ব্যথা বড়ো বাজিয়াছে প্রাণে , সন্ধ্যা তুই ধীরে ধীরে আয়! কাছে আয় — আরো কাছে আয় — সঙ্গীহারা হৃদয় আমার তোর বুকে লুকাইতে চায় । আমার ব্যথার তুই ব্যথী , তুই মোর একমাত্র সাথী , সন্ধ্যা তুই আমার আলয় , তোরে আমি বড়ো ভালবাসি — সারাদিন ঘুরে ঘুরে ঘুরে তোর কোলে ঘুমাইতে আসি , তোর কাছে ফেলি রে নিশ্বাস , তোর কাছে কহি মনোকথা , তোর কাছে করি প্রসারিত প্রাণের নিভৃত নীরবতা । তোর গান শুনিতে শুনিতে তোর তারা গুনিতে গুনিতে , নয়ন মুদিয়া আসে মোর , হৃদয় হইয়া আসে ভোর — স্বপন-গোধূলিময় প্রাণ হারায় প্রাণের মাঝে তোর! একটি কথাও নাই মুখে , চেয়ে শুধু রোস মুখপানে অনিমেষ আনত নয়ানে । ধীরে শুধু ফেলিস নিশ্বাস , ধীরে শুধু কানে কানে গাস ঘুম-পাড়াবার মৃদু গান , কোমল কমল কর দিয়ে ঢেকে শুধু দিস দুনয়ান , ভুলে যাই সকল যাতনা জুড়াইয়া আসে মোর প্রাণ! তাই তোরে ডাকি একবার সঙ্গীহারা হৃদয় আমার , তোর বুকে লুকাইয়া মাথা তোর কোলে ঘুমাইতে চায় , সন্ধ্যা তুই ধীরে ধীরে আয় । আঁধার আঁচল দিয়ে তোর আমার দুখেরে ঢেকে রাখ , বল তারে ঘুমাইতে বল কপালেতে হাতখানি রাখ , জগতেরে ক ' রে দে আড়াল , কোলাহল করিয়া দে দূর — দুখেরে কোলেতে করে নিয়ে র ' চে দে নিভৃত অন্তঃপুর । তা হলে সে কাঁদিবে বসিয়া , কল্পনার খেলেনা গড়িবে , খেলিয়া আপন মনে কাঁদিয়া কাঁদিয়া , শেষে আপনি সে ঘুমায়ে পড়িবে । আয় সন্ধ্যা ধীরে ধীরে আয় , হাতে লয়ে স্বপনের ডালা গুন্ গুন্ মন্ত্র পড়ি পড়ি গাঁথিয়া দে স্বপনের মালা , জড়ায়ে দে আমার মাথায় , স্নেহ-হস্ত বুলায়ে দে গায়! স্রোতস্বিনী ঘুমঘোরে , গাবে কুলু কুলু করে ঘুমেতে জড়িত আধো গান , ঝিল্লিরা ধরিবে একতান , দিনশ্রমে শ্রান্ত বায়ু গৃহমুখে যেতে যেতে গান গাবে অতি মৃদু স্বরে , পদশব্দ শুনি তার তন্দ্রা ভাঙি লতা পাতা ভর্ৎ সনা করিবে মরমরে । ভাঙা ভাঙা গানগুলি মিলিয়া হৃদয়-মাঝে মিশে যাবে স্বপনের সাথে , নানাবিধ রূপ ধরি ভ্রমিয়া বেড়াবে তারা , হৃদয়ের গুহাতে গুহাতে! আয় সন্ধ্যা ধীরে ধীরে আয় , আন তোর স্বর্ণ মেঘজাল , পশ্চিমের সুবর্ণ প্রাঙ্গণে খেলিবি মেঘের ইন্দ্রজাল! ওই তোর ভাঙা মেঘগুলি , হৃদয়ের খেলেনা আমার , ওইগুলি কোলে করে নিয়ে সাধ যায় খেলি অনিবার । ওই তোর জলদের ' পর বাঁধি আমি কত শত ঘর! সাধ যায় হোথায় লুটাই , অস্তগামী রবির মতন , লুটায়ে লুটায়ে পড়ি শেষে সাগরের ওই প্রান্তদেশে তরল কনক নিকেতন! ছোটো ছোটো ওই তারাগুলি , ডাকে মোরে আঁখি-পাতা খুলি । স্নেহময় আঁখিগুলি যেন আছে শুধু মোর পথ চেয়ে , সন্ধ্যার আঁধারে বসি বসি কহে যেন গান গেয়ে গেয়ে , ‘ কবে তুমি আসিবে হেথায় অন্ধকার নিভৃত-নিলয়ে , জগতের অতি প্রান্তদেশে প্রদীপটি রেখেছি জ্বালায়ে! বিজনেতে রয়েছি বসিয়া কবে তুমি আসিবে হেথায়! ' সন্ধ্যা হলে মোর মুখ চেয়ে তারাগুলি এই গান গায়! আয় সন্ধ্যা ধীরে ধীরে আয় , জগতের নয়ন ঢেকে দে — আঁধার আঁচল পেতে দিয়ে কোলেতে মাথাটি রেখে দে!