সন্ধ্যানীড়

সন্ধ্যানীড়

আমার বন্ধু শিশিরের ওই এক রোগ, যখন-তখন যার-তার সঙ্গে পায়ে পা তুলে ঝগড়া বাধিয়ে বসে। সেইজন্য ওকে নিয়ে পথেঘাটে বেরোতে আমার ভয় লাগে। তা সেবার হল কি, আমাদেরই এক বন্ধু শিলদায় থাকে, হঠাৎ করে তার বোনের বিয়ের ঠিক হয়ে গেলে সেই উপলক্ষে আমাদেরও যেতে হল ঝাড়গ্রামে।

ইস্পাত এক্সপ্রেস তখন সবে চালু হয়েছে। সকাল ছ’টা দশে ট্রেন। তাড়াহুড়ো করে প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই দেখি ট্রেন আসছে।

স্টেশনে এসে টিকিট কেটে শিশির তো লাফাতে লাফাতে বলল, “যেভাবেই হোক জানলার ধারে একটা সিট আমাদের চাই।”

কিন্তু চাই বললেই তো হল না। রিজার্ভেশন নেই। আগে উঠে জায়গা দখল করতে পারলে তবেই না! তা সেইভাবেই ওঠা হল। শিশির করল কি, গাড়িতে ওঠার আগেই জানলা গলিয়ে সাইডের সিটে একটা রুমাল ফেলে দিয়েছিল। তারপর গাড়িতে উঠে অন্য এক সহযাত্রী সেখানে বসতে যেতেই তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওই সিটে আমাকে বসিয়ে

আমার পাশে নিজেও বসে পড়ল। ব্যস কেলেঙ্কারির চরম। সেই নিয়ে তো হাতাহাতি

হওয়ার উপক্রম। অবশেষে ওই সহযাত্রীকে শিশিরের বিক্রমের কাছে হার মানতেই হল। ট্রেন ছাড়ল যথাসময়ে। সেই সহযাত্রী, যিনি আমাদের আগে উঠে জায়গার দখল নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তিনি অনবরত গজগজ করতে লাগলেন। অন্যান্য সহযাত্রীরাও বললেন, “না না, এইভাবে রুমাল পেতে সিট রাখা যায় না।”

শিশিরও ছাড়বার পাত্র নয়। বলল, “কেন যায় না মশাই? সবাই রাখে। ক’জনকে দেখতে চান?”

“কাউকেই দেখতে চাই না। কিন্তু ওটা নিয়ম নয়।”

“আরে রাখুন তো মশাই নিয়ম। বেশি নিয়মকানুন দেখালে পর পর লাইন দিয়ে ট্রেনে উঠতে হয়। এই ভদ্রলোক তো আমাকে ঠেলে সরিয়ে আমার আগে উঠলেন। তখন কোথায় ছিলেন আপনারা?”

অবশেষে আমিই বিবাদের অবসান ঘটাতে জানলার ধার থেকে সরে এসে ভদ্রলোককে বললাম, “নিন দাদা, আপনিই বসুন। আমার জানলার ধারে না বসলেও চলবে।”

ওম শান্তি। ভদ্রলোক অন্য সিট থেকে সরে এসে গুছিয়ে বসলেন জানলার ধারে। কিন্তু ততক্ষণে শিশির তো আমার ওপর রেগে আগুন, তেলে বেগুন। বলল, “এটা কী করলি তুই? যে জায়গার জন্য এত ঝগড়াঝাঁটি করলাম, তুই কিনা বদান্যতা দেখিয়ে সেই জায়গাটা ওঁকেই ছেড়ে দিলি? এতে আমার কতটা অপমান হল একবার ভেবে দেখলি

না?”

আমি হেসে বললাম, “আরে মান-অপমানের কী আছে এতে? সবাই যখন অপছন্দ করছেন, তখন দিলামই না হয় সিটটা ছেড়ে।”

শিশির বলল, “বাঃ বন্ধু! বেশ বেশ।” বলে রাগে ফুলতে লাগল। তারপর খড়্গপুর এলে আমাকে বসিয়ে রেখে প্ল্যাটফর্মে নেমে ভাল চা এক ভাঁড় আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমার টিকিটটা আমাকে দে তো।”

“কেন, কী করবি? এখনই ছেড়ে দেবে ট্রেন, উঠে আয়।”

“যা বলছি তাই কর। তাড়াতাড়ি দে।”

অগত্যা একটা টিকিট ওর হাতে দিলাম।

নড়ে উঠল ট্রেন।

শিশির বলল, “তুই যা। আমি যাচ্ছি না। আমার মুড খারাপ হয়ে গেছে। আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।”

মুড আমারও খারাপ হয়ে গেল। এমন যে হবে তা কেই-বা জানত?

যথাসময়ে ঝাড়গ্রাম এলে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম আমি। এবং নামার সঙ্গে-সঙ্গেই স্থির করলাম, বন্ধুর বোনের বিয়ে যখন কাল, তখন আজ আর সেখানে না গিয়ে এখানেই কোনও একটা হোটেলে উঠে চারদিক একটু ভাল করে ঘুরে বেড়িয়ে নিই।

এই ভেবে স্টেশন সংলগ্ন দু-একটি লজে গেলাম আশ্রয় নিতে। কিন্তু কোনওটিই আমার মনের মতো না হওয়ায় যখন কী করব ভাবছি তখনই একজন বলল, “খুব ভাল জায়গায় যদি থাকতে চান তা হলে আপনি সন্ধ্যানীড়-এ চলে যান।”

“সন্ধ্যানীড়টা কোথায়?”

“ঝাড়গ্রামের শেষপ্রান্তে। মনোরম পরিবেশ। ওর চেয়ে ভাল জায়গা আর হয় না।”

তার কথামতো অনেকটা পথ হেঁটে চমৎকার একটি নবনির্মিত বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই সন্ধ্যানীড়। গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম এক প্রবীণ ভদ্রলোক খাতা পেন নিয়ে বসে আছেন। আমি যেতেই অভ্যর্থনা করলেন, “আসুন আসুন, ঘর নেবেন?”

বললাম, “হ্যাঁ। সিঙ্গল রুম একটা চাই।”

“আপনার নাম-ঠিকানাটা লিখে দিন। পঞ্চাশ টাকা জমা করুন।”

আমি তাই করলাম। অমনই এক রূপবতী বিবাহিতা তরুণী একমুখ হাসি নিয়ে পরিচিতজনের মতো এসে বলল, “আসুন।”

আমি তাকেই অনুস করলাম।

বাড়ির পেছনে বাগানের দিকে একা থাকার মতো ছোট্ট একটা ঘর দেখিয়ে তরুণী বলল, “এই ঘর পছন্দ আপনার?”

সত্যিকথা বলতে কি, এইখানকার পরিবেশটাই আমার পছন্দ। তার ওপর একার জন্য এমন একটি ঘর তো দারুণ লোভনীয়। বললাম, “এই ঘরই আমার পছন্দ।” বলে ঘরে ঢুকেই বললাম, “আঃ, কী সুন্দর গন্ধ। কীসের গন্ধ বলুন তো?”

“হাস্নুহানার। সারারাত আমোদে ভরিয়ে দেবে আপনাকে। ক’দিন থাকবেন?” “ঠিক নেই। এখানকার পরিবেশ দেখে আমি এমনই মুগ্ধ যে, এই জায়গা ছেড়ে আর কোথাও যাওয়ার কথা আমি ভাবতেও পারছি না।”

“বেশ তো, থাকুন না এখানে কিছুদিন। পরে সময় পেলে মাঝেমধ্যে চলে আসবেন।” “এই ঘরের ভাড়া কত?”

‘বেশি নয়, পঁচিশ টাকা। কুড়ি টাকার ঘরও আছে।”

“থাকুক, এই ঘরই আমার পছন্দ।”

“থ্যাঙ্কস।”

অ্যাটাচড বাথ নয়, কমন। তা হোক, এই লজে গেস্টও কেউ নেই। কাজেই কোনও অসুবিধে হবে না। ঘর থেকে বেরোলেই বাথরুম। পাশেই বাগানে নানারকমের গাছগাছালির শোভা। ফুলগাছও রয়েছে অনেক।

আমি বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতেই তরুণী আবার মিষ্টি হাসির মাধুর্য ছড়িয়ে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকল।

এই সময় চায়ের একটু সত্যি প্রয়োজন ছিল আমার। ভাবছিলাম বাইরে কোথাও গিয়ে খেয়ে আসব। তার জায়গায় মেঘ না চাইতেই জল। বললাম, “আপনি কি অন্তর্যামী? সত্যিসত্যিই এখন আমার খুব চা খেতে ইচ্ছে করছিল।”

তরুণী বলল, “বাঃ রে! হোটেল চালাই আর যা-ই করি, আমিও তো একজন গৃহবধূ। অতদূর থেকে ট্রেন জার্নি করে এসেছেন, এখন একটু চা খাবেন বইকী! তাই নিয়ে এলাম। দুপুরে কী খাবেন বলুন? মাছ, মাংস না ডিম?”

আমি বললাম, “যদি মাছ-মাংস খাই?”

“তা হলে বলুন খাসি না মুরগি?”

“মুরগি।”

“ঠিক বেলা বারোটায় পেয়ে যাবেন। চা খেয়ে ততক্ষণ একটু আশপাশ থেকে ঘুরে আসুন।”

আমি তাই করলাম। চা খেয়ে চায়ের কাপটা দরজার বাইরে রেখে ঘরে তালা দিয়ে বেড়াতে চললাম। ভাগ্যে শিশিরটা সঙ্গে আসেনি। এলে সব মাটি করে দিত। প্রথমত, ওই তরুণীকে দেখে এই লজে তো উঠতই না। তার ওপর রসবোধ না থাকায় কথাটি বলতে দিত না কারও সঙ্গে। বিশেষ করে কোনও মেয়ের সঙ্গে তো নয়ই। যখনকার গল্প, তখন আমার কাঁচা বয়স। তরুণীও সুন্দরী। ফলে তার মাধুর্য আমার মনকে ভরিয়ে তুলেছিল। তবুও একটা ব্যাপার আমার কিন্তু ভাল লাগছিল না, সেটি হল তরুণীর এই আন্তরিকতা। হোটেলের যাত্রী পরিষেবার জন্য এমন এক গৃহবধূকে এগিয়ে দেওয়ায় গৃহস্থের প্রতি কারও ধারণা ভাল থাকে কী? আমার পরিবারের মধ্যে এইরকম তো আমি কল্পনাও করতে পারি না।

যাই হোক, আমি ঝাড়গ্রামের পথে পথে ঘুরে শাল ও সেগুনের বন দেখতে লাগলাম। চারদিকে লাল মাটি আর ঘন সবুজের সমারোহ দেখে মন আমার ভরে গেল। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই আমার এক পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভদ্রলোক রেলে চাকরি করেন। একসময় উনি আমাদের এলাকাতেই থাকতেন। আমায় দেখেই উল্লসিত হয়ে বললেন, “কী গো! তুমি!”

“আপনি এখানে?”

“আমি তো এখন এখানেই আছি। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?”

“কিছুই না। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি।”

“বুঝেছি। মাথার পোকাটা আবার নড়ে উঠেছে তাই না? উঠেছ কোথায়?” “সন্ধ্যানীড়ে।”

সন্ধ্যানীড়ের নাম শুনেই কেমন যেন হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে বললেন, করে সন্ধান পেলে?”

‘স্টেশনের কাছেই একজনের মুখে শুনলাম, তাই—।” “ভাল ভাল। একেবারেই ঘরোয়া পরিবেশ ওখানকার।”

আমি বললাম, “তবে ওখানকার একটা ব্যাপার আমার কিন্তু ভাল লাগছে না।”

“কোন ব্যাপারটা?”

“কোনও ভদ্রঘরের তরুণী বউকে দিয়ে এইভাবে অতিথি আপ্যায়ন করানোটা কি ঠিক?”

