েছে?”

উপমন্যু ভাতে হাত দিয়ে বললেন “কী আর হবে। যা হয়। পুরো চাপ চলছে”।

তাতান বাবার পাশে বসে আগ্রহী গলায় বলল “বল বল, কেসটা শুনি”।

পিয়ালী রাগী গলায় বললেন “একদম না। এসব শুনবি তারপরে পরীক্ষায় গোল্লা খাবি। তুমি কিন্তু একদম তাতানকে কিছু বলবে না”।

তাতান বলল “হ্যাঁ, আমার কী? নেটফ্লিক্সে ক্রাইম সিরিজ দেখে নেব। দরকার কী আমার রিয়েল কেস শোনার?”

উপমন্যু হেসে ফেললেন। পিয়ালী বললেন “কী ফিক্স?”

তাতান জিভ কেটে বলল “ও কিছু না। আচ্ছা বাবা, শোন না, বলছি, ফোনটা রিকভার করার পর কী কী জানা গেল?”

উপমন্যু আড় চোখে পিয়ালীর অগ্নিমূর্তি দেখে নিয়ে মেয়েকে বললেন “সেরকম কিছু না। তুই এসব নিয়ে ভাবিস না। দেখছিস না তোর মা কী রেগে যাচ্ছে?”

তাতান বলল “আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে। সেরকম কিছু নেই বলছ? আচ্ছা, একটাই ফোন ছিল? আর কোন ফোন ছিল না তো?”

উপমন্যু চমকে উঠলেন। খাওয়া থামিয়ে তাতানের দিকে তাকালেন।

।। পূর্বকথা- সন্ন্যাসী ও ইঁদুরের উপাখ্যান।।

১৯৮৫। এপ্রিল মাস।

রমলাদের বাড়ির গলি সংকীর্ণ। ড্রেনের গন্ধও আছে। রমলাই বলেছিল শনিবার রাতে বাবা মা থাকবেন। তখন কথা বলতে। রাস্তার মুখে একটা ছোট বাচ্চা দাঁড়িয়ে ছিল শঙ্করকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

শঙ্কর বাচ্চাটার পেছন পেছন অনেকটা যাওয়ার পর একটা ছোট বাড়ির দরজার সামনে এসে বাচ্চাটা চলে গেল।

রমলা দরজা খুললেন। বললেন “এসো”।

শঙ্কর বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন।

বাড়ি বলতে ছোট একটা ঘর।

শঙ্কর বললেন “বাবা মা কোথায়?”

রমলা বললেন “দুজনেই বেরিয়েছে। এসে পড়বে কিছুক্ষণ পরে। কেন? তোমার অসুবিধে হচ্ছে আমাদের বস্তিতে?”

শঙ্কর হাসলেন “না না, তা কেন? সেসব কিছু না”।

রমলা বললেন “তোমার বাড়ি থেকে এ বিয়ে মানবেন না, বল?”

শঙ্কর বললেন “বিয়েটা তো আমার বাড়ির লোক করবে না। আমি করব। তুমি কেন খামোখা এটা নিয়ে চিন্তা করছ বল তো?”

রমলা শঙ্কিত মুখে বললেন “আমার সত্যিই চিন্তা হয় আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে। তুমি বনেদী বাড়ির ছেলে। আমার মত মেয়েকে…”

শঙ্কর বললেন “কেন? তোমার মত মেয়ে আবার কী?” শঙ্কর রমলার হাত ধরে নিজের কাছে টানলেন “দেখো রমা, আমাদের মধ্যে যা আছে সেটা আমাকে বুঝে নিতে দাও”।

রমলা বললেন “কিন্তু আমার যে তোমাকে দেওয়ার মত কিছু নেই”।

শঙ্কর আবেগে ভাসলেন “আমার তোমাকে ছাড়া কিছু প্রয়োজনও নেই যে”।

রমলা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় বেশ কয়েক জন লোক ঘরে প্রবেশ করল। রমলা শঙ্করকে ছেড়ে দূরে গিয়ে বসলেন। একজন এসে শঙ্করকে সোফা থেকে তুলে কলার চেপে ধরে উত্তেজিত গলায় বলল “এত বড় সাহস। আমাদের বস্তির মেয়েকে ফুসলানো হচ্ছে?”

শঙ্কর অবাক চোখে রমলার দিকে তাকালেন। রমলা কোন কথা না বলে মাথা নিচু করলেন।

শঙ্কর বিস্মিত গলায় বললেন “রমা তুমি কিছু বল। ওদের বল যে আমি তোমার বাবা মার সঙ্গে কথা বলতেই এসেছি”।

রমলা এবারেও নিরুত্তর রইলেন।

রমলার মা কোন কারণ ছাড়াই চিৎকার করে পাড়া মাথায় করলেন। পাড়ার বেশ কিছু মহিলাও এল। ব্যাপারটা এমনভাবে প্রচার হল যেন রমলাকে একা পেয়ে শঙ্কর জোর করে কিছু করতে গেছিলেন।

 কিছুক্ষণের মধ্যে বিচার সভা বসল। এলাকার এক নেতাও এল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হল শঙ্করকে রমলাকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে হবে। শঙ্করকে কিছু বলার সুযোগও দেওয়া হল না। পাড়ার কালিমন্দিরে নিয়ে গিয়ে দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল।

বিয়ের পরে একটা ঘরে দুজনকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল।

শঙ্কর এতক্ষণ পরে প্রশ্নটা আবার করলেন “এত সব করার কি কোন প্রয়োজন ছিল রমা? আমি তো তোমাকে বিয়ে করব বলে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই নিয়েছিলাম”।

রমলা কেঁদে ফেলে বললেন “বিশ্বাস কর, আমার বাবা মা যখন থেকে শুনেছে আমাদের ব্যাপারটা, এই ফন্দি বের করেছে। আমি অনেক বুঝিয়েও ওদের বোঝাতে পারি নি যে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। ওদের ধারণা তুমি আমার সঙ্গে দুদিন ফূর্তি করে আমায় ছেড়ে দেবে। শুধু এই জন্য ওরা তোমাকে ডেকে নিয়ে এই ট্র্যাপটা বানিয়েছিল। আমাকে ক্ষমা করে দিও তুমি। আমার সত্যিই কিছু করার ছিল না”।

শঙ্কর তেতো গলায় বললেন “সে তো বুঝতেই পারছি, ব্যাপারটা কেন করা হল। কিন্তু এতটা বোধ হয় না করলেও চলত। এত নীচ মানসিকতা আমি ভাবতেও পারি নি। যাই হোক রমা, আমি গোটা ব্যাপারটা সামলে নেব আমার বাড়িতে। কিন্তু, তোমাকেও একটা কথা দিতে হবে আমাকে”।

রমলা শঙ্করের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

শঙ্কর বললেন “কাল তোমাকে নিয়ে আমি আমার বাড়ি যাব। সব ম্যানেজও করব। কিন্তু তুমি কোন দিন তোমার বাপের বাড়ির কারো সঙ্গে কোন যোগাযোগ করতে পারবে না। বল তুমি রাজি?”

রমলা কোন কিছু না ভেবে শঙ্করের কথার উত্তরে বললেন “রাজি”।

উপমন্যু অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন সাড়ে ছ’টার। উঠে স্নান সেরে তৈরি হয়ে রায়কে ফোন করলেন।

রায় ফোনটার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন, ধরে বললেন “বলুন স্যার”।

উপমন্যু বললেন “দেবুকে আটটায় আসতে বলেছি। তুমি ফোর্স নিয়ে তৈরি থেকো। আমি বেরিয়ে ফোন করব”।

রায় বললেন “শিওর স্যার”।

পিয়ালী উঠে পড়েছিলেন।

উপমন্যু বললেন “পাউরুটি আছে?”

পিয়ালী বললেন “হ্যাঁ। টোস্ট করে দেব?”

উপমন্যু বললেন “হ্যাঁ। আরেকটা অমলেটও করে দিও”।

পিয়ালী বললেন “ওকে”।

উপমন্যু নিজের ঘরে ঢুকলেন।

জয়িতার চ্যাট হিস্ট্রির প্রিন্ট আউটগুলো মন দিয়ে কিছুক্ষণ দেখার পরে একটা পকেট ডায়েরীতে বেশ কয়েকটা নাম লিখলেন।

কিছুক্ষণ পরে পিয়ালী ডাকলেন “খেতে এসো”।

উপমন্যু ডায়েরীটা পকেটে ঢুকিয়ে ডাইনিং রুমে এলেন।

পিয়ালী বললেন “তাতান নেক্সট উইকে কলেজ এক্সকারসানে যাবে বলছিল”।

উপমন্যু খেতে খেতে বললেন “কোথায়?”

পিয়ালী বললেন “ব্যান্ডেলে”।

উপমন্যু বললেন “যাক। আমি ট্র্যাক করব”।

পিয়ালী বললেন “সব সময় এভাবে নজর রাখাটা মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না? একটা সময় তো ছেড়ে দিতেই হবে। মেয়ের বিয়ে হলে কী করবে?”

উপমন্যু অমলেট হাত দিয়ে ছিঁড়ে খেতে খেতে বললেন, “বিয়ের পরেও ট্র্যাক করব। কোথায় একটা দেখলাম খবর বেরিয়েছে মেয়েকে মেরেছে বলে জামাইকে পিটিয়েছে মেয়ের বাবা। আমি ওই ধরণের শ্বশুর হতে চাই”।

পিয়ালী হেসে ফেলে বললেন “আর যখন আমরা মরে যাব?”

উপমন্যু বললেন “ভূত হয়ে ঘাড়ে চাপব যে আমাদের মেয়ের কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তার”।

পিয়ালী মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন “পারোও বটে”।

উপমন্যু বললেন “পারার কিছু নেই। করতে হবে। সময় সেটা করতে বলছে। কিছু করার নেই আমার”।

পিয়ালী বললেন “নিজের মেয়ের ওপর ভরসা করবে না”?

উপমন্যু বললেন “একশো বার ভরসা করব, কিন্তু কোন কোন সময় আসে যখন ভরসা করলেও মেয়ে সেই জায়গায় থাকে না। আমি তো তোমাকে বললাম এটা সময়ের দাবী। আমার কিছু করার নেই। আমাদের ছোটবেলায় তুমি রেশন আনতে যেতে না? বাজার করতে না? ওই নক্সাল আমলেও আমাদের অ্যাটলিস্ট মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হয় নি। সময় পাল্টেছে জঘন্যভাবে। এখন আমাদের হাতে সবটা নেই। লোকজনের হাতে কাজ নেই, বেকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, পারভারটেড মানুষজনের সংখ্যা বাড়ছে। এই অবস্থায় কী করে সবটা ওইটুকু মেয়ের ওপর চাপিয়ে দিই বল?”

পিয়ালী শ্বাস ছেড়ে বললেন “আচ্ছা বুঝলাম। একই কথা বার বার বলতে হবে না। বরং নিজে চেষ্টা কর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে মেয়েটাকে একটু সময় দিতে। এত ন্যাওটা মেয়ে তোমার অথচ সময় দাও কোথায়?”

উপমন্যুর খাওয়া হয়ে গেছিল। টেবিল থেকে উঠে বললেন “তুমি তো জানো এক্ষেত্রে আমার চাকরির জন্য আমি অপারগ। যেদিন রিটায়ার করব, সারাদিন তোমাদের সঙ্গেই তো কাটাব। চিন্তা করছ কেন”?

পিয়ালী বললেন “হু তাহলেই হয়েছে। ওই আশাতেই তো সারাজীবন কাটিয়ে ফেললাম”।

দেবুর গাড়ির হর্ন শোনা গেল।

উপমন্যু ব্যস্ত হয়ে বললেন “দেবু এসে গেছে, আমি বেরলাম”।

পিয়ালী বললেন “সাবধানে যেও। আর পারলে তাড়াতাড়ি ফিরো”।

হাত মুখ ধুয়ে জুতো পরে বেরলেন।

গাড়িতে উঠতে দেবু জিজ্ঞেস করল “কোথায় যাব?”

উপমন্যু বললেন “বড় বাজার চ”।

দেবু অ্যাক্সিলেটরে পা দিল।

উপমন্যু রায়কে ফোন করে বড়বাজারে “দ্য হোপ” ক্লিনিকে আসতে বলে দিলেন।

ঘন্টাখানেক পরেই দ্য হোপ ক্লিনিকের সামনে দুটো গাড়ি এসে দাঁড়াল।

রায়কে নিয়ে উপমন্যু ক্লিনিকের ভেতরে প্রবেশ করলেন।

বেশ কয়েকজন রুগী সকাল থেকেই বসে ছিল।

উপমন্যু রিসেপশনে গিয়ে নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বললেন “একটা অ্যাবরশন কেসের হিস্ট্রি জানতে এসেছি”।

রিসেপশনে বসে থাকা মেয়েটির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে বলল “স্যার একটু অপেক্ষা করুন আমি আমাদের স্যারকে পাঠাচ্ছি”।

তারা সোফায় বসলেন। কিছুক্ষণ পরেই এক মাড়োয়াড়ি ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে এসে উপমন্যুর সামনে ভয়ার্ত গলায় বললেন “স্যার আমার মনে হয় আপনার কোন ভুল হয়েছে। এই ক্লিনিকে কোন অ্যাবরশন হয় না। উ তো ইল্লিগাল হে স্যার”।

উপমন্যু ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন “যেটা চাইছি সেটা দিন। নইলে এখানে ঠিক কী কী লিগাল কাজ চলে সেটা নিয়া আমাকে রিপোর্ট নিতে হবে।

ভদ্রলোক দিশেহারা ভঙ্গিতে উপমন্যুর দিকে তাকালেন।

পূর্বকথা- সন্ন্যাসী এবং ইঁদুরের উপাখ্যান

.

১৯৯৯। বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলছে।

নার্সিং হোমে ভিজিটিঙ আওয়ার শুরু হবে একটু পরেই। রমলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন শঙ্কর। তাদের প্রথম সন্তান হয়েছে বিয়ের চোদ্দ বছর পরে। স্বভাবতই শঙ্করের আনন্দের সীমা নেই।

পাঁচটার সময় ভিজিটিং আওয়ার শুরু হবে, ঘড়িতে চারটে পঁয়তাল্লিশ বাজে। শঙ্কর অধৈর্যের মত বার বার ঘড়ি দেখছিলেন এমন সময় দেখলেন রমলার বাবা মা সহ তিন চারজন হাজির হয়েছেন।

শঙ্করের চোয়াল শক্ত হল। বিয়ের এতদিন পেরিয়ে গেছে তাদের তবু সেদিনের জোর করে বিয়ে দেওয়াটা তিনি এখনও ভুলতে পারে নি।

রমলার মা-ই এগিয়ে এসে তাকে হাসিমুখে বললেন “খবরটা পেয়ে আর বাড়িতে বসে থাকতে পারলাম না বাবা। চলে এলাম”।

শঙ্কর চোখ মুখ শক্ত করে বললেন “আপনাদের এখানে না এলেই ভাল হত”।

রমলার মা দাঁত বের করে বললেন “তা বললে কী হয় বাবা? ছেলে যেমন তোমার হয়েছে, আমাদেরও তো নাতি হয়েছে। নাতির প্রতি আমাদেরও তো দাবী দাওয়া আছে নাকি?”

শঙ্কর দেখলেন নার্সিং হোমের সবাই কৌতূহলী চোখে তাদের দেখছে। তিনি ঠিক করলেন এখানে কোন রকম সীন ক্রিয়েট করবেন না। শুধু নার্সিং হোমের ম্যানেজমেন্টের একজনকে জানালেন রমলার পরিবারের লোকজনকে যেন নার্সিং হোম থেকে বের করে দেওয়া হয়।

কিন্তু কিছুই করা হল না। ওরা জানাল কাউকে এভাবে নার্সিং হোম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যায় না। বেশ রাগ নিয়ে শঙ্কর রমলার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।

রমলাকে কেবিনে দেওয়া হয়েছিল। তাকে দেখে হাসিমুখে বললেন “ছেলেকে দেখলে?”

শঙ্কর গম্ভীর গলায় বললেন “হ্যাঁ দেখেছি। তোমার বাবা মাকে কে খবর দিয়েছে? তুমি?”

রমলা খানিকটা সংকুচিত হয়ে বললেন “হ্যাঁ। পারি নি গো শেষ অবধি। এই খবর কি না দিয়ে পারা যায়?”

শঙ্কর গম্ভীর হয়েই বসে রইলেন। রমলা এক’বছরে স্বামীর ধাত বুঝে গেছিলেন। শঙ্করকে বেশি ঘাটালেন না। শঙ্কর বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে অফিসে গেলেন। অস্ট্রেলিয়ার একটা কোম্পানির সঙ্গে কোলাবরেশনের কথা হচ্ছিল তাদের সঙ্গে মিটিং করলেন অনেক রাত অবধি।

মাঝরাতে বাড়ি এসে স্কচের বোতল নিয়ে বসলেন কিছুক্ষণ। মাথা জ্বলছিল তার। কিছুতেই সেদিনটার কথা ভুলতে পারছিলেন না যেদিন অকারণ ট্র্যাপে ফেলে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। তার আরও রাগ হচ্ছিল এই ভেবে যে রমলা তার বাপের বাড়ির সঙ্গে তার অনেক বারণ সত্ত্বেও যোগাযোগ রেখেছে।

ছোটবেলায় পড়া সন্ন্যাসী এবং ইঁদুরের গল্প মনে পড়ে গেল শঙ্করের। এক সন্ন্যাসী একটি ইঁদুরকে একটি মেয়েতে রূপান্তরিত করে তাকে কন্যাস্নেহে বড় করে তোলেন। সে কন্যা যখন বিবাহযোগ্যা হয় তখন সন্ন্যাসী কন্যাকে বলেন নিজের জন্য পাত্র খুঁজতে। সব কিছু শেষে সে কন্যার ইঁদুরকেই পছন্দ হয়। সন্ন্যাসী বুঝতে পারেন আসলে যার জন্ম যেখানে, সে সেখানেই নিজেকে খুঁজে পেতে পছন্দ করে।

শঙ্করের বারে বারে মনে হচ্ছিল, আসলে রমলা হলেন সেই ইঁদুর যে সব কিছুর পরেও নিজের শেকড় ভুলতে পারে নি। রাতের সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করের এই সন্দেহও দৃঢ় হচ্ছিল যে, হয়ত সেদিন তার জন্য তৈরী করে রাখা ফাঁদে রমলারও সমান হাত ছিল।

পর দিন সকালে তার বাড়িতে একটা ফোন আসল। জানা গেল রাতে কোন এক অজ্ঞাত কারণে তার স্ত্রী শ্রীমতী রমলা মুখোপাধ্যায়ের অতিরিক্ত রক্তপাতজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে। পুরো ব্যাপারটাকে শঙ্কর যথেষ্ট শোকের সঙ্গেই সামলান এবং সব কিছুর শেষে সদ্যোজাত পুত্র অনীশকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাড়ির দারোয়ান চাকরদের পরিষ্কার নির্দেশ দিয়ে দেন, কোন ভাবেই যেন রমলার বাপের বাড়ির লোক তার বাড়িতে প্রবেশ না করতে পারে।

এর মধ্যে একদিন রমলার বাবা সত্যি সত্যিই তাদের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। বৃদ্ধকে রীতিমত লাঠিপেটা করে তাদের চত্বর থেকে তাড়ানো হয়।

রমলার মৃত্যুর পরে অনেকেই উঠে পড়ে লাগেন শঙ্করের আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু শঙ্কর কোনদিনই সে প্রস্তাবে কখনও রাজি হন নি।

ছেলে এবং অফিস ছাড়া বাকি জীবনটা শঙ্কর আর কোন কিছুর ওপরেই সময় নষ্ট করেন নি।

.

বাড়িতে সুশান্তবাবু একাই ছিলেন। উপমন্যু বেল টেপার মিনিট দশেক পরে এলেন।

উপমন্যু এবং ইন্সপেক্টর রায়কে দেখে বললেন “ওহ আপনারা? আসুন অফিসার”।

উপমন্যু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন “অত্যন্ত দুঃখিত সুশান্তবাবু। বুঝতেই পারছেন তদন্তের প্রয়োজনে একটু বিরক্ত করতে হল। আশা করি কিছু মনে করবেন না”।

সুশান্তবাবু বললেন “ছি ছি, কী যে বলেন। এত বড় একটা কান্ড হয়ে গেল, আমাদের দায়ও তো খানিকটা থেকে যায়। আপনি এসব বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না”।

উপমন্যু হেসে বললেন “আপনি যথার্থ ভদ্রলোক সুশান্তবাবু। আমরা এসেছি জয়িতার ঘরটা আরো একবার সার্চ করতে”।

সুশান্তবাবু বললেন “নিশ্চয়ই। ঘরটা তো আপনারা সিল করে দিয়ে গেছিলেন। আমি নিচে আছি। কোন প্রয়োজন হলে বলবেন”।

উপমন্যু বললেন “নিশ্চয়ই”।

রায়কে নিয়ে উপমন্যু দোতলায় জয়িতার ঘরের সামনে গেলেন। ইন্সপেক্টর রায় দরজার সিল খুলে দিলেন।

উপমন্যু ঘরের ভেতর ঢুকে আলো জ্বেলে রায়কে বললেন “আমি আশা করব জয়িতার আরেকটি মোবাইলের সূত্র এই ঘরেই কোথাও লুকিয়ে আছে রায়। চলুন শুরু করা যাক”।

রায় বললেন “সারটেনলি”।

ঘরের মশারি এর আগের দিন উপমন্যু গুছিয়ে রেখেছিলেন। খাটের নিচে অজস্র জিনিস। খাটের ওপর এক্সাম প্রিপারেশন বইটা খোলা।

উপমন্যু অস্ফূটে বললেন “এস আর জি ইনফোটেক থেকে বেরনোর শেষ চেষ্টা ছিল?”

রায় বললেন “কিছু বললেন?”

উপমন্যু বললেন “হু। দ্য গার্ল ওয়াজ ট্রাইং টু কুইট হার জব। সম্ভবত দ্যাট বাস্টার্ড অনীশের জ্বালাতনেই”।

রায় বললেন “ওই কি খুন করতে পারে?”

উপমন্যু মাথা নেড়ে বললেন “এখন অবধি কোন কংক্রিট প্রুফ নেই কোন কিছুরই। সন্দেহের ভিত্তিতে কিছু করা সম্ভব না র‍য়। তার থেকেও বড় কথা এত বড় ইনসিডেন্টে কোন রকম ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায় নি। এটাও একটা আশ্চর্যের ব্যাপার। যাই হোক…”

উপমন্যু বইটা হাতে তুললেন। আনমনে এ পাতা সে পাতা উলটে আবার খাটের ওপর রেখে দিলেন।

রায় খাটের তলায় উকি দিয়ে খানিকক্ষণ দেখেই বেরিয়ে এসে হাঁচি দিয়ে নাকে রুমাল দিয়ে বললেন “এখানে কিচ্ছু নেই”।

উপমন্যু বললেন “ঠিক আছে, আপনি আরেকবার এই ছোট আলমারিটাও দেখুন”।

ঘরের কোণে একটা ছোট স্টিলের আলমারি। রায় সেটা খুললেন। একগাদা জামাকাপড় ডাই করে রাখা। রায় বললেন “মেয়েটা খুব আগোছালো ছিল স্যার”।

উপমন্যু বললেন “হু। সে তো দেখতেই পাচ্ছি। প্লাগে পয়েন্টে একটা মাত্র ফোন চার্জার আছে দেখতে পাচ্ছি। তাহলে কি আর কোন ফোন নেই?”

রায় বললেন “আপনি কি ধরেই নিচ্ছেন দুটো ফোন ছিল মেয়েটার”?

উপমন্যু রায়ের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন “থাকা তো উচিত ছিল। আজকালকার ছেলেমেয়েদের দুটো করে ফোন…। ওহ… আমি তো ভুলেই গেছিলাম।”

উপমন্যু পকেট থেকে ফোন বের করে বিনয়বাবুকে ফোন করলেন। ফোন বেশ কয়েকবার রিং হবার পর বিনয়বাবু ফোনটা ধরলেন। উপমন্যু বললেন “বিনয়বাবু, আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করে এসেছিলাম। চিনতে পারছেন আশা করি”।

বিনয়বাবু একটু থমকে বললেন “হ্যাঁ অফিসার, বুঝেছি। বলুন”।

উপমন্যু বললেন “আপনার মেয়ের ক’টা ফোন ছিল বিনয়বাবু?”

বিনয়বাবু বললেন “মানে?”

উপমন্যু বললেন “মানে আজকালকার দিনের ছেলেমেয়েদের তো দুটো করে ফোন থাকে আজকাল। তা আপনার মেয়ের কি একটাই ফোন ছিল?”

বিনয়বাবু বললেন “হ্যাঁ। একটাই ছিল। তবে দুটো নাম্বার ছিল”।

উপমন্যু হতাশ হয়ে বললেন “সে দুটো আমাদের কাছে আছে। ঠিক আছে রাখছি”।

ফোনটা কেটে উপমন্যু কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে তাতানকে ফোন করলেন। তাতান ফোন কেটে দিল। উপমন্যু অধৈর্য হয়ে আবার করলেন। এবার তাতান ধরল।

উপমন্যু বিরক্ত গলায় বললেন “কী রে ফোন কেটে দিচ্ছিস কেন”?

তাতান বলল “ক্লাস করছি তো! কী যে কর না তুমি বাবা!”

উপমন্যু লজ্জিত হয়ে বললেন “ওহ সরি সরি। ভুলেই গেছিলাম”।

তাতান বলল “বল বল শিগগির। বেরিয়েছি ক্লাস থেকে। কথা শেষ হলেই আবার ক্লাসে ঢুকব”।

উপমন্যু বললেন “আচ্ছা, একটা ফোনে দুটো সিম আছে তো। মেয়েটার দুটো ফোন ছিল না”।

তাতান বলল “ওহ। এটা বলার জন্য ফোন করলে?”

উপমন্যু অন্যমনস্ক গলায় বললেন “হ্যাঁ। ঠিক আছে। আমার হিসেবগুলো মিলছে না। ঠিক আছে। রাখছি রে এখন। ক্লাসে যা”।

তাতান বলল “বাড়ি ফিরো তাড়াতাড়ি”।

উপমন্যু বললেন “হ্যাঁ হ্যাঁ। যা ক্লাসে”।

ফোন রেখে উপমন্যু হতাশ গলায় রায়কে বললেন “চলুন। আমি বরং অফিস যাই। আরেকটু ভাবি কেসটা নিয়ে। আপনি ঘরটা সিল করে দিন আবার”।

রায় বললেন “ঠিক আছে। চলুন”।

উপমন্যু আরও কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে খাটের ওপর থেকে এক্সাম প্রিপারেশন বইটা নিয়ে বললেন “চলুন, যাওয়া যাক”।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *