সন্ধ্যা হল

সন্ধ্যা হল

প্রতি মাসে একবার করে আমাদের মহিলা সমিতি বসে শনিবার সন্ধ্যাবেলায়। সেদিন হিসাবপত্র দেখা হয়, কাজ গুছোনো হয়, একটু চাও খাওয়া হয় আর এনতার গল্পগুজব হয়। এক একদিন ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়, কারো কিছু গাড়িঘোড়া নেই, দূরও নয়, যে যার দরকার মতো উঠে পড়ে। আবার এক একদিন কেউ একা বাড়ি ফিরতে চায় না। সব গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে পথ চলে সেদিন। মহিলা সমিতির সেজপিসিমার হাতে সুতো, কাপড় ইত্যাদির ভার থাকে, তার হিসেব সব সময় মেলাতে পারেন না, মিস মল্লিকের সঙ্গে তাই নিয়ে কত সময় কথা কাটাকাটিও হয় দু’চার মাস কথাও বন্ধ থাকে। তারপর সেজপিসিমা আবার ঘুসঘুসে জ্বরে পড়েন, নিজের একতলা ঘরখানিতে একা শুয়ে থাকেন। মিস মল্লিক সন্ধ্যাবেলায় হাঁড়িমুখ করে, হাতে এক শিশি লাল কাচের মতো পেয়ারার জেলি নিয়ে সেজপিসিমাকে দেখতে যান, দু’জনায় খানিক কাঁদাকাটিও করেন। পরের শনিবার দু’জনা পাশাপাশি বসেন, সবাই একটু মুখ টিপে হাসে। তাতে ওঁদের কিছু এসে যায় না। একদিন মেজপিসিমা বললেন, “ভূতে বিশ্বাস করি কি করি না এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না, কারণ বললেই তো ভূত কেন হতে পারে না, তোরা তার একশো রকম প্রমাণ এনে দিবি। কিন্তু পথেঘাটে ট্রামেবাসে এই যে হাজার হাজার মানুষ দেখিস, এরা কি সবাই জ্যান্ত মানুষ বলতে চাস নাকি? তবেই তো হয়েছিল! যেটুকু চাল ডাল পাওয়া যাচ্ছে তাও উঠে যেত।”

আমাদের করবী বললে, “জ্যান্ত মানুষ নয় তো কী তারা, সেজপিসিমা।”

সেজপিসিমা বিরক্ত হয়ে বললেন, “বলেছি তো এ বিষয় কিছু বলতে চাই না। কিন্তু আমাদের সেন্টারের নুটুকে জানিস তো, তাঁতের সুতোর ব্যবস্থা করতে গেছিল ডালহৌসি, ফিরতে সে কী দেরী। বিকেলে ওখানকার ট্রামেবাসে কী হয় জানিসই তো। যেন থিক্ থিক্ পোকা ধরে যায়। কোথায় ক্যান্টিন ম্যান্টিনে চা খেয়ে, কে চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, মোট কথা মেলা দেরী হয়ে গেল। শেষটা ট্রামস্টপে এসে দেখে পথঘাট ভোঁভাঁ, গাড়িঘোড়া জনমনিষ্যি নেই। কেন যেন গা ছমছম করতে লাগল। ওসব অঞ্চল কী পুরনো আর সেকালে ওখানে কী না বীভৎস কাণ্ড হয়ে হয়ে গেছে, কে না জানে। এমন সময় দুটো লোক এসে একেবারে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ভয়ে তো নুটুর প্রাণ উড়ে গেল। ঠিক সেই সময় অন্ধকার থেকে একগাদা কাগজপত্র বগলে নিয়ে তিনজন বুড়ি মেম বেরিয়ে এসে নুটুর সঙ্গ নিল। মিশনারি মেম, ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। তাদের দেখেই লোক দুটি চোঁচাঁ দৌড় মারল। মেমরা বলল, এরকম নির্জনে একলা দাঁড়িয়ে থাক কেন, তোমাদের হিন্দুদের বুদ্ধির বহর দেখে আশ্চর্য হতে হয়। নুটুর একটু বিরক্ত লাগলেও, ত্রাণকর্ত্রীদের চটানোটা ভালো বলে মনে করল না। ওরা ওকে বলল, চল তোমাকে মোড় অবধি এগিয়ে দিই। একটু আগেই লোকজন গাড়িটাড়ি সব পাবে। তারপর সমস্ত রাস্তা খ্রিস্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে করতে ওরা ওকে এগিয়ে নিয়ে চলল। বলল, তোমরা তোমাদের মরাদের ভগবানের হাতে ছেড়ে দিতে ভয় পাও, মলে পর নিশ্চিন্ত হতে পার না, বছরে বছরে আবার নতুন করে শ্রাদ্ধ কর, ছিঃ! মরা আগলাতে লজ্জা করে না! ততক্ষণে ওরা মোড়ের মাথায় পৌঁছে গেছে, আলো, লোকজন, ট্রাম সব নাগালের মধ্যে এসে গেছে, নুটুরও সাহস বেড়ে গেছে। সে বললে, যাও, যাও আর বোলো না, আমরা মরা আগলাই না আরও কিছু। আমরাই বরং পুড়িয়ে ঝুড়িয়ে ছাইগুলোকে পর্যন্ত জল দিয়ে ধুয়ে সাফ করে দিই। তোমরাই মরাদের ছেড়ে দিতে পারো না, সাজিয়ে গুছিয়ে, বাক্সবন্দী করে, যত্ন করে মাটিতে পুঁতে, তার উপর থাম্বা গেড়ে, তার উপর ফুল রাখো— বলতে বলতে ট্রাম আসছে কিনা দেখবার জন্য একটু মুখ ঘুরিয়েছি কী, অমনি ফিরে দেখি তিনটে মেমই অদৃশ্য! কোথায় গেল তারা? থুড়থুড়ে বুড়ি, এমন নয় যে তর্কে কোণঠাসা হয়ে টেনে দৌড় মারবে, তাছাড়া সোজা পথ, দু’দিকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। গেল কোথায়?”

রমাদি বললেন, “হ্যাঁ, ওরা তর্ক সইতে পারে না শুনেছি।”

করবী কিছু বলল না। মিস মল্লিক প্রমাণ সাইজ পাঞ্জাবিটার পকেট লাগানো পরীক্ষা করতে করতে বললেন, “তা তো বটেই। নেই বলে প্রমাণ দিলেই তো আর নেই হয় না। প্রমাণের কী-ই বা দাম বল। অবিশ্যি খ্রিস্টানদের সম্বন্ধে নুটুদি যা বলেছিলেন তার সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না, কারণ আমাদের খ্রিস্টান ধর্মে মানুষের দেহটাকে অত প্রাধান্য দেওয়া হয় না, সে থাকল কি গেল, তাতে কারো কিছু এসে যায় না, থাম্বা গাড়া কি ফুল দেওয়াটেওয়া কিছু নয়, আত্মাটাই হল সব। তবে যিশুকেই সব আত্মার গতি করে দিতে হবে, এও তো কম আবদার নয়! আর ইচ্ছে হলে তারা ফিরবে না-ই না কেন? জায়গা জুড়ে থাকছে না, খাচ্ছে-দাচ্ছে না—”

মিস্ মল্লিকের ছোট বোন বিন্দু মল্লিকের চার কাঁটায় মোজা বোনার অনেকগুলো ঘর পড়ে একেবারে দু’তিন লাইন নেমে গেছিল বলে, এতক্ষণ সে আলোচনায় যোগ দেয়নি। তবে সেও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। সমাদ্দার মাসিমার ক্রুশকাঁটা চেয়ে নিয়ে, সে ঘরগুলিকে বুনে কাঁটায় তুলে, নিরাপত্তার জন্য আর এক ঘর বুনে নিয়ে, তারপর সমাদ্দার মাসিমাকে ক্রুশ কাঁটা ফিরিয়ে দিয়ে বললে, “খবরদার না বোলো না— কিছু মনে করলেন না তো মাসিমা, এতক্ষণ আটকে রাখলাম বলে?” এতক্ষণ ধরে লেস বোনার সুতোর ফাঁস আঙুলে পরিয়ে বসে থেকে থেকে, আসলে সমাদ্দার মাসিমা খুবই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন, যারা চারটে বিলিতি কাঁটা কিনে এত বোনাবুনি করতে পারে, তারা কি একটা প্লাস্টিকের ক্রুশ কাঁটাও কিনে রাখতে পারে না? আর ক্রুশকাঁটা কেন, মাথার কাঁটা দিয়েও তো বুদ্ধি থাকলে পড়া ঘর তুলে নেওয়া যায়। তবু সে বিষয় কিছু উত্থাপন না করে অসহিষ্ণুভাবে বললেন, “আহা, কী বলছিলে তাই বলল না। খায়-দায় না কী যেন?”

বিন্দু মল্লিক তিন কাঁটার সব ক’টি ঘর এক জায়গায় জড়ো করে এনে, তার চারদিকে দু’ ফাঁস উল জড়িয়ে— বলা তো যায় না, আবার পড়তে কতক্ষণ— মোজাটাকে কোলের উপর নামিয়ে বললে, “একেবারে যে কখনই খায়-দায় না— ও কী, লিলিদি, অমন শিউরে ওঠার মতো কিছু হয়নি— কী বলছিলাম, হ্যাঁ, একেবারে যে কখনই খায়-দায় না তাও বলা যায় না।”

লিলিদি সমিতির সেজপিসিমার আর একটু কাছে ঘেঁষে বললেন, “যা বলবার চটপট বলেই ফেল না রে, বাপু, ওরকম আধখ্যাঁচড়া বললে যে গায়ে কাঁটা দেয়। ও, অপু, আচ্ছা, বারান্দার আলোটা আজ জ্বালিসনি কেন বল দিকিনি? যা, সুইচটা নামিয়ে দিয়ে আয় তো।”

অপু বললে, “ওবাবা! আমি পারব না।”

বিন্দু মল্লিক বললে, “গল্পটা শুনবে, না শুনবে না।”

“না না, তুমি বল।”

“আমার ঠাকুমার কাছে শোনা বুঝলে; মিথ্যে হবার জো নেই। ঠাকুমার শাশুড়ি ছিলেন যাকে বলে দজ্জাল মেয়েমানুষ। তিন তিনটা বউমা আর তিন আইবুড়ো মেয়েকে দীর্ঘকাল জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেয়ে, শেষটা হার্টের রোগে ধরল। কিন্তু হলে হবে কী, যেই না অবস্থা সঙ্গীন হয়ে আসে, মেয়ে বৌরা হাসিমুখে এ ওর দিকে তাকাতে শুরু করে, অমনি দু’এক ফোঁটা ওষুধ খেয়ে আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। ওদের কপালে আর সুখ লেখা ছিল না। এমনি সময় একদিন দারুণ জলঝড়ের রাতে শাশুড়ির শরীরটা একটু খারাপ বোধ হওয়াতে মহা হাঁকডাক লাগালেন, যাও এক্ষুনি ডাক্তার ডেকে আনো, পাড়ার ডাক্তারের অসুখ তো হালসিবাগানে কে নতুন ডাক্তার বসেছেন তাকেই আনো। শেষ পর্যন্ত বড় বৌ ওই দুর্যোগ মাথায় করেই ডাক্তার আনতে গেল। খানিকবাদে ডাক্তারও এলেন, কালো পোষাক, কালো ব্যাগ নিয়ে। দেখে শুনে ওষুধ দিলেন, ব্যাগ থেকে বের করে ছোট্ট সাদা একটা বড়ি। শাশুড়ি মহা খুশি, দে ওঁকে চা দে, কী কেকটেক করেছিস আমাকে লুকিয়ে, তাই দে ওঁকে। ডাক্তারও কেকের খুব তারিফ করলেন, ঐ এক চিমটি নুনও দিয়ে দেবেন গোলার সঙ্গে, দেখবেন আরো হালকা হবে। আরেকটু চিনি পেতে পারি কি চায়ে? শেষ চুমুকটি খেয়ে ডাক্তার উঠছেন আর শাশুড়িও খাবি খেতে শুরু করেছেন। ঠিক সেই সময় বড় বৌমা চুপ্পুড় ভিজে হালসিবাগানের ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে এসে হাজির। হৈ-চৈ। আগের ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে লজ্জিত হেসে বললেন, ভুল ওষুধ দিয়েছিলাম কি না। বলেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আরে উনি তবে কে? ও আবার কী কথা? সঙ্গে সঙ্গে এরাও দু-চার জনা বেরিয়ে এলেন, কিন্তু সিঁড়ির মাথায় কিংবা সিঁড়িতে কোথাও জনমানুষ নেই।” বিন্দু মল্লিক আবার বোনাটা তুলে নিল।

করবী মাথায় ঝাঁকি দিয়ে বলল, “ও আবার কী ভূতের গল্প হোল? ও হয়তো একটু দুষ্টু লোক, কী একটা পাগল ছিল। কিংবা ওই মেয়ে বৌদের কেউই হয়তো ওকে ভাড়া করে এনেছিল। শাশুড়িকে সাবাড় করবার জন্য।”

মিস মল্লিক শুকনো গলায় বললেন, “সে তোমার যা ইচ্ছে মনে করতে পারো কিন্তু আমরা খ্রিস্টানরা ধর্মে বিশ্বাস করি আর ঐ দারুণ জলঝড়ের মধ্যে দিয়ে এলেও লোকটার কাপড়চোপড় ছিল খটখটে শুকনো। নীচে দরওয়ান ছিল, সে কাকেও গাড়ি করে আসতেও দেখেনি, বেরুতেও দেখেনি। তোমরা বিশ্বাস কর না কিছু; ওই জন্যই আমি কিছু বলিনি, বিন্দুটার সবটাতেই বেশি বেশি।” বিন্দু মল্লিক তাই শুনে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল।

সবাই করবীর উপর রাগ করতে লাগল। সেজপিসিমা বললেন, “আমার দাদা খুব রাত করে ট্রামে বাড়ি ফিরছেন, এমন সময় কালীতলার মোড়ে চেক চেক আলোয়ান গায়ে দিয়ে একটা লোক উঠে দাদার পাশে বসল। তার সারা গায়ে ন্যাপথালিনের গন্ধ। চোখ দুটো ঢুলুঢুলু। টিকিটের পয়সা চাইলে দিল বের করে একটা এই বড় মহারানি ভিক্টোরিয়ার টাকা। কন্ডাক্টারও তা কিছুতেই নেবে না, ওর কাছেও আর কিছু নেই। শেষটা দাদাই ওর ভাড়া ঢুকিয়ে দিলেন। হেদোর মোড়ে দাদাও নামলেন সেও নামল। নেমেই বলল, দাঁড়ান, এইখানেই আমি থাকি, পয়সাটা না দিলেই নয়, কারো কাছে ঋণী থাকতে হয় না।

এই বলে পাশেই একটা গলির মধ্যে ঢুকে গেল, আবার তখুনি ফিরে এসে দাদার হাতে চারটে পয়সা গুঁজে দিয়েই মিলিয়ে গেল, সে তোমরা বিশ্বাস করো আর নাই করো। দাদা একরকম ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে দেখেন সে পয়লাগুলোও মহারানী ভিক্টোরিয়ার আমলের ভারী পয়সা।”

করবী আবার বলল, “আহা, মহারানী ভিক্টোরিয়ার মুখ দেওয়া কত পয়সা তো এমনি চলে। তাছাড়া পয়সারও ভূত হয় বলতে চান?”

সেজপিসিমা কোনো উত্তর না দিয়ে সুতোর লচ্ছির গিট খুলতে লাগলেন।

লিলিদিও হঠাৎ উঠে এসে একেবারে আসরের মাঝখানে বসে বললেন, “তোমরা তো আমার মাসিমাকে চেনো? এযে যাঁর সঙ্গে আমি থাকি। ওঁর যখন প্রথম ছেলে হয় কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে সাহাদের যে ওই বিরাট বাড়িতে দুটো ঘর নিয়ে থাকেন ওঁরা। স্বামীটা তো একটা লক্ষ্মীছাড়া, কোনোদিন রাত বারোটায় বাড়ি ফিরল আবার কোনোদিন হয়তো ফিরলই না। ছেলেটার একবার দারুণ জ্বর, মাসিমার নিজেরও জ্বর, তিনদিন স্বামীর দেখা নেই, কে কাকে দেখে তার ঠিক নেই। ভাবছেন না খেয়ে বুঝি মরতে হবে, এমনি সময় দরজায় কড়া নেড়ে— ই-ইক টুপ করে সমিতি ঘরের আলোটা নিভে গেল।

ওরকম হামেসাই আলো নেভে, পুরোন সব তার, কথায় কথায় ফিউজ হয়। তবু কীরকম যেন মনে হয়। সেজপিসিমা হাতড়ে হাতড়ে সেলাইকলের দেরাজ থেকে মোমবাতির টুকরো বের করেন, প্যান্ট সেলাইতে মোটা জোড়ার জায়গাতে মোম না ঘসে দিলে ছুঁচ উতরোয় না, তাই সর্বদা মোমবাতি মজুত থাকে। টিমটিম করে আলো, যে যার ব্যাগ থলি চটি খুঁজে নিয়ে একসঙ্গে উঠে পড়েন। সভা ভঙ্গ হয়, করবী সেজপিসির সঙ্গে বাড়ি যায়। কী জানি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *