সন্ধি-বিগ্রহ

সন্ধি-বিগ্রহ

ঘোড়সোয়ারের মতো মোটা ডালের দু’পাশে পা ঝুলাইয়া বসিয়া নিতাইবাবু গভীরভাবে চিন্তা করিতেছিলেন। ঝোঁকের মাথায় যা-হোক একটা কিছু করিয়া ফেলিবার বয়স আর তাঁহার নাই; প্রবীণ সেনাপতির মতো সব দিক দেখিয়া-শুনিয়া অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া কাজ করিতে হইবে। বিশেষত আজ ব্যাপারটা সত্যই অতিশয় ঘোরালো হইয়া উঠিয়াছে।

বহু নিম্নে বৃদ্ধ বটগাছের নিচ্ছিদ্র ছায়া মূলের চারি পাশের স্থানটিকে অন্ধকার করিয়া রাখিয়াছে, গাছের ঝুরিগুলা সারি সারি দড়ির মতো ঝুলিতেছে। বেলা মধ্যাহ্ন। নিতাইবাবু উদরের মধ্যে বৃশ্চিক দংশনের মতো একটা জ্বালা অনুভব করিলেন, বুঝিলেন তাঁহার ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছে। তিনি কামিজের পকেট দু’টা আর একবার ভাল করিয়া অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু কিছুই পাইলেন না। তুঁত ফল ও পেয়ারা যে কটা পকেটে ছিল তাহা বহু পূর্বেই নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে। চিন্তিতভাবে নিতাইবাবু উপরের দিকে চোখ তুলিয়া চাহিলেন। এতক্ষণ একটা একটানা গুঞ্জন ধ্বনি তাঁহার কর্ণে আসিতেছিল, কিন্তু মানসিক দুশ্চিন্তা হেতু তাহার কারণ তদারক করা হয় নাই। এখন দেখিলেন, তাঁহার মাথায় প্রায় দশ-বার হাত ঊর্ধ্বে একটা মোটা ডাল হইতে প্রকাণ্ড অর্ধচন্দ্রাকৃতি মৌমাছির চাক ঝুলিয়া আছে। নিতাইবাবু তাঁহার ক্ষুধার জ্বালা ও বর্তমান সমস্যা ভুলিয়া কৌতূহলীভাবে কিছুক্ষণ মৌমাছিপূর্ণ চাকটার দিকে চাহিয়া রহিলেন; তারপর অতি সন্তর্পণে দু’টা ডাল নামিয়া বসিলেন। মৌচাকের সান্নিধ্য যে নিরাপদ নয় নিতাইবাবু তাহা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দ্বারা ভালরূপ জ্ঞাত ছিলেন।

অতঃপর শাখারূঢ় নিতাইবাবু আবার গালে হাত দিয়া ভাবিতে লাগিলেন। বটগাছের পাশ দিয়া পাকা রাস্তা গিয়াছে, রাস্তার অপর পারে ঠিক বটগাছের সম্মুখেই প্রকাণ্ড হাতা-যুক্ত বাড়ির লোহার ফটক, ফটকের পাশে দরোয়ানের দেউড়ি। নিতাইবাবু যেখানে গাছের উচ্চশাখায় বসিয়া আছেন সেখান হইতে বাড়িখানা ও চতুষ্পার্শ্বের পাঁচিল-ঘেরা ভূভাগ পরিষ্কার দেখা যায়। এমন কি বাড়ি হইতে উঁচু গলায় কথা কহিলে শোনা পর্যন্ত যায়। বাড়ির মধ্যে কাহারা যাতায়াত করিতেছে তাহা পর্যবেক্ষণ করিবারও কোন অসুবিধা নাই।

কিন্তু প্রধান অসুবিধা—নিতাইবাবুর পক্ষে—এই বাড়িতে প্রবেশ করা। প্রথমত, সদরে দরোয়ান আছে, সুতরাং সেদিক দিয়া প্রবেশ করা চলিবে না। পিছনের দেওয়াল ডিঙাইয়া বাগানে ঢোকা যাইতে পারে, কিন্তু তার পর? বাড়ির ভিতর মাথা গলাইবার উপায় কি? সেখানে বিন্দি আছে, দেখিলেই ধরাইয়া দিবে, দয়ামায়া করিবে না। তা ছাড়া নিতাইবাবুর খুড়ামহাশয় স্বয়ং একটা চাবুক হাতে লইয়া বাড়িময় ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন এবং মাঝে মাঝে গর্জন ছাড়িতেছেন। তাঁহার চক্ষুকে ফাঁকি দেওয়া সহজ হইবে না। অবশ্য, কোনও রকমে একবার ঠাকুরমার কাছে গিয়া পৌঁছিতে পারিলে—

কিন্তু একটা কথা এখনো বলা হয় নাই—নিতাইবাবুর বয়ঃক্রম পূর্ণ নয় বৎসর।

অদ্য প্রাতঃকালে তিনি একটি গুরুতর দুষ্কার্য করিয়া বাড়ি হইতে প্রস্থান করিয়াছিলেন। কাল সন্ধ্যাবেলা জ্যেষ্ঠা ভগিনী একাদশবর্ষীয়া বিন্দুর সহিত তাঁহার ঝগড়া হইয়াছিল। ফলে, চিরকাল যাহা হইয়া আসিয়াছে, বিন্দি কাকা ও বাবাকে সালিশ মানিয়া মোকদ্দমা জিতিয়া গেল। ক্রুদ্ধ নিতাইবাবু তখন চুপ করিয়া রহিলেন, কিন্তু আজ সকালে শয্যা হইতে উঠিয়াই সে-পরাজয়ের ভীষণ প্রতিশোধ লইলেন। নিতাইবাবু বিন্দির সহিত এক শয্যায় শয়ন করিতেন। প্রভাতে বিন্দি ঘুম ভাঙিয়া দেখিল তাহার মাথায় খোঁপা নাই। বিহ্বলভাবে এদিক-ওদিক চাহিতে দৃষ্টি পড়িল খোঁপাটি অবিকৃত অবস্থায় সম্মুখের দেয়ালে ঘুঁটের মতো আটকাইয়া রহিয়াছে।

নিতাইবাবু নিজের কার্যের ফলাফল জানিবার জন্য আনাচে কানাচে বেড়াইতেছিলেন, বিন্দির চিল-চিৎকার কর্ণে প্রবেশ করিবামাত্র তিনি বুঝিলেন কাজটা ভাল হয় নাই, একটু বাড়াবাড়ি হইয়া গিয়াছে। তিনি নিঃশব্দে গৃহত্যাগ করিলেন।

তারপর পাড়ার এদিক-ওদিক বেড়াইয়া, জনৈক প্রতিবেশীর বাগান হইতে কিছু তুঁত ও পেয়ারা সংগ্রহ করিয়া বেলা দশটা আন্দাজ যখন দেখিলেন যে বাড়ির চাকর-বাকর তাঁহাকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছে তখন তিনি গোপনে এই বটগাছের শাখায় আশ্রয় লইয়াছেন এবং নিজে অলক্ষ্যে থাকিয়া প্রতিপক্ষের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করিতেছেন।

কিন্তু বিপদের কথা এই যে, রসদ একেবারে ফুরাইয়া গিয়াছে। খালি পেটে যুদ্ধ কতক্ষণ সম্ভব? নিতাইবাবু কল্পনার চক্ষে দেখিতে পাইলেন এই সময় কি কি খাদ্য বাড়িতে তৈয়ার হইয়াছে; তাঁহার মুখ লালসার প্রাবল্যে শীর্ণভাব ধারণ করিল। কিন্তু তিনি কোমরের কসি শক্ত করিয়া বাঁধিয়া পা দুলাইতে লাগিলেন। কারণ, কল্পনার চক্ষে ভোজ্য বস্তুর সঙ্গে সঙ্গে আর একটি জিনিস তিনি দেখিতে পাইয়াছিলেন—সেটি কাকার হাতের লিক্‌লিকে সরু চাবুকটি।

অবশ্য প্রহার বস্তুটি নিতাইবাবুর জীবনে নূতন নয়। সামান্য কিলটা চড়টার কথা ছাড়িয়া দিই, সে তো নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা, কিন্তু যাহাকে ‘সাতচোরের মার’ বলে সেইরূপ দুর্জয় প্রহারও তাঁহার ভাগ্যে বিরল নয়—প্রায়ই ঘটিয়া থাকে। বাড়ির লোকের কেমন একটা অভ্যাস হইয়া গিয়াছে, পাড়ার চতুঃসীমায় কোথাও কোনও দুর্ঘটনা ঘটিলেই সকলের সন্দেহ নিতাইবাবুর উপর আসিয়া পড়ে এবং সন্দেহটা যথার্থ কি অলীক তাহা নিরাকরণ হইবার পূর্বেই তাঁহার পৃষ্ঠে ও মস্তকে নানাপ্রকার অপ্রীতিকর বস্তু বর্ষিত হইতে থাকে। এই তো সেদিন, নিতান্ত অকারণেই নিতাইবাবুকে অশেষ লাঞ্ছনা নির্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছে।

এ ব্যাপারে তাঁহার বিন্দুমাত্র দোষ ছিল না; এমন কি, কেমন করিয়া কি হইল, সে বিষয়ে একটা ধোঁকার ভাব তাঁহার মনে রহিয়া গিয়াছিল। বিন্দু ছাদের উপর খেলাঘর পাতিয়াছিল, সেদিন তাহার খেলাঘরে চড়ুইভাতি ছিল। বিন্দু ব্যস্তসমস্তভাবে রান্নার যোগাড় করিতে করিতে গলার হারছড়া ছাদে ফেলিয়াই নীচে নামিয়া গিয়াছিল। এই সুযোগে নিতাইবাবু নেহাৎ পরিহাসচ্ছলেই হারটা গুড়ের বাটিতে ডুবাইয়া আবার যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া প্রস্থান করিয়াছিলেন। তাঁহার মনে কোনও দুরভিসন্ধি ছিল না; কেবল ইহাই উদ্দেশ্য ছিল যে, গুড়ের লোভে হারে পিঁপড়া লাগিবে এবং তারপর বিন্দু যখন না দেখিয়া আবার সেটা গলায় দিবে তখন একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য অভিনয় ঘটিয়া যাইবে।

অভিনয় কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত রকমের হইল। কিয়ৎকাল পরে বিন্দু চিৎকার করিতে করিতে নামিয়া আসিয়া খবর দিল যে, নিতাই তাহার হার লইয়া পলাইয়াছে। নিতাইবাবুকে ধরিয়া আনা হইল, কিন্তু তিনি সবেগে মাথা নাড়িয়া অভিযোগ অস্বীকার করিলেন। গুড়মাখানোর কথাটাও অবস্থাগতিক দেখিয়া চাপিয়া যাইতে হইল। কিন্তু তাঁহার কথা কেহই বিশ্বাস করিল না। কাকা কর্ণে প্যাঁচ দিয়া বলিলেন, ‘কোথায় রেখেছিস নিয়ে আয়, তাহলে কিছু বলব না।’

কিন্তু যে-জিনিসের সন্ধান জানা নাই তাহা কি করিয়া আনা যাইতে পারে। নিতাইবাবু হার আনিতে পারিলেন না। কানুটি চড়ে উঠিল। তথাপি হার বাহির হইল না। তখন কাকা বেত আনিয়া নিতাইবাবুর পৃষ্ঠ ও নিকটবর্তী আর একটা স্থান রক্তবর্ণ করিয়া দিলেন। নিতাইবাবুর মনে হইতে লাগিল যে ইন্দ্রজাল-প্রভাবে যদি একটা সোনার হার তৈয়ার করিয়া আনিয়া দিতে পারিতেন তাহা হইলে দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহাই করিতেন। কিন্তু ভোজবিদ্যায় পারদর্শিতা না থাকায় তাঁহাকে কেবল পড়িয়া পড়িয়া মার খাইতে হইল।

কাকা অবশেষে ক্লান্ত হইয়া ছাড়িয়া দিয়া বলিলেন, ‘বড় হয়ে এটা দাগী চোর হবে—একেবারে সি ক্লাস। নিয়ে যা আমার সুমুখ থেকে।’

ইহা দশ-বার দিন আগের ঘটনা। তারপর বিন্দু তাঁহাকে অনেক খোসামোদ করিয়াছে, কিন্তু অত মার খাইবার পর যে সকল নষ্টের গোড়া তাহার সহিত এক কথায় সদ্ভাব স্থাপন করা চলে না; নিতাইবাবু গর্বিতভাবে বিন্দুর সন্ধির প্রয়াস প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন এবং হার সম্বন্ধে একটা গভীর রহস্যময় নীরবতা অবলম্বন করিতেছেন। ইহার কয়েক দিন পরেই সামান্য বিষয় লইয়া কাল রাত্রে আবার বিন্দুর সহিত ঝগড়া বাধিয়া গেল। নিতাইবাবু তাঁহার সঞ্চিত ক্রোধ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিয়া কাঁচির সাহায্যে বিন্দুর খোঁপা নির্মূল করিয়া দিলেন।

গাছের ডালে ঠেসান দিয়া বসিয়া পা দুলাইতে দুলাইতে বিন্দুর লুপ্তবেণী মস্তকটির কথা স্মরণ হইতেই নিতাইবাবুর শুষ্ক মুখে একটু হাসি দেখা দিল। আর যাহাই হোক, বিন্দুকে দস্তুরমত জব্দ করা হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। এখন অন্তত ছয় মাসের জন্য নিশ্চিন্ত—বিন্দু খোঁপা বাঁধিতে পারিবে না। নাঃ—বেড়া বিনুনিও নয়। খোঁপার জায়গাটায় মাংস বাহির হইয়া গিয়াছে।

কিন্তু এই আনন্দ অধিকক্ষণ স্থায়ী হইল না, জঠরের বৃশ্চিকদংশন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। নিতাইবাবু ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। একটা কাঠবেড়ালী অনেকক্ষণ হইতে পাশের একটা ডাল দিয়া ওঠানামা করিতেছিল, চোখে পড়িলেও নিতাইবাবু ভাল করিয়া লক্ষ্য করেন নাই। কাঠবিড়ালীটা দ্রুতপদে যাতায়াত করিতে করিতে তাঁহার কাছাকাছি আসিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িতেছিল, কালো কালো পেঁপের বিচির মতো চোখ দিয়া তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া কিচিমিচি শব্দে মন্তব্য প্রকাশ করিতে করিতে চলিয়া যাইতেছিল। নিতাইবাবু এখন তাহার গতিবিধি চক্ষু দ্বারা অনুসরণ করিতে লাগিলেন। তিনি দেখিলেন, কাঠবিড়ালী প্রত্যেক বার নীচে হইতে উপরে আসিবার সময় একটি ছোট্ট ফল মুখে করিয়া আনিতেছে এবং সেটিকে একটি কোটরের মধ্যে রাখিয়া আবার ফিরিয়া যাইতেছে।

ক্ষুধার সহিত কৌতুহল যোগ দিয়া নিতাইবাবুকে স্থির থাকিতে দিল না। তিনি ধীরে ধীরে নিজের শাখা হইতে নামিয়া আসিয়া যে-শাখায় কাঠবিড়ালীর কোটর ছিল সেই শাখায় উঠিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি কোটরের কাছাকাছি পৌঁছিতে না পৌছিতে কাঠবিড়ালী তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া উত্তেজিতভাবে কিচিমিচি করিয়া উঠিল; নিতাইবাবু তবু উঠিতে লাগিলেন। কাঠবিড়ালী তখন বেগতিক দেখিয়া কোটর ছাড়িয়া পলায়ন করিল এবং বহু ঊর্ধ্বে একটা সরু ডালে বসিয়া অবিশ্রাম নিতাইবাবুকে গালাগালি দিতে লাগিল।

নিতাইবাবু তাহার সমস্ত তিরস্কার অগ্রাহ্য করিয়া কোটরের সম্মুখে শাখার দুই দিকে পা ঝুলাইয়া বসিলেন, কোটরে উঁকি মারিয়া দেখিলেন অন্ধকার, কিছু দেখিতে পাইলেন না। মারের ভয় ছাড়া অন্য কোনও ভয় নিতাইবাবুর শরীরে ছিল না, তিনি স্বচ্ছন্দে সেই অন্ধকার গর্তের মধ্যে হাত ঢুকাইয়া দিলেন। উপরে কাঠবিড়ালীর চেঁচামেচি ও গালিগালাজ আরও তীব্র হইয়া উঠিল।

কনুই পর্যন্ত হাত প্রবিষ্ট করাইয়া দিয়া নিতাইবাবু অনুভব করিলেন যে, তিনি কাঠবিড়ালীর বাসায় পৌঁছিয়াছেন, তুলার মতো নরম তুলতুলে একটি স্থান তাঁহার হাতে ঠেকিল। হাতড়াইতে হাতড়াইতে তিনি দেখিলেন, সেই নরম স্থানটিতে কাঠবিড়ালী তাহার রসদ সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছে। তিনি আর দ্বিধা না করিয়া এক খাম্‌চায় যতখানি পারিলেন সেই রসদ বাহির করিয়া আনিলেন।

কাঠবিড়ালী অতিশয় হিসাবী জন্তু। সন্তানসন্ততি এখনও জন্মগ্রহণ করে নাই, বর্ষাকাল আসিতেও অনেক দেরি আছে, ইহারই মধ্যে সে ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবিয়া অনাগত দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে। নিতাইবাবু কোলের কাপড়ের উপর শুষ্ক ফলগুলি ঢালিয়া একে একে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। বেশীর ভাগই ছোট ছোট শুকনা ডুমুর, করমচা ও আরও কয়েক প্রকারের নামগোত্রহীন জংলী ফল। তাছাড়া কয়েকটা চীনাবাদাম, ছোলা ও কড়াইয়ের দানা পাওয়া গেল। সেগুলি নিতাইবাবু প্রাপ্তিমাত্র উদরসাৎ করিলেন। দু-তিনটা পুরাতন কাঁঠালবিচি ও হরীতকী ছিল, সেগুলি নিতাইবাবু একবার কামড়াইয়া থু থু করিয়া ফেলিয়া দিলেন। অখাদ্য।

কোটর হইতে আর এক খাব্‌লা বাহির করিয়া তিনি ক্ষুধিতভাবে পরীক্ষা করিলেন, কিন্তু আর চীনাবাদাম কিংবা ছোলা পাওয়া গেল না। তাহার পরিবর্তে তিনি একটি হারানো জিনিস ফিরিয়া পাইলেন। কয়েকদিন পূর্বে তাঁহার একটি কাচের রঙ্‌চঙা মার্বেল হারাইয়া গিয়াছিল, সেটি রহিয়াছে দেখিলেন। নিতাইবাবু সেটি সযত্নে পকেটে পুরিলেন।

কাঠবিড়ালীটা তখনও উর্ধ্বে থাকিয়া তর্জন-গর্জন ও লাফালাফি করিতেছিল, একটা কাঁঠালবিচি তাহার উদ্দেশ্যে ছুঁড়িয়া মারিয়া নিতাইবাবু বলিলেন, ‘চোর কোথাকার।’ শব্দভেদী যুদ্ধে ক্রমশ অস্ত্রশস্ত্রের আমদানী হইতেছে দেখিয়া কাঠবিড়ালী রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করিল।

বিমর্ষভাবে আবার নিতাইবাবু স্বস্থানে ফিরিয়া আসিয়া বসিলেন। অপ্রচুর ইন্ধনে তাঁহার জঠরের অগ্নি আবার দ্বিগুণ বেগে জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। তিনি শাখায় হেলান দিয়া ঊর্ধ্বমুখে ভাবিতে লাগিলেন, এখন আত্মসমর্পণ করিলে মারের মাত্রা কিছু কমিবে কি-না? বেলা দুইটা বাজিয়া গিয়াছে, সূর্যদেব মাথার উপর হইতে পাশে ঢলিয়া পড়িয়াছেন; গাছের ছায়া বৃক্ষতল ছাড়িয়া সরিতে আরম্ভ করিয়াছে। নিতাইবাবু বিবেচনা করিয়া দেখিলেন, এখন বাড়ি ফিরিলে হয়তো অল্পের উপর দিয়া ফাঁড়াটা কাটিয়া যাইতে পারে। এত বেলা পর্যন্ত অভুক্ত থাকার পর মা ও ঠাকুরমা নিশ্চয় তাঁহাকে রক্ষা করিবেন, হয়তো প্রত্যাবর্তনের সংবাদ কাকার কানে না-উঠিতেও পারে। কিন্তু ওদিকে প্রতিহিংসাপরায়ণা বিন্দি আছে—সে ছাড়িবে না, নিশ্চয় কাকাকে খবর দিবে। তখন কি হইবে?

নিতাইবাবু গভীর নিশ্বাস মোচন করিলেন। এ অবস্থায় কি করা যায়।

হঠাৎ বাড়ি হইতে উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনিয়া নিতাইবাবু ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলেন। কান খাড়া করিয়া শুনিলেন দরোয়ান গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড়াইয়া বলিতেছে, ‘ক্যঁহি নহি মিলা হুজুর। খোকাবাবু বিলকুল লা-পতা হো গয়ে।’

কাকাকে দেখা গেল না, কিন্তু তাঁহার ভারী গলার আওয়াজ শোনা গেল, ‘ক্যা বেওকুফ্‌কা মাফিক বোল্‌তা হ্যয়। লা-পতা হোকে কাঁহা যায়েঙ্গে? জরুর কঁহি ছিপে হয়ে হ্যঁয়। মহল্লামে দেখা?’

‘জী হুজুর।’

‘যাও, ফির্‌ আচ্ছি তরহসে খোজো।’

গাছের উপর নিতাইবাবু নিজমনে দাঁত খিঁচাইয়া হাসিলেন। এই দুপুর রৌদ্রে দরোয়ানটা তাঁহাকে মিছামিছি চারিদিক খুঁজিয়া বেড়াইতেছে অথচ তিনি হাতের কাছেই রহিয়াছেন, ভাবিতে বড় মধুর লাগিল। তিনি দেখিলেন, বিষন্ন ও বিরক্ত দরোয়ান আবার লাঠি হাতে বাহির হইতেছে।

বাড়ির ফটক হইতে বাহির হইয়া দরোয়ান নিতাইবাবুর গাছের ছায়ায় আসিয়া দাঁড়াইল। নাগরা জুতা খুলিয়া ভিতরের ধূলা ঝাড়িয়া আবার পরিধান করিল, পাগড়ির পুচ্ছ দিয়া মুখের ঘাম মুছিল, তারপর অর্ধস্ফুট স্বরে কি বলিতে বলিতে প্রস্থান করিল।

নিতাইবাবুর একবার ইচ্ছা হইল, দরোয়ানের মাথায় একটা কাঁঠালবিচি কিংবা ঐ প্রকার কোনও দ্রব্য ফেলিয়া নিজের স্থিতিস্থান প্রকাশ করিয়া দেন। কিন্তু তিনি সে লোভ সংবরণ করিলেন। এত শীঘ্র আত্মপ্রকাশ করিলে চলিবে না। যদিও পেটের মধ্যে নেংটি ইঁদুর সবেগে ডন্‌ ফেলিতেছে, তথাপি ধৈর্য ধারণ করিতে হইবে। এখনও সময় উপস্থিত হয় নাই।

দরোয়ান চলিয়া যাইবার কিয়ৎকাল পরে নিতাইবাবু দেখিলেন, ঠাকুরমা বাড়ির ছাদের উপর উঠিয়া আলিসার ধারে দাঁড়াইয়া উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক চাহিতেছেন। নিতাইবাবুর মুখ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, উৎসাহে তাঁহার মুখ দিয়া প্রায় বাহির হইয়া গেল—‘ঠাকুমা, এই যে আমি এখানে।’ কিন্তু ‘ঠা—’ পর্যন্ত বাহির হইতে-না-হইতে তিনি সবলে দাঁত দিয়া জিব কাটিয়া ধরিলেন। সর্বনাশ! আর একটু হইলেই সব ফাঁস হইয়া গিয়াছিল!

ঠাকুরমা কিছুক্ষণ নিতাইবাবুর দর্শনাশায় ছাদের এদিক-ওদিক হইতে ব্যাকুলভাবে উকি মারিয়া অবশেষে নীচে নামিয়া গেলেন। যতক্ষণ দেখা গেল, নিতাইবাবু সতৃষ্ণনয়নে সেইদিকে তাকাইয়া রহিলেন। তারপর আবার ধীরে ধীরে ঠেসান দিয়া শুইলেন।

বাড়িতে যে বেশ একটা সাড়া পড়িয়া গিয়াছে তাহার নিদর্শন মাঝে মাঝে পাওয়া যাইতেছিল। ঝি-চাকরগুলা অনবরত ভিতর-বার করিতেছিল। কাকা জলদগম্ভীর স্বরে মধ্যে মধ্যে তাহাদের ধমকাইতেছিলেন; একবার ঠাকুরমার সঙ্গে কাকার কথা-কাটাকাটি হইল—সে আওয়াজও অস্পষ্টভাবে নিতাইবাবুর কানে পৌঁছিল। শেষে বেলা চারটা বাজিয়া গেল তখন কাকা স্বয়ং খোঁজ করিতে বাহির হইলেন। নিতাইবাবু উপর হইতে গলা বাড়াইয়া তাঁহার ভ্রূকুঞ্চিত উদ্বিগ্ন মুখ দেখিয়া মনে মনে বেশ তৃপ্তি অনুভব করিলেন, আশা হইল আরও কিছুক্ষণ এইভাবে অজ্ঞাতবাস চালাইতে পারিলে হয়তো প্রহারের পালাটা একেবারে বাদ পড়িতেও পারে।

তিনি পুনশ্চ কোমরের কসি টান করিয়া দিয়া, চক্ষু মুদিয়া পা দুলাইতে লাগিলেন। শরীর কিছু নির্জীব হইয়া পড়িয়াছিল, মাথার উপর মৌচাক হইতে মৌমাছিদের একটানা গুঞ্জন শুনিতে শুনিতে ক্রমে তাঁহার ঈষৎ তন্দ্রাকর্ষণ হইল।

তন্দ্রার ঘোরে তিনি দেখিতেছিলেন, কোনও অভাবনীয় উপায়ে একটা জীবন্ত কাঠবিড়ালী তিনি গলাধঃকরণ করিয়া ফেলিয়াছেন, সেটা পেটের মধ্যে গিয়া নখ দিয়া তাঁহার অভ্যন্তরভাগ আঁচড়াইতেছে ও তাঁহাকে বাপান্ত করিতেছে। এইরূপ বিপন্ন অবস্থায় নিতাইবাবু ছুটিতে ছুটিতে ঠাকুরমার কাছে গিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘ঠাক্‌মা, বড্ড খিদে পেয়েছে!’ ঠাকুরমা তাঁহাকে কোলে লইয়া বসিতেই কাঠবিড়ালীটা তাঁহার দক্ষিণ কর্ণের ছিদ্রপথ দিয়া বাহির হইয়া গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্নব্যঞ্জনপূর্ণ থালা কোথা হইতে সম্মুখে উপস্থিত হইল। নিতাইবাবু ভারী আনন্দিত হইলেন। শত্রুপক্ষ কেহ কাছে নাই; ঠাকুরমা সযত্নে অন্নব্যঞ্জন মাখিয়া নিতাইবাবুর ব্যাদিত মুখে গ্রাস দিতে যাইতেছেন এমন সময় নীচে হইতে কর্কশ গলার আওয়াজে তাঁহার চেতনা ফিরিয়া আসিল।

নিতাইবাবু চক্ষু মেলিয়া দেখিলেন, সূর্য একেবারে পশ্চিম দিগন্তরেখা স্পর্শ করিয়াছে এবং তাহার তির্যক্‌ রশ্মিতে যে ডালে তিনি ছিলেন তাহা আগাগোড়া আলোকিত হইয়াছে।

নীচে দৃষ্টিপাত করিলেন, দরোয়ান ও বাড়ির একটা ঝি দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছে দৃষ্টিগোচর হইল।

দরোয়ান বলিল, ‘ঐসা বিচ্ছু লড়কা কভি নেই দেখা। দেখো তো, সবেরে উঠ্‌কে ভাগা আভিতক্‌ পতা নই! খোজ্‌তে খোজ্‌তে হামরা নাকমে দম আ গিয়া, দিনভর খানা পিনা কুছ নহি—’

ঝি বলিল, ‘সত্যি বাপু, অমন ছেলেও দেখিনি কখনও—গিন্নিমা সমস্ত দিন মুখে জল পর্যন্ত দেননি,—বিন্দুদিদি তো কেঁদেকেটে শুয়ে আছে। আচ্ছা, কি বজ্জাত ছেলে বল দিকিন্‌ দরোয়ানজী, খোঁপাটি মুড়িয়ে কেটে দিলে গা? একটু মায়া হল না? না বাপু, ও ছেলের রকম-সকম মোটে ভাল নয়, যত বয়স বাড়ছে ততই যেন—’

দরোয়ান তিক্ত স্বরে বলিল, ‘আরে দাই, হম্ বোল্‌তে হেঁ, তুম খেয়াল রাখনা, ই লড়কা বড়া হোকে ডাকু বনেগা—বম্‌ গোলা ছোড়েগা! ইয়াদ হ্যয়? উস্‌-দিন রাত আঠ বজে চারপাই পর শো কর হমারা থোড়া নিদ্‌ আ গিয়া থা। লোণ্ডা কিয়া কা—চুপসে হমারা টিক্‌মে ডোরি বাহ্ন্‌কে চারপাইকা পায়াসে বাহ্ন্‌ দিয়া। উস্‌কো বাদ ছোটে ভইয়াকো যাকে খবর দে দিয়া। ব্যস, ছোটে ভইয়া জোরসে ফুকারিন, হম্‌ভি হড়বড়াকে উঠা—’

সহানুভূতিপূর্ণ স্বরে ঝি বলিল, ‘আহা মরে যাই। হেঁচকি লেগে টিকি তো তোমার সেদিন প্রায় উপড়ে গিয়েছিল। তারপর ছোটবাবু কত মারলেন, মার তো লেগেই আছে—কিন্তু তবু কি বজ্জাতি কমে—’

দরোয়ান বলিল, ‘লড়কা না লড়কেকা দুম্‌! ছোটে ভইয়াকা মার সে কুছ নেহি হোগা, হমকে একদফি সরকারসে হুকুম মিল যায়, হম্‌ ডান্ডাসে লৌণ্ডেকা বদমাসি নিকাল দেঁ—’

লৌণ্ডা! লড়কেকা দুম্! এ পর্যন্ত নিতাইবাবু কোনও রকমে সহ্য করিয়া ছিলেন, কিন্তু আর পারিলেন না। সক্রোধে পকেট হইতে সেই পুনঃপ্রাপ্ত মার্বেলটা বাহির করিয়া দরোয়ানের মাথা লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িয়া মারিলেন।

নিতাইবাবুর লক্ষ্য ব্যর্থ হইবার নয়, মার্বেল দরোয়ানের পাগড়ির মধ্যস্থিত মুক্ত স্থানটিতে আসিয়া লাগিল, খট্‌ করিয়া একটি শব্দ হইল। দরোয়ান শুন্যে প্রায় চার হাত লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘বাপ রে! জান গিয়া!’ তারপর উর্ধ্বে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া উত্তেজিত রাসভের মতো চিৎকার করিতে লাগিল, ‘উয়হ্‌ বৈঠা! পকড়া হ্যায়! ছোটে ভৈয়া জলদি আইয়ে, খোখাবাবু পেঁড় পর বৈঠা হ্যায়! হমারা শির ফোড় দিয়া! জল্‌দি আইয়ে—পকড়া হ্যায়!’

ঝি বৃক্ষাসীন নিতাইবাবুর হিংস্র মূর্তি দেখিয়াই জিব কাটিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল।

দেখিতে দেখিতে চক্ষের নিমেষে বাড়িতে যে যেখানে ছিল আসিয়া বৃক্ষতলে জমা হইল, বাবা কাকা হইতে আরম্ভ করিয়া বাড়ির দেড় বছরের ছেলেটা পর্যন্ত কেহই বাদ গেল না। নিতাইবাবু দেখিলেন, মুহূর্তের অবিমৃষ্যকারিতার ফলে তাঁহার পলায়নের পথ একেবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। তিনি ডালের উপর আর এক ধাপ উঠিয়া বসিলেন।

কাকা হাতের চাবুক আস্ফালন করিয়া বলিলেন, ‘নেমে আয়।’

নিতাইবাবু মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘নামব না।’

কাকা রুদ্র কণ্ঠে কহিলেন, ‘শিগ্‌গির নেমে আয় বলছি হনুমানের বা—’ বলিয়াই থামিয়া গেলেন। বাবা মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিলেন।

নিতাইবাবু বলিলেন, ‘আগে বল মারবে না, তবে নামব।’

‘মারব না? তোকে আজ জ্যান্ত মাটিতে পুঁতব। নাম্‌ শিগ্‌গির।’

‘তবে নামব না।’

‘নাম্‌বি না? আচ্ছা, দাঁড়া তবে। এই বুদ্ধু সিং, গাছ পর চহ্‌ড়ো, কান পকড়কে উস্‌কো উতার লে আও!’

নিতাইবাবুর কান পাকড়িয়া নামাইয়া আনিবার প্রস্তাবটা খুব মুখরোচক হইলেও বুদ্ধু সিং দরোয়ানের তাদৃশ উৎসাহ দেখা গেল না। তাহার মস্তকের কেশবিরল মধ্যস্থলটি সুপারির মতো ফুলিয়া উঠিয়াছিল, সে উর্ধ্বে একটি বক্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া ক্ষীণভাবে বলিল, ‘জী হুজুর।’

নাগরা ও পাগড়ি খুলিয়া রাখিয়া দরোয়ান গাছে চড়িতে প্রবৃত্ত হইল। নিতাইবাবু প্রমাদ গণিলেন। এবার তো আর রক্ষা নাই।

হঠাৎ তাঁহার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলিয়া গেল। তিনি উপর দিকে উঠিতে উঠিতে বলিলেন, ‘বুদ্ধু সিং, হামারা পাস আওগে ত হাম্‌ভি এই চাক্‌মে খোঁচা দেঙ্গে। তুম্‌ হাম্‌কো লৌণ্ডা বোল্‌কে গালি দিয়া থা—হাম্‌ভি তুমকো মজা দেখাবেঙ্গে।’—বলিয়া মাথার ইঙ্গিতে প্রকাণ্ড চাকটা দেখাইলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেই বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া গেলেন।

দরোয়ান খানিকটা দূর উঠিয়াছিল, পিছলাইয়া নামিয়া আসিল; বলিল, ‘হম্‌সে নেহি হোগা হুজুর! মধ্‌মচ্ছিকা খোঁতা হ্যায়—জান্‌ চলা যাগা।’

এই ক্ষুদ্র বালকের কূটবুদ্ধি দেখিয়া সকলে স্তম্ভিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিলেন।

ওদিকে নিতাইবাবুও স্তম্ভিত হইয়া মৌচাকের দিকে তাকাইয়া ছিলেন। এমন অভাবনীয় ব্যাপার যে ঘটিতে পারে তাহা কল্পনা করাও দুষ্কর। অস্তমান সূর্যের আলো পাতার ফাঁক দিয়া মৌচাকের উপর পড়িয়াছিল, মক্ষিকাপূর্ণ চাকটা অভ্রের মতো আলোক প্রতিফলিত করিতেছিল। নিতাইবাবু বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে দেখিলেন, ঠিক তাহারই এক হাত দূরে স্কুল শাখার রুক্ষ গায়ে আটকাইয়া ঝুলিতেছে—বিন্দুর সেই হারানো সোনার হার! সোনার উপর সূর্যকিরণ পড়িয়া চিক্‌চিক্ করিতেছে, চিনিতে নিতাইবাবুর এক মুহূর্তও বিলম্ব হইল না। ইহা সেই হার যাহা তিনি কয়েকদিন পূর্বে গুড়ের বাটিতে ডুবাইয়া মাধুর্যমণ্ডিত করিয়া দিয়াছিলেন। এতক্ষণ কেবল ওই স্থানটা অন্ধকার ছিল বলিয়াই উহা চোখে পড়ে নাই।

কাঠবিড়ালী, কাক, পিপীলিকা প্রভৃতি ইতরপ্রাণীর আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে নিতাইবাবুর প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা ছিল, সুতরাং কি করিয়া হারছড়া বৃক্ষের উচ্চ শাখায় আসিয়া দোদুল্যমান হইল তাহা অনুমান করিতে তাঁহার কষ্ট হইল না। তিনি বুঝিলেন মিষ্টান্নলুব্ধ কোনও ইতরপ্রাণীই এই কুকার্য করিয়াছে।

বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা সামলাইয়া লইয়া নিতাইবাবু বিজয়োল্লাসে হাস্য করিলেন; আজিকার যুদ্ধে এরূপভাবে ঘেরাও হইয়াও অবশ্যম্ভাবী পরাজয়কে তিনি যে অচিরাৎ সম্মানসূচক সন্ধিতে পরিণত করিতে পারিবেন তাহাতে আর সংশয় রহিল না।

নিম্নাভিমুখে তাকাইয়া তিনি বলিলেন, ‘একটা জিনিস পেয়েছি, বল্‌ব না।’

কাকা কথায় ভুলিবার লোক নয়, তিনি বলিলেন, ‘বটে? জিনিস পেয়েছ! আচ্ছা, আগে গাছ থেকে নেমে এস তো দেখি।’

‘আগে বল মারবে না।’

বাবা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি জিনিস পেয়েছিস?’

একটু ইতস্তত করিয়া নিতাইবাবু বলিলেন, ‘বিন্দির হার।’

বিন্দু উপস্থিত ছিল, শুনিবামাত্র সে চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘আমার হার! ও কাকা, শিগ্‌গির আমার হার দিতে বল।’

কাকা প্রশ্ন করিলেন, ‘হার কোথায় পেলি?’

‘বল্‌ব না। আগে বল মারবে না।’

কাকা বিবেচনা করিয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, কম মারব। তুই হার নিয়ে নেমে আয়।’

‘তবে নামব না। হারও দোব না।’

বিন্দু বলিল, ‘ও কাকা—’

কাকা ও বাবা নিম্নস্বরে পরামর্শ করিলেন, তারপর কাকা দুঃখিতভাবে বলিলেন, ‘আচ্ছা আয়, মারব না।’

নিতাইবাবুর সন্দেহ হইল ইহার মধ্যে আইনের ফাঁকি আছে, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘থাপ্‌পড়?’

‘না-থাপ্‌পড়ও মারব না।’

‘কানমলা?’

‘না।’

‘আচ্ছা, তবে যাচ্ছি।’

‘হার নিয়ে আস্‌বি, তা না হলে—’

সন্ধির শর্ত রীতিমত পাকা করিয়া লইয়া নিতাইবাবু হারটি উদ্ধারের চেষ্টায় যত্নবান হইলেন। সূর্যাস্ত হইয়া গিয়াছিল, অতএব মৌমাছির দিক হইতে আশঙ্কার বিশেষ কারণ ছিল না। নিতাইবাবু গুটি গুটি অতি সাবধানে মৌচাকের নিকটবর্তী হইলেন। মৌমাছি জাতিটা অতিশয় স্নায়ুপ্রধান, একটুতেই চটিয়া যায়, ইহা নিতাইবাবুর জানা ছিল; তিনি একটি চক্ষু চাকের উপর নিবদ্ধ রাখিয়া হারের দিকে অগ্রসর হইলেন। নীচে যাহারা ছিল তাহারা বিশ হাত ঊর্ধ্বে হারটি দেখিতে পায় নাই, কেবল এই দুঃসাহসিক বালকের গতিবিধির দিকে চাহিয়া নিস্পন্দ হইয়া রহিল।

চাক নিস্তব্ধ, মৌমাছিদের বোধ করি তন্দ্রা আসিয়াছে। নিতাইবাবু হারের নাগালে আসিয়া আস্তে আস্তে হাত বাড়াইলেন। ভোঁ—! একটা ক্রুদ্ধ গুঞ্জন উঠিল। কয়েকটা মৌমাছি চাক হইতে উড়িয়া একবার পরিক্রম করিয়া আবার চাকে গিয়া বসিল। নিতাইবাবু বিদ্যুদ্বেগে হাত টানিয়া লইয়াছিলেন, কিছুক্ষণ নিশ্চল মূর্তির মতো বসিয়া রহিলেন।

আবার চাক নিস্তব্ধ—মৌমাছিরা নিশ্চয় নিদ্রালু। নিতাইবাবু পুনরায় ধীরে ধীরে হাত বাড়াইলেন। হারটা গাছের কর্কশ ত্বক হইতে ছাড়াইতে একটু শব্দ হইল—অমনি ভন্‌ন! তিনটা মৌমাছি তাঁহাকে আক্রমণ করিল। একটা ঠিক নাকের ডগায় হুল ফুটাইয়া দিল, অন্য দু’টা দুই গণ্ডে দংশন করিয়া আবার ফিরিয়া গিয়া চাকে বসিল।

নিতাইবাবুর নাসিকা ও গণ্ডদ্বয় আগুনের মতো জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু তিনি নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মতো বসিয়া রহিলেন। একটু নড়িলে যে আত্মরক্ষার আর কোন উপায় থাকিবে না, চাক হইতে কোটি কোটি অর্বুদ অর্বুদ মৌমাছি আসিয়া তাঁহাকে গ্রাস করিয়া ফেলিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। নেহাৎ সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে বলিয়াই ইহারা সদলবলে বাহির হইতেছে না কিন্তু আর বেশি ঘাটাইলে সন্ধ্যার দোহাই মানিবে না। তখন তাদের হুলের জ্বালায় না হোক এই বিশ হাত উচ্চ হইতে মাটিতে পড়িলে মৃত্যু অনিবার্য। অপরিসীম সহিষ্ণুতা সহকারে নিতাইবাবু আরও দু’ মিনিট সেইভাবে বসিয়া রহিলেন। তারপর চাক যখন একেবারে নিঃশব্দ হইয়া গেল তখন তিল তিল করিয়া পিছু হটিয়া নামিতে আরম্ভ করিলেন।

পাঁচ মিনিট পরে, অন্ধকারপ্রায় বৃক্ষতলে নিতাইবাবু যখন নামিয়া আসিয়া দাঁড়াইলেন, তখন তাঁহার মুখ দেখিয়া বাবা এবং কাকা চমকিয়া একসঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, ‘এ কি! এ আবার কে?’

নিতাইবাবুর নাসিকা ও গলা দু’টি এরূপ বিপর্যয় ফুলিয়া উঠিয়াছিল যে, উপস্থিত কেহই তাঁহাকে চিনিতে পারিল না।

রাত্রে বিছানায় শয়ন করিয়া দুই ভাইবোনে কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল, তারপর বিন্দু আস্তে আস্তে বলিল, ‘নিতাই, বড্ড ব্যথা করছে—না রে?’

নিতাইবাবু বলিলেন, ‘হুঁ।’

বিন্দুর মনে আর রাগ ছিল না, সে বিগলিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘নাকে একটু হাত বুলিয়ে দেব ভাই?’

নিতাইবাবুর নাকটি মাঝারি-গোছের শাঁকআলুর আকার ধারণ করিয়াছিল, গণ্ডের স্ফীতিবশত চোখ দু’টিও প্রায় বুজিয়া গিয়াছিল; তিনি ক্রন্দনের প্রবল আবেগে ঢোক গিলিয়া বলিলেন, ‘হুঁ।’

বিন্দু তাঁহাকে জড়াইয়া লইয়া সযত্নে নাকে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে বলিল, ‘কেন ভাই, তুই আমার চুল কেটে নিলি? তাই তো ভগবান রাগ করে তোর নাক অমন করে দিলেন।’

অনুতপ্তভাবে নিতাইবাবু বলিলেন, ‘আর করব না।’

মানুষকে বুদ্ধিবলে পরাস্ত করিলেও দৈবী প্রতিহিংসার হাত হইতে নিস্তার পাওয়া যে অসম্ভব তাহা নিতাইবাবুর হৃদয়ঙ্গম হইয়াছিল।

বিন্দু সস্নেহে তাঁহার স্ফীত রক্তিম গণ্ডে একটি চুম্বন করিয়া বলিল, ‘লক্ষ্মী ভাই, আর কখ্‌খনো করিসনি।’

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া নিতাইবাবু বলিলেন, ‘দিদি, তোর চুল আবার গজাবে।’

চুলের কথা নূতন করিয়া স্মরণ হইতেই দিদির দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল, কিন্তু সে উদ্গত অশ্রু গিলিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ। তোর নাকও আবার ঠিক হয়ে যাবে, এবার ঘুমো।’

তারপর দুই ভ্রাতা-ভগিনী নিবিড়ভাবে পরস্পরের গলা জড়াইয়া ঘুমাইয়া পড়িল।

১২ চৈত্র ১৩৩৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *