সন্ধের পর, একা
মল্লিকা বেশ বুঝতে পারছিল চেঁচিয়ে কোনও লাভ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা বিকৃত চিৎকার ওর ঠোঁট চিরে বেরিয়ে আসতে চাইল। আজকের এই মুহূর্তটার জন্য ও মনে-মনে বহুবার তৈরি হয়েছে। তাতে ওর মনে হয়েছিল, বেশ শান্তভাবে ঠান্ডা মাথায় ও ব্যাপারটার মোকাবিলা করতে পারবে। কিন্তু এখন, নির্জন ঘরে, ভয়ঙ্কর মানুষটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মল্লিকার সব হিসেব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।
মোহনদাস জোয়ারদার তখন ঘরের একমাত্র দরজাটা লক করে মল্লিকার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। মেয়েটার মুখের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে, ভয় পেয়েছে। আজ পর্যন্ত মোহনদাস এমন কাউকে দেখেনি যে ভয় পায়নি। আচ্ছা-আচ্ছা সাহসী মেয়েও এই অবস্থায় ভয় পেয়েছে। অনেকে তো আবার কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। মেয়েগুলো ছিঁচকাদুনে হলে মোহনদাস তেমন মজা পায় না। বরং বিরক্ত লাগে।
‘কী, দিদিমণি, ভয় করছে? চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে?’ রীতিমতো স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন দুটো করল মোহনদাস।
মল্লিকা জোর করে মাথা নাড়ল।
মোহনদাস কী বুঝল কে জানে! হেসে বলল, ‘ভয়ের কী আছে! ভয়ের কিস্যু নেই। আমি তো তোমাকে আর খেয়ে ফেলছি না। শুধু একটু আদর করব। এ-কথা বোলো না যে, লাইফে কেউ কখনও তোমাকে আদর করেনি। তোমাদের গায়ে তো আর কিছু লেখা থাকে না—মানে, ক’জন লোক আদর করেছে তাদের নাম-ঠিকানা তো আর ট্যাক্সির মিটারের মতো তোমাদের কপালে বা…ইয়ে…বুকে লেখা হয়ে যায় না। তোমাদের বডি যদি কম্পিউটার হত তা হলে কী হত সেটা বলা মুশকিল—।’
মোহনদাস জোয়ারদার একটা গানের কলি গুনগুন করে ভাঁজতে-ভাঁজতে ঘরের বাঁ-দিকে রাখা একটা বড় সোফায় গিয়ে বসল। তার পাশের একটা ক্যাবিনেট থেকে ধীরেসুস্থে মদের বোতল, গ্লাস, আর সোডা বের করে নিল। কাজ করার ফাঁকে-ফাঁকে সে মল্লিকার দিকে আড়চোখে দেখছিল। মল্লিকা ঘরের কোণে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ হচ্ছে। একটু পরেই হয়তো জওহরলাল নেহরু রোডে জল দাঁড়িয়ে যাবে। গাড়িঘোড়া যানবাহন সব জট পাকিয়ে যাবে। বাড়ি ফেরার সময়ের কোনও ঠিক-ঠিকানা থাকবে না কারও। সুতরাং মল্লিকার আজ দেরি হওয়াটা কারও কাছেই তেমন অস্বাভাবিক বলে মনে হবে না। আর মল্লিকাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার লোক এখন তো একজনই—বুড়ি মা। অথচ গত বছরেও ওকে নিয়ে চিন্তা অথবা দুশ্চিন্তা করার দুজন মানুষ ছিল। এখন একজন আর নেই।
জওহরলাল নেহরু রোডের ওপরে মস্ত বাড়ি ব্যানার্জি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার। বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়ির ছাদের দিকে তাকাতে হলে আকাশমুখো হতে হয়, ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়। পরিভাষায় এ-ধরনের বাড়িকেই বোধহয় বলে গগনচুম্বী অট্টালিকা। এই বাড়িরই টেনথ ফ্লোরে মোহনদাস জোয়ারদারের কম্পিউটার ট্রেনিং স্কুল।
মল্লিকা এখানে রিসেপশনিস্টের চাকরিতে ঢুকেছে প্রায় একমাস। ও নিজেই একদিন চাকরির জন্য এসে হাজির হয়েছিল মোহনদাসের অফিসে। মল্লিকার যোগ্যতা ছিল তিনটি: পাস কোর্সে বি. এ. পাশ, অল্পসল্প টাইপিং-এ জ্ঞান, এবং ওর রূপযৌবন। মল্লিকা জানত, এরমধ্যে তৃতীয় যোগ্যতাটিই মোহনদাসের সবচেয়ে বেশি মনে ধরবে। কারণ, মোহনদাস জোয়ারদার সম্পর্কে খুঁটিনাটি খোঁজখবর নিয়ে তবেই মল্লিকা যেচে ওর কাছে এসেছে—ওর ফাঁদে নিজে থেকে এসে ধরা দিয়েছে। কারণ, মল্লিকার লক্ষ্য ছিল একটাই: মোহনদাস জোয়ারদারকে শায়েস্তা করা। এই জানোয়ারটা গত দেড় বছরে অন্তত চারটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। বেচারা মেয়েগুলো নিতান্ত পেটের দায়ে মোহনদাসের কাছে চাকরি করতে এসেছিল—রিসেপশনিস্টের চাকরি। লাঞ্ছিত চারজনের মধ্যে দুজন ব্যাপারটা চেপে যায়। কিন্তু বাকি দুজন পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করলেও শেষ পর্যন্ত মোহনদাসের গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত পড়েনি। পুলিশ ও উকিলের যৌথ কেরামতিতে মোহনদাস ছাড়া পেয়ে যায়।
‘আপনি…আপনি আমাকে ছেড়ে দিন…’ কথাটা বলতে গিয়ে মল্লিকার গলা কেঁপে যায়: ‘এভাবে আমার লাইফটা নষ্ট করবেন না, প্লিজ…।’
গ্লাসে চুমুক দিয়ে মোহনদাস হাসল। মেয়েটা দেখতে সত্যি সুন্দরী। আগের চারটে মেয়ের মধ্যে সুলক্ষণা নামের মেয়েটা সবচেয়ে সুন্দরী ছিল। মেয়েটা ঘটনার পর বিস্তর কান্নাকাটি করেছিল। করবেই তো! ওর বয়েস যে ছিল মাত্র উনিশ! তবে মোহনদাস ওকে দু-হাজার টাকা দিয়েছিল। বিয়ে করবে এরকম একটা বেহুদা শপথও করেছিল। এতে সুলক্ষণার কান্না থেমে গিয়েছিল। এবং মোহনদাস প্রায় দু-মাস মেয়েটাকে ভোগ করতে পেরেছিল।
এভাবেই দিব্যি চলছিল, কিন্তু কে যে সুলক্ষণার মাথায় কুমতলব ঢোকাল কে জানে! মেয়েটা হঠাৎই একদিন উধাও হয়ে গেল। তার কদিন পরেই পুলিশি ঝঞ্ঝাট, কোর্ট-কাছারি। বহু টাকা আর বুদ্ধি খরচ করে সেবার মোহনদাস পিঠ বাঁচাতে পেরেছিল।
এই মেয়েটার বয়েস হয়তো সাতাশ-আঠাশ হবে, তবে সুলক্ষণার চেয়েও সুন্দরী দেখতে, আর জিনিসও ভালো।
মল্লিকার কথার উত্তরে মোহনদাস অভয় দেওয়ার হাসি হাসল দ্বিতীয়বার। বলল, ‘কী যে বাচ্চা মেয়ের মতো কথা বলো! তোমাকে ছেড়ে দেব না-তো কি আটকে রাখব! তুমি লাইফ নষ্ট করার কথা বলছ কেন, মল্লিকা? আমরা দুজনে এই বৃষ্টির সন্ধ্যায় যদি বন্ধ ঘরে একটু বুলবুলি করি তাহলেই তোমার লাইফ নষ্ট হয়ে যাবে! আরে, দিদিমণি, লাইফ কি এতই সস্তা!’ গলাখাঁকারি দিল মোহনদাস। আর-একবার চুমুক দিল গ্লাসে। না, বেশি মদ গিললে চলবে না। তাতে শরীরের আঁকুপাঁকু ভাবটা বাড়বে, শরীরটা চাগাড় দিয়ে উঠবে—কিন্তু বেশিক্ষণ ব্যাট করা যাবে না। কিছুক্ষণ ঠুকঠুক করেই আউট। মল্লিকার সঙ্গে মোহনদাস অনেকক্ষণ তারিয়ে-তারিয়ে ব্যাট করতে চায়। এরমধ্যেই মোহনদাস বেশ বুঝতে পারছে, ওর শরীরটা অধীর হয়ে উঠেছে।
মল্লিকার চোখে এবার সত্যি-সত্যি জল এসে গেল। ভাঙা গলায় ও কোনওরকমে উচ্চারণ করল, ‘আপনি…আপনি একটা রেপিস্ট!’
মল্লিকা কী ভেবে এসেছিল, আর কী হচ্ছে! ও মন শক্ত করে এসেছিল মোকাবিলা করতে, লড়াই করতে, শোধ নিতে—অথচ এভাবে ভেঙে পড়ছে! কোনও রেপিস্টের সামনে মেয়েদের মনটাই বোধহয় আগে তছনছ হয়ে যায়, তারপর শরীর।
মোহনদাস জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, ‘মল্লিকা, তুমি বড্ড উলটোপালটা কথা বলো! ব্যাপারটা রেপ হবে কি হবে না তার সবটাই ডিপেন্ড করছে তোমার ওপরে। তুমি যদি কোনওরকম ঝামেলা না করে ব্যাপারটা ইয়ে…মানে…এনজয় করো, তা হলে সেটাকে মোটেই রেপ বলা যায় না। আর তুমি যদি ফালতু-ফালতু চিৎকার-চেঁচামেচি করো, হাত-পা ছুড়ে ঝামেলা পাকাও তা হলেও রেজাল্ট সেই একই—তবে তখন ব্যাপারটা ওই রেপ হয়ে দাঁড়াবে।’ মোহনদাস হাসল চাপা শব্দ করে: ‘এখানে যে লড়াই বা চেঁচামেচি করে বিশেষ সুবিধে হবে না সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ?’
হ্যাঁ, বেশ বুঝতে পেরেছে মল্লিকা। এই ঘরটা এই বেপরোয়া জহ্লাদটার প্রাইভেট অফিস। তবে বড্ড বেশি প্রাইভেট।
আজ সকাল থেকেই মল্লিকার মনটা কেমন করছিল। মেঘলা আকাশ, টিপটিপ বৃষ্টি, আর ঝোড়ো হাওয়া। কেন যেন ওর মনে হয়েছিল, আজই মোহনদাসের সঙ্গে মোকাবিলার দিন—অথবা, মোকাবিলার রাত। আর হলও ঠিক তাই।
পাঁচটার পর মোহনদাস জোয়ারদার একগাদা টাইপের কাজ চাপিয়ে দিয়েছে মল্লিকার ওপরে। তারপর, সাতটার সময়, যখন ক্লাস হয়ে গেল, ছাত্র-ছাত্রীরা সব চলে গেল একে-একে, তখন মোহনদাস মল্লিকাকে ওর ভেতরের প্রাইভেট অফিসে ডেকেছে ডিক্টেশান দেওয়ার জন্য। গোটা অফিসে তখন ওরা দুজন, আর দারোয়ান-কাম-সিকিওরিটি গার্ড মনোজিৎ। একটু পরেই মোহনদাস ‘একমিনিট আসছি।’ বলে উঠে গেছে এবং একমিনিট বা ষাট সেকেন্ড পূর্ণ হওয়ার আগেই ফিরে এসেছে।
মল্লিকা আন্দাজ করতে পেরেছিল, মোহনদাস মনোজিৎকে ছুটি দিয়ে এল। আর তখনই ওর বুকের ভেতরে কেউ ঢিপঢিপ করে কিল মারতে শুরু করেছিল। কিন্তু মল্লিকা ঠিক প্রকৃত অর্থে ভয় পায়নি। সেটা পেয়েছে এখন, একটু আগে। আগের চারটে মেয়ের করুণ অবস্থার কথা মল্লিকা এখন আরও ভালো করে বুঝতে পারছে। ওদের জন্য এক অদ্ভুত দুঃখ আর মমতা উথলে উঠছিল মল্লিকা মনে। এমন কী নিজের জন্যও।
ওই চারজন মেয়ের ঘটনা নিয়ে হইচই কম হয়নি। ব্যাপারটা নিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ নারী কল্যাণ-সমিতি’-ও অনেক মিটিং-মিছিল করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও সুরাহা হয়নি। মল্লিকা খবরের কাগজে এই ঘটনার প্রত্যেকটি রিপোর্ট খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পড়েছে। আর তখন থেকেই মোহনদাস জোয়ারদার নামের এই লোকটার ওপরে ওর বিজাতীয় এক রাগ আর আক্রোশ তৈরি হয়েছে। মল্লিকার তো আর কিছু হারাবার ভয়ডর নেই। সুতরাং ও সটান বেলঘরিয়ার আস্তানা থেকে একদিন চলে এসেছে রাজা রামমোহন সরণিতে, ‘পশ্চিমবঙ্গ নারী কল্যাণ সমিতি’-র ছোট্ট অফিসে। সেখানে ও দেখা করেছে সেক্রেটারি বেলা সরকারের সঙ্গে।
ড্যাম্প ধরা ঘরের দেওয়ালে টাঙানো মাতঙ্গিনী হাজরা, সরোজিনী নাইডু, মাদার টেরেজা, ইন্দিরা গান্ধী আর কিরণ বেদির ছবি। এদিকে-ওদিকে কিছু ঝান্ডা আর পোস্টার। ঘরের কোণে আঠা-রং-তুলি। দুটো বেঞ্চে দুজন মহিলা বসে রয়েছে।
বেলা সরকার একটা বড় টেবিল সামনে রেখে বসেছিলেন। তাঁর বয়েস হয়েছে, চোখে চশমা, পোড়খাওয়া মুখ, সিঁথিতে সিঁদুরের চিহ্ন নেই।
মল্লিকা ওঁর সঙ্গে গোপনে কথা বলতে চেয়েছে। সুতরাং বেলা সরকার নরম গলায় কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন দুই সদস্যাকে। ওরা সঙ্গে-সঙ্গেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। মল্লিকা বুঝতে পেরেছিল, ‘বেলাদির’ নির্দেশ সহজে অমান্য করা যায় না।
মল্লিকা নিজের আক্রোশের কথা জানিয়েছিল বেলা সরকারকে। বলেছিল, ‘দিদি, মোহনদাস জোয়ারদারকে আমি শায়েস্তা করতে চাই।’
বেলাদি অবাক হয়ে বলেছেন, ‘তুমি—তুমি কেমন করে পারবে! সমিতি থেকে লড়াই করে আমরাই কিছু করতে পারলাম না…।’
‘আমি পারব!’ জেদের গলায় বলেছে মল্লিকা।
বেলা সরকার অবাক চোখে সুন্দরী মেয়েটিকে দেখছিলেন। একে কবজায় পেলে মোহনদাস কিছুতেই ছাড়বে না—চোখের পলকে গতি করে দেবে। সুলক্ষণা নামের মেয়েটা কীভাবেই না নাস্তানাবুদ হয়েছে! এবার এই মেয়েটা হেনস্থা হতে চায়—সাধ করে!
বেলা সরকারের কোনও বারণই শোনেনি মল্লিকা। শুধু বলেছে, ‘আপনি আমাকে একটা সুযোগ দিন, প্লিজ। আপনাদের না-জানিয়েও আমি যেতে পারতাম…কিন্তু পরে যদি কোনও পুলিশি ঝঞ্ঝাট হয়, সেইজন্যে আপনাদের জানিয়ে কাজে নামতে চাই। আপনারা তখন আমার পেছনে দাঁড়াবেন। দাঁড়াবেন তো?’
মেয়েটার কথায় কী যেন ছিল। বেলা সরকার অনিচ্ছাসত্ত্বেও মত দিলেন। মল্লিকাকে ওঁর কেমন যেন চেনা-চেনা লাগছিল। কোথায় যে দেখেছেন মেয়েটার মুখ!
মল্লিকা কাজে নামার আগে আরও দু-দিন বেলাদির সঙ্গে গোপন বৈঠকে বসেছিল। তারপর সোজা মোহনদাস জোয়ারদারের দপ্তরে।
কিন্তু শায়েস্তা করতে যুদ্ধে নেমে এ কী করুণ অবস্থা মল্লিকার! বারবার বুড়ি মায়ের কথা মনে পড়ছে। চোখ ফেটে জল আসছে। বাইরে বাজ পড়ার শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠছে ও।
ভয়ার্ত চোখে মোহনদাসকে দেখল মল্লিকা। ফরসা, টিকলো নাক, মাথায় টাক, মোটা গোঁফ, গাল দুটো সামান্য ফোলা। চোখে রিমলেস চশমা। বয়েস কত হবে? বড়জোর পঁয়তাল্লিশ। দেখে কে বলবে সুশ্রী ভদ্র এই মানুষটার খোলসের ভেতরে একটা অমানুষ লুকিয়ে আছে!
মোহনদাস তখন আবার গুনগুন করে গান ধরেছে: ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়, চুনরি কে নিচে কেয়া হ্যায়…।’
সুর ভাঁজতে-ভাঁজতেই গ্লাস-বোতল ইত্যাদি আবার ক্যাবিনেটের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখল মোহনদাস। চোখ থেকে চশমা খুলে রেখে দিল ক্যাবিনেটের ওপরে। তারপর আবার এসে বসল সোফায়। গদির ওপরে হাতের চাপড় মেরে বলল, ‘এসো, আর দেরি কোরো না…তোমাকে তো আবার বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। এসো, এসো—তোমার কোনও চিন্তা নেই—এটা সোফা নয়, সোফা-কাম-বেড।’ বিশ্রীভাবে হাসল, গদিতে আলতো করে তিনটে চাপড় মেরে বলল, ‘সোফা মানে তো জানোই। আর কাম কিংবা বেডও তোমার নিশ্চয়ই জানা। কাম, কাম…ফালতু ঝামেলা কোরো না, লক্ষ্মীটি—’ সোফা থেকে উঠে আর কলকব্জা নেড়ে পিঠের গদিটাকে পেতে দিল মোহনদাস, বলল, ‘সোফার কাজ শেষ। এখন শুধু কাম আর বেডের ব্যাপার…’
হঠাৎই মল্লিকার বুকের ভেতরে সমস্তরকম ঝড়-ঝঞ্ঝা থেমে গেল। চোখের কোণে জল থাকলেও বুকের গভীরে উথালপাথাল আর নেই। সাপ যখন ছোবল মারবেই তখন আর কীসের ভয়।
প্রতিশোধের কথা মনে পড়ছিল মল্লিকার, মনে পড়ছিল ওই চারটে মেয়ের কথা। আর একটু পরেই মল্লিকা ওদের দলে যোগ দেবে। তারপর? তারপর সত্যিই কি ক্ষান্ত হবে মোহনদাস? মল্লিকা কি পারবে লোকটার বিষদাঁত ভেঙে দিতে?
মল্লিকা অবাক হয়ে দেখল, ও ধীরে-ধীরে মোহনদাসের সোফা-কাম-বেডের দিকে এগিয়ে চলেছে—সাপের চোখের টানে মুগ্ধ হয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো। তবে মল্লিকার শরীরটা এক স্থির কম্পাঙ্কে কেঁপে-কেঁপে উঠছিল। আর কান্না অথবা গোঙানির একটা আওয়াজ পা টিপে-টিপে উঠে আসতে চাইছিল গলা দিয়ে। কিন্তু মল্লিকা দাঁতে দাঁত চেপে শব্দটাকে বন্দি রেখে দিয়েছে গলার ভেতরে।
মল্লিকাকে বেশিদূর এগোতে হল না। অধীর উত্তেজিত মোহনদাস নিজেই উঠে এল সোফা-কাম-বেড থেকে। ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একেবারে জাপটে ধরল মল্লিকাকে। মল্লিকা যে সামান্য বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল সেটা বোধহয় প্রতিবর্তী ক্রিয়ার বশে। কারণ, ওর চোখে তখন কোনও দৃষ্টি ছিল না, হৃৎপিণ্ডে কোনও শব্দ ছিল না, ফুসফুসে কোনও বাতাস ছিল না। একটা কোমল মৃতদেহ যেন আত্মসমর্পণ করল মোহনদাস জোয়াদারের হাতে।
ঘরে টিউব লাইট জ্বলছিল। সেই ঝকঝকে আলোতেই মল্লিকার জামাকাপড় ধরে বেপরোয়া টানাটানি শুরু করে দিল মোহনদাস। আর একইসঙ্গে মল্লিকাকে আঁকড়ে ধরে নিয়ে চলল সোফা-কাম-বেডের দিকে। বলল, ‘রুকমিনি, রুকমিনি, শাদি কে বাদ কেয়া কেয়া হুয়া…হাঃ, হাঃ, উঁ-উঁ-উঁ—’মল্লিকার গলার খাঁজে মুখ ঘষতে-ঘষতে আরও বলল, ‘ফুল ছাড়াই ফুলশয্যা করছি বলে রাগ কোরো না, লক্ষ্মীটি…’ মোহনদাসের মুখ থেকে হুইস্কি মেশানো বাতাস বেরিয়ে এল।
মল্লিকা আর বাধা দিচ্ছিল না। ওরা পৌঁছে গেল শয্যায়। উজ্জ্বল আলোয় জীবনে এই প্রথম সম্পূর্ণ নগ্ন হল মল্লিকা। মোহনদাস নিজের পোশাক ছিঁড়ে-টিড়ে কোনওরকমে খুলে একেবারে হামলে পড়ল মল্লিকার শরীরের ওপরে।
ঘরের টিউব লাইটটা এ-দৃশ্য হয়তো বহুবার দেখেছে, কিন্তু মোহনদাসের জানোয়ারের মতো আচরণে সে-ও একবার কেঁপে উঠল। আর বাইরের বৃষ্টি যেন নিষ্ফল আক্রোশে নিজের মাথা কুটে মরতে লাগল বাইরের দেওয়ালে, জানলার শার্সিতে।
আর ঠিক তখনই অদ্ভুত কান্না একেবারে ভাসিয়ে দিল মল্লিকাকে।
মোহনদাস জোয়ারদার মল্লিকার কান্না খেয়াল করেনি। কারণ মল্লিকা কাঁদছিল প্রায় নিঃশব্দে—শুধু ওর শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠছিল। মোহনদাস অর্ধেক চোখ বোজা অবস্থায় সেটাকে মল্লিকার সুখের সংকেত বলে ভুল করল, এবং দ্বিগুণ উৎসাহে ওর আদরের তীব্রতা বাড়িয়ে দিল। ব্যাট করার আনন্দে খেলার নিয়ম-কানুনের ব্যাপারটা মোহনদাসের আর খেয়াল ছিল না।
খেলা যখন শেষ হল মল্লিকা তখনও কাঁদছে। এক অদ্ভুত টানাপোড়েন চলছিল ওর মনের ভেতরে। কাজটা কি ঠিক হল? শাস্তির পরিমাণটা পাপের তুলনায় বেশি হয়ে গেল না তো! ও চারটে অসহায় মেয়ের কথা ভাবতে চেষ্টা করল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর মন থেকে দুঃখবোধটা মুছে যাচ্ছিল না। মোহনদাস যখন ওকে ছেড়ে দিল, তখনও ওর চোখে জল।
মোহনদাস ক্লান্তভাবে নিজের পোশাক ঠিকঠাক করে নিচ্ছিল, আর সতর্ক চোখে দেখছিল মল্লিকাকে। মেয়েটা দারুণ! কিন্তু হঠাৎ করে কোনও পাগলামি করে বসবে না তো! বেশ মনে আছে, অনুশ্রী না তনুশ্রী নামের বছর পঁয়ত্রিশের মেয়েটা সবকিছু মিটে যাওয়ার পর হঠাৎই ঘরের টেবিল থেকে একটা পেন-স্ট্যান্ড তুলে নিয়ে ক্ষিপ্তের মতো আক্রমণ করেছিল মোহনদাসকে। কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি। মোহনদাস সতর্ক তো ছিলই, তা ছাড়া ওর গায়ে জোরও যথেষ্ট। প্রচণ্ড থাপ্পড়ে মেয়েটাকে কাহিল করে দিয়েছিল মোহনদাস।
কাঁদতে-কাঁদতেই শাড়ি-ব্লাউজ ইত্যাদি পরে নিল মল্লিকা। টিউব লাইটের আলোয় ওর দু-গাল অশ্রুতে চকচক করছিল।
মোহনদাস বিরক্ত জড়ানো গলায় জিগ্যেস করল, ‘কী হল, এখন আবার কাঁদছ কেন? কান্নার কী আছে?’
মল্লিকা ঠান্ডা গলায় জবাব দিল, ‘আপনার জন্যে কাঁদছি।’
বাইরে বৃষ্টির তেজ যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল পলকে। কোথাও বাজ পড়ল কান-ফাটানো শব্দে।
ব্যঙ্গের একটুকরো হাসি তেরছাভাবে ছড়িয়ে গেল মোহনদাসের মুখে: ‘কেন, হঠাৎ আমার জন্যে দুঃখু হচ্ছে কেন?’
মল্লিকা শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে নিয়ে সেটা দিয়ে চোখ-গাল মুছে বলল, ‘আপনি আর নেই বলে—।’
‘কী যে সব উলটো-পালটা কথা বলো!’ সোফা-কাম-বেড থেকে উঠে দাঁড়াল মোহনদাস জোয়ারদার। ক্যাবিনেটের ওপরে রাখা চশমাটা চোখে দিয়ে মল্লিকাকে কাছে ডাকল: ‘এসো, এদিকে এসো। আর-একটু আদর করি। তুমি খুব লক্ষ্মী মেয়ে। দেখলে তো, একটু-আধটু বুলবুলি করে তোমার লাইফ একটুও নষ্ট হয়নি! আরে বাবা, একি ঘটি-বাটি যে টোল খেয়ে যাবে!’
মল্লিকা পিছিয়ে গিয়েছিল ঘরের এককোণে রাখা একটা টেবিলের কাছে। আলোর দিকে পিঠ করে দাঁড়ানোয় ওর মুখটা আবছা দেখাচ্ছিল। মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে শক্ত গলায় মল্লিকা বলল, ‘আমি লক্ষ্মী নই—অলক্ষ্মী। তা ছাড়া আমার লাইফ বলে কিছু থাকলে তবে তো আপনি নষ্ট করবেন। তখন ভয় পেয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মতো কথা বলেছি। আসলে আমি আপনার কাছে চাকরি নিয়েছিলাম আজকের দিনটার জন্যে। আপনি যে একটার-পর-একটা মেয়ের সর্বনাশ করে যাচ্ছিলেন, সেটা রোখবার জন্যে…আর আপনাকে শায়েস্তা করার জন্যে।’
‘শায়েস্তা! আমাকে!’ বেশ জোরে হেসে উঠল মোহনদাস।
কিন্তু মল্লিকার কানে হাসিটা ফাঁপা শোনাল। ও বলল, ‘খুব খারাপ লাগছে, জানেন—’ আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নিল মল্লিকা: ‘কিন্তু কী করব! আমার তো আর কোনও উপায় ছিল না—?’
‘তুমি কী করেছ আমাকে?’ চাপা কর্কশ গলায় মোহনদাস কথা বলল।
মল্লিকা ঘাড় ঘুরিয়ে অদ্ভুত চোখে দেখল মোহনদাসকে। হেসে বলল, ‘এখনও বোঝেননি? আপনার না আই, কিউ. ভীষণ কম। এইডস-এর নাম শুনেছেন?’
মোহনদাস জোয়ারদারের চোখের সামনে গোটা ঘরটা দুলে উঠল। এইচ.আই.ভি., এইডস—কাগজে এ-নিয়ে কত লেখালেখি চলেছে গত কয়েকবছর ধরে। মেয়েটা কি সত্যি বলছে, না মিছিমিঠি ভয় দেখাচ্ছে? মোহনদাসের শরীরের ভেতরে কতকগুলো অশরীরী পোকা যেন কিলবিল করে উঠল। ও এপাশ-ওপাশ তাকাল অসহায়ভাবে। আবার বসে পড়ল সোফায়। আমতা-আমতা করে বলল, ‘তুমি…তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ। ঠাট্টা করছ।’
মল্লিকার ভীষণ স্নান করতে ইচ্ছে করছিল। মাথায় টিপটিপ ব্যথা আর গা-বমি ভাব। ও সোফায় বসে থাকা লম্পট জানোয়ারটাকে দেখছিল। ওটার দাঁত-নখ আর নেই। সব খতম। মল্লিকার কেমন যেন মায়া হল। বলল শান্ত নরম গলায়, ‘না, ভয় দেখাচ্ছি না। আপনার অবস্থাটা এখন ঠিক কীরকম জানেন? ধরুন, সাঁতার জানে না, এমন একজন লোক হাওড়া ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিল গঙ্গায়। হিসেবমতো জলে ডোবার পর কিছুক্ষণ হাবুডুবু খেয়ে তারপর লোকটা মারা যাবে। ওর ফুসফুসে বাতাসের বদলে হুহু করে ঢুকে পড়বে গঙ্গার জল। তারপর একসময় বেচারা মরবে।’
একটু থামল মল্লিকা। কপাল থেকে চুল সরাল। আয়না দেখার কোনও উপায় নেই। গলার কাছে, গালে সামান্য জ্বালা করছে। শরীরে সামান্য ব্যথা। হাতব্যাগটা রয়েছে রিসেপশান কাউন্টারের ডেস্কের মধ্যে। ওটা পেলে নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে নিত।
‘এ তো গেল ডাক্তারি হিসেব।’ মল্লিকা আবার বলতে শুরু করল। এতটা মন খুলে নিজের অসুখের কথা কাউকে বলতে পারেনি ও: ‘কিন্তু আমার হিসেব কী বলে জানেন? যে-মুহূর্তে লোকটা ব্রিজের আশ্রয় ছেড়ে শূন্যে ঝাঁপ দিয়েছে সেইমুহূর্তেই খতমের খাতায় ওর নাম উঠে গেছে। শূন্যে ভেসে থাকার সময়টুকুই ওর বিচিত্র জীবন—যা থেকেও নেই—অনেকটা মরীচিকার মতো।’
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল মল্লিকা: ‘আপনার-আমার জীবনটা এখন তাই। আমার…আমার স্বামী জাহাজে কাজ করত। কোথা থেকে, কোন বিদেশ থেকে, সে এইডস-এর জীবাণু নিয়ে এসেছিল আমি জানি না। যখন সব জানা গেল, তখন সে-ও শেষ…আর, আমিও—।’
‘মল্লিকা, এসব তুমি কী বলছ!’ শিশুর মতো অসহায় সুরে কথা বলল মোহনদাস জোয়ারদার। ওর গলার স্বরে আতঙ্ক নিশ্চিত ছাপ ফেলেছে। ও ভাবতেই পারছে না, ওর জীবনটা এখন শুধু মায়া—’আছে’ অথবা ‘নেই’, এই দুইয়ের মাঝখানে দুলছে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর পশ্চিম আকাশের লালচে আভার কথা মনে পড়ল মোহনদাসের। সেতারের তারে শেষবারের মতো টান মেরে সেতারি যখন চলে যায়, তখন সেই সুরের রেশ কী চেষ্টাই না-করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে! মোহনদাসের বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। একটু আগেই ওর জীবন কী সম্পূর্ণ ছিল! আর এখন…সব ফাঁকা!
মল্লিকা তখন আপনমনেই বিড়বিড় করে নিজের কথা বলে যাচ্ছে: ‘…আমার স্বামীর প্রথম ফ্লু মতো হয়েছিল। তারপর জ্বর, গলা ব্যথা। আর দেখতে-দেখতে, বছরখানেকের মধ্যে, সব শেষ।…কিন্তু আমি রয়ে গেলাম…হাওড়া ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেওয়া ওই মানুষটার মতো…শূন্যে…এখনও গঙ্গা ছুঁতে পারিনি।’
পায়ে-পায়ে মোহনদাসের কাছে এগিয়ে এল মল্লিকা: ‘…গত বছর কাগজে আমার ছবি বেরিয়েছিল। আপনি বোধহয় ছবিটা খেয়াল করেননি। অবশ্য কেই-বা খেয়াল করে! জানেন, অসুখটা হওয়ার পর এটা নিয়ে কত খোঁজখবর করেছি, কতবার সুইসাইড করার কথা ভেবেছি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। আমি মরে গেলে আমার বুড়িমা-টাকে যে দেখার কেউ নেই!’ হাত দিয়ে মুখ মুছে নিল মল্লিকা। এমনভাবে বারবার মুখে হাত বোলাতে লাগল যেন অদৃশ্য কতকগুলো মাছি ঘনঘন বসছে ওর মুখের ওপরে: ‘আপনি হয়তো জানেন না, এইডস ছড়ালে ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ২৬৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তাতে ছ-মাস পর্যন্ত জেল হতে পারে। আবার ২৭০ নম্বর ধারায় এ-জাতীয় রোগ ছড়ালে দু-বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে, ফাইন হতে পারে, এমন কথাও লেখা আছে।’ হাসল মল্লিকা—তেতো হাসি, বলল, ‘এসব আইনই হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, প্লেগের কথা ভেবে। তবে প্লেগের বদলে লেখা হয়েছিল বিপজ্জনক কোনও সংক্রামক অসুখ। এখন তো এইডস এসেছে…আর, প্লেগও একবার উঁকিঝুঁকি মেরে গেছে।…কিন্তু শাস্তির ভয় আমার থাকবে কী করে! ফাঁসির আসামি কখনও জেলের ভয় পায়! তা ছাড়া আমি তো আপনাকে শায়েস্তা করতে এসেছিলাম।’
হঠাৎই মোহনদাস হাউহাউ করে ভাঙা গলায় কাঁদতে শুরু করল। জড়ানো গলায় কীসব বলতে লাগল কে জানে!
মল্লিকা শাড়ি-টাড়ি ঠিকমতো গুছিয়ে নিল শেষবারের মতো। মুখে আঁচল ঘষল কয়েকবার। তারপর বলল, ‘নিন, এবার দরজা খুলে দিন…আমি বাড়ি যাব…মা চিন্তা করবে।’ একটু হেসে: ‘নাকি আপনি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন?’
আচমকা মল্লিকার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল মোহনদাস জোয়ারদার। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে-করতে টিপে ধরল মল্লিকার গলা। লোকটার মুখ থেকে জন্তুর মতো শব্দ বেরোচ্ছিল। তার সঙ্গে মদের গন্ধ।
মল্লিকা প্রাণপণে বাধা দিল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘কী ছেলেমানুষি করছেন! আপনি বুঝতে পারছেন না, আমরা দুজনে কেউই আর ঠিকমতো বেঁচে নেই। আপনি আমাকে খুন করতে চান করুন, কিন্তু তাতে কোনও লাভ নেই। একটা মড়া আর একটা মড়াকে খুন করলে কার কী আসে যায়—’ ধস্তাধস্তি করতে-করতেই হাসি পেয়ে গেল মল্লিকার। ও হেসে উঠল শব্দ করে।
মোহনদাস কেমন যেন হতভম্ব হয়ে ছেড়ে দিল মল্লিকাকে। লোকটার ফরসা মুখ নীলচে দেখাচ্ছে। আচ্ছা, প্রথম সুযোগেই কি এইচ. আই. ভি. বাসা বাঁধে শরীরে? মল্লিকার মুখের দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজল মোহনদাস। ওর শরীরের সব শক্তি কে যেন শুষে নিয়েছে। ও সম্মোহিতের মতো প্রাইভেট অফিসের দরজা খুলে দিল। ভয়ঙ্কর সুন্দরী মেয়েটা সহজ পা ফেলে বেরিয়ে গেল বাইরে। মোহনদাসকে রেখে গেল শূন্যে—হাওড়া ব্রিজ আর গঙ্গার মাঝখানে।
তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল মল্লিকা। মায়ের কথা মনে পড়ল ওর। মনে পড়ল, মোহনদাসের হাতে হেনস্থা হওয়া চারটে মেয়ের কথা। ওদের কথা ভাবতে-ভাবতে মল্লিকা নিজের ভেসে থাকা জীবনের একটা মানে খুঁজছিল।