“না না, ঠিক নয়। তবে কি জানো, এ ছাড়া উপায়ও ছিল না ওদের। ওই সন্ধ্যামা সত্যিকারের একজন আদর্শ গৃহবধূ। অত ভাল মেয়ে হয় না। ওই যে প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখলে, উনিই ওর শ্বশুর। আগে আর্মিতে ছিলেন। ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় ওঁর দুটি পা-ই হারান উনি। ওঁর একমাত্র ছেলে জয়ন্ত বছর দুই আগে হঠাৎই নিখোঁজ। এই অবস্থায় জীবনধারণের জন্য ওই হোটেল ব্যবসা করা ছাড়া ওঁদের আর কোনও উপায় ছিল না। ঝাড়গ্রামের ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে দূরে এই বাড়িটি ওঁরা শান্তিতে বসবাসের জন্যই তৈরি করেছিলেন। এখন ওটাকেই একটু গুছিয়ে গাছিয়ে দু-একটা ঘর বাড়িয়ে যাত্রীনিবাস করে তুলেছেন। বেশি নির্জনে বলে খুব একটা লোকজনও যায় না ওখানে। দুপুরে এবং সন্ধ্যায় খাওয়ার জন্য কিছু লোক আসে। মাঝেমধ্যে চেঞ্জাররাও গিয়ে থাকেন। তবে দু-একদিন। কেউ কেউ নাকি ভয়টয়ও পান। অবশ্য এ সবই মনের ব্যাপার। তা যাক, সন্ধ্যামাই দেখাশোনা করে সবকিছুর। এমনকী অতিথিদের রুচি অনুযায়ী রান্নাবান্নাও। এক হাতে হোটেলের হাল ধরা, আর ওই প্রতিবন্ধী শ্বশুরের সেবাযত্ন করা কি কম কথা? কাজের লোক একজন আছে, সে কোনও কাজেরই না। ঘর ঝাঁট দেয় আর বাসন মাজে। এমনকী দোকানবাজার পর্যন্ত সন্ধ্যামাই করে।

আমি অভিভূত হয়ে বললাম, “তাই বুঝি?” আমি মনে মনে অন্যরকম ভাবছিলাম। ছিঃ ছিঃ।

“তোমার দোষ নেই। যারা ভেতরের ব্যাপার জানে না তারা অনেক কিছুই ভাবে।” আমি আর বেশিক্ষণ সেখানে না থেকে সন্ধ্যানীড়ে ফিরে এলাম। তরুণীর প্রতি এক বিনম্র শ্রদ্ধায় অন্তর আমার ভরে উঠল।

দুপুরে স্নানের পর তরুণী এসে মাংসভাত দিয়ে গেল। সেইসঙ্গে আলুভাজা, পাঁপড় আর চাটনি। একেবারে বাড়ির মতো রান্না। খেয়ে দারুণ তৃপ্ত হলাম। এর পর একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে গেলাম রাজবাড়ি দেখতে। তারপর সন্ধে উত্তীর্ণ হতেই আবার ফিরে এলাম।

আমি ফিরে আসায় যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তরুণী। বলল, “কী এত পথে পথে ঘুরছেন বলুন তো সেই থেকে? একে বনজঙ্গলের দেশ, তায় নির্জন জায়গা। হঠাৎ করে কোনও ভালুক-টালুক বেরিয়ে পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে যে!”

আমি হেসে বললাম, “বন্যজন্তুর কথাটা অবশ্য আমার মনে হয়নি একবারও। যাই হোক, এবার সাবধান হয়ে যাব।”

তরুণী বলল, “একটু আগে একজন যাত্রী এসেছিল। দূর করে দিয়েছি তাকে।” “সে কী! কেন?”

“মনে হল ড্রিঙ্ক করে এসেছিলেন ভদ্রলোক। মুখ থেকে গন্ধ ছাড়ছিল। আমার এখানে ওইসব হবে-টবে না।”

“বেশ করেছেন। দুষ্ট গোরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। বিশেষ করে এই সন্ধ্যানীড়ের একটা সুনাম আছে। সেটা যেন নষ্ট না হয়।”

আমি ঘরে এসে বসলে তরুণী আবার চা নিয়ে এল আমার জন্য।

আমি চায়ে চুমুক দিলে সে বলল, “রাত্রে কী খাবেন? ভাত না রুটি?” “রুটি আর মাংস।”

“না না। দু’ বেলা মাংস না। রাতে একটু আলুর দম করি। আমার হাতের আলুর দম খেয়ে দেখুন, সবাই ভাল বলে। আশা করি আপনারও ভাল লাগবে।”

“যা আপনি খাওয়াবেন, হাসিমুখ করে তাই খাব আমি।”

তরুণী আমাকে বসিয়ে রেখে সেই যে গেল, আর এল না। এল যখন, রাত দশটা। খান ছয়েক রুটি আর একবাটি আলুর দম টেবিলে রেখে বলল, “শুভরাত্রি। আজকের মতো আসি তা হলে?”

“অবশ্যই। আপনার দেরি দেখে ভাবলাম ভুলেই গেলেন বোধ হয়।”

“তাই কি পারি? আপনাদের সেবাই যে আমার ধর্ম।”

তরুণীর কথায় অন্তর প্লাবিত হয়ে গেল আমার। হাতে একটি গল্পের বই ছিল, তরুণীর হঠাৎ নজরে পড়ল সেদিকে। বইটা হাত থেকে নিয়ে নেড়েচেড়ে বলল, “কাল তো আপনি আপনার বন্ধুর বোনের বিয়েতে শিলদা যাবেন, যাওয়ার আগে বইটা দিয়ে যাবেন আমাকে? আমি সারাদিনে পড়ে শেষ করব।”

“বেশ তো, কাল কেন? আজ এখনই নিন আপনি। আমি খেয়েদেয়েই শুয়ে পড়ব। আর বই পড়ব না।”

তরুণী খুশিমনে বই নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, “বাগানের দিকের এই জানলাটা বন্ধ রাখবেন, কেমন? অন্ধকারে রাতদুপুরে লতাটতার উপদ্রব হতে পারে।” তরুণীর কথামতো জানলা বন্ধ করে খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। শোওয়ামাত্রই ঘুম।

সেই ঘুম ভাঙল মধ্যরাতে হঠাৎ একটা খস খস শব্দ শুনে। মনে হল পাশের বাগানে কে যেন পায়চারি করছে। কে? কে ওখানে? আমি শয্যাত্যাগ করে পা টিপে টিপে জানলার কাছে এসে জানলাটা ফাঁক করেই যে দৃশ্য দেখলাম তাতে সর্বাঙ্গ নীল হয়ে গেল আমার। দেখলাম বাগানের পাঁচিলের পাশে যে পেয়ারাগাছটা আছে তারই ডালে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে সন্ধ্যানীড়ের সন্ধ্যাপ্রদীপ। সেই তরুণী। চোখেমুখে কোনও বিকৃতি নেই। হাসিখুশি মিষ্টি মুখে স্থির চোখে অপলকে চেয়ে আছে আমার জানলার দিকে। সেই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠলাম আমি। এইটুকু সময়ের মধ্যে কী এমন হল যে, আত্মহননের পথ বেছে নিতে হল তরুণীকে? হঠাৎ সশব্দে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল জানলাটা। এমনভাবে বন্ধ হল যে, চেষ্টা করেও সেই জানলা আমি আর খুলতে পারলাম না। ভয়ে ভয়ে আবার এসে শয্যাগ্রহণ করলাম। সারারাত জেগেই কাটাতে হল এর পর।

ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুম ভাঙল রোদ ওঠার পর। দরজায় টক টক শব্দ শুনেই বুঝলাম নির্ঘাত পুলিশ। কিন্তু দরজা খুলেই অবাক! দেখি না চা-বিস্কুট হাতে নিয়ে হাসি হাসি মুখে তরুণী এসে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। বলল, “এ কী! এখনও ঘুমোচ্ছেন?”

আমি ভূত দ্যাখার মতো চমকে উঠলাম। আমতা আমতা করে বললাম, “না, মানে কাল রাতে প্রথমদিকে ঘুম হয়নি বলে শেষের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

“তবু ভাল।” বলে তরুণী আমার ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর চায়ের কাপ রেখে একটু রাগতস্বরেই বলল, “কাল আমি বলে গেলাম বাগানের দিকের জানলাটা খুলবেন না, ঠিক খুলেছেন দেখছি।”

আমার চোখ তখন কপালে উঠে গেছে। যে জানলাটা কাল রাত্রে আমি আর একবার চেষ্টা করেও খুলতে পারিনি, সেই জানলাটা শুধু যে খোলা আছে তাই নয়, ছিটকিনিও লাগানো আছে। আমি কোনওরকমে ঢোক গিলে বললাম, “না, মানে ইয়ে—।”

“যাক, মুখ ধুয়ে চা খেয়ে নিন। আপনি

“এখনই যাব। এবং একেবারেই।”

কি এখনই যাবেন, না খেয়েদেয়ে দুপুরে?”

আমার কথার সুরে আহত হয়ে তরুণী আমার চোখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেল ঘর থেকে।

বয়েই গেল! কাল রাতে যে দৃশ্য আমি দেখেছি তারপরে আর এখানে থাকার সাহস আমার নেই। তাই চা খেয়ে হিসেবের পাট চুকিয়ে বিদায় নিলাম। তরুণী আমার বইটি ফেরত দিতে এলে উপহার হিসেবেই বইটি দিয়ে এলাম ওকে।

শিলদায় আমাদের যে বন্ধু থাকে তার নাম অমল। আমি যাওয়ায় অমল তো দারুণ খুশি। আনন্দের আবেগে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল ও। তারপর বলল, “তুই একা কেন? শিশিরেরও তো আসবার কথা ছিল। সে কই?”

আমি তখন সব বললাম ওকে।

শুনে অমল বলল, “শিশিরটা দেখছি বরাবর একই রকম রয়ে গেল। তা যাক, তুই যে এসেছিস, এতেই আমরা খুশি হয়েছি খুব। তবে কাল সন্ধ্যানীড়ে না উঠে এখানেই চলে আসতে পারতিস। বাড়িটার একটু বদনাম আছে।”

“কীরকম?”

“রাত্রিবেলা অনেকেই নাকি অনেক কিছু দেখতে পায় ও-বাড়িতে। ভয়টয় পায়।” আমি তখন সুযোগ পেয়ে আমার অভিজ্ঞতার কথাটাও বললাম ওকে।

শুনেই শিউরে উঠল অমল। বলল, “ভাগ্য ভাল যে, বেঁচে গেছিস! ওই তরুণী নিশ্চয়ই জানত রাতের অন্ধকারে বাগানের মধ্যে ওইরকম কিছু দেখা যায়, তাই জানলাটা বন্ধ করতে বলেছিল।”

“কিন্তু এমনও কি হয়?”

“হয় কিনা জানি না। শুনতে পাই অনেক কিছুই। তবে তুই যখন দেখেছিস তখন আর অবিশ্বাস করি কী করে বল? এই প্রথম একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শুনলাম।”

এর পর সারাটা দিন বেশ ভালভাবেই কেটে গেল অমলদের বাড়িতে। বিকেল হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই লোকজনের আগমনে বাড়িটা জমজমাট হয়ে উঠল। আর ঠিক সন্ধের মুখেই মস্ত একটি পুষ্পস্তবক হাতে নিয়ে এসে হাজির হল শিশির। ওকে দেখে তো আনন্দে অধীর হয়ে উঠল সকলে। আমি কিন্তু শিশিরের চোখেমুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষণ ভাল বুঝলাম না। আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল বটে, কিন্তু একটি কথাও বলল না।

রাত্রে খেতে বসলাম দু’জনে। ফার্স্ট ব্যাচেই বসলাম। গোঁজ হয়ে বসে খুব দ্রুততার সঙ্গে যা খাওয়ার গপাগপ করে খেয়ে নিল ও। নিজের থেকে কিছু চাইল না। কিন্তু যা দেওয়া হল তা পাতে রইল না।

খেয়েদেয়ে উঠেই অমলকে বলল, “আমি চলি রে!”

‘সে কী! অতদূর থেকে এলি, একটা রাতও থাকবি না?”

“কোনও কাজের বাড়িতে রাত কাটানো আমার পোষায় না। আর কেউ যদি যেতে চায় তো আমার সঙ্গে যেতে পারে।”

কথাটা যে আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলল, তা বুঝতেই পারলাম।

অমল আমাকে ইশারা করল ওর সঙ্গে যেতে। তারপর বলল, “এখন গেলেও লাস্ট বাসটা পেয়ে যাবি হয়তো। কিন্তু রাত কাটাবি কোথায়?”

“ঝাড়গ্রামে সন্ধ্যানীড়ে একটা ঘর আমি বুক করে এসেছি। সেখানেই উঠব।” সন্ধ্যানীড়ের নাম শুনেই চমকে উঠলাম আমরা। আমার তো বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল।

অমল তখন আমার ব্যাপারটা সব খুলে বলল শিশিরকে।

শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল শিশির। বলল, “সেইজন্যই তো আরও বেশি করে যাব ওখানে। এই সমস্ত বুজরুকি আমি বিশ্বাস করি না। কিছু লোকের স্বভাবই হচ্ছে অযথা গুজব সৃষ্টি করা। আজ রাতে আমি স্বচক্ষে দেখব ওখানে কী হয়।”

অতএব অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিশিরের সঙ্গে যেতে হল আমাকে।

সন্ধ্যানীড়ে যেতেই তরুণী মৃদু হেসে বলল, “কী ব্যাপার! আবার এলেন যে?” “বাধ্য হয়েই আসতে হল আমার এই বন্ধুটির জন্য।” তরুণী হেসে গড়িয়ে পড়ল, “বন্ধু! কোথায় বন্ধু আপনার?”

আমার তখনকার অবস্থাটা আমি ঠিক কাউকেই বুঝিয়ে বলতে পারব না। কোথায় শিশির, কোথায় কে? আমি তো একা। আমার শরীরের মধ্য দিয়ে যেন একটা হিমস্রোত বয়ে গেল।

তরুণী বলল, “আপনি কি ওই ঘরেই থাকবেন? না অন্য ঘর দেব আপনাকে?” আমি কোনওরকমে বললাম, “আমি যাই।”

“আপনি যেতে চাইলেও আমি তো আপনাকে যেতে দেব না। তার চেয়ে বরং এখানেই থাকুন আপনি। একা থাকতে না চান এইখানেই বসে আমার সঙ্গে গল্প করেই রাতটা কাটিয়ে দিন।”

তরুণীর প্রস্তাবে রাজি হলাম আমি। না হওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। তার কারণ এই বাড়িতে কোনওমতেই একা থাকা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে।

দু’জনে মুখোমুখি বসলে তরুণী বলল, “আচ্ছা বলুন তো, আজ সকালে হঠাৎ আপনি মতের পরিবর্তন করে চলে গেলেন কেন? কাল রাতে আপনি কি কোনও কারণে ভয়টয় পেয়েছিলেন?”

আমি তখন রাতের ঘটনার কথা বললাম তরুণীকে।

সব শুনে তরুণীর চোখ দুটি সজল হয়ে উঠল। বলল, “আমাদের এই সন্ধ্যানীড়ে আপনিই শেষ অতিথি। খুব শিগগির আমরা এখানকার পাট তুলে দিয়ে মধুপুরে চলে যাব।” “কিন্তু কেন?”

“এইভাবে কি হোটেল ব্যবসা করা যায়? আপনিই বলুন না? এই সন্ধ্যানীড়ে আর একবার ফিরে আসতে আপনারই কি ইচ্ছে করবে?”

“তা অবশ্য ঠিক।”

“কাল রাতে যাকে আপনি দেখেছিলেন সে আর কেউ নয়, আমারই বোন। সামান্য একটা ব্যাপারে অভিমান করে ওই পেয়ারাগাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়েছিল সে। তারপরেই অত্যন্ত রহস্যময়ভাবে আমার স্বামী নিখোঁজ হয়ে যান। এদিকে এখানকার ব্যাপারস্যাপার লোকমুখে চাউর হয়ে যাওয়ায় কেউ এখানে আসেও না বড় একটা। তবুও মাঝেমধ্যে আপনার মতো কেউ হঠাৎ করে এখানে এসে পড়লে দারুণ চমকে উঠি। কেননা তারা সবাই বলে স্টেশন এলাকা থেকেই কেউ নাকি তাদের এখানে আসতে বলেছে। অথচ ওখানে আমার কোনও লোকই নেই।”

আমি বললাম, “তা না হয় হল। কিন্তু আমার সঙ্গে যে বন্ধুটি এল সে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল কী করে? ঠিক যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।”

“আপনার সঙ্গে কোনও বন্ধুই আসেননি।”

“সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু সারাটা পথ যে আমরা একসঙ্গেই এলাম।” “এবং এখান থেকে বিদায় নিলে ওই বন্ধুই আবার আপনার সঙ্গ নিতেন। সেইজন্যই আপনাকে আমি যেতে দিলাম না।”

“তা হলে কি বলতে চান আমার বন্ধুও, মানে ওরও কিছু হয়ে গেছে?”

“কী করে বলব বলুন? আপনিও যেখানে আমিও সেখানে।”

সে রাতটা তরুণীর সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে কোনওরকমে কাটিয়ে দিলাম। পরদিন সকালের ট্রেনেই ফিরে এলাম বাড়িতে। এসেই এক মর্মান্তিক সংবাদ পেলাম। আমার পাশের বাড়ির নরেশবাবু হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা গেছেন। তবে কিনা অধিকাংশ ভূতের গল্প যা হয়, এক্ষেত্রে তা হয়নি। শিশিরের আত্মা শিশিরের মধ্যেই আছে। অর্থাৎ সজ্ঞানে এবং সুস্থ শরীরেরই আছে সে। ওইদিনের ঘটনার জন্য সে নিজেই অনুতপ্ত। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, শিশিরের মতো চেহারা নিয়ে যে আমাকে দেখা দিল, সে তা হলে কে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *